আনওয়ারুল কুরআন ॥ প্রশ্নোত্তর
আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম প্রশ্নোত্তর। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।
প্রশ্ন ১০৬. হুজুর, هُمَزَة ও لُمَزَة অর্থ কী?
উত্তর : هُمَزَة ও لُمَزَة শব্দদুটির অর্থ প্রায় একই। শব্দদুটির অর্থ হল, যে অন্যের দোষ খোঁজে এবং বলে বেড়ায়। তবে সাধারণত هُمَزَة শব্দটি কারো পেছনে নিন্দা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। আর لُمَزَة সামনাসামনি নিন্দা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়।
সূরা হুমাযাহ-এর শুরুতে ইরশাদ হয়েছে—
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ.
বহু দুঃখ আছে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির, যে পেছনে অন্যের বদনাম করে (এবং) মুখের ওপরও নিন্দা করে। (দ্র. সংশ্লিষ্ট আয়াত; ইরাবুল কুরআন, আবু জাফর আন-নাহহাস; তাফসীরে কুরতুবী; লিসানুল আরব ১৩/২৩১)
প্রশ্ন ১০৭. কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময় একটি কথা কয়েকবার শুনেছি। সেটা হল, হাফসের সূত্রে আসেমের কেরাত। এ কথাটির ব্যাখ্যা কী?
উত্তর : ইসলামের প্রথম যুগে যারা ইলমুল কিরাআত ও ইলমুত তাজবীদের ইমাম ছিলেন, তাদেরকে কারী বা মুকরি বলা হত। এমনই একজন কারী হলেন ইমাম আসেম ইবনে আবিন নাজূদ রাহ. (মৃত্যু : ১২৭ হি.)। তিনি ছিলেন তাবেয়ী। তিনি আবু আবদুর রহমান আসসুলামী, যির ইবনে হুবায়শ, আবু আমর আশশায়বানী রাহ. প্রমুখের কাছে কুরআন শিখেছেন। তাঁরা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., উসমান রা., আলী রা., উবাই ইবনে কা‘ব রা., যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম থেকে কুরআন শিখেছেন। আসেম রাহ. থেকে যারা কুরআন শিখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হাফস ইবনে সুলায়মান আলআসাদী আলকূফী রাহ. (জন্ম : ৯০ হি., মৃত্যু : ১৮০ হি.)। হাফস রাহ.-এর সূত্রে আসেম রাহ. থেকে যে কিরাআত বর্ণিত হয়েছে, সেটাকেই হাফসের সূত্রে আসেম রহিমাহুমাল্লাহ-এর কিরাআত বলা হয় এবং উল্লেখিত সনদ বা সূত্রে এই কিরাআত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। আসেম রাহ.-এর ছাত্রদের মধ্যে হাফস রাহ. যেহেতু সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন, তাই তার সনদ বা সূত্রও বেশি প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমরাও সেভাবেই কুরআন কারীম তিলাওয়াত করি এবং এটাকে হাফসের সূত্রে আসেমের কিরাআত বলা হয়।
সংক্ষেপে বোঝার জন্য এতটুকু কথাই যথেষ্ট। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসারে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকতুহুম কর্তৃক রচিত ‘সাত কারী, চৌদ্দ রাবী : একটি আলোচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি।
(আলহুজ্জাহ লিল কুররাইস সাবআ, আবু আলী আলফারসী ১/১৮; আননাশর ফিল কিরাআতির আশর ১/৫৩১-৫৩২; আততিবইয়ান লিবা‘যিল মাবাহিছিল মুতাআল্লিকাতি বিল কুরআন ১১৪-১১৫
প্রশ্ন ১০৮. উপমহাদেশের কিছু মুসহাফের ভূমিকা, পাদটিকা, ও পরিশিষ্টে তাফসীরে ‘বাহরুল উলূম’-এর হাওয়ালা পাওয়া যায়। যেমন নকল নিজামী মুসহাফ, যা ১৩১২ হি./১৮৯৪ ঈ. সনে লখনৌ-এর নওল কিশোর প্রেস থেকে ছেপেছে। এটি মূলত কানপুরের নিজামী ছাপাখানা থেকে ছাপা নিজামী মুসহাফের প্রতিলিপি। নকল নিজামী মুসহাফের প্রায় প্রত্যেক পৃষ্ঠার টীকায় বাহরুল উলূমের হাওয়ালা রয়েছে। তেমনি আঞ্জুমানে হেমায়াতুল ইসলাম লাহোর-এর সুপ্রসিদ্ধ মুসহাফ (ছাপার সন ১৩৫৪ হি.)-এর ভূমিকায় (পৃ. ৪ ও ৪৯-৫০) বলা হয়েছে, উক্ত মুসহাফে ওয়াকফ-ইবতিদার চিহ্ন ‘তাফসীরে বাহরুল উলূম’-এর অবলম্বনে বসানো হয়েছে। মুহতারামের নিকট আমার জানার বিষয় হল, এ তাফসীরের পরিচয় কী? এর লেখক কে? হাওয়ালাগুলো দেখে মনে হচ্ছে কিতাবটি ফারসি ভাষায়।
উত্তর : প্রশ্নে উল্লেখিত তাফসীরটির নাম হল, بحر العلوم الإسلامية (বাহরুল উলূম আলইসলামিয়্যাহ)। এটি ‘تفسير مصطفوي’ নামেও পরিচিত। এর লেখক হলেন মাওলানা গোলাম মুস্তফা ইবনে মুহাম্মাদ আকবর থানেশ্বরী রাহ.। তিনি হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর একজন আলেম। মাওলানা আব্দুল হাই হাসানী রাহ.—এর الثقافة الإسلامية في الهند কিতাবে (পৃ. ১৫০) হিন্দুস্তানের তাফসীরী খিদমতের তালিকায় এ তাফসীরের নাম এসেছে। এর একটি পাণ্ডুলিপি (২ খণ্ডে) হিন্দুস্তানের টোংকের মাকতাবায় (ক্রমিক : ১২২ ও ১২৩) সংরক্ষিত আছে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে (ক্রমিক : ১) আরেকটি অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
তাফসীরটিতে علم الوقف والابتداء، علم رسم الخط ও علم القراءات -এর বিশেষ ইহতিমাম করা হয়েছে। তাফসীরের ভূমিকায় তিনি একাধিক ফন নিয়ে শাস্ত্রীয় আলোচনা করেন, যেমন ইলমুল কালাম, ইলমু রাসমিল খাত, ইলমুল ওয়াকফ, ইলমুল কিরাআত, ইলমুত তাফসীর, ইলমুল ফিকহ, ইলমুত তাসাউফ ইত্যাদি। দেখুন :
المكتبة القرآنية في الهند في القرن الثاني عشر الهجري< للشيخ سعيد حسن بن محمد مرتضى الندوي، ص : ৮০-১০১
ও خزينة المخطوطات (মাকতাবায়ে টোংকের সূচি) ১/২৮৪-২৮৫
প্রশ্ন ১০৯. হুজুর, আমি উলূমুল কুরআনের একটি কিতাবে الانتصار للقرآن ও المرشد الوجيز নামে দুটি কিতাবের হাওয়ালা পেয়েছি। কিতাবদুটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি?
উত্তর : الانتصار للقرآن কিতাবের মুসান্নিফ কাযী আবু বকর ইবনুত তয়্যিব আলবাকিল্লানী রাহ.। জন্ম : ৩৩৮ হি., মৃত্যু : ৪০৩ হি.। তিনি ছিলেন মালেকী মাযহাবের অনেক বড় ইমাম। ইলমুল আকায়েদ ও ইলমুল কালামসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন।
তিনি الانتصار للقرآن কিতাবে রাফেযী, খারেজী, মুতাযিলী এবং তার যুগের নাস্তিক কাফেরসহ বাতিল মতবাদের লোকদের কুরআন কারীম ও মুসহাফ সম্পর্কে নানা সংশয়-সন্দেহ ও অমূলক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন, কুরআনের বিন্যাস, কিরাআত ও কারীগণ সম্পর্কে, সেইসাথে প্রসঙ্গক্রমে কুরআন নাযিল, বিভিন্ন আয়াত ও সূরা, সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ও মর্যাদা ইত্যাদি আরো বহু বিষয়ে ওইসকল ভ্রান্ত গোষ্ঠীর নানান বিভ্রান্তি খণ্ডন করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এ কিতাবটি মুআসসাসাতুর রিসালাহ, দারু ইবনে হায্মসহ একাধিক মাকতাবা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
المرشد الوجيز কিতাবটির পূর্ণ নাম المرشد الوجيز إلى علوم تتعلق بالكتاب العزيز। এ কিতাবের মুসান্নিফ শিহাবুদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে ইসমাঈল আলমাকদিসী রাহ.। তিনি আবু শামাহ আলমাকদিসী নামেই জগদ্বিখ্যাত। জন্ম : ৫৯৯ হি., মৃত্যু : ৬৬৫ হি.। তিনি ছিলেন একাধারে শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহ, মুহাদ্দিস ও ইলমুল কিরাআতের ইমাম। আরো অনেক শাস্ত্রেরও তিনি পণ্ডিত ছিলেন।
কিতাবের পূর্ণ নাম থেকেই এর বিষয়বস্তু স্পষ্ট। তিনি এ কিতাবে কুরআন নাযিল ও সংরক্ষণ, বিভিন্ন কিরাআত এবং সাবআতে আহরুফ (أنزل القرآن على سبعة أحرف) ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ কিতাবে সাবআতে আহরুফের আলোচনা সবচেয়ে দীর্ঘ। এ প্রসঙ্গেই বিভিন্ন কিতাবে এ কিতাবের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়।
এ কিতাবটি দারুল লুবাব, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহসহ একাধিক মাকতাবা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।