কুরআনের ভাষায় শাসকের কয়েকটি গুণ
অন্য সকল কিছুর ন্যায় ক্ষমতা ও রাজত্বও আল্লাহরই পক্ষ থেকে। কারো হাতে আসে নিআমত হয়ে, কারো জন্য আসে অভিশাপ হয়ে। ক্ষমতা যদি আল্লাহর ভয়, জবাবদিহি ও সেবার মনোভাব জাগ্রত করে এবং সেভাবেই ব্যবহার হয়, সেটি অবশ্যই আল্লাহর নিআমত। কিন্তু ক্ষমতা যদি হয় জুলুম ও শোষণের হাতিয়ার, নির্ঘাত তা নিজের জন্য এবং সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই বিপদ ও অভিশাপ। কুরআন কারীমে সৎ ও আদর্শ শাসকের সফলতা ও সুখবরের কথা যেমন এসেছে, এসেছে জালেম শাসকদের প্রতি অভিশাপ ও করুণ পরিণতির কথাও। কুরআনের শিক্ষা ও বার্তাগুলো কখনো নির্দেশনা, কখনো নীতিকথা, কখনো ঘটনা ও বিবরণের মাধ্যমে জানানো হয়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে নেককার ও আদর্শ শাসকের কিছু বিবরণ ও নির্দেশনামূলক আয়াত পেশ করা হল।
আল্লাহ ও পরকালমুখিতা
দাউদ আ.-এর পুত্র হযরত সুলাইমান আ.। বাবা ও ছেলে দুজনই একাধারে নবী ও বাদশাহ ছিলেন। সুলাইমান আ.-কে আল্লাহ তাআলা নবুওতের পাশাপাশি সুবিশাল রাজত্বও দান করেছিলেন। তাঁর প্রজাদের মধ্যে মানুষের পাশাপাশি জিনজাতি ও পাখিকূলও শামিল ছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ حُشِرَ لِسُلَيْمٰنَ جُنُوْدُهٗ مِنَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ وَ الطَّيْرِ فَهُمْ يُوْزَعُوْنَ.
সুলাইমানের জন্য তার বাহিনীগুলো সমবেত করা হল, যাতে ছিল জিন, মানুষ ও পাখিকুল। তাদের বিভিন্ন দলে বিন্যস্ত করা হত। -সূরা নামল (২৭) : ১৭
সুলাইমান আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে কী পরিমাণ নিআমত ও রাজত্ব লাভ করলেন, সেটি তাঁর ভাষায়ই জানতে পারি। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
عُلِّمْنَا مَنْطِقَ الطَّيْرِ وَ اُوْتِيْنَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ.
আমাকে পাখির ভাষা শেখানো হয়েছে এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস দান করা হয়েছে। -সূরা নামল (২৭) : ১৬
এরপর তিনি এতসব নিআমতকে আল্লাহরই করুণা ও অনুগ্রহ হিসেবে স্বীকার করে বলেছেন-
اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْفَضْلُ الْمُبِيْنُ.
নিশ্চয়ই এটি (আল্লাহ তাআলার) সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। -সূরা নামল (২৭) : ১৬
অর্থাৎ এত মহা রাজত্ব প্রাপ্তির পরও আল্লাহমুখিতা ও আল্লাহর প্রতি ভালবাসাই ছিল তাঁদের প্রথম ও প্রধান পুঁজি। আল্লাহ তাআলা তার প্রশংসা করে বলেন-
وَ وَهَبْنَا لِدَاوٗدَ سُلَيْمٰنَ، نِعْمَ الْعَبْدُ اِنَّهٗۤ اَوَّابٌ.
আমি দাউদকে দান করলাম সুলাইমান (-এর মতো পুত্র)। সে ছিল উত্তম বান্দা। নিশ্চয়ই সে ছিল অতিশয় আল্লাহ-অভিমুখী। -সূরা ছদ (৩৮) : ৩০
ইনসাফ কায়েম করা
সুলাইমান আ.-এর পিতা হযরত দাউদ আ.-কেও আল্লাহ তাআলা নবুওতের সঙ্গে রাজত্বও দান করেছিলেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
يٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلْنٰكَ خَلِيْفَةً فِي الْاَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الْهَوٰي فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيْلِ اللٰهِ، اِنَّ الَّذِيْنَ يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللٰهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌۢ بِمَا نَسُوْا يَوْمَ الْحِسَابِ.
হে দাউদ! আমি পৃথিবীতে তোমাকে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করো এবং খেয়াল-খুশির অনুগামী হয়ো না। অন্যথায় তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি, যেহেতু তারা হিসাব দিবসকে বিস্মৃত হয়েছিল। -সূরা ছদ (৩৮) : ২৬
সৎপথে অবিচল থাকা এবং অন্যায় পরিহার করা
মূসা আ. যখন আল্লাহর নির্দেশে চল্লিশ রাতের জন্য তূর পাহাড়ে গেলেন, নিজের ভাই হযরত হারূন আ.-এর হাতে স্বজাতির শাসন ও দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। তখন তিনি হারূন আ.-কে বলেছিলেন-
اخْلُفْنِيْ فِيْ قَوْمِيْ وَ اَصْلِحْ وَ لَا تَتَّبِعْ سَبِيْلَ الْمُفْسِدِيْنَ.
আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করবে, সবকিছু ঠিকঠাক রাখবে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করবে না। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৪২
বোঝা যায়, একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব, জনগণের দ্বীন-ঈমান ও জাগতিক সবকিছুর সঠিক তত্ত্বাবধান, দেখভাল ও ঠিকঠাক রাখা। কোনো ধরনের ফাসাদ সৃষ্টি না করা এবং সৃষ্টি হতে না দেওয়া।
শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন
একজন আদর্শ শাসকের যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা, তেমনি শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন করাও তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ‘যুলকারনাইন’ উপাধিতে পরিচিত আল্লাহপ্রিয় একজন দ্বীনদার বাদশাহ ছিলেন। কুরআন কারীমে তাঁর কিছু ঘটনা ও গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তাকে পৃথিবীর বুকে শক্তি-ক্ষমতা দান করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রত্যেক বিষয়ের উপকরণ। (অর্থাৎ তাঁর ছিল উপায়-উপকরণের মাধ্যমে যে কোনো কাজ সম্পন্ন করা এবং যে কোনো জিনিস তৈরি করার যোগ্যতা।)
তিনি একবার সফরে বের হলেন। যেতে যেতে এমন স্থানে পৌঁছলেন, যেখানে সন্ধ্যাবেলায় দর্শকের কাছে মনে হত, যেন সূর্য এক কর্দমাক্ত জলাশয়ে অস্ত যাচ্ছে। সেখানে তিনি একটি সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পেলেন। সম্ভবত তারা আল্লাহর আনুগত্যকারী ছিল না। তখন আল্লাহ তাআলা বললেন-
يٰذَا الْقَرْنَيْنِ اِمَّاۤ اَنْ تُعَذِّبَ وَ اِمَّاۤ اَنْ تَتَّخِذَ فِيْهِمْ حُسْنًا.
হে যুলকারনাইন! (তোমার সামনে দুটি পথ আছে।) হয় তুমি তাদেরকে শাস্তি দেবে, নতুবা তাদের ব্যাপারে উত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। [দ্র. সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৮৪-৮৬]
অর্থাৎ, রাজা-বাদশাহদের যেমন ভালো-মন্দ উভয়ই করার ক্ষমতা থাকে, তেমনি যুলকারনাইনকে উভয় বিষয়ের ক্ষমতা দান করা হল। ইচ্ছা করলে সৃষ্টিজীবকে কষ্ট দিয়ে কুখ্যাত হতে পারে, ইচ্ছা করলে ন্যায় বিচার ও ইনসাফ কায়েম করে সুনাম-সুখ্যাতিও অর্জন করতে পারে। আয়াতের আরেকটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। (দ্র. তাফসীরে উসমানী, বাংলা অনুবাদ খ. ২ পৃ. ৪৫৬)
তখন যুলকারনাইন যে উত্তর দিয়েছিলেন তার সারমর্ম হল, আমি তাদেরকে সরল পথে চলার দাওয়াত দেব, যারা দাওয়াত কবুল না করে এভাবে জুলুমের পথ অবলম্বন করবে আমি তাদেরকে শাস্তি দেব। যারা দাওয়াত কবুল করে ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম অবলম্বন করবে, তাদের প্রতি আমি সহজ ও সদয় আচরণ করব। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/১৪০)
কুরআন কারীমের ভাষায়-
اَمَّا مَنْ ظَلَمَ فَسَوْفَ نُعَذِّبُهٗ ثُمَّ يُرَدُّ اِلٰي رَبِّهٖ فَيُعَذِّبُهٗ عَذَابًا نُّكْرًا، وَ اَمَّا مَنْ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَلَهٗ جَزَآءَِالْحُسْنٰي وَ سَنَقُوْلُ لَهٗ مِنْ اَمْرِنَا يُسْرًا.
তাদের মধ্যে যে কেউ সীমালঙ্ঘন করবে তাকে আমি শাস্তি দেব। তারপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে, তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। তবে যে ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে, তার জন্য প্রতিদান স্বরূপ রয়েছে কল্যাণ এবং আমিও আদেশ করার সময় তাকে সহজ কথা বলব। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৮৭-৮৮
বস্তুত ন্যায়পরায়ণ শাসকের রীতিই হল, দুরাচারীদের শাস্তি প্রদান আর ভালো লোকদের সঙ্গে নম্র ও কোমল আচরণ। অর্থাৎ শিষ্টের লালন, দুষ্টের দমন।
আল্লাহর প্রতি ভরসা ও অকাতরে জনগণের জন্য খরচ করা
ইয়াজুজ ও মাজুজ নামক একটি অসভ্য গোষ্ঠীর অনাচার থেকে যখন একটি সম্প্রদায় যুলকারনাইনের শরণাপন্ন হয়ে বলল, হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়। প্রয়োজনে আমরা আপনাকে কিছু র্ক দেব, যার বিনিময়ে আপনি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর বানিয়ে দেবেন!
তখন যুলকারনাইন তাদের থেকে অর্থগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন-
مَا مَكَّنِّيْ فِيْهِ رَبِّيْ خَيْرٌ فَاَعِيْنُوْنِيْ بِقُوَّةٍ اَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَ بَيْنَهُمْ رَدْمًا.
আল্লাহ আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন সেটাই (আমার জন্য) শ্রেয়। সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সহযোগিতা কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৯৫
জনসাধারণের খেদমতকে সৌভাগ্য মনে করা এবং শোকর আদায় করা
শাসকদের আল্লাহ তাআলা ক্ষমতা ও সামর্থ্য দান করেন। চাইলে তারা এমন অনেক ভালো কাজ করতে পারেন, যা সাধারণত অন্যদের জন্য কঠিন। আল্লাহপ্রদত্ত সেই ক্ষমতা ও সামর্থ্য ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করার পর নিজের বাহাদুরি না ফলিয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ইয়াজুজ ও মাজুজের অনাচার থেকে নিরাপত্তা-প্রাচীর নির্মাণের পর মহা শৌর্য-বীর্যের অধিকারী বাদশা যুলকারনাইন নিজের কোনো বাহাদুরি ফলাননি এবং গর্ব করেননি। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা সেই ঘটনা ও যুলকারনাইনের হৃদয়ের অবস্থাও দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছিলেন-
قَالَ هٰذَا رَحْمَةٌ مِّنْ رَّبِّيْ، فَاِذَا جَآءَ وَعْدُ رَبِّيْ جَعَلَهٗ دَكَّآءَ، وَ كَانَ وَعْدُ رَبِّيْ حَقًّا.
যুলকারনাইন বলল, এটা আমার রবের রহমত (যে, তিনি এরকম একটা প্রাচীর বানানোর তাওফীক দিয়েছেন)। অতঃপর আমার রবের প্রতিশ্রুত সময় যখন আসবে, তখন তিনি এ প্রাচীরটি ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন। আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত সত্য। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৯৮
রক্ষণাবেক্ষণে পূর্ণ যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ ধারণা থাকা
হযরত ইউসুফ আ. দেশের পরিস্থিতি দেখে এবং আসন্ন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা চিন্তা করে নিজ থেকে দরখাস্ত করে দেশের অর্থ বিভাগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। নিজের গুণকীর্তন বা ক্ষমতার লোভে নয়; বরং দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই নিজের মধ্যে নিহিত দুটো গুণের কথা বাদশাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-
اجْعَلْنِيْ عَلٰي خَزَآىِٕنِ الْاَرْضِ اِنِّيْ حَفِيْظٌ عَلِيْمٌ.
আপনি আমাকে দেশের অর্থ-সম্পদের (ব্যবস্থাপনা) কার্যে নিযুক্ত করুন। নিশ্চিত থাকুন, আমি রক্ষণাবেক্ষণে পারদর্শী ও সুবিজ্ঞ। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৫৫
কাজেই জাতীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয় ও ব্যয়ের খাত সম্পর্কে অবগতি এবং হিসাব-নিকাশে পারদর্শী হওয়া একজন শাসকের জন্য অপরিহার্য।
ঘুস-উৎকোচ ও অন্যায় সুবিধা গ্রহণ এড়িয়ে চলা
সুলাইমান আ. যখন সূর্যপূজারী এক রাণীর (অনেক মুফাস্সিরের মতে তার নাম রানী বিলকিস) কাছে ইসলাম গ্রহণের চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে ছিল এক আল্লাহর আনুগত্যের দাওয়াত। রাণী তার সভাসদবর্গের সাথে পরামর্শ করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন- আগে কিছু উপঢৌকন পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হোক, বাদশার আগ্রহ কোন্ জিনিসে- ধন-সম্পদে, না দুর্লভ বস্তু সামগ্রীতে! তাই সব ধরনের উপহারসামগ্রী পাঠালেন।
উপহার গ্রহণ করলে বোঝা যাবে, তিনি কেবলই একজন রাজা এবং গতানুগতিক রাজাদের মতোই অর্থ ও ক্ষমতার মোহে আক্রান্ত। সে মতে তার সাথে বোঝাপড়া করার সুযোগ থাকবে। উপঢৌকন পাঠিয়ে আসন্ন মসিবতও মাথার ওপর থেকে সরানো যাবে। যদি আমাদের হাদিয়া প্রত্যাখ্যান করেন, তবে বুঝতে হবে, তিনি পার্থিব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে; কোনো অলৌকিক যোগাযোগ ও শক্তি দ্বারা চালিত। সে ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার চিন্তা ত্যাগ করে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশই হবে সুবুদ্ধির পরিচায়ক। তাই রাণী বলেছিলেন-
وَ اِنِّيْ مُرْسِلَةٌ اِلَيْهِمْ بِهَدِيَّةٍ فَنٰظِرَةٌۢ بِمَ يَرْجِعُ الْمُرْسَلُوْنَ.
বরং আমি তাদের কাছে উপঢৌকন পাঠাব। তারপর দেখব, দূতেরা কী উত্তর নিয়ে ফেরে। -সূরা নামল (২৭) : ৩৫ (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর; তাফসীরে কুরতুবী)
কিন্তু সুলাইমান আ. যেহেতু পার্থিব মোহে আক্রান্ত সাধারণ কোনো শাসক ছিলেন না, তাই তিনি এসব হাদিয়া-উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করে বললেন-
اَتُمِدُّوْنَنِ بِمَالٍ فَمَاۤ اٰتٰىنِ َۧ اللهُ خَيْرٌ مِّمَّاۤ اٰتٰىكُمْ بَلْ اَنْتُمْ بِهَدِيَّتِكُمْ تَفْرَحُوْنَ.
তোমরা কি ধন-সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাও? তবে (শোনো), আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার চেয়ে উত্তম। বরং তোমরা নিজেদের উপহার-সামগ্রী নিয়ে খুশি থাক। -সূরা নাম্ল (২৭) : ৩৬
স্বচ্ছতা, আমানতদারি ও ন্যায়বিচার
এই প্রসঙ্গে মুমিনের প্রতি কুরআনের নিদের্শনা-
اِنَّ اللهَ يَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤي اَهْلِهَا وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ، اِنَّ اللهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهٖ، اِنَّ اللهَ كَانَ سَمِيْعًۢا بَصِيْرًا.
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৫৮
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করা আদর্শ শাসকের অন্যতম প্রধান গুণ
একজন শাসকের সবচেয়ে বড় গুণ আসমানী কিতাব ও শরীয়ত গ্রহণ করা এবং সেই অনুযায়ী ফয়সালা ও বিচার করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَيْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ الْحَقِّ.
(হে রাসূল!), আমি আপনার প্রতি সত্যসম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, তার পূর্বের কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী ও সেগুলির (বিষয়বস্তুর) সংরক্ষকরূপে। সুতরাং আপনি তাদের মধ্যে সেই বিধান অনুসারেই বিচার করুন, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। আর আপনার নিকট যে সত্য এসেছে তা এড়িয়ে ওদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৮
আরো ইরশাদ করেন-
وَ اَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ وَ احْذَرْهُمْ اَنْ يَّفْتِنُوْكَ عَنْۢ بَعْضِ مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ اِلَيْكَ.
আর (আমি আদেশ করছি,) আপনি মানুষের মধ্যে সেই বিধান অনুসারেই বিচার করবেন, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। ওদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, ওরা যেন আপনাকে কোনো বিধান থেকে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন, বিচ্যুত করতে না পারে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৯
কাজেই মুসলিম নামের অধিকারী আল্লাহর কোনো বান্দার জন্য কুরআন ও ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিচার করা বা রায় দেওয়া কত যে গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিরুদ্ধাচরণ করা কত ভয়াবহ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শরীয়তের বরখেলাফ শাসন ও বিচারকার্যকে কুরআন কারীমে ‘জাহিলিয়াতের শাসন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُوْنَ، وَ مَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُّوْقِنُوْنَ.
তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধান চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কে আছে? -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৯-৫০
প্রিয় পাঠক!
জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে, কোনো না কোনো অঙ্গনে সবাইকে নিতে হয় কিছু না কিছু শাসন ও দায়িত্বভার। হোক তা নিজের বা পরিবারের, হোক প্রতিষ্ঠান বা সমাজের কিংবা দেশ ও রাষ্ট্রের। সবক্ষেত্রেই কুরআনী শিক্ষাগুলো আমাদের জন্য পাথেয়।