সালাম : ইসলামের অনুপম অভিবাদন পদ্ধতি
পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা বিনিময়ে, কল্যাণ কামনা এবং অন্তরঙ্গতা প্রদর্শনে অভিবাদনের বিশেষ পরিভাষা প্রচলিত রয়েছে।
ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যেও পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে একজন অপরজনকে অভিবাদন জানানোর বিশেষ পরিভাষা প্রচলিত ছিল।
ইমরান ইবনে হুসাইন রা. বলেন, ইসলাম-পূর্ব কালে আমরা পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় বলতাম-
اَنْعَمَ اللهُ بِكَ عَيْنًا.
আল্লাহ তোমার চোখ শীতল করুন।
اَنْعِمْ صَبَاحًا.
তোমার প্রভাত শুভ হোক।
যখন আমরা জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অভিবাদনের পূর্ববর্তী পরিভাষা রহিত করে পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে ‘আসসালামু আলাইকুম’ -(তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)- এ শিক্ষা দান করলেন। (দ্র.সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২২৭)
একজন মুসলিমের আরেক মুসলিমের ওপর যত হক রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হক হল, একজন আরেকজনকে সালাম দেওয়া।
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একজন মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের ছয়টি বিশেষ হক রয়েছে-
১. সাক্ষাৎ হলে, তুমি তাকে সালাম দেবে।
২. তোমাকে দাওয়াত দিলে, (শরয়ী কোনো ওযর না থাকলে) তার দাওয়াত গ্রহণ করবে।
৩. তোমার নিকট উপদেশ (বা নিঃস্বার্থ পরামর্শ) কামনা করলে তাকে (নিঃস্বার্থভাবে) উপদেশ বা পরামর্শ দেবে।
৪. হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে জবাবে তুমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন) বলবে।
৫. অসুস্থ হলে তুমি তার শুশ্রূষা করবে।
৬. মৃত্যুবরণ করলে তুমি তার জানাযা(-দাফনে) শরীক হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬২
বস্তুত পারস্পরিক হৃদ্যতা-অন্তরঙ্গতা, সুসম্প্রীতি ও সৌহার্দ সৃষ্টিতে এবং একে অপরের কল্যাণকামিতা প্রদর্শনে সালাম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কোনো বিষয় পৃথিবীর কোনো জাতিগোষ্ঠী পেশ করতে পারেনি। মুসলমানদের পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময় হল শ্রেষ্ঠতম অভিবাদন পদ্ধতি।
‘আসসালামু আলাইকুম’ -এর অর্থ, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আসসালাম অর্থ শান্তি- ইহজাগতিক ও পরজাগতিক উভয় প্রকার শান্তি এখানে উদ্দেশ্য। কারণ, শব্দটি নিঃশর্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং একজন মুমিন অপর মুমিনকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার অর্থ হল, একজন অপরজনের ইহকালীন ও পরকালীন সব ধরনের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করছে। অধিকন্তু সালাম প্রদানকারী ও সালামের জবাব দানকারী প্রত্যেকে নিজের পক্ষ থেকে অপরজনের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করছে। সালাম প্রদানের মাধ্যমে যেহেতু আরেক মুসলিম ভাইকে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাই অন্যের গৃহে প্রবেশ করার পূর্বে গৃহবাসীকে সালাম প্রদানের বিধান দেওয়া হয়েছে। নিজ গৃহ ব্যতিরেকে অন্য কারো গৃহে প্রবেশ করার নীতি নির্দেশ করে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰی تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَهْلِهَا، ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যের গৃহে গৃহবাসীর অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। -সূরা নূর (২৪) : ২৭
পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা প্রকারান্তরে অপর মুসলমানের জন্য অত্যন্ত সুসমৃদ্ধ ও সারগর্ভ দুআ করা এবং তার ইহ ও পরজাগতিক সব ধরনের শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ কামনা করা। এটা বড়দের পক্ষ থেকে ছোটদের প্রতি পরম স্নেহ ও মায়া মমতা প্রদর্শনের মাধ্যম। অনুরূপ ছোটদের পক্ষ থেকে বড়দের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনেরও মাধ্যম।
‘সালাম’ এটি আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে একটি।
সূরা হাশরে ইরশাদ হয়েছে-
اَلْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلٰمُ ...
তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা ...। সূরা হাশর (৫৯) : ২৩
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ‘সালাম’ শব্দটি নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রকাশার্থে ব্যবহার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
سَلٰمٌ قَوْلًا مِّنْ رَّبٍّ رَّحِیْمٍ، سَلٰمٌ عَلٰی نُوْحٍ فِی الْعٰلَمِیْنَ، سَلٰمٌ عَلٰی إِبْرَاهِيْمَ، سَلٰمٌ عَلَی الْمُرْسَلِیْنَ...
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত সালামের এ শাশ্বত বিধান মুসলমানদের সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস, শান্তি-নিরাপত্তা, প্রেম-ভালবাসা এবং ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতে এক অব্যর্থ মাধ্যম। পূর্ব পরিচিত দুই ঘনিষ্ঠজনের মাঝে যখন সালাম বিনিময় অব্যাহত থাকে, এর মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ-সৌভ্রাতৃত্ব, মহব্বত-ভালবাসা এবং একে অপরের শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা পূর্বাপেক্ষা বহু বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। অপরিচিত দুইজনের মাঝে সালাম আদান-প্রদান অব্যাহত থাকলে, পরস্পরের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস, অন্তরঙ্গতা ও হিতকামনার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
মুসলমানদের জীবনে সালাম বিনিময় যেমন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত ও প্রবর্তিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণজনক শিক্ষা, তেমনি তা ইসলামের একটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক ও সর্বজনীন নিদর্শনও বটে।
সালামের সূচনা হযরত আদম আ. থেকে
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম তাঁকে সালামের শিক্ষাদান করেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
خَلَقَ اللهُ آدَمَ عَلَى صُورَتِهٖ، طُولُهٗ سِتُّونَ ذِرَاعًا، فَلَمَّا خَلَقَهٗ قَالَ اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ النَّفَرِ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ جُلُوسٌ، فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ، فَإِنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَّتِكَ. فَقَالَ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ. فَقَالُوا السَّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ. فَزَادُوهُ وَرَحْمَةُ اللهِ.
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করলেন। তাঁর দেহের দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। সৃষ্টি করার পর তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, তুমি যাও এবং ফিরিশতাগণের ওই জামাতটিকে সালাম দাও। তারা তোমার সালামের জবাব কী দিয়ে দেন তা তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এটাই হবে তোমার ও তোমার বংশধরের অভিবাদন-পদ্ধতি।
তিনি গিয়ে ফিরিশতাগণকে সালাম দিলেন- ‘আসসালামু আলাইকুম’।
তাঁরা জবাবে বললেন- ‘আসসালামু আলাইকা ওয়ারাহমাতুল্লাহ’। তাঁরা ‘ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ বাক্যটি বৃদ্ধি করেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩২৬-৬২২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৪১
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল, সালাম শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক অভিবাদন পদ্ধতিই নয়; বরং মানবজাতির প্রথম অভিবাদনের ভাষাও সালাম।
জান্নাতে জান্নাতীরা একে অপরকে অভিবাদন জানাবে সালামের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন-
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ.
অর্থাৎ জান্নাতে জান্নাতীদের পারস্পরিক অভিবাদনের ভাষা হবে ‘সালাম’। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৪
হাদীসের ভাষ্যমতে, আল্লাহ তাআলা উম্মুল মুমিনীন খাদিজাতুল কুবরা রা.-এর প্রতি বিশেষ সম্মানার্থে তাঁকে সালাম শব্দে সম্ভাষিত করেছেন। ফিরিশতাগণের পারস্পরিক অভিবাদনের ভাষাও সালাম। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
هذا جِبْرِيلُ يَقْرَأُ عَلَيْكِ السَّلَامَ.
এ হলেন জিবরীল, তিনি তোমাকে সালাম বলেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৮২
মোটকথা, মুসলমানদের পারস্পরিক সম্ভাষণে ব্যবহৃত ‘আসসালামু আলাইকুম’ বাক্যটি এমন এক সর্বজনীন ও পবিত্রতম বাক্য, যা দ্বারা আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফিরিশতাকুল এবং আদিপিতা আদম আ. অভিবাদন জানিয়েছেন। জান্নাতে জান্নাতীদেরও পারস্পরিক সম্ভাষণের ভাষা হবে সালাম।
ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সালাম
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত সালামের এ সর্বজনীন বিধানটি ইসলামের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিআর বা নিদর্শন। সালামের মাধ্যমেই মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে তথা মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয়। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا.
কেউ তোমাদেরকে সালাম দিলে পার্থিব জীবনের সম্পদ লাভের প্রত্যাশায় তাকে বলো না- তুমি মুমিন নও। -সূরা নিসা (৪) : ৯৪
এ আয়াতাংশ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, সালাম মুমিনের অন্যতম শিআর বা নিদর্শন।
পরিচিত-অপরিচিত সকলকেই সালাম দেব
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
تَقْرَأُ السّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ.
পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে প্রতিটি মুসলিমকে সালাম দাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯
শুধু পরিচিত মুখ দেখে সালাম দেওয়া অসঙ্গত। পরিচিত-অপরিচিত সকলকেই আমরা সালাম দেব।
সালামের ফযীলত ও গুরুত্ব
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
اعبُدوا الرَّحمنَ، وأطعِموا الطَّعامَ، وأفشوا السَّلامَ تدخُلوا الجنَّةَ بسَلامٍ.
তোমরা দয়াময় আল্লাহর ইবাদত কর, মানুষকে আহার করাও এবং সালামের বিস্তার ঘটাও, নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮৫৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৬৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৮৭
আলোচ্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি নেক আমল বা সৎকর্মের উপদেশ দিয়েছেন। উক্ত তিনটি আমল যে কাজে পরিণত করবে তার জন্য জান্নাতের মহা সুসংবাদ রয়েছে।
ক. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত করা
আল্লাহ তাআলার যে বিশেষ হক বা অধিকার বান্দার ওপর আরোপিত হয়েছে, যে জন্য তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তা হল বান্দা শুধু তাঁরই ইবাদত করবে। শুধু তাঁকেই উপাস্যরূপে গ্রহণ করে নেবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর হুকুম ও বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করবে।
খ. অপরকে আহার করানো
নিঃস্ব-দরিদ্র, অসহায়-অভাবগ্রস্ত ও ক্ষুধা-পিপাসাক্লিষ্টকে ইখলাস ও একনিষ্ঠতার সাথে আহার দান করবে। বন্ধুবান্ধব, আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও আল্লাহর নেক বান্দাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী আন্তরিকতাপূর্ণ মেহমানদারি করবে। এর মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হবে, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসা গভীর থেকে গভীরতর হবে। সংকীর্ণ মানসিকতা ও কৃপণতার ন্যায় ঘৃণিত মনোবৃত্তি দূরীকরণে এটি একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ ব্যবস্থা।
গ. পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে সালাম বিনিময় করা
সালাম ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, আল্লাহ তাআলা নির্দেশিত একটি সারগর্ভ দুআও এটি। উল্লিখিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের এ বিধানটি সমাজ জীবনে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলেন, ‘ইসলামের সর্বোত্তম আমল কোনটি?’
তিনি বললেন-
تُطْعِمُ الطّعَامَ، وَتَقْرَأُ السّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ.
(এক) আল্লাহর বান্দাদেরকে আহার করানো।
(দুই) পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯
উপরোক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী আমলসমূহের মধ্য থেকে অপরকে আহার করানো ও সালাম প্রদানকে সর্বোত্তম আমল বলেছেন। অথচ বিভিন্ন হাদীসে অন্য অনেক নেক আমলকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর জিকির করা, আল্লাহর পথে জিহাদ করা, মা-বাবার আনুগত্য করা, যথাসময়ে নামায পড়া ইত্যাদিকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দুই বক্তব্যের মধ্যে কোনো বিরোধ বা বৈপরীত্য নেই। কারণ, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ এ প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যের বিভিন্নতা মূলত সম্বোধিত ব্যক্তি, তার অবস্থা ও অবস্থানগত বিভিন্নতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। অন্যথায় ইসলামী জীবনব্যবস্থায় উল্লিখিত সৎকর্মসমূহের মধ্য থেকে প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্ববিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের দাবি রাখে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا تَدْخُلُونَ الْجَنّةَ حَتّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتّى تَحَابّوا، أَوَلَا أَدُلّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوا السّلَامَ بَيْنَكُمْ.
তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা পূর্ণাঙ্গ মুমিন হবে। তোমরা পূর্ণাঙ্গ মুমিন হবে না, যে পর্যন্ত না তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের কথা বলব না, যা করলে তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হবে। তা হল, তোমরা সালামের বিস্তার ঘটাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪
এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে জানা গেল, পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার জন্য মুসলমানদের পারস্পরিক মহব্বত ও ভালবাসা অতি আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্ব ও দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, দুই মুসলমান পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে একে অপরকে সালাম দেওয়া ও সালামের জবাব দানের মাধ্যমে এ মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। আর পারস্পরিক মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টির ফলেই ঈমান পূর্ণতায় পৌঁছে।
বস্তুত প্রতিটি নেক আমল ও সৎকর্মের বিশেষ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া তখনই প্রকাশ পায়, যদি তাতে রূহ ও প্রাণশক্তি তথা ইখলাস ও একনিষ্ঠতা থাকে। যেমন, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ¦ এবং যিকির ও তিলাওয়াতের ন্যায় ইসলামের মৌলিক ইবাদাতসমূহ; মুসলমানদের সামাজিক শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা, সাম্য-শান্তি এবং সৌহার্দ ও সুসম্প্রীতি সৃষ্টিতে কার্যকর ইসলামের সালাম বিধানটিও ঠিক তেমনি। একজন মুসলিম যখন আরেকজন মুসলিমকে হৃদয়ের গভীর থেকে পূর্ণ ইখলাস ও ঐকান্তিকতার সাথে এবং ঈমানের দাবি ও চেতনা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত পন্থায় সালাম দেবে এবং তা অব্যাহত রাখবে, তখন অবশ্যই উক্ত সালামের মাধ্যমে তাদের অন্তরের সব মলিনতা ও কদর্যতা, সব হিংসা ও বিদ্বেষ, সব শত্রুতা ও বৈরিতা তিরোহিত হবে এবং তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে গভীর অন্তরঙ্গতা ও অকৃত্রিম ভালবাসা।
বস্তুত পারস্পরিক সৌহার্দ ও সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে, অন্তরঙ্গতা ও আপনত্ব তৈরিতে সালাম ইসলামের এক অনন্য অভিবাদন পদ্ধতি। কিন্তু আজ আমাদের বহু আমলই রূহ ও প্রাণশূন্য। তাতে না থাকে ইখলাস ও ঐকান্তিকতা, আর না তাতে অনুসৃত হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত কর্মপন্থা। ফলে সালাত-সিয়াম থেকে শুরু করে কোনো নেক আমল থেকেই আমরা তার অন্তর্নিহিত সুফল ও কল্যাণ অর্জন করতে পারছি না।
সালামের সওয়াব
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّ رَجُلًا جَاءَ إِلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ، قَالَ: قَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: عَشْرٌ ثُمّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: عِشْرُونَ. ثُمّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهٗ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: ثَلَاثُونَ.
এক ব্যক্তি নবী আলাইহিস সালামের নিকট এসে বললেন-
السّلَامُ عَلَيْكُمْ.
(আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।)
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, عَشْرٌ (দশ)। (অর্থাৎ, আগন্তুক ব্যক্তির আমলনামায় সালামের বিনিময়ে দশ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।)
এরপর আরেক ব্যক্তি এসে বললেন-
السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ.
(আপনার প্রতি শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।)
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, عِشْرُونَ (বিশ)। (অর্থাৎ, তার আমলনামায় বিশ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।)
এরপর তৃতীয় আরেক ব্যক্তি এসে বললেন-
السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ.
(আপনার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ বর্ষিত হোক।)
তখন তিনি বললেন, ثَلَاثُونَ (ত্রিশ)। (অর্থাৎ তার আমলনামায় ত্রিশ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯৫
শুধু সালাম প্রদানের উদ্দেশ্যেই বাজারে গমন
ইমাম মালিক রাহ. হযরত উবাই ইবনে কা‘ব রা.-এর পুত্র তোফায়েল সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তোফায়েল বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর মজলিসে উপস্থিত হতাম। তাঁর অভ্যাস ছিল, তিনি আমাকে সাথে নিয়ে বাজারে যেতেন এবং পরিচিত-অপরিচিত, পথচারী ও দোকানদার যাকেই অতিক্রম করতেন সালাম দিতেন। কোনো কিছু ক্রয় না করে তিনি বাজার থেকে ফেরত চলে আসতেন। একদিন আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম। যথারীতি আমাকে সাথে নিয়ে বাজারের উদ্দেশে বের হলেন। আমি আরয করলাম, হযরত! আপনি বাজারে গিয়ে কী করবেন? না আপনি কোনো দোকানে গিয়ে দাঁড়ান, না কোনো কিছু ক্রয় করেন, আর না আপনি কোনো পণ্যের মূল্য জিজ্ঞেস করেন, আর না বাজারে গিয়ে কোথাও বসেন! তাহলে আপনি বাজারে কেন যান? আপনি যদি আপন জায়গায় অবস্থান করে দ্বীনী কথাবার্তা বলতেন আর আমরা আপনার থেকে তা শুনে উপকৃত হতাম!
প্রতিউত্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বললেন, আমি তো শুধু এ উদ্দেশ্যে বাজারে যাই, যেন যাকে সামনে পাই তাকে সালাম দিতে পারি।( দ্র. মুয়াত্তা মালেক, বর্ণনা ১৭২৬)
আগে সালাম দেওয়ার ফযীলত
দুই ব্যক্তির মধ্যে সালাম প্রদানে যে অগ্রবর্তী হবে, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও অনুগ্রহ লাভেও সে অগ্রবর্তী হবে। আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللهِ مَنْ بَدَأَهُمْ بِالسَّلاَمِ.
মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও অনুগ্রহলাভে অধিক অগ্রবর্তী সেই ব্যক্তি, যে (অপর মুসলিমকে) সালাম প্রদানে অধিক অগ্রবর্তী। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯৭
আরেক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْبَادِئُ بِالسَّلَامِ بَرِيءٌ مِنَ الْكِبْرِ.
সালাম প্রদানে অগ্রবর্তী ব্যক্তি অহংকার থেকে মুক্ত। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৮৪০৭
অর্থাৎ, সালাম প্রদানে অগ্রবর্তী হওয়া একথা প্রমাণ করে, উক্ত ব্যক্তির অন্তরে অহংকার নেই। অহংকার বান্দার জন্য একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় চরিত্র। বিনয় মুমিনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে প্রথমে সালামের অভ্যাস অহংকার দূরীকরণে এবং বিনয় অর্জনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রতি সাক্ষাতে সালাম
দুই ব্যক্তি পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও সালাম বিনিময়ের পর সামান্য সময়ের জন্য একজন অপরজন থেকে পৃথক হয়ে গেল। পুনরায় উক্ত দুই ব্যক্তি একত্রিত হল; তাহলেও দ্বিতীয়বার একে অপরকে সালাম দেবে।
সুনানে আবু দাউদে আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِذَا لَقِيَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ، فَإِنْ حَالَتْ بَيْنَهُمَا شَجَرَةٌ أَوْ جِدَارٌ، أَوْ حَجَرٌ ثُمَّ لَقِيَهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ أَيْضًا.
তোমাদের কারো যখন কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হবে, তখন তাকে সালাম দেবে। এরপর যদি তাদের দুজনের মাঝে গাছ বা দেয়াল বা (বড় কোনো) পাথর-খণ্ড অন্তরায় হয়, অতঃপর পুনরায় একজনের সাথে অপরজনের সাক্ষাৎ হয়, তাহলে পুনরায় একে অপরকে সালাম দেবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২০০
গৃহে বা মজলিসে আগমন-প্রস্থানকালে সালাম
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا بُنَيَّ إِذَا دَخَلْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُونُ بَرَكَةً عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে বৎস! তুমি যখন তোমার পরিবার পরিজনের নিকট গমন করবে, তখন তাদেরকে সালাম দেবে। এটি তোমার জন্য এবং তোমার পরিবার পরিজনের জন্য বরকত ও কল্যাণ বয়ে আনবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৯৮
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِذَا انْتَهَى أَحَدُكُمْ إِلَى مَجْلِسٍ فَلْيُسَلِّمْ، فَإِنْ بَدَا لَهُ أَنْ يَجْلِسَ فَلْيَجْلِسْ، ثُمَّ إِذَا قَامَ فَلْيُسَلِّمْ فَلَيْسَتِ الأُولَى بِأَحَقَّ مِنَ الآخِرَةِ.
তোমাদের কেউ যখন কোনো মজলিসে পৌঁছবে, সে যেন মজলিসে উপস্থিতদেরকে সালাম দেয়। এরপর সে মজলিসে বসতে চাইলে যেন বসে যায়। অতঃপর যখন সে মজলিস থেকে প্রস্থান করবে পুনরায় সালাম দেবে। প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালাম অপেক্ষা উত্তম নয়। অর্থাৎ মজলিসে আগমনকালীন সালামের যতটুকু মর্যাদা, মজলিস থেকে প্রস্থানকালীন সালামেরও ঠিক ততটুকু মর্যাদা ও গুরুত্ব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭০৬
সালাম সংশ্লিষ্ট নীতিমালা
সালাম দেওয়া সুন্নত এবং জবাব দেওয়া ওয়াজিব। সালাম এমন স্পষ্ট উচ্চারণে দিতে হবে, যেন শ্রোতা ভালোভাবে শোনে। মাসনূন পদ্ধতি হল, হাতে ইশারা ব্যতীত সুস্পষ্ট উচ্চারণে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে। সাথে ‘ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহু’ যোগ করলে অতিরিক্ত আরো বিশ নেকী বর্ধিত হবে। সালাম অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা। এর মাধ্যমে একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য ইহ ও পরকালীন যাবতীয় শান্তি ও নিরাপত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করে। সুতরাং সালাম প্রদানে থাকতে হবে শতভাগ তাওয়াযু ও বিনয়। এজন্য আবশ্যক হল, পায়ে হেঁটে চলাচলকারী বাহনে চড়ে চলাচলকারীকে সালাম দেবে। অনুরূপভাবে ছোট বড়কে, পথ অতিক্রমকারী বসা ব্যক্তিকে, মুখোমুখি পথ অতিক্রমকারী দুই দলের মধ্য থেকে ছোট দল বড় দলকে সালাম দেবে। পথ অতিক্রমরত দলের মধ্য থেকে একজনের সালাম অন্য সকলের জন্য যথেষ্ট হবে এবং বসা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজনের জবাব অন্যদের পক্ষে যথেষ্ট হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ، وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ، وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ.
দুই ব্যক্তির মধ্যে ছোট বড়কে সালাম দেবে, পথ অতিক্রম বা চলাচলকারী বসা ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং অল্প সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যক লোকের জামাতকে সালাম দেবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৩১
আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সূত্রে) বলেন-
يُجْزِئُ عَنِ الْجَمَاعَةِ، إِذَا مَرُّوا، أَنْ يُسَلِّمَ أَحَدُهُمْ، وَيُجْزِئُ عَنِ الْجُلُوسِ أَنْ يَرُدَّ أَحَدُهُمْ.
পথ অতিক্রমকারী দলের মধ্য থেকে একজন সালাম দিলে পুরো দলের জন্য তা যথেষ্ট এবং বসা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন সালামের জবাব দিলে অন্য সকলের পক্ষ থেকে তা যথেষ্ট হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২১০
সালামের জবাব সালাম অপেক্ষা উত্তম বাক্যে হওয়া
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। আর সালামের শব্দের তুলনায় জবাবের শব্দ অপেক্ষাকৃত সুন্দর হতে হবে। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا.
তোমাদেরকে যখন অভিবাদন জানানো হবে তখন তোমরা তা অপেক্ষা উত্তম পদ্ধতিতে অথবা অনুরূপ পদ্ধতিতে অভিবাদন জানাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী। -সূরা নিসা (০৪) : ৮৬
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানকে সালাম দেয়া বা তার ইহ-পরজাগতিক শান্তি ও নিরাপত্তার দুআ করা বস্তুত তার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট সুপারিশ করা। আয়াতে আদেশ করা হচ্ছে, যখন তোমাদেরকে কেউ সালাম দেবে বা তোমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার দুআ করবে তখন তোমাদের ওপরও আবশ্যক তার জবাব দেওয়া। হয়তো তাকে তার সালাম বা দুআর সমপরিমাণ শব্দ বলে দেবে কিংবা তদপেক্ষা অধিক শব্দ বলবে। অর্থাৎ, যদি কেউ তোমাকে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম, তখন তোমার ওপর আবশ্যক, তুমিও তাকে কমপক্ষে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলবে। অতিরিক্ত সাওয়াব পেতে চাইলে সাথে ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ যুক্ত করবে। সালাম প্রদানকারী যদি ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’সহ বলে, তাহলে তুমি জবাবে ‘ওয়া বারাকাতুহু’ শব্দটি যুক্ত করে দাও।
যেসব ক্ষেত্রে সালাম দেওয়া অনুচিত
সালাম প্রদান করা সর্বাবস্থায় এবং সর্বক্ষেত্রে সমীচীন নয়। এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে সালাম দেয়া অনুচিত। যেমন, কেউ কোনো মজলিসে দ্বীনী আলোচনায় রত এবং মজলিসের সকলে তার আলোচনা শুনছে; এমতাবস্থায় মজলিসে নবাগত ব্যক্তির সালাম দেওয়া ঠিক নয়; বরং সালামের শব্দ করা ব্যতীত সে নীরবে মজলিসে বসে যাবে। এমনিভাবে কোনো ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দুআ-মুনাজাত বা অন্য কোনো ইবাদতে মাশগুল রয়েছে, এমন ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া ঠিক নয়।
মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রা. একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করে বলেছেন-
فَيَجِىءُ مِنَ اللَّيْلِ فَيُسَلِّمُ تَسْلِيمًا لاَ يُوقِظُ نَائِمًا وَيُسْمِعُ الْيَقْظَانَ.
...রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা ঘরে প্রবেশের সময় এমন সন্তর্পণে ও সতর্কভাবে সালাম দিতেন, যেন ঘুমন্ত ব্যক্তি (তাঁর সালামের শব্দে) জেগে না যায় আবার জাগ্রত ব্যক্তি সালামের শব্দ শুনতে পায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৮০৯
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সালাম প্রদানকারীর এদিকে লক্ষ রাখতে হবে, যেন তার সালামের কারণে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে; কিংবা অন্য কোনো ধরনের কষ্ট কোনো আল্লাহর বান্দাকে স্পর্শ না করে।