আল্লাহর অনুগত শাসকের করণীয় ॥
কুরআনের দুটি নির্দেশনা
রাষ্ট্র ও ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তাআলা
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে শাসনব্যবস্থা, শাসক ও শাসিত সম্পর্কে বহু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেসকল দিকনির্দেশনা অবলম্বনেই তৈরি ইসলামী রাজ্য-শাসন নীতিমালা। এর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাগ্রে লক্ষণীয় আয়াতটি হল-
قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِی الْمُلْكَ مَنْ تَشَآءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَآءُ بِیَدِكَ الْخَیْرُ اِنَّكَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ.
(হে নবী, তুমি) বল, হে আল্লাহ! সার্বভৌম শক্তির মালিক! আপনি যাকে চান ক্ষমতা দান করেন, আর যার থেকে চান ক্ষমতা কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে চান লাঞ্ছিত করেন। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ২৬
এ আয়াতে শাসক ও শাসিত সকলের জন্যই হেদায়েত রয়েছে, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ তাআলা। তিনিই বিশ্বজগতের অধিপতি। অনাদি থেকে অনন্ত তাঁরই একচ্ছত্র ক্ষমতা। সমস্ত কিছু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো শাসক বা জনগণ কোনো রাষ্ট্র ও ক্ষমতার মালিক নয়। আল্লাহ তাআলা যখন যাকে চান কোনো অঞ্চলের সাময়িক শাসনক্ষমতা দান করেন।
কাজেই প্রত্যেক শাসককে মনে রাখতে হবে, এ শাসনক্ষমতা আল্লাহ তাআলার দান। আল্লাহ্ই এ শাসনভার দিয়েছেন। তাই শাসকের কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। যথাযথভাবে শোকর আদায়ের পন্থা হল, আল্লাহর চাওয়া ও নির্দেশনা পালন করা। আল্লাহ তাআলা যখন যাকে শাসনক্ষমতা দেন, তিনি চান তাঁর বান্দারা যেন তাঁর প্রতি অনুগত থেকে তাঁরই বিধানাবলি পালন ও মানুষের মধ্যে বাস্তবায়ন করে, তাঁর দ্বীন ও কালিমা প্রতিষ্ঠা করে। তাই শাসককে আল্লাহর অনুগত থেকে তাঁর বিধানাবলি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। যদি তা করা হয়, তাহলেই আল্লাহ তাআলার এ দানের শোকর ও হক আদায় করা হবে। কিন্তু যদি কোনো শাসক তা না করে, বরং আল্লাহর অবাধ্যতা করে নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়ে অন্যায়-অনাচার ও সীমালঙ্ঘন করতে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা একসময় তার থেকে এ ক্ষমতা নিয়ে অন্য কাউকে দান করবেন। যেন পরবর্তীরা আল্লাহর দ্বীন ও কালিমা প্রতিষ্ঠা করে। একই শিক্ষা পরবর্তীদেরকেও মনে রাখতে হবে- এ ক্ষমতা তাদের জন্যও সাময়িক। আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করলে তিনি যে কোনো সময় তাদেরকে এ দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে আবার অন্য কাউকে তা দান করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই চলে আসছে। আল্লাহ তাআলার নীতি হল, আল্লাহর নেক বান্দাগণই যমীনে শাসনভারের প্রকৃত হকদার। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَقَدْ كَتَبْنَا فِی الزَّبُوْرِ مِنْۢ بَعْدِ الذِّكْرِ اَنَّ الْاَرْضَ یَرِثُهَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوْنَ
আমি যাবুরে উপদেশের পর লিখে দিয়েছিলাম, ভূমির উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দাগণ। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৫
সুতরাং কুরআন কারীমের বার্তা অনুযায়ী নেককার ব্যক্তিই শাসনক্ষমতার প্রকৃত হকদার। অতএব যে নেককার নয়, তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে থাকা একরকম জবরদখল। তার যোগ্যতা নেই, অধিকার নেই, তবুও সে এই পদে বসে আছে। তার উচিত স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে নেককার ব্যক্তির কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করা। অথবা কালবিলম্ব না করে নিজেকে শুধরে নেওয়া। নেককার হয়ে যাওয়া। সুতরাং বোঝা গেল, শাসনক্ষমতার বিষয়টি কেবল দুনিয়াবী বিষয় নয়; বরং এর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান রাখে, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই একসময় তাদেরকে বিজয়ী করবেন, শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন। এটা আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি। কুরআন কারীমে তিনি ইরশাদ করেন-
وَعَدَ اللهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِی الْاَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَ لَیُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِیْنَهُمُ الَّذِی ارْتَضٰی لَهُمْ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمْ مِّنْۢ بَعْدِ خَوْفِهِمْ اَمْنًا یَعْبُدُوْنَنِیْ لَا یُشْرِكُوْنَ بِیْ شَیْـًٔا وَ مَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ.
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে নিজ খলীফা বানাবেন, যেমন খলীফা বানিয়েছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তাদের জন্য তিনি সেই দ্বীনকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যে দ্বীনকে তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তারা যে ভয়-ভীতির মধ্যে আছে, তার পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। এর পরও যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। -সূরা নূর (২৪) : ৫৫
আল্লাহর অনুগত শাসকের করণীয়
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেছেন, যারা যমীনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎকাজে বাধা দেবে এবং নামায রোযা যাকাত ইত্যাদি দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদিসহ আল্লাহ তাআলার যাবতীয় বিধিবিধান বাস্তবায়ন করবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন। অপরদিকে যারা জমিনে অশান্তি বিস্তার করবে, অনাচার ও পাপাচার ছড়িয়ে বেড়াবে, জোর-জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে একসময় ধ্বংস করে দেবেন। কারণ যাদের চারিত্রিক অবক্ষয় ও মানবিক বিপর্যয় ঘটে, এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা অনিবার্যভাবে তাদের জাগতিক মান-মর্যাদাও কেড়ে নেন। এ দুই শ্রেণির মধ্যে যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি অনুুগত, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَ لِلهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ.
তারা এমন যে, আমি যদি দুনিয়ায় তাদেরকে ক্ষমতা দান করি, তবে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে। সব কাজের পরিণতি আল্লাহরই হাতে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৪১
আল্লাহ তাআলার প্রতি যারা আনুগত্যশীল, তারা যখন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে, তখন তাদের করণীয় কী? কিছুটা সংক্ষেপে উপরিউক্ত আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। যদিও আয়াতটি কুফরের বিরুদ্ধে জিহাদের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু আয়াতের মর্ম অনেক ব্যাপক। এর পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ও তাদেরকে সাহায্য করবেন। কুরআন কারীমের ভাষায় আল্লাহকে সাহায্য করার অর্থ, তাঁর বান্দাদেরকে সাহায্য করা এবং তাঁর দ্বীনকে যমীনে প্রতিষ্ঠা করা। যারা আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে, তারা আল্লাহর অনুগত বান্দা। আল্লাহ তাঁর এই অনুগত বান্দাদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় উপায়ে সাহায্য পেতে থাকবে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের কর্তব্য- নামায রোযা যাকাত ইত্যাদি দ্বীনের মৌলিক বিধানাবলি পালনকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করা। সৎকাজের আদেশ করা ও অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া। নিজেরাও ফেতনা-ফাসাদ না করা, অন্যদেরকেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে ও ছড়াতে না দেওয়া। এভাবে মুসলিম সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, গড়ে উঠবে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের বন্ধন।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ- মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। এই উম্মতের এক শ্রেণির মানুষ তা নিষ্ঠার সাথে সর্বদা পালন করে বিধায় এ উম্মত এই দিক থেকেও অপরাপর উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন-
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ.
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১০
কাজেই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ছেড়ে দিলে আল্লাহ প্রদত্ত একটি গুরুদায়িত্বে চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হবে এবং এ উম্মত অন্যান্য সম্প্রদায় অপেক্ষা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের একটি দিক হারাবে। কাজেই সরকারের কর্তব্য, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ-এর দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে তদারকি করা। সরকারের একটি বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থাকবে, যারা সমাজের সর্বস্তরে আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ)-এর কাজ পরিচালনা করবে। আর এ কথা তো বলা বাহুল্য, সৎ ও অসৎ কাজের মানদণ্ডের একমাত্র নির্ধারক আল্লাহ তাআলা। তাঁর নীতি-নির্ধারণ অনুযায়ীই ন্যায় ও অন্যায় কাজের বিচার-বিবেচনা হবে।
ইনসাফ রক্ষা করা, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন না করা
আল্লাহর অনুগত শাসকের আরেকটি কর্তব্য হল, ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। কোনো অবস্থায়ই নিজেরাও জুলুম ও সীমালঙ্ঘন না করা, আবার জনগণের মধ্যেও শক্তিমান যেন দুর্বলের ওপরে নিপীড়ন-নির্যাতন করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া। সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা। এমনকি নিজে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার পরে ক্ষমতা লাভ হলে জালেমের ব্যাপারেও প্রতিশোধ পরায়ণ না হওয়া। হয়তো ক্ষমা প্রদর্শন করা, অথবা ইনসাফ-সম্মতভাবে বিচার করা। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে ইরশাদ করেন-
وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ اَنْ صَدُّوْكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اَنْ تَعْتَدُوْا وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ شَدِیْدُ الْعِقَابِ.
তোমাদেরকে মসজিদে হারামে (প্রবেশ করতে) বাধা দিয়েছিল- এই কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি তোমাদের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে (তাদের প্রতি) সীমালঙ্ঘন করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২
মসজিদে হারামে ইবাদত করা যে কত বড় প্রাপ্তি তা প্রত্যেক মুমিনেরই জানা রয়েছে। সে মসজিদে হারামে ইবাদত এমনকি তাতে প্রবেশ করতেও যারা দিনের পর দিন বাধা দিয়েছিল, অকথ্য নির্যাতন করেছিল, সেইসব কাফের-মুশরিকদের প্রতিও আল্লাহ তাআলা জুলুম করতে ও প্রতিশোধ পরায়ণ হতে নিষেধ করেছেন। এটাই ইসলামের মহা আদর্শিক শিষ্টাচার।
অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِیْنَ لِلهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوْا اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। আর আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। -সূরা মায়েদা (৫) : ৮।
রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার জন্য উক্ত দুই আয়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি বলা হয়েছে। তা হল, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। ইনসাফ-রক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, কারো দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার পরেও তার ব্যাপারে ইনসাফ-লঙ্ঘন করা বৈধ হয়ে যায় না। শত্রুর প্রতিও ইনসাফরক্ষা করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন, কারো প্রতি শত্রুতা যেন কোনো মুসলিমকে ইনসাফ-রক্ষা থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। ইসলাম প্রতিশোধ পরায়ণতা পছন্দ করে না। নির্যাতিত ব্যক্তি প্রতিপত্তির মালিক হলে অনেক সময় জুলুম করে বসে। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, জালেমের বিচার করতে গিয়ে নিজে জুলুম করা যাবে না। অপরাধ অনুযায়ী যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য, ততটুকুই শাস্তি কার্যকর করা যাবে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব, যদি বিচারব্যবস্থা আল্লাহর বিধান অনুসারে হয়। তাহলে মজলুমও তার হক ফিরে পাবে, আর জালেমের প্রতিও অন্যায়-অবিচার করা হবে না। তবে কেউ যদি মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া জুলুমের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে এর বিনিময়ে বিরাট প্রতিদান দেবেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوْا بِمِثْلِ مَا عُوْقِبْتُمْ بِهٖ وَ لَىِٕنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَیْرٌ لِّلصّٰبِرِیْنَ.
তোমরা যদি (কোনো জুলুমের) প্রতিশোধ নাও, তবে ঠিক ততটুকুই নেবে, যতটুকু জুলুম তোমাদের ওপর করা হয়েছে আর যদি সবর কর, তবে নিশ্চয়ই সবর অবলম্বনকারীদের পক্ষে তাই শ্রেয়। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ১২৬
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে আরো বলেন-
وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ اِنَّ اللهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمْ بِهٖ اِنَّ اللهَ كَانَ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا.
যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৫৮
জুলুম আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয়। কিয়ামতের দিন জুলুমকারীর কী মর্মন্তুদ পরিণতি হবে, আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে তা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন। কাজেই আল্লাহর প্রতি যে ঈমান রাখে, সে কিছুতেই জালেম হতে পারে না। আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাগণ পৃথিবীর ইতিহাসে যখনই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন, উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনচরিতেও এ ব্যাপারে অনেক বড় শিক্ষা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসী ও তায়েফবাসীর দ্বারা কত নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু কখনো কারো প্রতি সামান্যতম জুলুমের আচরণও করেননি। বরং তাঁর সারা জীবনের আচরণ ছিল ক্ষমা ও ইনসাফের আচরণ। তিনি ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ وَالٍ يَلِي رَعِيَّةً مِنَ المُسْلِمِينَ، فَيَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لَهُمْ، إِلّا حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الجَنَّةَ.
যে শাসক মুসলমানের ওপর শাসনক্ষমতা লাভ করার পরে খেয়ানতকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০২৯১
যে শাসক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের প্রতি অন্যায় করবে, আল্লাহর দ্বীন ও বিধানাবলির ব্যাপারে খেয়ানত করবে, জুলুমের শাসন কায়েম করবে, তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَنْصُرُهٗ إِذَا كَانَ مَظْلُومًا، أَفَرَأَيْتَ إِذَا كَانَ ظَالِمًا كَيْفَ أَنْصُرُهٗ؟ قَالَ: تَحْجُزُهٗ، أَوْ تَمْنَعُهٗ مِنَ الظُّلْمِ، فَإِنَّ ذٰلِكَ نَصْرُهُ.
তোমার ভাই জালেম হোক বা মজলুম সর্বাবস্থায় তাকে সাহায্য কর।
একজন জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে যখন মজলুম হবে, তখন তাকে আমি সাহায্য করব (তা বুঝতে পেরেছি)। কিন্তু সে যখন জালেম হবে, তখন তাকে কীভাবে সাহায্য করব?
তিনি বললেন, তাকে জুলুম করা থেকে বাধা দেবে। এটাই হল তাকে সাহায্য করা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩০৭৯
রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস থেকে স্পষ্ট, জালেমকেও সাহায্য করা আবশ্যক। জালেমকে সাহায্য করার অর্থ হল, তাকে জুলুম করতে না দেওয়া। এটা এক মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অন্য মুসলিম ভাইয়ের কর্তব্য, মজলুম হওয়া থেকেও বাঁচানো, আবার জালেমও না হতে দেওয়া। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এ শিক্ষা বাস্তবায়ন করলে সমাজে বহুলাংশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানির অবসান ঘটানো সম্ভব। সেইসঙ্গে সূরা মায়েদার উল্লিখিত আয়াতের নির্দেশনা -‘পরস্পর ভালো কাজ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। গুনাহ ও জুলুমে সহযোগিতা না করা’- মেনে চললে সমাজ থেকে সব ধরনের অনাচার ও বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে যাবে। এক ভাইয়ের প্রতি অপর ভাইয়ের প্রকৃত সাহায্য ও কল্যাণকামিতার পরিচয় হল, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানাবলি মেনে চলতে ও আখেরাতে সাফল্য লাভ করতে পথনির্দেশ করা।
সবশেষে সূরা শূরার কিছু আয়াত উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করছি, যে আয়াতগুলোতে আল্লাহর অনুগত ক্ষমতাসীন ও শাসিত সকলের জন্যই শিক্ষার অনেক উপকরণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَمَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنْ شَیْءٍ فَمَتَاعُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ مَا عِنْدَ اللهِ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَلٰی رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ، وَ الَّذِیْنَ یَجْتَنِبُوْنَ كَبٰٓىِٕرَ الْاِثْمِ وَ الْفَوَاحِشَ وَ اِذَا مَا غَضِبُوْا هُمْ یَغْفِرُوْنَ،وَ الَّذِیْنَ اسْتَجَابُوْا لِرَبِّهِمْ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰی بَیْنَهُمْ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ، وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَصَابَهُمُ الْبَغْیُ هُمْ یَنْتَصِرُوْنَ، وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَةٍ سَیِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَ اَصْلَحَ فَاَجْرُهٗ عَلَی اللهِ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَ، وَ لَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ مَا عَلَیْهِمْ مِّنْ سَبِیْلٍ، اِنَّمَا السَّبِیْلُ عَلَی الَّذِیْنَ یَظْلِمُوْنَ النَّاسَ وَ یَبْغُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ،وَ لَمَنْ صَبَرَ وَ غَفَرَ اِنَّ ذٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْاُمُوْرِ.
তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ। আল্লাহর কাছে যা আছে, তা অনেক শ্রেয় ও স্থায়ী তাদের জন্য, যারা ঈমান এনেছে ও নিজ প্রতিপালকের ওপর ভরসা রাখে। এবং যারা বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কর্ম পরিহার করে এবং যখন তাদের ক্রোধ দেখা দেয়, তখন ক্ষমা প্রদর্শন করে। এবং যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়েছে, নামায কায়েম করেছে এবং যাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হয় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকর্মে) ব্যয় করে। এবং যখন তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হয় তখন তারা তা প্রতিহত করে। মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ। তবে যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধনের চেষ্টা করে, তার প্রতিদান আল্লাহর যিম্মায়। নিশ্চয়ই তিনি জালেমদেরকে পছন্দ করেন না। যারা নিজেদের ওপর জুলুম হওয়ার পর (সমপরিমাণে) বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে- এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ। -সূরা শূরা (৪২) : ৩৬-৪৩