Zilqal 1445   ||   May 2024

হাদীস ও আছারে ইস্তিসকা ও বৃষ্টি প্রার্থনা

Mawlana Hujjatullah

ইস্তিসকামানে বৃষ্টি প্রার্থনা করা। অনাবৃষ্টিকালে বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে একাকী কিংবা সমবেতভাবে আল্লাহ তাআলার কাছে ইস্তিগফার-দুআ-মুনাজাত-রোনাজারি করা; তদ্রুপ একাকী কিংবা সমবেতভাবে সালাত আদায় করা, অতঃপর আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ-মুনাজাত-রোনাজারি করে বৃষ্টি প্রার্থনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-তাবেয়ীন অনাবৃষ্টি দেখা দিলে ইস্তিগফার ও আল্লাহ তাআলার কাছে  কায়মনোবাক্যে দুআর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো সমবেত লোকদের নিয়ে সালাতুল ইস্তিসকা (বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত) আদায় করে বৃষ্টির জন্য দুআ করেছেন। আবার কখনো সালাত ছাড়া সমবেত লোকদের নিয়ে ইস্তিগফার-দুআ-মুনাজাত-রোনাজারি করে বৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন। সাহাবা-তাবেয়ীনও অনাবৃষ্টি দেখা দিলে বৃষ্টির জন্য দুআ করেছেন। সামনে এ সম্পর্কিত কিছু হাদীস ও আছার উল্লেখ করা হচ্ছে-

এক. আনাস ইবনে মলেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একবার অনাবৃষ্টির কারণে মানুষ প্রচণ্ড দুর্ভোগে পড়ে। সে সময় এক জুমার দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন এক বেদুঈন লোক উঠে দাঁড়াল এবং আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (বৃষ্টির অভাবে) সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবার পরিজনও অনাহারে রয়েছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। তার কথা শুনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করার জন্য দুহাত তুললেন এবং বললেন-

اَللّٰهُمَّ اسْقِنَا، اَللّٰهُمَّ اسْقِنَا، اَللّٰهُمَّ اسْقِنَا

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন! হে আল্লাহ! আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন! হে আল্লাহ! আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন!

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সবাই হাত তুলল এবং দুআ করল।

(আনাস রা. বলেন,) সে সময় আমরা আকাশে এক খণ্ড মেঘও দেখিনি। (কিন্তু) যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ (করে বলছি! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শেষ করে) হাত নামানোর আগেই পাহাড়ের ন্যায় মেঘের বিরাট বিরাট খণ্ড উড়ে এল। তারপর তিনি মিম্বর থেকে নামার আগেই বৃষ্টি শুরু হল এবং আমি দেখলাম যে, তাঁর পবিত্র দাঁড়ি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। সেদিন আমাদের এখানে বৃষ্টি হল। এর পরে ক্রমাগত দুই দিন বৃষ্টি হল। এভাবে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত প্রতিদিন বৃষ্টি হল।

(পরবর্তী জুমার দিন) সে বেদুইন অথবা অন্য কেউ উঠে দাঁড়াল এবং আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (অতি বৃষ্টির কারণে) এখন আমাদের বাড়ি-ঘর ধসে পড়ছে, সম্পদ ডুবে যাচ্ছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করুন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুহাত তুলে দুআ করলেন-

اَللّٰهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا، اَللّٰهُمَّ عَلَى الْآكَامِ وَالظِّرَابِ، وَبُطُونِ الْأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ.

হে আল্লাহ! আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় (বৃষ্টি দিন), আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! পাহাড়ে ও টিলায়, গিরিখাদে ও বৃক্ষের গোড়ায় বৃষ্টি দিন।

(দুআর সময়) তিনি মেঘের এক একটি খণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন আর সেখানকার মেঘ কেটে যাচ্ছিল। এর ফলে মদীনার আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে গেল এবং কানাতউপত্যকায় এক মাস ধরে বৃষ্টির ধারা প্রবাহিত হতে লাগল। (যেহেতু মদীনা ছাড়া পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই) তখন (মদীনার) চারপাশের যে কোনো অঞ্চল থেকে কেউ এসেছে, সে এ মুষলধারে বৃষ্টির কথা আলোচনা করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০৩৩, ১০১৩, ১০১৪, ১০২৯

)اللفظ مأخوذ من جميع الروايات(.

এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য আলাদাভাবে সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করেননি; বরং জুমার খুতবার মাঝখানেই দুআ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত তোলার পর সমবেত সবাই তাঁর সঙ্গে হাত তুলে দুআ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ইস্তিসকা তথা বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করা শর্ত নয়। হাঁ, বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করার কথাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত আছে। সামনে সালাতুল ইস্তিসকা সম্পর্কিত হাদীসগুলোও উল্লেখ করা হল।

দুই. আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত-

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ بِالنَّاسِ يَسْتَسْقِي، فَصَلَّى بِهِمْ رَكْعَتَيْنِ جَهَرَ بِالقِرَاءَةِ فِيهِمَا، وَحَوَّلَ رِدَاءَهُ، وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَاسْتَسْقَى، وَاسْتَقْبَلَ القِبْلَةَ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে লোকদের নিয়ে (উন্মুক্ত প্রান্তরে) বের হন। অতঃপর সবাইকে নিয়ে দুই রাকাত নামায পড়েন। যাতে তিনি উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পড়েন। তিনি  তাঁর চাদর উল্টে দেন এবং দুহাত তুলে বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য দুআ করেন। এবং তিনি কিবলামুখী হন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৫৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৬১-১১৬২; সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১২, ১০২৩, ১০২৮

সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় (১০২৩) এই হাদীসের শেষে একথাও আছে যে, দুআর পর বৃষ্টি হয় এবং তারা বৃষ্টিসিক্ত হন- (فأُسقوا)

এই হাদীস থেকে জানা গেল যে, বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের নিয়ে প্রান্তরে গিয়ে সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করেছেন, নামাযে তিনি সশব্দে কেরাত পড়েছেন, কিবলামুখী হয়ে হাত তুলে দুআ করেছেন এবং নিজের গায়ের চাদর উল্টে দিয়েছেন।

মুসনাদে আহমাদের রেওয়ায়েতে এই হাদীসের শেষে একথা আছে যে-

قَالَ إِسْحَاقُ فِي حَدِيثِهِ: وَبَدَأَ بِالصَّلَاةِ قَبْلَ الْخُطْبَةِ

তিনি খুতবার আগে নামায আদায় করেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৪৬৬; ফাতহুল বারী ২/৫৮০ (১০১২ নং হাদীসের আলোচনা)

সুনানে আবু দাউদের এক বর্ণনায় এই হাদীসটির শেষে কীভাবে চাদর উল্টে দিয়েছেন তার বয়ান আছে। সেখানে আছে যে, চাদরের ডান প্রান্ত বাম কাঁধে আর বাম প্রান্ত ডান কাঁধে রেখেছেন। (দ্রষ্টব্য : সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৬৩)

وحوَّل رداءَه، فجعل عِطَافَه الأيمنَ على عاتقهِ الأيسرِ، وجعل عطافَه الأيْسَرَ على عاتِقه الأيمنِ.

আর চাদর কখন উল্টে দেবে তার কথা আছে সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনায়-

وَحَوَّلَ رِدَاءَهُ حِينَ اسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ.

তিনি তাঁর চাদর উল্টে দেন যখন তিনি কিবলামুখী হন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৯৪

তিন. সাহাবী আ-বুল লাহম-এর আযাদকৃত গোলাম উমায়ের রা.-এর সূত্রে সাহাবী আ-বুল লাহম  থেকে বর্ণিত, (কোনো কোনো বর্ণনা আনুসারে সরাসরি উমায়ের থেকে বর্ণিত, যিনি নিজেও সাহাবী ছিলেন, যে) তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আহজারুয যায়তনামক স্থানে বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য দুহাত তুলে দুআ করতে দেখেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৫৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৫১৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৯৪৩

আহজারুয যায়তমদীনার একটি জায়গার নাম। এ হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে দু-হাত তুলে দুআ করেছেন।

চার. আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে অনাবৃষ্টির অভিযোগ পেশ করে। তখন তিনি ময়দানে মিম্বর স্থাপনের নির্দেশ দিলে তা স্থাপিত হয়। তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে সকলকে ওয়াদা দেন। আয়েশা রা. বলেন, সেদিন সূর্য ওঠা আরম্ভ হতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ময়দানে গিয়ে উক্ত মিম্বরে আরোহণ করেন এবং তাকবীর বলেন, অতঃপর মহান আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা অনাবৃষ্টির কারণে ফসলহানির অভিযোগ করেছ। অথচ আল্লাহ তাআলা তোমাদের বলেছেন, তাঁর কাছে দুআ করতে এবং তোমাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, যদি তোমরা তাঁর নিকট দুআ কর, তবে তিনি তা কবুল করবেন।

অতঃপর তিনি বলেন-

اَلْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ، الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ، مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ، لاَ إِلٰهَ إلَّا اللهُ، يَفْعَلُ مَا يُرِيْدُ، اَللّٰهُمَّ أَنْتَ اللهُ
لاَ إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ الْغَنِيُّ وَنَحْنُ الْفُقَرَاءُ، أَنْزِلْ عَلَيْنَا الْغَيْثَ، وَاجْعَلْ مَا أَنْزَلْتَ لَنَا قُوَّةً وَبَلاَغًا إِلى خَيْرٍ.

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের মালিক ও প্রতিপালক। যিনি অত্যন্ত দয়ালু ও সীমাহীন মেহেরবান, যিনি প্রতিদান দিবসের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ  নেই। তিনি যা চান তা-ই করেন। ইয়া আল্লাহ্! আপনিই আল্লাহ্। আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনি চিরঅমুখাপেক্ষী আর আমরা সবাই আপনার মুখাপেক্ষী। আপনি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন। এবং যে বৃষ্টি ইতিমধ্যে বর্ষণ করেছেন তা আমাদের জন্য শক্তিসামর্থ্য ও কল্যাণের ওসীলা বানান।

অতঃপর তিনি উভয় হাত এত উপরে উত্তোলন করেন যে, তাঁর বগলের সাদা অংশ দৃষ্টিগোচর হয়।

অতঃপর তিনি লোকদের প্রতি পিঠ ফিরিয়ে (অর্থাৎ কিবলামুখী হয়ে) স্বীয় চাদর মুবারক উল্টিয়ে দেন, তখনও তাঁর হাত উপরে ওঠানো ছিল, এমনকি তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখা যাচ্ছিল।

হাদীসের শেষে একথাও আছে যে, বৃষ্টি প্রার্থনার পর আকাশে মেঘের সঞ্চার হয় এবং মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎচমক শুরু হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে এমন বৃষ্টিপাত হতে থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে আসার আগেই সমস্ত এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। তারপর তিনি যখন তাদেরকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ব্যস্তসমস্ত হতে দেখেন, তখন এমনভাবে হেসে দেন যে, তাঁর সামনের পাটির দাঁত দৃষ্টিগোচর হয়। অতঃপর তিনি বলেন-

أَشْهَدُ أنَّ اللهَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، وَأَنِّيْ عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُه.

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তাআলা সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন এবং (সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,) আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৭২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৯১

قال أبو داود: وهذا حديث غريب إسناده جيد.

পাঁচ. হিশাম ইবনে ইসহাক বলেন, আমাকে মদীনার আমীর ওয়ালীদ ইবনে উতবাহ (উকবাহনয় : কিফায়াতুল মুগতাযী) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইস্তিসকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য পাঠালেন। আমি তাঁর কাছে আসার পর তিনি বলেন-

إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ مُتَبَذِّلًا مُتَوَاضِعًا مُتَضَرِّعًا، حَتَّى أَتَى المُصَلَّى، فَلَمْ يَخْطُبْ خُطْبَتَكُمْ هَذِهِ، وَلَكِنْ لَمْ يَزَلْ فِي الدُّعَاءِ وَالتَّضَرُّعِ وَالتَّكْبِيرِ، وَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَمَا كَانَ يُصَلِّي فِي العِيدِ (حسن صحيح(

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইস্তিসকার জন্য বেরিয়েছিলেন, তখন তাঁর গায়ে ছিল পুরনো জীর্ণশীর্ণ কাপড়, তিনি ছিলেন চরম বিনয়াবনত ও অনুনয় বিনয়ের অবস্থায়। নামাযের স্থানে আসার পর তিনি তোমাদের খুতবার মতো (অর্থাৎ এত লম্বা) খুতবা দেননি; বরং দুআ, অনুনয়-বিনয়-কাকুতি-মিনতি ও তাকবীরে মশগুল ছিলেন। এবং তিনি দুই রাকাত নামায আদায় করেন, যেভাবে তিনি ঈদের সময় দুই রাকাত নামায আদায় করতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৫৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৫০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৬৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪০৫

এই হাদীসেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত লোকদের নিয়ে সালাতুল ইস্তিসকা আদায়ের কথা আছে।

বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক পঠিত দুটি দুআ

ক. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য এই দুআ পড়েছেন- 

اَللّٰهُمَّ اسْقِنَا غَيْثًا مُّغِيْثًا مَرِيْئًا مُرِيْعًا نَافِعًا غَيْرَ ضَارٍّ، عَاجِلاً، غَيْرَ آجِلٍ.

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে অবিলম্বে ও অতি তাড়াতাড়ি বৃষ্টি দান করুন; অ-ক্ষতিকর, উপকারী, উৎপাদনশীল, সুপেয় ও সাহায্যকারী বৃষ্টি দান করুন।

জাবের রা. বলেন, এই দুআর পর অঝোরে বৃষ্টি নামে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৬৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪১৬

খ. আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর দাদা (আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন তখন বলতেন-

اَللّٰهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَكَ، وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ، وأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ.

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আপনার বান্দাদের বৃষ্টি দান করুন, বৃষ্টি দান করুন চতুষ্পদ জন্তুদেরকে, আপনিই তাদের মালিক। আপনার রহমত ছড়িয়ে দিন (সব জায়গায়)। মৃত ভূমিকে (বৃষ্টি প্রদান করে) জীবিত করুন, আপনিই তো ভূমির অধিপতি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৭৬

সাহাবা-তাবেয়ীনের বৃষ্টি প্রার্থনা

ক. উমর রা. কর্তৃক বৃষ্টি প্রার্থনা

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন লোকেরা অনাবৃষ্টির সম্মুখীন হত তখন উমর ইবনে খাত্তাব রা. আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা.-এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন-

اَللّٰهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِينَا، وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا

হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবীর ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করতাম, তখন আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীর চাচার ওসিলা দিয়ে প্রার্থনা করছি, আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন।

আনাস রা. বলেন, এরপর আল্লাহ তাদের বৃষ্টি দান করতেন এবং তারা বৃষ্টিসিক্ত হতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১০

উমর রা. ইস্তিসকার ক্ষেত্রে ইস্তিগফার তথা গুনাহ মাফের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাবেয়ী আমের ইবনে শারাহীল শাবী রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর রা. বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য বের হন, অতঃপর মিম্বারে উঠে এই আয়াত পাঠ করেন-

فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ اِنَّهٗ كَانَ غَفَّارًا، یُّرْسِلِ السَّمَآءَ عَلَیْكُمْ مِّدْرَارًا،  وَّ یُمْدِدْكُمْ بِاَمْوَالٍ وَّ بَنِیْنَ وَ یَجْعَلْ لَّكُمْ جَنّٰتٍ وَّ یَجْعَلْ لَّكُمْ اَنْهٰرًا.

[আমি বলেছি, তোমরা আপন রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য উদ্যানরাজি উৎপন্ন করবেন ও তোমাদের জন্য প্রবাহিত করবেন নদ-নদী। -সূরা নূহ (৭১) : ১০-১২]

এরপর তিনি (সূরা হূদের) এই আয়াত পাঠ করেন-

اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْۤا اِلَیْهِ یُرْسِلِ السَّمَآءَ عَلَیْكُمْ مِّدْرَارًا وَّ یَزِدْكُمْ قُوَّةً اِلٰی قُوَّتِكُمْ.

[তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তার অভিমুখী হয়ে যাও। তিনি তোমাদের প্রতি আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের বর্তমান শক্তির সাথে বাড়তি আরো শক্তি জোগাবেন।-সূরা হূদ (১১) : ৫২]

তার পর তিনি মিম্বার থেকে নেমে যান। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, বর্ণনা ৮৫৬৫ (শাছরী); মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৪৯০২; আলইসতিযকার, ইবনে আবদুল বার ৭/১৩২ (সনদ নির্ভরযোগ্য)

খ. আবু মূসা আশআরী রা. কর্তৃক বৃষ্টি প্রার্থনা

হারেছা ইবনে মুদাররিব আলআবদী কর্তৃক বর্ণিত, আমরা আবু মূসা রা.-এর সাথে বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বের হই। তিনি আযান ও ইকামত ছাড়া আমাদের নিয়ে দুই রাকাত নামায পড়েন। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, বর্ণনা ৮৫৫৯ (সনদ নির্ভরযোগ্য)

গ. উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. কর্তৃক ইস্তিসকা ও বৃষ্টি প্রার্থনার ফরমান জারি

জাফর ইবনে বুরকান থেকে বর্ণিত, উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. মায়মুন ইবনে মিহরানের কাছে লিখে পাঠিয়েছেন যে, আমি বিভিন্ন শহরে ফরমান লিখে পাঠিয়েছি, তারা যেন অমুক শহর থেকে অমুক দিন ইস্তিসকার জন্য বের হয়। আর যার পক্ষে সম্ভব হয়, সে যেন রোযা রাখে ও সদকা করে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰی،  وَ ذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰی.

[নিশ্চয়ই সে সফল হয়েছে যে পরিশুদ্ধ হয়েছে, এবং স্বীয় রবের নাম নিয়েছে ও নামায পড়েছে। -সূরা আলা (৮৭) : ১৪-১৫]

আর তোমরা ইস্তিগফারের উদ্দেশ্যে বলবে, যেমনটি তোমাদের পিতা-মাতা (আদম আ. ও হাওয়া আ.) বলেছেন-

رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.

[হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তÍর্ভুক্ত হয়ে যাব। -সূরা আরাফ (০৭) : ২৩]

এবং তোমরা বলবে, যেমনটি নূহ আ. বলেছেন-

وَ اِلَّا تَغْفِرْ لِیْ وَ تَرْحَمْنِیْۤ اَكُنْ مِّنَ الْخٰسِرِیْنَ.

[যদি আপনি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমার প্রতি দয়া না করেন তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। -সূরা হুদ (১১) : ৪৭]

এবং বলবে, যেমন মূসা আ. বলেছেন-

رَبِّ اِنِّیْ ظَلَمْتُ نَفْسِیْ فَاغْفِرْ لِیْ فَغَفَرَ لَهٗ  اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.

[হে আমার রব! আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। -সূরা কাসাস (২৮) : ১৬]

এবং বলবে, যেমন ইউনুস আ. বলেছেন-

لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ.

 [আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আপনি পবিত্র, নিশ্চয়ই আমি ছিলাম এক অপরাধী। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭] -মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, বর্ণনা ৪৯০৩ (সনদ নির্ভরযোগ্য)

সালাতুল ইস্তিসকা আদায়ের পদ্ধতি

ইস্তিসকার নামায যদি জনসাধারণকে নিয়ে আদায় করার ইচ্ছা করা হয়, তাহলে আগেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এরপর নির্দিষ্ট দিনে সবাইকে নিয়ে কোনো মাঠ বা প্রান্তরে যাবে। সবাই সাধারণ পোশাকে যাবে ও বিনয়াবনত থাকবে। ইস্তিগফার, যিকির ও দুআয় মশগুল থাকবে। প্রান্তরে পৌঁছার পর ইমাম সমবেত জনতাকে নসীহতমূলক কোনো কথা বা উপদেশ দিতে চাইলে দিতে পারবেন। তারপর ইমাম আযান ও ইকামত ছাড়া সবাইকে নিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে দুই রাকাত নামায পড়বেন। নামাযে তিনি সশব্দে কিরাত পড়বেন। অতিরিক্ত তাকবীর দেওয়ার  প্রয়োজন নেই। এরপর ইমাম দুটি খুতবা দেবেন। খুতবা শেষে তিনি কিবলামুখী হবেন ও নিজ চাদর উল্টা করে- চাদরের ডান প্রান্ত বাম কাঁধে ও বাম প্রান্ত ডান কাঁধে দিয়ে দেবেন। অতঃপর দুই হাত  যথাসম্ভব উপরে তুলে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে গুনাহ ক্ষমা চাইবেন ও বৃষ্টি প্রার্থনা করবেন। সবাই ইমামের সাথে হাত তুলে দুআয় শরীক হবেন ও নিজ নিজ গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে বৃষ্টি প্রার্থনা করবেন। এক্ষেত্রে হাদীসে বর্ণিত দুআগুলো যত্নের সাথে পাঠ করার চেষ্টা করা কর্তব্য। কাফের মুশরিক কেউ মুসলিমদের সঙ্গে ইস্তিসকায় শরীক হবে না। উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ইস্তিসকার দিন যাদের পক্ষে সম্ভব হয় তাদেরকে দান-সদাকা করা ও রোযা রাখার কথাও বলেছেন। 

 

সূত্র : পূর্বোক্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস ও আছারসমূহসহ নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলি :

কিতাবুল আছল, ইমাম মুহাম্মাদ ১/৩৬৬-৩৬৭; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, পৃ. ২৩৪ (দারুল কলম, দামেশক); আলমাবসূত, সারাখসী ১/১৬৬; হিদায়া ২/১১৩-১১৫ (দারুস সিরাজ); আলমুহীতুল বুরহানী ৩/২২-২৫; রদ্দুল মুহতার ১/৭০-৭১ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ); ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫৩-১৫৪; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ, পৃ. ৫৫১ 

 

advertisement