শ্রমিকের অধিকার সব সময়ের
আজ পহেলা মে। দুপুর প্রায় ৩টা বাজে। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু মনে হয় বাস্তবে তাপমাত্রা অনেক বেশি। তীব্র দাবদাহে মনে হচ্ছে চারপাশ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দূর থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ রড কাটছে, কেউ কাঠে পেরেক ঠুকছে।
পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে আমেরিকায় এক শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ আক্রমণ করে। সেখানে বেশ কজন শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। সেই দিনকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় এই ‘শ্রমিক দিবস’।
বহুকাল ধরে আমরা যেহেতু পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করে আসছি, তাই সেখান থেকে নির্দ্বিধায় ভালো-মন্দের বাছবিচার ছাড়াই সব আমদানি করছি। তাদের থেকে আমদানি করা জিনিসগুলোর মধ্যে নফস ও শয়তানের খুশি হওয়ার জিনিসগুলোই বেশি থাকে। ভালো যা আমদানি করি, সেগুলো কেবলই নামকাওয়াস্তে। শিরোনাম আছে, কিন্তু সারশূন্য। পশ্চিম থেকে নামকাওয়াস্তে আমদানি করা জিনিসের মধ্যে একটি হল, এইসব নানা রকম দিবস। প্রতি বছর এই দিনে নানা শ্লোগান থাকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর নানা বাণী থাকে। বিভিন্ন সংগঠন নানান দাবি-দাওয়া পেশ করে। এরপর ফলাফল কী হয়? ফলাফল তথৈবচ। শ্রমিককে বেতন-বোনাসের জন্য আন্দোলন করতে হয়। সেই আন্দোলন থেকে কখনো রক্তাক্ত ফিরতে হয়। কখনো ফিরতে হয় সহকর্মীর লাশ কাঁধে। কখনো ফিরতে হয় নিজেই লাশ হয়ে। অধিকার আদায় করতে গিয়ে আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় নিরীহ শ্রমিকেরা। অথচ ইসলামের দেওয়া শ্রমিকের অধিকারগুলো সঠিকভাবে চর্চিত হলে, না শ্রমিকদের কষ্ট করতে হয়, না পশ্চিমের ব্যর্থ অনুকরণ করতে হয়।
দেড় হাজার বছর আগে মানবতার চরম দুর্যোগে আলোকবর্তিকা হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কুরআন-সুন্নাহ্র কোমল স্পর্শে মানবতা জেগে উঠেছিল। ঘুম ভেঙে মানবতা দেখেছিল পৃথিবীর চারপাশ আলোয় আলোয় ভরা। সেই বিবরণ অনেক দীর্ঘ। সেই আলোর দিশা পেয়েই পথহারা মানুষ ছুটে আসছে ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। আজ এতসব কথা না বলে শুধু শ্রমিকদেরকে ইসলাম কতটুকু অধিকার দিয়েছে তারই সামান্য নমুনা পাঠকদের সামনে পেশ করব।
মানুষ মানুষের কাছে নানান প্রয়োজনে ছুটে যায়। কেউ শ্রম দেয় অর্থের জন্য, কেউ অর্থ দেয় শ্রম নেওয়ার জন্য। এই প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক হলেও অর্থের প্রয়োজন শ্রমিককে সমাজের চোখে ছোট করে তোলে। এই ছোট ভাবনাটাই শ্রমিককে অবহেলা ও নিগ্রহের মুখে ঠেলে দেয়। ইসলাম এসে এ ধারণাকে বিলুপ্ত করে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দেন-
إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ.
তোমাদের সেবকেরা তোমাদের ভাই। তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীন করেছেন। কারও অধীনে কোনো ভাই থাকলে সে যা খায় তাকেও যেন তা খাওয়ায়, সে যা পরিধান করে তাকেও যেন তা পরায়। তোমরা তাদের ওপর কষ্টকর কাজ চাপিয়ে দিয়ো না। যদি দিতেই হয়, তাহলে তাদেরকে সহযোগিতা কর।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০
শুধু এটুকুই নয়, তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে বলেছেন; ঠিক যেমন মানুষ নিজ সন্তানের সঙ্গে আচরণ করে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أَكْرِمُوهُمْ كَكَرَامَةِ أَوْلَادِكُمْ، وَأَطْعِمُوهُمْ مِمَّا تَأْكُلُونَ.
তাদেরকে সন্তানের মতো মর্যাদা দাও (আদর-যত্ন কর)। তোমরা যা খাও তাদেরকেও খাওয়াও। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৬৯১
এসব ঘোষণার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ سَيِّءُ الْمَلَكَةِ.
রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে যাবে না। -প্রাগুক্ত
চাকর-নফরের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের শাস্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গিয়েছেন-
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيِّ، قَالَ: كُنْتُ أَضْرِبُ غُلَامًا لِي، فَسَمِعْتُ مِنْ خَلْفِي صَوْتًا: اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ، للهُ أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ، فَالْتَفَتُّ فَإِذَا هُوَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، هُوَ حُرٌّ لِوَجْهِ اللهِ، فَقَالَ: أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ لَلَفَحَتْكَ النَّارُ، أَوْ لَمَسَّتْكَ النَّارُ.
আবু মাসউদ আনাসারী রা. বলেন, আমি একদিন গোলামকে মারছিলাম। পেছনে কাউকে বলতে শুনলাম, মনে রেখ আবু মাসউদ, আল্লাহর ক্ষমতা তোমার ওপর এর চেয়েও বেশি।
পেছনে ফিরে দেখি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে। বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, সে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ।
নবীজী বললেন, তুমি এমনটি না করলে আগুন তোমাকে পুড়িয়ে দিত কিংবা বলেছেন, স্পর্শ করত।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৫৯
এ দেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। এ দেশেই গরমের অভিজ্ঞতা যা হচ্ছে, তা ভয়াবহ। হিটস্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। রোদে বের হলে মনে হয়, চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। একটু ছায়া, একটু পানির জন্য দেহ-মন কাতর হয়ে ওঠে। দুনিয়ার সূর্যের তাপেরই যখন এমন তীব্রতা। পরকালে সূর্যের তীব্রতা কী ভয়াবহই না হবে। যখন সূর্য থাকবে মাত্র আধা হাত ওপরে, ওই সময়ে ছায়ার জন্য মানুষ কী করবে, ওই কঠিন সময়ে আল্লাহ তাআলা কিছু মানুষের প্রতিপক্ষ হবেন। তাদের একজনের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
رَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أجِيرًا، فاسْتَوْفَى منه، ولم يُعطِه أجرَه.
এক ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। তার থেকে শ্রম আদায় করে নিয়েছে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করেনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২২৭
শ্রমিকের শ্রম নেওয়ার পর ইসলাম বলে, যত দ্রুত সম্ভব পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। নবীজী সেই দ্রুততা কতটা হবে- তা খুব সুন্দর করে ব্যক্ত করেছেন-
أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ.
ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দাও। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৪৩
কাজ করতে গিয়ে মানুষের নানা রকম ভুল হয়ে। ভুল যে মানুষের কতভাবে হতে পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমার উস্তাযে মুহতারাম মুফতী আবদুস সালাম ছাহেব বলতেন, ‘ভুলের কোনো মূলনীতি নেই। ভুল যে কোনোভাবেই হতে পারে।’
এক সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, কর্মচারিকে কত বার মাফ করব?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব। সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করেন। নবীজী কোনো উত্তর দেননি। তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলে নবীজী বলেন-
اعْفُوا عَنْهُ فِي كُلِّ يَوْمٍ سَبْعِينَ مَرَّةً.
প্রতিদিন সত্তর বার ভুল করলে সত্তর বার ক্ষমা করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৬৪
ইসলামের এই শিক্ষা গোটা আরব জাহানকে বদলে দিয়েছিল। জাহেলী যুগে যেখানে আরবরা গোলাম-শ্রমিকদের সঙ্গে চতুষ্পদ প্রাণীর মতো আচরণ করত, সেখানে আরবরা গোলাম ও শ্রমিকদের বুকে টেনে নিল। নিজে যা খেত, তাই খেতে দিত। নিজে যা পরত, তাই পরতে দিত। গোলামের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অনুশোচনায় গোলামকে আযাদ করে দিত কিংবা মনিব গোলামকে সমান প্রতিশোধ নিতে আহ্বান জানাত।
যুবায়ের ইবনে আব্দুল্লাহ্র দাদি ছিলেন উসমান রা.-এর খাদেম। তিনি বলেন, উসমান রা. কাউকে ঘুম থেকে উঠাতেন না। নিজে নিজেই ওযু করতেন। কেউ সজাগ থাকলে তার থেকে সহযোগিতা নিতেন।-আলইসাবাহ ৪/৪৫৮
হিলাল ইবনে ইয়াসাফ বলেন, আমরা সুওয়াইদ ইবনে মুকাররিন রা.-এর বাড়ি গেলাম। আমাদের সঙ্গে এক বৃদ্ধ ছিলেন খুবই রাগি। সঙ্গে ছিল তার এক বাদি। বৃদ্ধ বাদির চেহারায় থাপ্পড় মারলেন। সুওয়াইদ ইবনে মুকাররিনকে সেদিনের মতো রাগ করতে আর দেখিনি। তিনি বললেন, থাপ্পড় মারার জন্য কেবল চেহারাই ছিল!
আমরা সাত ভাই ছিলাম। আমাদের মাত্র একজন ভৃত্য ছিল। কোনো এক ভাই একদিন সেই ভৃত্যকে মেরেছিল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই গোলামকে আযাদ করে দেওয়ার হুকুম দিলেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৬৬
সুওয়াইদ ইবনে মুকাররিন রা.-এর ছেলে মুআবিয়া বলেন-
لَطَمتُ مولى لنا، فدَعَاه أبي ودَعَاني، فقال: اقتَصَّ مِنْه.
আমি একবার আমাদের এক গোলামকে থাপ্পড় দিয়েছিলাম। বাবা আমাকে এবং গোলামকে ডাকলেনে। গোলামকে বললেন, আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৬৭
মে দিবস। তাই চতুর্দিকে শুধু শ্রমিকের অধিকার নিয়েই আওয়াজ-উচ্চারণ। সেই আওয়াজ-উচ্চারণের প্রভাব শ্রমিকের জীবনে কতটুকু তা আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। যারা দ্বীন-শরীয়ত মেনে চলার চেষ্টা করি, তারা হা-হুতাশ করি, আহ এত সুন্দর ইসলামের বিধান ছেড়ে আমরা কোথায় চলেছি। শ্রমিককে ইসলামের দেওয়া এত এত অধিকার শুনে হয়তো কেউ ভাবতে পারেন, মালিকের অধিকার কোথায়?
হাঁ, ইসলাম মালিকের অধিকারও সমানভাবে দিয়েছে। ইসলাম যেহেতু সর্বজনীন, তাই সবার কথাই ইসলাম বলে। সবার কথাই ইসলামে আছে। শ্রমিক দিবসে মালিকের অধিকার নিয়ে একটি হাদীসই বলব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن العبْدَ إذا نَصَحَ لِسيِّدهِ، وأحْسنَ عِبادَةَ اللهِ، فله أجرهُ مرَّتينِ.
ভৃত্য যখন তার মনিবের কল্যাণ কামনা করে এবং আল্লাহর ইবাদত সুন্দর করে করে, তাহলে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৬৯
ইসলাম শুধু একদিনই নয়, তিন শ পয়ষট্টি দিনই চাকর-নফর, অধীনদের সঙ্গে এমন কোমল আচরণ করতে বলে। তাই আমরা যারা শ্রমিকের অধিকারকে দিবসে বন্দি করে ফেলি, তাদের উচিত পশ্চিম থেকে চোখ ফিরিয়ে কুরআন-হাদীসে নিবদ্ধ করা; তাহলেই সব সমস্যার সমাধান সুন্দর হয়ে ধরা দেবে।
আল্লাহর দেওয়া মহান নিআমত ইসলামকে আমরা অনাদরে ফেলে রাখলেও কিছু কিছু অমুসলিম ইসলামের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল। মাহত্মা গান্ধী হিন্দু ছিলেন। তার পরও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কুরআনের মাহাত্ম্য। তিনি বলেছিলেন, ‘জঘন্য দাসপ্রথা মেটানোর জন্য জরুরি হল, হিন্দু শাস্ত্রকে কুরআন দিয়ে বদলে দেওয়া।’ (দ্র. মাওলানা মুজীবুল্লাহ নদভী রাহ.-কৃত ইসলামী কানুনে মেহনত ওয়া উজরত, পৃষ্ঠা ১৫১)
সেদিন পশ্চিমের চশমা চোখে দেওয়া ইয়ামেনী এক নামধারী মুসলিম সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে লিখল, ‘ইসলাম সন্ত্রাস ও অশান্তির ধর্ম, আমি ইয়ামেন থেকে বলছি।’
তার এই পোস্টের নিচে এক খ্রিষ্টান মন্তব্য করল, ‘বিশ্বেরর শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ইসলামের কোনো বিকল্প নেই। আমি ইংল্যান্ড থেকে বলছি।’
শান্তি, শৃঙ্খলা ও সভ্যতার সব আয়োজন আল্লাহ মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন কেবলই দরকার আমাদের সুমতি ও সাদরে গ্রহণ করা।