এক টুকরো জমি
সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল। স্নিগ্ধ আলোয় গোটা কুরাইশ নগর যেন ভেসে যাচ্ছিল। এই গ্রামের এত সুন্দর নাম কীভাবে হয়েছে জানা হয়নি আজও। চাঁদের আলোতে এমন স্নাত হওয়ার সুযোগ প্রতি মাসেই আসে। কিন্তু গ্রামে এসেও শহুরে জীবনের বদঅভ্যাস প্রকৃতি উপভোগ করার সুযোগ কমই দেয়।
কাজের তাগিদই সেই রাতে আমাকে চাঁদের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে চাঁদ ও তারার কাছে অনেক দিন আসা হয় না। ঢাকার এই শেষ প্রান্তে বাবা এক টুকরো জমি কিনেছেন। সেই জমি উন্নয়নের ভার পড়েছে আমার ওপর। জমি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। দূরের নদীতে ড্রেজারের বালু আসে বোটে করে। সেই বোট থেকে বালু আসবে জমিতে। বেশ কদিন ধরেই বালু আসবে আসবে করছে। ড্রেজারের মালিক বলেন, সাভারের দিকে নদীতে পানি কম। বোট আটকে যায়। তাই সময় দিয়েও সময় রক্ষা করা যাচ্ছে না।
কখনো তাগাদা দেওয়া হয়। কখনো ওরাই কথা দেয় আজই শুরু হবে। কিন্তু দিন গড়িয়ে রাত ফুরিয়ে যায়, বোটও আসে না, বালুও পড়ে না, জমিও ভরাট হয় না। সে রাতে সত্যি সত্যিই বোট এল। মুহূর্তেই শোঁ শোঁ করে বালু আসতে শুরু করল। দেখতে দেখতেই জমি উঁচু হতে লাগল আর ঢাকায় একটি ঠিকানা হতে যাচ্ছে বলে মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। চাঁদনি রাত, ঢাকায় একটি ঠিকানা হওয়ার দীর্ঘ স্বপ্নের একটু কাছে যাওয়া- সব মিলিয়ে মনের আনন্দটা ছিল বাধভাঙা। পানি-বিধৌত বালু আমাকে স্বপ্নকাতর করে তুলছিল।
আমি হয়তো এমন স্বপ্নাতুরই হয়ে থাকতাম। হয়তো অজপাড়া গাঁয়ের এক টুকরো জমির প্রতি তীর্থের কাকের মতোই তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আল্লাহ আমার হাত ধরলেন। প্রকৃত ও কাক্সিক্ষত স্বপ্নের দিকে আমার ভাবনাকে ঘুরিয়ে দিলেন। পূর্ণিমার চাঁদ। গড়তে থাকা স্বপ্নের বালিয়াড়ি সব ছাপিয়ে আমার মনে হল, পৃথিবীর বুকে সামান্য একটু ঠিকানার জন্য মন এমন উদ্বেলিত। যার জন্য এখনো অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ঠিকানা হলেও এতগুলো ভাই-বোনের মাঝে আমার আর কতটুকুই বা মিলবে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলেও সেটা ভোগ করার ফুরসৎই বা কতটুকু হবে- এসব ভাবনা আমাকে জগতের মোহ কাটিয়ে ওঠার দিগন্তের দিকে নিয়ে চলে। কিন্তু ঢাকায় একটি ঠিকানার স্বাদ দেহ ও মন আবিষ্ট করে রাখে।...
ছোটবেলা মা-বাবার শেখানো যিকিরগুলোর কথা মনে পড়ল-
سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلهِ، وَلا إِلهَ إِلا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَر
-বললে প্রতিটি কালিমার বিনিময়ে জান্নাতে গাছ লাভ হয়। (দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬২)
سُبْحَانَ اللهِ،وبِحَمْدِه
বললে জান্নাতে একটি করে খেজুর গাছ উৎপন্ন হয়। -মুসনাদে বাযযার, হাদীস ২৪৬৮
لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ
-এ যিকিরকে বলা হয়েছে, জান্নাতের ধনভাণ্ডার। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৮৪)
নিস্তব্ধ রাতে, চাঁদের আলোয়, পানি আর বালুর শোঁ শোঁ আওয়াজে মন ভরে হাদীসের বাক্যগুলো পড়লাম। দিলের হালাত একেক সময় একেক রকম থাকে। মনে হল, অনন্তকালের মহা দৌলত লাভ হচ্ছে। প্রতিটি যিকির কবুল হচ্ছে। প্রতিটি বাক্য মহাসৌভাগ্যবান সম্পদশালী করে তুলছে, যে সৌভাগ্য কখনো শেষ হওয়ার নয়, যে সম্পদের কোনো ক্ষয় নেই। পৃথিবীর যেকোনো ঠিকানা যেগুলোর সামনে খুবই তুচ্ছ।
বাসায় ফিরে এসে অনন্তের ঠিকানা জান্নাতে বাড়ি কী করে লাভ করা যায় সেই খোঁজ নিতে লাগলাম। আল্লাহু আকবার! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতের ঠিকানা লাভের কত সুন্দর সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন। নবীজীর প্রতিটি বাণী পড়ছি। আপ্লুত হচ্ছি। একবার পড়ে আবার পড়ছি। বারবার পড়ছি। ঈমানের সাথে চোখ বন্ধ করতে পারলে মানুষ এতই খোশ নসীব!
হাদীসে এসেছে, হকদার হয়েও ঝগড়া ছেড়ে দেওয়া, মজাচ্ছলে বলা মিথ্যা ছেড়ে দেওয়া এবং সুন্দর আচার-ব্যবহার করা জান্নাতে বাড়ি লাভের মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ.
যে ব্যক্তি হকদার হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের বেষ্টনীর মধ্যে একটি ঘরের জিম্মাদার; যে ব্যক্তি তামাশার ছলেও মিথ্যা বলে না, আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের জিম্মাদার। যে ব্যক্তি চরিত্রকে সুন্দর করেছে আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত একটি ঘরের জিম্মাদার। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮০০
জান্নাত লাভের এই তিনটি আমল এতই সহজ যে, না আছে অর্থ খরচ, না করতে হয় সময় ব্যয়। শুধু মনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই এ চিরস্থায়ী ঠিকানার বন্দোবস্ত করা যায়।
আরও কিছু আমল এমন আছে, যেগুলো সামান্য পরিশ্রমের মাধ্যমেই করা যায়। সেসব আমলের প্রতিদানেও জান্নাতে বাড়ি লাভের প্রতিশ্রুতি আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ صَلَّى اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً فِي يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، بُنِيَ لَه بِهِنَّ بَيْتٌ فِي الْجَنَّةِ.
যে ব্যক্তি দিনে-রাতে বারো রাকাত নামায পড়ে, এসবের বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৮
অন্য হাদীসে এই বারো রাকাতের বিবরণ এসেছে-
مَنْ ثَابَرَ عَلَى ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً مِنَ السُّنَّةِ، بُنِيَ لَه بَيْتٌ فِي الْجَنَّةِ، أَرْبَعٍ قَبْلَ الظُّهْرِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الظُّهْرِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْفَجْرِ.
যে নিয়মিত বারো রকাত সুন্নত পড়বে তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করা হবে- চার রকাত যোহরের আগে, দুই রকাত যোহরের পর, দুই রাকাত মাগরিবের পর, দুই রাকাত এশার পর, দুই রাকাত ফজরের আগে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১১৪০
পৃথিবীতে অনেক বেদনা আছে, যেগুলো দেখতে না দেখতে মানুষকে শোকসাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তেমনি একটি বেদনা হল, সন্তানের মৃত্যু। সেই বেদনায় নিজেকে ধরে রাখতে পারলে, এমন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর প্রশংসা করতে পারলে, ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়লে আল্লাহ জান্নাতে ঘর নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
বান্দার সন্তান মারা গেলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা আমার বান্দার ছেলের জান কবজ করেছ।
তাঁরা বলেন, হাঁ।
আল্লাহ বলেন, তোমরা তার হৃদয়ের ফলটি কবজ করেছ।
তাঁরা বলেন, হাঁ।
আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কী বলেছে?
তাঁরা বলেন, আপনার প্রশংসা করেছে আর ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়েছে।
আল্লাহ বলেন, তাঁর জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করো। ঘরের নাম রাখো ‘বাইতুল হামদ’। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০২১
আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামের দৌলতে দৌলতমন্দ করেছেন। এই দৌলতের সঙ্গে হিজরত যুক্ত হলে, জিহাদ যুক্ত হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতের বেষ্টনীর মাঝে, জান্নাতের মাঝখানে এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে ঘরের জিম্মাদারি নিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করছে, হিজরত করছে, আমি সে ব্যক্তির জন্য এমন একটি ঘরের যামিন হলাম, যা জান্নাতের বেষ্টনীর মাঝে, আরেকটি ঘরের, যা জান্নাতের মধ্যভাগে।
যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে, ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আমি তার জন্য যামিন হলাম, এমন ঘরের, যা জান্নাতের বেষ্টনীর মাঝে, আরেকটি ঘরের, যা জান্নাতের মধ্যভাগে এবং আরও একটি ঘরের, যা জান্নাতের সব কক্ষের উপরিভাগে হবে। সে যেখানেই কল্যাণের সন্ধান পায়, সেখান থেকে কল্যাণ সন্ধান করে এবং মন্দ থেকে রক্ষার জন্য যেখানে পলায়ন করা প্রয়োজন পলায়ন করে। সে যেখানে ইচ্ছা মৃত্যুবরণ করুক (উক্ত ফযীলত লাভ করবে)। -সুনানে নসায়ী, হাদীস ৩১৩৩
ইসলামে দান-সদকার গুরুত্ব অপরিসীম। দানের অনেক ক্ষেত্র এবং অনেক ফযীলত রয়েছে। কুরআন-হাদীসে এর বিবরণ রয়েছে অনেক। দানের বড় একটি ক্ষেত্র হল, আল্লাহর ইবাদতের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা। মসজিদ নির্মাণ করলেও আল্লাহ তাআলা জান্নাতে ঘর নির্মাণ করেন। সেই মসজিদ যতই ছোট হোক না কেন। মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلهِ بَنَى اللهُ لَهُ فِي الْجَنَّةِ مِثْلَه.
যে আল্লাহর জন্য মসজিদ বানাবে আমি তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ নির্মাণ করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৩৩
কেউ হয়তো ভাবতে পারে, মসজিদ নির্মাণ তো ব্যয়বহুল ব্যাপার। এত অর্থ তো সবার থাকে না! এর সমাধানও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ بَنَى لِلهِ مَسْجِدًا وَلَوْ كَمَفْحَصِ قَطَاةٍ لِبَيْضِهَا، بَنَى اللهُ لَه بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ.
যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার জন্য কোনো মসজিদ বানায়, যদিও তা কাতাত পাখির ডিম দেওয়ার পরিমাণ জায়গাই হোক না কেন, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৫৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৬১০
এতক্ষণ তো জান্নাতের বাড়ি লাভের আমল দেখলাম। জান্নাতের বাড়ি কেমন হবে তা জানতে মন ব্যাকুল হল। হাদীসে জান্নাতের বাড়ির বিবরণও এসেছে। আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, জান্নাত কী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে?
তিনি বললেন, সোনা-রুপার ইট দিয়ে। একটি রূপার ইট, তারপর একটি সোনার ইট, এভাবে গাঁথা হয়েছে। এর গাঁথুনির উপকরণ সুগন্ধি মৃগনাভি এবং কংকরসমূহ মণি-মুক্তার আর মাটি হল জাফরান। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫২৬
আল্লাহ তাআলা জান্নাতে বাড়ি লাভের আমল দিয়েই ক্ষান্ত হননি। বাড়ির আসবাবপত্র কীভাবে হবে সে আমলও বলে দিয়েছে। সেগুলো খুবই সহজ, খুবই আয়াসহীন। যার বিবরণ লেখার শুরুতে গিয়েছে।
পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণুতা, এখানে ঠিকানা তৈরির জটিলতার বিপরীতে অনন্ত জীবনের ঠিকানা জান্নাতে বাড়ি ও বাড়ির আসবাব লাভের সহজতা বিভোর করে রাখে। নতুন সংকল্পে পৃথিবীকে অন্য রকম লাগে। কেবলই মনে হয়, এই পৃথিবী পরকালের শষ্যক্ষেত্র। করণীয় শুধু সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বেশি বেশি ফসল ফলানো।
اَللّٰهُمَّ أَصْلِحْ لِي دِينِي الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي، وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتِي فِيهَا مَعَاشِي، وَأَصْلِحْ لِي آخِرَتِي الَّتِي فِيهَا مَعَادِي، وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ، وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ.
হে আল্লাহ, আমার আসল সম্বল দ্বীন ঠিক করে দাও, আমার জীবিকার মাধ্যম দুনিয়া ঠিক করে দাও, আমার প্রত্যাবর্তনস্থল আখেরাত ঠিক করে দাও, আমার হায়াতকে নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার মাধ্যম বানাও এবং মৃত্যুকে সকল প্রকার কষ্ট থেকে শান্তি লাভের উপায় বানাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২০
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।