ঋণ ও সুদের অতল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে দেশ ও জাতি
এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে জাতীয় সংসদে। গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। এই লেখা যখন পাঠকের হাতে যাবে তখন দেশ নতুন অর্থবছরে পদার্পণ করবে। হালকা কিছু কাটছাঁট হয়ে বাজেটও পাশ হয়ে যাবে।
জাতীয় বাজেট নিয়ে বেশ কয়েকবার আলকাউসারের পাতায় ছোট-বড় প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে বাজেটে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। তাই নতুন করে লেখা বা বলার মতো তেমন কিছু থাকে না। একটা সময় ছিল, যখন বাজেট উত্থাপনের তারিখে দেশের অসংখ্য নাগরিক রেডিও সেট অন করে বসে যেত। বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন দল, সামাজিক সংস্থা ও সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়াও হত ব্যাপক। সরকারি দল বাজেটকে গণমুখী ও দেশবান্ধব বললেও চারদিক থেকে বাজেটের নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া আসত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, সংবাদ মাধ্যমগুলোর মতো বাজেট এবং অর্থনীতিও হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ একঘেয়ে ও গতানুগতিক। বস্তুত এসব কিছু এখন নামেই আছে।
শুধু এগুলোই নয় রাষ্ট্রের অন্যান্য স্তম্ভগুলোও এখন শুধু থাকার জন্যই আছে। প্রকৃতপক্ষে কোনো বিভাগেরই আলাদা কোনো শক্তি, অবদান বা কার্যকর ভূমিকা এখন আর দৃশ্যমান হয় না। সবকিছু যেন চলছে মেশিনের মতো। আর ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ নির্বিকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগির মতো সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে। এসব কিছুর মতোই বাজেটের গতানুগতিকতা মানুষকে আর আগের মতো তার দিকে আকর্ষণ করে না। তাই কারো কারো আবদার সত্ত্বেও আমরাও আর আলকাউসারে এ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাই না।
তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে একটি বিষয় দেখে আঁৎকে উঠেছেন অনেকেই। তা হচ্ছে বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দের খাত। এবারের বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে ২২% বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধ খাতে। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য এক লক্ষ তেরো হাজার পাঁচ শ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একক খাত হিসেবে নতুন বাজেটে এটিই বৃহত্তম ব্যয়। যদিও বিগত কয়েক বছর থেকেই সরকারের ঋণ ও সুদের ব্যয় ব্যাপক হারে বাড়ছিল। আমরাও বাজেট আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় কিছু আরজ করেছিলাম। কিন্তু এ বছর ব্যাপারটি একেবারে প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে।
একটি মুসলিম রাষ্ট্র, যেখানে ৯০% -এর বেশি লোক ইসলাম ধর্ম এবং কুরআন-সুন্নাহর নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী; কুশিক্ষা, অপসংস্কৃতি ও চারদিকের বেহায়াপনার সয়লাবের মধ্যে এখনও এদেশের মানুষের একটি বৃহৎ অংশ সুদকে এড়িয়ে চলে। তারা কোনো সুদী লোন গ্রহণও করে না আবার কাউকে সুদের ভিত্তিতে ঋণ-করজও দেয় না। তাই তাদেরকে সুদ দিতেও হয় না, নিতেও হয় না। কারণ ইসলামে যে বিষয়গুলো খুব কঠোরভাবে হারাম তার একেবারে শুরুর দিকে রয়েছে সুদ আদান-প্রদান। পবিত্র কুরআনুল কারীম এবং বিভিন্ন হাদীস শরীফে সুদদাতা ও সুদ গ্রহীতার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। তাই পুঁজিবাদের এই আগ্রাসনের মধ্যেও অনেকেই সযত্নে সুদকে এড়িয়ে চলতে পেরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। কিন্তু সরকারের বাজেট হিসাব দেখার পর কেউ কি আর নিজেকে সুদমুক্ত ভাবতে পারবেন? আপনি কোনো সুদী ঋণ গ্রহণ করেন না; তাই আপনাকে সুদ দিতে হয় না। আর সুদভিত্তিক কোনো ঋণ আপনি অন্যকে প্রদানও করেন না; তাই আপনার সুদ গ্রহণের প্রশ্নও আসে না। এতটুকুতে সন্তুষ্ট থাকার সুযোগ কি আর আছে?
জনগণ সুদী ঋণ গ্রহণ না করলেও, কাউকে সুদ প্রদান না করলেও দেশের ক্ষমতাবানেরা তো জনগণের নামে কাড়ি কাড়ি সুদভিত্তিক ঋণ নিয়ে থাকেন। সে ঋণ বাড়তে বাড়তে এত বেশি হয়েছে, যার সুদ আদায়ের জন্য জাতীয় বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখতে হয়েছে। এক-দুই কোটি, একশ কোটি বা এক হাজার কোটি নয়; বরং এক লক্ষ তেরো হাজার পাঁচ শ কোটি টাকা শুধু সুদ বাবদই সরকার পরিশোধ করবে। একথা সবারই জানা যে, এ টাকা সরকার জনগণের থেকে নেওয়া ভ্যাট, আয়কর ও অন্যান্য শুল্ক থেকেই পরিশোধ করবে।
দেশের একজন হতদরিদ্র থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ধনি, সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে বড় থেকে বড় আলেম ও বুযুর্গ কেউই তো সরকারকে কর না দিয়ে বাঁচতে পারে না। মোবাইল ফোনে এক শ টাকা রিচার্জ করলে চল্লিশ টাকার মতো নিয়ে যায় সরকার। ক’জন নাগরিক আছেন, যিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে থাকতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের জরুরি কেনাকাটায় মূল্যসংযোজিত করও তো ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলকেই নিজ হাতে পরিশোধ করতে হয়। সরকারের আয়ের সর্বোচ্চ খাতও এ ভ্যাট, যা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাইকে পরিশোধ করতে হয়। আর ধনীদের আয়করের বোঝাও পরোক্ষভাবে সাধারণ জনগণ তথা ভোক্তাদের ওপরই বর্তায়। তাই সুদ পরিশোধে যে টাকা ব্যয় হয়, তাতে ধার্মিক ও অধার্মিক সকল শ্রেণির লোকের অর্থই রয়েছে।
কেন এত সুদ?
একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অর্থকড়ি তো লাগবেই। যারা জনগণকে সেবা দেবে, নিরাপত্তা দেবে তাদের বেতন-ভাতা এবং অতীব জরুরি অবকাঠামো উন্নয়নের পেছনেও অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু একটি সরকারকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা সুদ কেন পরিশোধ করতে হবে? এর জবাবও বাজেট বিশ্লেষণের মধ্যে রয়েছে। জানা কথা যে, সুদ প্রদান করতে হয় অপরিশোধিত ঋণের জন্য। আর বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এ বছরের বাজেটে ঋণের স্থিতি প্রাক্কলন করা হয়েছে একুশ লক্ষ বাষট্টি হাজার চার শ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ -এ ঋণের স্থিতি ছিল তেরো লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার সাত শ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যেই আট লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী তিন বছরে সরকারের ঋণ সাতাশ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। (বণিকবার্তা)
এইসকল ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যই এখন সরকারকে জনগণ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা কর নিতে হয়।
কেন এত ঋণ?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারকে এত ঋণ কেন করতে হয়? বিষয়টি সহজে অনুধাবন করার জন্য আমরা কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ পেশ করছি। ঘটনাগুলো বাস্তবসম্মত। নামগুলো ছদ্ম।
মাহের একজন সাধারণ চাকরিজীবী। টানাটানির সংসার হলেও ঋণ-করজের অভ্যাস ছিল না। আয় বুঝে ব্যয় করে চলতে অভ্যস্ত ছিল তার পরিবার। বাড়িতে ভালো টিনের ঘর। মাঝে মাঝে মেরামত করতে হলেও বসবাসে তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না।
হঠাৎ মাহেরের মাথায় এল গ্রামের অনেকেই বাড়িতে দালান তুলছে। তাকেও তাই করা উচিত। সে চিন্তায় নিজের সামান্য জমা টাকা দিয়ে কিছু ইট কিনে ফেলল। এরপর চার-পাঁচ কামরার একটি ঘরের ডিজাইন করাল স্থানীয় ঠিকাদারদের দিয়ে। ঘরটির ফাউন্ডেশন দিতে গিয়ে নিজের দামি জমিটিও বিক্রি করে দিল। কিন্তু কোনো রকম ছাদ ঢালাই হয়ে গেলেও ঘরের কাজ আর শেষ হয় না। বাধ্য হয়ে মাহের গৃহঋণের জন্য ছোটাছুটি করে। একসময় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেয়েও যায়। ঋণের মেয়াদ যত বেশি, সুদের পরিমাণও ততই অধিক। সে ঋণ আর সুদ কখনো শেষ হয় না। যেহেতু তার আয় সীমিত, তাই ঋণের কিস্তি ও সুদ আদায় করতে গিয়ে আরও ঋণ নিতে হয়। যার জন্য সুদের পরিমাণও বেড়ে যায় নতুন করে। এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, সাধারণ বিচারে মাহের তার জীবদ্দশায় এই ঋণ ও সুদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সুরুজ মিয়া লেখা-পড়া তেমন করেননি। তবে মেহনতি মানুষ। চার-পাঁচ জনের সংসার। গায়ে-গতরে খেটে যা কামাই করেন তা দিয়ে সংসার কোনোরকম চলে যায়। সন্তানাদিকে কম খরচের বিদ্যালয়ে পড়াতে পারেন। সবকিছু একরকম স্বাভাবিকভাবে পার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কয়েক বছর থেকে সুরুজের পরিবারে হতাশা ও বিষণ্নতা নেমে এসেছে। সুরুজ সাধারণ আয় রোজগার থেকে যা অর্জন করে, তার বড় একটি অংশই এখন ফড়িয়াদের ঋণ-সুদের কিস্তি পরিশোধে ব্যয় হয়ে যায়। যার দরুন ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধপত্র কিনতে গিয়েও এখন তাকে আবার সুদী ঋণ নিতে হয়।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল একটু ভিন্নভাবে। সুরুজের পরিবার দুই-তিন বছর আগ থেকেই তার মধ্যে ব্যতিক্রম ভাব লক্ষ করেছে। রাত করে বাড়িতে ফেরা, খারাপ লোকদের সাথে আড্ডা দেওয়া এবং পরবর্তীতে নেশাজাত দ্রব্যে জড়িয়ে পড়া— এসব কারণে গ্রাম্য ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া মহাজনদের কাছে তার নেওয়া সুদী ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল একেবারে শূন্য। টানাটানির সংসার হলেও তাদেরকে কখনো ঋণ করে চলতে হয়নি। এখন তার আয়রোজগারের সিংহভাগই ব্যয় হয়ে যায় সুদ পরিশোধে। সে সুদ আদায়ের জন্য আবার নতুন ঋণ, সে ঋণের আবার বাড়তি সুদ। জীবন যেন সুদে আর ঋণে, ঋণে আর সুদে আবদ্ধ হয়ে গেছে। পরিবারটির জমি-জিরাত যা ছিল তা শেষ হয়ে এখন ভিটেবাড়িও যাওয়ার অবস্থা।
সেলিম একজন ছাত্র। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। স্কুল ও কলেজ জীবন মোটামুটি ভালোই পার হয়েছে। হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছে। বাড়ি থেকে যা খরচাদি পেয়েছে, তা দিয়ে মোটামুটি চলে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে কিছু বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্য তার মধ্যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন সে তার স্বাভাবিক আয়ের তুলনায় নিয়মিতই বেশি ব্যয় করে। দামি ব্র্যান্ডের ফাস্টফুড ও কফি শপে তার যাতায়াত নিয়মিত। ক’দিন পর পর নতুন নতুন মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিভাইস খরিদ করে সে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে আরও হরেক রকম খরচ বেড়েছে তার। যে কারণে মা-বাবার পাঠানো অর্থে তার আর এখন কোলায় না। প্রতি মাসেই সে ঋণ করে। একসময় সুদী ঋণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র ঋণদাতাদের এসব ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের দায়ভারও তার পরিবারের ওপর গিয়ে বর্তায়। মধ্যবিত্ত পরিবারটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানের পরিবর্তিত জীবনের গ্লানি বইতে বইতে একসময় নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
আরজু সুশিক্ষিত ব্যক্তি। ভালো চাকরি করেন। কয়েক লক্ষ টাকার মাসিক বেতন-ভাতা। স্বচ্ছন্দেই চলে জীবন। কামাই যেমন বেশি, ভদ্রলোক তেমন খরুচেও। নিয়মিত নামি-দামি রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া। সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশে বেড়াতে চলে যাওয়া— এসব খাতে তার মোটা অংকের বেতনের একটি বিরাট অংশ খরচ হয়ে যায়। তাই জমা থাকে না তেমন কিছুই। অবশ্য টানাপোড়েন, ঋণ-করজও নেই। কিন্তু কয়েক বছর থেকে লোকটির জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। এখন আর তার সংসার আগের মতো চলে না। তার ব্যাপারটি একটু ভিন্ন রকম। তাকে পেয়ে বসেছে বড় বড় ব্র্যান্ডের ইএমআইএ। পুঁজিবাদে পণ্য বিপননের একটি নতুন কৌশল হচ্ছে, কিস্তির বিক্রি। যাবতীয় বিলাস দ্রব্য, ভ্রমণ প্যাকেজ, প্লট, ফ্ল্যাটের ব্যবসা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও গেজেটস, ঘরোয়া ফার্নিচার ও অন্যান্য আসবাবপত্রসহ অসংখ্য পণ্য এখন বিক্রি হয়ে থাকে কিস্তি সুবিধায়। ছয় মাস, বারো মাস, চব্বিশ মাস, ছত্রিশ মাস এবং গাড়ি ও প্লট-ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে দশ-বিশ বছরের কিস্তি সুবিধাও পাওয়া যায়।
একটি মোবাইল কোম্পানি নতুন সেট নিয়ে এল। দাম দেড়-দুই লাখ টাকা। তা তো আর শুধু কোটিপতিদের কাছে বিক্রি করে ব্যবসা চলবে না। তাই সুকৌশলে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকেও নিজেদের খরিদদার বানাচ্ছে। শুরুতেই বারো মাস-চব্বিশ মাসের ইএমআই সুবিধা ঘোষণা করছে। বলা হচ্ছে, আপনি মাসিক মাত্র আট/দশ হাজার টাকা কিস্তি দিয়ে পণ্যটি পেতে পারেন। দামি ব্র্যান্ডের সকল ফার্নিচারের সকল দোকানে রয়েছে ইএমআইয়ের সুবিধা। প্রায় সকল ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যেও এসব সুবিধা রয়েছে। যার দরুন ভালোভাবে হিসাব-নিকাশ না করে অনেকেই প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসবে ঘরের যাবতীয় ফার্নিচার পরিবর্তন করে ফেলেন। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, এসি, ফ্রিজ এবং এজাতীয় অন্যান্য পণ্যেও নতুন মডেল বা প্রযুক্তি আসলেই ইএমআই সুবিধা নিয়ে সংগ্রহ করে ফেলেন।
আরজু সাহেবও এই খপ্পরে পড়েছেন। তার সাবলম্বি সংসার এখন ইএমআইয়ের ফাঁদে বন্দি হয়ে পড়েছে। তাকে এখন প্রতি মাসে লক্ষ টাকার বেশি কিস্তিই পরিশোধ করতে হয়। যার কারণে শিশুদের স্কুল খরচ এবং সংসারের দৈনন্দিন খরচে প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। দামি স্কুলের মোটা ফি, অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাট ভাড়া এগুলো আগে পরিশোধ করা কঠিন না হলেও এখন আর তিনি স্বাভাবিকভাবে তা আদায় করতে পারছেন না। অথচ যেই যেই বস্তুগুলোর জন্য কিস্তি আদায় করছেন, সেগুলোর কোনোটিই তার জন্য অপরিহার্য ছিল না। এসবই পরিবর্তন করেছেন শখের বশবর্তী হয়ে। অথবা আপডেট প্রযুক্তি খরিদের মানসিকতা থেকে। কিন্তু জীবন তো আর সহজে থেমে যায় না। আরজু সাহেবের পরিবার হঠাৎ করে তাদের খরচ কমাতে পারে না। যার দরুন শুরু হয় ঋণ। আভিজাত্য ও মান বাঁচানোর তাগিদে ঋণ ও সুদ তাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। একসময় ভালোভাবে চলা একটি সুশিক্ষিত পরিবার ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে চোখে অন্ধকার দেখে।
প্রিয় পাঠক, একজন মানুষ ব্যক্তি জীবনে কীভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে পেশ করা হল। যদিও মানুষের ঋণগ্রস্ত হওয়ার কারণ এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অনাকাক্সিক্ষত বিভিন্ন সমস্যা এবং সাধারণ জীবন যাপনের খরচাদি জোগাড় করতে না পারার কারণেও অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মতো রাষ্ট্রের ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ওপরের উদাহরণগুলোর সাথেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মানবজীবনের স্বাভাবিক স্বীকৃত নিয়ম, যা বুদ্ধিমান মা-বাবারাও সন্তানাদিকে তালীম দিয়ে থাকেন। তা হচ্ছে, ‘আয় বুঝে ব্যয় করা।’ কিন্তু এ যুগের রাষ্ট্রগুলো চলে এর ঠিক বিপরীত পথে। সে আগে নিজের একটি ব্যয়ের তালিকা বানায়। এরপর আয় করার চেষ্টা করে। সে আয়ের জন্য সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরোপিত হয় বিশাল করের বোঝা। যার কারণে মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস ওঠে গণমানুষের। এতেও রাষ্ট্রের খরচ কুলায় না। সে এবার ঋণ-করজ নেওয়া শুরু করে। দেশ-বিদেশ থেকে নেওয়া এসব ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। সাথে ঋণের সুদও।
আলোচিত ২০২৪-২৫ -এর বাজেটের দিকে তাকালেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই সনে রাষ্ট্র তার খরচের প্রাক্কলন করেছে সাত লক্ষ সাতানব্বই হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ভ্যাট ও কর ইত্যাদি বাবদ আয় করার আশা করেছে পাঁচ লক্ষ একচল্লিশ হাজার কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, মানুষের ওপর মোটা অংকের কর বসিয়েও রাষ্ট্র তার প্রাক্কলিত ব্যয় সাত লক্ষ সাতানব্বই হাজার কোটি থেকে দুই লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার কোটি টাকা পেছনে থেকে গেছে! এটিকেই বলা হয় ঘাটতি বাজেট। এই দুই লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার কোটি টাকা (যা পুরো বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ) সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন করে ঋণ করবে। অর্থাৎ পরবরর্তী অর্থবছরে সরকারের ঋণের পরিমাণ যেমন বাড়বে, সুদ পরিশোধের জন্যও আরও অধিক বরাদ্দ রাখতে হবে। কারণ যত ঋণ, তত সুদ। সুদ আদায়ের জন্য নতুন করে আবার ঋণ।
রাষ্ট্র কি ঋণ এড়াতে পারে না?
প্রশ্ন হচ্ছে, যে ঋণের জন্য সাধারণ নাগরিকগণ এবং আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ব্যক্তি জীবনে সুদ ও ঋণ এড়িয়ে চলা এদেশের মুসলিম সমাজও পরোক্ষভাবে সুদের বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে, রাষ্ট্র কি সে ঋণ এড়িয়ে চলতে পারত না। ঋণ-করজ ছাড়া একটি রাষ্ট্রের কি চলা অসম্ভব? এর সহজ জবাব হচ্ছে, অবশ্যই রাষ্ট্র চাইলে ঋণ-করজ এড়িয়ে চলতে পারত। এটি কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। শুধু ঋণগ্রহণই নয়, বরং রাষ্ট্র যদি কল্যাণমুখী এবং স্বকীয়তা নিয়ে চিন্তা করত, তাহলে সে ঋণগ্রস্ত তো হতই না; বরং তাকে স্বাভাবিক খরচাদি নির্বাহের জন্য এত মোটা অংকের করও জনগণের ওপর বসাতে হত না।
আমাদের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতাবানেরা এবং আমলাশ্রেণি যেভাবে বিলাসিতা করে রাষ্ট্রের টাকা উড়ায়, এ নামে সে নামে ঘন ঘন বিদেশ গমন করে যেভাবে ডলার ব্যয় করে, ভিআইপি, ভিভিআইপিদের সুবিধা ও প্রটোকলে যেভাবে দুহাতে অর্থ ব্যয় করা হয়— সেগুলোর লাগাম টানলেও হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এছাড়া এখন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যত মোটা অংকের বরাদ্দ রাখা হয় এবং একেকটি প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ানো হয়— এসবের লাগাম টেনে ধরলে এবং সাধ্য ও সামর্থ্যরে মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে রাষ্ট্রকে এ বিপর্যয়ে পড়তে হত না। এখন ঋণ করে ঘি খাওয়ার যে অভিলাষ ও মিছে আত্মতৃপ্তিতে রাষ্ট্র আবর্তিত হয়েছে এবং জনগণকে ঋণ ও সুদের বোঝার চাপে যেভাবে ক্ষমতাবানেরা আবদ্ধ করেছে, আগে থেকে সুবুদ্ধি, স্বকীয়তা এবং নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বাস্তবমুখী চিন্তা করে অগ্রসর হলে কিছুতেই আজকের অবস্থা দেখতে হত না। চিন্তা করা যায়, একটি দেশ যত টাকা ঋণের চাপে আবদ্ধ রয়েছে, সে টাকা দিয়ে তার কয়েক বছরের বাজেট পুরা করা যেতে পারে। যত টাকা সে সুদ পরিশোধ করে, তা দিয়ে বছরের এক পঞ্চমাংশের মতো খরচ সহজেই নির্বাহ করা সম্ভব।
আমরা আমাদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাই শুধু হারাইনি; বরং এসবের সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও অন্যদের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েছি। একদিকে উন্নয়নের বড় বড় বুলি আওড়ানো, মাথাপিছু আয়ের ফুটানি দেখানো, ইট-কংক্রিটের কতগুলো কাঠামো বানিয়ে উন্নতির দাবি তোলা, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঋণ ও সুদের বোঝা বৃদ্ধি করা, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ আয়ের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা— এই হচ্ছে হাল আমলের বাংলাদেশ এবং এধরনের অন্যান্য রাষ্ট্রের চিত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
পরিশেষে আরেকটি কথা। তা হচ্ছে, রাষ্ট্র যে জনগণের নামে মোটা অংকের ঋণ করে এবং সে ঋণের সুদ পরিশোধ করে, তার গোনাহ কি জনগণের ওপর বর্তাবে?
এক অর্থে তো এর দায়ভার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। কারণ এখনকার সরকারগুলো তো নিজেদেরকে জনগণের প্রতিনিধি নাম দিয়েই বসে থাকে। তাই তাদের কাজ মানে জনগণের কাজ। কিন্তু ভিন্ন আরেকটি বাস্তবতা তো সবারই জানা। ক্ষমতাবানেরা নিজেদেরকে জনপ্রতিনিধি নাম দিলেও অনেক ক্ষেত্রে আসলে গায়ের জোরেই ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে। এছাড়াও অনেক দেশের অনেক প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরাও ঋণগ্রহণ ও সুদ পরিশোধ এবং অন্যান্য অনেক কাজে জনগণের ইচ্ছার বাইরে কাজ করে থাকে। সেই বিচারে জনগণের গোনাহও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ও নীতি নির্ধারকদের কাঁধে গিয়ে পড়বে— একথাও বলা যায় সন্দেহাতীতভাবে। অবশ্য তাওবা করতে হবে সকলকেই। নিজেদের নামে রাষ্ট্রের নেওয়া সুদী ঋণের জন্য যার যার সাধ্য অনুযায়ী ঘৃণাও প্রদর্শন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ঋণ ও সুদ শুধু লজ্জিত এবং অপদস্থই করে না; বরং একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি রাষ্ট্র ও জাতিকে ধ্বংসের মুখে পতিত করা এবং ডুবিয়ে দেওয়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
সরকারকে টাকা কে দেয়, বিদেশীরা নাকি দেশের জনগণ?
এতটুকু লেখার পর নিবন্ধটি প্রেসে যাওয়ার পর্যায়ে ছিল। এর মধ্যে আজকের বণিকবার্তার (২০ জুন ২০২৪) একটি অনলাইন প্রতিবেদন নজরে পড়ল। শিরোনাম ছিল, ‘এটি প্রস্তাবিত বাজেট, কোনো কিছু থাকলে পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে : অর্থমন্ত্রী।’
কৌতূহলী হয়েই শিরোনামটিতে ক্লিক করেছিলাম। অর্থমন্ত্রী জনগণের জন্য বিশেষ কোনো ছাড়ের ঘোষণা দিলেন কি না। ভেতরে এমন কিছু পাওয়া যায়নি; বরং শিরোনামের কথাটির পরে যা ছিল তা নিম্নরূপ :
‘সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেট সবেমাত্র দিয়েছি। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ ভালো আছে। বিশ্বব্যাংক যা বলছে, আমাদের শুনতে হবে, কারণ তারা আমাদের টাকা দেয়। আমাদের টাকা লাগবে। আপনি কি টাকা দেন? আপনি টাকা দেন, আপনার কথা শুনব।
দেশ ভালো অবস্থানে আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা সরকার জনবান্ধব। তিনি বলেন, কই সরকার তো পড়ে না। দেশ দেউলিয়া তো হল না। বিশ্বব্যাংক কিছু বোঝে না, আপনি সবকিছু বোঝেন।’
বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর উপরোক্ত কথাগুলোতে এ যুগের নেতা ও সরকারগুলোর চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যেমন :
এক. এখনকার নেতা-নেত্রীরা জনগণকে থোড়াই কেয়ার করেন। ন্যূনতম জবাবদিহিতার জন্যও তারা রাজি নন।
দুই. তাদের কথায় কথায় দম্ভ ও অহমিকা ফুটে ওঠে।
তিন. এ দেশে এবং আমাদের মতো অন্যান্য দেশগুলোতে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বুলি আওড়ানো হলেও এখনকার সিংহভাগ গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের পকেটে থাকে। তারা তাদের প্রভুদের চাহিদার চেয়েও বেশি তল্পিবাহক হয়ে থাকে। দুয়েকজন একটু ভিন্ন চিন্তার সাংবাদিক ক্ষমতাবানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করে ফেললে যখন সে নেতা-নেত্রীদের অপ্রাসঙ্গিক কথা, তাচ্ছিল্য ও ধমকির সম্মুখীন হয়, তখন সে একেবারেই একা হয়ে যায়। তাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো তেমন কেউই থাকে না। ওই দিনের সংবাদ সম্মেলনের কথাই ধরা যাক। যখন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিককে বললেন, ‘বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে টাকা দেয়, আপনি কি টাকা দেন? তাদের কথা শুনব, নাকি আপনার কথা শুনব?’ তখন বড় বড় সাংবাদিকেরা যদি সত্যিই দেশপ্রেমিক হত, যদি তারা অন্ধ সমর্থক না হত, তাহলে কি তারা একযোগে প্রশ্ন তুলত না যে, সরকারকে খরচাদির জন্য টাকাকড়ি কি জনগণ দেয়, নাকি বিশ্বব্যাংক দিয়ে থাকে? বিদেশী সংস্থাগুলো খরচের কত ভাগ দেয় আর দেশের মানুষ কত ভাগ দেয়? জনগণের করের টাকায় বেতন-ভাতা ও সুবিধাদী পাওয়া একজন মন্ত্রী কি দেশের মানুষের কাছে সামান্য পরিমাণেও দায়বদ্ধ নন?
তো দেশে অসংখ্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও হরেক রকমের মিডিয়ার রমরমা অবস্থা দেখা গেলেও ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মতো এসব তথাকথিত গণমাধ্যমের সিংহভাগও এখন ক্ষমতাসীনদের বি-টিম হিসেবে কাজ করে থাকে। ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ যেমন বর্তমানে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতা-নেত্রীদের হাতে প্রায় এককভাবে আবদ্ধ থাকে, তেমনি গণমাধ্যমগুলোতেও থাকে তাদের লোকজনেরই মালিকানা। এরা নিরলসভাবে তাদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানো ও গুণ-গান প্রচারে ব্যস্ত থাকে।
চার. সরকারকে টাকা কে দেয়? দেশের মানুষ, না বিদেশীরা? অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কথাগুলো থেকে আরও অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়। আমরা সেসব দিকে না গিয়ে মূল কথায় চলে আসি। মন্ত্রী বলেছেন, ‘টাকা কে দেয়, টাকা কি আপনি দেন যে আপনার কথা শুনব, বিশ্বব্যাংক যা বলেছে আমাদের শুনতে হবে, কারণ তারা আমাদের টাকা দেয়।’
উপরোক্ত কথার যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য কি কোনো অর্থনীতিবিদের দরকার আছে? অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট দেখলেই তো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার তার খরচাদি নির্বাহের জন্য সবচেয়ে বেশি আয় করবে ভ্যাট তথা মূল্য সংযোজন কর থেকে। যার পরিমাণ এক লক্ষ বিরাশি হাজার সাত শ তিরাশি কোটি টাকা। কে না জানে যে, এটি দেশের ধনী-গরিব সকল নাগরিকই আদায় করে থাকে। সরকারের আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত আয়কর থেকে প্রাপ্য এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ছয় শ বিশ কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে প্রাপ্য ৬৪,২৭৮ কোটি টাকা। আমদানী শুল্ক বাবদ ৪৯,৪৬৪ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত অন্যান্য খাত থেকে ৪৬,০০০ কোটি টাকা আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট ৫,৪১,০০০ কোটি টাকা আয় করবে সরকার দেশের জনগণ থেকে। এছাড়া বাজেটের অবশিষ্ট দুই লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকার (ঘাটতি সত্ত্বেও) সিংহভাগ আসবে দেশের ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে (১,৩৭,৫০০ কোটি+২৩,৪০০ কোটি) যার পরিমাণ এক লক্ষ ষাট হাজার নয় শ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে সরকার ঋণ নেবে নব্বই হাজার সাত শ কোটি টাকা। অনুদান গ্রহণ করবে চার হাজার চার শ কোটি টাকা। তা হলে কী বোঝা গেল? সরকারকে আসলে কে টাকা দেয়? সরকারের কার কথা শোনা দরকার? কার কাছে জবাবদিহি করা দরকার? সাত লক্ষ এক হাজার নয় শ কোটি টাকা যে দেশের জনগণ দেবে তাদের কাছে, নাকি (ঋণ হিসেবে নব্বই হাজার সাত শ কোটি এবং অনুদান হিসেবে চার হাজার চার শ কোটি) পচানব্বই হাজার এক শ কোটি টাকা যে বিদেশীরা দেবে তাদের কাছে?
অথচ তা-ই হয়, যা মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। তিনি কিন্তু অসত্য কিছু বলেননি। সরকার তো বিদেশীদের কথাই শুনে থাকে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশের জনগণের ওপর কর বসানো হয়, তাদের নিত্য ব্যবহার্য তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে জনগণের দুঃখ-কষ্ট দেখার বা তাদের কথা শোনার সময়, সুযোগ ও ইচ্ছা এ যুগের নেতা-নেত্রীদের থাকবে কেন?
সুতরাং বহু শর্তের বিনিময়ে পাওয়া ভিক্ষার, না না ভদ্র ভাষায় বলতে হবে অনুদানের চার হাজার চার শ কোটি টাকা এবং চড়া সুদ এবং জনগণের নাভিশ্বাস ওঠানো নতজানু শর্তাবলি ও নাকে খত দিয়ে নেওয়া বিদেশী ঋণ নব্বই হাজার সাত শ কোটি টাকার পাওয়ার ও শক্তি দেশের জনগণ থেকে পাওয়া সাত লক্ষ এক হাজার নয় শ কোটি টাকার চেয়ে বেশি হবে— এটাই তো এ যুগের বাস্তবতা। এসব দেখে কারো আর বুঝতে অসুবিধা হবে না— কেন বারবার আমাদের মতো দেশে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এ চাকরি করা সাবেক আমলাদের অর্থমন্ত্রী বানানো হয়। এবার কেউ চাইলে গবেষণা করতে পারেন, রাজা-বাদশা ও জামিদারি আমলের করের হার এবং বর্তমান করের হার নিয়ে। স্পষ্টতই ফুটে উঠবে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও হরেক রকমের নাগরিক সুবিধা দেওয়ার বুলি আওড়ানো সরকারগুলোর করের বোঝা আগের সময়ের রাজা-বাদশাহ ও জমিদারদের চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি।