Zilqal 1445   ||   May 2024

তাকওয়ার মাধ্যমেই লাভ হয় সংকট থেকে উত্তরণের পথ

Mawlana Muhammad Abdul Malek

হামদ ও সালাতের পর...

ঈমানী সিফাত বা যেসব গুণাবলির সম্পর্ক ঈমানের সাথে এবং ঈমানের কারণে যেসব গুণাবলি মানুষের মধ্যে পয়দা হয়- ঈমান যত মজবুত হয় ওই গুণগুলো তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গুণগুলো যত বাড়তে থাকে, ঈমানও তত মজবুত হতে থাকে। ঈমানী সিফাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিফাত তাকওয়া। তাকওয়াকে বলা হয় মিলাকুল হাসানাত- তথা সমস্ত নেকীর মূল। এটা কেবল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণই নয়, বরং সবচেয়ে বড় সিফাত। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে তাকওয়ার নির্দেশ করা হয়েছে, আবার অনেক আয়াতে তাকওয়ার ফায়দাগুলোর বিবরণও দেওয়া হয়েছে। গতকাল তারাবীতে সূরা ত্বলাক তিলাওয়াত করা হয়েছিল। সেখানে একসঙ্গে কয়েকটা ফায়দার কথা এসেছে। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে-

ذٰلِكُمْ یُوْعَظُ بِهٖ مَنْ كَانَ یُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا، وَّ یَرْزُقْهُ مِنْ حَیْثُ لَا یَحْتَسِبُ  وَ مَنْ یَّتَوَكَّلْ عَلَی اللهِ فَهُوَ حَسْبُهٗ  اِنَّ اللهَ بَالِغُ اَمْرِهٖ  قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَیْءٍ قَدْرًا.

এটা এমন বিষয়, যার দ্বারা তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহ্ই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ পূরণ করেই থাকেন। (অবশ্য) আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। -সূরা ত্বলাক (৬৫) : ৩

এখানে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পারিবারিক জীবনের কিছু বিধান দান করেছেন। বিধানগুলোর বলার পর শেষে বলেছেন-

ذٰلِكُمْ یُوْعَظُ بِهٖ.

অর্থাৎ বিধানকে নসীহতশব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। হালাল-হারামের বিধান, ফরয বিধানÑ এসবকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন ওয়াজবা নসীহতকুরআনের ওয়াজ বা নসীহত শব্দ থেকে অনেকে গলত ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা বলে, এ তো কেবল উপদেশ; মান্য করলে ভালো, অমান্য করলেও কোনো সমস্যা নেই! অথচ ব্যাপারটা এমন নয়এই ধারণা সম্পূর্ণ গলত। বরং কুরআন কারীমে ওয়াজ’ ‘যিকির’ ‘নসীহাশব্দগুলো যেভাবে উত্তম-অনুত্তম, মুস্তাহাব ও গায়রে মুস্তাহাব বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি ফরয বিধানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে

অনেক বছর আগের কথা। এক বুদ্ধিজীবীর লেখায় দেখেছিলাম, সে বলছে, শরীয়ত কেবল একটা উপদেশমূলক বিষয়। কুরআনকে আল্লাহ উপদেশ হিসেবে পাঠিয়েছেন; কিন্তু এই যে চাপিয়ে দেওয়া, এটা মওলবীদের কাজ। আল্লাহ কিন্তু চাপিয়ে দেননি, বরং তিনি একটা উপদেশ দিয়ে রেখেছেন।

অথচ কুরআনকে আল্লাহ তাআলা যিকিরহিসেবে যেমন অবতীর্ণ করেছেন, তার অবস্থান কীÑ সেটাও তিনি কুরআন কারীমে জানিয়ে রেখেছেন। এই যিকির ও উপদেশ থেকে যে বিমুখ হবে, তার ঠিকানা যে জাহান্নাম, তাও তিনি বলে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ مَنْ اَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِیْ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیْشَةً ضَنْكًا وَّ نَحْشُرُهٗ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اَعْمٰی، قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِیْۤ اَعْمٰی وَ قَدْ كُنْتُ بَصِیْرًا، قَالَ كَذٰلِكَ اَتَتْكَ اٰیٰتُنَا فَنَسِیْتَهَا  وَ كَذٰلِكَ الْیَوْمَ تُنْسٰی، وَ كَذٰلِكَ نَجْزِیْ مَنْ اَسْرَفَ وَ لَمْ یُؤْمِنْۢ بِاٰیٰتِ رَبِّهٖ  وَ لَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَشَدُّ وَ اَبْقٰی.

আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব্ব! তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম!

আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।

যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে ও নিজ প্রতিপালকের নিদর্শনাবলিতে ঈমান আনে না, তাকে আমি এভাবেই শাস্তি দেই। আর আখেরাতের আযাব বাস্তবিকই বেশি কঠিন ও অধিকতর স্থায়ী। -সূরা ত্বহা (২০) : ১২৪-১২৭

وَ مَنْ یُّعْرِضْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهٖ یَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا.

আর কেউ তার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তিতে গেঁথে দেবেন। -সূরা জিন (৭২) : ১৭

وَ مَنْ یَّعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمٰنِ نُقَیِّضْ لَهٗ شَیْطٰنًا فَهُوَ لَهٗ قَرِیْنٌ.

যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর যিকির থেকে অন্ধ হয়ে যাবে, তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, যে তার সঙ্গী হয়ে যায়। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩৬

যিকরুন’ ‘ওয়াযুনএসব শব্দ থেকে বিধানগুলোকে মুস্তাহাব বা ঐচ্ছিক পর্যায়ের বিষয় ধারণা করা জাহেলদের স্বভাব। যাদের কুরআনের ভাষা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, তারাই কেবল এমন কথা বলতে পারে।

উপদেশশব্দ এলেই বিধানটা ঐচ্ছিক হয়ে যায় না। কুরআনের বিধানাবলি ও শরীয়তকে কুরআন কারীমের ভাষায় উপদেশও বলা হয়েছে, আবার সেই উপদেশ অমান্য করা হলে বা তা থেকে বিমুখ হলে দুনিয়াতে বরবাদি এবং আখেরাতে জাহান্নামের ঘোষণাও কুরআনে দেওয়া হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াতেও অনেকগুলো ফরয বিধানের আলোচনা করার পর আল্লাহ তাআলা বলছেন-

ذٰلِكُمْ یُوْعَظُ بِهٖ مَنْ كَانَ یُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ.

এই নসীহত তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে, যাদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আছে এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান আছে।

লক্ষ করুন, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার ভাষাটা কেমন? বলা হচ্ছে-

مَنْ كَانَ یُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ.

যদি আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান থাকে, তবে এই ওয়াজ গ্রহণ করো। এটা তো তাকীদের সর্বোচ্চ ভাষাকোনো বিষয়ে গুরুত্বারোপ করার জন্য ভাষার এই শৈলীটা অত্যন্ত মজবুত। সরাসরি জরুরি বলার চেয়ে এটা বেশ কঠিন নয় কি? আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান থাকলে তুমি এই উপদেশ গ্রহণ করো।

এরপর বলা হয়েছে-

وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا، وَّ یَرْزُقْهُ مِنْ حَیْثُ لَا یَحْتَسِبُ.

(যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে।)

অনেক সময় একটা বিধানের ওপর আমল করতে মানুষের মনে বিভিন্ন ভয় কাজ করে। আমি পেরে উঠব কি না! ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলে এরপর কী করব? আয়ের উৎস হারাম। এটা তাৎক্ষণিক ছেড়ে দিলে এরপর কী হবে? মনের মধ্যে একটা পেরেশানী কাজ করে। এই পেরেশানীর কারণে কোনো কোনো সময় কাউকে বলা হয়, তুমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হও! একেবারে নগদ এখনই সব ছেড়ে দিলে যদি আবার টিকতে না পারো বা আরো বড় পাপে লিপ্ত হয়ে যাও, তাহলে কী হবে! এসব চিন্তা করে তাকে বলা হয়, ধীরে ধীরে হালালের দিকে আসতে থাক!

এটা তাকে মাসআলা দেওয়া হয় না; বরং একটা পরামর্শ। কীভাবে হারাম ছেড়ে হালালের দিকে আসতে পারব, সেটা কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন এই আয়াতে।

আল্লাহকে ভয় করলে আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে।

তুমি যদি তাকওয়ার পরিচয় দিতে পার, আল্লাহ তোমার জন্য কোনো না কোনো রাস্তা বের করেই দেবেন।

যদিও এই হিম্মতটুকু সবার হয় না। কিন্তু কেউ যদি হিম্মতটা করতে পারে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তাহলে তার ব্যবস্থা করবেনই।

مَنْ یَّتَّقِ اللهَ.

আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহকে হাযির-নাযির মনে করে তাঁর বিধানের সম্মান রক্ষার্থে, তাঁর হুকুম পালনের জন্য এবং তাঁকে রাজি-খুশি করার জন্য আর আল্লাহর সামনে কী জওয়াব দেবে- এই ভয়ে সে হিম্মত করল যে, আমি সহীহটাই গ্রহণ করব আর গলতটা এখনই ছেড়ে দিব। তাহলে-

یَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا.

আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার জন্য পথ খুলে দেবেন। শুধু তা-ই নয়; বরং-

وَّ یَرْزُقْهُ مِنْ حَیْثُ لَا یَحْتَسِبُ.

সে কোনো দিন ভাবেনি, ভাবতেও পারেনি যে, এই পথ থেকে আমার জন্য হালাল রিযিক আসবেÑ সে পথে, সে মাধ্যমে তাকে রিযিক দান করবেন।

এরপর আল্লাহ তাআলা আবার বলেন-

وَ مَنْ یَّتَوَكَّلْ عَلَی اللهِ فَهُوَ حَسْبُهٗ.

আল্লাহর ওপর যে ভরসা করবে, আল্লাহ্ই তার জন্য যথেষ্ট।

এটি তাকওয়ার অন্যতম ফায়দা যে, আল্লাহ তাআলা তাকওয়ার মাধ্যমে বান্দাকে সংকটমুক্ত করে দেন। তার জন্য এমন দিক থেকে রিযিকের পথ খুলে দেন, যা কখনো তার কল্পনায়ও আসেনি। আর আল্লাহ্ই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। তাই মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর কাছে সবকিছুর একটা সময় আছে এবং নির্ধারিত পরিমাণ আছে। তাই সবর তো করতেই হবে।

এখানে একথাও মনে রাখা দরকার, তাকওয়া দ্বারা যেমন পেরেশানী দূর হয়, তাকওয়ার বিপরীত চললে পেরেশানীও আসে এবং সংকট সৃষ্টি হয়। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছিল। যা নাজায়েয কাজ। পরক্ষণে সে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর কাছে আসে এবং বাঁচার রাস্তা খোঁজে। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি তো আল্লাহ্কে ভয় করনি! (ভয় করলে তো আর একসাথে তিন তালাক দিতে না।) আল্লাহ তো বলেছেন, যে আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য কোনো রাস্তা খুলে দেবেন। আর তুমি তো তা করনি!   

কয়েক আয়াত পরেই আল্লাহ তাআলা আবার বলেন-

ذٰلِكَ اَمْرُ اللهِ اَنْزَلَهٗۤ اِلَیْكُمْ  وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یُكَفِّرْ عَنْهُ سَیِّاٰتِهٖ وَ یُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا.

এসব আল্লাহর বিধান, যা তিনি তোমাদের নিকট অবতীর্ণ করেছেন। (এগুলোর অধিকাংশই পারিবারিক বিধান) যে আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন এবং তার সওয়াব ও প্রতিদান বৃদ্ধি করে দেবেন।

এভাবে যদি আমরা কুরআন কারীম তিলাওয়াত করি, তাহলে তাকওয়ার অনেক ফায়দা দেখতে পাব, ইনশাআল্লাহ। বিধান দেওয়ার আগে একবার তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, বিধান বর্ণনা করার পর আবারও তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে তাকওয়ার ফায়দাও জানিয়ে দিয়েছেন। কুরআন কারীমে তাকওয়ার প্রায় তিরিশের কাছাকাছি ফায়দার কথা উল্লেখিত হয়েছে।

মাজদুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব ফাইরোযাবাদী রাহ. (৮১৭ হি.)-এর রচিত একটি কিতাবের নাম বাসাইরু যাবিত তাময়ীয ফী লাতাইফিল কিতাবিল আযীযতিনি আমাদের তালেবে ইলম ভাইদের নিকট বেশি পরিচিত-আলকামূসুল মুহীতকিতাবের লেখক হিসেবে। তার এই কিতাবে তাকওয়ার একটা অধ্যায় আছে। সেখানে তিনি তাকওয়ার অনেকগুলো ফায়দা উল্লেখ করেছেন। কয়েকটি ফায়দা আমরা এখন আলোচনা করছি!

সূরা ত্বলাকের দুই আয়াতে চারটা ফায়দার কথা আমরা আলোচনা করেছি। সূরা আনফালের-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ تَتَّقُوا اللهَ یَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا وَّ یُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَیِّاٰتِكُمْ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ..

অর্থাৎ, যদি তুমি তাকওয়ার রাস্তা অবলম্বন কর, তাকওয়ার যিন্দেগী অবলম্বন কর, আল্লাহকে ভয় কর এবং এর তাকাযা পূরণ কর, তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমার মধ্যে পার্থক্য করার একটা যোগ্যতা সৃষ্টি করে দেবেন। হক-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করা, সুন্নত-বিদআতের মাঝে পার্থক্য করা, কল্যাণ-অকল্যাণের মাঝে পার্থক্য করা, হেদায়েত ও গোমরাহীর মাঝে পার্থক্য করা ইত্যাদি। আসলে উদাসীন যিন্দেগী হলে সব জায়গায় প্যাঁচ লাগায়। কারণ পার্থক্য করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। ঈমান যত মজবুত হয়, তত মানুষের হক-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা বাড়তে থাকে। মুত্তাকী-মুমিনদের মাঝে এই সিফাতটা বেশি মাত্রায় থাকে। পক্ষান্তরে গাফলত যত বাড়বে, তাকওয়ার ব্যাপারে যত উদাসীনতা হবে, ততই পার্থক্য করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে। পার্থক্য করার জন্য শরীয়তের দলীল কুরআন-সুন্নাহ তো আছেই, সেটাই মানদণ্ড। কিন্তু আমি যখন নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও জীবনের বিষয়গুলোকে শরীয়তের বিধানের আলোকে বিচার করা শুরু করব, তখন আমার নিজেরও তো বুঝতে হবে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে আমার কোন্ কাজটি ঠিক হচ্ছে আর কোন্টি ভুল- পার্থক্য করার এই বুঝটুকু তাকওয়া দ্বারা বাড়ে। আমাকে আরেকজন বুঝিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি বুঝিই না। সবাই আমাকে বোঝাচ্ছে, মুরব্বিরা বোঝাচ্ছেন, ঘরের বড়রা বোঝাচ্ছেন, কিন্তু বুঝেই আসছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আরেকজন সহজেই বুঝে ফেলছে। একটু ইশারার মাধ্যমেই ধরে ফেলছে। কেন এমন হয়? মূলত তাকওয়ার সিফাত যার যত বাড়বে, ততই ফুরকান- তথা পার্থক্য করার যোগ্যতা ও সিফাতটাও বাড়তে থাকবে।

কুরআন কারীম হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। সহীহ ও গলতের মাঝে পার্থক্যকারী। সুন্নত-বিদআত এবং খায়র ও শার- তথা ভালো-মন্দের মাঝে পার্থক্যকারী। ঠিক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সীরাতও এসবের মাঝে পার্থক্য করে।

তাই শরীয়তের দলীল বাদ দিয়ে কারো একথা বলার অধিকার নেই যে, আমি তাকওয়ার দৃষ্টিতে এই বিধান বুঝেছি, নাউযুবিল্লাহ। এমন চিন্তাটাই তো গোমরাহী। তাহলে সে লোক আবার মুত্তাকী হল কীভাবে?!

اِنْ تَتَّقُوا اللهَ یَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا.

(তোমরা যদি আল্লাহর সাথে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্য করার শক্তি দেবেন।)

তালিবে ইলম ভাইয়েরা এখান থেকে আরো আলোও নিতে পারেন যে, যে তালেবে ইলমের মধ্যে তাকওয়ার গুণ যত বেশি হবে তার মধ্যে কুরআন ও হাদীসের ফাহ্ম ও বুঝ তত বেশি হবে।

সূরা ত্বলাকের আয়াতে আরেকটি কথাও বলা হয়েছে-

وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ اَمْرِهٖ یُسْرًا.

যার মধ্যে তাকওয়া যত বেশি হবে, আল্লাহ তাআলা তার বিষয়গুলো তত সহজ করে দেবেন। [দ্র. সূরা ত্বলাক (৬৫) : ৪]

আমাদের তো পেরেশানী ও শেকায়েতের শেষ নেই। কমবেশি সবারই পেরেশানীর শেকায়েত আছে। বিভিন্ন সমস্যা, বিভিন্ন ঝুট-ঝামেলা থাকেই। হাঁ, আল্লাহর মুত্তাকী বান্দাদের যিন্দেগীতেও পেরেশানী হয়। তবে তার ধরন ভিন্ন।

এই আয়াতে বলা হয়েছে, তাকওয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা সহজতা দান করেন।

এছাড়াও আখেরাতে তাকওয়ার কী কী ফায়দা, দুনিয়াতেও আরো কী ফায়দা রয়েছে, মনোযোগসহ কুরআন তিলাওয়াত করলে তার অনেকগুলো বা কিছু আমরা নিজেরাও ধরতে পারব- ইনশাআল্লাহ।

আর একটা কথা বলেই আমি শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِیْنَ اتَّقَوْا وَّ الَّذِیْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ.

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই সাথী, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ইহসানের অধিকারী হয়। [দ্র. সূরা নাহল (১৬) : ১২৮]

যাদের মধ্যে তাকওয়া ও ইহসানের সিফাত আছে, আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে আছেন। অর্থাৎ আল্লাহর নুসরত, তাঁর ফযল ও করম এবং তাঁর দয়া ও করুণা- সবকিছু মুত্তাকীদের সঙ্গে।

তাকওয়া ও ইহসানের সিফাত একটা অপরটার পরিপূরক। তাকওয়া হলে ইহসান আসবে, ইহসান আসলে তাকওয়া আসবে। তাকওয়া এবং ইহসানের সিফাত যাদের মধ্যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নুসরত, ফযল ও করমও তাঁদের সঙ্গে।

তাকওয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করণীয়টা করা, বর্জনীয়টা বর্জন করা। আল্লাহ যা ফরয করেছেন, তা আদায় করা, আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু তাকওয়ার স্থান হল কলব বা অন্তর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কলবের দিকে ইশারা করে বলেছেন-

التَّقْوَى هَاهُنَا.

তাকওয়ার মূল অন্তরে।

অর্থাৎ, আল্লাহর ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখা, হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাস রাখা এবং আমি আল্লাহর নিআমতে ডুবে আছি- এই অনুভূতি-উপলব্ধি সদা জাগরূক রাখা- এটিই তাকওয়ার মূল। এগুলো থাকে অন্তরে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তাকওয়ার মূল অন্তরে।

কিন্তু তার প্রকাশ ঘটবে- আল্লাহ যা ফরয করেছেন, তা পালনের মধ্য দিয়ে এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। এই দুটোর মধ্যেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, যা থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন তা থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকা। সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকা।

তাকওয়া অবলম্বনের মধ্যে যেমন ফায়দা রয়েছে, তাকওয়া-বিমুখ হওয়ার মধ্যেও রয়েছে সমূহ ক্ষতি। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হল, গোমরাহী পেয়ে বসাকেবল এতটুকু নয় যে, কিছু গুনাহ হয়ে গেল; বরং এটা ধীরে ধীরে মানুষকে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যায়। আজ ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব তিলাওয়াত করেছেন সূরা

তাওবা থেকে-

وَ مَا كَانَ اللهُ لِیُضِلَّ قَوْمًۢا بَعْدَ اِذْ هَدٰىهُمْ حَتّٰی یُبَیِّنَ لَهُمْ مَّا یَتَّقُوْنَ  اِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمٌ..

আল্লাহ এমন নন যে, কোনো সম্প্রদায়কে হেদায়েত করার পর গোমরাহ করে দেবেন, যাবৎ না তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেন যে, তাদের কোন্ কোন্ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা উচিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত। -সূরা তাওবা (৯) : ১১৫

আল্লাহ কাউকে হেদায়েত দান করার পর পুনরায় সে গোমরা হবে কেন? গোমরা হওয়ার তো কথা ছিল না। কুরআন-সুন্নাহ্র মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাকে হক ও হেদায়েতের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। এই রাস্তা মজবুতির সঙ্গে ধরলে তো গোমরা হওয়ার কথা নয়। তার পরও কেন কিছু মানুষ গোমরা হয়ে যায়? ঈমান ও ইসলামের আলো পাওয়ার পরও কিছু মানুষকে দেখা যায় দুর্ভাগ্যবশত গোমরা হয়ে যাচ্ছে! কেন হয় তাদের এই দশা? কাকে বলে ইসলাম- তার পরিচয় পাওয়ার পরও কেন তাকে গোমরাহী পেয়ে বসে?

কারণ হল-

حَتّٰی یُبَیِّنَ لَهُمْ مَّا یَتَّقُوْنَ.

কী কী বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং দূরে থাকতে হবে, সেটি আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া সত্ত্বেও সে বেঁচে থাকেনি বা থাকতে পারেনি। নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, এটা হারাম, ওটা নাজায়েয। এসব থেকে তোমরা বেঁচে থাক! তার পরও যদি কেউ বিরত না থাকে, বরং গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে যায়, তার কাছে তো গোমরাহী আসবেই। এজন্য বলছি, তাকওয়া অবলম্বনের মধ্যে যেমন ফায়দা রয়েছে, তাকওয়া-বিমুখ হওয়ার মাঝেও রয়েছে সমূহ ক্ষতি। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হল, মানুষকে গোমরাহী পেয়ে বসে। রমযানুল মুবারকের ওসীলায় আল্লাহ যেন আমাদের মধ্যে তাকওয়ার মেযাজ দান করেন। এই সিফাত হাসিল হলে ইনশাআল্লাহ, হক-বাতিল ও সহীহ-গলতের মাঝে পার্থক্য করা সহজ হবে। অন্যথা গোমরাহী পেয়েই বসবে।

গোমরাহী মানে কী? গোমরাহী মানে কারো রাস্তা-ই ভিন্ন হয়ে যাওয়া। গোমঅর্থ হারিয়ে যাওয়া আর রাহঅর্থ রাস্তা। গোমরাহমানে রাস্তা হারিয়ে ফেলা ব্যক্তি। গোমরাহকোনো গালি নয়, বরং এটি বাস্তবতা। কেউ যদি বাস্তবেই হকের রাস্তা হারিয়ে ফেলে, তাকে গোমরাহবলা কোনো গালি দেওয়া নয়। এক্ষেত্রে কেউ যদি আমাকে সংশোধন করে দেয় যে, ভাই, রাস্তা এটা নয়; ওটা। তাহলে নিশ্চয়ই সে আমার প্রতি ইহসান করেছে; অন্যায় কিছু করেনি। দুনিয়াতে যেমন কোথাও যাওয়ার সময় আমার পথ ভুল হতে পারে। কেউ আমাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিলে এটি আমার প্রতি তার ইহসান ও করুণা। তার প্রতি আমার শোকরগুযার হওয়া উচিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, আখেরাতের বেলায় এটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়ার ক্ষেত্রে কেউ স্বেচ্ছায় রাস্তা হারায় না। কিন্তু আখেরাতের ক্ষেত্রে অনেককে দেখা যায়, ইচ্ছা করেই গলত রাস্তায় চলে। হয়তো না বোঝার কারণে অথবা হঠকারিতাবশত। না বোঝার কারণে কেউ গোমরাহীর পথে চলে গেলে ভালো করে বোঝানো হলে সে হয়তো ফিরেও আসে। কিন্তু হঠকারিতাবশত যে গলত রাস্তায় চলে, তার কী হাশর হবে? তার তো অন্তরে ব্যাধি আছে।

সারকথা, তাকওয়ার জরুরত আমাদের ঈমানী যিন্দেগীতে অনেক বেশি- এক হল, তাকওয়ার ফায়দাগুলো বেশি বেশি অর্জন করার জন্য, আরেক হল তাকওয়ার অভাবে যেসব ক্ষতি ও আশঙ্কা হয় সেগুলো থেকে রক্ষার জন্য।

সূরা বাকারার শুরুতেই তাকওয়ার কথা এসেছে।

هُدًی لِّلْمُتَّقِیْن.

এই কুরআন মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত। -সূরা বাকারা (২) : ২

কুরআন কারীম থেকে হেদায়েত পাওয়ার জন্য তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আর তাকওয়ার অভাবে কুরআন কারীম থেকে মাহরূম হওয়ার কথাও কুরআন কারীমে রয়েছে। কাজেই বিষয়টা খুবই জরুরি। তবে তাকওয়ার বিষয়ে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। কারণ আল্লাহ তাআলা যে তাকওয়ার নির্দেশ করেন এবং যে তাকওয়ার ওপর মূল ফায়দা দান করেন সেটি হল, কুফর-শিরক ও মুনাফেকী থেকে বেঁচে থাকা এবং সমস্ত গুনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। বিশেষত কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এই তাকওয়াটা ফরয। এই তাকওয়ার বরকতেই আল্লাহ তাআলা এসব ফায়দা দান করে থাকেন। এই তাকওয়ার বরকতেই আল্লাহ তাআলা সমস্ত ক্ষতি ও আশঙ্কা থেকে হেফাযত করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

اِتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ.

তুমি হারাম থেকে বেঁচে থাক, তাহলে সবচেয়ে বড় আবেদ হয়ে যাবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮০৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩০৫

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাকওয়া হাসিল করার তাওফীক দান করুন। সমস্ত কুফর, শিরক, গোমরাহী ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন।

[মাসিক দ্বীনী মজলিস

মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ,

হযরতপুর, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

২৫ রমযান ১৪৪৫ হি.

৫ এপ্রিল ২০২৪ ঈ., জুমাবার।

শ্রুতলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]

 

advertisement