কুরআন কারীম থেকে সর্বপ্রথম নিজে হেদায়েত গ্রহণ করুন
(তাফসীর ও উলূমুল কুরআন বিভাগে ইফতিতাহী আলোচনা)
কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার কালাম। কুরআনের গুরুত্ব সবকিছুর ওপরে। কালামে ইলাহীকে যারা নিজেদের ব্যস্ততা ও শগফ বানিয়েছে এবং কুরআন, উলূমুল কুরআন ও তাফসীরুল কুরআন সম্পর্কে বিশেষ পড়াশোনার নিয়ত করেছে- তাদেরকে এর গুরুত্ব সবার আগে অনুধাবন করতে হবে। এরপর এই গুরুত্বই তাকে টেনে নেবে আরো বেশি অধ্যয়ন এবং আরো বেশি অধ্যবসায়ের প্রতি। এর জন্য মেহনত করতে হবে। সাধনা করতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে।
কুরআনের উলূম ও মাআরিফ হল অতলান্ত সমুদ্র। সারাজীবন কুরবান করে দিলেও এর কুল-কিনারা পাবে না-
لَا تَنْقَضِي عَجَائِبُه.
যদিও এর কুল-কিনারা নেই; তবে এখন পর্যন্ত যা লিপিবদ্ধ হয়েছে, তারও বা কতটুকু আমরা পড়ে শেষ করতে পারব!
তাই কাজ হল, গুরুত্বটা অনুধাবন করা এবং লেগে থাকা। উলূমুল কুরআনের যতগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে, যেটা তাফসীলী পড়া জরুরি, সেটা তাফসীলী পড়া, বাকিগুলোর ‘ইজমালি খাকা’ আমাদের যেহেনে পরিষ্কার থাকা। এ বিষয়ে যত বেশি সম্ভব মেহনত ও ফিকির করা।
আমরা কুরআন তিলাওয়াত করি আর তাফসীর পড়ি বা কুরআন বিষয়ে বিশেষ অধ্যয়ন করি- যাই করি, আমাদের জন্য উপরের বিষয়গুলো বিশেষভাবে জরুরি। কারণ আমরা এ বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করব।
কুরআন কারীম প্রথমে নিজের জন্য। সর্বপ্রথম যেন এর হেদায়েত আমার নিজের মধ্যে আসে। একটা আয়াত পড়লাম; এর ওপর আগে নিজে ঈমান আনলাম, নিজের আমলের চিন্তা করলাম। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, এর নূর ও হেদায়েত যেন আমার মধ্যে আসে।
মানুষের মাঝে হেদায়েত ছড়ানো পরবর্তী কাজ। আল্লাহ তাআলা যেন আমার দ্বারা মানুষকে কুরআনের দিকে নিয়ে আসেন এবং কুরআনের হেদায়েত যেন আমি ব্যাপক করতে পারিÑ এ নিয়ত তো থাকবেই। তবে তার আগে নিজের আমলের মধ্যে সেটা নিয়ে আসতে হবে। এটা না হলে খুব একটা ফায়দা নেই।
একই কথা হাদীসের ক্ষেত্রেও। শত শত হাদীস পড়লাম, অথচ আমলের সাথে সম্পর্ক নেই; আমল ভিন্ন রকম। তাহলে তুমি কীসের জন্য হাদীস পড়ছ? শুধু ওয়াজের জন্য? এটা কোনো তালিবে ইলম তো দূরের কথা, মুমিনের শান হতে পারে না।
কাজেই সবার আগে নিয়ত পাকাপোক্ত করতে হবে। কুরআন কারীম আমার জন্য। যখন আয়াতগুলো পড়ছি মনে করতে হবে, এই আয়াতটি মনে হয় আমার জন্যই নাযিল হয়েছে। এখানে আমাকেই সম্বোধন করা হয়েছে। কুরআনের এই ইলম দ্বারা যেন প্রথমে নিজে উপকৃত হই। মানসিকতার মধ্যে এটা থাকা আবশ্যক। তবেই মেহনতটা ফলপ্রসূ হবে। অন্যকে উপকৃত করতে পারব কি না- সেটা অনিশ্চিত। বেশির চেয়ে বেশি হয়তো চেষ্টা করা যাবে। তবে নিজের ওপর তো জোর খাটানো যায়। বলা যায়, আমি নিজে এর ওপর আমল করব ইনশাআল্লাহ।
তাই আমার প্রথম কাজ হল, কুরআন বিষয়ে আগে নিজের ঈমান ও আমল ঠিক করা। বিষয়টা মাথায় রাখলে পড়াশোনা অনেক বেশি উপকারী ও ফলপ্রসূ হবে ইনশাআল্লাহ।
***
শেখা ও শেখানোর সুবিধার জন্য ইসলামের বিষয়গুলোকে আমরা বিভিন্ন শিরোনামে ভাগ করে থাকি। ঈমানিয়াত, ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাকিয়াত ইত্যাদি। এসব কিছুর মা’খাযে আউয়াল বা প্রথম ও প্রধান উৎস কুরআন কারীম।
মুআশারা ও আখলাক বিষয়ে যে হাদীসগুলো আমরা পড়ে থাকি, তিলাওয়াত করার সময় দেখবে, ওই হেদায়েতগুলো কুরআন কারীমেও আছে। কিন্তু সেটার জন্য পূর্ণ কুরআন কারীম তাদাব্বুরের সঙ্গে তিলাওয়াত করে জমা করতে হবে। সব তুমি এক সূরায় পেয়ে যাবে না। যেহেতু হাদীসের অনেক কিতাব বিষয়ভিত্তিক সংকলিত সেহেতু মুআমালাত ও মুআশারাতের কথা আসলে অনেককে দেখা যায়, শুধু হাদীস পেশ করে। এর অর্থ এই নয় যে, বিধানগুলো কুরআন কারীমে নেই। কিন্তু কুরআন থেকে আখ্য ও আহরণ করার জন্য একটু মেহনত করতে হয়। কারণ কুরআন হল, আল্লাহর কালাম। তানযীল। আল্লাহর নাযিল করা কিতাব। কারো রচনা নয়। তার নিজস্ব শৈলী রয়েছে। বিন্যাসেও তার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এর বিন্যাস বিষয়ভিত্তিক নয়। এমনকি তার উপস্থাপনও আইনের মতো নয়। আমাদের ফিকহের কিতাবগুলো বিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক সাজানো। নামায অধ্যায়, ওযু অধ্যায়, যাকাত অধ্যায়, হজ্ব অধ্যায় ইত্যাদি। তাই ফিকহের কিতাবে তুমি যেভাবে মাসআলা খুঁজতে অভ্যস্ত, কুরআন কারীম থেকে ওভাবে তালাশ করলে কিন্তু হবে না। এর জন্য তাদাব্বুরের সঙ্গে বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে হবে, যাতে কুরআন কারীমের মাযামীন যেহেনে হাজির থাকে। তাহলে মনে থাকবে, কোন্ কোন্ সূরার কোন্ কোন্ আয়াতে একই বিষয়ের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে।
‘কাইফিয়াতুস সালাত’ অর্থাৎ এভাবে নামায শুরু করে এভাবে শেষ করতে হয়। হাদীসের মধ্যেও ‘কাইফিয়াতুস সালাত’ উল্লেখ আছে। কিন্তু কুরআন ঠিক এই আন্দাযে বলে না। তার নিজস্ব আন্দায আছে। সেখানে ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমেই বিধান জানিয়ে দেওয়া হয়।
কুরআনের মধ্যে ‘আকর্ষণশক্তি’ আছে, যা মানুষকে নিজের দিকে টেনে নেয়। খুব আপন বানিয়ে নেয়- এমন একটা আন্দাযে কুরআন কথা বলে। এর ভেতর দিয়ে আমাদেরকে কানুনও জানিয়ে দেয়। আখলাকও বলে দেয়। এর ভেতর দিয়ে মুআমালার কথাও বলে ফেলে। আল্লাহ তাআলার নিআমতের বিবরণ দেওয়ার ভেতরে ঈমানের কথাও বলে দেয়। ইবরত হাসিল করার জন্য পেছনের ঘটনা, উপস্থিত ঘটনা, অনেক কিছুই দেখিয়ে দেয়।
কুরআনের আন্দায ও উপস্থাপনভঙ্গি ভিন্ন। কিন্তু মৌলিক সবকিছুই কুরআন কারীমে বিদ্যমান। আখলাকিয়াতের সবকিছুই কুরআনে রয়েছে। এজন্যই উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত ও আখলাকের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেছেন, তোমরা কি কুরআন
পড় না?
অর্থাৎ তিনি যেভাবে চলতেন, সবই কুরআনের মধ্যে আছে। কুরআনে যেভাবে আছে তিনি সেভাবেই চলতেন। এখন আমাদের কাজ খুঁজে খুঁজে বের করা। সীরাত পড়ার সময় দেখতে হবে- এটা কুরআন কারীমের কোন্ আয়াতে আছে, কোন্ আয়াতের সঙ্গে মিলছে- এভাবে নিজে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবে।
মুআমালার বিষয়ে হোক বা অন্য যে কোনো বিষয়েই হোক, যখন তুমি তা ফিকহের কিতাবে পড়বে তখন সেটা কুরআন থেকে বের করার চেষ্টা করবে। ফিকহে তো কুরআন-সুন্নাহর বিধানগুলোই সুবিন্যস্তভাবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ফিকহের মধ্যে ‘আক্দ’-এর কথা বলা হয়েছে। ‘শাহাদাত’-এর কথা বলা হয়েছে। চুক্তির মধ্যে সাক্ষী নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। সাক্ষীদের আমানত রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। কুরআনে খোঁজ করলে দেখা যাবে, কুরআনের মধ্যে স্বতন্ত্র আয়াতই আছে।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ.
হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো। -সূরা মায়েদা (০৫) : ০১
এই ‘আওফূ বিল উকূদ’-এর মধ্যে বর্তমান সময়ের অসংখ্য নতুন নতুন বিষয় দাখিল আছে। এখনকার পৃথিবী আগের পৃথিবীর চেয়ে কায়-কারবারে অনেক বেশি অগ্রসর। আগে মানুষ হালকা-পাতলা কারবার করে শেষ করত। এখন কোনো কারবার করতে গেলে প্রথমে এগ্রিমেন্ট তথা চুক্তি করা হয়। তাতে থাকে বিভিন্ন শর্ত-শরায়েত। যাকে চলমান ভাষায় বলা হয় ‘ট্রামস এন্ড কন্ডিশন’। আন্তর্জাতিক কারবার হোক আর দেশীয় কারবার, সেগুলোতে বিভিন্ন শর্ত ও নিয়মাবলি উল্লেখ থাকে।
ব্যাংকে কেউ একাউন্ট খুলতে গেলে তাকে একটা কাগজ দেওয়া হয়, সেখানে তাবিজের মতো করে ছোট ছোট লেখার কয়েক পাতার কাগজে দস্তখত নিয়ে নেওয়া হয়। অনেকেই পড়ে না। আমি কিন্তু সবই পড়ে দেখি। বিভিন্ন ইলেক্ট্রিক পণ্য বা যন্ত্রাদি কিনতেও বিভিন্ন শর্ত-শারায়েতের কাগজ থাকে। এর মাধ্যমেই মূলত আমি আকদ বা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু শর্ত এ পক্ষ মানবে, কিছু শর্ত ওই পক্ষ মানবে। দুই পক্ষ মিলেই ‘আক্দ’ সম্পন্ন হয়। নিচে লেখা থাকে, প্রথম পক্ষের স্বাক্ষর, দ্বিতীয় পক্ষের স্বাক্ষর। ফার্স্ট পার্টি, সেকেন্ড পার্টি। কখনো থার্ড পার্টিও থাকে। সাথে থাকে সাক্ষীদের স্বাক্ষর। এগুলো এখন সর্বজনস্বীকৃত। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও এভাবে হয়, দেশীয় বিষয়গুলোও এভাবে হয়।
সূরা মায়েদায় আহকাম অনেক; কিন্তু তার প্রথম আয়াতই হল-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ.
আমরা সাধারণ লোকদের সাথে, উদাহরণস্বরূপ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলার সময় বলি, নামায রোযার মাসআলা তো আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে; কিন্তু আমরা যে ব্যবসা-বাণিজ্য করি, এগুলো সম্পর্কেও ইসলামে নির্দেশনা ও বিস্তারিত নিয়ম-কানুন বলা আছে। তখন তাদেরকে বলি, দেখুন! কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত সূরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াত। এক পৃষ্ঠাব্যাপী। এ আয়াতটা কারবার বিষয়েই।
তাদের বলি, আপনি অবাক হবেন, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এমন এমন কথা বলা হয়েছিল, যে কথাগুলো এখনকার পৃথিবী আধুনিক আন্দাযে পেশ করছে! এত বছর আগে কুরআন বলে রেখেছে, তোমরা যখন লেনদেন করবে, লিখে রাখবে। একজন যেন চুক্তিপত্র লিখে দেয়! লেনদেনের সময় সাক্ষী রাখবে! সাক্ষীরা যেন পরবর্তীতে সাক্ষ্য প্রদানে অস্বীকৃতি না জানায়। বলা হয়েছে-
وَ لَا یَاْبَ الشُّهَدَآءُ اِذَا مَا دُعُوْا.
সাক্ষীদেরকে যখন (সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য) ডাকা হবে, তখন তারা যেন অস্বীকার না করে। -সূরা বাকারা (০২) : ২৮২
এখনকার সময়ে চুক্তিতে কোনো ধরনের লঙ্ঘন হলে বিষয়টা আদালতে গড়ায়। আয়াতের এ অংশে আদালতের কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ দুই পক্ষের কেউ যদি কোনো গন্ডগোল করে, তাহলে ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। না-হয় এটা কেন বলা হল-
وَ لَا یَاْبَ الشُّهَدَآءُ اِذَا مَا دُعُوْا.
এটা এজন্যই এসেছে, যখন এক পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে বলবে, তার সাথে আমার এত টাকার চুক্তি হয়েছে, এখন তো সে মাল নিচ্ছে না, অথচ আমি বানিয়ে রেখেছি। আমার মাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন আদালত বলবে, তোমার দলীল-দস্তাবেজ পেশ কর! সাক্ষী-প্রমাণ উপস্থিত কর! আদালত তলব করলে সাক্ষীরা যেন অস্বীকৃতি না জানায়।
এখনকার পৃথিবী এত এত উন্নতি দেখাচ্ছে, কিন্তু মৌলিক যেসব উসূল ও নীতিমালা কুরআন দিয়ে রেখেছে, তা অতিক্রম করতে পারেনি। বরং কুরআন-সুন্নাহ প্রদত্ত নীতিগুলোর ভেতরেই আবর্তিত হয়। এগুলোর আলোকেই তারা বিভিন্ন ‘তাফসীল’ বানায়।
হাঁ, কুরআন কারীমে আহকামের বর্ণনা টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। যা করতে হয়, তা হল কুরআন থেকে ‘ইকতিবাস’-এর যোগ্যতা অর্জন করা।
কুরআন তিলাওয়াতের সময় খেয়াল করতে হবে, আমি এখানে আহকামের কী কী বিষয় পেলাম! এক পৃষ্ঠা পড়েছি, সেখান থেকে আমি কী কী হুকুম পেলাম! ইবাদত সংক্রান্ত হুকুম, মুআমালাত সংক্রান্ত হুকুম। এমনও হতে পারে, পুরো পৃষ্ঠা পড়ে কিছু নসীহত পেলাম অথবা আম্বিয়ায়ে কেরামের কিছু ঘটনা পেলাম; বিধান সংক্রান্ত সরাসরি কিছু পেলাম না। কিন্তু এসব জায়গায় আমরা লক্ষ করব, ঈমান, আখলাক, আদাব ও আফকার বিষয়ক অনেক হেদায়েত আমরা এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে পেয়ে যাচ্ছি, যেগুলোর মাধ্যমে মুমিনের ঈমানী যিন্দেগী ও ইসলামী যিন্দেগীর পুরো নকশা সামনে এসে যায়।
তবে এর মানে এই নয়, এধরনের জায়গাগুলোতে কোনো আহকাম থাকে না। আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলির মধ্যেও অনেক সময় বিভিন্ন হুকুমের আলোচনা থাকে। হালাল-হারামের উল্লেখ থাকে। ঈমান-আকীদার বিষয় তো থাকেই। যেমন হযরত শুআইব আ.-এর কিসসায় বলা হয়েছে-
وَ یٰقَوْمِ اَوْفُوا الْمِكْیَالَ وَ الْمِیْزَانَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْیَآءَهُمْ وَ لَا تَعْثَوْا فِی الْاَرْضِ مُفْسِدِیْنَ.
হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা পরিমাণ ও ওজন ন্যায়সঙ্গতভাবে পূর্ণ করবে। মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দেবে না এবং পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে বেড়াবে না। -সূরা হূদ (১১) : ৮৪
হযরত শুআইব আলাইহিস সালামের গোত্রের লোকেরা ওজনে কম দিত। হযরত শুআইব আ. নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা মানেনি। তাই তাদের ওপর শাস্তিও এসেছিল। এখান থেকে আমরা বিধান পেয়ে গেলাম, ওজনে কম দেওয়া যাবে না। কেউ যদি প্রশ্ন করে, ওজনে কম দেওয়ার নিষেধ কুরআনের কোথায় কোথায় আছে? তাকে উত্তর দেওয়া যাবে যে, অনেক আছে। যেমন-
أَلّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ، وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ.
[যাতে তোমরা পরিমাপে জুলুম না কর। এবং ইনসাফের সাথে ওজন ঠিক রাখ এবং পরিমাপে কম না দাও। -সূরা আর-রহমান (৫৫) : ৮-৯]
وَ اَوْفُوا الْكَیْلَ اِذَا كِلْتُمْ وَ زِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِیْمِ.
[যখন পরিমাপ-পাত্র দ্বারা কাউকে কোনো জিনিস মেপে দাও তখন পরিপূর্ণ মাপে দিও আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৫]
হযরত শুআইব আ.-এর ঘটনাতেও আছে-
وَ لَا تَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَ الْمِيْزَانَ.
[এবং ওজন ও পরিমাপে কম দিও না। -সূরা হূদ (১১) : ৮৪]
যেখানেই হযরত শুআইব আ.-এর কাহিনী আছে, সেখানে এ বিধানটিও আছে।
এছাড়াও আরো অনেক জায়গায় আছে।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাহ্যত যদিও এটা একটা ঘটনা, তবে এখানেও বিধান আছে। তা হল ওজনে কম না দেওয়ার বিধান। শুধু ওজনে কম দেওয়াই নয়; বরং ধোঁকা-প্রতারণার মাধ্যমে বা অন্য যে কোনোভাবে কারো হক নষ্ট করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও এখান থেকে বোঝা যায়।
এজন্য কুরআন পড়ার সময় আমাদেরকে ‘ইকতিবাস’ করতে হবে। এক্ষেত্রে হেদায়েতের আয়াতগুলোর প্রতি আলাদা নযর রাখা। আহকামের প্রতি আলাদা নযর থাকা। আহকামের মধ্যে আবার ইবাদত সংক্রান্ত আহকাম, মুআমালা সংক্রান্ত আহকাম, সবগুলোর প্রতি পৃথক দৃষ্টি রাখা। মুআমালা মূলত ব্যাপক বিষয়। যদিও আমাদের উপমহাদেশে মুআমালা ও মুশাআরা দুই ভাগে ভাগ করা হয়। মুআমালা বলতে অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বোঝানো হয় আর মুআশারা বলতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ বোঝানো হয়। আসলে মুআশারাও মূলত মুআমালার অংশ। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত যত কিছু আছে সবই মুআমালা। আরবদের অনেকে কিতাবের মধ্যে মুআশারা অধ্যায়কে মুআমালাতেই নিয়ে আসে।
***
কুরআন কারীমে অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে, খাস ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে খেতাব করে হুকুম এসেছে, তবে হুকুমটা ব্যাপক। ফুকাহায়ে কেরাম যখন কথা বলেন, সেগুলো টেনে আনেন। আমরা সূরাতুল আহযাবে উম্মাহাতুল মুমিনীনের কথা পড়ি-
وَ قَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰي.
নিজ ঘরে অবস্থান কর (পর-পুরুষকে) সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলী যুগে প্রদর্শন করা হত। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৩৩
ফকীহগণ বলেন, উম্মুল মুমিনীনদের জন্য যদি এই হুকুম হয়, তাহলে অন্যদের জন্য ‘বতরীকে আওলা’ এই হুকুম প্রযোজ্য হবে।
মাওরিদ খাস কিন্তু হুকুম আম; এটা উসূলে ফিকহ ও উসূলে তাফসীরের গুরুত্বপূর্ণ কায়েদা।
***
আরেকটি কথা বলি। যদি নিয়মিত তিলাওয়াত করা হয় এবং খেয়াল করে তিলাওয়াত করা হয়, তাহলে ইসলামের মৌলিক আকীদা এবং মৌলিক বিধানের দলীলগুলো আত্মস্থ হয়ে যাবে। তাহলে ভ্রান্ত চিন্তার লোকেরা, যাদের ব্যাপারে কুরআন الَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ زَيْغٌ বলেছে, তাদের ছড়ানো সন্দেহ-সংশয়ের কারণে এবং কোনো মুলহিদের ইলহাদ ও তাহরীফের কারণে কোনো পেরেশানী হবে না ইনশাআল্লাহ। আমি দুটি বিষয়ের দিকে একটু ইঙ্গিত দিচ্ছি-
এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের মাধ্যমে আগের সব শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে।
সূরা মায়িদার ৪৭ নং আয়াত-
وَ لْيَحْكُمْ اَهْلُ الْاِنْجِيْلِ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ فِيْهِ.
ইঞ্জিল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ তাতে যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে ফায়সালা করে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৭
এ আয়াতের মর্ম হল, আহলে ইঞ্জিল সত্য কথা বলুক। ইঞ্জিলে যা আছে, সবকিছুর ওপর যেন তারা ঈমান আনে, গ্রহণ করে এবং আমল করে।
যে ইঞ্জিল আল্লাহ নাযিল করেছেন সেখানে আছে, আখেরী যমানায় শেষ নবী আগমন করবেন। তাঁকে মানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে।
এর মানে ইঞ্জিলের অনুসারীরা যদি সত্যিই আল্লাহর নাযিলকৃত ইঞ্জিল অনুসরণ করতে চায়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদেরকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর শরীয়ত মানতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এর দ্বারা শেষ নবীর শরীয়ত ইঞ্জিলের যেসব বিধান রহিত করে দিয়েছে, সেগুলো স্বয়ংক্রিভাবেই রহিত হয়ে যাবে। কারণ ইঞ্জিলে যেখানে শেষ নবীর ওপর ঈমান আনা এবং তাঁর অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে একথাটা এমনিতেই আছে; এটা আবার আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। কারণ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করলে তিনি ইঞ্জিলের যেসব বিধান বহাল রাখবেন, সেগুলো থাকবে, যেগুলো বহাল রাখবেন না, সেগুলো রহিত হয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নতুন বিধান তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবে।
এ ধরনের কিছু বিষয় আছে, যেগুলো খেয়াল করে পড়তে হয় এবং সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হয়। তাহলে দেখবে, কোনো বিভ্রান্তকারী এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তোমার সামনে কাউকে ঈসাইয়্যাতের দাওয়াত দিতে পারবে না।
দুই. ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম এবং আখেরী নবীর শরীয়ত সফলতা ও মুক্তির একমাত্র মানদণ্ড
এরকমভাবে অনেককে দেখবে, উদারতার নাম দিয়ে শরীয়তকে অস্বীকার করে বসে। কেউ কেউ সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তকে জরুরি মনে করে না। এসব কুফরী আকীদা-বিশ্বাস লালনকারী লোকদেরও দেখবে, বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের অপব্যাখ্যা করে। তাদের অনেকেই বলে, কেবল আমার ধর্মকেই কেন সত্য মনে করতে হবে? তাদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্ম আর চার মাযহাবকে একই পর্যায়ের মনে করে। অর্থাৎ চার মাযহাবের কোনো এক মাযহাবের ওপর আমল করলে যেমন হয়ে যায়, ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা। হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী যেমন, ইহুদী, নাসারা, মাজূসী ও তেমন। চার মাযহাবের সবাই যেমন সত্য, কেউ বাতিল নয়; বিভিন্ন ধর্মের ক্ষেত্রেও তাদের একই চিন্তা। তাদের কাছে সব ধর্মই ঠিক। নাউযু বিল্লাহ।
শিক্ষিত শ্রেণির অনেকেই আছে এই মেযাজের। ভারতে এক ব্যক্তি এই মেযাজের ছিল। ‘আহসানুল ফাতাওয়া’-এর প্রথম খণ্ডে এ বিষয়ে দুটি রিসালা আছে-
১. گاندھي کو مسلمان سمجھنا کفر ہے
(খ. ১, পৃ. ৫৯-৬৫)
২. مسلمان کى تعرىف
(খ. ১, পৃ. ৬৬-৭২)
ইমদাদুল ফাতাওয়াতেও এ বিষয়ে একটি রিসালা আছে-
توحىد الحق
(খ. ৪, পৃ. ৬৫৬-৬৮৪)
সবগুলো রিসালাই পড়ে নেওয়ার মতো।
কত স্পষ্ট মুহকাম আয়াত রয়েছে কুরআন কারীমে, যাতে আছে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র ধর্ম ইসলাম। এবং যাতে আছে, আখেরী নবীর শরীয়ত অনুসরণ ছাড়া হেদায়েত ও নাজাতের কোনো রাস্তা নেই। কুরআনের শত শত আয়াতের অকাট্য বার্তা হল, আকীদা ও বিধান থেকে চলাফেরা ও চালচলনের নিয়মনীতি পর্যন্ত এবং ব্যক্তি-জীবন থেকে রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রসহ সকল অঙ্গনে শরীয়তের যাবতীয় বিধান গ্রহণ করার নামই হল ইসলাম ও ঈমান। এখন কেবল একটি আয়াত তিলাওয়াত করছি-
وَ اَنِ احْكُمْ بَیْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ وَ احْذَرْهُمْ اَنْ یَّفْتِنُوْكَ عَنْۢ بَعْضِ مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ اِلَیْكَ ؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ اَنَّمَا یُرِیْدُ اللّٰهُ اَنْ یُّصِیْبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوْبِهِمْ ؕ وَ اِنَّ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ لَفٰسِقُوْنَ
এবং (আমি আদেশ করছি যে,) আপনি মানুষের মধ্যে সেই বিধান অনুসারেই বিচার করবেন, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন, পাছে তারা আপনাকে এমন কোনো বিধান থেকে বিচ্যুত করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ তাদের কোনো কোনো পাপের কারণে তাদেরকে বিপদাপন্ন করার ইচ্ছা করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ফাসিক। -সূরা মায়েদা (৫) : ৪৯
এখানে নবীকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস, তার মাধ্যমে আপনি ফয়সালা করুন।
بَیْنَهُمْ
তাদের মধ্যে।
সিয়াক-সিবাক (পূর্বাপর) থেকে স্পষ্ট, এখানে بَیْنَهُمْ দ্বারা প্রথম উদ্দেশ্য হল আহলে কিতাব এবং অমুসলিম সম্প্রদায়। অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রে যে সকল অমুসলিম আইনসম্মত নাগরিক হয়ে বসবাস করে, যাদেরকে ফিকহের পরিভাষায় ‘যিম্মী’ বলা হয় তাদের মাঝে ফায়সালা করার সময়ও আপনি ইসলামী বিধান অনুসারেই রায় দেবেন।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলছেন-
وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ.
‘তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না।’
এখন যেমন বলে, আন্তর্জাতিক আইন এরকম। আমাদের সংবিধান একথা বলে। আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না।
কিন্তু কুরআন বলছে, না, রাষ্ট্রীয় নীতিমালার ক্ষেত্রেও তোমাকে مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ -এর ভেতরেই থাকতে হবে। مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ -এর নীতির খেলাফ করা যাবে না।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ احْذَرْهُمْ اَنْ ىَّفْتِنُوْكَ عَنْۢ بَعْضِ مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ اِلَىْكَ.
‘তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকুন, যেন তারা আপনাকে কিছু বিধান থেকেও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন।’
তারা এভাবেও বলতে পারে যে, ইসলামী নীতি আদর্শ থেকে এক-দুইটা সরালে কী আর হবে?
কিন্তু কুরআনের নির্দেশ- না, তাদের কথা শোনা যাবে না।
এরপর আল্লাহ বলছেন-
اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِىَّةِ ىَبْغُوْنَ.
তবে কি তারা জাহিলিয়াতের ফয়সালা চায়?
এখনকার জাহিলিয়াত তার চেয়েও ভয়াবহ!
اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِىَّةِ ىَبْغُوْنَ.
আল্লাহর হুকুম আসার পরও কি তারা তাদের বিচার-আচার, কারবার-দরবার, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন জাহিলিয়াতের মতো রাখতে চায়? সেটাই কি তারা খোঁজ করছে?! কুরআন আসার পরেও?!
ধমকিটা বড় কঠিন!
মোটকথা, এই আয়াতে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে কাফেরদের অনুসরণ না করতে ও তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সুতরাং এরপর আর কুরআনের অন্য কোনো আয়াতের অপব্যাখ্যা করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ থাকল না।
***
যাইহোক, আমি সামান্য কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছি, সেগুলোর প্রতি খেয়াল রাখবে। ফিকহুল কুরআন, হেদায়াতুল কুরআন, আহকামুল কুরআন, তাযকীরুল কুরআন সবগুলো বিষয়ই আমাদের ধীরে ধীরে হাসিল করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা তাওফীক দেওয়ার মালিক।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.