কোটা বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা
এজাতীয় বিপর্যয়ে প্রয়োজন ধৈর্যধারণ ও আল্লাহমুখী হওয়া
চলতি জুলাই মাসে বাংলাদেশ সম্মুখীন হয়েছে চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির। ছাত্র সমাজের কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা তৈরি হয়, তাতে ঝরে গেছে অসংখ্য শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষের প্রাণ। এমনকি একাধিক পুলিশ সদস্যও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। আর ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে অনেক সরকারি স্থাপনায়। অর্থাৎ জানের সাথে সম্পদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেশের সকল প্রকার ইন্টারনেট। জারি করা হয়েছে কারফিউ। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা—বাণিজ্যসহ মানুষের সকল প্রকারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একদিকে নিরাপত্তাহীনতা, ভয় ও শঙ্কা অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা-উভয় সংকটের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে মাতৃভূমির আম জনতা। স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। হাজার হাজার যখমী লোক এবং রাষ্ট্রের হাতে বন্দিদের আত্মীয়-স্বজনকে পোহাতে হচ্ছে বর্ণনাতীত হয়রানি ও দুর্দশা। অন্যদিকে সরকারও ভালো নেই। তারা যদি ভালো থাকতেন, তাহলে তো এখন পর্যন্ত কারফিউ বহাল রাখতে হত না। দীর্ঘদিন পরে চালু করা ইন্টারনেটের গতিও কমিয়ে রাখতে হত না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রাখা হত না। এর মানে কারো অবস্থাই ভালো নয়।
এ ভয়াবহ সংকট থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় একটিই। আমাদের যাদের যে অন্যায় হয়েছে, যারা জুলুমে জড়িয়েছি, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি, যারা জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করেছি তাদের প্রত্যেকেরই তো মনে মনে জানা আছে; সে অপরাধবোধকে মনে জাগ্রত করে খাঁটি দিলে আল্লাহ্র দরবারে তওবা করতে হবে। যে বা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের যখমে ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে। বন্ধ করতে হবে সকল প্রকার হঠকারিতা। বেরিয়ে আসতে হবে আক্রোশ ও প্রতিশোধ-পরায়ণতা থেকে। এমনটি না করলে আল্লাহ কিন্তু বারবার ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ দেন না। সুতরাং কোথায় কোথায় আমাদের ভুল হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
এই যে এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত যেখান থেকে হল, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ২০১৮-এর পরে এ বিষয়ে পরিস্থিতি তো শান্তই ছিল। বিপর্যয় শুরু হল গত মাসে হাইকোর্টের কোটা বহাল করে দেওয়া রায়ের পর থেকে। উন্নত অনেক রাষ্ট্রে আদালতের রায়ের গঠনমূলক পর্যালোচনার আইনগত সুযোগ থাকলেও আমাদের মতো দেশগুলোতে অল্পতেই আদালত অবমাননার রুল জারি হয়ে যায়। বিগত দিনগুলোতে উচ্চ আদালতের কোনো কোনো সম্মানিত বিচারককে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের স্যালুট না দেওয়ার অপরাধে রুল জারি করতে দেখা গেছে। অন্য আরেকজন বিজ্ঞ বিচারক বিমানে তার পরিবারের লোকদের যথাযথ প্রটোকল না পাওয়ার জন্য সেখানেই এজলাস বসিয়ে আদালত অবমাননার রুল জারির হুমকি দিয়েছিলেন। সুতরাং আদালত নিয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না। আর অবমাননার তো প্রশ্নই আসে না। আমরা তো মুসলমান হিসেবে কোনো সাধারণ ব্যক্তিরও অসম্মান বা অবমাননা বৈধ মনে করি না। কিন্তু কিছু কিছু রায় যে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে যায়, তা তো এবারের ঘটনাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
যাইহোক, দেরিতে হলেও আপিল বিভাগ রায়টি বাতিল করে আন্দোলনকারীদের দাবির পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই যে রায়ের বিষয়গুলো, এগুলো কিন্তু নতুন নয়। এর আগেও হাইকোর্টের একজন বিচারক তালাকপ্রাপ্তা নারীর খোরপোশ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী রায় দিয়েছিলেন। এমন আরেকটি রায় দেওয়া হয়েছিল সকল প্রকার ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে। যার কারণে দেশব্যাপী গণ আন্দোলনও হয়েছিল। পরে অবশ্য আপিল বিভাগে দুটি রায়ের কোনোটিই টেকেনি। এ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশেই এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়েও অতি উৎসাহী রায়ের প্রবণতা দেখা যায়। অনেক সময় রাজনীতির ময়দানে বা পালার্মেন্টে সমাধা হওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়েও অতি উৎসাহী রায় এসে থাকে এবং এর ফলে পরবতীর্তে কেউ কেউ ঐ রায়ের সুবিধাভোগীদের থেকে বিভিন্নভাবে পুরস্কৃতও হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া ব্যক্তিত্ব বহু বছর থেকেই আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে আছেন। আমরা কারো সম্মান খাটো করতে চাই না। উদাহরণও বাড়াতে চাই না। শুধু এতটুকু আরজ করতে চাই যে, অনেক রায় অনুকূল মনে হলেও পরিণামে তা প্রতিকূলতাও ডেকে আনে। এসব বিষয়ে আমরা যত বেশি সতর্ক ও সংশোধিত হব ততই নিজের জন্য, দেশের জন্য ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। চলুন সততা, নিষ্ঠা ও আত্মসমালোচনার পথে অগ্রসর হই। মুক্তির এটিই একমাত্র পথ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।