দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতন ॥
এ যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পাকড়াও
ভদ্রলোক একটু দ্রুতই হেঁটে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে ‘হাই’ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেনÑ স্মার্ট এক যুবক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বিক্রি করছেন। মুখ ফেরাতেই বলে উঠলেন, হাসিনা বাই (বিদায় হাসিনা)। লোকটির মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, শয়তান বাই। সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি ‘শয়তান বাই’, ‘শয়তান বাই’ বলে লাফানো শুরু করলেন। একজন ভিনদেশী স্বৈরশাসকের বিদায়ে সাধারণ একজন লোকের এমন উচ্ছ্বাস ছিল অনুভব করার মতো। শুধু ফুটপাতের ওই বিক্রেতাই নয়, বরং পথচারী লোকটির ওই শহরে কয়েকদিনের সফরে বিভিন্ন দেশের আরো বেশ কয়েকজন লোকের সাথে কথা হয়েছে। প্রবাসী বাঙালিরা তো রয়েছেনই। তাদের খুশি ও আনন্দের মাত্রা তো ভিন্ন রকম ছিল। কিন্তু বিদেশীরাও যে শেখ হাসিনার বিদায়ে এত আনন্দ এত আকর্ষণ বোধ করেছে, তা না দেখলে বোঝা যেত না। আজকের লেখার মূল কথায় যাওয়ার আগে আমরা এদিকে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই।
বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের বিগত দিনের অধিকাংশ শাসকদের এমন কোনো বিশেষ অবস্থান বিশ্ব দরবারে ছিল না, যার দরুন মানুষ এ দেশকে খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখবে। এর ওপর দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে জেঁকে বসা স্বৈরশাসন, জুলুমবাজি ও মহাদুর্নীতি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একজন দুষ্ট লোকের বিদায়ে একটি দেশ এবং সে দেশের জনগণের সম্মান ও ভাবমূর্তি বিদেশীদের কাছে রাতারাতি এত ওপরে উঠতে পারেÑ তা ছিল কল্পনাতীত। ভাবমূর্তির কথা বললেই মনে পড়ে, বিগত দিনগুলোতে এদেশে সরকার বা সরকার প্রধানের কোনো কুকর্মের সমালোচনাকে ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে’ বলে কত লোককেই না জেল-জুলুম ও গুমের শিকার হতে হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তৎকালীন সর্বোচ্চ বিচারকেরাও এ ভাবমূর্তির নামে সমালোচকদের শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। অথচ ভাবমূর্তি কাকে বলে- তা এখন কেউ দেশের বাইরে গেলে বুঝতে পারবে। বিদেশী সংবাদমাধ্যম ঘাঁটাঘাঁটি করলেও নজরে আসবে। ৫ ও ৬ আগস্টের বিদেশী বড় বড় সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন খবর ও প্রতিবেদনের দিকে নজর দিলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
যাক, এ তো হল সংবাদমাধ্যমের কথা। কিন্তু বিদেশের সাধারণ জনগণের এত উচ্ছ্বাসের কারণ কী? বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি দেখলেই বুঝে আসবে, এগুলো আসলে মজলুমের মুখের হাসি। পৃথিবীব্যাপী যেখানেই জালেম বা স্বৈরশাসক মানুষের ওপর জেঁকে বসে, বিশ্বায়নের এ যুগে সে খবর পুরো পৃথিবীতে পৌঁছে যায়। আবার অনেক দেশেই সাধারণ লোকজন নিজ দেশের ক্ষমতাবান জালেমদের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। তাই কোনো এক অঞ্চল থেকে যদি একজন জালেমের পতনের খবর আসে তখন সেটি শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের লোকজনের আনন্দের বিষয় থাকে না, বরং পুরো পৃথিবীর মজলুমদেরও ছুঁয়ে যায়। তারা একই তরীকায় নিজ দেশের জালেমদের বিতাড়িত হওয়ার বিষয়েও আশাবাদী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ফ্যাসিবাদী হাসিনার পলায়ন বিশ্ব দরবারে এদেশের ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও উন্নত করেছে।
দুই.
মাসিক আলকাউসারের আগস্ট ২০২৪ সংখ্যা ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে প্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যেন মাসের শুরুতেই পাঠক পত্রিকা হাতে পেয়ে যান। ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ১৫ জুলাই কাছাকাছি হয়ে গেছে। একসময় পারও হয়ে গেছে। বিভাগীয় লোকজন একটি লেখা ও সম্পাদকীয়র জন্য যথারীতি তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু লিখতে মন আগাচ্ছে না। দেশের এ পরিস্থিতি, এত রক্তপাত ও মজলুমের আর্তনাদ দেখে মনে হচ্ছিল আল্লাহ তাআলা এবার একটা কিছু হয়তো করবেন। এবার আর হয়তো জালেম পতন ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু ২০-২২ তারিখ পার হওয়ার পরও যখন তেমনটি ঘটেনি তখন কোনো রকম একটা লেখা তৈরি করে রক্তিম লাল প্রচ্ছদের আলকাউসার আগস্ট সংখ্যা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কাছে সবকিছুরই একটি সময় নির্ধারিত থাকে। তিনি সেটি এনেছেন ৫ আগস্ট ২০২৪-এ। যখন আলকাউসারের আগস্ট সংখ্যা মানুষের হাতে পৌঁছেছে। সেই সংখ্যার লেখা -‘কোটা আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানি : একটি নিরীহ দাবিকে কেন সহিংস ও রক্তাক্ত করে তোলা হল’- শব্দ চয়নে কত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। পাছে না আবার কারো ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মেহেরবানী সে ভাবমূর্তিওয়ালারা ... মতো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন তাদের প্রভুরূপী বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে। শোনা যাচ্ছে, সেখানেও তার স্থায়ী ঠাঁই হচ্ছে না। আসলে যারা দেশ ও জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যদের সেবাদাসে পরিণত হয়, তাদের প্রভুরা তো তাদেরকে ততদিনই মূল্য দেয়, যতদিন তাদের কাজে আসে। এরপর টিস্যু পেপারের মতো ময়লার বাস্কেটই হয় তাদের ঠিকানা।
جا کے یہ کہہ دے کوئی شعلوں سے چنگاری سے + پھول اس بار کھلے ہیں بڑی تیاری سے
مدتوں بعد یوں تبدیل ہوا ہے موسم + جیسے چھٹکارا ملا ہو کسی بیماری سے
অগ্নিশিখা ও স্ফুলিঙ্গকে গিয়ে বল/ ফুল এবার ফুটেছে বড় প্রস্তুতি নিয়ে
দীর্ঘকাল পর এমন পরিবর্তন হয়েছে মৌসুম যেন মুক্তি মিলেছে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে।
তিন.
শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। তার নামের আগে এখন অনেক বিশেষণই লাগানোর সুযোগ আছে। এদেশে জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাকালে তিনি নিজের ও নিজের বাবার জন্য কত খেতাবই না জবরদস্তি চালু করেছেন। নিজেকে ও তার বাবাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে সেসবের কি কোনো চিহ্ন আছে? এখন তাকে মানুষ কী কী নামে ডাকছে, তারই দলের তারই মদদপুষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তার নামের সাথে কী কী শব্দ ব্যবহার করছে- এগুলো থেকে জ্ঞানী লোকদের শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছুই। আমরা তাই শেখ হাসিনার নামের সাথে যুক্ত হওয়া বিশেষণগুলো যোগ করা থেকে বিরত থাকছি। গত সংখ্যায় আমরা বলেছিলাম, সরকার পানি ঘোলা করল কেন? উচ্চ আদালতকে দিয়ে কারফিউয়ের মধ্যে কোটা বাতিলের রায় দেওয়াতে পারলে আগে কেন তা করল না? আমরা বলেছি, ‘নিরীহ ও যৌক্তিক একটি দাবি এবং এর সপক্ষের আন্দোলনকে প্রতিরোধ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাই এই সমস্যা ও জটিলতা তৈরি হওয়ার প্রাথমিক কারণ। যে আপিল বিভাগের মাধ্যমে কারফিউয়ের ভেতর এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হল, সেটা কদিন আগে করলে কী হত? কেন এত ঘোলা করে পানি পান করতে হল।’ শুধু এতটুকু বলতে পারিনি, গাধা পানি ঘোলা করে খায়। কিন্তু বাস্তবে বোকা হোক আর চালাক হোক খোদায়ী পাকড়াও যখন এসে যায় তখন সকল কূটকৌশলই বিফলে যায়। না-হয় কোটা সংস্কারের যে দাবিটা পরে মেনে নেওয়া হল, তা যদি শুরুতে মেনে নেওয়া হত, যদি রাজাকার বলে ছাত্রদেরকে গালি দেওয়া না হত, যদি প্রথম দিনই ছাত্রদের প্রাণহানি না ঘটানো হত, তাহলে কি পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়াত?
পেছনের কত আন্দোলনই তো তিনি জোর-জুলুম-জবরদস্তি দিয়ে দমন করেছেন। ৫ মে’র হেফাজত ট্রাজেডির কথা কার না মনে আছে। বিএনপির দীর্ঘ আন্দোলন, জামাতের আন্দোলন- সবগুলোই বিভিন্ন কূটকৌশলে দমানো হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল কীভাবে? নিশ্চয় এর বাহ্যিক বহু কারণ রয়েছে। দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমে সেগুলো নিয়ে অল্পবিস্তর বিশ্লেষণও হয়েছে। কিন্তু আসল কারণটি কী?
সেটি যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পাকড়াও- তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ আন্দোলনের শুরুর দিকে সরকার পতনের কোনো ডাক ছিল না। হাসিনার পদত্যাগের দাবি ছিল না। একেবারে শেষ দিকে এসে এ দাবি যুক্ত হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত আসার আগেই সরকার আন্দোলনকারীদের সাথে মিটমাট করার সুযোগ পেয়েছে একাধিকবার। কিন্তু যুগ যুগ থেকে ইতিহাস সাক্ষ্য দিয়ে আসছে, যখন জালেমের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়, তখন তার দম্ভ এবং মরণ কামড় আরো বেড়ে যায়। যা তার পতনকে ত্বরান্বিত করে। সুতরাং শেখ হাসিনার বিদায়ে আম ছাত্র-জনতা কর্তৃক শোকরানার নফল নামায আদায় যথাযথই ছিল।
সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের, যিনি দীর্ঘ দম বন্ধকর পরিস্থিতি থেকে তার ১৭ কোটি বান্দাকে নাজাত দিয়েছেন। সাথে সাথে এবারের আন্দোলনের সূচনাকারী সর্বস্তরের ছাত্রসমাজ পুরো জাতির কাছ থেকে মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। জালেমের বুলেটের মুখোমুখি হয়েও তারা যেভাবে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, এজন্য পুরো জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। তাদের সাথে আপামর জনসাধারণের যে পুরোপুরি সমর্থন ও দুআ ছিল- তা তো পরবর্তীতে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থেকেই বোঝা গেছে। আল্লাহ তাআলা এদেশের সর্বস্তরের ছাত্র সমাজকে হেফাজত করুন। তাদেরকে সত্য ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে সহজ করে দিন। হালাল রুজির তাওফীক দিন। হারাম, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার রাখুন।
চার.
শেখ হাসিনা তো পালালেন, কিন্তু এদেশের কী করে গেলেন? শুধু কি গুম হত্যা নির্যাতন করেই তিনি ক্ষান্ত হয়েছেন? শত শত লোকের প্রাণহানি হাজার হাজার মানুষের জেল-জুলুম- এসব তো সকলেই দেখতে পেয়েছেন; কিন্তু তিনি যে পুরো রাষ্ট্র কাঠামোটিই ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন- তা তো কেবল সচেতন লোকজনের কাছেই সুস্পষ্ট হয়েছে; যারা অনেক আগেই তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। দেশের এমন কোনো মৌলিক সেক্টর নেই, যা তিনি ধ্বংস করে যাননি। জনপ্রশাসন, অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুদক, জাতীয় সংসদ, শিক্ষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি, পররাষ্ট্রনীতি, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা- এধরনের কতটি সেক্টরের নাম আপনি নেবেন, কোন্টির কথা আগে বলবেন? একেকটি বিষয় বিশ্লেষণ করতে হলে কমপক্ষে পুরো একটি পত্রিকা লেগে যাবে। যিনি তার দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত তার সেবাদাসদেরকে ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে উন্নয়নের ডামাডোল পিটিয়ে গেছেন দেড় দশক থেকে। তিনি যে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিলেন তা তো অল্প মানুষেরই জানা ছিল। ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ তিনি পালানোর সময় এদেশের জনগণের কাঁধে রেখে গেছেন। শুধু তাই নয়, পুরো ব্যাংকব্যবস্থাকে ধ্বংস করে গেছেন। দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো তো ধ্বংস করেছেনই, সাথে বড় বড় বেসরকারি ব্যাংকগুলোও দলীয় লোকদেরকে দিয়ে লুটপাট করিয়েছেন। বন্দুকের জোরে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা রাতারাতি বদলি করে দলীয় লোকদের লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন।
সেই ১৯৯৬ সালে যে মখা আলমগীর প্রশাসনে বিদ্রোহ করে তার ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিলেন তার লুটপাট করা ফার্মার্স ব্যাংক রাষ্ট্রীয় টাকা দিয়ে আবার দাঁড় করানো হয়েছে। নাম বদলি করে রাখা হয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এরপর আবার লুটপাট! একইভাবে যে কোম্পানিটি দেশে শুধু বাস পরিচালনায় প্রসিদ্ধ ছিল, সেই এস আলম গ্রুপকে মালিক করে দেওয়া হয়েছে বড় বড় অর্ধ ডজনেরও বেশি ব্যাংকের। যারা (অনেকের মতে তাদেরকে হাত করে ক্ষমতাবানেরা) হাতিয়ে নিয়েছে জনগণের লক্ষ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার দোসর ও দলীয় লোকেরা বিগত দিনগুলোতে বিদেশে পাচার করেছে লক্ষ কোটি ডলার। তার নিয়োগ দেওয়া সাবেক পুলিশ প্রধান ও অন্যান্য অফিসারগণ, র্যাব প্রধান ও আর্মি প্রধানের দুর্নীতির ফিরিস্তি তো মাত্র আসা শুরু হয়েছিল। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ছাত্র আন্দোলন। না-হয় এতদিনে পুলিশ ও র্যাব নামধারী আরো কত দুর্নীতিবাজের হাজার হাজার কোটি টাকার তথ্য জনসম্মুখে এসে যেত। এই যে এখন দেখা যাচ্ছে, পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দুর্নীতিবাজ অফিসাররা তো বটেই, তাদের দলের পাকড়াও হওয়া একেকজন সাধারণ নেতারও দুর্নীতির হিসাব এলে হাজার কোটির নিচে কিছু শোনা যায় না। এগুলোর জন্য তো আসলে বড় প্রমাণের দরকার নেই। বাংলাদেশের ৮৭ হাজার গ্রামের সাধারণ জনগণই এর সাক্ষী।
শেখ হাসিনা তার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল পর্যন্ত। যাদের মাধ্যমে এই দীর্ঘ সময়ে ধ্বংস করে ফেলেছেন গ্রামবাংলার আপামর জনসাধারণের সৌহার্দপূর্ণ ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কও। তার মনোনয়ন দেওয়া একেকজন চেয়ারম্যান এবং তাদের চ্যালাচামুণ্ডারা মালিক হয়েছে শত শত কোটি টাকার। কোনো কোনো উপজেলা চেয়ারম্যানও হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। এ দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি সবই লুটেপুটে শেষ করেছে হাসিনা ও তার বাহিনী। দশ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলে ক্ষমতায় এলেও চরম দুর্নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি গিয়ে দাঁড়িয়েছে গণমানুষের নাগালের অনেক বাইরে। মোটা চাল কিনতে হয়েছে ৬০ টাকা দামে। তার পরও তার দোসররা উন্নয়নের গান গেয়ে গেছেন। উন্নয়ন দেখানোর জন্য কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, উড়াল সড়ক, মেট্রোরেল করা হয়েছে আর দালাল গণমাধ্যমকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রোপ্যাগান্ডার কাজে। অথচ এসবের আড়ালেই যে লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং পাচার করা হয়েছেÑ তা তো আর সাধারণ মানুষ তখন বুঝতে পারেনি।
এক পদ্মা সেতুর প্রচারে যেভাবে গণমাধ্যম জিগির তুলেছিল, এমন একটা ভাব তৈরি করা হয়েছিল যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং দামি সেতু এদেশে হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ডামাডোল যখন বাজানো শুরু হল, দালাল মিডিয়া ও উচ্ছিষ্টভোগী কিছু শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, ভিসি ও বুদ্ধিজীবী পদ্মা সেতুর মাহাত্ম্য নিয়ে রাত-দিন এক করা শুরু করল, তার কিছুদিন আগেই আমার পঁচিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সেতু পারাপারের সুযোগ হয়েছিল। বাহরাইন ও সৌদি আরবকে যুক্ত করা ওই সেতুটি নির্মিত হয়েছে সমুদ্রের ওপরে। আমার কাছে সেটি বড় কিছু মনে হয়নি। কারণ ততদিনে চীন ৫৫ কিলোমিটারের সেতু উদ্বোধন করে ফেলেছে। কিন্তু যখন দেখলাম, এদেশে পদ্মা সেতু নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা হচ্ছে, এমনকি একসময় দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় প্রচারিত হওয়ার দাবিদার পত্রিকাটিও (সম্ভবত নিজের সম্পাদককে হত্যামামলা থেকে বাঁচানোর জন্য) পদ্মা পদ্মা জিগির তুলেছিল। তখন বারবারই যাচাই করেছিলাম, পদ্মা সেতু আসলে কত দীর্ঘ। কিন্তু যতই যাচাই করা হোক, ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তো ৬০ কিলোমিটার হয়ে যাবে না। তো হাসিনা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একা নন, বরং তার সাথে ভাগ বাটোয়ারা নেওয়া ও উচ্ছিষ্টভোগী হাজার হাজার দালালদেরকেও কাজে লাগিয়েছেন, যাদের অনেকেই এখন হয়তো বোল পাল্টে ফেলেছেন। লুটপাট ও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য একশ্রেণির উচ্চশিক্ষিত সমাজও কম ব্যবহৃত হয়নি। এই যাদেরকে ভিসি বানানো হয়েছে এবং বড় বড় শিক্ষক, ডক্টর, প্রফেসর, যারা নির্লজ্জ দলবাজি ও অন্ধ গুণ গেয়ে গেছেন, এতদিন পর্যন্ত হাসিনার জোর করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পেছনে তাদের অবদানও কিন্তু কম নয়।
যাহোক দেশের অর্থনীতিতে লুটপাট নিয়ে কিছু কথা আলকাউসারের ‘খবর-অতঃপর’সহ বিভিন্ন পাতায় অল্প করে হলেও আমরা বিগত বছরগুলোতে আরয করার চেষ্টা করেছি। চলতি সংখ্যাতেও দৈনিক বণিক বার্তার এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন হুবহু প্রকাশ করা হচ্ছে। যত দিন যাবে হাসিনা ও তার দোসরদের লুটপাট ও দুর্নীতির ফিরিস্তি লম্বা হতে থাকবে- এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাতে লাভ আর কী হবে? দেশের অর্থনীতি তিনি যেভাবে ধ্বংস করে গেছেন, তা কি আর সহজে আগের জায়গায় ফেরত নেওয়া যাবে?
পররাষ্ট্রনীতি
শেখ হাসিনা জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য বাংলাদেশকে করে তুলেছিলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটি কলোনির মতো। কদিন পরই তাদেরকে একেকটা একতরফা সুবিধা তিনি দিয়ে আসতেন। ক্ষমতা ছাড়ার কয়েকদিন আগেও দিয়ে এসেছেন ট্রানজিট সুবিধা। বিনিময়ে দেশের জন্য আদায় করেননি তেমন কিছুই। তার নাকি ভারত থেকে কিছু চাইতে লজ্জা লাগত! লজ্জা তো লাগবেই। তিনি যে নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য তিন তিনটি ভুয়া নির্বাচন করেছেন। সে শেল্টার তো মোদির ভারতই দিয়েছে। ভারত তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোকেও হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা দিয়েছে। আজকে যখন এ লেখা লিখছি তখন বাংলাদেশের অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ ভয়াবহ বন্যার জন্য ভারত কি তার দায় এড়াতে পারে? তাদের এ স্পর্ধা তো আওয়ামী লীগ এবং হাসিনারাই দিয়ে গেছেন।
শিক্ষা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- একথা সর্বজনবিদিত হলেও হাসিনা সরকার সম্ভবত ইচ্ছে করেই এ সেক্টরকে পরিপূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা হয়তো ভেবেছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যত মূর্খ ও শিক্ষায় যত দুর্বল রাখা যাবে, ততই তাদের অবৈধ শাসন দীর্ঘায়িত করা যাবে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছাত্রলীগ নামের তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ও একশ্রেণির দালাল... প্রফেসরদের হাতে। বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় ও মঞ্জুরি কমিশন- সব সেক্টরেরই একই অবস্থা করা হয়েছে। সবারই কাজ ছিল দলাদলি, ভাগবাটোয়ারা, ভিন্নমতের লেকদের দমনপীড়ন। শিক্ষার উন্নতি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। কয়েক বছর পর্যন্ত তো এমন গিয়েছে, একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস না হয়ে থাকেনি। এরপর করোনার দোহায় দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। দীপু মনি নামের এক মহিলাকে দেওয়া হয়েছিল শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। যার কাজ ছিল কয়েকদিন পর পর সংবাদ সম্মেলনে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা এবং অটোপাস ঘোষণা করা। কতবার যে তারা অটোপাস ঘোষণা করেছে এর কোনো ইয়ত্তা নেই। তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্রলীগ কর্তৃক কত নিরীহ শিক্ষার্থী যে নিগৃহীত হয়েছে তার প্রকৃত হিসাব করতেও কয়েক যুগ লেগে যাবে। বুয়েটের সেই আবরার হত্যাকাণ্ড এখনো আতঙ্কিত করে তোলে জাতিকে।
পতিত হাসিনা সরকার শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করেছে, তা হল, শিক্ষা কারিকুলাম ধ্বংস করে দেওয়া। সিলেবাস সংস্কার ও নতুন সিলেবাস প্রণয়নের নামে শুধু শিক্ষার্থীদের অযোগ্য অনুপযুক্ত রেখে দেওয়ার পাঁয়তারাই করা হয়নি, বরং পশ্চিমাদের বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা করা হয়েছে নতুন সিলেবাসে। মাসিক আলকাউসারের বিগত সময়ের কোনো কোনো সংখ্যায় এ বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা করিকুলামে অশ্লীলতা অপসংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতা, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি বিষয়ে দ্বীনদার শ্রেণি ও উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ আসলেও এ কারিকুলাম যে ছাত্র গড়ার জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়, তা কিন্তু শিক্ষাবিদ ও ওয়াকিফহাল মহলও ব্যাপকভাবেই উচ্চারণ করেছেন। তবুও শেখ হাসিনা দীপু মনি ও নওফেলদের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সন্তানদের ওপর এ বস্তাপচা কারিকুলাম চাপিয়ে রেখেছিলেন। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা দিয়েছেন এক দল কুরুচিপূর্ণ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টাও বলেছেন, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা কঠিন। তারা পুরোনোটিতেই ফেরত যাবেন। শুধু পুরোনোটিতে ফেরত গেলেই হবে না; বরং পুরো কারিকুলামকেই এদেশের এবং এ অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস, সভ্যতা ও কৃষ্টি-কালচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
বিচারব্যবস্থা
একটি রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোর অন্যতম হচ্ছে বিচারব্যবস্থা। বলা হয়, আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। সেটিকেই হাসিনা করে ফেলেছিলেন তার পকেটস্থ। দলীয় ও অনুগত লোকদের আখড়া বসিয়েছিলেন আদালত পাড়ায়। তারা মানুষকে ন্যায়-বিচার দেওয়ার পরিবর্তে সরকারের তোষামোদে ব্যস্ত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। নিজের অনুকূলে বিচার বিভাগকে চালানো এবং অপকর্মগুলোতে সমর্থন আদায় করতে গিয়ে হত্যা মামলার আসামীদেরকে পর্যন্ত বিচারালয়ে বসানো হয়েছে। এই যে এবার হাসিনার পলায়নের পর তার দলীয় রাঘব-বোয়ালরা সেনাবাহিনীর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিল, তাদের সাথে নাকি একদল বিচারকও ছিলেন। বিচারকরা তো কোনো দল করেন না, তাহলে তারা কীসের ভয়ে পালাতে গেলেন! এরপর অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আপিল বিভাগের বিচারকগণ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন কেন? তাদের যদি নৈতিক শক্তি থাকত, তাহলে তো তাদের ইস্তফা দেওয়ার প্রয়োজন হত না। আইনগতভাবে সরকার চাইলেও তো তাদের সরাতে পারতেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা, স্বাধীনতার মিথ্যা ঘোষক তৈরি করা, দলীয় স্লোগানকে রাষ্ট্রীয় স্লোগান বানানোÑ এমন আরো অনেক কিছুই তো বিচার পাড়ার কিছু সাহেবের কীর্তি, যারা এগুলোর জন্য আলাদা পুরস্কারও পেয়েছেন। তো যারা এত তোষামোদে ব্যস্ত থাকেন, তারা হতভাগা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবেন কীভাবে? বিচারক নামের সে শ্রেণির কলঙ্করা তাদের প্রভু সরকারের হুকুম ও ইঙ্গিতে ফয়সালা করতেই সময় কাটিয়েছেন বেশি। বিরোধীদের দমন পীড়নে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রায় দিয়ে জুলুম ও বর্বরতার বড় অংশীদার হয়েছেন তারাও। আর এটা এজন্যও বড় হাতিয়ার ছিল, যেহেতু আদালত অবমাননার একটি আইনও এদেশে রয়েছে। তাই বিচার বিভাগ নিয়ে কেউ কিছু বললেই তাকে সম্মুখীন হতে হত কঠিন শাস্তির। এ তথাকথিত কিছু বিচারকের ওপর ভর করেই অনেক নিপীড়নমূলক আইন প্রতিষ্ঠা করেছে পতিত জালেম সরকার। কিন্তু কোথায় গেল সেই আদালত অবমাননার ভয়ভীতি? কোথায় গেল সরকারের পক্ষে বেশরম হয়ে রায় দেওয়ার ঘৃণ্য সাহস? ছাত্রদের এক হুমকিতেই তো তছনছ হয়ে গেল সবকিছু।
আহ! পৃথিবীর যে দেশেই যারা হাসিনা ও মোদির মতো বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ আটকে রাখতে চায়, তারা যদি এই ঘটনা থেকে কিছু হলেও শিক্ষা নিত! এখনো নিশ্চয় হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া অনেক জঞ্জাল বিচার বিভাগে থেকে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সেদিকে সবিশেষ নজর দিতে হবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
একটি দেশে দুষ্টের দমন এবং সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। অথচ অন্যান্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মতো এটিকেও সমূলে বরবাদ করেছেন শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের পুলিশে ভর্তি এবং এসআই, এএসইআই, ওসি, এসপি থেকে শুরু করে আইজি পর্যন্ত সকল স্তরের পুলিশ অফিসারদের মনে হত, তারা রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কোনো লোক নয়, বরং দলীয় ক্যাডার। অনেকে খোলামেলা তেমনটি বলতেও পছন্দ করতেন। সৎ ও ভিন্নমতাবলম্বী পুলিশ সদস্যরা কোণঠাসা হয়ে থাকতেন এদের কাছে। ওই দলীয় মোসাহেব গোষ্ঠী হাসিনার বাবার আমলের চার বছর এবং তার ২১ বছর ক্ষমতাকালে বাংলার জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কীভাবে পেশাদারত্বহীন নৈতিকতা বিবর্জিত ও জুলুমবাজে পরিণত করা হয়েছিল- তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে হাসিনার পলায়নের পর। বাহিনীটির মনোবল এতই ভেঙে পড়েছিল এবং অপরাধবোধে তারা এতই ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল যে, বার বার আল্টিমেটাম দিয়েও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য তাদেরকে কাজে ফেরাতে বেগ পেতে হয়েছে। বেশ কিছু দিন দেশের ট্রাফিক বিভাগ পরিচালিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র সমাজের মাধ্যমে। শুধু কি পুলিশ বিভাগ? এলিট ফোর্স র্যাবকেও কলঙ্কিত করা হয়েছে একই কায়দায়। বেনজীর ও মামুনের মতো লোকেরা যে বিভাগের প্রধান হন, তার দশা কী হবে- তা তো আগামই বলে দেওয়া যায়। আর বিজিবি (সাবেক বিডিআর)-এর কথা তো সকলেরই জানা।
২০০৯ সালে বিদ্রোহের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সুপ্রশিক্ষিত এক দল অফিসারকে হত্যা করানো হয় তৎকালীন বিডিআরের বিপথগামী কিছু লোক দিয়ে। আগেও এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। এখন তো বিডিআর সদস্যগণ ও নিহত আর্মি অফিসারদের স্বজনরা প্রকাশ্যে দাবি করছেন যে, এর পেছনে শেখ হাসিনা এবং তার নিকটাত্মীয়দের (সেলিম, তাপস প্রমুখ) সরাসরি হাত ছিল। তারা এই ঘটনার পুনরায় স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। ওই যে বিডিআরের ভাবমূর্তি ধ্বংস হল, এর পর লোগো, পোশাক ও নাম পরিবর্তন করেও সেটি আর ফেরানো যায়নি। সীমান্তে একতরফাভাবে বাংলাদেশীরা জান দিয়েছে এত বছর। কোনো প্রতিরোধ গড়ার সাহস হয়নি বিডিআর থেকে বিজিবি হয়ে যাওয়া বাহিনীটির।
বেশ কিছুদিন পরে হলেও পুলিশ বাহিনী কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু জানা কথা যে, এর ভেতরে থেকে গেছে পতিত হাসিনা সরকারের বহু দোসর। তাদের থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত করা ছাড়া এ বাহিনী ভালোভাবে উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে গেছে। নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সাবেক দক্ষ কর্মকর্তা। আশা করা যায়, তিনি বিষয়গুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
নির্বাচন ব্যবস্থা
একথা তো সবাই জানে যে, জুলুম দুর্নীতি করে কেউ নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হতে পারে না। সে কারণে হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে কায়েম করেছিলেন একদলীয় শাসন ও একনায়কতন্ত্র। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা না ঘটলে হয়তো তিনিও তার মেয়ের মতোই আমৃত্যু ক্ষমতায় থেকে যেতে চাইতেন। তার পথ ধরেই তার মেয়ে শেখ হাসিনা আজীবন বাংলার মানুষকে শোষণ করার সংকল্প করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেটি তো নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ৫ বছর পর মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তো তাদের বিপক্ষেই ভোট দেবে। পতিত জালেমরা সে কথা ভালোভাবেই জানত। তাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাত্রিকালীন নির্বাচন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করিয়ে দেশ ও জাতিকে বিশ্ব দরবারেও অসম্মান ও অপদস্থ করেছে পতিত জালেম গোষ্ঠী। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনার বসিয়ে নির্বাচনের নামে করা হয়েছে তামাশা। এ পুরো সময়টাতে প্রধানমন্ত্রীই ঠিক করে দিতেন, কারা কোথায় জয়ী হবে, কোথায় পরাজিত হবে। গণভবনের সবুজ সংকেতই ছিল নির্বাচনে জয়ের গ্যারান্টি। হাঁ, সে অপকর্মের দোসর সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালরা ইস্তফা দিয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি। তাদেরকে কেন বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে- সেদিকে মনে হয় ছাত্র-জনতার একবার নজর দেওয়া দরকার।
সমাজব্যবস্থা
বাংলাদেশ মফস্বল কেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এদেশের বেশির ভাগ লোক বাস করে গ্রামাঞ্চলে। আবহমান কাল থেকেই অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রামাঞ্চলের লোকদের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে একপ্রকার মিলেমিশে চলার সুরীতি ছিল। একে অন্যের সুখে-দুঃখে শরীক হওয়া এবং পরস্পরে হানাহানিতে না জড়ানোর ভালো রেওয়াজ ছিল এদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে। কিন্তু সেটিকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। এদেশের গ্রামে গ্রামে এখন হানাহানি-মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ লুটতরাজ ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্বংসাত্মক মাদকে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। এসব কারবারকে ছত্রছায়া দিয়েছে পতিত আওয়ামী গোষ্ঠী। গ্রাম্য শিষ্টাচার, মুরব্বিদের সম্মান, মা-বোনদের ইযযত রক্ষা, ছোটদের স্নেহ-মমতা ইসলামের এ সৌন্দর্যগুলোও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের পাতি নেতাদের হাতে। একেকজন মেম্বার-চেয়ারম্যান অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা-ই কামায়নি; বরং বাড়িতে বাড়িতে তাদের চ্যালাচামুণ্ডা তৈরি করে গণমানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। যাদের অত্যাচারের ভয়ে এবং তাদের দ্বারা সম্মানহানির আতঙ্কে তটস্থ থাকত গ্রামের সাধারণ মানুষ।
ব্যক্তি ও পরিবার-পূজা
হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা সরকার তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। যা নিয়ে ফুঁসে ওঠে বাঙালি জাতি। বেঁধে যায় যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করে পাক বাহিনী। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল এদেশের জনসাধারণ। যুদ্ধকালীন পুরো সময় জুড়ে পাকিস্তানের করাচিতে রাজবন্দির মর্যাদায় আটক ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে আসেন। বাঙালি জাতি বীরোচিত সংবর্ধনা দেয় তাকে। তাদের আশা ছিল জুলুম দূর হবে, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা পাবে, বৈষম্যহীন সমাজ গঠিত হবে। তারা ভোটাধিকার পাবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে অবাধে। কিন্তু সে আশায় পানি ঢেলে দেন শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। ৩/৪ বছরেই তার দলবল ও চ্যালাচামুণ্ডারা ধ্বংস করে ফেলে সমাজব্যবস্থা। লুটতরাজ শুরু করে নবগঠিত রাষ্ট্রটিতে। চার বছর যেতে না যেতেই তিনিও হয়ে ওঠেন চূড়ান্ত স্বৈরাচার। পার্লামেন্টে অল্প কয়েক মিনিটের আলোচনাতেই নিয়ে আসেন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। যার মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। সে সময় গণমাধ্যম বলতে হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যমই ছিল। আর ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টেলিভিশন। সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে শুধু চারটিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে বহাল রাখা হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও বাকশালে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ স্লোগান চালু করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সব পরিকল্পনাই নস্যাৎ হয়ে যায়। এমন একজন নেতা, যাকে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ ঐতিহাসিক সংবর্ধনা দিয়ে দেশে স্বাগত জানিয়েছিল, সপরিবারে তার এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি দেশের মানুষের মধ্যে। বলা হয়, কাদের সিদ্দিকীর মতো দুয়েকজন ছাড়া তখন ইন্না-লিল্লাহ পড়ারও লোক ছিল না। সেসব ইতিহাস যখন লেখা হত, অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইত না। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ দেখার পর ওসব কথা অনেক কমই মনে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। চিন্তা করা যায়, যদি শেখ হাসিনা তার ছোট বোনকে নিয়ে বেঁধে দেওয়া সময় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পালাতে না পারতেন, তাহলে তাদের সঙ্গে কী ঘটত? আর তার আত্মীয়-স্বজন যারা এতদিন পর্যন্ত সবকিছুকে তাদের নিয়ন্ত্রণে ও তাদের গোলামীর অধীন ভেবে চলছিল, তাদের কোনো একজন যদি বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার হাতে আটক হত, তাহলে তারই বা কী দশা হত?
যাইহোক, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। কিন্তু তার করুণ পরিণতি থেকেও শিক্ষা হাসিল করেননি বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যাওয়া তার কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে তিনি হজ্ব করে এসে মাথায় কালো হিজাব লাগিয়ে কাকুতি-মিনতি করে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভোট ভিক্ষা চেয়েছিলেন। সেসময়ের বিএনপি সরকারের কর্মকাণ্ডে রাগান্বিত মানুষ আওয়ামী লীগের অতীত ভুলে গিয়ে ভোট দিয়েছিল শেখ হাসিনাকে। কিন্তু তিনি তার বাবার পরিণতি থেকে শিক্ষা নেননি; মাফ চাওয়া, ভিক্ষা চাওয়া- সবকিছু ভুলে গিয়ে চূড়ান্ত স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিলেন। ভাগ্যিস তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকায় পরবর্তী নির্বাচনে দেশের মানুষ সমুচিত জবাব দিয়েছিল। চূড়ান্ত ভরাডুবি হয়েছিল হাসিনার।
শেখ হাসিনার সে আমল এবং ২০০৯-২০২৪ এই পনের বছর মোট ২১ বছরে তিনি বাবার মতোই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চূড়ান্ত পরিবারতন্ত্র। ব্যক্তি ও পরিবার পূজা, তাদের জন্য অঢেল রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও পদবি বরাদ্দ এবং প্রটোকলের নিয়ম-কানূন দলীয় ব্যক্তিকে জাতীয় ব্যক্তিতে রূপান্তর এবং এসব প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দেশের হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটি স্বাধীন জাতিকে একটি পরিবারের গোলামে পরিণত করার সব চেষ্টাই করা হয়েছিল। দেশের আনাচে-কানাচে শেখ মুজিবের অসংখ্য মূর্তি বানানো হয়েছিল গরীব দেশের জনগণের টাকায়। যে দেশের একটি বিশাল অংশ এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে, দুমুঠো অন্নের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে, সে দেশের কত শত কোটি টাকা যে মূর্তি বানানো ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে খরচ হয়েছে, তার হিসাব কবে বের হবে কে জানে? কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪ -এ কী দেখল বিশ্ববাসী? এই মূর্তিগুলো এবং পুরো দেশে ছেয়ে থাকা তাদের অসংখ্য তোরণ ও কোটি কোটি ব্যানার-ফেস্টুন যদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অপসারণ করা হত, তাহলে নিশ্চয় কয়েক শ কোটি টাকা লেগে যেত। অথচ বিক্ষুব্ধ জনতা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরো দেশ থেকে শুধু শেখ মুজিবের মূর্তিই নয়, বরং হাসিনা ও তার দোসরদের সকল ব্যানার-ফেস্টুন-তোরণ এমনভাবে অপসারণ করেছে যে, পেছনের ঘটনা প্রবাহ কারো জানা না থাকলে সে বুঝতেই পারবে না- এতদিন আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা এদেশে কী ঘটিয়ে গেছে।
সবাই জেনে গেছেন যে, বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে গণভবন, শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর বাড়িসহ অনেক কিছুই রক্ষা পায়নি। আসলে তখন পরিস্থিতি কারোরই নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিন্তু এর পেছনে দায়ী কে? বলার অপেক্ষা রাখে না, এ পরিস্থিতির পুরো দায়ভারই হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের। জোর করে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠিত করার চূড়ান্ত ফলাফল যে বিরূপ হয়, তার নজীর ইতিহাসে কম নেই। সমাজতন্ত্রের বিপ্লবীরা স্বহস্তে এবং সদর্পেই ভেঙেছিল লেলিন ও মুসোলিনির মূর্তি। এধরনের উদাহরণ রয়েছে আরো অসংখ্য।
যাহোক এখন ৯০% ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ অনেকটাই মূর্তিমুক্ত। পৌত্তলিকতায় দেশটাকে বিশ্রী বানিয়ে ফেলা হলেও আশা করা যায় এখন সে প্রবণতা কমে আসবে।
এখানে শুধু আমরা একশ্রেণির মতলবী ও মুনাফিক মিডিয়ার কথা তুলে ধরতে চাই, যাদের মনের কোণে হাসিনা বা শেখ মুজিবের জন্য তেমন দরদ না থাকলেও মূর্তি ভাঙায় তারা ব্যথিত বলে মনে হয়। দেশের কতগুলো মূর্তি ভাঙা হয়েছে এগুলোর হিসাব-নিকাশও প্রকাশ করছে তাদের কেউ কেউ। অথচ এ নির্লজ্জ গোষ্ঠীটির এ মূর্তিগুলো বানানোর সময়ই প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল, কেন রাষ্ট্র ও জনগণের টাকা ব্যয় করে ব্যক্তিপূজা ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে? ভবিষ্যতে আইন করে রাষ্ট্রের খরচে এধরনের অপচয় স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
এখানে আমরা কাদের সিদ্দিকী সাহেবের একটি বিষয়ও উল্লেখ করতে চাই। হাসিনা সরকারের পতনের পর যখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি বিক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক তছনছ হয়েছে। তিনি তা পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং অনেক নীতিকথা বলেছেন। শেখ মুজিব ও তার কন্যা এক নয়- এ সবকও জাতিকে শুনিয়েছেন। কাদের সিদ্দিকীর প্রতি আমরা শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, বাবা ও বেটি এক না হওয়ার সবক বাঙালি জাতি তার থেকে নিতে রাজি আছে বলে মনে হয় না। আমরা কোনো ধ্বংসাত্মক কাজের পক্ষে নই। একটি দালানের তো আর কোনো দোষ থাকে না। সেটিকে ভাঙলেই বা কী লাভ? সেটিতে আগুন দিলে কিংবা ভাঙলে সে তো ব্যথাও পায় না। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী কি একথা বোঝেন না যে, শেখ মুজিবের প্রতি এই অশ্রদ্ধা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে তার কন্যা হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগই ভূমিকা পালন করেছে। অন্যায়ভাবে জাতির ওপর তাদের প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়াতেই যে এসব কিছু ঘটেছে- সেকথা কাদের সিদ্দিকীর মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ১৯৭৫-১৯৯৫ এবং ২০০১-২০০৮ আটাশ বছর তো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না, তখন কি ৩২ নম্বরে কেউ কোনো আঘাত করেছিল? এ বাড়িটিকে কি কেউ অসম্মান করতে গিয়েছিল? জিয়াউর রাহমানের আমলে লেখক নিজেও বাড়িটি পরিদর্শন করেছে। যাতে তখন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সকল স্মৃতিই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
এই ধ্বংসলীলা যে শেখ হাসিনার প্রজাতন্ত্রকে পরিবারতন্ত্র বানিয়ে ফেলা এবং দীর্ঘ আওয়ামী দুঃশাসনের নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া- তা বুঝতে কোনো বিবেকবান মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
জনপ্রশাসন
জনপ্রশাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জনগণকে সেবা দিয়ে থাকেন। বাস্তবায়ন করেন সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত। এ দেশে যে দলই সরকার হোক, প্রশাসনকে নিজ দলের অনুকূলে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ কাজটি করেছে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে। জনপ্রশাসনকে একচ্ছত্র দলীয়করণ করতে গিয়ে অনেক অযোগ্য-অপদার্থদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্ধ, অনুগত ও পা-চাটা লোকদের অন্যায়ভাবে পদোন্নতি দেওয়া, যোগ্যদের পদ-বঞ্চিত করা, ভিন্ন মতের লোক মনে করে অনেককে ওএসডি করে রাখা ছিল তাদের কাছে সাধারণ বিষয়। অনুগত দুর্নীতিবাজ পিএসসির মাধ্যমেও তারা নিজস্ব লোকজন ও তাবেদারদের নিয়োগের কাজটি করে ফেলত। হাসিনা সরকারের পতনের কিছুদিন আগেও তো পিএসসির দুর্নীতির বিভিন্ন খতিয়ান জনসম্মুখে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। একেকটি প্রশ্নপত্র দেওয়ার জন্য বা চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য ১৫/২০ লক্ষ বা আরো বেশি টাকার নাকি ঘুষ আদান-প্রদান হত। পিএসসির একজন চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের কাড়ি কাড়ি অর্থ নিয়ে কয়েক দিন পর্যন্ত দেশ গরমও ছিল। সে সূত্রে খোদ প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মুখেও শোনা গেছে যে, তার একজন পিয়নও চার শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সে কথা বলতে গিয়ে তিনি দুর্নীতির পক্ষে পরোক্ষ সাফাইও গেয়েছিলেন। বলেছেন, উন্নয়ন হলে দুর্নীতিও হয়। এটা অন্য দেশেও হয়। তো প্রশাসনের সকল স্তরে দলীয় দোসরদের আধিপত্য তৈরি করে চেইন অব কমান্ডই ভেঙে ফেলা হয়েছিল। আর একশ্রেণির দুর্নীতিবাজের আখড়াও হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন সরকারি দফতরগুলো। দলীয় ও ন্যায়-অন্যায় বাছবিচার না করে অনুগত থাকবে- এমন লোকদের নিয়োগ দেওয়ার জন্যই হয়তো সরকারি চাকরিতে ৫৬٪ কোটা জোর করে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। রাগের চোটে মুখ ফসকে একবার তা বাতিল করে দিলেও হাইকোর্টের তাবেদার লোকদের মাধ্যমে আবার কোটার পক্ষে ফয়সালা আদায় করে নিয়েছে। শুধু কি জনপ্রশাসন? ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় মসজিদসহ ধর্মীয় সেক্টরগুলোতেও হয়তো আজ্ঞাবহ লোকদের বসানো হয়েছে, নতুবা তাদেরকে আজ্ঞাবহ করা হয়েছে। সুতরাং জনপ্রশাসনকে এই আওয়ামী জঞ্জালমুক্ত করা অন্তবর্তী সরকারের জন্য সহজ কাজ হবে না। হাসিনার বাড়তি নুন খাওয়া দুষ্ট কর্মকর্তারা ওঁত পেতে থাকবে যেকোনো সময় ঝামেলা তৈরি করার জন্য।
ধর্ম ও ধর্মীয় লোকদের নিয়ন্ত্রণ
স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিব সরকার দেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। সে সময়ে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে অসংখ্য আলেম-উলামা। বন্ধ হয়েছে বহু দ্বীনী প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনাও ক্ষমতা গ্রহণ করার কিছুদিন পর একই পথে হাঁটা শুরু করেছেন। দেশের শীর্ষ আলেমদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছেন। মাদরাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় লোকদের নিপীড়ন করেছেন তাদের মতো করেই। যার জবাব অবশ্য ২০০১-এর নির্বাচনে তারা পেয়ে গেছেন। এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেই তার আইনমন্ত্রী শফীক আহমদ বলে বসলেন, ‘কওমী মাদরাসাগুলো জঙ্গি প্রজনন ক্ষেত্র।’ মাদরাসা, আলেম-উলামা ও দ্বীনদার সমাজের সাথে এই শত্রুতার মধ্যেই চিরাচরিতরূপে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নাস্তিক ও ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠী। স্বাভাবিকভাবেই উলামায়ে কেরাম ও দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ এসবের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। প্রাণের চেয়ে প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর আনীত শাশ্বত ও শান্তির ধর্ম ইসলামের অবমাননা সয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না তাদের জন্য। স্বভাবতই ২০১৩ সালের দিকে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। গণবিক্ষোভে কেঁপে ওঠে শহর-বন্দর। এরপর ৫ মে’র শাপলা চত্ত্বর ট্রাজেডির কথা তো সকলেরই জানা। কীভাবে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ লক্ষ ধর্মপ্রাণ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জালেম হাসিনার বাহিনীগুলো। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের সকল লাইট বন্ধ করে দিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধের মতো করে সশস্ত্র হামলা করে কীভাবে তারা হত্যা করেছিল নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে। এসবের বিস্তারিতও হয়তো একদিন উদ্ঘাটিত হবে।
এ ঘটনার পর যখন পুরো দেশ ফুঁসে উঠতে থাকে, তখন কৌশল পাল্টে ফেলেন শেখ হাসিনা। এবার তিনি ধর্মের বিরোধী নন, বরং ধর্ম ও ধর্মীয় লোকদের পক্ষেÑ এ প্রচারণায় লেগে যান। এ প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য তার একান্ত ঘনিষ্ঠ শেখ আব্দুল্লাহ ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা নিজেদেরকে আলেমদের বন্ধুরূপে জাহির করতে থাকে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে কিছু মতলবী ও সুবিধাবাদী মাওলানাকে হাত করা হয়। ঘোষণা করা হয় দাওরায়ে হাদীসের সনদের স্বীকৃতি। আদায় করে নেওয়া হয় শীর্ষ আলেমদের থেকে গণসংবর্ধনা। এমপি পদপ্রত্যাশী একজন মাওলানা কর্তৃক কওমী জননী খেতাবও বাগিয়ে নেওয়া হয়। মুহূর্তেই পুরো দেশের আওয়ামী লীগারদের মুখে ছড়িয়ে পড়ে, ‘আপনারাই তো আমাদের নেত্রীকে কওমী জননী খেতাব দিয়েছেন। তিনি তো ধর্মপ্রাণ তাহাজ্জুদগোযার। ইসলামের জন্য নিবেদিত। আপনাদের সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন।’ আরো কত কী!
এভাবে মুনাফেকীর শেষ সীমায় পৌঁছে যায় শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। চরম ইসলাম বিদ্বেষী ও পৌত্তলিক মানসিকতার হয়েও নিজেদেরকে ধর্মপ্রাণ বলে জাহির করতে থাকে তারা। আর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় দেশের কওমী মাদরাসাগুলোর সকল কেন্দ্রীয় বোর্ড এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বড় বড় মসজিদ-মাদরসা। তাদের গোয়েন্দারাই ঠিক করে দিত কোথায় কারা দায়িত্বে বসবে। খুব লজ্জার সাথেই আমাদের একথা বলতে হচ্ছে, তাদেরকে এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন কতিপয় সুবিধাবাদী লোভী ও মতলবি মাওলানা। এদেরকে ব্যবহার করেই দেশের মূল দ্বীনদার গোষ্ঠী ও সর্ববৃহৎ দ্বীনী শিক্ষাব্যবস্থা কওমী মাদরাসাগুলোকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা ও তার দল। অথচ কে না জানে, স্মরণকালের ইতিহাসে এ অঞ্চলের মাদরাসা-মসজিদ ও ধর্মপ্রাণ মানুষজন এত বেশি নিগৃহীত ও নিয়ন্ত্রিত আর কখনো ছিল না। কোনো খতীব কি বলতে পারবেন যে, বিগত এক দশকে তিনি স্বাধীনভাবে মসজিদে বক্তব্য দিতে পেরেছেন? মসজিদে মসজিদে শুধু গোয়েন্দাদেরকেই লাগানো হতো না; বরং মুসল্লিরূপে আওয়ামী লীগের ষণ্ডা-পাণ্ডাদেরকে পাহারায় বসানো হত ইমাম-খতীবরা তাদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলে বসেন কি না। দুয়েকজন যদি কখনো ঈমানের ডাকে তাড়িত হয়ে কিছু বলে ফেলেছেন, তবে তার জন্য জেল-জুলুম ছিল অবধারিত। তার চাকরি চলে যাওয়া ও অপদস্থ হওয়া মুহূর্তের ব্যাপার ছিল। শুধু শেখ মুজিব ও হাসিনার নাম ধরে দুআ না করার খেসারতস্বরূপ কত ইমামের চাকরি গিয়েছে তার সঠিক হিসাব করতেও সময় লেগে যাবে অনেক দিন। শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নির্যাতন এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদগুলোই তারা নিয়ন্ত্রণ করেনি; বরং বাংলাদেশকে পৌত্তলিক রাষ্ট্রের রূপ দেওয়ারও সকল আয়োজন করেছে। ঢাকাসহ এদেশের শহরে শহরে যত মন্দির স্থাপন করা হয়েছে, সে অনুপাতে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বসবাস করে কি না- তা তো সাধারণ মানুষ মাত্রই অবগত আছেন। শুধু কি তা-ই, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি পৌত্তলিক ও হিন্দুয়ানী বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। আজ আমরা পতিত জালেমদের অপকর্মের ফিরিস্তি আর বাড়াতে চাচ্ছি না। শেষে একটি কথা বলেই ইতি টানছি।
পাঁচ.
জালেমরা কোটি মানুষের ওপর জেঁকে বসে কীভাবে?
২০২৪ সালের জুলাই মাসে অনেক দিন পর বাংলাদেশ একটি বিষয় প্রত্যক্ষ করেছে। তা হচ্ছে, জালেমের বিরুদ্ধে পুরো জাতির ঐক্য। হাসিনার দোসর, সেবাদাস ও সরাসরি সুবিধাভোগীরা ছাড়া পুরো জাতিই এককণ্ঠ হয়ে উঠেছিল জালেম ও জুলুমের বিরুদ্ধে। অবশেষে আল্লাহর রহমতও এসেছে এবং পালাতে বাধ্য হয়েছেন আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখা ইতিহাসের বর্বরতম জালেম সরকার। কিন্তু এই যে শেখ হাসিনা এ রাক্ষুসে মানসিকতা ও চরিত্রের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেনÑ সেটি কি একদিনে ঘটেছে?
না। এমনটি তো নয়; বরং ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। একেক শ্রেণি ও গোষ্ঠীকে নির্যাতন করতে করতে তার জুলুমের হাত পাকাপোক্ত হয়েছে। প্রথমে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন ও গুম-খুন শুরু করেন। তাতে ওই দলের লোকেরা ছাড়া অন্যরা তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। দেশের শিক্ষিত সমাজ, গুণীজন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হওয়ার দাবিদারেরা ওসব জুলুমের কি কোনো প্রতিবাদ করেছে? বরং তাতে তাদের একপ্রকার নীরব সমর্থনই ছিল। এরপর যখন ধর্মপ্রাণগোষ্ঠী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত করা হয় তখন কি অন্যেরা এর প্রতিবাদ করেছিল? বরং শাপলা ট্রাজেডির পর হেফাজতকাণ্ড ও শাপলাকাণ্ড নামে মিথ্যা বানোয়াট গল্প-কাহিনী তো এই নিরপেক্ষরাই তৈরি করেছিল। এই একশ্রেণির শিক্ষিত গোষ্ঠী ও কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীল শ্রেণি তো বরং এতে খুশিই হয়েছিল। এবং মিথ্যা অপপ্রচারে জালেমের সঙ্গই দিয়েছিল। এরপর যখন জালেম শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তাদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারে যে, এখন এ রাক্ষস আর কাউকে অবশিষ্ট রাখবে না।
তাহলে কী বোঝা গেল? যদি শুরু থেকেই যেকোনো জুলুমের এমনকি নিজের ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর হওয়া জুলুমের ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করা হত, তবে কি জালেম এপর্যন্ত অগ্রসর হতে পারত? তার অত্যাচারের হাত এত শক্তিশালী হত। মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই দেড় হাজার বছর আগেই ইরশাদ করে গেছেন-
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا، قالوا: يا رَسُولَ اللهِ، هذا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا، فَكيفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا؟ قالَ: تَأْخُذُ فَوْقَ يَدَيْهِ.
তুমি জালেম ও মজলুম উভয় অবস্থায় তোমার ভাইকে সাহায্য কর।
সাহাবায়ে কেরাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মাজলুমকে সাহায্য করার কথা তো বুঝে এল; কিন্তু জালেমকে সাহায্য করার মর্ম কী?
নবীজী জবাব দিলেন, তাকে জুলুম থেকে বারণ করা ও নিবৃত্ত রাখা হচ্ছে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪৪
হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি যাদের অন্তরে কিছুটা ভালবাসা ছিল বা এখনো যারা গোপনে তা পোষণ করেন, কিন্তু তার জুলুমে শরীক হননি, তারা যদি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উপদেশের ওপর আমল করে হাসিনাকে জুলুম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তাহলে আজ দেশ ও জাতি এ চরম বিপর্যয়ে পড়ত না। তাদেরও মুখ বুজে আওয়ামী লীগের এ দুর্দশার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকতে হত না।
সবশেষে নাওয়ায দেওবন্দীর বিখ্যাত একটি কবিতা-
جلتے گھر کو دیکھنے والو پھوس کا چھپرآپ کا ہے
آگ کے پیچھے تیز ہوا ہے آگے مقدر آپ کا ہے
যারা পুড়তে থাকা ঘর চেয়ে চেয়ে দেখছেন,
আপনারও কিন্তু খড়ের আঁটি আছে
আগুনের পেছনে প্রবল বাতাস বইছে, সামনে আপনার ভাগ্য ঝুলছে।
اُس کے قتل پہ میں بھی چپ تھا + میرا نمبر اب آیا
میرے قتل پہ آپ بھی چپ ہیں + اگلا نمبر آپ کا ہے
তার খুন হওয়ার সময় আমি চুপ ছিলাম, এখন আমার পালা
আমার খুনের সময় আপনিও নীরব,
এর পরের পালা কিন্তু আপনার।
আল্লাহর শোকর যে উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার শ্রেণি এবার সেরকম কোনো আচরণ করেননি; বরং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সহযোগিতা ও সমর্থন এবং অংশগ্রহণে তারা অগ্রগামীই ছিলেন।