আনওয়ারুল কুরআন : প্রশ্নোত্তর
আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম প্রশ্নোত্তর। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।
প্রশ্ন ১১০. আমি মাদরাসার একজন ছাত্র। একটি বিষয় জানতে চাচ্ছি। ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ণিত হয়েছে-
وَ مَاۤ اُبَرِّئُ نَفْسِيْ اِنَّ النَّفْسَ لَاَمَّارَةٌۢ بِالسُّوْٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّيْ اِنَّ رَبِّيْ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ.
আমার প্রশ্ন হল, এই কথাটি কার? ইউসুফ আলাইহিস সালামের, নাকি যে মহিলা তাকে ফুসলিয়েছিল কথাটি তার?
উত্তর : অনেক মুফাসসির বলেছেন, এটি ইউসুফ আলাইহিস সালামের কথা। কিন্তু ইবনে কাসীর রাহ. এ আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, কুরআন কারীমে ঘটনাটির বর্ণনার ধারিবাহিকতার সাথে বেশি যুক্তিযুক্ত হল, এটি আযীযে মিসরের স্ত্রীর কথা, যে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে মন্দ প্রস্তাব দিয়েছিল। যখন তার ঘটনা সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল, তখন সে সবার উদ্দেশে যা বলেছিল, তা এখানে বর্ণিত হয়েছে। এর পূর্বের আয়াত থেকে বর্ণিত তার বক্তব্য হল-
‘এবার যেহেতু সব ঘটনা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমি স্বীকার করছি যে, আমিই তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করেছিলাম। সে সম্পূর্ণ সত্যবাদী ও নিরপরাধ। আমি একথা এজন্য স্বীকার করেছি, যাতে আমার স্বামী বুঝতে পারে, আমি তার অনুপস্থিতিতে বড় কোনো খেয়ানত করিনি।’
অথবা ‘আমি একথা এজন্য স্বীকার করছি, যেন ইউসুফ বুঝতে পারে, সে যখন জেলে ছিল, তখন তার অনুপস্থিতিতে আমি তাকে দোষারোপ করিনি। তবে আমি এ দাবিও করি না, আমার মন পবিত্র, আমি নির্দোষ। কারণ, মন তো পাপের দিকে আকৃষ্ট হয়েই থাকে।’ [দ্র. সূরা ইউসুফ (১২) : ৫১-৫৩]
আবূ হাইয়ান রাহ.-সহ আরো কোনো কোনো মুফাসসির এ মতকেই সমর্থন করেছেন।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর : তাফসীরে মাওয়ারদী, তাফসীরে ইবনে কাসীর, আলবাহরুল মুহীত, আলইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর, তাফসীরে উসমানী।
প্রশ্ন ১১১. জান্নাতী নারীদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে-
اِنَّاۤ اَنْشَاْنٰهُنَّ اِنْشَآءً فَجَعَلْنٰهُنَّ اَبْكَارًا.
[নিশ্চয়ই আমি সে নারীদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছি এবং তাদেরকে বানিয়েছি কুমারী। -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৩৫-৩৬]
এ আয়াতের তাফসীরে একটা ঘটনা কয়েকবার শুনেছি। সংক্ষেপে ঘটনাটি এরকম, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক মহিলাকে বলেছেন, বৃদ্ধারা জান্নাতে যাবে না। এ কথা শুনে সে বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বৃদ্ধাকে উক্ত আয়াত শুনিয়ে বললেন, বৃদ্ধাদেরকে যুবতী বানিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
আমার প্রশ্ন হল, উক্ত ঘটনা কি ঠিক? এটি কোন্ কিতাবে আছে?
উত্তর : হাঁ, ঘটনাটি সঠিক। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক বৃদ্ধা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য দুআ করুন, আল্লাহ যেন আমাকে জান্নাত দান করেন। নবীজী তাকে বললেন, বৃদ্ধারা তো জান্নাতে যাবে না।
একথা শুনে সে বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করলেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নারীগণ বৃদ্ধা অবস্থায় জান্নাতে যাবে না। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতে নব যৌবন দান করবেন। তারপরে তিনি উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করলেন।
ঘটনাটি একাধিক সূত্রে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তবে হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় এ হাদীস মুরসাল। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ. থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এটি বর্ণিত, তিনি এ হাদীস সরাসরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন।
(দ্র. শামায়েলে তিরমিযী, হাদীস ২৪০; আয্যুহদ, হান্নাদ ইবনুস সারী, হাদীস ২৪; আলবা‘ছু ওয়ান নুশূর, বাইহাকী, হাদীস ৩৩২, ৩৩৫; তাখরীজু আহাদীসিল কাশ্শাফ ৪/৪০৫-৪০৭। আরো দ্রষ্টব্য : সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর, তাফসীরে তবারী, তাফসীরে বাগাবী।)
প্রশ্ন ১১২. ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদেরকে হাওয়ারী বলা হয় কেন?
উত্তর : হাওয়ারী (حواري) শব্দের অর্থ সঙ্গী, বন্ধু, সাহায্যকারী ইত্যাদি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِيًّا، وَإِنَّ حَوَارِيَّ الزُّبَيْرُ بْنُ العَوَّامِ.
প্রত্যেক নবীরই সঙ্গী বা সাহায্যকারী রয়েছে, আর আমার সঙ্গী বা সাহায্যকারী হল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৮৪৬, ২৮৪৭, ২৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪১৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস অনুযায়ী প্রত্যেক নবীর বিশেষ এক বা একাধিক সঙ্গী তাঁদের হাওয়ারী। এ হিসেবে ঈসা আলাইহিস সালামের নিষ্ঠাবান বিশেষ সঙ্গীগণও তাঁর হাওয়ারী।
সূরা আলে ইমরানের ৫২ নম্বর আয়াতে তাদের কথা বর্ণিত হয়েছে, যখন ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর অনুসারীদেরকে বললেন-
مَنْ اَنْصَارِيْۤ اِلَي اللهِ قَالَ الْحَوَارِيُّوْنَ نَحْنُ اَنْصَارُ اللهِ اٰمَنَّا بِاللهِ وَ اشْهَدْ بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ.
‘কে কে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী হবে?’
তখন হাওয়ারীগণ বললেন, আমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনি সাক্ষী থাকুন, নিশ্চয়ই আমরা অনুগত।
হাওয়ারী (حواري) শব্দের আরেকটি অর্থ ‘ধোপা’।
কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথম দিকের অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ ধোপা ছিলেন। তাদেরকে হাওয়ারী বলা হত। তাদের সাথে মিলিয়ে ঈসা আলাইহিস সালামের ঘনিষ্ঠ অন্যান্য অনুসারীগণকেও হাওয়ারী বলা হয়। (দ্র. সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর : তাফসীরে কুরতুবী, যাদুল মাসীর, তাফসীরে ইবনে কাসীর, লুগাতুল কুরআন, আবদুর রশীদ নুমানী ২/২৯৫)