তাহাজ্জুদের প্রতি সালাফ-আকাবিরের যওক ও শওক
রমযানকে কাজে লাগাই, তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হই
রমযানুল মুবারক। বারো মাসের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মাস। জীবনকে আলোকিত করার মৌসুম। আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজতম সুযোগ। খায়ের ও বরকত, রহমত ও মাগফিরাতের বসন্ত।
সাধারণ আমলের পাশাপাশি এ মাসের বেশকিছু বিশেষ আমল রয়েছে। অন্য সময়ের সাধারণ আমলগুলোরও এ মাসে গুরুত্ব বেড়ে যায়। তাহাজ্জুদ এধরনেরই একটি আমল। এখানে আমরা তাহাজ্জুদের প্রতি সালাফ ও আকাবিরের যওক-শওক ও আগ্রহ-উদ্দীপনা সম্পর্কে আলোচনা করব। মূল আলোচনার আগে তাহাজ্জুদের ফযীলত ও এর প্রতি নবীজীর যওক-শওক সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যায়।
তাহাজ্জুদের ফযীলত
তাহাজ্জুদ মহিমান্বিত একটি ইবাদত। কুরআন ও হাদীসে এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং এর প্রতি খুব উৎসাহিত করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوْن، اٰخِذِیْنَ مَاۤ اٰتٰىهُمْ رَبُّهُمْ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذٰلِكَ مُحْسِنِیْنَ، كَانُوْا قَلِیْلًا مِّنَ الَّیْلِ مَا یَهْجَعُوْنَ، وَبِالْاَسْحَارِ هُمْ یَسْتَغْفِرُوْنَ.
নিশ্চয় মুত্তাকীগণ উদ্যানরাজি ও ঝরনাসমূহের ভেতর থাকবে। তাদের রব তাদেরকে যা দেবেন, তারা তা উপভোগ করতে থাকবে। তারা এর আগেই সৎকর্মশীল ছিল। তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনা করত। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৫-১৮
এখানে মুত্তাকীদের জান্নাতে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তারা দুনিয়াতে সৎকর্মশীল ছিল। তারপর তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য এই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা রাতে খুব অল্প সময় ঘুমাত। রাতের বেশির ভাগ সময় তারা আল্লাহর ইবাদতে কাটাত। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, সাহরীর সময়, যখন রাত শেষ হয়ে আসত, তখন তারা নিজেদের ভুলত্রুটির জন্য কাকুতি-মিনতির সঙ্গে ইস্তিগফার করত।
এ থেকে বোঝা যায়, রাতের ইবাদত আল্লাহর কাছে খুব পছন্দনীয় এবং শেষ রজনী অনেক বরকতপূর্ণ।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًا، نِّصْفَهٗۤ اَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِیْلًا، اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا، اِنَّا سَنُلْقِیْ عَلَیْكَ قَوْلًا ثَقِیْلًا، اِنَّ نَاشِئَةَ الَّیْلِ هِیَ اَشَدُّ وَطْاً وَّاَقْوَمُ قِیْلًا.
হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রি জাগরণ করুন, তবে কিছু সময় ছাড়া। অর্ধেক রাত বা তা থেকে কিছুটা কমান কিংবা তা থেকে বাড়িয়ে নিন এবং ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত করুন। আমি আপনার প্রতি এক গুরুভার বাণী অবতীর্ণ করছি। নিশ্চয় রাত্রি জাগরণ (প্রবৃত্তির) দলনে অধিকতর কঠোর এবং বাক্য উচ্চারণে অধিকতর সঠিক। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ১-৬
এখানে নবীজীকে অর্ধেক রাত বা তার থেকে কিছু কমবেশি সময় তাহাজ্জুদ পড়ার আদেশ করা হয়েছে এবং তাতে ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এর কিছু উপকারিতাও উল্লেখ করা হয়েছে-
১. রাতে উঠে ইবাদত করা সহজ কাজ নয়। নফস এতে সায় দেবে না। যদি নফসের বিরোধিতা করে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করে নেওয়া যায়, তাহলে নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে যাবে।
২. রাতের বেলা পরিবেশ শান্ত থাকে এবং চারদিকে অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করে। এজন্য তখন তিলাওয়াত ও দুআ-যিকির অত্যন্ত সুন্দর ও সঠিকভাবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে করা যাবে। দিনের বেলা এ সুবিধা কম থাকে।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
تَتَجَافٰی جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ یَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا وَّمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ، فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّاۤ اُخْفِیَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ اَعْیُنٍ جَزَآءًۢ بِمَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.
তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা তাদের রবকে ভয় ও আশার সঙ্গে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি জানে না- এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কী লুকিয়ে রাখা হয়েছে। -সূরা সাজদা (৩২) : ১৬-১৭
এখানে ওই মুমিনদের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা রাতের বেলা মধুর নিদ্রা ও সুখশয্যা ত্যাগ করে আল্লাহর আযাবের ভয় ও রহমতের আশা নিয়ে তাঁকে ডাকে, নামায পড়ে।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
وَ الَّذِیْنَ یَبِیْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا.
এবং যারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রবের সামনে (কখনো) সেজদাবনত অবস্থায় এবং (কখনো) দণ্ডায়মান অবস্থায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৪
এখানে আল্লাহ ‘ইবাদুর রহমানের’ (তাঁর ওই বান্দাদের) প্রশংসা করেছেন, যারা রাতের বেলায় নিদ্রা ও আরামের স্বাদ বিসর্জন দিয়ে তাঁর সামনে দণ্ডায়মান থাকে, সিজদাবনত হয়, নামাযে মগ্ন থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلّ لَيْلَةٍ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللّيْلِ الآخِرُ، يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.
আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ, আমার কাছে দুআ করবে, আমি তার দুআ কবুল করব। কে আছ, আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব। কে আছ, আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮
লক্ষ করুন, শেষ রজনী কত বরকতপূর্ণ যে, এ সময় খোদ আল্লাহ বান্দাকে ডাকতে থাকেন। কীভাবে ডাকেন তাও আমরা জানলাম। মহান আল্লাহর এমন আহ্বানের পরও বান্দার জন্য ঘুমে বিভোর থাকা বড় আফসোসের বিষয়।
অন্য হাদীসে নবীজী পরিষ্কার বলেন-
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الرّبّ مِنَ العَبْدِ فِي جَوْفِ اللّيْلِ الآخِرِ، فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ مِمّنْ يَذْكُرُ اللهَ فِي تِلْكَ السّاعَةِ فَكُنْ.
রব বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী হন রাতের শেষ ভাগে। যদি পার ওই সময় আল্লাহর যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও! -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১১৪৭
নবীজী আরো বলেন-
أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللّيْلِ.
রমযানের পর রোযা রাখার উত্তম সময় মুহাররম মাস আর ফরয নামাযের পর উত্তম নামায রাতের নামায।
অন্য বর্ণনায় এসেছে-
الصّلاَة فِيْ جَوْفِ اللَّيْلِ.
গভীর রাতে নামায পড়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৩৪
অন্য হাদীসে বলেন-
يَاأَيّهَا النّاسُ، أَفْشُوا السّلاَمَ، وَأَطْعِمُوا الطّعَامَ، وَصَلّوا وَالنّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُونَ الجَنّةَ بِسَلاَمٍ.
হে লোক সকল! সালামের প্রসার কর। মানুষকে আহার করাও! আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামায আদায় কর! তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৮৫; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৩৭৮৪
একবার নবীজী মুআয রা.-কে বলেন-
أَلاَ أَدُلُّكَ عَلَى أَبْوَابِ الخَيْرِ: الصَّوْمُ جُنَّةٌ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ، وَصَلاَةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ.
আমি কি তোমাকে কল্যাণের দরজাসমূহ সম্পর্কে অবহিত করব না? তা হল-
১. রোযা ঢালস্বরূপ।
২. সদকা গোনাহ এমনভাবে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।
৩. গভীর রাতের নামায।
এরপর নবীজী সূরা সাজদার ১৬-১৭ নং আয়াত পাঠ করেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬
তাহাজ্জুদের প্রতি নবীজীর যওক-শওক
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেও আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁর তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত বিষয়াদি সবিস্তার আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র পুস্তিকার দরকার। এখানে অতি সংক্ষেপে কিছু কথা পেশ করা হল।
তাহাজ্জুদের প্রতি নবীজীর অপরিসীম আগ্রহ ও ভালবাসা ছিল। তিনি সারা বছর সীমাহীন গুরুত্ব ও যত্নের সঙ্গে তাহাজ্জুদ পড়তেন। বিনা ওজরে কখনো তা তরক করেননি। তিনি এশার নামাযের পর তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন। শোয়ার সময় বিভিন্ন দুআ-তাসবীহ পড়তেন। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়ে দ্রুত উঠে যেতেন। ওঠার পরও দুআ-তাসবীহ পড়তেন। তারপর ওযু করে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দীর্ঘ সময় নামাযে মশগুল থাকতেন।
তিনি সাধারণত দুই দুই রাকাত করে আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন। কখনো কখনো দশ বা ছয় অথবা চার রাকাতও পড়েছেন। তাতে দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন। ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে তিলাওয়াত করতেন। রুকু-সিজদাও দীর্ঘ করতেন। তাহাজ্জুদ শেষে তিন রাকাত বিতির পড়তেন। এবার এ সম্পর্কিত কয়েকটি বর্ণনা দেখুন।
আবদুল্লাহ ইবনে আবী কায়স রাহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. তাঁকে বলেছেন-
لاَ تَدَعْ قِيَامَ اللّيْلِ، فَإنّ النّبِيّ صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ مَا كَانَ يَدَعُه، وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلّى قَاعِدًا.
তুমি কিয়ামুল লাইল কখনো ছেড়ো না! কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কখনো ছাড়েননি। কখনো অসুস্থতা বা দুর্বলতা বোধ করলে বসে আদায় করতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩০৭; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১১৩৭
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আরো বলেন-
إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا فَاتَتْهُ الصَّلَاةُ مِنَ اللَّيْلِ مِنْ وَجَعٍ أَوْ غَيْرِه، صَلَّى مِنَ النَّهَارِ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً.
যদি অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজরের দরুণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) আদায় করতে না পারতেন, তাহলে দিনের বেলায় বারো রাকাত নামায পড়ে নিতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৪৬
এ দুই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, তাহাজ্জুদের প্রতি নবীজীর কত গুরুত্ব ছিল।
আয়েশা রা. আরো বলেন-
كَانَ يُصَلِّي ثَلَاثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً مِنَ اللَّيْلِ، ثُمَّ أَنَّهُ صَلَّى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، تَرَكَ رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ قُبِضَ حِينَ قُبِضَ وَهُوَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ بِتِسْعِ رَكَعَاتٍ، آخِرُ صَلَاتِهِ مِنَ اللَّيْلِ الْوِتْرُ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা তেরো রাকাত নামায পড়তেন। তারপর দুই রাকাত কমিয়ে এগারো রাকাত পড়তেন। মৃত্যুর আগের সময়গুলোতে নয় রাকাত পড়তেন। তাঁর রাতের সর্বশেষ নামায ছিল বিতির। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১১৬৮
এই বর্ণনায় উল্লেখিত নামায থেকে বিতির বাদ দিলে বাকি থাকে যথাক্রমে দশ, আট ও ছয় রাকাত। তার অর্থ নবীজী যথাক্রমে দশ রাকাত, আট রাকাত, ছয় রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন।
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান রাহ. আয়েশা রা.-কে নবীজীর রমযানের রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন-
مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَألْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَألْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে ও রমযানের বাইরে এগারো রাকাতের বেশি (তাহাজ্জুদ) পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন, এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে তুমি জানতে চেয়ো না। তারপর চার রাকাত পড়তেন, এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কেও জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত (বিতির) পড়তেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৭
এ থেকে বোঝা যায়, নবীজী রমযানে ও রমযানের বাইরে সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং তাঁর নামায এত দীর্ঘ ও সুন্দর ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
আয়েশা রা. আরো বলেন-
كَانَ يُوتِرُ بِأَرْبَعٍ وَثَلَاثٍ، وَسِتٍّ وَثَلَاثٍ، وَثَمَانٍ وَثَلَاثٍ، وَعَشْرٍ وَثَلَاثٍ، وَلَمْ يَكُنْ يُوتِرُ بِأَنْقَصَ مِنْ سَبْعٍ، وَلَا بِأَكْثَرَ مِنْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে চার রাকাত (তাহাজ্জুদ) ও তিন রাকাত (বিতির), ছয় রাকাত (তাহাজ্জুদ) ও তিন রাকাত (বিতির), আট রাকাত (তাহাজ্জুদ) ও তিন রাকাত (বিতির), দশ রাকাত (তাহাজ্জুদ) ও তিন রাকাত (বিতির) পড়তেন। তিনি (তাহাজ্জুদ ও বিতির মিলে) সাত রাকাতের কম এবং তেরো রাকাতের বেশি পড়তেন না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩৬২
এ থেকে জানা গেল, নবীজী চার রাকাতের কম তাহাজ্জুদ পড়তেন না। আয়েশা রা. অন্য বর্ণনায় বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوتِرُ بِتِسْعٍ، فَلَمَّا بَلَغَ سِنًّا وَثَقُلَ أَوْتَرَ بِسَبْعٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাহাজ্জুদ ও বিতির মিলে) নয় রাকাত পড়তেন। এরপর যখন তাঁর বয়স বেড়ে যায় এবং স্বাস্থ্যগতভাবে একটু ভারী হয়ে যান তখন (তাহাজ্জুদ ও বিতির মিলে) সাত রাকাত পড়তেন। -শরহু মাআনিল আছার, হাদীস ১৬৯১
এ থেকে জানা গেল, নবীজী জীবনের শেষ দিকে চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন।
আউফ ইবনে মালেক আশজায়ী রা. বলেন-
قُمْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً، فَقَامَ فَقَرَأَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ، لَا يَمُرُّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ إِلَّا وَقَفَ فَسَأَلَ، وَلَا يَمُرُّ بِآيَةِ عَذَابٍ إِلَّا وَقَفَ فَتَعَوَّذَ، قَالَ: ثُمَّ رَكَعَ بِقَدْرِ قِيَامِهِ، يَقُولُ فِي رُكُوعِهِ: سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوتِ وَالْمَلَكُوتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ، ثُمَّ سَجَدَ بِقَدْرِ قِيَامِهِ، ثُمَّ قَالَ فِي سُجُودِهِ مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ قَامَ فَقَرَأَ بِآلِ عِمْرَانَ، ثُمَّ قَرَأَ سُورَةً سُورَةً.
একবার রাতের বেলায় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামাযে দাঁড়ালাম। তিনি সূরা বাকারা পড়লেন। রহমতের আয়াত তিলাওয়াত করলে আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করতেন। আর আযাবের আয়াত তিলাওয়াত করলে তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতেন। এরপর কিয়াম সমপরিমাণ রুকু করেন। তারপর কিয়াম সমপরিমাণ সিজদা করেন। তারপর (দ্বিতীয় রাকাতে) দাঁড়িয়ে সূরা আলে ইমরান পড়েন। পরে এক একটি সূরা পড়েন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৮৭৩
এ থেকে অনুমেয়, নবীজী তাহাজ্জুদের নামাযে কিয়াম, রুকু ও সিজদা কত দীর্ঘ করতেন এবং কত চিন্তাভাবনা ও ধ্যানমগ্নতার সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাঁর স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ত।
আয়েশা রা. বলেন-
كَانَ يَقُومُ مِنَ اللّيْلِ حَتّى تَتَفَطّرَ قَدَمَاهُ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত।
এ দেখে আয়েশা রা. নিবেদন করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে!
নবীজী বলেন-
أَفَلاَ أُحِبّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا.
আমার কি উচিত নয় যে, আমি একজন পূর্ণ শোকরগুজার বান্দা হব? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২০
তাহাজ্জুদের প্রতি সালাফের যওক-শওক
এখানে আমরা দেখলাম, তাহাজ্জুদ কত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত এবং এর প্রতি নবীজীর কী যওক-শওক ও আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল। নবীজী হলেন সকল তাহাজ্জুদগুজারের সরদার। সর্বশ্রেষ্ঠ তাহাজ্জুদগুজার। তাঁর তাহাজ্জুদ-প্রীতির সুন্দর প্রভাব পড়েছে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের ওপর। তাঁরা তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তাহাজ্জুদের সঙ্গে তাঁদের অন্তরের সম্পর্ক ছিল। ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। তাঁরা গভীর রাতে সুখশয্যা ত্যাগ করে প্রভুর ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। তাহাজ্জুদ পড়তেন, কুরআন তিলাওয়াত করতেন, দুআ-যিকির করতেন, তওবা-ইস্তিগফার করতেন। হাদীস, সীরাত ও তারীখের গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কিত বিস্ময়কর প্রচুর ঘটনা রয়েছে। এখানে আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. আসলাম রাহ. বলেন-
إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ كَانَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ مَا شَاءَ اللهُ، حَتَّى إِذَا كَانَ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ أَيْقَظَ أَهْلَهُ لِلصَّلاَةِ، يَقُولُ لَهُمُ: الصَّلاَةَ الصَّلاَةَ، ثُمَّ يَتْلُو هَذِهِ الآيَةَ: وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَیْهَا لَا نَسْـَٔلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَ الْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰی.
উমর রা. রাতের বেলায় আল্লাহর ইচ্ছায় যতটুকু সম্ভব নামায পড়তেন। এরপর রাতের শেষ ভাগে পরিবারবর্গকে ‘নামায, নামায’ বলে জাগিয়ে দিতেন এবং এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন-
وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَیْهَا لَا نَسْـَٔلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَ الْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰی .
এবং নিজ পরিবারকে নামাযের আদেশ কর এবং নিজেও তাতে অবিচলিত থাক। আমি তোমার কাছে রিযিক চাই না। রিযিক তো আমিই দেব। আর শুভ পরিণাম তো তাকওয়ারই। (সূরা ত্বহা : ১৩২) -মুআত্তা মালেক, বর্ণনা ৩১১
২. আলকামা রাহ. বলেন-
بِتُّ مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ لَيْلَةً، فَقَامَ أَوَّلَ اللَّيْلِ، ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي، فَكَانَ يَقْرَأُ قِرَاءَةَ الْإمَامِ فِي مَسْجِدِ حَيِّهِ، يُرَتِّلُ، وَلَا يُرَجِّعُ، يُسْمِعُ مَنْ حَوْلَهُ، وَلَا يَرْفَعُ صَوْتَهُ، حَتَّى لَمْ يَبْقَ عَلَيْهِ مِنَ الْغَلَسِ إِلَّا كَمَا بَيْنَ الْأَذَانِ لِلْمَغْرِبِ إِلَى انْصِرَافٍ مِنْهَا، ثُمَّ أَوْتَرَ.
একবার আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সঙ্গে রাত্রিযাপন করলাম। তিনি রাতের প্রথম ভাগে ঘুম থেকে উঠে নামায শুরু করেন। তাঁর মহল্লার মসজিদের ইমামের মতো তারতীলের সঙ্গে মধ্যম আওয়াজে তিলাওয়াত করেন। মাগরিবের আযান থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত যতটুকু অন্ধকার থাকে রাত ততটুকু অন্ধকার থাকা পর্যন্ত তিনি নামাযে মশগুল থাকেন। এরপর বিতির আদায় করেন। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ৯/২৮০, বর্ণনা ৯৪০৪
৩. আবু উসমান নাহদী রাহ. বলেন-
تَضَيَّفْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ سَبْعًا، فَكَانَ هُوَ وَامْرَأَتُهُ وَخَادِمُه يَعْتَقِبُونَ اللَّيْلَ أَثْلَاثًا، يُصَلِّي هَذَا ثُمَّ يُوقِظُ هَذَا، وَيُصَلِّي هَذَا ثُمَّ يُوقِظُ هَذَا.
আমি আবু হুরায়রা রা.-এর কাছে সাত দিন মেহমানস্বরূপ ছিলাম। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও খাদেম রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। একজন নামায পড়ে আরেকজনকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতেন। -মুসনাদে আহমদ, বর্ণনা ৮৬৩৩
৪. একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রী হাফসা রা.-এর কাছে তার ছোট ভাই আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. সম্পর্কে বলেন, আবদুল্লাহ কতই না উত্তম মানুষ, যদি সে রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) পড়ত।
হাফসা রা. বলেন-
فَكَانَ بَعْدُ لاَ يَنَامُ مِنَ اللَّيْلِ إِلَّا قَلِيلًا.
এ কথা শোনার পর থেকে সে রাতে খুব অল্প সময়ই ঘুমাত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২২
৫. আবদুল্লাহ ইবনে শাউযাব রাহ. বলেন-
كَانَ عُرْوَةُ يَقْرَأُ رُبُعَ الْقُرْآنِ كُلَّ يَوْمٍ نَظَرًا فِي الْمُصْحَفِ، وَيَقُومُ بِهِ اللَّيْلَ، فَمَا تَرَكَهُ إِلَّا لَيْلَةَ قُطِعَتْ رِجْلُه، ثم عاوده مِنَ اللَّيْلَةِ الْمُقْبِلَةِ.
উরওয়া ইবনে যুবাইর প্রতিদিন কুরআনের এক চতুর্থাংশ দেখে তিলাওয়াত করতেন এবং তাহাজ্জুদেও সেটাই পড়তেন। যেদিন তার পা কাটা হয় কেবল সে দিনই তিনি তা পড়তে পারেননি। পরদিন থেকে আবার শুরু করেন। -আলমারিফাতু ওয়াততারীখ ১/৫৫২
৬. আবদুল্লাহ ইবনে শুবরুমা রাহ. বলেন-
كان زبيد اليامي يجزئ الليل ثلاثة أجزاء، جزءا عليه، وجزءا على عبد الرحمن ابْنه، وجزءا على عَبد الله ابنه، وكان زبيد يصلي ثلث الليل ثم يقول لأحدهما: قم، فإن تكاسل صلى جزئه، ثم يقول للآخر: قم، فإن تكاسل صلى جزئه، فيصلي الليل كله.
যুবায়দ (ইবনে হারিস) ইয়ামী রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। এক ভাগ নিজের জিম্মায়, আরেক ভাগ পুত্র আবদুল্লাহ্র জিম্মায়, আরেক ভাগ অপর পুত্র আবদুর রহমানের জিম্মায়। তিনি এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়তেন। তারপর এক ছেলেকে উঠতে বলতেন। সে অলসতা করলে তার অংশে নিজেই নামায পড়তেন। তারপর অন্য ছেলেকে উঠতে বলতেন। সে অলসতা করলে তার অংশেও নিজেই নামায পড়তেন। এভাবে কখনো কখনো পুরো রাত নামাযে কাটিয়ে দিতেন। -আলমুযাক্কিয়াত, পৃ. ২৫২
৭. আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ ইবনে জাবির রাহ. বলেন, আমরা আতা ইবনে আবী মুসলিমের সঙ্গে জিহাদে ছিলাম। তিনি পুরো রাত নামায পড়তেন। তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক রাত পার হলে তিনি আমাদের ডাকতেন আর বলতেন-
قُومُوا وَتَوَضَّئُوا وَصَلُّوا، فَإِنَّ قِيَامَ هَذَا اللَّيْلِ وَصِيَامَ هَذَا النَّهَارِ أَيْسَرُ مِنْ شَرَابِ الصَّدِيدِ وَمُقَطّعَاتِ الْحَدِيدِ، الْوَحَا الْوَحَا، النَّجَا النَّجَا، ثُمَّ يُقْبِلُ عَلَى صَلَاتِه.
তোমরা ওঠ, ওযু কর, নামায পড়। এই রাতে ওঠা, দিনে রোযা রাখা পুঁজ পান করা ও হাতুড়িপেটা অপেক্ষা সহজ। জলদি কর, মুক্তি খোঁজো। এরপর তিনি নিজ নামাযে মনোনিবেশ করতেন। -হিলইয়াতুল আওলিয়া ৫/১৯৩
৮. ওয়াকী‘ ইবনুল জাররাহ রাহ. বলেন-
كَانَ عَلِيٌّ وَالْحَسَنُ ابْنَا صَالِحِ بْنِ حُيَيِّ وَأُمُّهُمَا قَدْ جَزَّءُوا اللَّيْلَ ثَلَاثَةَ أَجْزَاءٍ، فَكَانَ عَلِيٌّ يَقُومُ الثُّلُثَ ثُمَّ يَنَامُ، وَيَقُومُ الْحَسَنُ الثُّلُثَ ثُمَّ يَنَامُ، وَتَقُومُ أُمُّهُمُ الثُّلُثَ، ثُمَّ مَاتَتْ أُمُّهُمَا، فَجَزَّأَ اللَّيْلَ بَيْنَهُمَا، فَكَانَا يَقُومَانِ بِهِ حَتَّى الصَّبَاحَ، ثُمَّ مَاتَ عَلِيٌّ، فَقَامَ الْحَسَنُ بِه كُلِّه.
সালেহ ইবনে হুয়াইয়ের দুই পুত্র আলী, হাসান ও তাদের মা রাতকে তিন ভাগ করেছিলেন। আলী এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়ে বিশ্রাম করতেন। তারপর হাসান এক তৃতীয়াংশ নামায পড়ে বিশ্রাম করতেন। এরপর তাদের মা এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়তেন। মায়ের মৃত্যুর পরে দুই ভাই রাতকে দুই ভাগ করে নামায পড়তেন। আলী ইন্তেকাল করলে হাসান একাই পুরো রাত্রি জাগরণ করতেন। -হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৩২৭
৯. হুসাইন ইবনে আলী কারাবিসী রাহ. বলেন-
بت مع الشافعي غير ليلة، فكان يصلي نحو ثلث الليل، فما رأيته يزيد على خمسين آية، فإذا أكثر فمائة، وكان لا يمر بآية رحمة إلا سأل الله لنفسه وللمؤمنين أجمعين، ولا يمر بآية عذاب إلا تعوذ منها، وسأل النجاة لنفسه ولجميع المسلمين.
আমি শাফেয়ী রাহ.-এর সঙ্গে একাধিক রাত থেকেছি। তিনি প্রায় এক তৃতীয়াংশ রাত নামায পড়তেন। পঞ্চাশ থেকে সর্বোচ্চ একশ আয়াত পড়তেন। রহমতের আয়াত এলে নিজের জন্য এবং সকল মুমিন-মুসলমানের জন্য আল্লাহর কাছে রহমত প্রার্থনা করতেন। আর আযাবের আয়াত এলে নিজের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। -তারীখে বাগদাদ ২/৩৯২
তাহাজ্জুদের প্রতি আকাবিরে দেওবন্দের যওক-শওক
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের মতো প্রতি যুগের আল্লাহ-প্রেমীরা তাহাজ্জুদের প্রতি আগ্রহী ও যত্নবান ছিলেন। আমাদের আকাবিরগণ এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন-
১. মাওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠী রাহ. হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. (১৩২৩ হি.) সম্পর্কে লেখেন, তিনি এশার নামাযের পর ওযীফা থেকে ফারেগ হয়ে বিশ্রাম করতেন। প্রায় এক তৃতীয়াংশ রাত বাকি থাকতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং সুবহে সাদিক পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
...জনাব মাওলানা মুহাম্মাদ মুনীর ছাহেব নানূতবী বলতেন, একবার হজ্বের সফরে আমি হযরতের সঙ্গে ছিলাম। এক রাতে জাহাজে তাহাজ্জুদের সময় হযরতের গোসলের প্রয়োজন হলে আমাকে বলেন, সমুদ্র থেকে কিছু পানি তুলে দাও, আমি গোসল করব। আমি আরয করলাম, এখনো অনেক রাত বাকি; সকাল হোক। একদিন তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে অসুবিধা নেই। কিন্তু তিনি এটা মঞ্জুর করলেন না। তিনি ওই সময়ই গোসল করে তাহাজ্জুদ আদায় করেন এবং যথানিয়মে ওযীফা ও তিলাওয়াতে মশগুল হন। -তাযকিরাতুর রশীদ ২/২১-২২
২. মিরাঠী রাহ. হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ. (১৩৪৬ হি.) সম্পর্কে বলেন, হযরতের আমল ছিল শেষ রাতে দশ বা বারো রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া। এতে তিনি প্রায় দুই পারা তিলাওয়াত করতেন। -তাযকিরাতুল খলীল, পৃ. ৩০৬
৩. মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তফা বিজনূরী হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. (১৩৬২ হি.) সম্পর্কে লেখেন, তিনি অর্ধরাতের পরে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন। অধিকাংশ সময় রাতের শেষ ষষ্ঠাংশে উঠতেন। কখনো এর আগপিছ হত। সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন। কখনো কমবেশি হত। রমযান মাসে তাহাজ্জুদে দৈনিক এক পারা তিলাওয়াত করতে দেখেছি। কখনো এর চেয়ে বেশিও দেখেছি। -মামূলাতে আশরাফী পৃ. ২০
রমযানে তাহাজ্জুদ
ওপরে যে ঘটনাবলি আমরা দেখলাম এগুলো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও আকাবিরে দেওবন্দের তাহাজ্জুদের সাধারণ অবস্থা। এ থেকে অনুমেয়, রমযানুল মুবারকে তাহাজ্জুদের প্রতি তাঁরা কত যত্নবান ও মনোযোগী ছিলেন। বস্তুত মাহে রমযান এলে তাঁরা অত্যধিক আনন্দিত হতেন। এই মাসকে রোযার পাশাপাশি সর্বোচ্চ পরিমাণে নামায, তিলাওয়াত, দুআ-যিকির, তওবা-ইস্তিগফরে কাটাতেন। রাতের বেশির ভাগ সময় নামায-তিলাওয়াতে বিভোর থাকতেন। দীর্ঘ সময় জুড়ে তাহাজ্জুদ পড়তেন। তাতে প্রচুর তিলাওয়াত করতেন।
হিশাম ইবনে হাসসান রাহ. বলেন-
كَانَ ابْنُ سِيرِينَ يُحْيِي اللَّيْلَ فِي رَمَضَانَ.
মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রাহ. রমযানে পূর্ণ রাত্রি জাগরণ করতেন। -আযযুহদ, ইমাম আহমদ, পৃ. ২৪৮
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন-
كَانَ الْأَسْوَدُ يَخْتِمُ الْقُرْآنَ فِي رَمَضَانَ فِي كُلِّ لَيْلَتَيْنِ، وَكَانَ يَنَامُ بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ، وَكَانَ يَخْتِمُ الْقُرْآنَ فِي غَيْرِ رَمَضَانَ فِي كُلِّ سِتِّ لَيَالٍ.
আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ রাহ. রমযানে প্রতি দুই রাতে কুরআন খতম করতেন। মাগরিব ও এশার মাঝামাঝি সময়ে বিশ্রাম করতেন। আর রমযানের বাইরে প্রতি ছয় রাতে কুরআন খতম করতেন। -হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১০২-৩
মুজাহিদ রাহ. বলেন-
كَانَ عَلِيٌّ الأَزْدِيُّ يَخْتِمُ الْقُرْآنَ فِي رَمَضَانَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ.
আলী আলআযদী রাহ. রমযানে প্রতি রাতে কুরআন খতম করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৬৮৪
রমযানুল মুবারক কেন্দ্রিক তাঁদের এই অত্যধিক কুরআন তিলাওয়াতের বড় একটা অংশ কাটত তাহাজ্জুদে। রাতের বেলায় নামায আর কুরআন তিলাওয়াতের যুগপৎ মোহে তাঁরা অন্য ভুবনে হারিয়ে যেতেন।
হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ. গাঙ্গুহী রাহ. সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর মুজাহাদার অবস্থা এমন ছিল যে, তা দেখে অন্যদের করুণা ও ভয় হত। যখন তাঁর বয়স সত্তরের বেশি, তখনো অবস্থা এই ছিল, দিনে রোযা রাখতেন, মাগরিবের পরে বিশ রাকাত আওয়াবীন পড়তেন। তাতে যতটুকু তিলাওয়াত করতেন, তা আনুমানিক দুই পারার কম হবে না। রুকু-সিজদা এত দীর্ঘ হত যে, অন্যদের মনে হত তিনি (রুকু বা সিজদা থেকে ওঠার কথা) ভুলে গেছেন। আওয়াবীন শেষ করে ঘরে যাওয়া ও খাওয়ার জন্য অবস্থানকালে কয়েক পারা তিলাওয়াত করতেন। কিছুক্ষণ পরে এশা ও তারাবীহ পড়তেন, তাতে এক ঘণ্টা সোয়া এক ঘণ্টা সময় ব্যয় হত। তারাবীহ শেষে সাড়ে দশটা এগারোটার দিকে বিশ্রাম করতেন এবং দুইটা আড়াইটা বাজে অবশ্যই উঠে যেতেন। কখনো খাদেম তাঁকে একটার সময়ও ওযু করতে দেখেছেন। আড়াই-তিন ঘণ্টার মতো তাহাজ্জুদে মশগুল থাকতেন। কখনো খাদেম পাঁচটার সময় গিয়েও তাঁকে তাহাজ্জুদে পেয়েছেন। -আকাবির কা রমযান, পৃ. ১৮
তাহাজ্জুদের কী স্বাদ অনুভব করেছিলেন তাঁরা; যার ফলে সত্তরোর্ধ্ব বয়সে শীতের রাতেও তা ছাড়েননি!
তাবেয়ী বুযুর্গ মি‘যাদ ইবনে ইয়াযীদ রাহ. যথার্থ বলেছেন-
لَوْلَا ظَمَأُ الْهَوَاجِرِ، وَطُولُ لَيْلِ الشِّتَاءِ، وَلَذَاذَةُ التَّهَجُّدِ بِكِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، مَا بَالَيْتُ أَنْ أَكُونَ يَعْسُوبَا.
যদি উত্তপ্ত দুপুরের (রোযাজনিত) তৃষ্ণা, শীতের দীর্ঘ রাত এবং তাহাজ্জুদে কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ না থাকত, তাহলে আমি মৌমাছি হয়ে যেতে পরোয়া করতাম না। -আযযুহদ ওয়ার রাকাইক, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক, বর্ণনা ২৭৮
আল্লাহ আমাদেরকে তাহাজ্জুদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন। বিশেষত রমযানুল মুবারকের সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন।