ফিরে আসার গল্প
‘অতীতের কথা ভেবে চোখ ভিজে আসে
যাকে নবী বিশ্বাস করতাম, ভদ্র মানুষও গণ্য করা যায় না তাকে!’
[ইরফান মাহমুদ বারক সাহেব একজন শিক্ষিত সংগ্রামী যুবক। যিনি কাদিয়ানীবাদের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামের আলোয় প্রবেশ করেছেন। খুবই বেদনাদায়ক গল্প তাঁর। আল্লাহর রহমতে তিনি, তাঁর মা ও এক ভাইকে ইসলামে দীক্ষিত করেছেন। তার পরিবার এবং পুরো কাদিয়ানী সম্প্রদায় তার জানের শত্রু। কিন্তু জীবনের পরোয়া না করে তিনি তাদের কাছে হকের দাওয়াত ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি একজন প্রসিদ্ধ লেখকও বটে। খুব চমৎকার ও পরিশীলিত গদ্য লেখেন। বহমান নদীর মতো তার কলম এগিয়ে চলে। এ কলম সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষে পুষ্প হয়ে বর্ষিত হয়। কাদিয়ানীবাদের ওপর অগ্নি বর্ষণ করে। আর মির্যা কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে এ কলম পরিণত হয় জ্বলন্ত উল্কায়।
ইরফান মাহমুদ বারক কাদিয়ানীবাদের ওপর প্রথম প্রতিশোধ নিয়েছেন ‘কাদিয়ানিয়াত ইসলাম ও সাইন্স কে কাঠরে মে’ (ইসলাম ও বিজ্ঞানের কাঠগড়ায় কাদিয়ানীবাদ) নামক গ্রন্থ রচনা করে। এ বইতে তিনি বিশেষ বিবেচনায় ইসলামী উদ্ধৃতি কম দিয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ বেশি উল্লেখ করেছেন। বৈজ্ঞানিক এ রেফারেন্সগুলোর প্রায় নব্বই ভাগ অমুসলিম ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের। বইটিতে তিনি নিজের ইসলাম গ্রহণের ঈমানদ্বীপ্ত বৃত্তান্তও তুলে ধরেছেন। পাঠকবর্গের সামনে তার ফিরে আসার গল্পের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হল।
ভাষান্তর ও টীকা—মাওলানা মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম]
আমার জন্ম এক কাদিয়ানী পরিবারে। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে চারপাশে কাদিয়ানীই দেখেছি। মা কাদিয়ানী, বাবা কাদিয়ানী, ভাই কাদিয়ানী, বোনেরা কাদিয়ানী, দাদা কাদিয়ানী, দাদী কাদিয়ানী, চাচা কাদিয়ানী, ফুফা কাদিয়ানী। মোটকথা, দূর-সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যেও কোনো মুসলমান চোখে পড়েনি। তাই আমিও এ ধর্মত্যাগীদের পরিবেশে বড় হয়েছি।
ছোট বয়সেই কাদিয়ানী আকীদা আমার হৃদয়জগতে প্রবেশ করতে শুরু করে। চৌদ্দ বছর বয়সে আমি পরিপূর্ণ কাদিয়ানী হয়ে যাই। তখন থেকেই আমি আমার সমবয়সীদের ধরে নিয়ে জামাতের পক্ষ থেকে আয়োজিত বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে কাদিয়ানী বানানোর চেষ্টা করতাম।
ছেলেবেলা থেকে আমার বইপাঠের খুব শখ ছিল। কাদিয়ানীবাদ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়বস্তু আমি বেশ কৌতূহল নিয়ে পড়তাম। এতে মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিনি।
আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড়, যা আমাকে নিরপেক্ষ হয়ে ভাবতে শিখিয়েছিল। খতমে নবুওত ও কাদিয়ানীবাদের খণ্ডন নিয়ে অধ্যয়ন করতে আকৃষ্ট করেছিল। তা ছিল আমার ও আমার পরিবারের সাথে আমাদের মহল্লাবাসীর কঠোর ব্যবহার। প্রতিবেশীরা কোনো সময় আমাদের বাড়িতে কিছু পাঠাত না। মহল্লায় কেউ আমাদের সুখ-দুঃখে শরীক হত না। আমরা মহল্লায় কারো সুখ-দুঃখে শরীক হতে চেষ্টা করলে আমাদের বের করে দেওয়া হত। আমার দাদা-দাদি মারা গেলে পাড়ার কেউ তাদের চেহারা পর্যন্ত দেখতে আসেনি। মানুষ আমাদের পরিবারের লোকদের প্রতি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাত। এমনকি কোনো কোনো আবেগী মুসলমান যাওয়ার পথে আমাদের ঘরের দিকে সজোরে থুথু ফেলত। আমার মাঝেমধ্যে মনে হত, আমাদের বাড়ি যেন বাড়ি নয়;
ময়লার ডিপো।
মুসলমানদের এ ব্যবহার আমার অস্তিত্বে ঝাঁকুনি দিয়ে যেত। অন্তরে জোরে জোরে করাঘাত করত। একথা ভেবে আমি খুব অবাক হতাম যে, যারা আমাদের ঘৃণা করে, তারা খুবই সম্ভ্রান্ত ও চরিত্রবান লোক; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে খুব কঠোর— এর কারণ কী? আমার অন্তর এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। একপর্যায়ে আমি কাদিয়ানীবাদের খণ্ডনে লিখিত বই-পুস্তক অধ্যয়ন শুরু করি।
এসময় কাদিয়ানীবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী জনাব মুহাম্মাদ তাহের আবদুর রাযযাকের সাথেও আমার যোগাযোগ হয়। বই খুঁজতে খুঁজতে আমি তার বাসায় যাই। তিনি আমাকে পড়ার জন্য প্রচুর বই দেন। আমি নিয়মিত অধ্যয়ন শুরু করি। ডুব দেই জ্ঞান-সাগরে। অধ্যয়নের ফলে আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। হৃদয়ের গ্রন্থিসমূহ একে একে বন্ধনমুক্ত হতে থাকে। ক্রমে বিস্ময়ের অতলে আমি হারিয়ে যেতে থাকি। আমার মনোজগতে মির্যা কাদিয়ানী বিশেষ সম্মান ও মর্যাদায় আসীন ছিল, খতমে নবুওতের আলোকছটায় সে চিরতরে পালিয়ে গেল। আলহামদু লিল্লাহ!
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত ও জীবনী পাঠ করতে লাগলাম। আমার জীবন সুন্দর হতে থাকল। চোখে ইসলামের দ্যুতি জাগল। হৃদয়ে সুগন্ধির পরশ লাগল। ঈমানের সুরভি ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। নতুন জন্ম পেলাম। নব জীবন লাভ করলাম। কাদিয়ানীবাদকে অভিশাপ দিয়ে খতমে নবুওতের আলোয় আলোকিত হয়ে ইসলামের উদ্যানে প্রবেশ করলাম।
আবু জাহেলের পুত্র ইকরিমা রা. সবসময় আল্লাহর শোকর আদায় করে বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার শোকর। তুমি আমাকে বদরের দিন হত্যা করনি।’১ আমিও ভেবে কেঁপে উঠি যে, যদি ইসলাম গ্রহণের আগে আমি মারা যেতাম, তবে আজ আমিও মির্যা কাদিয়ানীর সাথে জাহান্নামে জ্বলতাম। কখনো আমার মুক্তি হত না।
অতীত জীবনের জন্য আমার বড়ই দুঃখ হয়। নিজের অদূরদর্শিতার কথা ভেবে চোখের পানি ফেলি, এমন এক ব্যক্তিকে আমি নবী বিশ্বাস করে গেছি, যাকে একজন ভদ্র মানুষও গণ্য করা যায় না। এমন এক অসচ্চরিত্র ও নীতিভ্রষ্ঠ ব্যক্তিকে ‘প্রতিশ্রুত ঈসা’ ও ‘ইমাম মাহদী’ বিশ্বাস করে এসেছি, যে কোনো অফিসের পিয়ন হওয়ারও যোগ্য ছিল না।
আমার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা কাদিয়ানীদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমার ইসলামে ফেরা বেশ পীড়াদায়ক ছিল তাদের জন্য। এ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য তারা লাহোরে তাদের সবচে বড় কেন্দ্র ও উপাসনালয় দারুয যিকর-এ দলের কর্মকর্তা, মুরব্বি (কাদিয়ানী ধর্মগুরু) এবং আমাদের বাড়ির কয়েকজন দায়িত্বশীলদের একটি বৈঠক ডাকে। বৈঠকে বিভিন্ন কাদিয়ানী মুুরব্বিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমাকে প্রতিদিন আমার ঘরে গিয়ে তালীম দেবে যে, কাদিয়ানীজমই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম। আর মুসলমানদের ইসলাম মিথ্যা! (নাউযুবিল্লাহ।)
এ বৈঠকে দলের কর্মকর্তারা আমার বাবা এবং ভাইদেরকেও খুব তিরস্কার করে বলে, ‘একটা বাচ্চা ছেলেকেও তারা দেখে রাখতে পারল না! শুরুতেই ছেলের ‘বিগড়ে যাওয়াকে’ ধমক-শাসনের যাঁতাকলে পিষে দিলে তার অ-আহমদী হওয়ার সাহস কীভাবে হত!’ তাই আমার বাপ-ভাইদের শাস্তি স্থির করা হল, যেভাবেই হোক এখন আমাকে কাদিয়ানীজমের কালো কূপে ঠেলে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে কঠোর থেকে কঠোর ব্যবস্থাও নিতে হবে, কিংবা বড় বড় লোভও দেখাতে হবে।
বৈঠকের পরপরই কাদিয়ানী ধর্মগুরু এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের মিশন শুরু করে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাদিয়ানী ধর্মগুরু আমাদের বাড়িতে আসতে আরম্ভ করল। সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যয় করে তারা আমাকে বোঝাতে লাগল—
‘কাদিয়ানীবাদ একটি জীবন্ত ধর্ম। এর নাম ইসলাম। আর মুসলমানদের ইসলাম হল মৃত ইসলাম। (নাউযুবিল্লাহ) অতএব যে নাজাতের পোশাক পরতে চায়, সে প্রথমে মির্যা কাদিয়ানীকে আল্লাহর নবী ও রাসূল মনে করবে, তবেই সে জান্নাত পাবে। অন্যথায় কাফের ও
জাহান্নামীই থাকবে।’
আমি যতটুকু পারতাম, কাদিয়ানী ধর্মযাজককে তার কুসংস্কারের জবাব দিতাম। তারা যখন দেখত, কিছুই ফল হচ্ছে না, তখন ফিরে চলে যেত।
একদিকে কাদিয়ানী ধর্মজাযকরা আমার ঈমানের ফুলকলি পিষে ফেলতে মরিয়া, অন্যদিকে পরিবারের প্রতিকূল আচরণ ঝড়ো হাওয়ার মতো আমার হৃদয়ের খতমে নবুওতের দ্বীপশিখা নিভিয়ে দিতে তৎপর। কখনো নির্যাতনের কৌশল অবলম্বন করা হত। কখনো প্রলোভনের অস্ত্র প্রয়োগ করা হত। কখনো বয়কটের ভয়, আবার কখনো সম্পত্তি থেকে ত্যাজ্য করে দেওয়ার হুমকি। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ প্রদত্ত দৃঢ়তার পর্বতের মুখে এই মুরতাদী ঝড়-তুফানের কোনো জোর চলেনি, আমার ঈমান বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ।
আমি মুসলমান হওয়ার পর আমার বাবা বড় বড় কাদিয়ানী মুরব্বিদের ডেকে আমাকে কাদিয়ানীবাদে ফিরিয়ে নিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু আমি বিতর্কে প্রত্যেক মুরুব্বিকে ধরাশায়ী করে ছেড়ে দিতাম। আমার যুক্তির মুখে ওসব মুরব্বি সাঁপ শুকত, প্রমাদ গুনত। তারা এমনভাবে নিরুত্তর হয়ে যেত, যেন তাদের ঠোঁটে নীরবতা সিল করে দেয়া হয়েছে।
কয়েক ডজন কাদিয়ানী মুরব্বি নাকানি-চুবানি খাওয়ার পর একদিন আমার বাবা লাহোরের সবচে বড় মুরুব্বিকে ডেকে আনলেন। মুনাযারা-বিতর্ক শুরু হল। আমি তাকে প্রথম প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি কখনো সিনেমা দেখতে গিয়েছেন?’
‘সিনেমা দেখতে তো বিলাসী ও উশৃঙ্খল লোকেরা যায়। আমার কী কাজ?’ -উত্তর দিলেন মুরব্বি।
আমি সাথে সাথে তাকে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর কথিত সাহাবী ‘মুফতী’ মুহাম্মাদ সাদেকের বই ‘যিকরে হাবীব’ দেখালাম। যাতে লেখা ছিল, মির্যা কাদিয়ানী সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। এ রেফারেন্স দেখে কাদিয়ানী মুরব্বির চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে গেল। কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। তিনি উঠে আমার বাবাকে বললেন, ‘এ কেসটি খুবই বাজে হয়ে গেল। আপনার সন্তান সংশোধনের অযোগ্য।’
এ বলে ওই প্রধান মুরব্বি লেজ গুটিয়ে পালালেন।
যে বিষয়টি ভেবে আমার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ত, বহু রাত অস্থির হয়ে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতাম, তা ছিল, কোনোভাবে আমার পরিবার বিশেষ করে আমার জীবনের সর্বাধিক মহান মানুষ আমার প্রিয় আম্মাজান ইসলামের সুরভিত উদ্যানে প্রবেশ করুক। জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুন থেকে বেঁচে যাক। এ চিন্তা থেকে আমি সাহস সঞ্চয় করে সর্বপ্রথম আমার প্রিয় মাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলাম। একদিকে তিনি এমনিতেই আমার প্রতি নাখোশ ছিলেন, তার ওপর এ দাওয়াতের কারণে আরো রেগে যান।
কিন্তু আমি সাহস হারাইনি। কাদিয়ানীবাদের বইপত্রে বিদ্যমান কুফরী আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে তাকে অবহিত করতে থাকি। তন্মধ্যে মির্যা কাদিয়ানীর ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ দাবি২, তার আজেবাজে কথাগুলোকে ‘আল্লাহর ওহী’ বলা৩, তার ফালতু কথাবার্তাকে ‘নবীর হাদীস’, তার জঘন্য আচরণকে ‘রাসূলের সুন্নত’, তার স্ত্রীদেরকে ‘উম্মুল মুমিনীন’, তার বিপথগামী পরিবারকে ‘আহলে বাইত’৪, তার সঙ্গীদের ‘সাহাবায়ে কেরাম’৫ , তার গদিনশীনদের ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ এবং তার শহর (কাদিয়ান)-কে ‘মদীনা মুনাওয়ারা’ এবং ‘মক্কা মুকাররমা’ থেকেও শ্রেষ্ঠ৬ লেখা হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ।) এর প্রভাব প্রিয় আম্মাজানের ওপর এই হয়েছে যে, আল্লাহর রহমতে তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে সক্ষম হন, কাদিয়ানীবাদ ইসলামের বিরুদ্ধে কত বড় ফিতনা ও প্রতারণা। অবশেষে তিনি আমার হাতে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মির্যা কাদিয়ানীকে অভিশাপ দেন। আলহামদু লিল্লাহ। ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পর তিনি স্বপ্নে দেখেন, দুই হাতে তিনি দুটি আম ধরে রেখেছেন। ভয়ঙ্কর একটি কুকুরনি তার থেকে আমদুটি ছিনিয়ে নিতে চাইছে। তিনি দৌড়াচ্ছেন। কুকুরটিও তাকে ক্রমাগত তাড়া করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি একটি ফুলবাগানে প্রবেশ করেন। কুকুরটি তা দেখে ফিরে যায়।
স্বপ্নটি প্রিয় মা যখন আমাকে শোনান, আমি তার ব্যাখ্যা করে বলি, আম অর্থাৎ ফল, মানে ছেলে। কুকুরনি দ্বারা উদ্দেশ্য সেই কাদিয়ানী মহিলা প্রচারক, যে আমাদের বাড়িতে কাদিয়ানীবাদের প্রচার করতে আসে। সে আপনার এবং আপনার দুই ছেলের পেছনে লেগে আছে। কারণ, সে এদিক থেকেই বেশি আশংকা বোধ করছে। কিন্তু মহান আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার দুই ছেলেকে এ কুকুরনি (অর্থাৎ কাদিয়ানী প্রচারক) থেকে রক্ষা করেছেন। আমি আশা করি, আল্লাহ পাক আপনার জীবদ্দশায় আমার এক ভাইকেও ইসলামের সৌভাগ্য দান করবেন। এ স্বপ্নের কয়েক মাস পর আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতের মুক্তা আমার এক ভাইয়ের ঝুলিতেও দান করেন। তা দেখে আমার মমতাময়ী মায়ের ঈমান হিমালয় উচ্চতায় পৌঁছে যায়।
ওই সময়টা আমি কখনো ভুলতে পারব না, যখন সারা রাত আমার প্রিয় মায়ের শিয়রে আমার অশ্রু ঝরেছে। তিনি গুরুতর হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। ডাক্তাররা হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তার আরোগ্যের জন্য রাত জেগে আমি অনেক দুআ করেছিলাম; কিন্তু আফসোস, জগতের চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ছেড়ে তিনি আখেরাতে পাড়ি জমান।
ইন্তেকালের এক ঘণ্টা আগে তিনি আমার অনুরোধে পুনরায় স্বীকার করেন যে, তিনি কাদিয়ানী নন। সাথে আমাকে এ বিষয়েও সতর্ক করেন যে, আমি মারা গেলে শুধু মুসলমানরাই আমার জানাযা পড়বে এবং আমাকে মুসলমানদের কবরস্থানেই দাফন করবে। আমি আমার পরিবারের সামনে যখন মায়ের এ ওসিয়তের কথা উল্লেখ করি, তারা আমাকে বিশ্বাস না করে নিজেদের কবরস্থানে কবর খননের নির্দেশ দেয়। কাদিয়ানী ধর্মগুরু ও কাদিয়ানী আত্মীয়রা আমাদের বাড়িতে জমায়েত হতে শুরু করে।
অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে আমি আমার বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের কাছে ঘোষণা দেই যে, আমার মা একজন মুসলমান। তার ওসিয়ত ছিল মুসলমানরা আমার জানাযা পড়বে। ঘোষণা শোনার অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পুরো গলি মুসলমানদের উপস্থিতিতে ভরে যায়। আমার বন্ধুরা আরো যোগাযোগ করে পুরো শহরের স্বনামধন্য ওলামায়ে কেরামকেও একত্র করেন। বিখ্যাত স্কলার, খতমে নবুওতের আশেক ভাই মুহাম্মাদ তাহের আবদুর রাযযাক সাহেবও এসেছিলেন। প্রসিদ্ধ মুজাহিদে খতমে নবুওত মাওলানা গোলাম হোসাইন কালিয়ালবী জানাযার নামায পড়ান। আমার মমতাময়ী মাকে লাহোরের বুধো আওয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুরো দৃশ্য কয়েক ডজন কাদিয়ানী পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কিন্তু জানাযার খাটিয়া স্পর্শ করা বা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার সাহস তাদের ছিল না।
ইন্তেকালের পর প্রায়ই আমার মা স্বপ্নে খুব সুন্দর সুন্দর জায়গায় আমাকে দেখা দিতেন। আমাকে তিনি উৎসাহ দিয়ে বলতেন, বাবা আমার! মৃত্যু পর্যন্ত হাল ছাড়বে না। বিপদ ও দুর্যোগে কখনো ভীত হবে না। নিজ পরিবার ও অন্য কাদিয়ানীদের কাছে দাওয়াত ও তাবলীগ অব্যাহত রাখবে। এ কাজে আল্লাহ তাআলা এবং দোজাহানের সরদার খাতামুন্নাবীয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত খুশি হন।
জীবনের একটা সময় ছিল যখন আমি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর প্রশংসায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি আমার ভক্তির জ্ঞানগত বা বাস্তব কোনো ভিত্তি ছিল না। নিছক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত একটি অন্ধ অনুকরণ ছবির উল্টো পিঠ আমার চোখের আড়াল করে রেখেছিল।
ওই সময় প্রায়ই মুসলমান জনসাধারণের এসব কথা আমার কানে আসত, মনে ধাক্কা দিত যে, মির্যা কাদিয়ানী ছিল একজন অসচ্চরিত্র মিথ্যা দাবিদার। তার পুরো জীবন অন্যায়, অপকর্ম ও অশ্লীলতার চোরাবালিতে আটকে ছিল। কিন্তু এ কানাঘুষাকারীদেরকে আমি পাত্তা না দেওয়াই আবশ্যক মনে করতাম। কারণ, আপত্তিকারীদের আপত্তিগুলো প্রায়শই ভিত্তিহীন ও দলীলহীন থাকত। কোনো দলীল থাকলেও সেটা এমন কাদিয়ানী বই থেকে দেওয়া হত, যার নাম আমি প্রথম শুনতাম। ফলে কথাগুলো আমাকে আকর্ষণ করত না। তবে একটি বড় সুফল এই হয়েছে যে, একদিন আমি অনেক ভেবেচিন্তে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পরীক্ষা ও পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেসব বইয়ের অনুসন্ধানে নেমে পড়লাম, যার উদ্ধৃতি দিয়ে আপত্তিকারীরা মির্যা কাদিয়ানীর জীবনী এবং তার রচনার ওপর আঙ্গুল তুলত। এর মধ্যে ছিল মির্যা কাদিয়ানীর স্বলিখিত বই ও তার মুরিদদের রচনাবলি।
শেষ পর্যন্ত অনেক দিনের পরিশ্রম ও ঘাম ঝরানোর পর আমি কয়েকটি বই পেতে সক্ষম হই। তারপর নিরপেক্ষ মনে পূর্বাপর প্রেক্ষাপটসহ বইগুলো পাঠ করি। আমার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না— যখন দেখি, সত্যিই এ বইগুলোর লেখা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, মির্যা কাদিয়ানী ছিল ইংরেজদের প্রতিপালিত এবং নবুওতের মিথ্যা দাবিদার। তার ব্যক্তিত্ব ছিল চালবাজি, প্রতারণা, কু-অভ্যাস এবং অনেকগুলো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি। দয়াময় রবের করুণায় এসব তথ্য জানতে পেরে ধীরে ধীরে মির্যা কাদিয়ানীর প্রতি আমার ভক্তি-ভালবাসার সবগুলো সেলাই ছিঁড়ে যায়। অবশেষে একদিন কাঁচা সুতোর মতো চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আমার ইসলামের উদ্যানে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ছিল আমার দেখা কিছু স্বপ্ন, যা আমার ধর্মীয় আগ্রহের পথে আলোকবর্তিকার ভূমিকা রেখেছে। সে স্বপ্নগুলোর একটি ছিল—
যখন আমি কাদিয়ানীজম বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণার পর এর ভণ্ডামি বহুলাংশেই বুঝে ফেলেছিলাম। এই স্বপ্নে আমি দেখলাম, একটি বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর। জ্বলন্ত সূর্যের রশ্মি ভূ-পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করেছে। আমার থেকে কিছুটা দূরে প্রকাণ্ড এক অগ্নিকুণ্ডে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। এর ফলে আরো তাপ ছড়াচ্ছে। এমন সময় এক ভীষণদর্শন ফেরেশতা কাদিয়ানীদের ভণ্ড নবী মির্যা কাদিয়ানীকে বাম হাতে ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসে এবং ডানহাতে আমার কব্জি ধরে আগুনের দিকে ছুটতে শুরু করে। আমি তার থেকে আমার কব্জি মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করি; কিন্তু সে আমাকে ছাড়ার পরিবর্তে আগুনের অভিমুখে ছুটে যেতে থাকে। আমাদের এবং ওই আগুনের মাঝে দূরত্ব যতই কমছে তাপের তীব্রতা ততই বাড়ছে। অবশেষে সেই ফেরেশতা হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পরপরই আমি মাথা তুলে ওই ফেরেশতার দিকে তাকাই। দেখি, সে অগ্নিকুণ্ডের কাছে গিয়ে মির্যা কাদিয়ানীকে তাতে নিক্ষেপ করেছে। সাথে সাথে আগুন ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় মির্যা কাদিয়ানীকে লুফে গভীরে টেনে নেয়। সেইসাথে আমার মুখ থেকে এক বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসে। আর আমি আতঙ্কে ঘুম থেকে উঠে বসি।
আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। জেগে ওঠার পরপরই এক মুহূর্ত নষ্ট না করে আমি কাদিয়ানীবাদের ওপর চিরস্থায়ী অভিশাপ দেই এবং সর্বান্তকরণে ইসলাম গ্রহণ করি। আলহামদু লিল্লাহ।
আমার ইসলাম গ্রহণের পর বিরোধিতার প্রবল ঝড় আসে। ঈমানকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিতে তেড়ে আসে কুফরি বন্যার জোয়ার। যদি মহান আল্লাহ প্রদত্ত দৃঢ়তা ও রহমত না হত, তবে নিশ্চিত সেসব ঘাত-প্রতিঘাতে আমার ঈমান প্রভাত প্রদীপের মতো কাঁপতে কাঁপতে নিভে যেত!
টীকা :
১। nv`x‡m ewY©ZÑ BKwigv iv.-Gi e³e¨wU ûeû Ggb bq, †hgbwU Dc‡i D‡jøL n‡q‡Q| Zvui e¨vcv‡i (GLvbKvi †cÖÿvc‡U cÖvmw½K) †h eY©bv cvIqv hvq Zv nj, nhiZ BKwigv iv. hLb †Kv‡bv wel‡q `„pfv‡e Kmg Ki‡Zb ZLb ¸iæZ¡ †evSv‡Z Gfv‡e ej‡ZbÑ
والذي نجاني يوم بدر!
Ô†mB mËvi Kmg, whwb Avgv‡K e`‡ii w`b (Kzdwi Ae¯’vq g„Zz¨) †_‡K iÿv K‡i‡Qb!Õ ÑAvjgyRvgyj Kvexi, Zevivbx, eY©bv 1018; gvRgvDh hvIqv‡q` 9/385, eY©bv 16049
২। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর কথিত ‘সাহাবী’ ও কাদিয়ানী ধর্মের ‘মুফতী’ মুহাম্মাদ সাদেকের বইয়ের বিখ্যাত সেই উদ্ধৃতিটি এই-
ایک شب دس بجے کے قریب میں تھیئٹر میں چلا گیا۔ جو مکان کے قریب ہی تھا۔ اور تماشا ختم ہونے پر دو بجے رات کو واپس آیا۔ صبح منشی ظفر احمد صاحب نے میری عدم موجودگی میں حضرت صاحب کے پاس میری شکایت کی کہ مفتی صاحب رات تھیئٹر چلے گئے تھے۔ حضرت صاحب نے فرمایا: ایک دفعہ ہم بھی گئے تھے تاکہ معلوم ہو کہ وہاں کیا ہوتا ہے۔.
একদিন রাত দশটার দিকে আমি থিয়েটারে গেলাম যা বাড়ির খুব কাছেই ছিল। সিনেমা শেষ হলে রাত দুটোয় ফিরে আসি। সকালে মুনশী যফর আহমদ সাহেব আমার অনুপস্থিতিতে হযরত সাহেবের (মির্যা গোলাম আহমদ) কাছে আমার ব্যাপারে নালিশ করেন যে, মুফতী সাহেব রাতে থিয়েটারে গিয়েছিলেন।
হযরত সাহেব তখন বললেন, আমিও একবার গিয়েছিলাম। সেখানে কী হয় সেটা জানার জন্য। -যিকরে হাবীব, পৃ. ১৮, ‘মুফতী’ মুহাম্মাদ সাদেককৃত
৩। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকৃষ্টতম এক ভয়ানক দাবি হল, তিনি নিজে নাকি স্বয়ং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ!’ এক্ষেত্রে তার একাধিক স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। দ্র : মির্যা কাদিয়ানীর পুস্তক- এক গলতি কা ইযালা, পৃ. ৫, ৬; রূহানী খাযায়েন (রচনাসমগ্র) ১৮/২১২, ২১৬; একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ১০, ১৫ (বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের মূল কেন্দ্র বকশী বাজার, ঢাকা থেকে অনূদিত); নূযুলুল মাসীহ ৩নং পৃষ্ঠার টীকা, রূহানী খাযায়েন ১৮/৩৮১; কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নেতাদের বক্তৃতা সংকলন ‘নবুয়ত ও খেলাফত’ (বাংলা), পৃ. ৬৭ (ঢাকাস্থ বকশী বাজার কাদিয়ানী কেন্দ্র থেকে অনূদিত)।
৪। মির্যা কাদিয়ানীর অন্যতম দাবি ও কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস হল, মির্যা গোলাম আহমদের তথাকথিত ওহী-ইলহামও কুরআনের সমতুল্য (?)। কুরআনের ন্যায় অকাট্য ওহী! তাদের মতে এর প্রতি কুরআনের ন্যায় ঈমান আনা আবশ্যক। (নাউযুবিল্লাহ)। দ্রষ্টব্য : মির্যা কাদিয়ানীর পুস্তক- হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৩৯১, রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৭; হাকীকাতুল ওহী (কাদিয়ানীদের অনূদিত বাংলা), পৃ. ৩৩১; এক গলতী কা ইযালা, পৃ. ৩-৪; রূহানী খাযায়েন ১৮/২২০, একটি ভুল সংশোধন (বাংলা), পৃ. ৮।
৫। কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের এক জঘন্য বিশ্বাস হল, মির্যা কাদিয়ানীর পরিবারকে তারা নবী পরিবার মনে করে। তার স্ত্রীদেরকে বলে উম্মুল মুমিনীন! (মুমিনদের মা) নাউযুবিল্লাহ। কাদিয়ানী বইপুস্তকের জায়গায় জায়গায় এর শত শত প্রমাণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মির্যা বশীর আহমদ রচিত তার পিতা মির্যা গোলাম আহমদের জীবনীগ্রন্থ ‘সীরাতুল মাহদী’ দেখা যেতে পারে।
৬। কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে, মির্যা গোলাম আহমদের অনুসারীরা সাহাবায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত। দ্রষ্টব্য : মির্যার বই- খুতবায়ে ইলহামিয়া, পৃ. ১৭১, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র) ১৬/২৫৮-২৫৯।
৭। এ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হল, তারা মির্যা কাদিয়ানীর জন্মভূমি ভারতের কাদিয়ানকে মক্কা ও মদীনার মতো পবিত্রভূমি বরং তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। নাউযুবিল্লাহ। দ্রষ্টব্য : (মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য) দাফেউল বালা, পৃ. ১০, রূহানী খাযায়েন ১৮/২৩০; দাফেউল বালা (বাংলা), পৃ. ১১ (বাংলাদেশের কাদিয়ানী কেন্দ্র থেকে অনূদিত); (মির্যাপুত্র ও কাদিয়ানী খলীফা মির্যা মাহমুদের বক্তব্য) ইলম হাসিল করো, আনওয়ারুল উলূম (মির্যা মাহমুদের রচনাসমগ্র) ৪/১৩৫, ১৩৬।