ফিলিস্তিন ইস্যু : দুটি মূল্যায়ন
[ওয়াসআতুল্লাহ খান। সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিবিসি উর্দূ ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলাম লেখক। তূফানুল আকসা শুরুর পর তিনি ফিলিস্তিন-হামাস নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন। যার প্রতিটি লেখাই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় রমযানের আগে ও রমযানের মাঝামাঝিতে প্রকাশিত তার দুটি লেখা মাসিক আলকাউসার-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল। লেখা দুটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন -মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]
থলের বেড়াল বেরিয়েই এল!
৭ অক্টোবরের পরপরই থলের বেড়াল বেরিয়ে এসেছিল। আর এখন তার ধারালো দাঁত ও থাবাও পুরোপুরি বসিয়ে দিল। প্রথম আগ্রাসন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এ সময় সাড়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ঠেলে দেওয়া হয়। এরপর তাদের সব মালিকানা অবলুপ্ত ঘোষণা দিয়ে তা অধিগ্রহণ করা হয় এবং সেখানে ইসরাইলী বসতি স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় আগ্রাসন ১৯৬৬ সালের জুনে শুরু হয়ে গত ৫৭ বছর ধরে অব্যাহত আছে। লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনীকে ইসরাইলী ভূ-খণ্ড থেকে অধিগৃহিত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদেরকে সেনা ও ফৌজদারি বিশেষ আইনের মারপ্যাঁচে এমনভাবে ফাঁসানো হয়, যেন তারা বাধ্য হয়ে চিরদিনের জন্য তা ছেড়ে চলে যায়। এরপর তাদের নাগরিকত্ব বাতিল ঘোষণা দিয়ে ফিরে আসার পথও বন্ধ করে দেওয়া যায়।
আর ৭ অক্টোবর থেকে এখন তৃতীয় আগ্রাসন শুরু হল। হামাসের সশস্ত্র হামলার অনেক আগেই ইসরাইলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থার থিংক ট্যাঙ্ক গাজাকে খালি করে পূর্ব জর্ডানের মতো সেখানেও ইহুদী বসতি স্থাপনের একটি নীলনকশা প্রস্তুত করে রেখেছিল।
১৯৬৬ সালের যুদ্ধের পর গাজায় বসতি স্থাপনকারী সাড়ে ৫ হাজার ইহুদীকে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের সাথে এক সমঝোতার মাধ্যমে পশ্চিম জর্ডানে স্থানান্তর করার পর গাজা অঞ্চলে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সেখানকার ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনীকে এক উন্মুক্ত জেলখানার কয়েদি বানিয়ে রাখে। ২০০৭-এর নির্বাচনে হামাসের জয়লাভের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ শেষ হলে গাজায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া যেখানে একটি সুঁই পৌঁছানোরও সুযোগ ছিল না। ফলে নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে গাজার অধিবাসীরা নিজ উদ্যোগে ভূ-গর্ভস্থ সুরঙ্গের এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। মিসর সংলগ্ন গাজা সীমান্তে যার ২০টি মুখ রাখা হয়েছিল; যেখান দিয়ে মিসরের আমলাদের যোগসাজশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য চোরাইপথে গাজায় পৌঁছানো হত। আর ৭ অক্টোবরের পর এ সুযোগটিও বন্ধ হয়ে যায়।
ইসরাইলের মতো মিসরও তাদের গাজা সংলগ্ন সীমান্তপথ বন্ধ করে দিয়েছে। গত চার মাস যাবৎ গাজাবাসীরা বিদ্যুৎ, পানি, পেট্রল ও খাদ্য সামগ্রী ছাড়াই জীবন পার করছে। যুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থা UNRWA ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় যে সামান্য মানবিক সাহায্য গাজায় পৌঁছেছিল তাও ফুরিয়ে গেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পুরো উপত্যকা বসতিমুক্ত করা এবং কেউ যেতে না চাইলে তাকে হত্যার পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ৭ অক্টোবর হামলার পরপর ইসরাইলের পক্ষ থেকে উত্তর গাজা ও গাজা সিটির বাসিন্দাদেরকে দক্ষিণ গাজায় চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। আর দক্ষিণ গাজাকে নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। আরো ঘোষণা দেওয়া হয় যে, উত্তর গাজার বাসিন্দাদেরকে সরিয়ে হামাসের সন্ত্রাসীদেরকে নির্মূল করার লক্ষ্যে ইসরাইল সেখানে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনীদেরকে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
উত্তর গাজায় অভিযান শেষ হলে ইসরাইল গাজার মধ্য ও দক্ষিণ এলাকায় অভিযান শুরু করার ঘোষণা দেয়। কারণ তাদের দাবি, হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলী বন্দীদের নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে এসেছে। তাই দক্ষিণ গাজা বিশেষত খান ইউনুসের প্রতিটি ভবন ধসিয়ে দেওয়া হয় আর সেখানের অধিবাসীদেরকে মিসরের সীমান্তবর্তী শেষ শহর রাফায় চলে যেতে বলা হয়। সেটিও এক নিরাপদ এলাকা। এরপর উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ গাজায় ধারাবাহিকভাবে বোমা ও গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখা হয়। এসব অঞ্চলকে মানুষের বসবাস অনুপযোগী ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়।
রাফায় মূলত গাজার তিন চতুর্থাংশ ফিলিস্তিনীকে মুরগির খোপের মতো গাদাগাদি করে জড়ো করে রাখা হয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বর্তমানে এখানে প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১৬ হাজার মানুষ অবস্থান করছে। যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে ইসরাইলী সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, যুদ্ধের শেষ পদক্ষেপ হিসেবে তারা এখন রাফায়ও সামরিক অভিযান চালাবে। কেননা, হামাস যোদ্ধারা নাকি সেখানেও সরে এসেছে।
জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ইসরাইলের পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ সবাই সতর্ক করে বলছে যে, রাফায় সামরিক অভিযান চালানো হলে সেখানে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমেরিকার আশির্বাদপুষ্ট নেতানিয়াহু বুক ফুলিয়ে বলছে, ইসরাইল অবশ্যই রাফায় হামলা করবে। তবে এর আগে রাফায় আশ্রয় গ্রহণকারীদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
পুরো গাজাই যখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে তখন ফিলিস্তিনীরা আর যাবে কোথায়? মিসরের সিনাই উপদ্বীপে ঠেলে দেওয়া ছাড়া ‘নিরাপদ স্থান’টি তাদেরকে আর কোথায় নিয়ে যাবে? কেউ সেখানে না গেলে ইসরাইলের অভিযানে মারা পড়বে। কিন্তু পরিকল্পনা এটাই- হয়তো এলাকা ছেড়ে বিদেয় হও, নইলে মরার জন্য প্রস্তুত হও।
পরিকল্পনার সফলতার বিষয়ে ইসরাইল এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, দুই সপ্তাহ আগে তেলআবিবে খ্যাতনামা স্থপতি ও নির্মাণকারীদের এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রায় ১০ জন মন্ত্রীও অংশগ্রহণ করে। ফিলিস্তিনী অধিবাসী থেকে মুক্ত করার পর গাজায় ইসরাইলী বসতি স্থাপনের একটি নির্মাণ-নকশাও ওই কনফারেন্সে পেশ করা হয়।
রাফার বিরুদ্ধে কার্যত অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে। মিসর কোনোমূল্যেই তার সীমান্ত খুলে দিতে প্রস্তুত নয়। তারা বরং এখন সীমান্ত-প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেছে। অথচ পশ্চিম জর্ডানে বসতি স্থাপনকারী ইহুদীদের ধারাবাহিক সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং ফিলিস্তিনীদের ভূ-খণ্ড জবরদখলের অগ্রাধিকারভিত্তিক উদ্যোগ ও নতুন ইহুদী বসতি স্থাপনের জন্য দেদারসে অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বরং কয়েকটি বসতির নির্মাণকাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইসরাইল সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পশ্চিম জর্ডান ও পূর্ব জেরুজালেম থেকেও সর্বোচ্চ সংখ্যক অধিবাসীকে জর্ডানের দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে। যদিও জর্ডান প্রশাসন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা তৃতীয়বারের মতো ফিলিস্তিনের এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। আর ইসরাইল যদি ফিলিস্তিনীদের পিছু নেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে জর্ডান কূটনেতিক সম্পর্কসহ ইসরাইলের সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে।
আশঙ্কা হচ্ছে, রাফায় গাজার ফিলিস্তিনীদেরকে একত্র করার উদ্দেশ্য এটিই যে, ধারাবাহিক বোমা ও গোলা বর্ষণের ফলে ভীত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা রাফাহ সীমান্ত ভেঙ্গে সিনাই উপদ্বীপে চলে যাবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম শরণার্থী শিবিরেই থাকবে।
এদিকে ইসরাইলী সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছে, যা কিছু করার এক মাসের মধ্যেই করতে হবে। কেননা, এরপর মুসলমানদের পবিত্র মাস রমযান শুরু হয়ে যাবে। তখনও যদি সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকে, তাহলে ইসরাইলের পাশর্^বর্তী দেশের শাসকগণ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তাদের জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে পারে। আর এ ভয়েই আরব দেশ, বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলো নিছক লোক দেখানোর জন্য ইসরাইলের জাতি নিধন-পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করে চলেছে। যদিও গাজার বাসিন্দাদের কাছে রুটি, পানি, ওষুধ ও আশ্রয় প্রদান আরব ও মুসলিম দেশগুলোর অগ্রাধিকার তালিকায় সবার নিচেই রয়েছে। যার অর্থ, ফিলিস্তিনীদের বিষয়ে ‘চূড়ান্ত সমাধানে’র জন্য গৃহিত ইসরাইলের পরিকল্পনার প্রতি অনেক প্রভাবশালী আরব শাসকেরও মৌন সমর্থন রয়েছে।
জাতিনিধনে ইসরাইলের শরীক দেশগুলো
আমেরিকার একজন সিনিয়র জেনারেল ও জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ-এর প্রধান জেনারেল চার্লস ব্রাউন এর বক্তব্য- ‘ইসরাইলের প্রতি আমেরিকার পরিপূর্ণ সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও এর অর্থ এই নয় যে, ইসরাইলের সামরিক সকল প্রয়োজন পূরণ করা হবে। এমনটি করা হলে আমাদের সামরিক প্রস্তুতি ও সক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।’
জেনারেল সাহেবের এই বক্তব্যের মর্ম আমার জানা নেই। তবে গোটা বিশ্ব জানে, মার্কিন কংগ্রেস যখন ইসরাইলের সকল প্রয়োজনে সহযোগিতার শক্ত প্রাচীর হয়ে আছে তখন সিনেটের সংগ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটিক পার্টির সংসদীয় প্রধান চেক শোমার-এর মতো কথিত ইসরাইলভক্ত রাজনীতিকের পক্ষ থেকে ইসরাইলের জাতি নিধনের ‘গাজা পরিকল্পনা’র বিরোধিতা করা ও ইসরাইলের সামরিক সহায়তার ওপর শর্তারোপের দাবি জানানোতে সাময়িক একটি চমক তৈরি করা ছাড়া আর কোনো মাহাত্ম্য আছে বলে মনে হয় না।
যদিও আমেরিকার আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রের কাছেই শর্তহীনভাবে অস্ত্র বিক্রি করা যায় না। কোন্ পরিস্থিতিতে এবং সম্ভাব্য কোন্ শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হবে এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-আইন অনুযায়ী মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়- এমন কোনো লক্ষ্যে অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত স্পষ্ট নিশ্চয়তা দেওয়া ছাড়া অস্ত্র বিক্রয় নিষিদ্ধ। আর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সাধারণ ও বেসামরিক জনগণ এবং তাদের মালিকানার বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা যায় না। এসব অস্ত্র ব্যবহারের আগে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন যে, ৭ অক্টোবরের পর বাইডেন প্রশাসন এমন কোনো রিভিউ করেনি, যাতে বোঝা যেতে পারে যে, গাজায় ইসরাইলের মার্কিন সমরাস্ত্রের ব্যবহার আন্তর্জাতিক ও মার্কিন নীতিমালা অনুযায়ী হয়েছে, নাকি এর লঙ্ঘন ঘটেছে। লঙ্ঘন হলে ইসরাইলকে আমেরিকার সমরাস্ত্র সরবরাহ করা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ অথবা সীমিত করতে হবে।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও এমন কোনো রিভিউ চাওয়া হয়নি। আর বাইডেন প্রশাসনও বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে কোনো পরীক্ষায় ফেলতে চায় না। উল্টো বরং ইসরাইলের জন্য ১৪ বিলিয়ন ডলারের জরুরি সামরিক সহায়তা প্যাকেজ কংগ্রেসের বিবেচনাধীন রয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন জরুরি সহায়তার নামে ইসরাইলকে শত শত মিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র নিয়মিত সরবরাহ করে চলেছে। কোনো মার্কিন মিত্রের কাছে এত বিপুল পরিমাণ অর্থের সমরাস্ত্র বিক্রি করতে কংগ্রেসের পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন হয় না। আর বাইডেন প্রশাসনও ইসরাইলের অস্ত্রাগার সচল রাখতে আইনের এই সুযোগটির সদ্ব্যহার করে চলেছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইনস্টিটিউট STOCKHOLM INTERNATIONAL PEACE RESEARCH INSTITUTE (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী আমেরিকা ইসরাইলের ৬৮ শতাংশ সামরিক চাহিদা পূরণ করে থাকে। বার্ষিক ৪ হাজার বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর যেসব সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হয়, তার মূল্য ঐ মার্কিন মঞ্জুরি থেকে কেটে রাখা হয়। ফলে অধিকাংশ মার্কিন সমরাস্ত্র ইসরাইল যেন বিনামূল্যেই পেয়ে থাকে।
এর মধ্যে এম-১৬ মডেলের এসাল্ট রাইফেল (M16 Assault Rifle) থেকে শুরু করে এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার (F35 Stealth Fighter)সহ তথাকথিত স্মার্ট বোমা সবই শামিল। গাজায় এখন অব্যাহতভাবে এসবের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
আমেরিকা নিজের প্রয়োজনেও ইসরাইলে অস্ত্রাগার স্থাপন করে রেখেছে। এই অস্ত্রাগার থেকে ইসরাইলও জরুরি পরিস্থিতিতে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে। এখান থেকে ইউক্রেনেও মার্কিন অস্ত্র পাঠানো হয়। এছাড়াও আমেরিকা ইসরাইলকে মিসাইল হামলা থেকে সুরক্ষিত রাখার আইরন ডোম ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং এন্টি মিসাইল সরবরাহ করে থাকে।
ইসরাইলকে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানের যে বহর সরবরাহ করা হয়েছে, তার যন্ত্রাংশ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেদারল্যান্ড ও বৃটেনে স্থাপিত মার্কিন সামরিক গোডাউন থেকে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে ডাচ আদালত হল্যান্ড সরকারের ওপর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
আদালত আশঙ্কা করছে, এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানগুলো সামরিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি বেসামরিক লোকদেরকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। তবে ডাচ প্রশাসন আদালতের নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচার একটি উপায় বের করে নিয়েছে। তারা সরাসরি ইসরাইলকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে বরং ইউরোপের তৃতীয় কোনো দেশকে সরবরাহ করছে। এরপর সেখান থেকে খুব সহজেই এসব সরঞ্জাম ইসরাইলকে পৌঁছে দেওয়া হয়। যেন জাতি নিধনের এই মহাযজ্ঞে ইসরাইলকে কোনোক্রমেই নিবৃত্ত রাখা না যায়।
ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী অন্য বড় দেশটি হল জার্মানি। যারা ২৪ শতাংশ সমরাস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। ২০২২ সালে ইসরাইল জার্মান থেকে যে পরিমাণ অস্ত্র কিনেছে ২০২৩ -এ তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদীদের ওপর চালানো পাশবিক নির্যাতনের কারণে জার্মানি ধারাবাহিকভাবে যে অপরাধবোধে ভুগছে, তা দূর করার লক্ষ্যে ইসরাইলের সব প্রয়োজন পূরণে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ! যেন ফিলিস্তিনীদের রক্তে ইসরাইলের তৃষ্ণা মিটে যায় এবং সময় সময় জার্মানিকে তাদের অতীত স্মরণ করিয়ে না দেয়।
বৃটেন ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। তারা ইসরাইলের ১৫ শতাংশ সামরিক প্রয়োজন পূরণ করে থাকে। বৃটেনই ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মলাভের পথ সুগম করেছিল। ফলে এ দুটি দেশের সম্পর্ক সাধারণ কূটতৈনিক সম্পর্ক নয়; বরং এ হল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক।
ইটালি গত পাঁচ মাসে ইসরাইলকে ২৩ লাখ ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করেছে।
তবে কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। যেমন, কানাডা ইসরাইলের কাছে বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করত। বর্তমানে তারা নতুন বিক্রয় চুক্তি করা থেকে বিরত রয়েছে। জাপানের ইটুচু কর্পোরেশন (Itochu Corporation) ইসরাইলের সর্ববৃহৎ অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি এলবাইত-এর সাথে অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আদালতের আংশিক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় স্পেন ইসরাইলের অস্ত্র আমদানির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে। বেলজিয়ামও বারুদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
এসব নিষেধাজ্ঞা যদিও বেনজীর ও খুশির বিষয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার শাস্তি ও নিয়ন্ত্রণমূলক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া ইসরাইলকে যথেচ্ছাচার থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। আমেরিকা চাইলে আজ রাতেই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। কিন্তু জাতি নিধনের এই মহাযজ্ঞ থেকে আমেরিকা কী অর্জন করতে চায়। এই রহস্য বর্তমানে হয়তো বাইডেন জানে অথবা আল্লাহ জানেন।