মাহে রমযানে ইবাদত-বন্দেগী
যেভাবে রমযান কাটাতেন আমাদের আকাবির-আসলাফ
মাহে রমযানুল মুবারক। মুমিন জীবনের সোনালি বসন্ত। জাহান্নামের কপাট বন্ধ। দুষ্ট শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ। জান্নাতের দুয়ার উন্মুক্ত। রহমত বরকতের অবিরাম বর্ষণ। আসমানী ঘোষণা- ‘ওহে কল্যাণ প্রত্যাশী! আরো অগ্রসর হও। ওহে অন্যায়ের পথিক! নিবৃত্ত হও।’ মুমিনের প্রতি আহ্বান- গুনাহের পঙ্কিলতা থেকে পাক ছাফ হয়ে মাগফেরাতের সরোবরে অবগাহন কর!
রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। তাকওয়া হাসিলের মাস। তাই এ মাসে দুআ-ইস্তিগফার, নামায-তিলাওয়াত এবং যিকির ও দুআয় নিমগ্ন থাকাই বড় আমল। এর মাধ্যমে তাকওয়ার পথে অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে মূল কথা।
নবীজীর ইবাদত-বন্দেগীর কোনো তুলনা হয় না। বিশেষ করে রমযানে তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর কোনো সীমা থাকত না। নবীজী নিজেও রমযান মাসে সীমাহীন আমল করতেন এবং পরিবার পরিজনকেও আমলে উদ্বুদ্ধ করতেন।
নবীজীর অনুসরণে তাঁর সাহাবীগণ এবং আল্লাহ তাআলার নেককার বান্দাগণও রমযানের সময়গুলোকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকতেন।
এই প্রবন্ধে আমরা রমযানে আমাদের আকাবির-আসলাফের ইবাদত-বন্দেগীর কিছু নমুনা উল্লেখ করব, যা আমলের পথে আমাদের প্রেরণা জোগাবে, ইনশাআল্লাহ।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কুরআনের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। রমযান মাসে তিনি প্রতি তিন দিনে একবার কুরআন খতম করতেন। (দ্রষ্টব্য : ফাযায়েলে কুরআন, আবু উবাইদ, পৃ. ১৮০; ফাযায়েলে কুরআন, ইবনে কাছীর, পৃ. ২৫৫)
বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আসওয়াদ নাখাঈ রাহ. মাগরিব এবং এশার মাঝে সামান্য ঘুমিয়ে নিতেন। সারারাত নামায-তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। রমযান মাসে প্রতি দুই রাতে তিনি এক খতম কুরআন পড়তেন। রমযান ব্যতীত অন্য সময় ছয় রাতে এক খতম পড়তেন। (দ্রষ্টব্য : ফাযায়েলে কুরআন, আবু উবাইদ, পৃ. ১৮০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৫১)
বিখ্যাত তাবেঈ ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. রমযান মাসে প্রতি তিন দিনে একবার কুরআন খতম করতেন। রমযানের শেষ দশকে দুই রাতে একবার খতম করতেন। (দ্র. মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৬১২৮)
আবু যর রা. বলেন, যখন তুমি রোযা রাখবে তখন তা হেফাজতের ব্যাপারেও সতর্ক থাকবে। বর্ণনাকারী তলীক ইবনে কায়সের অবস্থা ছিল, তিনি রমযান মাসে ঘরে ঢুকতেন, নামাযের সময় ছাড়া আর বের হতেন না। এভাবে তারা রোযা হেফাজতে সচেষ্ট থাকতেন এবং কোনোভাবে যেন কোনো অনর্থক বিষয়ে জড়িয়ে না পড়েন- সে ব্যাপারে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। (দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৯১২২)
কাতাদা রাহ.-এর বছরব্যাপী আমল ছিল, তিনি তাহাজ্জুদ নামাযে প্রতি সাত দিনে এক খতম কুরআন পড়তেন। রমযান এলে প্রতি তিন রাতে এক খতম পড়তেন। যখন রমযানের শেষ দশক আসত তিনি প্রতি রাতে এক খতম করে পড়তেন। (দ্রষ্টব্য : হিলইয়াতুল আউলিয়া ২/৩৩৮-৩৩৯; লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৭১)
রমযান শুরু হতেই ইমাম যুহরী রাহ. হাদীস চর্চা ও অন্যান্য ইলমী ব্যস্ততা স্থগিত করে তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, এখন তিলাওয়াতের মাস উপস্থিত হয়েছে এবং মানুষের মেহমানদারী করার সময় এসেছে। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৭১)
তেমনিভাবে ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রাহ. রমযান এলে অন্যান্য নফল ইবাদতের চেয়ে তিলাওয়াতের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করতেন। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৭১)
ইমাম মালেক রাহ.-ও রমযান শুরু হলে সকল ইলমী ব্যস্ততা স্থগিত রেখে তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৭১)
ইমাম বুখারী রাহ. তাহাজ্জুদে এক তৃতীয়াংশ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এভাবে প্রতি তিন রাতে একটি করে খতম করতেন। (দ্রষ্টব্য : তবাকাতে হানাবেলা ১/২৭৫)
মাহে রমযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে দান সদকা ও ভালো কাজে খরচ করতে এগিয়ে আসা।
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেন- নবীজীর অনুসরণে এ মাসে দান-খয়রাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই। কেননা মানুষের অনেক প্রয়োজন থাকে। আর অনেকে এ মাসে ইবাদতে অধিক মশগুল থাকার ফলে তাদের আয় রোযগার কম হয়। (দ্রষ্টব্য : মুখতাছারুল মুযানী, বর্ণনা ৭৮৮)
হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রাহ. রমযানে প্রতি রাতে পঞ্চাশ জনের মেহমানদারি করতেন। ঈদ এলে তাদের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতেন। আর ঈদের দিন তাদেরকে একশ দেরহাম করে হাদিয়া দিতেন। (দ্রষ্টব্য : আলকামেল, ইবনে আদী, ৩/৭; মুখতাছারুল মুযানী, বর্ণনা ৭৮৮)
হযরত যাকারিয়া রাহ. বলেন, কান্ধালায় আমাদের ঐতিহ্য ছিল- ইফতারের আগে এক ডেগ পোলাও প্রস্তুত হত। তারপর ছোট ছোট পাত্রে পরিমাণ মতো বিভিন্ন ঘরে নারীদের জন্য পাঠানো হত। অবশিষ্টগুলো নিয়ে বাড়ির উঠানে বসা হত। মুরব্বিরা সবাই এখানে শরীক হতেন। রাস্তা দিয়ে যারাই যেত সবাইকে ডেকে এনে ইফতার করানো হত। সবাই ইফতার করে মাগরিবের নামাযে শরীক হতেন এবং প্রায় এশা পর্যন্ত নফলে মশগুল থাকতেন। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ৬২)
এভাবে আমাদের পূর্ববর্তী বুযুর্গগণ রমযান মাসের খুব কদর করতেন। এর প্রতিটি মুহূর্ত যেন অধিক ফলপ্রসূ হয় সে ব্যাপারে যত্নবান থাকতেন। ইবাদত-বন্দেগী এবং সাধারণ নেক আমলগুলো এ সময়ে বাড়িয়ে দিতেন। নিকট অতীতেও আমাদের উলামায়ে দেওবন্দ ছিলেন পূর্ববর্তী বুযুর্গানে দ্বীনের পদাঙ্ক অনুসরণকারী। তাদের রমযানের রুটিন দেখলেও রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। তাদের জীবন থেকে সামান্য আলো গ্রহণের লক্ষ্যে এখানে কিছু বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হল।
হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রাহ.
হযরত গাঙ্গুহী রাহ.-এর ইবাদত-বন্দেগীর বিবরণ পড়লে আশ্চর্যের অন্ত থাকে না। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। ভীষণ অসুস্থ। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেন না। এই বয়সে সারাদিন রোযা রাখার পর তার ইবাদতের হালাত হল- মাগরিবের পর দীর্ঘ রুকু সিজদাসহ আওয়াবীন পড়তেন। অন্যান্য সময় ছয় রাকাত পড়লেও রমযানে পড়তেন বিশ রাকাত। এই বিশ রাকাতে তিনি কমপক্ষে দুই পারা তিলাওয়াত করতেন। এত দীর্ঘ আওয়াবীন পড়ার পর এশা ও তারাবীহ পড়তেন ঘণ্টা সোয়া ঘণ্টা সময় নিয়ে। তিনি এই নামাযগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আদায় করতেন। আশপাশের সাথীরা বার বার বলতেন, হযরত আজ একটু বসে নামায পড়ুন!
তিনি বলতেন, না, এটা তো কম হিম্মতীর কথা!
রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে বিশ্রামে যেতেন। আবার দুইটা-আড়াইটার মধ্যে তাহাজ্জুদের জন্য উঠে যেতেন। কখনো কখনো একটা বাজেই উঠে পড়তেন নামাযের জন্য। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। নামাযের প্রতি হযরতের গভীর নিমগ্নতা লোকমুখে প্রসিদ্ধ ছিল।
ফজরের পর আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিভিন্ন ওযীফা আদায় করতেন। যিকির আযকার করতেন। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠিপত্র আসত। সেগুলোর উত্তর দিতেন। মানুষ মাসআলা জিজ্ঞাসা করত, সেগুলোর ফতোয়া লেখাতেন। এরপর চাশতের নামায পড়ে যোহর পর্যন্ত সামান্য বিশ্রাম নিতেন।
যোহরের পর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতেন। আছর পর্যন্ত তিলাওয়াত করতে থাকতেন। মাঝে মাঝে সেই বদ্ধ দুয়ার থেকে কান্নার হেঁচকি শোনা যেত।
নামাযের আগে পরে ঘরে আসা যাওয়ার সময়গুলোতেও তিলাওয়াত করতে থাকতেন। কোনো কথাবার্তা বলতেন না। নামাযে এবং নামাযের বাইরে সব মিলিয়ে দৈনিক প্রায় পনের পারা তিলাওয়াত করে ফেলতেন। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ., পৃ. ১৮-২০,৬৬)
হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রাহ.
দারুল উলূম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রাহ.-এর কুরআন হিফযের ঘটনা অত্যন্ত বিস্ময়কর। তা ঘটেছিল রমযান মাসেই। ১২৭৭ হিজরীতে তিনি হজে¦র সফরে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে রমযানের চাঁদ ওঠে। তিনি সারাদিন তিলাওয়াত করতে থাকলেন। রাতে সেই পারা নামাযে পড়তে লাগলেন। এভাবে বলা যায়, এক মাসেই হিফয সম্পন্ন করে ফেলেন।
তিনি নামাযে অত্যন্ত দীর্ঘ দীর্ঘ কেরাত পড়তেন। একাকী পড়তেন। সাথে কেউ শরীক হলে তিনি তিলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে সালাম ফিরিয়ে তাকে ফারেগ করে দিতেন। আবার নিজে দাঁড়িয়ে লম্বা কেরাতে নামায পড়তে থাকতেন। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ২৩)
হযরত মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ.
কুরআনপ্রেমী এক বুযুর্গ বান্দার নাম হযরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ.। তিনি সাহারানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদীস ছিলেন। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.-এর শায়েখ ও উস্তায ছিলেন। সুনানে আবু দাউদের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বযলুল মাজহুদ’ তিনিই রচনা করেছেন।
বাল্য বয়সে হিফয করার সুযোগ হয়নি হযরতের। কিছুটা বয়স হয়ে যাওয়ার পর তিনি কুরআন হিফয আরম্ভ করেন। তার হিফযের বিষয়ে যা জানা যায় তা হচ্ছে, রমযানে তিনি এলাকা থেকে দূরে গিয়ে খতমে তারাবীহতে শরীক হতেন। একবার তিনি হাফেয সাহেবকে অনুরোধ করলেন, আমাদের মহল্লার মসজিদে যদি আপনি খতমে তারাবীহের কোনো ব্যবস্থা করতেন, তাহলে অনেক উপকার হত। এলাকার মুরব্বিরা তো এতদূর আসতে পারেন না। এলাকার মসজিদে খতমে তারাবীহ হলে অনেকেরই কুরআন খতম হত। কিন্তু হাফেয সাহেব কোনোভাবে রাজি হলেন না।
উপরন্তু হযরতকে কিছুটা কঠিন করে বললেন, এত যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনি হাফেয হলেন না কেন? হাদীস শিখতে তো ঠিকই সময় দিয়েছেন!
এতেই তিনি পণ করে বসেন। হযরতের সাথে তার এক চাচাতো ভাই ও এক বন্ধু ছিলেন। তিনজন পরামর্শ করলেন, এই বছরটা যাক। আগামী বছর আসতে আসতে আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দশ পারা হিফয করে ফেলব। এভাবে আমাদের খতমে তারাবীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
এভাবে তিনি হিফয করতে আরম্ভ করলেন। করতে করতে দশ পারা হিফয হয়ে গেল। কিন্তু থামলেন না। হিফয এগিয়ে নিলেন। এভাবে পরবর্তী রমযান আসার আগেই পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করে ফেললেন। ওদিকে তার বন্ধুও পুরো কুরআন হিফয করে ফেললেন। কিন্তু রমযান আগমনের পূর্বেই তিনি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান।
তো এভাবে বয়স হয়ে যাবার পর হযরত সাহারানপুরী রাহ. কুরআন হিফয করেন।
এখন হিফযুল কুরআনের এই নিআমত হেফাযতের জন্য হযরতের কসরতটাই হল শোনার বিষয়। শীত-গরম, সুস্থতা-অসুস্থতা, প্রবাসে-নিবাসে সর্ব হালতে হযরতের রুটিন ছিল প্রতিদিন মাগরিবের পর ছয় রাকাত নফলে দুই থেকে আড়াই পারা তিলাওয়াত করা। কমসে কম সোয়া এক পারা তো পড়তেনই। সফরে ট্রেনে বা অন্য কোনো ভীড়ে কিংবা ব্যস্ততার দরুন দীর্ঘ নফলের সুযোগ না পেলে বসে বসে পড়ে নিতেন।
এ তো গেল আওয়াবীনের কথা। তাহাজ্জুদের জন্য ছিল ভিন্ন তারতীব। তাহাজ্জুদের বারো রাকাতে সুযোগ মতো দুই পারা থেকে চার পারা তিলাওয়াত করতেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে কুরআন খতম করতেন। পুরো মাসে তার পাঁচ-ছয়টি খতম হয়ে যেত।
এটা ছিল এগারো মাসের হিসাব। রমযানের তারতীব ছিল মোটামুটি এরকম- দিনের শুরুতে ফজর থেকে ইশরাক পর্যন্ত মুরাকাবা করতেন। এরপর থেকে এগারোটা পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। ‘বযলুল মাজহুদ’ লেখার সময় শীত কালে বারোটা পর্যন্ত আর গরমকালে একটা পর্যন্ত লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন। এরপর যোহর পর্যন্ত সামান্য বিশ্রাম নিতেন। যোহরের পর কোনো হাফেয সাহেবকে সোয়া এক পারা শোনাতেন। এ সময় হযরত মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব রাহ. এবং যাকারিয়া রাহ.-কেও শোনাতেন। এভাবে শোনাতে শোনাতে আসর হয়ে যেত।
আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাসবীহ পড়তেন এবং মানুষকেও সময় দিতেন। হাতে তাসবীহ থাকত, যবানে থাকত যিকির। এর মধ্যে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে হালকা করে উত্তরও দিয়ে দিতেন।
মাগরিবের পর নফল নামাযে সোয়া এক পারা তিলাওয়াত করতেন। তবে অন্যান্য মাসের তুলনায় রমযানে আরো সময় নিয়ে নামায আদায় করতেন।
যতদিন পেরেছেন নিজেই তারাবীহ পড়িয়েছেন। ইন্তেকালের দুই বছর পূর্বে যখন আর পড়াতে পারতেন না তখন ভালো হাফেয সাহেবের পেছনে নামায পড়তেন। কখনো মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-ও নামায পড়াতেন। কোথাও সফরে গেলে সাথে করে হাফেয সাহেবকে নিয়ে যেতেন। যাতে খতমে ব্যাঘাত না ঘটে।
অভ্যাস অনুযায়ী সুবহে সাদিকের দুই-তিন ঘণ্টা পূর্বে উঠে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। দুই থেকে আড়াই পারা তিলাওয়াত করতেন। এভাবে রমযান মাসে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেত হযরতের তিলাওয়াতের পরিমাণ।
রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফের পাবন্দ ছিলেন। ইন্তেকালের দুই বছর পূর্বে যখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনো ইতিকাফ বাদ দেননি।
হযরতের এমনিতেই লেখালেখির ব্যস্ততা থাকত। শেষ বয়সে যখন মদীনা মুনাওয়ারায় চলে যান তখন লেখার সময়গুলোও তিলাওয়াতে ব্যয় করতে থাকেন। যোহরের পর আহলিয়া মুহতারামাকে এক পারা শোনাতেন। সেটাই মাগরিবের পর নফলে পড়তেন এবং তারাবীহতে তিলাওয়াত করতেন।
সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর এত পরিশ্রম করে তিলাওয়াত করতে দেখে মাওলানা সায়্যেদ আহমাদ ছাহেব (মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.-এর ভাই) এবং মাওলানা যাকারিয়া রাহ. আরজ করলেন, হযরত! এভাবে তো আপনার মাথায় খুব চাপ পড়ছে। এদিকেও তো কিছুটা খেয়াল করা দরকার।
এ শুনে হযরত বলেন, এখন এই মাথা থেকে কী বা আর কাজ নেবার আছে যে, এর প্রতি খেয়াল রাখব!
একবার বললেন, বার্ধক্যের দরুন মাথায় চাপ বোধ হয়। তাই আশঙ্কা হয়, ফের না কুরআন ভুলে বসি! তাই তিলাওয়াতের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেই। দেমাগের যা হয় হোক, কুরআন যেন না যায়, সেটাই কথা!!
জীবনের শেষ রমযানে কুরআনের প্রতি তার আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। দেখে না দেখে তিলাওয়াত করা, শোনানো, নামাযে পড়া, যতক্ষণ পারেন ততক্ষণ দাঁড়িয়ে, নতুবা বসে বসে- এভাবে তিলাওয়াতের পরিমাণ বহু বেড়ে যায়। তিনি না দেখেই বেশি তিলাওয়াত করতেন।
হযরতের জীবনে রয়েছে কুরআন প্রেমের লম্বা দাস্তান, বিশেষ করে রমযানকে কেন্দ্র করে। এখানে সামান্যই উল্লেখ করা হল। (দ্রষ্টব্য : তাযকেরাতুল খলীল, পৃ. ৫৪-৫৫, ৬৪-৬৭; আকাবির কা রমযান, পৃ. ৭-১৮; ফাযায়েলে রমযান, যাকারিয়া রাহ., পৃ. ৬-৭)
শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.
হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. নিজে হাফেয ছিলেন না; কিন্তু তারাবীর পর প্রায় সারারাত নামাযে থাকতেন। হযরতের নামাযের জন্য কয়েকজন হাফেয সাহেব নিযুক্ত ছিলেন। হযরত তাদের খুব সমাদর করতেন। খাবার-দাবার ও অন্যান্য বিষয়ে লক্ষ রাখতেন এবং তাদের জন্য সম্মানজনক ব্যবস্থা করতেন। হাফেয সাহেবগণ বারি বারি করে দুই চার পারা পড়িয়ে পড়িয়ে চলে যেতেন। কিন্তু হযরত সাহরী পর্যন্ত এভাবে নামাযে তিলাওয়াত শুনতেন। দিনের বেলা এক আধটু বিশ্রাম নিলেও রাতে বলা চলে বিশ্রামই নিতেন না।
কখনো কখনো এশার নামায পড়ে ঘরে চলে আসতেন। হাফেয সাহেবদের নিয়ে দীর্ঘ সময় তারাবীহ পড়তেন। চার পারা, ছয় পারা এমনকি দশ পারা পর্যন্ত তারাবীহে শুনতেন। দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পড়তে হযরতের পা ফুলে যেত।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ শায়েখের এত কষ্ট দেখে একদিন ঘর থেকে হাফেয সাহেবকে বলা হল, কোনো কৌশলে আপনি নামায কিছুটা সংক্ষিপ্ত করবেন, যাতে হযরতের কিছুটা আরাম হয়। সে হিসেবে হাফেয সাহেব অল্প পড়িয়ে বললেন, আজ ক্লান্তি লাগছে। হযরতের অভ্যাস ছিল, তিনি অন্যের সুবিধার প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। তাই হাফেয সাহেবকে খুশি খুশি ছুটি দিয়ে দিলেন।
হাফেয সাহেব বিশ্রামে আছেন। একটু পর কেমন যেন স্পর্শ অনুভব করলেন। চোখ খুলে দেখেন, হযরত তার পা টিপে দিচ্ছেন। এ দেখে তো হাফেয সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। হযরত বললেন, না ভাই, তুমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নাও। আশা করি, আরাম পাবে। (দ্রষ্টব্য : সাওয়ানেহে শাইখুল হিন্দ আছগরী, আকাবির কা রমযান, পৃ. ২৬-২৮)
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
হযরত থানভী রাহ. হাফেযে কুরআন ছিলেন। নিজেই তারাবীহ পড়াতেন। হযরতের ইয়াদ খুব পাকা ছিল আর তিলাওয়াতও ছিল শানদার। ধীরে-সুস্থে তিলাওয়াত করতেন। চার রাকাত পর পর কিছুটা লম্বা সময় নিয়ে বসতেন। সাতাশ দিনে খতম করতেন। কানপুর থাকতে হযরতের তারাবীহ শুনতে এ পরিমাণ মানুষ জমা হত যে, তড়িৎ ইফতার করে মসজিদে গেলে তবেই মসজিদের ভেতরে জায়গা পাওয়া যেত। নতুবা মসজিদের ভেতরে জায়গা মেলা মুশকিল ছিল।
হযরত মাদরাসায় মেহমানদের সাথে ইফতার করতেন। খুব ধীরে সুস্থে সব কাজ করতেন। কোনো তাড়াহুড়া ছিল না।
হযরত রমযান মাসে ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফে বসে লেখালেখিও অব্যাহত রাখতেন। হযরতের বিখ্যাত পুস্তিকা ‘কসদুস সাবীল’ ইতিকাফে বসেই লিখেছেন। বস্তুত রমযান ও গায়রে রমযানের রুটিনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন থাকত না।
রাতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। কিছু সময় তাহাজ্জুদ পড়তেন। সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন। রমযান মাসে তাহাজ্জুদে দৈনিক এক পারা করে পড়তেন। কখনো কখনো বেশিও পড়তেন।
হযরত ইফতারের পর প্রথম রাতে কম করে খেতে বলতেন। যাতে সাহরীর সময় খাবার গ্রহণে আগ্রহ থাকে। সাধারণত ফলমূল বা অন্য কিছু তারাবীর পর খেতেন। কারণ আগে খেলে শরীর ভারি হয়ে যায়, ফলে নামায পড়তে কষ্ট হয়।
হযরতের জীবন যাপন অত্যন্ত সাধারণ এবং স্বাভাবিক ছিল। এলাকার মানুষের সাথে মিশতেন। শিশুদের সাথে স্নেহসুলভ আনন্দ করতেন। ঘরে সময় দিতেন। বাড়িতে নারীরা একত্র হত। তিনি তাদের হালপুরসী করতেন। এভাবে জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ইসলাহী কাজ করতেন। বস্তুত এটাই ছিল হযরতের ভারসাম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ২৯-৪০)
হযরত মাওলানা ইয়াহয়া কান্ধলবী রাহ.
হযরত মাওলানা ইয়াহয়া কান্ধলবী রাহ. বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। হযরত গাঙ্গুহী রাহ.-এর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। হযরত গাঙ্গুহীর জীবনের শেষ তারাবীহ তিনিই পড়িয়েছিলেন। হযরত শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. ছিলেন তাঁর পুত্র।
মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কুরআন মাজীদ হিফয শেষ করেন। তিনি বলেন, হিফয শেষ করার পর ছয় মাস কুরআন শরীফ দেখে দেখে প্রতিদিন তিলাওয়াত করতাম। এরপর থেকে আর দেখে তিলাওয়াত করার সুযোগ হত না।
তিনি সারাদিন মুখস্থ তিলাওয়াত করতে থাকতেন। হযরতের তেজারতি কুতুবখানা ছিল। সেখানে তিনি কাজ করতেন, কিতাব প্যাকেটজাত করতেন আর হালকা আওয়াজে তিলাওয়াত করতে থাকতেন।
হযরত মাওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠী রাহ. বলেন, এক রমযানে আমার দরখাস্তে তিনি মিরাঠ তাশরীফ আনেন খতমে তারাবীহ শোনানোর জন্য। সে সময় দেখতাম, তিনি সারাদিন গুনগুন করে তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন। ইফতারের সময় খেয়াল করতাম, তিনি সূরা নাস তিলাওয়াত করছেন। অর্থাৎ এখন তার এক খতম কুরআন পূর্ণ হচ্ছে।
তিনি সবসময় ওযু অবস্থায় থাকতেন। মিরাঠে যখন আসেন তখন ট্রেন থেকে নামতেই এশার সময় হয়ে যায়। তিনি সোজা মসজিদে গিয়েই নামাযে দাঁড়িয়ে যান। তিন ঘণ্টায় দশ পারা খুব সুন্দর সাবলীলভাবে তিলাওয়াত করে ফেলেন। এভাবে তিন দিনে দশ পারা করে এক খতম পূর্ণ করে সাহারানপুর চলে যান। তার আগমনের কথা শুনে ত্রিশ-চল্লিশজন হাফেয সাহেবও তারাবীহতে যোগ দিয়েছিল ইয়াদ পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু হযরতের যেই পাকা ইয়াদ, তাতে ভুল হয় কীভাবে!
রমযান মাসে মানুষের সাথে বেশি মিশতেন না। ইফতারের পর কয়েক রাকাত নফল পড়ে ঘরে এসে গুনগুন করে তারাবীহের পড়া পড়তে থাকতেন। রাতে ঠিকমতো ঘুম আসত না। তাই ঘুম আসা পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে তিলাওয়াত করতে থাকতেন। আবার যখন চোখ খুলে যেত তিলাওয়াত করতে থাকতেন।
রাতের বেলা তাহাজ্জুদের পর খুব কান্নাকাটি করতেন। হযরত যাকারিয়া রাহ. বলেন, আমার মতো গভীর ঘুমের মানুষও কখনো কখনো সেই কান্নার শব্দে জেগে উঠত। আমার মুরব্বিদের মাঝে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. এবং মাওলানা ইয়াহয়া রাহ.-কে দেখতাম শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে। (দ্রষ্টব্য : তাযকেরাতুল খলীল, পৃ. ২০৪; আকাবির কা রমযান, পৃ. ২০-২১, ৬০-৬২, ৬৫-৬৬)
হযরত মাওলানা আবদুর রহীম রায়পুরী রাহ.
বুযুর্গানে দ্বীনের ব্যক্তিগত আমলের রুটিনে নানা বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। একেক জনের জীবন-রুটিন ছিল একেক রকম।
হযরত রায়পুরী রাহ.-এর রমযান কিছুটা অভিনবই কাটত। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তবৃন্দ এসে দরবারে ভীড় জমাত। কিন্তু হযরত ব্যক্তিগত আমলেই নিমগ্ন থাকতেন। সারাদিন হুজরা বন্ধ করে নিভৃতে ইবাদত করতেন। নামাযে আসা যাওয়ার সময়টুকুতে সবাই হযরতকে একটুখানি দেখে নিত। এছাড়া চিঠিপত্রের উত্তর প্রদানও এক মাস স্থগিত রাখতেন। মেহমানদেরকে আছর থেকে মাগরিব এবং সকাল নয়টা-দশটার দিকে ঘণ্টা-খানেক সময় দিতেন।
হযরত নিজে হাফেযে কুরআন ছিলেন। কুরআনের সাথে তাঁর বেপানাহ মহব্বত ছিল। কুরআনের শিক্ষা ব্যাপক করার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। যাইহোক, রমযানুল মুবারকে দিনভর তিনি তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। নিজে নিজে তো তিলাওয়াত করতেনই। আবার তিন-চারটি খতমও শুনতেন। চব্বিশ ঘণ্টায় খুব কম সময়ই বিশ্রাম নিতেন। খাবার-দাবার প্রসঙ্গে বলতে গেলে যিকির তিলাওয়াতই ছিল তাঁর মূল আহার।
তিনি নিজেই তারাবীহ পড়াতেন। তারাবীহ শেষ করতে করতে রাত দুইটা -আড়াইটা বেজে যেত। তবে শেষ বয়সে এসে মাথায় আর কুলাত না। ফলে হাফেয ছাহেবানের পেছনে ইকতেদা করতেন। (দ্রষ্টব্য : তাযকেরাতুল খলীল, পৃ. ২৪৮-২৪৯; আকাবির কা রমযান, পৃ. ২৪-২৫)
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.
তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর জীবনযাপন ছিল আত্মপীড়নমূলক। রমযান মাসে তিনি সংক্ষিপ্ত ইফতার করতেন। বাল্যকাল থেকেই দীর্ঘ নফল নামায পড়তেন। কিন্তু রমযান মাসে একেবারে এশার আযানের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত নফল পড়তেন। এরপর মসজিদেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন।
নিজেই তারাবীহ পড়াতেন। নামায পড়ে সাথে সাথে শুয়ে পড়তেন। কারো সাথে কথাবার্তা বলতেন না। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বারোটা বাজে উঠে যেতেন। এরপর সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদ পড়তেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে সাহরী করতেন।
ফজরের পর ইশরাক পর্যন্ত নামাযের জায়গায় বসে থাকতেন। এ সময় যিকির-আযকার করতেন, ওযীফা আদায় করতেন।
দুপুর বেলা এক-দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিতেন। যোহরের পর হুজরায় চলে যেতেন। সেখানে আসর পর্যন্ত মেহমানদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। এসময় কোনো সবক থাকলে তাও পড়াতেন। আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত যিকির করতেন। আর রমযান ছাড়া এ যিকির তাহাজ্জুদের সময় করতেন। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ৬৬-৬৯)
যেভাবে কাটত মা-বোনদের দিনগুলো
রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলোর সদ্ব্যবহারে আমাদের বুযুর্গদের ঘরওয়ালারাও বেশ সচেতন ছিলেন। সাংসারিক ব্যস্ততা সবকিছু সামাল দেওয়ার পরও মা-বোনদের ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার কারগুযারীগুলো শুনলে বাস্তবেই হয়রান হতে হয়। হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ. নিজের ঘরের মেয়েদের গল্প করতে গিয়ে বলেন, আমাদের মেয়েদেরকে আল্লাহ তাআলা আরো হিম্মত দান করুন। এত বড় সংসারের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা, তারপর সবার কোলে কয়েকটি করে সন্তান, এগুলো সামলানো... এতকিছুর পরও দেখি রমযান মাসে ওরা রাত জেগে জেগে ইবাদত করে। রাতে ছেলেরা তারাবীহতে খতম করে, সেখানে তাদের পেছনে ওরাও শরীক হয়। দিনের বেলা কাজ-কর্ম করার পর তারা কমপক্ষে চৌদ্দ-পনেরো পারা তিলাওয়াত করে। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা চলে- কে কত বেশি তিলাওয়াত করতে পারে। তাদের প্রতি মায়া হয়- রাতে যখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা নামাযে তিলাওয়াতে থাকে। আর দিনের বেলা যখন ওরা ঘুমাতে যায়, বাচ্চাগুলো বিরক্ত করতে থাকে। আল্লাহ তাআলাই কবুল করার মালিক।
হযরত নিজের দাদীজানের ব্যাপারে বলেন- দৈনিক তিনি এক মনযিল করে তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সাত দিনে খতম হত। রমযান মাসে দৈনিক এক খতম করে আরো দশ পারা পড়তেন। তাঁর তাসবীহাতের লম্বা ওযীফা তো আছেই।
হযরত মাওলানা ইয়াহয়া রাহ. প্রতি রমযানে নিজের বাড়ি কান্ধলায় গিয়ে নিজের মা ও নানী বিবি আমাতুর রহমানকে তারাবীহ পড়াতেন। তিন দিনে খতম করে আবার চলে আসতেন। তাদের সেই নামায চলত প্রায় সারা রাতব্যাপী। কখনো কখনো মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-ও গিয়ে প্রায় সারা রাত নামায পড়াতেন।
একদিন ছিল ত্রিশ রোযার তারাবীহ। বিবি আমাতুর রহমানের পুত্র মাওলানা রউফুল হাসান ছাহেব রাহ.। তিনি তারাবীহে প্রথম রাকাতে আলিফ লাম মীম থেকে ফালাক পর্যন্ত পড়লেন। দ্বিতীয় রাকাতে পড়লেন সূরা নাস। এভাবে দুই রাকাতে (বরং এক রাকাতে) পূর্ণ কুরআন পড়ে বললেন, অবশিষ্ট আঠারো রাকাত আপনারা পড়ে নিন। সেদিন বিবি আমাতুর রহমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের পেছনে এক রাকাতে পূর্ণ কুরআন শরীফ শুনেছেন।
বিবি আমাতুর রহমান বলেন, আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আব্বাজান বাইআত করে নেন। আব্বাজান আমাদেরকে যিকির-আযকার এবং মাসনূন দুআ-দরূদের সবক দেন। রমযান মাসে ঘরের কোণে ইতিকাফে বসিয়ে দেন। তখন থেকে এ নিয়মই মেনে আসছি।
বিবি ছাহেবা তৎকালীন আকাবিরে দেওবন্দের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বিশেষ করে হযরত থানভী এবং সাহারানপুরী রাহ.-এর। তাঁর পিতা ছিলেন মাওলানা মুযাফফর হুসাইন কান্ধলবী রাহ.। অত্যন্ত উঁচু মাপের মুত্তাকী বুযুর্গ ছিলেন তিনি। রমযান মাসে পুরা রাত ইবাদতে থাকতেন। এক মুহূর্তের জন্যও রাতে বিশ্রাম করতেন না। আল্লাহর ভয়ে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকত। কখনো কখনো চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। আবার আল্লাহ তাআলার রহমানী ছিফাতের ফিকিরে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। (দ্রষ্টব্য : আকাবির কা রমযান, পৃ. ২২, ৬৩-৬৫; হালাতে মাশায়েখে কান্ধলা, পৃ. ২৮, ৪৬-৪৮)
এমনই ছিল আমাদের বুযুর্গানে দ্বীনের রমযানের আমল। আজ আমরা গাফেল। আমল করা তো পরের কথা; আমরা জানিও না, আমাদের আকাবিরের আমল কেমন ছিল। আজ আমাদের পরিবেশ থেকে সেই নূরানী আবহ বিদায় হতে চলেছে। আমাদের করণীয় হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে অবগতি লাভ করা। তাদের জীবন থেকে আলো গ্রহণ করা। পরিবারে তাদের চর্চা করা। তবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলোর সংযোগ ঘটবে।
আমরা এ ঘটনাগুলো থেকে রমযানকে যথাযথ কদর করার এবং ইবাদত-বন্দেগীতে প্রাণবন্ত রাখার প্রতি অনুপ্রাণিত হতে পারি। হতে পারি আল্লাহর প্রিয়পাত্র।