লিবাসুত তাকওয়া
দুনিয়ায় মানুষের মৌলিক প্রয়োজন তিনটি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। প্রত্যেকটিই আল্লাহ তাআলার অপার নিআমতরাজির এক একটি নিদর্শন। মানুষের ওপর দুনিয়াবী এসব অনুগ্রহের কথা আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। বান্দার প্রতি মহান রবের দয়া ও অনুকম্পা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যেন শোকরগোযার বান্দারা শোকর আদায় করতে পারে এবং আরো বেশি থেকে বেশি আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারে।
আমরা যদি সূরা কুরাইশের নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব, সেখানে আল্লাহ তাআলা কুরাইশের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলছেন-
فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هٰذَا الْبَيْتِ، الَّذِيْۤ اَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ، وَّ اٰمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ.
তারা যেন এই ঘর (কা‘বার) মালিকের ইবাদত করে, যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে নিরাপদ রেখেছেন। -সূরা কুরাইশ (১০৬) : ৩-৪
এমনিভাবে আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বস্ত্র ও পোশাকের নিআমতের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন-
يٰبَنِيْۤ اٰدَمَ قَدْ اَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُّوَارِيْ سَوْاٰتِكُمْ وَ رِيْشًا وَ لِبَاسُ التَّقْوٰي ذٰلِكَ خَيْرٌ ذٰلِكَ مِنْ اٰيٰتِ اللٰهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ.
হে বনী আদম, আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং তা (তোমাদের জন্য) শোভাস্বরূপ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট। এগুলো আল্লাহর নিআমতরাজির অন্যতম। যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা আ‘রাফ (০৭) : ২৬
উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় লক্ষণীয় বিষয় হল, আল্লাহ তাআলা বাহ্যিক পোশাকের বাইরে আরেকটি পোশাকের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে, ‘লিবাসুত তাকওয়া’ বা তাকওয়ার পোশাক। সাথে একথাও বলে দিয়েছেন যে, বাহ্যিক পোশাকের চেয়ে লিবাসুত তাকওয়াই অধিক উৎকৃষ্ট। কারণ বাহ্যিক পোশাক তো কেবল গরম বা ঠাণ্ডার তীব্রতা থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে লিবাসুত তাকওয়া মুমিনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। তাছাড়া দুনিয়াবী পোশাক সর্বোচ্চ দুনিয়ায় অল্প কিছুদিনের জন্য কাজে আসবে। অথচ লিবাসুত তাকওয়া এমন পোশাক, যেটা দুনিয়াতেও মুমিনদেরকে সকল অনিষ্ট থেকে হেফাযত করবে, আবার পরকালেও সেটা কাজে দেবে।
তবে ‘লিবাসুত তাকওয়া’ কী, কীভাবে আমরা তা অর্জন করব— কুরআনের আয়াতের ‘লিবাসুত তাকওয়া’ শব্দবন্ধের ব্যাখ্যায় সালাফে সালেহীন বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। তাকওয়ার লিবাস ধারণ করতে চাইলে আমাদেরকে এই সবগুলো বিষয়ই হাসিল করতে হবে। সংক্ষেপে আমরা বিষয়গুলো তুলে ধরছি—
১. ঈমান ও ইসলাম। যেহেতু মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় হচ্ছে কুফর। আর দ্বীন ও ঈমান মানুষকে এই ভয়াবহ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। তাই অনেকেই লিবাসুত তাকওয়ার ব্যাখ্যায় ঈমান ও ইসলামের কথা উল্লেখ করেছেন।
২. সৎ কাজ। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে সৎ কাজের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ‘লিবাসুত তাকওয়া’ হিসেবে কোনো কোনো মনীষী সৎ কাজের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
৩. উত্তম পথ। যেকোনো বিষয়ে সফলতা লাভের জন্য সঠিক পথ ও পন্থা অবলম্বন করা প্রথম কর্তব্য। পরকালীন কাজের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। সেই বিবেচনায় লিবাসুত তাকওয়া ধারণ করতে হলে উত্তম পথে নিজেকে চালিত করা অনেক বেশি জরুরি।
৪. আল্লাহর ভয়। তাকওয়ার মৌলিক কথাই হচ্ছে, সকল কাজে-কর্মে একমাত্র আল্লাহর হুকুম মেনে চলা এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়কে ভয় করে চলা। তাই লিবাসুত তাকওয়া গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই অন্তরে আল্লাহর ভয় অর্জন করতে হবে।
৫. লজ্জাশীলতা। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষকে সব ধরনের বিবস্ত্রতা ও বেহয়াপনা থেকে রক্ষা করে। সে মানুষের সামনে যেমন লজ্জাজনক কাজ থেকে বিরত থাকে, তেমনি আপন রবের অপছন্দনীয় কাজ করতেও লজ্জাবোধ করে। যার দরুন লজ্জাশীল ব্যক্তি খুব সহজেই লিবাসুত তাকওয়া অর্জনে
সক্ষম হন।
৬. উপরোক্ত গুণাবলির পাশাপাশি আমাদের বাহ্যিক পোশাক এবং চালচলনও এমন হওয়া উচিত, যা তাকওয়ার পরিচায়ক। [দ্র. তাফসীরে তবারী ১২/৩৬৬-৩৬৮]
লিবাসুত তাকওয়া এমন কোনো পোশাক নয়, যেটা মার্কেট থেকে কিনে এনে গায়ে চড়ানো যাবে। বরং এর জন্য চাই নিরলস চেষ্টা ও মুজাহাদা। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার দরবারে দুআ-মুনাজাত এবং রোনাজারিও কাম্য।
বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রায়ই তাঁর দুআয় বলতেন—
اَللّٰهُمَّ أَلْبِسْنَا لِبَاسَ التَّقْوٰى.
হে আল্লাহ, আমাদেরকে লিবাসুত তাকওয়া দান করুন। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০১৪৮
এমনিভাবে প্রখ্যাত দুইজন তাবেয়ী সাঈদ ইবনে আবিল হাসান রাহ. ও মালেক ইবনে দীনার রাহ. এভাবে দুআ করতেন—
اَللّٰهُمَّ سَوِّمْنَا سِيْمَاءَ الإِيْمَانِ وَألْبِسْنَا لِبَاسَ التَّقْوٰى.
হে আল্লাহ, আমাদেরকে ঈমানের ভূষণে সজ্জিত করুন এবং তাকওয়ার আচ্ছাদনে আবৃত করুন। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০৫০৬; আযযুহ্দ, আহমাদ, পৃ. ২৬৩
লিবাসুত তাকওয়া হাসিলের আরেকটি উপায় হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়াবী যেই পোশাক দান করেছেন, তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা। এই কৃতজ্ঞতা যেমন যবানে উচ্চারণের মাধ্যমে, তেমনি পোশাকের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমেও। উদাহরণস্বরূপ উল্লিখিত সূরা আ‘রাফের (২৬ নং) আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট লক্ষ করা যায়। আয়াতটি নাযিল হয়েছিল কাফেরদের একটি মন্দ প্রথার অপনোদনে। তারা হজে¦র সময় বিবস্ত্র হয়ে কা‘বার তাওয়াফ করত এবং বলত, যেই কাপড় পরে আল্লাহর নাফরমানী করি, সেই কাপড় পরেই আবার আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করব! আল্লাহ তাআলা শয়তানের এই ধোঁকার ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রথমত পোশাকের নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এরপর ইরশাদ করেছেন—
يٰبَنِيْۤ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَاۤ اَخْرَجَ اَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا اِنَّهٗ يَرٰىكُمْ هُوَ وَ قَبِيْلُهٗ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ اِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ اَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ.
হে আদম সন্তান, শয়তান যেন তোমাদের কোনোভাবেই প্রতারিত করতে না পারে। যেভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল, তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য তাদের পোশাক সরিয়ে ফেলেছিল। সে ও তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে লক্ষ করে যে, তোমরা তাদের দেখতে পাও না। নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের সহযোগী করেছি। —সূরা আ‘রাফ (০৭) : ২৭
অতএব পোশাকের যথাযথ ব্যবহারে আমাদের যত্নবান হতে হবে। পাশাপাশি এর যেন কোনো অপব্যবহার না হয় এবং তা সংগ্রহে আমরা যেন কোনো অপব্যয়ের শিকার না হই, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।
সবশেষে আবারও কুরআনের সেই কথাই স্মরণ করি— ‘তাকওয়ার পোশাকই সর্বোৎকৃষ্ট’। লিবাসুত তাকওয়া যদি হাসিল না হয়, তবে শত পোশাক গায়ে জড়িয়েও বিবস্ত্রতা ঢাকা যাবে না। একসময় না একসময় তা প্রকাশ হয়েই পড়বে। আরব কবি আবুল আতাহিয়ার ভাষায়—
إذا المرءُ لمْ يلبَسْ ثيابًا من التُّقى
تَقلَّب عُريانًا وإنْ كان كَاسِيًا.
মানুষ যতক্ষণ না তাকওয়ার লেবাস পরিধান করবে,
গায়ে পোশাক থাকা সত্ত্বেও সে হবে বিবস্ত্র।
—দিওয়ানু আবিল আতাহিয়া, পৃ. ১৫৮