মহব্বত হতে হবে আল্লাহর জন্য
সৃষ্টিগতভাবেই মানুষকে আল্লাহ তাআলা যেসব গুণ ও স্বভাব দান করেছেন তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হল, মহব্বত। এটি নিছক একটি গুণই নয়, এটি জীবন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি। জীবন ও জগতের বহু বিষয়, চিন্তা ও কর্মের বহু ক্ষেত্র এবং ধ্যান ও ভাবনার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা এই সহজাত শক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ব্যক্তির চেতনে-অবচেতনে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এই গুণ ও স্বভাব তার মাঝে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে কোনো কোনো পর্যায়ে এটি দুর্দম প্রভাবক শক্তিরূপে প্রকাশ পায়। তখন মানুষ তার সামনে একরকম অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে নিজের বিবেক ও বিবেচনা, জ্ঞান ও বুদ্ধি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিরোধী কাজের প্রতিও উদ্যত হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে কারো কাছেই বিষয়টি স্পষ্ট ও বোধগম্য।
মহব্বত সৃষ্টি হয় কীভাবে?
সকল ভালো ও সৌন্দর্যের প্রতিই মানুষের কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। কিছু মুগ্ধতা ও ভালো লাগা থাকে। ফলে যেখানে এবং যার মাঝে সেই ভালো ও সৌন্দর্য থাকে, তার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়। সেই আকর্ষণ থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় মহব্বত ও ভালবাসা।
এমনিভাবে মানুষ যার কাছ থেকে অনুগ্রহ লাভ করে তার প্রতিও অনুভব করে বিশেষ এক ধরনের টান ও আগ্রহ। ফলে অনুগ্রহকারীর প্রতিও মানব-হৃদয়ে ভালবাসার সঞ্চার হয়।
এছাড়া কখনো শুধু কাছাকাছি থাকা, নিয়মিত সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ করা, কোনো না কোনো মাধ্যমে খোঁজ-খবর রাখা এবং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথাবার্তা বলা ইত্যাদি কারণেও একধরনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সেই ঘনিষ্ঠতাও কখনো অন্তরঙ্গতা বা মহব্বত ও ভালবাসার রূপ ধারণ করে। তবে মৌলিকভাবে এটা থাকে একধরনের ঘোর কিংবা মোহনির্ভর আকর্ষণ ও মায়া, যা নির্দিষ্ট একটা সময় পরে হালকা হয়ে যায়। কখনোবা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম হয় অথবা নিজের ভুল বুঝতে পারলে অনুতাপ ও অনুশোচনার আবেগ তৈরি হয়।
মোটকথা, মানব স্বভাবে থাকা মহব্বত ও ভালবাসা বিভিন্নজনের মাঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পায়। তা থেকে যথাযথভাবে লাভবান হওয়ার মানুষ কম হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সংখ্যা কম হয় না।
তবে হাঁ, যথাস্থানে, যথানিয়মে, যথাযথ পন্থায় মহব্বত যেমন সকলের কাম্য, তেমনি তার উপকারিতাও যথেষ্ট বিস্তৃত।
মহব্বতের মানদণ্ড কী?
হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশেষ এক মুহূর্তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন- আপনি (আমার কাছে কিছু) প্রার্থনা করুন। তখন তিনি প্রার্থনা করলেন এভাবে-
...اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يُحِبُّكَ، وَحُبَّ عَمَلٍ يُقَرِّبُ إِلىূ حُبِّك.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার মহব্বত চাই এবং চাই ঐ ব্যক্তির মহব্বত, যে আপনাকে মহব্বত করে। আর ঐ কাজের প্রতিও মহব্বত চাই, যা আপনার মহব্বতের নিকটবর্তী করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৩৫; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৯৪৯
এমনিভাবে সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ আলখাতমী রা. থেকেও একটি দুআ বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলতেন-
اللّٰهُمَّ ارْزُقْنِي حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يَنْفَعُنِي حُبُّه عِنْدَكَ.
হে আল্লাহ! আমাকে আপনার মহব্বত দান করুন এবং যার মহব্বত আপনার কাছে আমার জন্য উপকারী হয়, তার মহব্বতও দান করুন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৩১৫৭১
দুআটি কোনো কোনো কিতাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআ হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে।
(দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯১; কিতাবুদ দুআ, তবারানী, হাদীস ১৪০৩)
উপরোক্ত দুটি দুআতেই খুব গুরুত্বের সাথে আল্লাহর মহব্বত চাওয়া হয়েছে। এরপর চাওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তির মহব্বত, যে আল্লাহকে ভালবাসে এবং যার মহব্বত আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য উপকারী হয়। এমন কাজের মহব্বতও চাওয়া হয়েছে, যা বান্দাকে আল্লাহর মহব্বত লাভে অগ্রসর করে।
এসব হাদীস থেকে বোঝা যায়, বান্দার মহব্বত হতে হবে মূলত আল্লাহ তাআলার প্রতি। মহব্বতের এই শক্তি দিয়ে বান্দা তার রবের নৈকট্য অর্জন করবে। তাঁর আনুগত্যে নিজেকে অবিচল রাখবে। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশ পালনে সংকল্পবদ্ধ হবে। তাঁর অবাধ্যতা থেকে নিজেকে সর্বতোভাবে সংযত রাখবে।
এরপর অন্য কারো প্রতি মহব্বত হলে সেটা হবে কেবলই আল্লাহ তাআলার মহব্বতকে কেন্দ্র করে এবং আল্লাহ তাআলার খুশি ও সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে।
কেবলই মনের ভালো লাগা বা চোখের ভালো লাগার ভিত্তিতে ভালবাসা, এমনিভাবে দ্বীন-ইসলাম ও শরীয়তের কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো কারণে ভালবাসা- মুমিনের কাঙ্ক্ষিত ভালবাসা হতে পারে না। আর দ্বীন-বিরোধী কোনো ক্ষেত্রে এবং শরীয়ত নিষিদ্ধ কোনো পন্থায় মহব্বত ও ভালবাসা মুমিনের ঈমানী যিন্দেগীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখতে হবে- মুমিনের সকল কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য হওয়া জরুরি। তদুপরি মহব্বতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা; যা অবশ্যই আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। তাছাড়া হাদীস শরীফে এসেছে- সাত শ্রেণির লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে, তন্মধ্যে এক শ্রেণি হল-
رَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ، اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ.
ঐ দুই ব্যক্তি, যারা একে অপরকে মহব্বত করে আল্লাহর জন্য। তাঁর জন্যই একত্রিত হয়, আবার তাঁর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬০, ১৪২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩১
মহব্বতের প্রকাশ ও ঝুঁকি
কেউ কাউকে মহব্বত করলে তার কাছে যেমন নিজেকে ভালো রাখতে চায়, তেমনি তার সন্তুষ্টির প্রতিও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে লক্ষ রাখে। খেয়াল রাখে তার খুশি-অখুশি, পছন্দ-অপছন্দ এবং ভালো লাগা না লাগা। সর্বোপরি তার সন্তুষ্টি আর আনন্দই থাকে পরম আরাধ্য। আর সেজন্য মানুষ কত কী-ই না করে। কত ত্যাগ-কুরবানী স্বীকার করে। কত কষ্ট-যাতনা সহ্য করে। কত দুঃসাধ্য সাধন করে এবং কত কিছু বিসর্জন দেয়। এমনকি প্রিয়জনের সন্তুষ্টির জন্য অন্য কতজনকে অসন্তুষ্ট করে! কতজনকে কষ্ট দেয়! কতজনের ওপর জুলুম করে! কত নিয়ম, নীতি, রীতি, প্রথা লঙ্ঘন করে! এক্ষেত্রে সে অন্য কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা আগ্রহ-দাবিরও পরোয়া করে না। মহব্বতের মাত্রা ও পরিমাণ অনুযায়ী এজাতীয় বহু কর্মকাণ্ড হয় শুধু প্রিয়জনকে খুশি করার লক্ষ্যে! কিংবা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে!
মহব্বত যখন এমনই ঝুঁকিপূর্ণ শক্তিশালী একটি বিষয়, তার জন্য অবশ্যই কিছু নিয়ম ও নীতি থাকবে। অবশ্যই এ বিষয়ে শরীয়তের কিছু মৌলিক নির্দেশনা থাকবে।
তো এ বিষয়ে প্রথম কথা হল, মহব্বত হতে হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহর পছন্দ ও সন্তুষ্টিই হবে মহব্বতের কেন্দ্রীয় বিষয়।
এতএব যাকে মহব্বত করলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন, তাকে যেমন মহব্বত করা যাবে না, তেমনি মহব্বতের আতিশয্যে যেসব কাজ আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে আবশ্যক করে, তা থেকেও বাঁচতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। এ বিষয়ে শরীয়তের পরিষ্কার নীতি হল-
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ.
আল্লাহর নাফরমানী করে কোনো মাখলুকের আনুগত্য হবে না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৬৫৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৩৭১৭
কারণ মহব্বতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিষয়টিই হল ইতাআত বা আনুগত্য। মানুষ যাকে মহব্বত করে, নিজের অজান্তেই তার আনুগত্য করে। অবচেতন মনেই তার সন্তুষ্টিকে গুরুত্ব¡ দেয়।
কবিতায় আছে-
لو كان حُبُّكَ صَادِقًا لأَطَعْتَه + إنَّ المُحِبَّ لمَن يُحِبُّ مُطِيْع
‘যদি তার প্রতি তোমার মহব্বত সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তুমি তার আনুগত্য করবে। নিশ্চয়ই প্রেমিক প্রেমাষ্পদের অনুগত-অনুসারী হয়।’
সেজন্য মহব্বতের ক্ষেত্রে খুব যত্নের সাথে খেয়াল রাখতে হবে- আমি যাকে মহব্বত করি, তাকে মহব্বত করতে শরীয়তের কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে কি না! তার আনুগত্যে শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘনের আশঙ্কা আছে কি না!
হিসাব নিতে হবে- মহব্বতের ক্ষেত্রে আমি কতটা নিয়ন্ত্রিত! আবেগের বশবর্তী হয়ে মুমিন শরীয়ত থেকে বের হতে পারে না। মহব্বতের আতিশয্যে মুমিন তার দ্বীনকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। মুমিনের ভেতরে তার ঈমান থাকবে সদা জাগরূক, জীবন্ত, সতেজ, সজীব। মুমিনের ঈমান হল তার সবচেয়ে দামি সম্পদ। দুনিয়া আখেরাতের সকল বিষয়ে তাকে তার ঈমান সতর্ক করবে, নির্দেশনা দেবে। তাকে মনে রাখতে হবে- আমার ঈমান সবার আগে, সবকিছুর আগে। ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত করে- এমন কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আর মনে রাখতে হবে এই হাদীস-
مَنْ أَحَبَّ لِلهِ، وَأَبْغَضَ لِلهِ، وَأَعْطَى لِلهِ، وَمَنَعَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, আল্লাহর জন্য কারো প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়, আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু দেয় এবং আল্লাহর জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকে- সে ঈমানকে পূর্ণ করল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৭১
আর মহব্বত যখন আল্লাহর জন্য হবে তখন তাতে যেমন নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তেমনি থাকবে নিজের ও অপরের সার্বিক কল্যাণকামিতা। সকল চিন্তা ও সিদ্ধান্তেই থাকবে মজবুত এক নিয়ন্ত্রণ। থাকবে ঈমান সুরক্ষার ফিকির ও আমলে অবিচলতার পূর্ণ প্রস্ততি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে জীবনের সকল কাজে তাঁর হুকুম ও বিধান সামনে রাখার তাওফীক দিন। তাঁর সন্তুষ্টি ও রেযামন্দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন।