জুলুমের পরিণতি : স্বদেশ ও বিদেশ
প্রতি মাসে আলকাউসার প্রেসে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে সহকর্মীদের থেকে আবদার বাড়তে থাকে- চলমান ইস্যুতে আপনি কিছু বলুন। মূল কাজ যেহেতু লেখালেখি নয় এবং অন্যান্য চৌকিদারি করে হাতে সময়ও থাকে না, তাই প্রতিবারই না লিখে বাঁচার চেষ্টা করা হয়। আবার লিখতে রাজি হয়ে গেলে বিষয় নির্বাচনও একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ চারদিকে এক মাসে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এত কিছু ঘটে, যেগুলোকে ছোট্ট পরিসরে আঁটানো সম্ভব নয়। আবার কোনো একটি বিষয় বাছাই করতে হলে কোন্টি ছেড়ে কোন্টি নেওয়া হবে- তা-ও একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
জুন ২০২৪ ঈসায়ী-এর মাসিক আলকাউসার প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সম্পাদকীয়ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাছোড় সহকর্মীরা গো ধরে বসে আছেন, হালাতে হাজেরা বা চলমান কোনো একটি বিষয়ের ওপর অল্প কিছু হলেও লিখতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, কী বিষয়ে লেখা যায়?
একদমে চার-পাঁচটি বিষয় সামনে এসে গেল। এগুলো মাসের শুরুর দিকের। সেগুলো ছাপিয়ে এখন নতুন বিষয়ও এসে গেছে। পরে বললাম, ঠিক আছে এবার কয়েকটি বিষয়ে অল্প করে কিছু নিবেদন পেশ করা হোক।
প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়াছড়ির এই যুগে কোন্ বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন্টি কম গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাও অনেকের জন্য দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মিডিয়ার কল্যাণে ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। আবার অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় মানুষের সামনে সেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। অর্থাৎ হরেক রকম গণমাধ্যমের যতই ছড়াছড়ি বাড়ছে, উল্টো দিকে সংবাদ ও ঘটনা প্রবাহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং সেগুলোর মধ্যে কৃত্রিমতা আনার আয়োজনও সে গতিতেই এগুচ্ছে। আজ থাক সেসব কথা।
বিদেশ প্রসঙ্গ
আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজ) কর্তৃক ইসরাইলকে ‘রাফা’ এলাকায় যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ
এই দুদিন আগেই শুক্রবার ২৪ মে ২০২৪ হেগ-এ অবস্থিত জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক আদালত দখলদার ইসরাইলকে অবিলম্বে ফিলিস্তিনী গাজার রাফা এলাকায় যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সাথে সাথে জাতিসংঘকে সে এলাকায় জাতি-নিধন ও গণহত্যা তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছে। ইসরাইলকে এ-ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সে অঞ্চলে তদন্তকারীদের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেয়। যাবতীয় মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর রাস্তাও পরিষ্কার করে দেয়। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর ওপর দখলদার ইসরাইলের হামলায় শহীদ হওয়া ফিলিস্তিনী নারী, শিশু ও সাধারণ মুসলমানের সংখ্যা চল্লিশ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ ফিলিস্তিনী মারাত্মক আহত হয়েছেন।
গত আট মাসে ইসরাইল গাজা অঞ্চলে গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের এমন এক নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে, যা বহু শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে লিখিত থাকবে। পুরো উপত্যকাটির কোনো বাড়ি-ঘর ও স্থাপনা অক্ষুণ্ন রাখা হয়নি। হাসপাতাল ও বিদ্যালয়গুলো কবরস্তানে পরিণত করা হয়েছে। পৃথিবী দেখার অপেক্ষায় থাকা গর্ভের শিশু এবং আজকে জন্ম নেওয়া নবজাতকটিও তাদের বর্বরতা থেকে রক্ষা পায়নি। এমতাবস্থায় কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র নয়; বরং দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গত কয়েক মাস আগে। সে মামলার সর্বশেষ আর্জিতে কিছু দিন আগে রাফা ক্রসিংয়ে ইসরাইলের চলমান হামলা মানবতার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দক্ষিণ আফ্রিকা দখলদারদেরকে এ থেকে বিরত থাকার জরুরি নির্দেশ জারি করতে আদালতকে আহ্বান জানিয়েছে। বিস্তারিত শুনানির পর আদালত উপরোক্ত মর্মে আদেশ প্রদান করে।
আদালতের রায় প্রকাশের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের দুই বড় মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মন্তব্য থেকে বিরত রয়েছে।
বিগত দু-তিন মাস থেকে একটি বিষয় বিশ্ববাসীকে অবাক করছে। সেটি হচ্ছে, আমেরিকা-কানাডাসহ পশ্চিম ও পূর্বের অমুসলিম দেশগুলোতে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ, বিশেষত বিভিন্ন দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন এবং যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে সেসব দেশের পুলিশকে হামলা-মামলাসহ হরেক প্রকারের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এরই মধ্যে ইউরোপের তিনটি রাষ্ট্র- স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপের আরেকটি রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। বলা হয়েছে, ‘এই যুদ্ধবাজ লোকটি এ দেশে আসলেই গ্রেফতার করা হবে।’
অন্যদিকে সম্প্রতি ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, ‘যুদ্ধের কোনো কৌশলগত উদ্দেশ্যই হাসিল হয়নি। হামাসকেও ধ্বংস করা যায়নি।’
এসবই অমাবশ্যার অন্ধকারে আশার আলো। মুসলিম দেশের শাসকগণ দু-চারটি আহ্বান ও নীতিবাক্য বলে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে ঘুমিয়ে থাকলেও অন্যদের মাধ্যমে ইসরাইলের চলমান বর্বরতা বন্ধ হওয়ার একটি পথ সুগম হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার বিলও পাশ হয়েছে। জালেমের জুলুম যখন সীমা পার করে যায়, তখন মজলুম জনগোষ্ঠীর আপনজনদের মাধ্যমে জালিমকে শায়েস্তা করা না হলেও অন্য কোনো ওসীলায় আল্লাহ তাআলা তার ঘাড় মটকানোর ব্যবস্থা করে দেন। পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই চলে আসছে। সাধারণ মুসলমানদের ফিলিস্তিন ও গাজার ভাই-বোনদের জন্য চলমান দুআ এবং যার যার সাধ্য অনুযায়ী নৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা সময়ের দাবি।
স্বদেশ প্রসঙ্গ
সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে গেছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিয়ে আমরা আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
এমপি আনোয়ারুল আজিমের খুন
গত ১৩ মে ২০২৪ তারিখে নিহত হন জাতীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ভারতের কলকাতায় পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় বলে জানা গেছে। জাতীয় দৈনিকগুলোর খবরে প্রকাশ পেয়েছে, ভদ্রলোক তাঁর নিজ এলাকায় ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। হত্যা-নির্যাতন-জুলুম কোনো কিছুতেই পিছিয়ে ছিলেন না তিনি। এসব জেনেও প্রভাবশালী হওয়ায় আওয়ামীলীগ তাকে বারবার মনোনয়ন দিয়েছে। সে দাপুটে লোকটিরই এমন নির্মম পরিণতি হয়েছে।
যেকোনো মৃত্যু থেকেই মুমিন-মুসলমানকে শিক্ষা নিতে হয় যার যার অবস্থান থেকে। এই ঘটনা থেকেও যদি জুলুমবাজ ক্ষমাতাবানরা শিক্ষা নিত! যদি তারা বুঝত, কখনো কখনো জালেম ও নির্যাতনকারীদের আপনজনেরাই তার জন্য কত নিষ্ঠুর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যেতে পারে তার ক্ষমতার সকল বাহাদুরি।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এমপি আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল তাঁর নামে রেড অ্যালার্টও জারি করেছিল।
এই খুনের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে দাবি করা আখতারুজ্জামান শাহীন ছিলেন এমপি আনোয়ারুল আজীমের বন্ধু। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হলেও তাঁর প্রধান ব্যবসা ছিল সোনা চোরাচালান। আবুধাবি থেকে সোনা নিয়ে এসে তিনি ভারতে বিক্রি করতেন। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করতেন আনোয়ারুল আজীম। সম্প্রতি কয়েকটি চালান এমপি গায়েব করে দিয়েছেন, যার দাম হবে ২০০ কোটি টাকা। এই টাকার জন্যই আখতারুজ্জামান পরিকল্পিতভাবে এমপিকে খুন করেছেন।
অন্য একটি সূত্র বলেছে, বন্ধু শাহীনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন এমপি আজীম। ওই টাকা গায়েব করে দিতে হত্যার পরিকল্পনা করা হতে পারে।
আট বছর আগে আনোয়ারুল আজীম কর্তৃক মেধাবী তরুণ সোহানকে চোখ উপড়ে হত্যা করার ঘটনাটি তো এখনও দেশের আলোচিত বিষয়।
জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা
আরেকটি সংবাদ সরকারি-বেসরকারি মহলে সম্প্রতি নতুন করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তা হচ্ছে, সদ্য সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। আমাদের মতো সাধারণ লোকজনের জন্য তো এসব নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন কোনো বিষয় নয়। অনেকে তো এমনও আছেন, যাঁদেরকে কেউ ফ্রি টিকিট দিলেও আমেরিকা যেতে রাজি হন না। বিশ্বে অন্যায় কাজে মোড়লগিরির জন্য দেশটির প্রতি একধরনের অনীহা ও ঘৃণা কাজ করা লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তারা এবং তাদের মতো অন্যান্যদের জন্য এটি বড় একটি বিপর্যয়। যদি আমেরিকা যাওয়ার ভিসা বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে যদি তাদের পরিবার না যেতে পারে, সেসব দেশে তাদের অবৈধ অর্জিত সম্পদ না নিয়ে যেতে পারে, তাহলে ওই শ্রেণির লোকদের তো জীবনই বৃথা হয়ে যায়। তাই সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও তাঁর পরিবারের ওপর আমেরিকান ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সরকারি-বেসরকারি মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। একইসাথে জেনারেল আজিজের সেনাবাহিনীতে থাকাকালে তার পরিবারের লোকজন রাষ্ট্র থেকে কী কী সুবিধা অর্জন করেছে, বিভিন্ন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া এবং একসময়কার শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে পরিচিত ও আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত তার তিন তিনজন ভাইকে সরকার কীভাবে ক্ষমা করে জেল থেকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে- সেসব নিয়েও এখন ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে।
এরই মধ্যে দেশবাসী এমাসের সেরা মজাটি হয়তো পেয়েছেন আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্যে। সাবেক সেনা প্রধানের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, যারা ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে স্বীকার করে না, তাদের স্যাংশনের কোনো মূল্য নেই।
আহ কী খুশির কথা! বাংলাদেশের সরকারি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ও সিনিয়র মন্ত্রী ফিলিস্তিনী মুসলমানের পক্ষে কত দরদি কথাই না বললেন! নিজেদের কঠোর নিরাপত্তা ও জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরাইলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং প্রায় আট মাস থেকে চলতে থাকা জায়নবাদী গোষ্ঠীর এ বর্বর হামলার বিপক্ষে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলেও এবং তাদের মূল মদদদাতা আমেরিকার বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগের নির্বাচনের সময় বা তার পরে তেমন কিছু না বললেও এখন তো তিনি এটিকে গণহত্যা আখ্যা দিচ্ছেন এবং মদদদাতাদের তুচ্ছ করে কথা বলছেন। এ সাহসিকতার কি প্রশংসা না করে উপায় আছে!
যাইহোক, বর্তমান সময়ে দেশে দেশে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দেশের উপকারে কম এলেও জোরজবরদস্তি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শাসকদের দোসর হয়ে তাদের নিরাপত্তা দানেই মূলত ব্যস্ত থাকে। বিনিময়ে পেয়ে থাকে বিভিন্ন অন্যায় ও অনৈতিক সুবিধা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন এই সব নিরাপত্তাদানকারী সেবাদাসদের যে কী করুণ পরিণতি হয় তার একটি নজির জেনারেল আজিজ।
বেনজীর আহমেদের সম্পদের পাহাড় শুমারি
একসময়ের চরম পরাক্রমশালী; ক্ষমতার দাপট ও দম্ভে যার চোখ মাটিতে পড়ত না, সে এখন দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ডিএমপি কমিশনার, এলিট ফোর্স র্যাবের প্রধান এবং সর্বশেষ আইজিপি অর্থাৎ নিজ বাহিনীর প্রধানের আসনও অলংকৃত (?) করেছেন এই সাবেক পুলিশ অফিসার।
এখন চলছে তাঁর ও তাঁর পরিবারের দখলে থাকা সম্পদের পাহাড় শুমারি। একের পর এক বেরিয়ে আসছে জমি-ফ্ল্যাট-নগদ ব্যাংক-ব্যালেন্স। দেশ-বিদেশে থাকা এসব সম্পদের হিসাব করে কুল-কিনারা পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। কয়েকদিন আগে তথ্য এসেছিল ৩৪৫ বিঘা জমির। আজ আবার শোনা গেল, বেনজীরের আরো ১১৩ দলীল ও গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছেন বিচারিক আদালত।
ধারণা করা যায়, আগামী কয়েক দিন এ মহারথিকে নিয়ে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেশবাসী জানতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত বিচার হোক বা না হোক, এই সাবেক ক্ষমতাবানের মহা কারনামাগুলোর আরো কিছু ফিরিস্তিও হয়তো গণমানুষের সামনে আসবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদগুলোতে থাকাকালে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা (তার নির্দেশে) কত নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে! জুলুমের স্টীম রোলার চালিয়েছে কত অসহায় লোকের ওপর! সেসব তথ্য কি কোনো দিন বের হয়ে আসবে? এখন না হোক, আড়ালে থাকা তার পৃষ্ঠপোষকদেরও দিন যখন ফুরিয়ে আসবে, তখনো কি সেসব সামনে আসবে না? কোনো ভুক্তভোগীই কি ইহকালে এধরনের লোকদের যথোপযুক্ত পরিণাম দেখে যাবে না?
এসব প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যতেই জানা যাবে। তবে এ লোকটি আজকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, বিগত দিনগুলোতে এক মুহূর্তের জন্যও কি তিনি বা তাঁর থেকে সুবিধা নেওয়া এবং তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া ক্ষমতাবানেরা এমন কিছু কল্পনা করেছিলেন? এটিই হচ্ছে মূল শিক্ষা নেওয়ার বিষয়।
এই বেনজীর আহমেদের নাম উচ্চারিত হলেই এদেশের কোটি নিরীহ দ্বীনদার শ্রেণির মনে পড়ে যায় সেই ৫ই মে’র কথা। শাপলা চত্বর ট্রাজেডির কথা। যে রাতে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের শাপলা চত্বরে লক্ষ জনতার ওপর তাদেরই ট্যাক্সের টাকায় চলা বিভিন্ন বিভাগের সসস্ত্র বাহিনী হামলে পড়েছিল। এর পরের ঘটনা অনেকেই হয়তো এখনো ভুলে যাননি। এই হামলার মূল নেতৃত্বও ছিল এই বেনজীরের হাতে। কারণ তিনি তখন ডিএমপি কমিশনার। ঐ রাতে শাপলা চত্বরে যা করতে চাওয়া হয়েছে, তা তো করা হয়েছেই। নিরস্ত্র ও নিরীহ মুসল্লিরা জান নিয়ে বিভিন্ন মসজিদে আশ্রয় নেয়। সেই মসজিদগুলোতে গিয়েও হামলা করা হয়েছিল। এমনকি ভোরে যখন বিভিন্ন বাসে উঠে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন নিজেদের গন্তব্যে যাচ্ছিলেন তখনো এই বেনজীর বাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় রাস্তায় বাস থামিয়ে তাদেরকে বেধড়ক লাঠি-পেটা করেছে। বেনজীর-আজিজদের আজকের অবস্থা দেখে অনেকেরই মনে সেসব স্মৃতিও ভেসে উঠছে।
না, দুনিয়া জাযা-সাজা তথা প্রতিদান ও শাস্তির চূড়ান্ত জায়গা নয়। এর আসল জায়গা তো আখেরাত। যেখানে কোনো বাদী-বিবাদী, সাক্ষী বা তদন্তের কোনোই প্রয়োজন হবে না; বরং অপরাধীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোই তার সকল অপকর্মের স্বীকারোক্তি দিয়ে যাবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
يَّوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ اَلْسِنَتُهُمْ وَ اَيْدِيْهِمْ وَ اَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، يَوْمَىِٕذٍ يُّوَفِّيْهِمُ اللهُ دِيْنَهُمُ الْحَقَّ وَ يَعْلَمُوْنَ اَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ الْمُبِيْنُ.
যে দিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দেবে। সে দিন আল্লাহ তাদেরকে তাদের উপযুক্ত প্রতিদান পুরোপুরি দান করবেন এবং তারা জানতে পারবে আল্লাহই সত্য, তিনিই যাবতীয় বিষয় সুস্পষ্টকারী। -সূরা নূও (২৪) : ২৪, ২৫
আরো দেখুন, সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ৬৫
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَتُؤَدَّنَّ الحقوقُ إلى أهلها يوم القيامة، حتى يُقادَ للشاةِ الجَلْحاءِ من الشاة القَرْناءِ.
আল্লাহর শপথ! কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের হক বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি শিংবিহীন বকরির প্রতিশোধ নেওয়া হবে শিংওয়ালা বকরি থেকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮২
দুনিয়ার সকল মজলুম তার ওপর কৃত জুলুমের প্রতিকার পেয়ে যাবে। দেখতে পাবে জালেমের ভয়াবহ পরিণতিও।
কিন্তু কখনো কখনো মহান রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতেও কোনো কোনো জালেমের সামান্য পরিণতি তার বান্দাদের দেখিয়ে থাকেন।
উর্দূভাষী কবির পংক্তি মনে পড়ল-
ستمگر وقت کا تيور بدل جائے تو کيا ہوگا + ميرا سر اور تيرا پتھر بدل جائے تو کيا ہوگا
হে জালেম, সময়ের চিত্র বদলে গেলে তোমার কী দশা হবে/আমার মাথা আর তোমার পাথর বদলে গেলে তখন কী দশা হবে।