Shawal 1445   ||   April 2024

রাব্বুল আলামীনের গুণ-পরিচয় ॥
সিফাত সংশ্লিষ্ট দ্ব্যর্থবাধক শব্দের ব্যাখ্যায় ॥
বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার কুরআনী উসূল

Mawlana Muhammad Abdul Majid

সিফাত সংশ্লিষ্ট মুতাশাবিহশব্দের মর্ম অনুধাবনে বিভ্রান্তির আসল কারণ

ইলাহী সিফাতের ব্যাপারে মানুষ সাধারণত যেসব ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয় তার বিভিন্ন প্রকার ও পর্যায় সম্পর্কে গত অক্টোবর ২০২৩ সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেসব ভুল-ভ্রান্তির অন্যতম একটি প্রকার হল সিফাত সংশ্লিষ্ট মুতাশাবিহাত বা দ্ব্যর্থবোধক ও দুর্বোধ্য কিছু শব্দ ও বাক্যের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনে বিভ্রান্তির শিকার হওয়া। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ তাআলার শানে ব্যবহৃত যেসব শব্দ-বাক্যে ভাষাগত বিচারে আল্লাহ তাআলার শায়ানেশান ইলাহী ও অসীম অর্থের সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি মাখলুকের উপযোগী লৌকিক ও সীমাবদ্ধ অর্থেরও সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু কিছু মানুষ তাদের অজ্ঞতা বা অসতর্কতার কারণে কিংবা ইত্তেবায়ে হাওয়া তথা নিজস্ব খেয়াল-খুশিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ইলাহী অর্থের পরিবর্তে মানবীয় ও লৌকিক অর্থ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা এধরনের ভুলের শিকার হন, তাদের নিজের অজ্ঞতা, অসর্তকতা ও খামখেয়ালিপনাই এর জন্য দায়ী। কেননা মুতাশাবিহাতের অর্থ অনুধাবনের ক্ষেত্রে এধরনের ভুল মূলত দুটি বিষয়ে অজ্ঞতা বা অসতর্কতার ফলাফল-

এক. আল্লাহ তাআলার সত্তা ও সিফাতের পবিত্রতা ও অনন্যতা সম্বন্ধে সঠিক, স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকা।

দুই. আরবী ভাষার বাকরীতি, অলংকার ও শব্দার্থের ব্যাপকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে শব্দকে সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করা এবং সর্বোপরি শব্দের পূর্বাপর প্রসঙ্গ ও আলামতসমূহের প্রতি খেয়াল না করে, শব্দকে খণ্ডিতভাবে বোঝার চেষ্টা করা। 

এজন্যই মুতাশাবিহ আয়াত ও হাদীসের সঠিক মর্ম অনুধাবনের ক্ষেত্রে পূর্বাপর প্রসঙ্গ ও আলামত খেয়াল করা এবং সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও সাদৃশ্যহীনতার আকীদাকে অন্তরে হাজির রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহ. বলেন-

وما ذَكَرَ كلمةً منها إلا مع قرائنَ وإشاراتٍ ورموزٍ تُزِيلُ عنها إيهامَ التشبيهِ، وقد أَدْرَكَها الحاضرونَ المُشاهدونَ، فإذا نُقِلَتِ الألفاظُ مجرَّدةً عن تلكَ القرائنِ ظهر الإيهامُ، وأعظمُ القرائنِ في زَوالِ الإيهامِ: المعرفةُ السابقةُ بتقديسِ اللهِ تعالى عن قَبُولِ معاني هذهِ الظواهرِ، ومن سبقتْ معرفتُه بذلك، كانتْ تلك المعرفةُ ذخيرةً له، راسخةً في نفسِه، مقارِنَةً لكلِّ ما يسمعُ، فينمحقُ معه الإيهامُ انمحاقاً لا يُشَكُّ فيهِ.

আসলে মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যবোধের ভ্রম দূর করার প্রাসঙ্গিক আলামত ও ইশারা-ঈঙ্গিত ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এধরনের মুতাশাবিহ শব্দগুলো উল্লেখ করেননি। আর এসব প্রাসঙ্গিক আলামত ও ইশারা মজলিসে উপস্থিত সাহাবীগণ নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যবোধের ভ্রম দূর করার সবচেয়ে বড় আলামত হল, মাখলুকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে আল্লাহ তাআলার তাকদীস ও পবিত্রতা সম্পর্কে আগে থেকেই অর্জিত জ্ঞান। এই জ্ঞান যার আগে থেকেই অর্জিত আছে, সেই জ্ঞানই হবে ঐ ব্যক্তির সঞ্চিত সম্পদ, যা তার মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে গ্রথিত থাকবে এবং যখনই কোনো মুতাশাবিহ শব্দ শুনবে তখনই সেই সঞ্চিত জ্ঞান তার সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ফলে সাদৃশ্যবোধের ভ্রম কোনোরূপ সন্দেহ ছাড়া দূরীভূত হবে ও মুছে যাবে। -ইলজামুল আওয়াম আন ইলমিল কালাম, পৃ. ১২২-১২৩ (দারুল মিনহাজ প্রকাশিত)

এ ব্যাপারে ইমাম গাযালী রাহ.  আরো বলেন-

لا نُسَلِّم أنَّ جَهْلَ أهلِ التشبيهِ حصلَ بألفاظِه، بل بتقصيرِهم في كسبِ معرفة التقديسِ وتقديمِه على النظر في الألفاظِ، ولوحَصَّلُوا تلكَ العلومَ التي كُلِّفُوا بها وقَدَّمُوها على البحثِ عن الألفاظِ، لَمَا جَهِلُوا ... .

এটা স্বীকার্য নয় যে, মুশাব্বিহা ফিরকার মূর্খতাসুলভ আচরণের কারণ হল মুতাশাবিহ শব্দ। বরং এর প্রকৃত কারণ হল, আল্লাহ তাআলার তাকদীস ও পবিত্রতা সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে তাদের ত্রুটি ও অবহেলা এবং মুতাশাবিহাত অধ্যয়নের আগে তাকদীস সংক্রান্ত জ্ঞান ও আকীদা অর্জন না করা। তাই তারা যদি তাকদীস সংক্রান্ত জ্ঞান আগেই অর্জন করত তবে তারা এমন মূর্খতাসুলভ আচরণ করত না। -ইলজামুল আওয়াম আন ইলমিল কালাম, পৃ.  ১৩৪

বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার উপায়

একটু ভাবুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবত লাভে ধন্য হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এসব মুতাশাবিহাতের মর্ম অনুধাবনে কেন কোনো প্রকার বিভ্রান্তির শিকার হননি? কারণ তারা একে তো আরবীভাষী ছিলেন, যার ফলে আরবী ভাষার বাকরীতি ও ভাষার অলংকার এবং শব্দার্থের ব্যাপকতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। তাই তারা শব্দকে সংকীর্ণ অর্থে সীমাবদ্ধ না রেখে, আল্লাহ তাআলার শায়ানেশান অসীম অর্থ সহজেই বুঝে নিতেন।

দ্বিতীয়ত, তারা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে বিশুদ্ধ আকীদা সরাসরি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিখেছিলেন। তারা তো কুরআনের আয়াত ও শব্দমালা শেখার আগেই নবীজী থেকে ঈমানের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহাবী জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন-

تعلَّمنا الإيمان قبل أن نتعلمَ القرآنَ، ثم تعلَّمنا القرآنَ، فازددنا به إيمانا وإنكم اليوم تعلمون القرآنَ قبل الإيمانِ.

আমরা তো কুরআন শেখার আগে ঈমান শিখেছি। তারপর কুরআন শিখেছি। ফলে এর দ্বারা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আজ তোমরা ঈমান শেখার আগেই কুরআন শিখছ! -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৬১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ১/৭৫, হাদীস ৫১

এমনিভাবে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর শাগরিদদেরকে লক্ষ করে বলেন-

لقد عِشْنَا بُرْهَةً مِن دهرٍ، وأحدُنا يُؤْتَى الإيمانَ قبلَ القرآنِ، وتَنْزِلُ السورةُ على محمدٍ، فيتعلَّمُ حلالَها وحرامَها وآمرَها وزاجِرَها، وما ينبغي أن يُوقَفَ عنده منها، كما تتعلَّمون أنتم اليوم القرآنَ، ثم لقد رأيتُ اليومَ رجالاً يُؤْتَى أحدُهم القرآنَ قبلَ الإيمانِ، فيقرأُ ما بين فاتحتِه إلى خاتمتِه، ولا يدرِي ما آمرُه، ولا زاجرُه، ولا ما ينبغي أن يُوقفَ عندَه منهُ ويَنتثرُه نثرَ الدَّقَلِ.

একটা যুগ আমরা এভাবে কাটিয়েছি যে, আমাদেরকে কুরআনের আগে ঈমান শেখানো হয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যখন কুরআনের কোনো সূরা নাযিল হয়েছে তখন সেই সূরায় বর্ণিত হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ এবং কোথায় কোথায় ওয়াকফ করতে হবে- তা আমরা শিখেছি, যেমন তোমরা (আমাদের থেকে শিখে) থাকো।

তারপর এ যুগে এসে আমি কিছু মানুষকে দেখতে পাচ্ছি, তাদেরকে ঈমান শেখানোর আগেই কুরআন দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারা কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ছে, কিন্তু তারা কুরআনের আদেশ-নিষেধ এবং কোথায় কোথায় ওয়াকফ করতে হবে- তা জানে না, বোঝে না। -শরহু মুশকিলিল আছার, ইমাম তহাবী ৪/৮৫, হাদীস ১৪৫৩আলমুসতাদরাক, হাকিম নিশাপুরী ১/৩৫, হাদীস ১০১

এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, কুরআন অধ্যয়নের আগে ঈমানের সহীহ তালীম গ্রহণ করা জরুরি। এটাই হল কুরআনের তালীম গ্রহণ করার মাসনূন পদ্ধতি। এভাবেই সাহাবীগণ নবীজী থেকে ঈমান ও কুরআন উভয়ের শিক্ষা লাভ করেছেন। সাহাবীদের থেকে তাবেয়ীগণ শিখেছেন এবং তাবেয়ীদের থেকে তাবে-তাবেয়ীগণ শিখেছেন। এভাবে ঈমান ও কুরআন শেখার এই মাসনূন পদ্ধতি প্রজন্ম পরম্পরায় এখনো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলেমদের মাঝে চালু রয়েছে।

তাই এটি একটি বাস্তবতা যে, কুরআনী আকাইদ শুধু মুসহাফের পাতায় রক্ষিত হয়নি, বরং কুরআন কারীমে যে আকাইদ ও আহকাম বর্ণিত হয়েছে, তা কুরআন যে মহান রাসূলের ওপর নাযিল হয়েছে এবং যিনি কুরআনের তালীম ও ব্যাখ্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন এবং নিজ বাণী ও কর্মের মাধ্যমে সাহাবীগণকেও শিখিয়েছেন। এরপর সহাবীদের থেকে তাবেয়ীগণ শিখেছেন। এভাবে প্রজন্ম পরম্পরায় দ্বীনের মৌলিক আকাইদ ও আহকাম আমাদের পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। এধরনের আকীদা ও বিধানকে পরিভাষায় মুতাওয়ারাছবলা হয়। এধরনের মুতাওয়ারাছমুজমা আলাইহিআকীদাকে উপেক্ষা করে কুরআনের কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা করা চরম গোমরাহী ও বিদআত।

তাই কুরআনী আয়াতের সঠিক মর্ম বোঝার জন্য আরবী ভাষা-জ্ঞানের পাশাপাশি প্রয়োজন ইখলাস ও তাকওয়া এবং সবচেয়ে বেশি দরকার কুরআন অধ্যয়নের আগে ঈমান বিল্লাহ সম্পর্কে মুতাওয়ারাছআকীদা শিক্ষা করা।

যাইহোক সারকথা হল, কোনো নস তথা আয়াত ও হাদীসের সঠিক অর্থ বোঝার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সম্পর্কে বিশুদ্ধ  আকীদা থাকা জরুরি। তা না হলে বিভ্রান্তির আশঙ্কা আছে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ একজন মানুষ সাধারণত কোনো কথার, বিশেষত দ্ব্যর্থবোধক শব্দের এমন অর্থই বুঝে থাকে, যা তার পূর্ব-ধারণার সঙ্গে খাপ খায়।

একটি সহজ উদাহরণ লক্ষ করুন, আপনি যখন অবোধ অনভিজ্ঞ শিশুকে বলবেন, কাবা হল আল্লাহর ঘর, তখন সে ধারণা করবে, সে যেমন ঘরে থাকে, তার বাবা-মা যেমন ঘরে থাকে, অন্য অনেক মানুষ যেমন ঘরে থাকে, তেমনি আল্লাহ্ও বোধহয় কাবা ঘরে বাস করেন!

কিন্তু পরিণত বয়সের একজন সমঝদার মুমিন ব্যক্তি নিশ্চিতভাবেই বোঝেন, কাবা ঘরকে আল্লাহর ঘর বলার অর্থ এটা নয় যে, কাবা হল আল্লাহর বাসস্থান। কারণ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব কোনো স্থানের মুখাপেক্ষী নয়, তিনি তো স্থান-কালের স্রষ্টা। স্থান-কাল সৃষ্টির আগেও তিনি ছিলেন এবং সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন। সুতরাং কাবা ঘরকে আল্লাহর ঘর বলার তাৎপর্য হল, কাবা আমাদের কেবলা, আল্লাহর হুকুম পালনার্থে যার অভিমুখী হয়ে আমরা আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁরই হুকুমে আমরা সেই ঘরের তাওয়াফ করি। তাই সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশের জন্য রূপকার্থে কাবাকে আল্লাহর ঘর বলা হয়।

তবে বিভ্রান্তির শিকার আমাদের কোনো কোনো সালাফী ও লা-মাযহাবী ভাই এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলবেন, কাবা আল্লাহর বাসস্থান নয়, কারণ তিনি তো আরশে থাকেন! আবার তাদের কেউ হয়তো  আরো বেফাঁস শব্দে ব্যাখ্যা করবেন যে, কারণ আরশ হল, আল্লাহর ঘর এবং আল্লাহর ঠিকানা, নাউযুবিল্লাহ! সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্ব্যর্থবোধক কোনো শব্দের ও বাক্যের ভ্রান্ত অর্থ বোঝার সবচেয়ে বড় প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হল, বিশুদ্ধ ঈমান ও আকীদা।

মুহকামাত ও মুতাশাবিহাতের পরিচয়

এই বাস্তবতাও ভালোভাবে উপলব্ধি করা জরুরি যে, কুরআন মাজীদ নিজেই ঘোষণা করেছে- তার কিছু আয়াত মুহকামতথা দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট, যা কুরআনের আসল ভিত্তি। এবং কিছু আয়াত মুতাশাবিহ তথা দ্ব্যর্থবোধক ও দুর্বোধ্য। আর মুহকামাত কুরআনের মূল ভিত্তি হওয়ার অর্থ এটাই যে, এর ভিত্তিতে বা এর আলোকেই মুতাশাবিহাতকে বুঝতে হবে। তাই মুহকামাতকে ছেড়ে নিজ খেয়াল-খুশির ভিত্তিতে দ্ব্যর্থবোধাক মুতাশাবিহাতের বাতিল তাবীল বা ভুল ব্যাখ্যা করা বক্র হৃদয়ের পরিচায়ক। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

هُوَ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ مِنْهُ اٰیٰتٌ مُّحْكَمٰتٌ هُنَّ اُمُّ الْكِتٰبِ وَ اُخَرُ مُتَشٰبِهٰتٌ فَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِهِمْ زَیْغٌ فَیَتَّبِعُوْنَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَآءَ الْفِتْنَةِ وَ ابْتِغَآءَ تَاْوِیْلِهٖ وَ مَا یَعْلَمُ تَاْوِیْلَهٗۤ اِلَّا اللهُ  وَ الرّٰسِخُوْنَ فِی الْعِلْمِ یَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا بِهٖ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ رَبِّنَا  وَ مَا یَذَّكَّرُ اِلَّاۤ اُولُوا الْاَلْبَابِ،رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً  اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.

(হে রাসূল!) সে আল্লাহ্ই এমন সত্তা, যিনি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন, যার কিছু আয়াত মুহকাম, যার ওপর কিতাবের মূল ভিত্তি এবং অপর কিছু আয়াত মুতাশাবিহ। যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা সেই মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের পেছনে পড়ে থাকে, উদ্দেশ্য- ফিতনা সৃষ্টি করা এবং সেসব আয়াতের তাবীল খোঁজা; অথচ সেসব আয়াতের যথার্থ তাবীল আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আর যাদের জ্ঞান পরিপক্ব তারা বলে, আমরা এর প্রতি বিশ্বাস রাখি; সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। এবং উপদেশ কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধিমান। (এরূপ লোক প্রার্থনা করে), হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে যখন হেদায়েত দান করেছ তারপর আর আমাদের অন্তরে বক্রতা সৃষ্টি করো না এবং একান্তভাবে নিজের পক্ষ হতে আমাদেরকে রহমত দান কর। নিশ্চয়ই তুমিই মহাদাতা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৭-৮

এই আয়াতে মুহকামাত ও মুতাশাবিহাত সম্পর্কে অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা যথাযথ উপলব্ধি করার পর হাজারও সন্দেহ-সংশয়ের অবসান ঘটতে পারে। বিষয়টি এভাবে বুঝুন, কুরআন মাজীদ ও সমস্ত আসমানী কিতাবে দুই রকমের আয়াত পাওয়া যায়-

এক. যেসব আয়াতের অর্থ সুবিদিত ও সুনির্দিষ্ট

তা হয়তো একারণে যে, অভিধান ও শব্দ বিন্যাস প্রভৃতির দিক থেকে আয়াতের শব্দমালার মাঝে কোনো অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা নেই, ভাষার মাঝেও একাধিক অর্থের অবকাশ নেই এবং বিষয়বস্তুও  দুর্বোধ্য নয়; এমনকি বাহ্যিক দৃষ্টিতেও তা সাধারণ স্বীকৃত মূলনীতিসমূহের পরিপন্থী মনে হয় না। কিংবা এই কারণে যে, ভাষা ও শব্দে আভিধানিক দিক থেকে একাধিক অর্থের অবকাশ থাকলেও কুরআন-হাদীসের সুবিদিত ও অকাট্য উক্তি বা উম্মতের সর্ববাদিসম্মত রায় কিংবা দ্বীনের সর্বজন-স্বীকৃত মূলনীতি দ্বারা নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে- বক্তব্যের উদ্দেশ্য ওই অর্থ নয়; বরং এই অর্থ। এরূপ আয়াতসমূহকে মুহকামাত বলে। প্রকৃতপক্ষে কিতাবের যাবতীয় শিক্ষার মূল ভিত্তি এই প্রকারের আয়াতই হয়ে থাকে।

মুহকামাতের কিছু উদাহরণ

আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে সালাফ তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন থেকে মুহকামাতের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়েছে। রঈসুল মুফাসসিরীন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে মুহকামাতের দৃষ্টান্ত হিসেবে বিভিন্ন আয়াতের কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, এক রেওয়ায়েতে তিনি সূরা আনআমের ১৫১ নম্বর থেকে ১৫৩ নম্বর পর্যন্ত তিনটি আয়াতকে মুহকামের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই আয়াত তিনটি হল-

 قُلْ تَعَالَوْا اَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَیْكُمْ اَلَّا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـًٔا وَّ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ مِّنْ اِمْلَاقٍ  نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَ اِیَّاهُمْ وَ لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ مَا بَطَنَ وَ لَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِیْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ  ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ، وَ لَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْیَتِیْمِ اِلَّا بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ حَتّٰی یَبْلُغَ اَشُدَّهٗ وَ اَوْفُوا الْكَیْلَ وَ الْمِیْزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا  وَ اِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَ لَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰی وَ بِعَهْدِ اللهِ اَوْفُوْا  ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ، وَ اَنَّ هٰذَا صِرَاطِیْ مُسْتَقِیْمًا فَاتَّبِعُوْهُ  وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِیْلِهٖ  ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

(তাদেরকে) বল, এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি যা-কিছু হারাম করেছেন, আমি তা (তোমাদেরকে) পড়ে শোনাই। তা এই যে, তোমরা তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকেও রিযিক দেই এবং তাদেরকেও। আর তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন কোনো রকম অশ্লীল কাজের কাছে যেয়ো না আর আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না। এই সব বিষয়ে, আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা উপলব্ধি কর। এতীম পরিপক্ব বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত তার সম্পদের কাছেও যেয়ো না, তবে এমন পন্থায় (যাবে, তার পক্ষে) যা উত্তম হয় এবং পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ানুগভাবে পরিপূর্ণ করবে। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেই না। এবং যখন (কোনো কথা) বলবে, তখন ন্যায্য বলবে, যদিও নিকটাত্মীয়ের বিষয়ে হয়। আর আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে। আল্লাহ এসব বিষয়ে তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (হে নবী! তাদেরকে) আরো বল, এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনো পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। -সূরা আনআম (৬) : ১৫১-১৫৩

অন্য এক রেওয়ায়েতে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সূরা বনী ইসরাঈলের আরো তিনটি আয়াতকে মুহকামাতের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-

وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا، وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَ قُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا،رَبُّكُمْ اَعْلَمُ بِمَا فِیْ نُفُوْسِكُمْ اِنْ تَكُوْنُوْا صٰلِحِیْنَ فَاِنَّهٗ كَانَ لِلْاَوَّابِیْنَ غَفُوْرًا.

তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং দুআ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালনপালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের অন্তরে কী আছে তা ভালো জানেন। তোমরা যদি নেককার হয়ে যাও, তবে যারা বেশি বেশি তার দিকে রুজু হয় তিনি তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করেন। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩-২৫

মনে রাখতে হবে, এখানে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. মূলত মুহকামাতকে বোঝানোর জন্য কেবল উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি আয়াতের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যথায় কুরআনের অধিকাংশ আয়াতই মুহকাম। তাই ভিন্ন এক রেওয়ায়েতে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কোন্ কোন্ বিষয়ের আয়াতসমূহ সাধারণত মুহকাম হয়ে থাকে তা উল্লেখ করেছেন-

المحكمات: ناسخه، وحلاله، وحرامه، وحدوده، وفرائضه، وما يؤمن به، ويعمل به.

মুহকামাত হল- নাসেখ বিধান, হালাল-হারাম সংক্রান্ত বিধান, হদ ও দণ্ডবিধি, ফরয বিধানাবলি এবং যেসব বিষয়ের সঙ্গে ঈমান ও আমল উভয়ই জড়িত। -তাফসীরুত তবারী ৫/১৯৩

মোটকথা, দ্বীনের যেসব আকাইদ, আহকাম, আখলাক ও মৌলিক শিক্ষাসমূহ কুরআন মাজীদে ও হাদীস শরীফে স্পষ্টভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারংবার ঘোষিত হয়েছে, বিশদ ব্যাখ্যাসহ বর্ণিত হয়েছে এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ্র দ্বারা প্রজন্ম পরম্পরায় সংরক্ষিত হয়েছে- তা মুহকামাত নামে অভিহিত। এসব বিষয় আহলে ইলমের পরিভাষায় জরুরিয়্যাতে দ্বীন’, ‘কাওয়াতিয়ুল ইসলামএবং মুসাল্লামাতে দ্বীননামেও পরিচিত।

আল্লাহ সম্পর্কে মুহকাম আকীদা কোনগুলো

এ ব্যাপারে সারকথা হল, আল্লাহ তাআলাই সবকিছুর একমাত্র খালিক ও সৃষ্টিকর্তা, রব ও পালনকর্তা এবং একমাত্র সত্য ইলাহ ও মাবূদ। এমনিভাবে খালিক, রব ও ইলাহ হওয়ার জন্য যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক এমন সকল পূর্ণ গুণে তিনি গুণান্বিত এবং সেসব পূর্ণ গুণের পরিপন্থী সকল দোষ-ত্রুটি, সীমাদ্ধতা এবং মাখলুকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা হতে চিরপবিত্র। এসবই হল, আল্লাহ সম্পর্কে মুহকাম আকীদা। এসবের পরিপন্থী অন্য কোনো আকীদা, মতবাদ, দর্শন কিংবা তাবীল ও ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য।

এসব মুহকাম গুণাবলি সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে একাধিক স্বতন্ত্র প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। দেখুন, মাসিক আলকাউসার ২০২৩-এর জুন, জুলাই ও সেপ্টেম্বর সংখ্যা।

দুই. মুতাশাবিহ ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত

দ্বিতীয় প্রকার আয়াতকে মুতাশাবিহাতবলে; অর্থাৎ যার অর্থ জানতে ও নির্ণয় করতে সংশয় ও বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। কেননা আরবীতে মুতাশাবিহ শব্দের অর্থ এমন অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য বিষয়, যা বুঝতে মানুষ দ্বিধা-সংশয়ের শিকার হয় কিংবা ভ্রমে পতিত হয়, বিশেষত কোনো বিষয় অন্য বিষয়ের সাথে গুলিয়ে যাওয়ার কারণে যখন ভ্রম তৈরি হয়।

তাছাড়া খোদ এই আয়াতের বর্ণনাধারা বা পূর্বাপর প্রসঙ্গ একটু তাদাব্বুর ও চিন্তা করলেও বোঝা যায়, মুতাশাবিহ হল এমনসব ব্যাখা-সাপেক্ষ ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত, যার ভুলভাল ব্যাখ্যা করে সত্যবিমুখ ও বক্র-হৃদয়ের সুযোগসন্ধানী মানুষ ফিতনা ও বিভ্রান্তি ছড়ায়।

কেননা, প্রথমত, মুতাশাবিহাত শব্দটি মুহকামাতের বিপরীতে বলা হয়েছে। আর মুহকামাত অর্থ যেহেতু অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থতা থেকে মুক্ত ও সুরক্ষিত বিষয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুতাশাবিহাত অর্থ হবে এমন দ্ব্যর্থবোধক বিষয়, যা বুঝতে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা বা সংশয় তৈরি হয়।

দ্বিতীয়ত, মুহকামাতকে উম্মুল কিতাববা কিতাবের মূল ভিত্তি বলা হয়েছে, কিন্তু মুতাশাবিহাতকে তা বলা হয়নি; কারণ মুতাশাবিহাতকে তো মুহকামাতের আলোকে বুঝতে হয়, তাই মুতাশাবিহাত মূল ভিত্তি নয়, বরং মুহকামাতের অনুগামী।

তৃতীয়ত, মুতাশাবিহাতের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা এসবের পেছনে পড়ে ফেতনা ছড়ানোর জন্য এবং নিজ মর্জি অনুসারে তাবীল ও ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু একথা মুহকামাতের ব্যাপারে বলা হয়নি; কারণ মুহকামাতের উদ্দিষ্ট অর্থ ও ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট, সুবোধ্য ও সর্বজনবিদিত। তাই কারো পক্ষে মুহকামাতের ভিন্ন কোনো তাবীল ও ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে না। ফলে মুহকামাতের ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করতে গেলে তা সবার কাছে সরাসরি তাহরীফ ও বিকৃতি হিসেবেই গণ্য হয়। পক্ষান্তরে মুতাশাবিহাতের মধ্যে বাহ্যত যেহেতু দ্ব্যর্থতা থাকে কিংবা বিষয়বস্তু জটিল ও দুর্বোধ্য হয় এবং এর ব্যাখ্যা সবার জানা থাকে না, তাই এই সুযোগে ফেতনাবাজ লোকেরা নিজ মর্জি মতো ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।

চতুর্থত, উপরোক্ত আয়াতে মুতাশাবিহাতের ব্যাপারে সর্বশেষ যা বলা হয়েছে, তার সারকথা হল, এর প্রকৃত তাবীল ও ব্যাখ্যা কেবল আল্লাহ তাআলাই জানেন। আর রাসিখ ফীল ইলমতথা পরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারী যারা, তারা মুতাশাবিহাতকে মুহকামাতের সঙ্গে সমন্বয় করে যতটুকু বোঝা সম্ভব ততটুকু বোঝেন আর যা বুঝতে পারেন না, সে ব্যাপারে নিজেদের অক্ষমতা স্বীকার করে আল্লাহ তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ করেন; তারা কখনোই দ্ব্যর্থতার কারণে মুতাশাবিহাতকে মুহকামাতের বিরুদ্ধে পেশ করেন না এবং মুতাশাবিহাতকে অস্বীকারও করেন না বা অপছন্দও করেন না। বরং তারা বলেন-আমরা এর প্রতি বিশ্বাস রাখি। (কেননা মুহকামাত ও মুতাশাবিহাত) সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ (দ্রষ্টব্য : ইমাম তহাবী, শরহু মুশকিলিল আছার ৬/৩৩৯-৩৪০; তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আলে ইমরানের (০৩) : ৭-৮ আয়াতের তাফসীর)

সালাফ যেসব বিষয়কে মুতাশাবিহ মনে করতেন

মুতাশাবিহাতের সংজ্ঞা ও পরিচয় সম্পর্কে সালাফ ও খলফের বিভিন্ন মনীষীর বক্তব্য রয়েছে। সবার বক্তব্য উল্লেখ করে বিশ্লেষণ করার সুযোগ এখানে নেই। তবে সবার কথার খোলাসা ও সারমর্ম তাই, যা আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম। উদাহরণস্বরূপ এখানে মাত্র একজন মনীষীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি, যা মুহকামাত ও মুতাশাবিহাতের সংজ্ঞা হিসেবে মুহাক্কিক আলেমদের কাছে সমাদৃত ও অগ্রগণ্য।

যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা.-এর নাতি, মুহাম্মাদ ইবনে জাফর ইবনে যুবাইর রাহ., যিনি তৎকালীন মদীনা শরীফের প্রখ্যাত ফকীহ, মুফাসসির এবং সীরাত ও মাগাযীর আলেম ছিলেন, তিনি উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন-

هُوَ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ مِنْهُ اٰیٰتٌ مُّحْكَمٰتٌ هُنَّ اُمُّ الْكِتٰبِ: فيهن حُجَّةُ الربِّ، وعِصْمةُ العبادِ، ودَفْعُ الخُصومِ والباطلِ، ليس لهن تصريفٌ ولا تحريفٌ عما وُضِعْنَ عليه وَ اُخَرُ مُتَشٰبِهٰتٌ لهن تصريفٌ وتأويلٌ، ابتلى اللهُ فيهن العِبَادَ، كما ابتلاهم في الحلالِ والحرامِ، ألا يُصْرَفْن إلى الباطلِ، ولا يُحَرَّفْن عن الحقِّ. يقول عز وجل: فَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِهِمْ زَیْغٌ: أي مَيْلٌ عن الهُدى فَیَتَّبِعُوْنَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ، أي ما تَصَرَّفَ منه،( ) ليُصَدِّقوا به ما ابتدعُوا وأَحْدَثوا، لتكونَ لهم حجةٌ، ولهم على ما قالوا شُبْهةٌ ابْتِغَآءَ الْفِتْنَةِ أي اللَّبْسِ وَ ابْتِغَآءَ تَاْوِیْلِهٖ ذلك على ما رَكِبوا من الضلالةِ في قولهم: خلقنا وقضينا. يقول: وَ مَا یَعْلَمُ تَاْوِیْلَهٗۤ أي الذي به أرادوا ما أرادوا اِلَّا اللهُ وَ الرّٰسِخُوْنَ فِی الْعِلْمِ یَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا بِهٖ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ رَبِّنَا فكيف يختلفُ وهو قولٌ واحدٌ، من ربٍّ واحدٍ؟! ثم رَدُّوا تأويلَ المتشابهِ على ما عَرَفُوا من تأويلِ المُحْكَمةِ التي لا تأويلَ لأحدٍ فيها إلا تأويلٌ واحدٌ، واتَّسَقَ بقولهم الكتابُ، وصَدَّق بعضُه بعضًا، فنَفَذتْ به الحُجَّةُ، وظهَر به العُذْرُ، وزاح به الباطلَ، ودَمغ به الكفرَ. يقول الله تعالى في مثل هذا: وَ مَا یَذَّكَّرُ في مثل هذا( )اِلَّاۤ اُولُوا الْاَلْبَابِ.

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের অনেক মনীষী আলেম মুতাশাবিহাতকে একটু ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন তারা বলেছেন, মুতাশাবিহাত হল, ‘এমনসব আয়াত ও হাদীস, যার প্রকৃত তাবীল ও ব্যাখ্যা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ছাড়া অন্য কেউ জানে না এবং তা এই দুনিয়ায় অন্য কেউই কখনো জানতেও পারবে না।

মনে রাখতে হবে, এটি মূলত মুতাশাবিহাতের এক বিশেষ প্রকারের সংজ্ঞা। তাই এটি সব মুতাশাবিহাতের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। অন্যথায় ভাষাগত বিচারে মুতাশাবিহ শব্দের অর্থ আরো ব্যাপক। অর্থাৎ যে শব্দ বা বিষয়ের মধ্যে কোনো ইশতেবাহ ও দ্ব্যর্থতা তৈরি হয়, তাকেই আরবীতে মুতাশাবিহ বলা হয়। এ ব্যাপক অর্থেই শব্দটি বিভিন্ন হাদীসে এবং সাহাবা ও তাবেয়ীনের বিভিন্ন আছার ও বাণীতে ব্যবহৃত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যখনই কোনো আহলে বিদআত ও আহলে বাতিল কুরআন ও হাদীসের কোনো দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ও বাক্য দ্বারা নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনের অপচেষ্টা করেছে তখনই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলেমগণ তাদের সেই অপচেষ্টাকে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

যেমন, আমরা দেখতে পাই, খারেজী ফেরকা যখন সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুরআন কারীমের ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ ও দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল তখন তাদের এই বিভ্রান্তিকে অনেক ফকীহ সাহাবী ও তাবেয়ী মুতাশাবিহাতের অনুসরণ নামে আখ্যায়িত করেছেন। (দ্রষ্টব্য : তাফসীরুত তবারী, পূর্বোক্ত আয়াতের তাফসীর; আলমুসান্নাফ, ইবনু আবী শাইবাহ ২১/৪৩০-৪৩৭; শরহু মুশকিলিল আছার, ইমাম তহাবী ৬/৩৩৪-৩৩৮)

ইলাহী সিফাত সংশ্লিষ্ট কোন্ শব্দগুলো মুতাশাবিহ

মুহকামাত ও মুতাশাবিহাতের যে সংজ্ঞা ও পরিচয় এতক্ষণ আলোচনা করা হল, তা যারা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন তারা এটা সহজেই বুঝতে পারবেন যে, মুতাশাবিহাতের অন্যতম একটি প্রকার হল, আল্লাহ তাআলার শানে ব্যবহৃত ঐসব দ্ব্যর্থবোধক ও ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ শব্দ ও বাক্য, যার কারণে অতীতে ও বর্তমানে গোমরাহীর শিকার কিছু মানুষ মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলিকে মাখলুকের সদৃশ বলে ধারণা করে। যেমন কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার শানে ইয়াদাইন’ (হস্তদয়), ওয়াজহ (মুখমণ্ডল), ইয়ুন (চক্ষুসমূহ) এবং আরশে ইস্তাওয়াকরলেন, দুনিয়ার আসমানে নুযুল বা অবতরণ করেন ইত্যাদি যেসব শব্দ ও বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা এধরনের শব্দ ও বাক্যগুলো অতি প্রচলিত অর্থে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বোঝায়, কিংবা মানুষের দেহ ও মনের সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী বিভিন্ন অবস্থা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোঝায়। আর তাই এধরনের শব্দাবলির কারণেই অতীতে ও বর্তমানেও মুশাব্বিহা ফিরকা (সাদৃশ্যবাদী ফিরকা) এবং মুজাসসিমা ফিরকা (দেহবাদী ফিরকা) বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে।

অথচ এই শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ যদিও দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা দৈহিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু আরবী ভাষায় এগুলো বিভিন্ন রূপক ও ইঙ্গিতার্থেও প্রচলিত।

তাছাড়া এগুলো কুরআন ও হাদীসে একসঙ্গে এক জায়গায় বর্ণিত হয়নি, স্বতন্ত্রভাবেও বর্ণিত হয়নি এবং আয়াত ও হাদীসের মূখ্য উদ্দেশ্য ও মাকসাদ হিসেবেও বর্ণিত হয়নি। কুরআন ও হাদীসের কোথাও সরাসরি এভাবে বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাআলার হাত আছে, মুখমণ্ডল আছে, চোখ আছে...।

বরং শব্দগুলো অন্য কোনো প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। তাই ভাষাগত বিচারেই এগুলোর বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য হওয়া অবধারিত নয়, বরং রূপক অর্থের বা ইঙ্গিতার্থের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

সর্বোপরি এই শব্দগুলোকে আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে মানবীয় অর্থে গ্রহণ করা খোদ কুরআন কারীমে বর্ণিত মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতের পরিপন্থী, দ্বীনুল ইসলামের অকাট্য নীতিমালার পরিপন্থী এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী। কুরআন কারীমের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-

لَیْسَ كَمِثْلِهٖ شَیْءٌ  وَ هُوَ السَّمِیْعُ الْبَصِیْرُ.

তাঁর সদৃশ কিছুই নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। -সূরা শূরা (৪২) : ১১

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সদৃশ বা তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই। তিনি সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু দেখেন, কিন্তু তাঁর দেখা ও শোনা কোনো মাখলুকের দেখা ও শোনার মতো নয়। তিনি সকল কামালাত ও পূর্ণতা গুণে গুণান্বিত, কিন্তু তিনি গুণের ক্ষেত্রে মাখলুকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এমনিভাবে কুরআন কারীমের বিখ্যাত সূরা, যাকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ বলা হয়েছে অর্থাৎ সূরা ইখলাসে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে-

وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.

তাঁর সমতুল্য কেউই নেই। -সূরা ইখলাস (১১২) : ০৫

সাদৃশ্যহীনতার বিষয়ে এই আয়াতদুটি মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন হওয়া হকপন্থী সকল আলেমের কাছে স্বীকৃত ও ইজমায়ী বিষয়। এছাড়াও এবিষয়ে কুরআন ও হাদীসে আরো বহু নসবর্ণিত হয়েছে, যার কিছু বিবরণ আমরা ইতিপূর্বে মাসিক আলকাউসারের জুলাই-২০২৩ সংখ্যায়, ‘তাঁর হাম্দের পাশাপাশি তাসবীহও জরুরিশিরোনামের প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

সারকথা হল, আল্লাহ তাআলা মাখলুকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা হতে পবিত্র- এই আকীদা ইসলামের মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন আকীদা। এমনকি পূর্ববর্তী সকল আসমানী দ্বীনের সর্বজন স্বীকৃত আকীদা। আর দ্বীনুল ইসলামে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সকল মুসলমানের সর্ববাদিসম্মত ইজমায়ী আকীদা। বস্তুত ইসলাম হল, খালিস তাওহীদের ধর্ম। এতে যেমন কোনো শিরকের অবকাশ নেই, তেমনি তাশবীহ তথা স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্যায়নেরও সুযোগ নেই। শিরক যেমন তাওহীদের পরিপন্থী, তেমনি তাশবীহ তাওহীদের পরিপন্থী।

সুতরাং পবিত্রতা ও সাদৃশ্যহীনতার এই মুহকামও সর্ববাদিসম্মত আকীদার আলোকে এটা অবধারিত যে, পূর্বোক্ত মুতাশাবিহশব্দ ও বাক্য আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে মানবীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং আল্লাহ তাআলার শায়ানেশান ভিন্ন কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই ভিন্ন অর্থ কী- তা আয়াত ও হাদীসের মর্মোদ্ধারের স্বীকৃত নীতিমালার আলোকেই নির্ণয় করতে হবে। বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তাই এবিষয়ে আমরা স্বতন্ত্র প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

মুতাশাবিহাতের ক্ষেত্রে সঠিক কর্মপন্থা

এক্ষেত্রে সঠিক পন্থা কী- তা সূরা আলে ইমরানের উপরোক্ত আয়াত থেকেই আমরা বুঝতে পারি। যার সারমর্ম হল, কুরআন মাজীদের মুতাশাবিহাতের তাবীল ও ব্যাখ্যা নিজস্ব খেয়ালখুশি মতো করা যাবে না, বরং এসব মুতাশাবিহাত যে মহান আল্লাহ তাআলার কালাম ও বাণী এবং যিনি এসবের প্রকৃত তাবীল ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে সম্যক অবগত তাঁর প্রতিই এগুলোকে সোপর্দ করতে হবে অর্থাৎ তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেসব মুহকামাত নাযিল করেছেন তার মধ্যেই ঐসব মুতাশাবিহাতের তাবীল ও ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে। সেই অনুসন্ধান হবে এভাবে যে, মুতাশাবিহ আয়াতকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে দেখতে হবে- কোন্ অর্থ তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে অর্থ তার পরিপন্থী হবে, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যে অর্থ মুহকামাতের পরিপন্থী না হবে, বরং সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং আরবী বাকরীতি সম্মত হবে, তাকেই উদ্দিষ্ট অর্থ বলে গণ্য করতে হবে। যদি চূড়ান্ত চেষ্টার পরও উদ্দিষ্ট অর্থ নির্ণয় করা সম্ভব না হয়, তবে সবজান্তার দাবিতে সীমা অতিক্রম করে যাওয়া উচিত নয়; বরং যেসব ক্ষেত্রে জ্ঞানের কমতি ও যোগ্যতার ত্রুটির কারণে বিষয়ের রহস্য ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে আমরা সক্ষম না হই, তাকেও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। কিন্তু সাবধান, এরূপ কোনো ব্যাখ্যা ও হেরফের করা যাবে না, যা দ্বীনুল ইসলামের মূলনীতি ও মুহকাম আয়াতের বিরোধী।

বস্তুত যারা পরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারী, তারা মুহকাম ও মুতাশাবিহ সর্বপ্রকার আয়াতকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে। তাদের এ প্রত্যয় আছে যে, উভয় প্রকার আয়াত একই উৎস থেকে উৎসারিত, যাতে পরস্পর বিরোধ ও বৈসাদৃশ্যের কোনো অবকাশ নেই। এজন্যই তারা মুতাশাবিহকে মুহকামের দিকে ফিরিয়ে অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। আর যা তাদের বোধশক্তির ঊর্ধ্বে, তা মহান আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয় এবং বলে, এর অর্থ তিনিই ভালো জানেন, আমাদের কাজ ঈমান আনা।

এটি হল কুরআন কারীম ও দ্বীন বোঝার অন্যতম ইলাহী দস্তুর ও নীতি। এই নীতিকে কেউ যদি রক্ষা না করে এবং  ঈমানের মৌলিক শিক্ষা অর্জনের আগেই যদি কুরআন অধ্যয়ন শুরু করে, তবে এধরনের মুতাশাবিহ আয়াতের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে।

বস্তুত মুহকামাতকে উপেক্ষা করে মুতাশাবিহাতের পেছনে পড়া ফেতনা ও গোমরাহীর এক বড় রাস্তা। কারণ কিছু মানুষ তো মুতাশাবিহ আয়াত ও হাদীসের বাতিল ও অবাস্তব অর্থ বুঝে আয়াত ও হাদীসের সত্যতাকেই অস্বীকার করেছে বা সন্দেহের শিকার হয়েছে। আবার কিছু মানুষ মুতাশাবিহ আয়াত ও হাদীসের মুহকাম-বিরোধী ভ্রান্ত অর্থ বিশ্বাস করে গোমরাহীর শিকার হয়েছে।

এভাবে মুতাশাবিহ বিষয়কে বোঝার ইলাহী দস্তুরকে লঙ্ঘন করে যুগে যুগে বহু ব্যক্তি এবং বহু দল গোমরাহীর শিকার হয়েছে। যেমন, বর্ণিত আছে, নাজরানের নাসারারা নিজেদের ত্রিত্ববাদের শিরকী বিশ্বাসকে প্রমাণ করার জন্য কুরআন কারীমে আল্লাহর শানে ব্যবহৃত বহুবচনের সর্বনাম, যেমন- فعلنا، أمرنا، خلقنا، قضينا  ইত্যাদিকে এবং কুরআনের আরো কিছু দ্ব্যর্থবোধক শব্দকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। অথচ আরবী ভাষায় মহিমা ও বড়ত্ব প্রকাশার্থে বহুবচনের সর্বনামের ব্যবহার সুপরিচিত। কিন্তু এই নাসারারা নিজেদের কুফুরী বিশ্বাসের কারণে দ্ব্যর্থবোধক ভাষার সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে ভুল অর্থকেই গ্রহণ করেছিল। আর সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের মতবাদ খণ্ডনের জন্য সূরা আলে ইমরানের শুরুর দিকের বেশ কিছু আয়াত নাযিল হয় বলে বর্ণিত আছে, যাতে মুহকাম ও মুতাশাবিহ সম্পর্কে পূর্বোক্ত নীতিটি বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য: তাফসীরে তবারী, তাফসীরে ইবনে কাছীর)( )

এরপর দেখা যায়, মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন সময় বিদআতপন্থীরা নিজেদের বিদআতী আকীদা ও আমল প্রমাণের জন্য কুরআনের এমন দ্ব্যর্থবোধক আয়াতকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে যাদের ঈমান ও ইলম পরিপক্ব তারা মুতাশাবিহকে মুহকামাতের মতোই সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং সম্ভব হলে মুহকামাতের সঙ্গে সমন্বয় করে মুতাশাবিহাতের অর্থ বোঝে। বুঝে না আসলে এর সত্যতার প্রতি এজমালীভাবে বিশ্বাস রাখে আর এর প্রকৃত ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা কী- তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ছেড়ে দেয় এবং নিজের জ্ঞানের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নেয়।

মুতাশাবিহাত সম্পর্কে কিছু হাদীস ও আছার

মনে রাখতে হবে, মুতাশাবিহাত সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বর্ণিত উপরোক্ত নীতির কথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁর হাদীসে বর্ণনা করেছেন। তারপর কুরআন ও হাদীসের ধারক-বাহক সহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং পরবর্তী আইম্মায়ে দ্বীন তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। এখানে এসংক্রান্ত সব হাদীস ও আছার এবং সালাফের সব বক্তব্য বিস্তারিত উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তাই নমুনাস্বরূপ মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করছি।

সূরা আলে ইমরানের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তিনি মুতাশাবিহাতের অনুসারীদের সম্পর্কে বলেছেন-

فَإِذَا رَأَيْتِ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ فَأُولَئِكِ الَّذِينَ سَمَّى اللهُ، فَاحْذَرُوهُمْ.

যারা কুরআনের দ্ব্যর্থবোধক বিষয়াবলির অনুসরণ করে, তাদেরকে যখন তুমি দেখতে পাও, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হও, কারণ তাদের কথাই আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে বলেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫৪৭

অন্য রেওয়ায়েতে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন-

فَإِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِيهِ، فَهُمُ الَّذِينَ عَنَى الله عَزَّ وَجَلَّ، فَاحْذَرُوهُمْ.

যারা কুরআন নিয়ে (অর্থাৎ কুরআনের দ্ব্যর্থবোধক বিষয় নিয়ে) বিবাদ করে, (উক্ত আয়াতে) আল্লাহ তাআলা তাদের কথাই বলেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সতর্ক হও। -মুসনাদে আহমাদ ৬/৪৮, হাদীস ২৪২১০; শরহু মুশকিলিল আছার, তহাবী ৬/৩৩৫, হাদীস ২৫১৬

অন্য রেওয়ায়েতে মুতাশাবিহাতের অনুসারীদের পরিচয় সম্পর্কে একথাও বর্ণিত হয়েছে-

ولا يعملون بمحكمه.

তারা কুরআনের মুহকাম আয়াতের ওপর আমল করে না। -তাফসীরে তবারী ৫/২১০

আর আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত রাসিখ ফীল ইলমদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ هُمُ الَّذِينَ آمَنُوا بِمُتَشَابِهِه، وَعَمِلُوا بِمُحْكَمِه.

যারা রাসিখ ফীল  ইলম’ (অর্থাৎ জ্ঞানে পরিপক্ব) তারা কুরআনের মুতাশাবিহ বিষয়ের সত্যতার প্রতি ঈমান রাখে এবং এর মুহকাম অনুসারে আমল করে। -শরহু মুশকিলিল আছার, তহাবী ৬/৩৩৪, হাদীস ২৫১৫ (এর সনদ সহীহ)

এছাড়াও বর্ণিত আছে, কিছু সাহাবী তাকদীর সংক্রান্ত কুরআন মাজীদের কিছু মুতাশাবিহ  আয়াত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে খুব রাগান্বিত হন এবং তাদেরকে সতর্ক করে বলেন-

مَهْلًا يا قومِ، بهذا أُهْلِكتْ الأُمَمُ مِن قَبلِكم، باختلافِهم على أنبيائِهم، وضربِهم الكتبَ بعضَها ببعضٍ، إن القرآن لم يُنَزَّلْ يُكَذِّبُ بعضُه بعضًا، بل يُصَدِّقُ بعضُه بعضًا، فما عَرَفْتم منه، فاعْمَلُوا به، وما جَهِلْتم منه، فرُدُّوه إلى عالِمِه.( )

হে কওম! তোমরা থামো। এভাবে তো নবীদের ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে এবং আল্লাহর কিতাবের আয়াতসমূহকে পরস্পর বিরোধী বানিয়ে পূর্ববর্তী উম্মত ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ তো কুরআনকে এভাবে নাযিল করেননি যে, এর এক অংশ অন্য অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে; বরং এর আয়াতসমূহ তো পরস্পরকে সত্যায়িত করে। সুতরাং কুরআনের যেসব আয়াতের মর্ম সম্পর্কে তোমরা জানো, সেগুলো অনুসারে আমল করো এবং যেগুলোর মর্ম সম্পর্কে তোমার জানো না, সেগুলোকে ঐ সত্তার প্রতি সোপর্দ কর, যিনি এ সম্পর্কে সম্যক অবগত। -মুসনাদে আহমাদ ২/১৮১, হাদীস ৬৭০২, ২/১৯৬, হাদীস ৬৮৪৬

আর মুতাশাবিহাতের ব্যাপারে সাহাবা ও তাবেয়ীনের আছার জানার জন্য তাফসীরে তবারীতে এবং ইমাম সুয়ূতীর আদদুররুল মানসূর’-এ সূরা আলে ইমরানের আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দেখা যেতে পারে। এমনিভাবে হাদীস ও আছারের বিখ্যাত সংকলন আলমুসান্নাফও দেখা যেতে পারে, যার সংকলক হলেন ইমাম আবু বকর ইবনু আবী শাইবাহ। এই গ্রন্থের ফাযায়িলুল কুরআন অধ্যায়ে মুতাশাবিহ বিষয়ে করণীয় সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ রয়েছে। দেখুন, উক্ত গ্রন্থের ১৫ খণ্ডের ৪৬৯-৪৭০ পৃষ্ঠা (শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামার সম্পাদনা ও টীকাসহ)।

এই গ্রন্থ থেকে কেবল সাহাবী উবাই ইবনুল কাব রা.-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন-

كتاب الله ما استبانَ منه فاعملْ به، وما اشتبه عليك فآمِنْ به،  وكِلْه إلى عالِمِه. (ابن أبي شيبة في >مصنفه< في كتاب فضائل القرآن، تحت باب عنوانه: >في القرآن إذا اشتبه< ১৫/৪৬৯-৪৭০، برقم: ৩০৬৫৫)

আল্লাহর কিতাবের যতটুকু তোমার সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসে ততটুকুর ওপর তুমি আমল করো। আর যতটুকু তোমার বুঝে আসে না, ততটুকুর প্রতি তুমি (এজমালীভাবে) ঈমান রাখো এবং যিনি এবিষয়ে সম্যক অবগত, একে তাঁর প্রতি সোপর্দ কর।

সবশেষে এবিষয়ে আহলুস ওয়াল জামাআর বিখ্যাত তরজুমান ইমাম আবু জাফর তহাবী (ওফাত : ৩২১ হি.) রাহ.-এর ব্যাখ্যা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি-

>أخبر الله عزَّ وجلَّ في هذهِ الآيةِ بعِجْزِ الخلقِ عن تأويلِ المتشابه الذي ذكرُه فيها بقولِه عز وجل: وَ مَا یَعْلَمُ تَاْوِیْلَهٗۤ اِلَّا اللهُ ، ثم أَخبرَ عزَّ وجلَّ بما يقوله الراسخون في العلم في ذلك؛ ليَمتثلوه ويَتمسكوا ويقتدُوا بهم فيه، وهو قولُه عزَّ وجلَّ: وَ الرّٰسِخُوْنَ فِی الْعِلْمِ یَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا بِهٖ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ رَبِّنَا ، فهكذا يكون أهل الحق في المتشابه من القرآن يردونه إلى عالِمه، وهو الله عز وجل، ثم يلتمسون تأويَله من المحكمات اللاتي هن أم الكتاب، فإن وجدوه فيها عملوا به كما يعملون بالمحكمات، وإن لم يجدوه فيها لتقصير علومهم عنه لم يتجاوزوا في ذلك الإيمانَ به، وردَّ حقيقته إلى الله عز وجل، ولم يستعملوا في ذلك الظنونَ التي حرّم الله عليهم استعمالَها في غيره، وإذا كان استعمالُها في غيره حراما كان استعمالُها فيه أحرمَ وَ مَا یَعْلَمُ تَاْوِیْلَهٗۤ اِلَّا اللهُ.

 (মুতাশাবিহের তাবীল আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না)- এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, মাখলুক নিজ থেকে কুরআনের মুতাশাবিহের তাবীল করতে অক্ষম। আর-

وَ الرّٰسِخُوْنَ فِی الْعِلْمِ یَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا بِهٖ  كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ رَبِّنَا

(এবং জ্ঞানে যারা পরিপক্ব তারা বলে, আমরা এর প্রতি ঈমান রাখি, এর (মুহকাম ও মুতাশাবিহ) সবই  আমাদের রবের পক্ষ থেকে।)- এই বাণীটি দ্বারা আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, জ্ঞানে পরিপক্ব ব্যক্তিরা এব্যাপারে কী বলেন; যদি সকলেই তাদের অনুসরণ করে এবং তাদের বক্তব্যকে আঁকড়ে থাকে। এভাবে যারা হকপন্থী তারা কুরআনের মুতাশাবিহ বিষয়কে সেই মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি সোপর্দ করে, যিনি এ বিষয়ে সম্যক অবগত। তারপর তারা মুতাশাবিহের তাবীলকে ঐসব মুহকামাতের মধ্যে তালাশ করে, যা আল্লাহর কিতাবের মূল ভিত্তি। এখন যদি তারা মুহকামাতের মধ্যে মুতাশাবিহাতের তাবীল খুঁজে পায়, তবে সেই তাবীল অনুসারে আমল করে, যেভাবে তারা মুহকামাতের ওপর আমল করে থাকে। কিন্তু যদি তারা নিজেদের জ্ঞানের ত্রুটির কারণে মুহকামাতের মধ্যে মুতাশাবিহাতের তাবীল খুঁজে না পায়, তাহলে তারা এর প্রতি (এজমালীভাবে) ঈমান রাখে এবং এর হাকীকত ও প্রকৃত মর্ম কী- তা আল্লাহ তাআলার ওপর ছেড়ে দেয়। মুতাশাবিহের তাবীলের ব্যাপারে তারা আন্দায ও অনুমানকে ব্যবহার করে না, যা আল্লাহ তাআলা অন্যান্য ক্ষেত্রেও হারাম করেছেন। তো অন্যান্য ক্ষেত্রে যখন নিছক আন্দায ও অনুমান করে কথা বলা হারাম করেছেন, তখন মুতাশাবিহাতের তাবীলের ব্যাপারে নিছক অনুমান ও ধারণা ব্যবহার করা তো আরো বড় হারাম। -শরহু মুশকিলিল আছার, তহাবী ৬/৩৩৯-৩৪০

কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, গোমরাহী ও বিদআতের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক এই কুরআনী দস্তুরকে বর্তমান যামানায় সালাফের অনুসরণের দাবিদার সালাফী ভাইয়েরা এবং ফিকহুস সালাফকে অবজ্ঞাকারী লা-মাযহাবী ভাইয়েরা সিফাতে ইলাহীর আলোচনায় পুরোপুরি রক্ষা করে না; বরং তাদের অনেকেই আজ বুঝে কিংবা না বুঝে বলে বেড়ায়, সিফাত বিষয়ক আয়াত ও হাদীসে মুতাশাবিহবলতে কিছু নেই! আরো অবাক লাগে, যখন দেখি, তাদের বড় কোনো আলেম ও শায়েখও এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলে ও লেখে!! অথচ ইলাহী সিফাত বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের  কিছু শব্দ ও বাক্য যে মুতাশাবিহ আর যেসব মুতাশাবিহ শব্দ ও বাক্যের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সময় কিছু মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে- একথা সালাফের কাছে স্বীকৃত বিষয়। তারপরও সালাফের অনুসরণের দাবিদাররা কীভাবে বলে, সিফাত সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসের মধ্যে কোনো মুতাশাবিহ শব্দ নেই! তাদের এধরনের অতিরঞ্জিত ও হঠকারিতাপূর্ণ কথাবার্তা কী প্রমাণ করে? তারা কি আসলে সালাফের অনুসরণের নামে পরবর্তী যুগের কোনো এক আলেমের যাল্লাত ও ভুল বক্তব্যের এবং জযবাতী কথাবার্তার অন্ধ অনুসরণ করে থাকেন? এর জবাব সত্যান্বেষী পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমরা সকল মুসলিমের জন্য কুরআন মাজীদের শেখানো এই দুআ করি-

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

টীকা

(1) أخرجه سعيد بن منصور (493-تفسير)، وابن أبي حاتم 2/592 (3168)، والحاكم  في >المستدرك< في تفسير سورة آل عمران 2/277، من طريق عبد الله بن قيس عن ابن عباس، وعزاه السيوطي إلى ابن مردويه، وصححه الحاكم، وأقره الذهبي.

(2) أخرجه الطبري 5/193، وابن المنذر (221)، وابن ابي حاتم 2/592 في تفاسيرهم، وعزاه السيوطي إلى عبد بن حميد، وفي إسناده راو مبهم، وهو الراوي عن ابن عباس، وقال ابن أبي حاتم عقبه تعليقا: >وروي عن سعيد بن جبير نحو ذلك<. وعلَّق ابن عطية في >تفسيره< 2/156 على قول ابن عباس هذا بقوله: >وهذا عندي مثال أعطاه في المحكمات<.

3. يعنيما تشابهت ألفاظه وتصرَّفت معانيه بوجوه التأويلات.

4.     يعني في رد تأويل المتشابه إلى ما قد عرف من تأويل المحكم حتى يتسقا على معنى واحد. انتهى من >تفسير الطبري< 5/227

 .5 رواه الطبري في تفسير الآية المذكورة مفرَّقا في تفسير كل قطعةٍ من الآية الكريمة (5/197 وما بعده)، والقول المذكور قد رجَّحه ابن عطية (>المحرر الوجيز< 2/157)، وابن كثير (2/6-7) ، وقال ابن عطية: >وهذا أحسن الأقوال في هذه الآية<. وانظر لزاما بقية كلام ابن عطية في >المحرر الوجيز<، ففيه تنقيح وتحرير لأقوال العلماء في تفسير معنى المحكم والمتشابه.

(6)انظر: >تفسير الطبري< ط هجر 5/171، و>سيرة ابن هشام< ت السقا 1/574. قال الراقم: هذا مرسل محمد بن جعفر بن الزبير، وله شاهد من مرسل التابعي الربيع بن أنس البصري ثم الخراساني، انظر: >تفسير الطبري< 5/205

(7)وفي رواية للحارث (>بغية الباحث عن زوائد مسند الحارث< للهيثمي 2/740، و>إتحاف الخيرة< للبوصيري 6/323): >فما كان من محكمه فاعملوا به، وما كان من متشابهه فآمنوا به<.

 

 

advertisement