মাহে রমযান : হাফেয ছাহেবানের খেদমতে কিছু নিবেদন
রমযান মাস। কুরআন নাযিলের মাস। ঈমানদারের জন্য পরম প্রাপ্তি ও সৌভাগ্যের মাস। আর যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের ইলম দান করেছেন, হিফযের তাওফীক দিয়েছেন, আমলের তাওফীক দিয়েছেন, তাদের জন্য তো এ মাস শুধুই প্রাপ্তির। হাফেয ছাহেবান এ মাসে দিনে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করেন আর রাতে আল্লাহর বান্দাদেরকে নামাযে শোনান। এটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত এবং অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا حَسَدَ إِلاّ فِي اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ عَلّمَهُ اللهُ الْقُرْآنَ، فَهُوَ يَتْلُوه آنَاءَ اللّيْلِ وَآنَاءَ النّهَارِ فَسَمِعَهٗ جَارٌ لَهٗ. فَقَالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلاَنٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُ. وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَهْوَ يُهْلِكُهٗ فِي الْحَقِّ، فَقَالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلاَنٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُ.
দুই ব্যক্তির বেলায় কেবল ঈর্ষা হতে পারে-
১. আল্লাহ যাকে কুরআন শেখার তাওফীক দিয়েছেন, ফলে সে দিনরাত তিলাওয়াত করে। তার প্রতিবেশী শুনে বলে, হায় যদি আমাকেও তার মতো তাওফীক দেওয়া হত; তাহলে আমিও এমন আমল করতাম!
২. আল্লাহ যাকে সম্পদ দিয়েছেন। ফলে সে তা উত্তম কাজে ব্যয় করে। তখন কেউ বলে, হায় যদি আমাকেও তার মতো দেওয়া হত, তাহলে তার মতো আমল করতাম! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৬
হিফযের সূত্রে হাফেয ছাহেবান ঐ কাফেলায় যুক্ত আছেন, যাদের সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَه.
(তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে তা শেখায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৭)
তবে এই শ্রেষ্ঠত্ব যে কাফেলার, সে কাফেলার সিফাত ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা কর্তব্য। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীসে, সাহাবায়ে কেরামের বাণীতে এবং সালাফের উক্তিতে সে সিফাত ও বৈশিষ্ট্যাবলির কথা বর্ণিত আছে। ‘হামালাতুল কুরআন’ বা ‘আহলুল কুরআন’ কাফেলার সিফাতগুলো অর্জনের মাধ্যমেই কাফেলার মর্যাদার হকদার হওয়ার আশা করা যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ‘হামালাতুল কুরআন’-এর সেই সিফাত ও বৈশিষ্ট্যাবলি অর্জনের তাওফীক দান করেন, আমীন। এই নিবন্ধে শুধু হাফেয ছাহেবানের খেদমতে মাহে রমযান ও তারাবীহ সংক্রান্ত কয়েকটি কথা আরয করাই উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
এক. হিফযের যে নিআমত আল্লাহ তাআলা দান করেছেন, এ নিআমত-প্রাপ্তির অনুভূতি, নিআমতের শোকরগুযারি সর্বদা দিলে জাগরূক রাখা। নিয়মিত তিলাওয়াত, তিলাওয়াতের বিশুদ্ধতার ইহতিমাম, সুন্নত ও নফল নামাযে অধিক পরিমাণে তিলাওয়াত করা এবং ইবাদত, আখলাক, মুআমালা-মুআশারায় তাকওয়া-তাহারাতের বিষয়ে যত্নশীল হওয়া- এগুলো শোকরগুযারির গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ। তাই এসব বিষয়ে যত্নশীল হওয়া এবং নিজের মানসিবের লাজ রক্ষা করা কর্তব্য।
দুই. যেকোনো আমল আল্লাহ তাআলার কাছে পছন্দনীয় হওয়ার জন্য দুইটি বিষয় জরুরি- ক. ইখলাস খ. ইতকান। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلاً أَنْ يُتْقِنَه.
আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন- তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে, সে যেন তা নিখুঁতভাবে করে। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪৩৬৯
কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ইতকানের একটি দিক হল তাজবীদের উসূল রক্ষা করে তিলাওয়াত করা। আজকাল এ বিষয়ে অনেককে যত্নবান দেখা যায়। তবে ইখলাসের ক্ষেত্রে মনে হয় আমাদের আরো মুহাসাবা দরকার। কারণ কুরআন কারীমের তালীম-তাআল্লুমের সাথে যারা যুক্ত, তাদেরকে এ বিষয়ে হাদীস শরীফে আলাদাভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাকে সহীহ-শুদ্ধ-সুন্দর তিলাওয়াতের তাওফীক দিয়েছেন, সুতরাং আমার উচিত কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার ক্ষেত্রে এ নিআমতের ব্যবহার করা। কুরআন তিলাওয়াতে লোক দেখানো মনোভাব, শান-সম্মান, শুহরত ও প্রসিদ্ধি কামনা করা আল্লাহ তাআলার দেওয়া মহা নিআমতকে অপাত্রে ব্যবহারের শামিল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ، وَابْتَغُوا بِهِ اللهَ، مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ قَوْمٌ يُقِيمُونَهٗ إِقَامَةَ الْقِدْحِ، يَتَعَجَّلُونَهٗ، وَلَا يَتَأَجَّلُونَهٗ.
তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো এবং এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করো। এক সময় আসবে, যখন কিছু মানুষ তীর সোজা করার মতো সোজা করে কুরআন পড়বে, দুনিয়ার আকাক্সক্ষাই তাদের মনে থাকবে; আখেরাতের নয়! -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৮৩০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৮৫৫
সহীহ মুসলিমে (হাদীস ১৯০৫) বর্ণিত হাদীসটি তো অনেকেরই জানা; সেখানে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন ব্যক্তির কথা বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের বিচার হবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাদের একজন হল এমন লোক যে মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন ও ইলমে দ্বীন শিখেছিল।
কত কঠিন সতর্কবাণী! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের রিয়া ও লোক দেখানো মনোভাব থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।
তিন. সালাত ও তাহারাতের ক্ষেত্রে সুন্নত-মুস্তাহাব আমলগুলোর পাবন্দী করা। প্রত্যেক নামাযের পূর্বে মেসওয়াকের ইহতিমাম করা। বিশেষভাবে তারাবীর আগে এশার পূর্বে মিসওয়াকের ইহতিমাম করা। এটা কুরআনের তাযীমের অংশ। এবং তিলাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ আদব। রাসূলে কারীম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশের সময়ও মিসওয়াক করতেন। হাদীস শরীফে মিসওয়াককে ‘মুখের পবিত্রতা এবং রবের সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়’ বলা হয়েছে। এছাড়াও মিসওয়াকের মাধ্যমে যবান ‘হালকা’ থাকে, স্পষ্ট আওয়াজে তিলাওয়াত করা সহজ হয়।
চার. তারাবীর ইমামতিতে তাদীলে আরকানের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। কোনো কোনো মুসল্লির রুকু থেকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে, দুই সিজদার মাঝে ইতমিনানের সাথে বসতে সময় লাগে, তাদের বিষয়টি লক্ষ রাখা জরুরি। বলাবাহুল্য, দ্রুত নামায শেষ করার জন্য নামাযের আরকানসমূহ আদায়ে তাড়াহুড়া করা অনেক মুসল্লির জন্যই কষ্টের কারণ। নামাযের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সাথে এক ধরনের ‘ছুয়ে আদব’ও বটে।
পাঁচ. মুসল্লিদের প্রতি লক্ষ রেখে তারাবীর নামাযে কিছুটা দ্রুত তিলাওয়াতের অবকাশ রয়েছে। হাসান বসরী রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি রমযানে (তারাবীর) ইমামতি করবে, তার উচিত মানুষের আরামের খেয়াল রাখা। যে ধীরে পড়ে, সে এক খতম করবে, যার পড়া মধ্যম পর্যায়ের, সে দেড় খতম আর যার পড়া কিছুটা দ্রুত সে দুই খতম করবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৭৭৬১
এক রমযানে উমর রা. (তারাবীর হাফেয) ইমামদের ডেকে বললেন, যার পড়া (কিছুটা) দ্রুত, সে প্রতি রাকাতে (আনুমানিক) ত্রিশ আয়াত পড়বে, যার পড়া মধ্যম পর্যায়ের, সে পঁচিশ আয়াত আর যে ধীরে পড়ে সে বিশ আয়াত পড়বে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৭৭৫৪
মুসল্লিদের অবস্থাভেদে তিলাওয়াতের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে, তেমনিভাবে প্রয়োজনে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা দ্রুত পড়া যেতে পারে। কিন্তু এত দ্রুত পড়া যে, প্রতিটি হরফ যথাযথ আদায় হয় না, কিংবা মদ-গুন্নাহ ন্যূনতম পরিমাণে আদায় হয় না- কিছুতেই কাম্য নয়। আমাদের সালাফ তো সাধারণ তিলাওয়াতের সময়ও এ আদব শিখিয়েছেন- ‘এমন হালতে তিলাওয়াত করো না যে, তুমি এ ফিকিরে থাক- কখন সূরা শেষ হবে।’ তাহলে দ্রুত নামায শেষ করার জন্য তিলাওয়াতের সিহহতের ন্যূনতম মিকদার রক্ষা না করা কতটা নিন্দনীয় তা সহজেই অনুমেয়।
এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে এসে নামাযে নিজের তিলাওয়াতের বিবরণ শোনাল। বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, সে নামাযে খুবই দ্রুত তিলাওয়াত করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আপত্তির স্বরে বললেন-
هَذاًّ كهَذِّ الشِّعْرِ!
‘কবিতা আওড়ানোর মতো (কুরআন) পড়ো!’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮২২; ফাতহুল বারী ২/২৫৮-৫৯
অন্য বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
لاَ تَهُذُّوا الْقُرْآنَ كَهَذِّ الشِّعْرِ، وَلاَ تَنْثُرُوهُ نَثْرَ الدَّقَلِ، وَقِفُوا عِنْدَ عَجَائِبِه، وَحَرِّكُوا بِهِ الْقُلُوبَ.
তোমরা কবিতা পাঠের মতো গড়গড় করে দ্রুত তিলাওয়াত করো না এবং নষ্ট খেজুর যেমন ছুঁড়ে ফেলা হয় তেমন করে পড়ো না; বরং এর হৃদয়গ্রাহী জায়গাগুলোতে থেমে যাও, হৃদয়কে নাড়া দাও। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৮২৫
অন্য বর্ণনায় আছে- ‘এবং তোমরা সূরা শেষ হওয়ার ফিকিরে থেকো না।’ -কিতাবুল আছার, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফের রেওয়ায়েত, বর্ণনা ৪৬৪; আখলাকু আহলিল কুরআন, আজুররি, বর্ণনা ১; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী, বর্ণনা ২০৪২
ছয়. ইয়াদ করার ক্ষেত্রে হাফেয ছাহেবানের প্রত্যেকেরই এক এক তরীকা থাকে। মধ্যম স্তরের ইয়াদ যাদের, তারা ইয়াদ করার ক্ষেত্রে এই নীতি অবলম্বন করতে পারেন- প্রথমে এক পৃষ্ঠা/রুকু মুখস্থ পড়ুন, চেষ্টা করুন পৃষ্ঠাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে নিতে। দেখুন, কোথাও আপনার মুশাব্বাহ লাগছে কি না অথবা সন্দেহ হচ্ছে কি না। পৃষ্ঠাটি পড়া শেষ হওয়ার পর যেখানে আপনার সন্দেহ হয়েছে বা মুশাব্বাহ লেগেছে সে জায়গাটি দেখে নিন। এবার পৃষ্ঠাটি দেখে কয়েকবার পড়ুন। এরপর সামনের পৃষ্ঠাটি পূর্বের নিয়মে পড়ুন। এভাবে পুরো পারা পড়ার পর পারাটি এবার না দেখে পড়ুন। এরপর পারাটি কাউকে শুনিয়ে নিন। তারপর অধিক পরিমাণে দেখে এবং মুখস্থ পড়তে থাকুন। এরপর পুরো পারাটি নফল নামাযে পড়ে নিন।
অনেক হাফেয ছাহেব মুসহাফ দেখে তিলাওয়াত করেন না। সবসময় মুখস্থই তিলাওয়াত করেন, এভাবে দীর্ঘদিন মুসহাফ দেখে তিলাওয়াত না করলে ধীরে ধীরে ইয়াদ দুর্বল হয়ে যায়। তাই মুসহাফ দেখে তিলাওয়াতের ইহতিমাম করা চাই।
ইয়াদ করার সময় অবশ্যই ধীরে পড়ার চেষ্টা করুন। অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, যারা সব সময় দ্রুত তিলাওয়াতে অভ্যস্ত, তারা ধীরে পড়তে গেলে আটকে যায়। ‘দ্রুত পড়লে পড়া সামনে চলতে থাকে, কিন্তু ধীরে পড়তে গেলে আটকে যায়’- এমন হালত যাদের, তাদের ইয়াদ প্রকৃত ইয়াদ নয়।
সাত. ভালোভাবে ইয়াদ করার পরও তিলাওয়াতে ভুল হয়ে যাওয়া বা কিছু অংশ ছুটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমন হলে লোকমা দেওয়া বা গ্রহণ করায় কোনোরূপ সংকোচবোধ থাকা উচিত নয়। তবে আগে বেড়ে লোকমা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকা, বা যথাযথ নিয়ম রক্ষা করে লোকমা দিলে তা গ্রহণ না করা বা গ্রহণ না করার ভান করা- এ সবই ‘ছাহেবে কুরআন’-এর মানসিবের সাথে বেমানান এবং ইবাদতে ইখলাস পরিপন্থী আচরণ। তাই লোকমা বিষয়ক মাসায়েল ভালোভাবে বুঝে নেওয়া চাই। হযরত মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ দামাত বারাকাতুহুম ‘তারাবীতে তিলাওয়াতে কুরআন এবং হাফেয ছাত্রদের করণীয়’ শীর্ষক নিবন্ধে (মাসিক আলকাউসার শাবান-রমযান ১৪৪৪ সংখ্যায় প্রকাশিত) এ বিষয়ে যে হেদায়েত দিয়েছেন সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন-
‘প্রথম থেকেই শ্রোতা হাফেযদের তিলাওয়াতকারী হাফেযের পড়ার প্রতি চৌকান্না ও পূর্ণ মনোযোগী হতে হবে। যে আয়াতে ভুল হবে, হাফেয ছাহেব নিজেই তা সংশোধনের চেষ্টা করবেন। ভুল পড়ার বা কোথাও আটকে যাওয়ার সাথে সাথে পেছন থেকে শ্রোতা হাফেয ছাহেব লোকমা দেবেন না। হাফেয ছাহেব চেষ্টা করেও ভুল সংশোধন করতে না পারলে অথবা আয়াতের যেখানে আটকে গেছেন তা ছুটাতে না পারলে পেছন থেকে শ্রোতা হাফেযগণ লোকমা দেবেন।
এভাবে তিলাওয়াতকারী হাফেয শ্রোতা হাফেযদের সহায়তা নিয়ে হলেও চলতি রাকাতের ভুলটা সে রাকাতেই সংশোধন করে নেবেন।
প্রথম রাকাতের ভুল যদি ঐ রাকাতেই সংশোধন করা না যায়, তাহলে দ্বিতীয় রাকাতের শুরুতেই ভুলটা সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। চলতি দুই রাকাতেও যদি ভুল সংশোধন করা না যায় বা ভুলটা দ্বিতীয় রাকাতে হয় এবং সে রাকাতে সংশোধন করা না যায়, তাহলে পরবর্তী দুই রাকাতের প্রথম রাকাতেই ভুলটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
ভুলটা যদি এমন হয় যে, তাতে অর্থ এমনভাবে বিগড়ে যায় যে, তা নামায ফাসেদ হওয়ার মতো; তাহলে যে রাকাতে ভুল হয়েছে ঐ রাকাতেই সংশোধন করে নিতে হবে; নতুবা নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। এরকম অবস্থায় হাফেয ছাহেব মুসল্লিদের জানিয়ে ভুলের দুই রাকাতে পঠিত কেরাত দিয়ে পুনরায় দুই রাকাত পড়ে নেবেন।’
[অবশ্য এ ক্ষেত্রে একটি ছাড় হতে পারে। তা হল, যে অংশটুকু ভুল পড়া হয়েছে শুধু সে অংশটুকু দোহরানোই যথেষ্ট। পুরো দুই রাকাতে যতটুকু পড়া হয়েছে, সবটুকু না দোহরালেও খতম সম্পন্ন হয়েছে বলে ধর্তব্য হতে পারে, ইনশাআল্লাহ। -বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]
আট. তাসহীহে তিলাওয়াতের বিষয়ে যত্নবান হই। তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ওয়াকফ-ইবতিদার নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি। আল্লামা তাহের জাযাইরী রাহ. التبيان لبعض المباحث المتعلقة بالقرآن কিতাবের শেষে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত এবং উপকারী কিছু তাম্বীহ পেশ করেছেন। মনে রাখা দরকার, সুন্দর তিলাওয়াতের প্রথম শর্তই হল, তিলাওয়াত তাজবীদের উসূল মোতাবেক হওয়া, ওয়াকফ-ইবতিদা সহীহ হওয়া। কারো সুর, লাহজা কখনো মুখ্য নয়। তিলাওয়াতের বিশুদ্ধতার সাথে অনিচ্ছায় কারো তিলাওয়াতের আন্দায চলে আসা দূষণীয় নয়; তবে নামাযে তাকাল্লুফ করে কারো সুর নকল করার কসরত করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাকাল্লুফমুক্ত তিলাওয়াতের অভ্যাস করা চাই।
নয়. অনেকে এমন আছেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা হিফযের তাওফীক দিয়েছেন; কিন্তু কুরআন নাযিলের এ মাসে না তারা তারাবীর কোনো জামাতে ইমামতি করেন আর না নিজে তারাবীতে খতম করেন। এটি কুরআন হিফযের মতো মহা নিআমতের না-শুকরির বহিঃপ্রকাশ। এক ব্যক্তি, (যিনি কুরআনের হাফেয ছিলেন) আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি রমযান মাসে ইমামের পেছনে তারাবীর ইকতেদা করব? উত্তরে তিনি (তিরস্কার করে) বললেন-
تَنْصَبُ كَأَنَّك حِمَارٌ!
(মর্ম :) হিফয থাকা সত্ত্বেও তুমি কেবল দাঁড়িয়ে শুনবে! -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৭৭৯৭
অনেকে আছেন, যারা কুরআন কারীমের কিছু অংশ হিফয করেছেন, তাদেরও উচিত হিফযকৃত অংশ তারাবীর নামাযে কাউকে শোনানো অথবা নিজে পড়ে নেওয়া।
আমাদের সমাজে একটা দুঃখজনক বাস্তবতা হল, যে ভাইয়েরা পূর্ণ কুরআন হিফয করার নিয়তে হিফয শুরু করেছিলেন কিন্তু কোনো কারণে সেটা আর সম্পন্ন হয়নি, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা তাদের মুখস্থকৃত অংশের হিফয ধরে রাখার বিষয়ে কোনো খেয়াল রাখেন না এবং এটাকে কোনো দোষের বিষয় মনে করেন না। অথচ কুরআন ভুলে যাওয়ার বিষয়ে হাদীসে যে সতর্কবাণী এসেছে তার মধ্যে এ প্রকারও অন্তর্ভুক্ত।
দশ. ছাহেবে কুরআনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ইস্তেগনা; আল্লাহমুখিতা এবং মাখলুকের প্রতি নির্মোহতা। কুরআনের মতো মহা নিআমত যার হাসিল হয়েছে, তার জন্য মোটেও সমীচীন নয় যে, কোনো পার্থিব বিষয় তার কামনা থাকবে কিংবা কোনো মাখলুকের অর্থের প্রতি তার আগ্রহ থাকবে, কারো থেকে কিছু পাওয়ার সামান্য আশাও রাখবে! আমাদের সালাফ তো এমন ছিলেন যে, তারা কারো থেকে আশা তো করতেনই না। উপরন্তু কারো পক্ষ থেকে কিছু আসলে দিল কবুল না করলে সেটিও গ্রহণ করতেন না।
আবুল আহওয়াস রাহ. প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। ইলমে কেরাআতের ইমাম হামযা কুফী রাহ.-এর শাগিরদ ছিলেন। এক রমযানে সেসময়ের গভর্নর দশ হাজার দিরহাম দিয়ে তার কাছে এই মর্মে বাহক পাঠিয়েছেন- এখন তো রমযান মাস, এ অর্থ আপনি পরিবারের জন্য গ্রহণ করুন, এর দ্বারা রমযানে আপনার পরিবারকে স্বচ্ছল রাখুন।
আবুল আহওয়াস রাহ. বার্তাবাহককে বললেন, তুমি তাঁকে বল, ‘এগুলো আপনার কাছেই রেখে দিন, প্রয়োজন হলে নেব’। তিনি গ্রহণ করলেন না। অথচ তাঁর জরুরত ছিল, ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ. ঘটনাস্থলে ছিলেন। এ ঘটনার পর তিনি নিজ ঘর থেকে দশ হাজার দেরহাম নিয়ে আবুল আহওয়াস রাহ.-এর নিকট পেশ করে বললেন, আপনি এটি গ্রহণ করুন। আশা করি এটি গ্রহণ করতে আপনার সংকোচ হবে না। আবুল আহওয়াস ইবনুল মুবারক রাহ.-এর হাদিয়া গ্রহণ করলেন। (দ্র. সিফাতুস সফওয়া ৪/ ১৪৬)
এধরনের ঘটনা আমাদের সালাফের যিন্দেগীতে অসংখ্য।
এগারো. রমযানের দিন-রাত তিলাওয়াতের ধারা সারা বছর জারি রাখুন। প্রতি মাসে ২/৩ খতম, কমপক্ষে এক খতম অবশ্যই তিলাওয়াত করুন। সেইসাথে সুন্নত ও নফল নামাযে প্রতি দেড় থেকে দুই মাসে এক খতম করার অভ্যাস করুন। তাহাজ্জুদে কুরআন তিলাওয়াত সালাফের যিন্দেগীর বৈশিষ্ট্য ছিল, বিশেষত যারা কুরআন-উলূমে কুরআনের খেদমতে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। কারো যিন্দেগীতে সেই আদত নসীব হলে তা বড় খোশকিসমতির বিষয়। ইমাম আবু উবায়েদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রাহ. (২২৪ হি.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে-
كان أبو عبيد يقسم الليل أثلاثا، فيصلي ثلثه، وينام ثلثه، ويضع الكتب ثلثه.
আবু উবাইদ রাহ. রাত্রিকে তিনভাগ করতেন- একভাগ নামাযে কাটাতেন, একভাগ বিশ্রামে, আরেকভাগ ইলমী মাশগালায়। -তারীখে বাগদাদ ১৪/৩৯২
ইমাম আওযায়ী রাহ. কত বড় ফকীহ ছিলেন, তার সম্পর্কে আছে-
كان يحيي الليل صلاة وقرآنا وبكاء.
তিনি সারারাত নামায, তিলাওয়াত ও ক্রন্দন করে কাটিয়ে দিতেন। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/১২০
ইমাম আযম আবু হানীফা রাহ.-এর কথা তো সবারই জানা। এভাবে আমাদের নিকট ও দূর অতীতের আকাবির-আসলাফ, যাদের যিন্দেগী ইলমের খেদমত, দরস-তাদরীস ও তাসনীফ-তালীফের জন্য ওয়াকফ ছিল, রাতের একটি অংশ কিয়ামুল লাইলে কাটাতেন। আর কুরআনের নিআমত যারা প্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের উদ্দেশে ঐশী হেদায়েত তো রয়েছেই-
أوْتِرُوا يَا أَهْلَ القُرْآن.
হে কুরআনওয়ালা বান্দাগণ! তোমরা কিয়ামুল লাইলের আমল কর। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪১৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১০৬৭
ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুইয়াহ রাহ. বলেছেন, এ হাদীসে কিয়ামুল লাইলের হুকুম করা হয়েছে। (দ্র. জামে তিরমিযী ১/৫৮০)
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আমীরে ইয়ামানী রাহ. বলেন-
الْمُرَادُ بِأَهْلِ الْقُرْآنِ الْمُؤْمِنُونَ؛ لِأَنَّهُمْ الَّذِينَ صَدَّقُوا الْقُرْآنَ، وَخَاصَّةً مَنْ يَتَوَلَّى حِفْظَه وَيَقُومُ بِتِلَاوَتِه وَمُرَاعَاةِ حُدُودِهِ وَأَحْكَامِه.
অর্থাৎ (প্রাথমিকভাবে) ‘আহলুল কুরআন’ দ্বারা উদ্দেশ্য সকল মুমিন। কারণ কেবল মুমিনরাই কুরআন বিশ্বাস করে। আর বিশেষভাবে ‘আহলুল কুরআন’ বলে এমন ব্যক্তি উদ্দেশ্য যে কুরআন মাজীদ হিফয করে, তিলাওয়াতে যত্নবান থাকে এবং কুরআনে বর্ণিত বিধিবিধানের বিষয়ে সচেতন থাকে। -সুবুলুস সালাম ১/৩৫০
কুরআনের মহব্বত দিলে তাজা রাখি। আমার গুনাহ বা অবহেলার কারণে কিংবা কুরআনের নিআমতের কদর না করার কারণে আমি যেন এ নিআমত হারিয়ে না বসি। রবীআ বিন যুরারা আল উতাকী রাহ. হযরত উসমান রা.-এর কাছে কুরআন কারীম শিখেছেন। বয়সের ভারে শেষ বয়সে যখন নামাযের জন্য দাঁড়াতে পারতেন না। সেজদায় পড়ে এ দুআ করতেন-
اَللهم لَا تَسْلُبْنِيْ الْقُرْآنَ
হে আল্লাহ! কুরআন আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েন না। -কিতাবুয যুহদ, ইমাম আহমদ; আল ইসাবা ২/৫১২
বেশি বেশি এই দুআর ইহতিমাম করি-
اَللّٰهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، وَابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهٗ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهٗ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي.
অর্থ : ইয়া আল্লাহ! আমি গোলাম আপনার, গোলামের সন্তান, আপনার দাসীর সন্তান, আমার চুলের মুঠি আপনার হাতে (আমি সম্পূর্ণ আপনার অধীন)। আমার ওপর আপনার হুকুম সতত কার্যকর। আমার সম্পর্কে আপনার ফয়সালা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।
আমি আপনার কাছে আপনার প্রত্যেক ঐ নামের ওসীলায় প্রার্থনা করছি- যে নাম আপনি নিজের জন্য রেখেছেন, অথবা যে নাম আপনি নিজ কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন, বা আপনার কোনো মাখলুককে শিখিয়েছেন অথবা যে নাম আপনি কাউকে না জানিয়ে গায়েবের ইলম হিসেবে নিজের কাছে রেখেছেন। (আমি এই সকল নামের ওসীলায় প্রার্থনা করছি,) আপনি কুরআন মাজীদকে আমার হৃদয়-মনের বসন্ত, আমার অন্তরের আলো এবং আমার পেরেশানী বিদূরক ও দুঃখ-বেদনার উপশম বানিয়ে দিন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৩১৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৭২