কুরআনের বার্তা ॥
নিরাপদ সমাজ গড়তে আল্লাহমুখিতা কাম্য
একটি আদর্শ সমাজের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে মানুষের জীবন, সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকে না, তা আদর্শ সমাজ নয়। সে সমাজে কেউই সুখে-স্বস্তিতে বাস করতে পারে না। নিরাপত্তা আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ নিআমত। আল্লাহ তাআলার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বান্দা কখনোই নিজ প্রচেষ্টায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অতএব রাষ্ট্র ও সমাজে যেন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়, আল্লাহ তাআলার কাছে সকলে মিলে তা প্রার্থনা করা আবশ্যক।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে মক্কা মুকাররমায় আসেন, তখন সেখানে কোনো জনবসতি ছিল না। জনমানবহীন মরুময় এ ভূমিতে তিনি বসতির গোড়াপত্তন করেন। সেসময় আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাগ্রে দুআ করেছিলেন, আল্লাহ যেন সে পুণ্যময় ভূমিকে সর্ববিচারে নিরাপদ করে দেন। কুরআন কারীমের বর্ণনায় তিনি এভাবে দুআ করেছিলেন-
رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا بَلَدًا اٰمِنًا وَّ ارْزُقْ اَهْلَهٗ مِنَ الثَّمَرٰتِ مَنْ اٰمَنَ مِنْهُمْ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاَخِرِ.
হে আমার প্রতিপালক! এটাকে এক নিরাপদ নগর বানিয়ে দিন এবং এর বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান আনবে, তাদেরকে বিভিন্ন রকম ফলের রিযিক দান করুন। -সূরা বাকারা (২) : ১২৬
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا وَّ اجْنُبْنِیْ وَ بَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَامَ.
হে আমার প্রতিপালক! এ নগরকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা করা থেকে রক্ষা করুন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় আসেন, তখন মদীনায় বহুজাতিক লোকের বসবাস ছিল। এ বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা যেন একত্রে নিরাপদে বসবাস করতে পারে, পরস্পরে যেন হানাহানি লেগে না থাকে, সে লক্ষ্যে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের সন্তুষ্টি অনুযায়ী একটি চুক্তি করেন। যেটি মদীনা সনদ নামে পরিচিত। সে চুক্তির ধারাগুলোর প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটা জোরদারভাবে মদীনার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। সেখানে মুসলিম-অমুসলিম সকলেরই সমান নিরাপত্তা অধিকার ছিল। কারো বিপক্ষে কারো অন্যায় পদক্ষেপ ওঠানোর কোনোই সুযোগ ছিল না। সেই চুক্তিতে উল্লেখিত ছিল, কোনো মুসলমান যদি কাউকে নিরাপত্তা দেয় (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত যেই হোক,) সে নিরাপত্তা রক্ষা করা সকলের জন্য জরুরি। সেই চুক্তির ভাষ্য মোতাবেক যারা শর্তগুলো মেনে চলবে, তারা সকলেই তাদের প্রাপ্য অধিকার পাবে। আর যে অন্যায় ও অপরাধ করবে, সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা অনুযায়ী বিচার হবে। মদীনা সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার পত্রিকার রজব ১৪৩৪/মে ২০১৩ সংখ্যা।
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশম হিজরীতে বিদায় হজ্বের খুতবায় জগদ্বাসীর উদ্দেশে এক অমোঘ বিধান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন-
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هذَا، فِي بَلَدِكُمْ هذَا، فِي شَهْرِكُمْ هذَا.
তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানিত, যেমন হারাম ও সম্মানিত আজকের এই দিনটি, এই শহর ও এই মাসটি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৩৯, ৬০৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৩৬, ২০৩৮৬
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মুক্কা মুকাররমায় যিলহজ্ব মাসে আরাফার দিন এ খুতবা দেন। মক্কা মুকাররমা, যিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের সম্মান ও মর্যাদা সর্বজনবিদিত। এর যে কোনোটিরই অমর্যাদা করা হারাম। এগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের জীবন, সম্মান ও সম্পদকেও পরস্পরের জন্য হারাম করেছেন।
যে কোনো মুসলমানের জান-মাল-ইযযতের মর্যাদা রক্ষা করা এবং এর অনিষ্ট সাধন না করা প্রত্যেকের জন্যই আবশ্যক। তাঁর এ শাশ্বত বাণী কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল এলাকার সব মুমিনের জন্যই এক চিরন্তন বিধান। এই একটিমাত্র হুকুমও যদি বাস্তবায়ন করা হয়, নিশ্চিতভাবেই মুসলিম সমাজের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তার সুবাতাস বইতে থাকবে।
ইসলামের দণ্ডবিধি কার্যকর করা
শাসকদের দায়িত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হল, জনগণের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। ইসলামে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম প্রত্যেকেরই জান-মাল-ইযযতের সমান নিরাপত্তার বিধান আরোপ করেছে। কারো দ্বারা যেন অন্য কারো জীবন, সম্মান ও সম্পদের বিন্দুবিসর্গ ক্ষতিও না হয়, সেজন্য ইসলামী শরীয়তে অত্যন্ত কঠোর নীতিমালা রয়েছে। যারা এসবের কোনো এক ক্ষেত্রে অন্যের সামান্যতম ক্ষতিও করবে, আখেরাতে তাদের ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআন কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীস এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে।
জীবনের নিরাপত্তা বাস্তবায়নে ইসলামে রয়েছে কিসাস ও দিয়তসহ যথাযথ শাস্তির বিধান। হত্যার বদলে অনুরূপ হত্যা, অঙ্গহানির বদলে অনুরূপ অঙ্গহানি অথবা উভয় ক্ষেত্রে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের সম্মতিক্রমে রক্তপণ ও ক্ষতিপূরণ আদায়। সেইসঙ্গে হত্যা-চেষ্টার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত শাস্তি। ইসলামের এ বিধানাবলির ফলে ইতিহাসে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে মানুষের জীবনের কেমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। আল্লাহর বিধানে মানব জীবনের কী অপরিসীম মূল্য তা কুরআন কারীমের একটি আয়াত থেকেই বুঝে আসে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন-
مِنْ اَجْلِ ذٰلِكَ كَتَبْنَا عَلٰی بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا وَ مَنْ اَحْیَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْیَا النَّاسَ جَمِیْعًا.
এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩২
উক্ত আয়াতের মর্ম অনুযায়ী, যে কোনো এক ব্যক্তির জীবনের মূল্য পৃথিবীর সকল মানুষের জীবনের মূল্যের সমান। তাই অন্যায়ভাবে যথাযথ কারণ ছাড়া কোনো এক ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধ দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যার অপরাধের সমতুল্য। যখন কারো অন্তর থেকে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত বোধ লোপ পেয়ে যায়। তখন সে নিজ স্বার্থের খাতিরে আরেকজনকে হত্যা করতে মোটেও দ্বিধাবোধ করে না। এমন ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য সুযোগ পেলে গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর যার মনে মানুষের জীবনের মূল্যবোধ আছে, সে কখনোই কারো অকল্যাণ কামনা করতে পারে না। বরং সে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ কামনায় নিজেকে উৎসর্গিত করতেই অগ্রগামী থাকবে। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন, কেউ যদি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণরক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষেরই প্রাণরক্ষা করল।
যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে হত্যা করবে, তার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে আরো বলেন-
وَ مَنْ یَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهٗ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِیْهَا وَ غَضِبَ اللهُ عَلَیْهِ وَ لَعَنَهٗ وَ اَعَدَّ لَهٗ عَذَابًا عَظِیْمًا.
যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গযব নাযিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। -সূরা নিসা (৪) : ৯৩
ইসলামী আইনে অমুসলিমদের জীবনেরও নিরাপত্তার বিধান রয়েছে। কোনো মুসলিম যদি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে, অঙ্গহানি করে, তাহলে সে মুসলিমের ব্যাপারেও অনুরূপ শাস্তির হুকুম রয়েছে।
জীবনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার একটি বড় মাধ্যম হল সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। ন্যায়বিচার সম্পর্কে কুরআন কারীমে অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা নিসায় ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ اللهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهْلِهَا وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ اِنَّ اللهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمْ بِهٖ اِنَّ اللهَ كَانَ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا.
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৫৮
অতএব শাসকদের কর্তব্য, সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমেও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া। যদি বিচারব্যবস্থায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা না হয়, তাহলে জননিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হবে না।
এক মুসলমানের ইযযত-আব্রুর নিরাপত্তা সাধন অন্য মুসলমানের ওপর ফরয। কুরআন কারীমে বহু আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে মানুষের মর্যাদা ও সম্মানহানি করতে নিষেধ করছেন। যেমন, গিবত বা পরনিন্দা না করা, অপবাদ না দেওয়া, গালি না দেওয়া, কটুক্তি না করা ইত্যাদি। বরং নির্দেশ দিয়েছেন উত্তম আচরণ ও সম্ভাষণ করতে। এসকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা যে লঙ্ঘন করবে, তার মর্মন্তুদ পরিণতির কথাও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। যার মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং শিষ্টাচারসহ অন্যান্য সদগুণাবলি রয়েছে, সে অন্যজনকে অমর্যাদা ও অবমূল্যায়ন করতে পারে না। এজন্য ইসলামে উত্তম আচরণ ও গুণাবলি অর্জন ও পালনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অগণিত হাদীস এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে। ইসলাম ধনী-গরীব, আরব-অনারব, সাদা-কালো নির্বিশেষে সকলেরই ইযযতের মূল্য দিয়েছে। কারো জন্যই কারো সম্মানহানি করার কোনো সুযোগ নেই।
সম্পদের নিরাপত্তাকল্পে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা হল, কারো সম্পদের সরিষা-তুল্য অংশও অন্যায়ভাবে গ্রাস করা, ভোগ-দখল করা জায়েয নেই। অন্যের জিনিস আত্মসাৎ, চুরি, লুণ্ঠন, সুদ-ঘুষ, মিথ্যা দেন-দরবার, দুর্নীতি-ছলচাতুরি, রাষ্ট্রীয় মালামাল দখল এবং দুর্বল ও এতীমের সম্পদ ভক্ষণ ইত্যাদি যত অসদুপায়ে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নেওয়ার প্রচলন রয়েছে, তার প্রায় প্রত্যেকটির ব্যাপারেই কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন চুরি ডাকাতি ও রাহাজানির ক্ষেত্রে হাত ও হাত-পা উভয়টি কাটাসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে। তেমনিভাবে অন্যের অধিকার হরণ করে যত রকম অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন হতে পারে, সেসবকে হারাম করা হয়েছে এবং উপযুক্ত শাস্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি কারো কাছে অন্যের সামান্য পরিমাণ আমানত গচ্ছিত থাকলে তা অবশ্যই হকদারকে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনাও ইতিপূর্বে উল্লেখিত সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যে অন্যের সুঁই সমান সম্পদও জবরদখল করবে, ইসলামী শরীয়তে তারও বিচার-ব্যবস্থা রয়েছে, আর আখেরাতে আল্লাহর পাকড়াও তো রয়েছেই।
এসকল বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ্য় অনেক বিস্তারিত বিধিনিষেধ বর্ণিত হয়েছে। লেখাটির কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় সেসব আয়াত-হাদীস এখানে আর উল্লেখ করা হল না।
ইতিপূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট, সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবচে’ আগে আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করা জরুরি। দ্বিতীয়ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। ইসলামের দণ্ড-বিধান কার্যকর করতে হবে। আল্লাহর বিধিবিধান ও নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বদিক বিচারে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যে জাতি আল্লাহর বিধানাবলি যত ভালোভাবে আঁকড়ে ধরবে, সে জাতি তত বেশি নিরাপদে ও সুখে-শান্তিতে থাকবে। কারণ আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলে দিয়েছেন-
اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ لَمْ یَلْبِسُوْۤا اِیْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمُ الْاَمْنُ وَ هُمْ مُّهْتَدُوْنَ.
যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশ্রিত করেনি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি তো কেবল তাদেরই অধিকার এবং তারাই সঠিক পথে পৌঁছে গেছে। -সূরা আনআম (৬) : ৮২
আল্লাহ তাআলার প্রতি যারা ঈমান রাখে এবং সর্বক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাদেরকে নিরাপদ জীবন দান করবেন। এটা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَعَدَ اللهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِی الْاَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَ لَیُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِیْنَهُمُ الَّذِی ارْتَضٰی لَهُمْ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمْ مِّنْۢ بَعْدِ خَوْفِهِمْ اَمْنًا یَعْبُدُوْنَنِیْ لَا یُشْرِكُوْنَ بِیْ شَیْـًٔا وَ مَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ.
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে নিজ খলীফা বানাবেন, যেমন খলীফা বানিয়েছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তাদের জন্য তিনি সেই দ্বীনকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যে দ্বীনকে তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তারা যে ভয়-ভীতির মধ্যে আছে, তার পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। এর পরও যারা অকৃতজ্ঞতা করবে, তারাই অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। -সূরা নূর (২৪) : ৫৫
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। এর একটা পন্থা এটাও যে, আল্লাহ সে দেশের জনগণকে এমন বানিয়ে দেবেন যে, তারা কারো নিরাপত্তা বিঘ্ন করবে না। আবার তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা এমন শাসক নিয়োগ করে দেবেন, যারা তাদের সবরকম নিরাপত্তা বাস্তবায়নে লিপ্ত ও সচেষ্ট থাকবে। আর নিরাপদ জীবন লাভ করার পরে সকলের কর্তব্য, পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা। এর পরেও যারা অকৃজ্ঞতা ও আল্লাহর বিধান পালনে অবহেলা করবে, তারা নিশ্চিতভাবেই অবাধ্য সম্প্রদায়।
অন্যদিকে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের মনগড়া নীতিতে চলবে, তাদের সাময়িক সুখ সমৃদ্ধি লাভ হলেও ক্রমাগত অবাধ্যতার ফলে একসময় তাদের জীবন থেকে শান্তি বিনষ্ট হয়ে যাবে, নিরাপত্তা বিদূরিত হবে। বস্তুত আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করে কেউ সুখী ও নিরাপদ জীবন লাভ করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলছেন-
وَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا قَرْیَةً كَانَتْ اٰمِنَةً مُّطْمَىِٕنَّةً یَّاْتِیْهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِاَنْعُمِ اللهِ فَاَذَاقَهَا اللهُ لِبَاسَ الْجُوْعِ وَ الْخَوْفِ بِمَا كَانُوْا یَصْنَعُوْنَ.
আল্লাহ এক জনবসতির দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন, যা ছিল নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ। চতুর্দিক থেকে তার জীবিকা চলে আসত পর্যাপ্ত পরিমাণে। অতঃপর তারা আল্লাহর নিআমতের অকৃতজ্ঞতা শুরু করে দিল। ফলে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের। -সূরা নাহল (১৬) : ১১২
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সহজবোধ্য একটি দৃষ্টান্ত পেশ করে বলেছেন, একটি জনপদ ছিল নিরাপদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। কিন্তু কালক্রমে সে জনপদবাসী আল্লাহ তাআলার অকৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতায় ডুবে গেল, আল্লাহর নিআমত ও নির্দেশনা ভুলে গেল এবং নিজেদেরকে আর শোধরাল না। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তির স্বাদ চাখালেন। একদিকে তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দেওয়া হল, অন্যদিকে আক্রমণ ও লুটতরাজের ভয়-ভীতি। এ দুটো বিপদ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আল্লাহর প্রতি তাদের অকৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতামূলক কৃতকর্মের কারণে তাদের সুখও মুছে গেল, নিরাপত্তাও উবে গেল।
আসুন আমরা আমাদের সমাজে বিরাজমান অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি নিরাপদ সমাজ গড়তে সকলে মিলে আদি পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের শিক্ষা মতো আগে আল্লাহ তাআলার কাছে নিরাপত্তার দুআ করি। পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহ্য় বর্ণিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধিবিধান ও নির্দেশনা মেনে চলি।
আমার অবাধ্যতা ও গুনাহের কারণে যেন সমাজ থেকে নিরাপত্তার নিআমত উঠে না যায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকি। আমরা যে উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতায় কালাতিপাত করছি, এ থেকে মুক্তির সমাধান ও উত্তরণের উপায় কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষায়ই রয়েছে। সে শিক্ষা যতদিন আমরা মেনে চলব, নিরাপত্তা ও শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারব। আমাদের সমাজ হয়ে উঠবে নির্ভয় ও নিরাপদ আদর্শ সমাজ।