যাকাত : আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ
যাকাত। ইসলামের এক শাশ্বত বিধান। নিছক ইবাদত ছাড়াও এতে রয়েছে আত্মিক ও সামাজিক উৎকর্ষ। যাকাত যেমনিভাবে মুসলিমদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিধান করে, তেমনি ধনী-গরিবের বৈষম্যেরও হ্রাস ঘটায়। যাকাত হল আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। কোনো সমাজের দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাওয়া ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার হাতিয়ার। যাকাত বিধানের যথাযথ প্রয়োগ হলে সমাজে সুবিধা বঞ্চিত ও অসহায়-দুস্থ মানুষ যেমন থাকবে না, তেমনি মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে একতরফা সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠারও সুযোগ থাকবে না। নিম্নে এ বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হল।
যাকাত একটি ইবাদত
যাকাত ইসলামের অন্যতম ফরয ইবাদত। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হল যাকাত। কুরআন মাজীদের অনেক আয়াতে নামাযের পাশাপাশি যাকাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ.
তোমরা সালাত আদায় করো এবং যাকাত প্রদান করো। -সূরা বাকারা (০২) : ১১০
আরো দেখুন : সূরা নূর (২৪) : ৫৬
এছাড়া যাকাত প্রকৃত পুণ্যশীলের পরিচয়, মুমিনের বন্ধু, সৎকর্মপরায়ণদের বৈশিষ্ট্য, মসজিদ আবাদকারী, কুরআন মাজীদে যাদের জন্য রয়েছে শুভসংবাদ, যাদেরকে বলা হয়েছে হেদায়েতপ্রাপ্ত, ভূ-পৃষ্ঠে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভকারী মুমিনের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিসহ দ্বীনের মৌলিক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও সালাত-যাকাতের বিষয়টি অবধারিতভাবেই আসে।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ.
ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি- এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা ও রমযানের রোযা রাখা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ০৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, ‘যাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণ দিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। যাকাতের ফরযিয়তকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।’ -ফাতহুল বারী ৩/৩০৯
যাকাত ঈমান প্রকাশের মাধ্যম
একজন ব্যক্তির মুসলমান হওয়া এবং তার ঈমান প্রকাশের একটি উপায় হল যাকাত। কুরআন মাজীদে সালাত আদায় করা ও যাকাত প্রদানকে মুসলিম হওয়ার আলামত সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
فَاِنْ تَابُوْا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ فَخَلُّوْا سَبِیْلَهُمْ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
এরপর যদি তারা (কাফেররা) তওবা করে, নামায আদায় করতে শুরু করে এবং যাকাত দিতে শুরু করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। বাস্তবিকপক্ষেই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল এবং বড় অনুগ্রহকারী। -সূরা তাওবা (০৯) : ০৫
আরো দেখুন : সূরা তাওবা (০৯) : ১১
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
আমাকে মানুষের সাথে লড়াই করার আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর যতক্ষণ না তারা নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। তারা যদি এটা করে, তাহলে নিজেদের প্রাণ ও সম্পদকে হেফাযত করল। যদি না ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা রহিত হয়। আর তাদের (অন্তরের অবস্থার) হিসাব আল্লাহর উপর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২
যাকাত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে
যাকাতের মাধ্যমে মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। কৃপণতা, স্বার্থপরতা, আমিত্ব ইত্যাদি আত্মিক ব্যাধি থেকে যাকাত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আর ফকীর-মিসকীনদের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন থেকেও মনকে পবিত্র করে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ.
আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পাক-পবিত্র করবেন। -সূরা তাওবা (৯) : ১০৩
আয়াতের তাফসীরে শায়েখ আবদুর রহমান সা‘দী রাহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তিকে মুমিনদের পুতঃপবিত্রকারী ও তাদের ঈমানের পূর্ণতাদানকারী বিষয় সম্পর্কে আদেশ করতঃ ইরশাদ করেছেন- خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً এটি হল ফরয যাকাত। আর-تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا-এর অর্থ আপনি তাদেরকে গুনাহ ও মন্দ স্বভাবসমূহ থেকে পবিত্র করবেন। وَ تُزَكِّیْهِمْ -এর অর্থ তাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন। তাদের উত্তম আখলাক ও সৎ কর্মসমূহ বৃদ্ধি করবেন এবং তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের প্রতিদান সমৃদ্ধ করবেন। আর তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করবেন। -তাফসীরে সা‘দী (তাইসীরুল কারীমির রহমান), পৃষ্ঠা : ৩২৮
আনাস ইবনে মালিক রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, তামীম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনেক সম্পদশালী। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি এবং আমার ধন-সম্পদ ও ঘর-বাড়ির পরিমাণও বেশি। আমি কী করব এবং কীভাবে খরচ করবÑ এ বিষয়ে পরামর্শ দিন।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
তোমার সম্পদের যাকাত আদায় করো। কেননা যাকাত হল পবিত্রকারী। এটি তোমাকে পবিত্র করবে, তোমার আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখবে এবং মিসকীন, প্রতিবেশী ও সুওয়ালকারীর হক সম্পর্কে অবগত করবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৩৯৪; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৮৮০২
যাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে
সম্পদের যথাযথ যাকাত আদায় করলে একদিকে যেমন মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি হয়, তেমনি অনাথ-অসহায়ের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পদে পবিত্রতা ও খায়ের-বরকত আসে। আর আল্লাহ তাআলা এর সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করতে থাকবেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَاۤ اٰتَیْتُمْ مِّنْ رِّبًا لِّیَرْبُوَاۡ فِیْۤ اَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا یَرْبُوْا عِنْدَ اللهِ وَ مَاۤ اٰتَیْتُمْ مِّنْ زَكٰوةٍ تُرِیْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ.
আর যা তোমরা এই উদ্দেশ্যে দেবে যে, তা মানুষের সম্পদে পৌঁছে বর্ধিত হয়ে আসবে, তা আল্লাহর কাছে বর্ধিত হয় না। আর যা যাকাত দেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়- তো এমন মানুষই আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি করতে থাকবে। -সূরা রূম (৩০) ৩৯
আরো দেখুন : সূরা বাকারা (২) : ৭৬
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্থ : সদকা দ্বারা সম্পদের হ্রাস ঘটে না। বান্দার ক্ষমার কারণে আল্লাহ তার সম্মানই বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বনকারীকে আল্লাহ মর্যাদাবান করে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮
যাকাত সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা
ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে সম্পদের যাকাত প্রদানের আদেশ দিয়েছে, তেমনি ইসলামী শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রকে যাকাত উসূল করা এবং এর সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনেরও বিধান দিয়েছে। যার দরুন যাকাত আর্থ সামাজিক কল্যাণ ও মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি কল্যাণকর ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে, যা একটি সমাজের স্বনির্ভরতা অর্জন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক প্রয়োজনাদি পূরণ ও সমাজের সকল মানুষের সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টির এক কার্যকরী ব্যবস্থা।
মুআয রা.-কে ইয়ামেনে গভর্ণর হিসেবে প্রেরণের সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাতে ইরশাদ করেছেন-
‘আল্লাহ তাদের উপর যাকাত অপরিহার্যরূপে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা তাদের সম্পদশালীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭
তবে ব্যক্তির গচ্ছিত সম্পদ, স্বর্ণ-রূপার অলংকার ইত্যাদি, যা মানুষ একান্তই নিজের কাছে রাখে, এগুলোর যাকাতের হিসাব রাষ্ট্র খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করবে না; বরং এগুলোর যাকাত আদায়ের দায়িত্ব শরীয়ত ব্যক্তির যিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে। মুমিন বান্দা ও বান্দীগণ তাদের ঈমানের দাবি থেকে যথাযথ হিসাব করে এসব সম্পদের যাকাত নিজ দায়িত্বে আদায় করবে।
যাকাত দরিদ্র শ্রেণির প্রতি করুণা নয়; বরং তাদের অধিকার
আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম তা পরীক্ষা করেন। কখনো সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কখনো সম্পদ হরণ করে। আর মানুষের মধ্যে সম্পদের তারতম্য থাকা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। আল্লাহ চাইলে সবাইকে ধনী বা গরিব বানাতে পারতেন। কিন্তু তখন আর ভারসাম্য রক্ষা হত না। ধনী-গরিবের পরীক্ষা হত না। তিনি একদিকে যেমন ধনীকে সম্পদ দিয়েছেন তেমনি তার সম্পদে গরিবের হকও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘আর তাদের সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে প্রার্থনাকারীর জন্য এবং বঞ্চিতদের জন্য।’ -সূরা মাআরিজ (৭০) : ২৪-২৫
অন্য আয়াতে ধনীকে গরিবের সম্পদের প্রতিনিধি আখ্যা দিয়ে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘আর তোমরা ওই সম্পদ থেকে দান করো, যাতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি বানানো হয়েছে।’ -সূরা হাদীদ (৫৭) : ৭
তাই মুমিন ধনী ব্যক্তির বিশ্বাস হল, সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে সম্পদশালী করেছেন আবার গরিবের নিকট তার হক পৌঁছে দেওয়ারও প্রতিনিধি বানিয়েছেন। সে আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য, তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির আশায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পদের যথাযথ যাকাত আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে সে যাকাত প্রদান করাকে গরিবের প্রতি অনুগ্রহ বা করুণা মনে করে না। সে বরং এই ভেবে আল্লাহর শোকর আদায় করে যে, আল্লাহর আদেশ মোতাবেক নির্ধারিত হকদারকে তার হক পৌঁছে দিতে পেরেছে।
যাকাত আদায়ের ফযীলত
যাকাত আদায়ের সবচেয়ে বড় ফযীলত তো এই, আল্লাহ তাআলা যাকাত আদায়কারীর জন্য অভয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً فَلَهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ.
যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের নিকট। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা ভারাক্রান্তও হবে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৪
আর যেকোনো দান-সদকার ব্যাপারে তো আল্লাহ তাআলার ঘোষণা হল, (তরজমা) ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত হল একটি শস্যবীজের মতো, যাতে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়। আর প্রত্যেক শীষে থাকে এক শত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ -সূরা বাকারা (২) : ২৬১
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁরই পথে দানকারীর সওয়াব বৃদ্ধি করার একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আর সৎকর্ম তো সাধারণত ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪৭২
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহতা
আগেই বলা হয়েছে, যাকাত একটি ফরয বিধান। তাই যাকাত আদায় না করা আল্লাহর বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘণ। এছাড়া কুরআন মাজীদে যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ শাস্তির কথাও স্পষ্ট উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ لِلهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ.
আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা
কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমিনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮০
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্থ : যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভূত সম্পদ। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪০৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪৮২
আরো দেখুন : -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৮৭-৯৮৮
যাকাত আদায় না করার একটি অনিবার্য পরিণতি হল, সমাজে বিপর্যয় নেমে আসবে এবং এ বিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য তীব্রতর হবে। ধনিক শ্রেণি শুধু সম্পদের প্রাচুর্য গড়ে তুলবে। গরিব শ্রেণি শুধু লাঞ্ছনা ও বঞ্চনারই শিকার হতে থাকবে।
প্রসঙ্গত, দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন দেখা যেতে পারে। গত ২৬ জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল-
‘১০% ধনীর হাতে ৪১% আয়’
দেশের মোট আয়ে ধনীদের অংশ বাড়ছে। ফলে আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। উচ্চ বৈষম্যের দেশের দ্বারপ্রান্তে দেশ।
বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়েছে-
দেশে আয়বৈষম্য আরো বেড়েছে। ধনীদের আয় আরো বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, গত ৫০ বছরে ধনীদের আয় অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ধনী ও গরিবের আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে এই চিত্র উঠে এসেছে। -দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০২৩
অথচ ইসলামের যাকাত বিধান ও অন্যান্য দান-সদকার দ্বারা সমাজের ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হয় এবং সমাজে সকলের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান হয়। তাছাড়া ইসলামী অর্থনীতির এক মূলনীতি হল, কেবল বিত্তবানদের মাঝেই সম্পদ আবর্তিত না হওয়া। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
كَیْ لَا یَكُوْنَ دُوْلَةًۢ بَیْنَ الْاَغْنِیَآءِ مِنْكُمْ .
যেন তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মাঝেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে। -সূরা হাশর (৫৯) : ৭
উপরন্তু যাকাত আদায় না করলে সমাজে অনাবৃষ্টির মতো আযাব-গযব নেমে আসার কথাও হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, মুহাজিরগণকে সম্বোধন করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
হে মুহাজির সম্প্রদায়! তোমরা ৫টি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পার এবং তোমাদের উপর তা আপতিত হতে পারে। আমি আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন তোমাদের উপর তা আপতিত না হয়। কোনো জাতি প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হলে তাদের মাঝে প্লেগ মহামারি আকার ধারণ করে এবং এমন সব ব্যাধি দেখা দেয়, যা তাদের পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় খাদ্য-পানীয়র তীব্র সংকট, নেমে আসে দুর্ভিক্ষ ও ঘোর বিপদ-আপদ এবং জালেম শাসকের জুলুম-নির্যাতন। আর কোনো জাতি যাকাত আদায় না করলে তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে জন্তু-জানোয়ার না থাকত তবে আর কখনো বৃষ্টিপাত হত না।...। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৮৮৪৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪০১৯
যাকাত সম্পর্কিত কিছু জরুরি মাসআলা
যাদের উপর যাকাত ফরয হয়
মাসআলা : ১. প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থমস্তিষ্ক মুসলমান নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরয হয়। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/৭৮, ৮২
মাসআলা : ২. অসুস্থ মস্তিষ্ক ও নাবালেগ শিশু-কিশোরের উপর যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০২২২; রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮-২৫৯
নেসাবের বিবরণ
নেসাব হল যাকাতযোগ্য সম্পদের শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ। সম্পদের ধরনভেদে নেসাবের পরিমাণও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন, স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নেসাব হল ২০ মিসকাল। বর্তমান সময়ের হিসাবে সাড়ে সাত ভরি বা ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ। -সুনানে আবু দাউদ ১/২২১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৭৭, ৭০৮২
আর রুপার নেসাব হল ২০০ দিরহাম। বর্তমান সময়ের হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা ৬১২.৩৬ গ্রাম রুপা। এ পরিমাণ সোনা-রুপা থাকলে যাকাত ফরয হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৭৯
মাসআলা : ৩. নিত্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা বা ব্যবসাপণ্যের মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়, তাহলে এর যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬৭৯৭, ৬৮৫১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৯৩৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৭৯
মাসআলা : ৪. যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা বা ব্যবসাপণ্য কোনোটি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এগুলোর একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণে আছে যে, তার একত্রমূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের বা তার বেশি, তাহলে এক্ষেত্রে সকল সম্পদের মূল্য হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৯৩; কিতাবুল আছল ২/৯২
মাসআলা : ৫. নেসাবের অতিরিক্ত সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসাপণ্যের যাকাত শরীয়ত নির্ধারিত হারে দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৩২, ৭০৭৪-৭০৭৫, ৭০৭৯-৭০৮০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৯০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৯৯
যাকাতবর্ষ বলতে কী বোঝায়
যাকাতবর্ষ হচ্ছে একজন মুসলিম যে সময়ের হিসাব করে যাকাত আদায় করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জহির নামক ব্যক্তির হাতে মুহাররম মাসের এক তারিখে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের সম্পদ এল এবং বছরাধিককাল পর্যন্ত এটি বা এর চেয়ে বেশি সম্পদ তার হাতে থাকল, তাহলে এ ব্যক্তির যাকাতবর্ষ হবে পহেলা মুহাররম থেকে ৩০ যিলহজ্ব (কোনো বছর ২৯ যিলহজ্ব)। যিলহজ্ব মাস শেষে তিনি তার যাকাতযোগ্য সমুদয় সম্পদের হিসাব করবেন এবং সে অনুযায়ী যাকাত আদায় করবেন। এটি তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অনেককেই দেখা যায়, নেসাবের মালিক হওয়ার দিন থেকে ঠিকমতো যাকাতের হিসাব রাখেননি। ফলে তার যাকাতবর্ষ কবে শুরু হয়েছে- তা জানা থাকে না। এধরনের ব্যক্তি বছরের সুবিধামতো একটি দিনকে যাকাতবর্ষের শুরু হিসেবে নির্ধারণ করে নেবে এবং ঠিক এক বছর পর যাকাতবর্ষের শেষ গণ্য করবে। যেমনটি কোনো কোম্পানি তার সুবিধামতো একাউন্টিং ইয়ার বা হিসাববর্ষ গণনা করে থাকে। ভবিষ্যতে এ দিনটিই তার যাকাতবর্ষ হিসেবে নির্ধারিত হবে। কেউ কেউ আবার পহেলা রমযানকেও যাকাতবর্ষের প্রথম দিন হিসেবে নির্ধারণ করে থাকে। তবে এমনটি করার পরও যদি যাকাতদাতার মনে হয় যে, পেছনের কোনো বছরের যাকাত বাকি রয়ে গিয়েছে, তাহলে তিনি যথাযথ হিসাব করে তা আদায় করে দেবেন। প্রয়োজনে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের সহযোগিতা নেবেন।
মাসআলা : ৬. বছরের শুরু ও শেষে কারো নিকট পূর্ণ নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার যাকাত আদায় করতে হবে। বছরের মাঝে নেসাব কমে গেলে তা ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে কারো সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তখন থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৪২, ৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০২
মাসআলা : ৭. কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা বা ব্যবসাপণ্য পৃথকভাবে অথবা সম্মিলিতভাবে নেসাব পরিমাণ ছিল। বছরের মাঝে কিংবা শেষ দিকে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ পাওয়া গেল, এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরোনো সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার পর তার যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে প্রাপ্ত সম্পদের পৃথকভাবে বছর পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬৮৭২, ৭০৪০, ৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৩২৫, ১০৩২৭; কিতাবুল আছল ২/৮৯
মাসআলা : ৮. যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায়ে বিলম্ব করা উচিত নয়। তাই করণীয় হল, নেসাবের মালিক হওয়ার দিনটি মনে রাখা এবং তার ঠিক এক বছর পরই সম্পদের যাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানা
থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।
যেসব সম্পদের যাকাত দিতে হয়
সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর যাকাত দেওয়া ফরয নয়। শুধু সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা, গবাদি পশু (ক্ষেত্রবিশেষে) ও ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরয হয়।
ব্যাংকে রক্ষিত টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট, বিভিন্ন বন্ড, সঞ্চয়পত্র, ব্যবসার উদ্দেশ্যে খরিদকৃত কোনো কোম্পানির শেয়ার, কাউকে দেওয়া নগদ ঋণ, বিক্রিত পণ্য বাবদ পাওনা অর্থ সবই যাকাতযোগ্য সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।
মাসআলা : ৯. সোনা-রুপার অলংকার সর্বদা বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না হোক, নেসাব পরিমাণ হলে সর্বাবস্থায় তার যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৫৪-৭০৬১, ৭০৬৩-৭০৬৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৯৭৪, ৬/৪৬৯-৪৭১; কিতাবুল আছল ২/৯২
মাসআলা : ১০. অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীরও যাকাত ফরয হয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৬১, ৭০৬৬, ৭১০২; কিতাবুল আছল ২/৯২
মাসআলা : ১১. সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলঙ্কার ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তদ্রূপ হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথরেরও যাকাত ফরয নয়। তবে এগুলো ব্যবসার উদ্দেশ্যে হলে তা যাকাতের আওতায় আসবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৪৪৭-৪৪৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৮০
মাসআলা : ১২. মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা নেসাব পরিমাণ হলে তার যাকাত আদায় করা ফরয হয়।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৯১, ৭০৯২
মাসআলা : ১৩. টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও যাকাত ফরয হয়। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৭; রদ্দুল মুহতার ২/২৬২, ৩০০
মাসআলা : ১৪. হজ্বের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তারও যাকাত দিতে হয়।
সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পদের সাথে মিলে নেসাব পরিমাণ হলে এরও যাকাত দিতে হবে। তবে যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগেই যদি তা খরচ হয়ে যায়, তাহলে যাকাত দিতে হবে না।
মাসআলা : ১৫. বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যা কিছু রাখা থাকে তা ব্যবসাপণ্য। তাই এর মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরয। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১০৩, ৭১০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫৫৭, ১০৫৬০, ১০৫৬৩
মাসআলা : ১৬. ব্যবসার উদ্দেশ্যে কোনো কিছু ক্রয় করা হলে চাই তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট ইত্যাদি কিংবা অস্থাবর, যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলঙ্কার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি ইত্যাদি ব্যবসাপণ্য বলে গণ্য হবে এবং এর মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরয হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০১৬৮-১০১৬৯; কিতাবুল আছল ২/৯৮
যেসব সম্পদের যাকাত ফরয নয়
মাসআলা : ১৭. নিজের ও পোষ্য পরিজনের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
মাসআলা : ১৮. ঘর-বাড়ির প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী, যেমন হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি ইত্যাদি যত উচ্চমূল্যেরই হোক এসবের যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৯৩, ৭১০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫৬০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫
মাসআলা : ১৯. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি
থাকলেও তার যাকাত ফরয নয়। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬৫
মাসআলা : ২০. ব্যবসাপণ্য ছাড়া দোকানপাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র, ডেকোরেশন ইত্যাদির যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার থাকে, তা যেহেতু ব্যবসাপণ্য তাই এসবের যাকাত ফরয হবে।
মাসআলা : ২১. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসবের ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থ অন্যান্য সম্পদের সাথে মিলে নেসাব পরিমাণ হলে তার যাকাত ফরয হবে।
মাসআলা : ২২. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী, যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার যাকাত ফরয নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থ যাকাতযোগ্য হবে। -কিতাবুল আছল ২/৯৭
যাকাত আদায়ের নিয়ত করা
মাসআলা : ২৩. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য নিয়ত করা জরুরি। অর্থাৎ যাকাতের উপযুক্ত ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধির হাতে অর্থ প্রদানের সময় যাকাতের নিয়ত করা। -রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮
মাসআলা : ২৪. একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জন, লোকজনের প্রশংসা কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৪
মাসআলা : ২৫. নিজের অন্যান্য সম্পদ থেকে যাকাতের অর্থ পৃথক করার সময় নিয়ত করা যথেষ্ট। এক্ষেত্রে গরিবদেরকে দেওয়ার সময় প্রতিবার যাকাতের নিয়ত করার প্রয়োজন নেই। -শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/২৬৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/১৯৭; ফাতাওয়া সিরাজিয়্যা, পৃ. ২৬
মাসআলা : ২৬. যাকাতের উদ্দেশ্যে অর্থ পৃথক করে রাখা হলেও নিজের প্রয়োজনে তা খরচ করা যায়। তবে ওই পরিমাণ অর্থ পৃথকভাবে আদায় করতে হবে।
মাসআলা : ২৭. যাকাতের অর্থ পৃথক করে রাখার পর উপযুক্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার আগেই যদি হারিয়ে যায়, কিংবা কোনোক্রমে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। নতুন করে যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬৯৩৬, ৬৯৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৫৩১-৫৩২; রদ্দুল মুহতার ২/২৭০
কী পরিমাণ অর্থ যাকাত দিতে হয়
নগদ অর্থ-কড়ি, সোনা-রুপা ও ব্যবসাপণ্য নেসাব পরিমাণ থাকলে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫%) যাকাত দেওয়া ফরয। তাই যাকাতযোগ্য সম্পদের মূল্য হিসাব করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা এর সমমূল্যের খাদ্যদ্রব্য, কাপড়-চোপড়
অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৭২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১৩৩-৭১৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫৩৯, ১০৫৮১
মাসআলা : ২৮. যাকাতযোগ্য সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ হিসাব করে যে পরিমাণ অর্থ যাকাত ফরয হয়, তার চেয়ে বেশি আদায় করারও সুযোগ আছে। এতে যাকাত আদায় ও বাড়তি দান দুটোরই সওয়াব পাওয়া যাবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬৯০৭
মাসআলা : ২৯. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত গ্রহণকারীকে যাকাত সম্পর্কে জানানো জরুরি নয়; বরং যাকাতের নিয়তে যেকোনো উপায়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ পৌঁছে দিলেই যাকাত আদায় হয়ে যায়। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮
মাসআলা : ৩০. অন্যের পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে চাইলে তার অনুমতি নেওয়া জরুরি। অন্যথায় ওই ব্যক্তির যাকাত আদায় হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬৯
মাসআলা : ৩১. যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিনে ব্যক্তির নিকট মজুদ যাকাতযোগ্য সমুদয় সম্পদ হিসাব করে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়। যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার পরে কারো সম্পদ কমে গেলে কিংবা খরচ হয়ে গেলেও যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিন বিদ্যমান সম্পদের হিসাবই ধর্তব্য হবে। যাকাত আদায়ের দিন সম্পদ কমে গেলে তা ধর্তব্য হবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫৫৯; আলবাহরুর রায়েক ২/২২১
মাসআলা : ৩২. যাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য হবে, সৌরবর্ষের নয়। -আলবাহরুর রায়েক ২/২০৩
যাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়
যাকাত আদায়ের খাতগুলো শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। নির্ধারিত খাতের বাইরে কাউকে যাকাত দিলে তা আদায় হয় না। যাকাতের খাত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْهَا وَ الْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الْغٰرِمِیْنَ وَ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ فَرِیْضَةً مِّنَ اللهِ وَ اللهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ.
যাকাত তো কেবল ফকীর-মিসকীন, যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। -সূরা তাওবা (৯) : ৬০
মাসআলা : ৩৩. দরিদ্র ব্যক্তি, যার কাছে সামান্য সম্পদ আছে, অথবা কিছুই নেই। এমনকি এক দিনের খোরাকিও নেই। এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরিব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
মাসআলা : ৩৪. যার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নেসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য মাল-সামানাও নেসাব পরিমাণ নেই তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
মাসআলা : ৩৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যার ঋণ পরিশোধের পর নেসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না, তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। -আলমুহীতুল বুরহানী ৩/২১০
মাসআলা : ৩৬. যাকাতের টাকা দ্বীনদার দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয়, তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। তবে কারো ব্যাপারে যদি প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া হলে সে তা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে, তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।
মাসআলা : ৩৭. নিজের আত্মীয়-স্বজন যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে তাদেরকে যাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়দেরকে যাকাত দেওয়া যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১৬০-৭১৬১, ৭১৬৪, ৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৫৪২-৫৪৬; কিতাবুল আছল ২/১২৪
মাসআলা : ৩৮. যাকাতের উপযুক্ত মনে করে কাউকে যাকাত দেওয়ার পর যদি তার নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া প্রকাশ পায়, তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে গ্রহিতা যদি জানতে পারে যে, এটা যাকাতের টাকা ছিল, তাহলে তার জন্য তা ফেরত দেওয়া ওয়াজিব।
মাসআলা : ৩৯. অপ্রাপ্তবয়স্ক বুঝমান ছেলে বা মেয়েকে (যদি তাদের পিতামাতা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়) যাকাত দেওয়া যায়। -রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২০১
যাদেরকে যাকাত দেওয়া যায় না
মাসআলা : ৪০. যাকাত শুধু মুসলমানদের হক। কোনো অমুসলিম যাকাতের উপযুক্ত নয়। তাই কোনো অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ দেওয়া হলে তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে না। পুনরায় তা আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১৬৬, ৭১৬৭, ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৫১৬-৫১৭; কিতাবুল আছল ২/১২৪
মাসআলা : ৪১. যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, যাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল, তাহলে যাকাত আদায় হবে না; পুনরায় যাকাত দিতে হবে।
মাসআলা : ৪২. নিজের পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ, যারা তার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি এবং তাদের অধস্তনকে নিজ সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। -রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮
মাসআলা : ৪৩. কাজের ছেলে বা মেয়ে যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে তাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয। তবে তাদের কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলা : ৪৪. যার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, ব্যবসাপণ্য ইত্যাদি নেসাব পরিমাণ আছে, সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
মাসআলা : ৪৫. যাকাতের অর্থ তার হকদারকে মালিক বানিয়ে দেওয়া জরুরি। মালিক না বানিয়ে কোনো বস্তু-সামগ্রী কিনে তাকে শুধু ব্যবহার কিংবা ভোগ করার অধিকার দিলে যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলা : ৪৬. রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, পুল-সেতু নির্মাণ কিংবা বিদ্যুৎ-পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১৭০; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/২১২
মাসআলা : ৪৭. যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুআজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনী বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৪৭, ৬৯৪৮, ৭১৩৭, ৭১৭০
ঋণ ও পাওনা প্রসঙ্গ
ঋণ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে : এক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়। দুই. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়। প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দেওয়ার পর যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকে, তাহলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়। আর দ্বিতীয় প্রকারটি এর ব্যতিক্রম। তাই নির্ভরযোগ্য আলেমের কাছ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া কর্তব্য।
মাসআলা : ৪৮. ঋণ বাদ দেওয়ার পর কারো কাছে যদি নেসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৫৪৭-৫৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩
মাসআলা : ৪৯. বিয়ে-শাদিতে মোহরানার যে অংশ বাকি থাকে, তা স্বামীর কাছে স্ত্রীর পাওনা। তবে যাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাবের সময় এই ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬১
অবশ্য স্বামী যদি চলতি যাকাতবর্ষের মধ্যেই মোহরানা আদায় করে দেওয়ার ইচ্ছা করেন, তাহলে ওই পরিমাণ টাকা যাকাতের হিসাব থেকে বাদ যাবে।
মাসআলা : ৫০. কর্জ হিসেবে কাউকে কোনো অর্থ দেওয়া হলে কিংবা বাকিতে পণ্য বিক্রি করলে এই পাওনা পৃথকভাবে বা যাকাতযোগ্য অন্য সম্পদের সাথে মিলে নেসাব পূর্ণ হলে তারও যাকাত ফরয হয়। তবে পাওনা উসূল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করতে হয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১১১-৭১১৩, ৭১২১, ৭১২৩, ৭১২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৪৮৪-৪৮৬
মাসআলা : ৫১. পাওনা উসূল হওয়ার আগে তার যাকাত আদায় করা জরুরি নয়। তবে কেউ দিয়ে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৩৪৭, ১০৩৫৬
মাসআলা : ৫২. পাওনা উসূল হতে কয়েক বছর লেগে গেলে বিগত বছরগুলির যাকাত আদায় করা ফরয। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭১১৬, ৭১২৯, ৭১৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৩৪৬, ১০৩৫৬; কিতাবুল আছল ২/৯০
মাসআলা : ৫৩. স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নেসাব পরিমাণ হলেও তা হস্তগত হওয়ার আগে স্ত্রীর উপর তার যাকাত আদায় করা ফরয নয়। মোহরানা হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ওই মহিলার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে, তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।
মাসআলা : ৫৪. বকেয়া মোহরানা হস্তগত হওয়ার আগে থেকেই যদি স্ত্রী নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকে, তাহলে এই সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানা তার অন্যান্য সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
পরিশেষে, যাকাতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, এর উপকারিতা ও সুফল পৃথিবীর যেকোনো দেশ, জাতি ও যুগের জন্যই সমান কার্যকর। মুসলিম ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তিগণ যদি নিজেদের ধন-সম্পদের যাকাত যথাযথ আদায় করেন, তবে আমাদের সমাজেও পরিবর্তন আসবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমবে এবং মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপিত হবে। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীনী সচেতনতা বৃদ্ধি করে দিন। পুঙ্খানুপুঙ্খ যাকাত আদায় করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের সমাজেও যাকাতের সুফল ও কল্যাণ দান করুন- আমীন।