আনওয়ারুল কুরআন ॥
প্রশ্নোত্তর
আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম প্রশ্নোত্তর। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।
প্রশ্ন ১০২. সূরা হাশরের দ্বিতীয় আয়াতে যে لِاَوَّلِ الْحَشْرِ শব্দ রয়েছে, এর অর্থ কী?
উত্তর : اَوَّلِ الْحَشْرِ অর্থ প্রথম সমাবেশ। চতুর্থ হিজরীতে মদীনার ইহুদীগোত্র বনূ নাযীরকে তাদের একের পর এক ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার কারণে মদীনা থেকে নির্বাসন করা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে সূরা হাশর নাযিল হয়।
অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে اَوَّلِ الْحَشْرِ -এর দ্বারা নির্বাসিত হওয়ার জন্য বনূ নাযীরের ইহুদীদের সমাবেশ বা একত্র হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাসিত হওয়ার জন্য এটাই ছিল ইহুদীদের প্রথম একত্রকরণ। এর আগে তাদের আর এমন লাঞ্ছনাকর সমাবেশ হয়নি।
মুফাসসিরদের মতে ‘প্রথম সমাবেশ’ একথার ভেতর সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, এটা ছিল তাদের প্রথম নির্বাসন। এরপর তাদেরকে আরো নির্বাসনের সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং হযরত উমর রা.-এর আমলে তাদেরকে পুনরায় খায়বার থেকে নির্বাসিত করা হয়। আর তাছাড়া কিয়ামতের সময়কার হাশর বা সমাবেশ তো রয়েছেই।
আবার অনেক মুফাসসির বলেন, এর দ্বারা মুসলিম বাহিনীর সৈন্য-সমাবেশ বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বনূ নাযীরের ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ করার দরকার হয়নি, তাদেরকে উৎখাত করার জন্য মুসলমানরা প্রথমে যখন সৈন্য-সমাবেশ করে, তা দেখেই তারা ভয়ে পরাজয় মেনে নেয়। (দ্র. সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর; তাফসীরে তবারী, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে ইবনে কাসীর)
প্রশ্ন ১০৩. আমি মাদরাসায় হেদায়াতুন্নাহু জামাতে পড়ি। মাসিক আলকাউসারের রমযান সংখ্যায় ‘হাফেয ছাহেবানের খেদমতে কিছু নিবেদন’ শীর্ষক লেখায় পড়েছি, ‘তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ওয়াক্ফ-ইবতিদার নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করা’। ওয়াক্ফ-ইবতিদার নিয়ম মানে কী? এর দ্বারা কি ‘আয়াতের শুরু ও শেষ খেয়াল করা এবং আয়াতের মাঝে ওয়াক্ফের চিহ্ন দেখে ওয়াক্ফ করা’ বোঝানো উদ্দেশ্য?
উত্তর : ওয়াকফ-ইবতিদার নিয়ম দ্বারা আয়াতের শুরু ও শেষ খেয়াল করা বা কেবল ‘আয়াতের মাঝে ওয়াক্ফের চিহ্ন দেখে ওয়াক্ফ করা’ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। ওয়াক্ফ-ইবতিদা একটি ভিন্ন বিষয়, আর আয়াতের শুরু-শেষ আরেকটি ভিন্ন বিষয়। তবে উভয়টিই ইলমুল কিরাআতের শাখাগত দুটি শাস্ত্র।
আয়াতের শুরু-শেষ-এর ইলম হল কোনো একটি আয়াত কতটুকু দীর্ঘ সেটা নির্ণয়ের মাধ্যম। এ বিষয়টি কুরআনের আয়াতসংখ্যা বিষয়ক শাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ কুরআনের কোন্ সূরার আয়াতসংখ্যা কত সেটা জানার জন্য কোন্ আয়াত কোত্থেকে শুরু ও শেষ হয়েছে সেটা আগে নির্ণয় হওয়া জরুরি। আর এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই নির্ণীত। এটা ইজতিহাদী বিষয় নয়, বরং তাওকীফী। এজন্য আয়াত সমাপ্ত হওয়ার বিষয়টি অর্থ ও মর্ম পূর্ণ হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয়। কোথাও আয়াত শেষ হওয়ার সাথেসাথে অর্থও পূর্ণ হয়ে গেছে, কোথাও আয়াত শেষ হয়েছে, কিন্তু অর্থ পূর্ণ হয়নি। অর্থগত দিক থেকে এ আয়াত পরবর্তী আয়াতের সাথে যুক্ত। কিন্তু আয়াত হিসেবে দুটি আলাদা আলাদা আয়াত। কারণ আয়াতের দৈর্ঘ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্ধারিত। আয়াতের শুরু-শেষ-এর এই ইলম ইলমুল কিরাআতের শাখাগত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাস্ত্র। আয়াতের শুরু-শেষ-এর বিষয়টি সবার সহজে বোঝার সুবিধার্থে মুসহাফগুলোতে প্রত্যেক আয়াতের পরে নম্বর দেওয়া রয়েছে। এবিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেব দামাত বারাকাতুহুমের ‘কুরআন কারীমের আয়াতসংখ্যা : একটি পর্যালোচনা’ নামক গ্রন্থটি পড়তে পারেন।
অন্যদিকে ওয়াক্ফ-ইবতিদা হল, কোথায় ওয়াক্ফ করা জরুরি, কোথায় ওয়াক্ফ না করা উচিত, আর কোথায় ওয়াক্ফ করা বা না করা উভয়টারই সুযোগ আছে, এবং ওয়াক্ফ করা হলে আবার কোত্থেকে পড়া শুরু করতে হবে সে বিষয়ক ইলম। এই ইলম কুরআন কারীমের অর্থ ও মর্মের সাথে সম্পর্কিত। অর্থ ও মর্মের বিচারে এটি নির্ধারিত হয় যে, কোথায় ওয়াক্ফ করা হবে এবং কোত্থেকে পড়া শুরু হবে।
এর বিস্তারিত নীতিমালা এবং প্রত্যেক আয়াতে সে নিয়মের প্রায়োগিকরূপ ওয়াক্ফ-ইবতিদা শাস্ত্রের কিতাবাদিতে রয়েছে। সুতরাং নিয়মের আলোকে কোথাও এক আয়াতের মাঝে কয়েক জায়গায় ওয়াক্ফ করা যেতে পারে, আবার কোথাও একাধিক আয়াত একত্রে মিলিয়ে পড়ারও নিয়ম রয়েছে। এসকল নিয়মনীতির দিকে দৃষ্টিগোচর করাতেই মুসহাফগুলোতে আয়াতের শেষে এবং আয়াতের মাঝে নির্দেশনামূলক বিভিন্ন হরফ ছোট করে লিখে দেওয়া হয়েছে। এগুলোকে ‘রুমূযুল আওকাফ’ বা ওয়াকফের চিহ্ন বলে। ওয়াক্ফ-ইবতিদার নিয়ম মেনে তিলাওয়াত করলে তিলাওয়াত অধিক শুদ্ধ ও নিয়মসম্মত হয়। উল্লেখিত প্রবন্ধে এদিকেই হাফেয ছাহেবগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ১০৪. হুজুর, আমি জানি, ‘তাফসীরে নাসাফী’ নামে একটি তাফসীরগ্রন্থ আছে। কিন্তু একটি বাংলা বইয়ে ‘তাফসীরে নাসায়ী’ নামে একটি তাফসীরগ্রন্থের নাম দেখেছি। ‘তাফসীরে নাসায়ী’ নামেও কি তাফসীরগ্রন্থ আছে? নাকি এটি মুদ্রণজনিত ভুল?
উত্তর : ‘তাফসীরে নাসাফী’ ও ‘তাফসীরে নাসায়ী’ দুটি ভিন্ন তাফসীরগ্রন্থ।
তাফসীরে নাসায়ী হাদীসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুনানে নাসায়ী’ প্রণেতা ইমাম আবু আবদুর রহমান আহমাদ ইবনে শুআইব আননাসায়ী (মৃত্যু ৩০৩ হি.) রাহ.-এর তাফসীরগ্রন্থ। তবে এটি তার লেখা স্বতন্ত্র মৌলিক তাফসীরগ্রন্থ নয়। তার ‘আসসুনানুল কুবরা’ নামে আরেকটি সুবিশাল হাদীসের গ্রন্থ রয়েছে। সে কিতাবের তাফসীরের অংশটুকুকেই আলাদাভাবে ‘তাফসীরে নাসায়ী’ নামে প্রকাশ করা হয়েছে। মুআসসাসাতুর রিসালা বৈরূত থেকে ১২ খণ্ডে আসসুনানুল কুবরার যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে, এর দশম খণ্ডটিই কিতাবুত তাফসীর। এটিকেই আলাদাভাবে ‘তাফসীরে নাসায়ী’ নামে দারুল ফিকর বৈরূত থেকে ২ খণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে।
আর ‘তাফসীরে নাসাফী’ ইমাম আবুল বারাকাত আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ আননাসাফী (মৃত্যু ৭১০ হি.) রাহ.-এর তাফসীরগ্রন্থ। তিনি হানাফী মাযহাবের একজন বিখ্যাত ফকীহ ছিলেন এবং ফিকহে হানাফীর মাসআলার প্রসিদ্ধ কিতাব ‘কানযুদ দাকায়েক’সহ আরো বহু কিতাবের মুসান্নিফ। তার তাফসীরগ্রন্থের নাম ‘মাদারিকুত তানযীল ওয়া হাকায়িকুত তাওয়ীল’। দারু ইবনে কাসীর বৈরুত থেকে এটি ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন ১০৫. صلاة الوسطى (সালাতুল উসতা) কোন্ নামায?
উত্তর : صلاة الوسطى -এর অর্থ ‘মধ্যবর্তী নামায’। এর দ্বারা আসরের নামাযকে বোঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কিত হাদীসে আসর নামাযকে صلاة الوسطى (সালাতুল উসতা) বলেছেন। সূরা বাকারার ২৩৮ নম্বর আয়াতে ‘সালাতুল উসতা’ শব্দ উল্লেখ করে আসর নামাযের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৩১, ৬৩৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬২৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৪; সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর, তাফসীরে তবারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর)