ইফতারে বাধা ও হামলা ॥
সাধারণ ধর্মীয় আয়োজনগুলোও গায়ের কাঁটা হয়ে উঠছে ইসলাম-বিদ্বেষীদের
১৪৪৫ হিজরীর রমযানুল মোবারক শেষ হওয়ার পথে। এই পত্রিকা যখন পাঠকের হাতে যাবে তখন শাওয়াল মাস। বিশ্বব্যাপী ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অন্যবারের মতো এবারও সিয়াম ও কিয়ামের মাধ্যমে রমযানুল মোবারকে মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও মাগফিরাত কামনা করেছেন। সাধ্য অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী, তারাবী-তিলাওয়াত, যিকির-আযকারে নিজেদেরকে মগ্ন রেখেছেন। এ রমযানেও মুসলমানরা দান-খয়রাতে অগ্রসর ছিলেন অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি।
তবে এবারের রমযানুল মোবারক সুখকর যায়নি অনেক দেশে। তাবেদার মুসলিম শাসকেরা দেশে দেশে ইসলাম-বিদ্বেষীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে নিরীহ ইবাদতগুলোতে, দ্বীনী উৎসবগুলোতেও বিভিন্ন অজুহাতে বাধ সেধেছে।
রোযা আসার আগেই খবর এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশটি মসজিদের ইফতারী আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। খবরটির পেছনের উদ্দেশ্য যাই থাকুক। সেখান থেকে জানা গেছে, তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য মসজিদে ইফতার করতে না দিয়ে বাইরে ইফতার করতে বলেছে। কিন্তু এই খবরটি বিশ্বগণমাধ্যম এত ফলাও করে প্রচার করেছে যে, মনে হল, এটা বিশ্বের বড় কোনো খবর। এই প্রচার থেকেই বোঝা যায়, এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও প্রচারকারীরা একই সূত্রে গাঁথা; একই গোত্রের লোক। তাদের পোশাকী ধর্ম পরিচয়, নাম, দেশ ভিন্ন হলেও তারা ধর্মকে নিজেদের গায়ের কাঁটা মনে করে। তারা মুসলমানদেরকে স্বকীয়তা নিয়ে, ইবাদত-বন্দেগী নিয়ে বেঁচে থাকতে দিতে নারাজ। তারা পদে পদে মুসলমানদের দ্বীনের পথে চলতে বাধা সৃষ্টি করতে চায়। তা না হলে একটি দেশের সাধারণ খবর বিশ্বব্যাপী কয়েকদিন ধরে এত ব্যাপক প্রচারের কারণ কী? বোঝা যায়, নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং প্রচার করা- এ দুইয়ের মাঝে ব্যাপক যোগসূত্রিতা রয়েছে।
সে যাই হোক, পরিচ্ছন্নতার বিষয় যে বিশাল একটা অজুহাত এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ইফতারীর আয়োজন করলে মসজিদ অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে- এমন তো কোনো কারণ নেই। মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবেই দস্তরখান ব্যবহার করে। আরব দেশগুলোতে তো ওয়ানটাইম দস্তরখান থাকে। বড় করে বিছিয়ে দেওয়া হয়। ওই দস্তরখান উঠিয়ে নিলে আর কোনো ময়লা থাকে না। সুতরাং মসজিদ ময়লা-আবর্জনাময় হওয়ার প্রশ্নই তো আসে না। এটা একটা অজুহাত। উদ্দেশ্য হল, এ খবর প্রচার করা, ‘মসজিদে ইফতার হবে না।’
হাদীসে এসেছে-
للصَّائمِ فرحتانِ : فرحةٌ حينَ يفطرُ، وفرحةٌ حينَ يَلقى ربَّه.
রোযাদারের জন্য দুটি খুশি : এক খুশি হল, যখন সে ইফতার করে। আরেক খুশি হল, যখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৬৬
ইফতার রোযাদারের খুশির সময়। ইফতার সে একত্রে করে। দশজন মিলে করে। মুসল্লীরা মাগরিবের নামাযের জন্য একত্রিত হয়। সেখানে একত্রে ইফতার করে। সাথে বহু দরিদ্র লোক ইফতারের ওসিলায় এক বেলার খাবার পেয়ে যায়। এটা গায়ে সয়ে উঠছে না মুসলিম-বিদ্বেষীদের। তারা এখানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
সেইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য দেশের শাসকেরা আরও বিভিন্ন অজুহাতে ইফতারে বাধা প্রদান করছে। কেউ সরকারিভাবে ইফতারে বাধা প্রদান করছে। কৃচ্ছ্রতা সাধনের কথা বলছে। খুব ভালো কথা। কৃচ্ছ্রতা সাধন কি কেবল ইফতারের বেলায়?! ভিআইপি, ভিভিআইপিদের পেছনে যে দেশের শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। কারণে অকারণে বিদেশ সফর, সাধারণ চেক আপ-এর জন্য রাষ্ট্রের খরচে লন্ডন-সিঙ্গাপুর গমন। জাঁকজমকপূর্ণ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম- এসবের পেছনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া দেশের জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন নামে ক্ষমতাসীনদের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। এগুলোর পেছনে শত শত কোটি টাকা খরচ হয়! তাদেরই মুখে যখন কৃচ্ছ্রতার কথা উঠে আসে তখন ভাবতে হয়- আসলেই কি টাকা বাঁচানো উদ্দেশ্য, নাকি এটি একটি অজুহাত মাত্র।
যাইহোক, কৃচ্ছ্রতা সাধনের নামে না হয় সরকারি ইফতারি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের হাজার বছরের রেওয়াজ গণইফতারের আয়োজনও কেন বাধা থেকে মুক্ত থাকছে না! এখন মুসলমানরা সাধারণ নিরীহ ধর্মীয় আয়োজনগুলোতেও বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে এবার নতুন ইতিহাস তৈরি হল। ভবিষ্যতে এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকবে। অমুক সালের এত তারিখে মুসল্লিদের ইফতারে বাধা দেওয়া শুরু হয়, ইফতার মাহফিলে হামলা হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ইফতারের আয়োজনে হামলা হয়েছে। হামলা করেছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন। এগুলোর কারণে কোনো মামলা, গ্রেফতার বা বিচার হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি।
ইতিহাসে লেখা থাকবে, ষোলো কোটি মুসলমানের দেশে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এবং একটি জেলা শহরের ইফতারির আয়োজনে এই অজুহাতে, সেই অজুহাতে হামলা হয়েছে। মুসল্লীদের আহত ও রক্তাক্ত করা হয়েছে। বাধা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নোটিশ দিয়ে ইফতারীতে বাধা প্রদান করা হয়েছে। যেখানে নাচ-গান-কনসার্টে কত নামে কত আয়োজনে কত টাকা নষ্ট হয়! সেগুলো নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই! সামনে পৌত্তলিক স্টাইলে বাংলা বর্ষবরণের উৎসবের জন্য রমযানেই কত প্রস্তুতি, কত অপচয়ের আয়োজন চলছে। সেগুলো নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই! কিন্তু যে ইফতার মাহফিলগুলো আবহমান কাল থেকে এদেশের সাধারণ মুসলমানের সম্মিলনের স্থান ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে রয়েছে, যে মাহফিলগুলো থেকে অসংখ্য দরিদ্র লোক দুমুঠো খাবার না চেয়েই পেয়ে যাচ্ছে, সেগুলোতে কেন বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে! ইফতার মাহফিলগুলো সাধারণত এমন হয় আল্লাহর বান্দাদের কারো মনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশা তৈরি হয়, তিনি কিছু খরচ করে ইফতারের আয়োজন করেন। সেখানে সমাজের দশজন খায়- এসবে না কোনো রাজনীতি থাকে, না কোনো বক্তব্য থাকে। সেখানে হয়তো দুটি হাদীস শোনানো হয়। দুটো মাসআলা বলা হয়। একটু কুরআন তিলাওয়াত শোনানো হয়। দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করা হয়। সেটাই আজ সহ্য হচ্ছে না।
বুঝতে হবে, এখানে আসল কারণ কী? এখানে তো রাজনীতির কোনো প্রশ্ন নেই। এখানে কারও কোনো ক্ষতি হওয়ার প্রশ্ন নেই। সরকার-বিরোধিতার প্রশ্ন নেই, তাহলে কেন এত গা-জ্বালা? জ্বালাটা হল, এখন ইসলামের কোনো কিছুই আর সহ্য হচ্ছে না। ধর্মের নাম সহ্য হচ্ছে না। কারণ দেশে দেশে ক্ষমতাসীনরা এসব ক্ষেত্রে মনে করে, ইসলাম-বিদ্বেষী বিদেশী প্রভুরা নাখোশ হয়ে যাবে। তাই তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করার জন্যই হয়তো এসমস্ত কাজে বাধা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।
মুসলমানেরা এখন সবদিক থেকে চাপে আছে। কিন্তু মুসলমানেরা যত বেশি আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জেহ হবে, ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাআলার রজ্জু আঁকড়ে ধরবে, বাতিল তত দ্রুতই পালাতে বাধ্য হবে। বিশ্ব-মুসলিম কুরআন ও সুন্নাহর পথে যত অগ্রসর হবে, ধৈর্য ধরে আঁকড়ে থাকবে, বাতিলের পলায়ন ততই ত্বরান্বিত হবে।
قُلْ جَآءَ الْحَقُّ وَ زَهَقَ الْبَاطِلُ ؕ اِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا.
বল, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই। -সূরা ইসরা (১৭) : ৮১
আরেকটা রমযান তো চলে গেল। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত জনপদ গাজার মুসলিম ভাই-বোনদের কোনো কষ্টই লাঘব হয়নি। আগ্রাসী ইহুদী গোষ্ঠী তাদের আক্রমণ নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। যদিও জাতিসংঘে শেষ মুহূর্তে আমেরিকা ভেটো না দেওয়াতে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে। কিন্তু ইসরাইল সেটার কোনো তোয়াক্কাই করেনি। আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি ত্রাণ বিতরণের সারিগুলোতে আক্রমণ করছে।
জাতিসংঘে প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরও দখলদার ইহুদীদের এই আক্রমণ থেকে বোঝা যায়, তারা কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। জাতিসংঘ বলি বা বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো বলি- কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। এটাকে দুভাবে দেখতে হবে, হয়তো তারা ইসরাইলকে বলে দিয়েছে, আমরা এদিকে প্রস্তাব পাশ করব; তোমরা ওদিকে আক্রমণ চালাতে থাকবে। না হয় বলতে হবে, তারা হয়তো ভালো উদ্দেশ্যেই প্রস্তাবটা পাশ করেছে, কিন্তু ইসরাইলকে প্রশ্রয় দিতে দিতে, বিভিন্নভাবে অন্যায় সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে দিতে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, এখন ওদেরও গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে ইসরাইল। তাদের কথাও এখন আর শুনছে না।
আমরা এর আগেও আলকাউসারে বলেছি, একসময় ইসরাইল মদতদাতাদের জন্যও হুমকি হয়ে উঠবে। তখন দেখা যাবে, ইসরাইলকে তারাও সমর্থন দিতে পারছে না।
যদি ধরে নেওয়া হয়, সদুদ্দেশ্যেই এ প্রস্তাব জাতিসংঘে তারা পাশ করেছে, তাহলে বোঝা যায়, তাদের কথা এখন আর ইসরাইল শুনছে না। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। দুষ্ট চক্রকে দুধ-কলা খাইয়ে পুষলে এক সময়, সে চক্রই গলার কাঁটা হয়ে ওঠে এবং পতনের কারণ হয়। আজকে সেটাই হচ্ছে।
ফিলিস্তিনের মুসলমানদের দুঃখকষ্ট মানবাধিকার ও শান্তির কথা বলা মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- এ সবই তাদের মুখের বুলি। পুরো বিশ্ব মিলে ছোট একটি আগ্রাসী গোষ্ঠীকে থামাতে পারছে না। একটি জাতিকে নিধন করে ফেলার চক্রান্তে যে ইসরাইল নেমেছে, সেটাতে তারা কেউ বাধা দিচ্ছে না। সুতরাং মুসলমানদের অন্যের ওপর নির্ভরতা ছাড়তে হবে। নিজেদের স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। মুসলমান সমাজকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে। যার যেভাবে সম্ভব ফিলিস্তিনী ভাইদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো হেলাফেলা করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। ফিলিস্তিনী ভাই-বোনদের রক্ষা করেন। দখলদার গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে তাদেরকে স্বাধীনতা ও মুক্তি দান করেন।