ঈদ উদ্যাপন : আগে ও এখন
ঈদ একটি ইসলামী পরিভাষা। এটি মুসলিম উম্মাহর বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মুসলমানদের সংস্কৃতি- এ কথার আগে যুক্ত করে নিতে হবে, এটি ইসলামের দেওয়া সংস্কৃতি। অতএব ইসলামী মূল্যবোধের আলোকেই একে বুঝতে হবে এবং দ্বীন ও শরীয়তের শেখানো পদ্ধতিতেই এর উদ্যাপন করতে হবে; নিজেদের মনগড়া ধ্যান-ধারণার আলোকে নয়, কিংবা শরীয়তের বিধিনিষেধ বিবর্জিত বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানসিকতা নিয়ে নয়।
ঈদ আসলে কী?
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের এই দিনটি মূলত আল্লাহ দিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। তিনি যে রমযানের সবক’টি রোযা রাখার এবং তাঁর ইবাদতে পুরো একটি মাস কাটানোর তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায়- এটাই ঈদের তাৎপর্য। এই মাসে রোযা রাখতে পারা এবং আল্লাহর ইবাদতের অসীম-অবারিত সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ মুমিন-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়- ঈদুল ফিতর হল সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। সে আনন্দের প্রকাশ ঘটে দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। তাঁর মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবীর পাঠের মাধ্যমে এবং এই সিয়ামসাধনা যেন কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দুআ চাওয়ার মাধ্যমে।
ঈদের দিন কুশল বিনিময়ের ভাষার মধ্যেই এ বার্তা রয়েছে-
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ.
অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করুন- রমযান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের সমস্ত নেক আমল।
কুশল বিনিময়ের এই বাক্যটিই ইসলামের ঈদকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব থেকে আলাদা করে দেয়। মুসলমানের ঈদ আশা ও ভয়ে মিশ্রিত এক সতর্ক ও সংযত আনন্দ উদ্যাপন। একদিকে খুশি- আলহামদু লিল্লাহ, রোযাগুলো রাখতে পেরেছি। অন্যদিকে শঙ্কা- কবুল হয়েছে তো! রমযান পেয়েও যদি মাগফিরাত নসীব না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য তো কিছু নেই...।
মাসব্যাপী ইবাদতের তাওফীক পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং সেই খুশিতে তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা করে তাকবীর পাঠ, এটাই যে ঈদের মর্মকথা- নিম্নোক্ত আয়াতই তার প্রমাণ-
وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون.
এবং যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও আর আল্লাহ যে তোমাদের পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবেই এদিন বৈধ সব উপায়ে আনন্দ করতে দেওয়া হয়েছে। একজন মুমিন শরীয়তের সীমার ভেতরে থেকে যেভাবে আনন্দ করতে পারে। ভালো খাওয়া, ভালো পরা, আপনজন ও প্রিয়জনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও খোশগল্প, একে অপরকে হাদিয়া দেওয়া, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি।
এই আনন্দে যেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ শরীক হতে পারে, সেজন্যই সদাকাতুল ফিতরের বিধান। শুধু নিজে ভালো খাওয়া ও ভালো থাকার যে আনন্দ- অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দ তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ কারণেই দান-সদকা ও যাকাত-ফিতরার প্রতি এত উৎসাহিত করেছে শরীয়ত।
ইসলাম যে তার অনুসারীদের ধর্ম-কর্ম পালনের পাশাপাশি আনন্দ উদ্যাপনেরও সুযোগ দিয়েছে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনদুটি তারই এক বড় নিদর্শন। ঈদের দিন বৈধ পন্থায় আনন্দ উদ্যাপনের এই অবকাশ প্রসঙ্গেই আম্মাজান আয়েশা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেছেন-
لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ.
ইহুদীরা জানবে, আমাদের ধর্মেও অবকাশ আছে। নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি এমন এক শরীয়ত নিয়ে, যা সহজতা ও উদারতার গুণে গুণান্বিত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৮৫৫
সালাফের ঈদ
শরীয়তের শিক্ষা ও শরয়ী জ্ঞানের চর্চার অভাবে এবং শরীয়া প্রতিপালনে মুসলমানদের বর্ধমান উদাসীনতার কারণে ঈদের এই যে তাৎপর্য- সেটা দিন দিন দৃশ্যপটের আড়ালে চলে যাচ্ছে। তার স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে ঈদের এমন এক সংজ্ঞা এবং চিত্র ও চরিত্র, শরীয়তের মেযাজ ও রুচির সাথে যার কোনো মিল নেই।
বরং বলা যায়, যে উদ্দেশ্যে রোযা ও ঈদ, তার সম্পূর্ণ বিপরীত এক স্রোত গ্রাস করে নিচ্ছে মুসলমানদের ঈদভাবনা ও ঈদ-উদ্যাপন কর্মকাণ্ডকে।
ঈদের স্বরূপ ও শিক্ষা থেকে আমরা কত দূরে, সেটা বুঝতে পারব আমাদের পূর্বসূরিদের সঙ্গে নিজেদেরকে একবার মিলিয়ে নিলে।
সালাফে সালেহীন ঈদকে বাধ্যবাধকতার বন্ধন থেকে মুক্তি হিসেবে দেখেননি; বরং ইসলামের অন্যতম সম্মানিত দিন হিসেবে দেখেছেন। বিভিন্ন হারামে জড়িয়ে এ দিনের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেননি, কোনো কর্তব্য কাজে শিথিলতা করেননি। বরং এ দিনটিতে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন জায়েয খাবার ও পানীয় এবং পরিমিত ও পরিমার্জিত সাজসজ্জার মধ্যে এবং সেইসব কাজের মধ্যে, যা মুমিন-হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনে, যেমন আল্লাহর যিকির ও তাসবীহ-তাকবীর, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নির্দোষ হাসি-আনন্দ ও বৈধ বিনোদন। নিজের ও পরিবারের জন্য ভালো মানের খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ওয়াকী‘ রাহ. বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমরা ঈদের দিন সুফিয়ান সাওরীর সাথে বের হয়েছিলাম; তখন তিনি বললেন, এই দিনটি আমরা প্রথম যে কাজ দিয়ে শুরু করি, তা হল দৃষ্টি অবনত করা। -আলওয়ারা‘, ইবনু আবিদ দুনইয়া, পৃ. ৯৬৩
তাঁদের কাছে প্রকৃত ঈদ ছিল আল্লাহর কাছে কবুলিয়ত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ।
আলী রা. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তিনি রমযানের শেষ রাত্রিতে বলতে থাকতেন-
يا لَيتَ شعري! مَن هذا المَقبولُ فنُهنِّيه؟ ومن هذا المحروم فنُعزّيه.
হায়, জানা নেই, কে আমাদের মাঝে মাকবুল, যাকে স্বাগত জানাব! আর কে আমাদের মাঝে মাহরূম, যাকে সমবেদনা জানাব! -লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলী, পৃ. ৩৬৯
সালাফে সালেহীন ঈদের দিন এই চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন। তার ভেতর দিয়েই হত তাদের ঈদ উদ্যাপন। আনন্দ-বিনোদনের নামে হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার তো প্রশ্নই নেই। কারণ, বিবেকবান পরহেযগার মানুষের কাছে পাপাচারের পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়া কোনোভাবেই আনন্দের বিষয় হতে পারে না, আনন্দ উদ্যাপনের তরীকা হতে পারে না। হাসান বসরী রাহ. তাই বলেছেন-
كلَّ يومٍ لا تَعصِي اللهَ فيه فهو لك عيدٌ.
প্রতিটি দিন, যেদিন তুমি আল্লাহর নাফরমানি কর না, সেটা তোমার জন্য ঈদ। -লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলী, পৃ. ৫১২
কথাটিকে আরেকভাবে পড়ুন, যেদিন আল্লাহর নাফরমানি করা হয়, সেটা ঈদের দিন হলেও ঐ নাফরমান ব্যক্তির জন্য তা ঈদ বা খুশির দিন নয়, বরং ওয়াঈদ ও অভিশাপ!
ঈদ ও আমরা
আজ আমাদের অনেকেরই অবস্থা এমন, ঈদ তাদের ইবাদতকে প্রতিফলিত করে না। রমযানজুড়ে সিয়াম সাধনার কোনো ফলাফল তাদের এই দিনটির কথা ও কাজে প্রকাশ পায় না। ঈদের জন্য তারা এমনভাবে প্রস্তুতি নেয়, ঈদের আয়োজন ও ঈদ-উপভোগে তারা এমনই আত্মহারা ও লাগামহীন হয়ে পড়ে যে, ভাব দেখে মনে হয়, তারা যেন কোনো দাসত্বের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে বা অচিরেই মুক্ত হতে চলেছে। তাই এমন বাঁধভাঙা উল্লাস ও দিশেহারা অবস্থা। কী রেখে কী করবে ঠিক নেই। অপচয় ও ঔদ্ধত্য প্রকাশে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা। চোখের লালসা এবং মনের বাসনা পূরণের যত রকম উপায় ও উপকরণ হতে পারে- তার চর্চা ও প্রসারের এক মহা ধুম! পোশাক-আশাক ও পানাহার থেকে শুরু করে চলাফেরা ও কথাবার্তা, দেখাসাক্ষাৎ ও মেলামেশা এবং বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম ও আয়োজন, কোনো কিছুতেই হালাল-হারামের তোয়াক্কা নেই...।
পবিত্রতা ও সংযমে পার করা একটি মাসের বরকত তারা নষ্ট করে ফেলে সে মাস গত হওয়ার প্রথম দিনটিতেই!
শরীয়তের প্রতি অনুগত ও শরীয়া পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন মুসলমানের অবশ্যই জানা উচিত যে, আনন্দ করা শরীয়তে নিষেধ নয়। তবে তা করতে হবে শরীয়তের নির্দেশিত ও অনুমোদিত পন্থায়। বিশেষ করে যখন সে আনন্দের উপলক্ষ্যটি শরীয়ত নিজেই প্রদান করে- এক মহান লক্ষ্যে, শরীয়তের এক বিরাট শিআর ও নিদর্শন হিসেবে!
সত্যিকার মুসলিম ইসলামের শেখানো পন্থায়ই তার সব কাজ করে। কী ইবাদত কী উৎসব। মন যেভাবে চায় সেভাবে নয়। কারণ, সে বিশ্বাস করে, মনের চাহিদা পূরণের সুখটুকু তাৎক্ষণিক ও সাময়িক, কিন্তু তার ক্ষতি ও সাজা অসীম ও অনন্তকালীন।