সালাতুল হাজত : প্রয়োজন পূরণে নামায ও দুআ
ইসলামের স্বীকৃত আকীদা হল, দুনিয়াতে যা কিছু ঘটে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুমেই ঘটে। অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে, সর্বত্র, সর্বক্ষণ―একমাত্র আল্লাহ তাআলার হুকুমই কার্যকর। তাঁর হুকুমের বাইরে এবং তাঁর অগোচরে আসমান ও যমীনের কোথাও কিছু ঘটা সম্ভব নয়। এই আকীদা মুমিনমাত্রই ধারণ করে এবং মনেপ্রাণে লালন করে।
সেজন্যই মুমিন সকল বিষয়ে প্রথমে আল্লাহমুখী হয়। আল্লাহ তাআলার কাছেই নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহের কথা জানায়। যাবতীয় চাহিদা ও আকাক্সক্ষার কথা ব্যক্ত করে। এরপর কায়মনোবাক্যে দুআ করে। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার স্বতন্ত্র বিধান―উপায় ও উপকরণ অবলম্বনের প্রতি মনোযোগী হয়।
ছোট বড় যে কোনো প্রয়োজনে মুমিন উপকরণ অবলম্বন করে ঠিকই, তবে কাক্সিক্ষত বিষয় অর্জনের ক্ষেত্রে ভরসা রাখে একমাত্র আল্লাহ তাআলার ওপর। বিশ্বাস করে―আল্লাহ তাআলার হুকুম হলেই আমি তা লাভ করব, অন্যথায় নয়। তবে আল্লাহ তাআলাই যেহেতু উপকরণ অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন, তাই গুরুত্বের সাথে এবং যথাযথভাবে তা অবলম্বন করব।
মুমিনের চিন্তা ও কর্মনীতি
মুমিন শরীয়তের বিধান মোতাবেক উপকরণ অবলম্বনের সময় এবং তার আগে ও পরে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ-অভিমুখী হয়। একমাত্র আল্লাহ তাআলার ওপরই ভরসা করে। সেইসাথে বিনীতভাবে দুআ করে এবং বিভিন্ন নেক আমলের মাধ্যমে দুআ কবুল করানোর চেষ্টা করে। কাক্সিক্ষত বস্তুটি পাওয়া-না পাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনা করে। সে বিশ্বাস করে―জিনিসটি আমার প্রয়োজন ঠিক, তবে তা আমার জন্য কল্যাণকর না-ও হতে পারে। তাই সে তার ইচ্ছা ও আগ্রহ প্রকাশ করার পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার কাছে প্রকৃত কল্যাণও প্রার্থনা করে। এমনকি কাক্সিক্ষত বস্তুটি পাওয়ার পর তা উত্তম কাজে, উত্তম পন্থায় ব্যবহার করার তাওফীক কামনা করে।
প্রয়োজন দুই ধরনের
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মানুষের প্রয়োজন প্রথমত দুই ধরনের।
এক. সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে পাওয়ার মতো বিষয়, যাতে মানুষের কোনো হাত নেই। যেমন সন্তান লাভ করা, রোগমুক্তি লাভ করা, হায়াতে বরকত হওয়া, রিযিকে বরকত হওয়া ইত্যাদি।
দুই. কোনো মাখলুকের মধ্যস্থতায় পাওয়ার মতো বিষয়। যা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকেই পাওয়া, তবে ওসিলা হিসেবে সেখানে কোনো মাখলুক থাকে। যেমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ সুবিধা লাভ করা, শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হওয়া ইত্যাদি।
জীবন যাপন করতে গিয়ে মানুষ উভয় প্রকারের হাজারো প্রয়োজনের মুখোমুখি হয়। ফলে নিত্যদিন এসব প্রয়োজন পূরণের ক্লান্তিহীন চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে।
প্রথম প্রকারের প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ গভীর ধ্যান ও মনোযোগের সাথে আল্লাহ-অভিমুখী হয় ঠিক, তবে দ্বিতীয় প্রকারের প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে উপায়-উপকরণের দিকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। কেউ কেউ তো উপায়-উপকরণের প্রতিই পূর্ণ মনোযোগী হয় এবং এসবের প্রতিই ঝুঁকে থাকে। কিন্তু মুমিন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সবকিছু করার পাশাপাশি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি। তাঁর কাছেই দুআ করে। তাঁর কাছেই সাহায্য চায়।
সাহায্য চাওয়ার মাধ্যম
মুমিন তার যাবতীয় প্রয়োজনের ক্ষেত্রে কীভাবে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাইবে―সে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি প্রসঙ্গ এসেছে নিম্নোক্ত আয়াতে। আল্লাহ তাআলা বলেন―
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ .
হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। ―সূরা বাকারা (২) : ১৫৩
এখানে মুমিনদেরকে ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্বীনী ও দুনিয়াবী এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়―যে কোনো ধরনের, যেকোনো প্রয়োজনে মুমিন ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য চাইবে। এই ব্যাপকতা আয়াতটির মর্মে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। (দ্রষ্টব্য : তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৫১; তাফসীরে মাযহারী ১/১৫১; তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩৯৪)
এখানে সাহায্য চাওয়ার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দুটি বিষয়। সবর ও সালাত।
সবরের শাব্দিক অর্থ, ধৈর্য। দ্বীন ও শরীয়তে সবরের তিনটি ক্ষেত্রকে মৌলিকভাবে উদ্দেশ্য করা হয়ে থাকে।
এক. যাবতীয় গোনাহ ও পাপাচার থেকে ধৈর্যের মাধ্যমে নিজেকে বিরত রাখা।
দুই. আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে ধৈর্যের মাধ্যমে নিজেকে অবিচল রাখা।
তিন. বিপদাপদ ও বালা-মসিবতের ক্ষেত্রে সংযম অবলম্বন করা। অর্থাৎ যাবতীয় বিপদ ও মসিবত আল্লাহ তাআলার হুকুমেই এসে থাকে―এই বিশ্বাস জাগ্রত রাখা এবং এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ, ক্ষমা ও প্রতিদান আশা করা। ―আররিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১৮৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৫১-৫২
সাহায্য চাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নামায
আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাওয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল, সালাত বা নামায।
উপরে সবর বা ধৈর্যের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা থেকে বুঝে আসে যে, নামায এবং যাবতীয় ইবাদত মূলত সবরেরই একটি প্রকাশক্ষেত্র। তদুপরি এখানে নামাযকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; যা থেকে নামাযের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি আরো জোরালোভাবে সাব্যস্ত হয়। উপরন্তু নামায অবস্থায় বান্দা ইবাদতে মশগুল থাকার পাশাপাশি সকল গোনাহ ও পাপাচার থেকে এবং বিভিন্ন বৈধ কাজকর্ম থেকেও বিরত থাকে, যা সবরের অর্থকে আরো মজবুত করে।
মোটকথা, সবরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। তাঁর যাবতীয় হুকুম-আহকাম মেনে চলা সহজ হয়, যা তাঁর নৈকট্য ও মহব্বত এবং রহমত ও নুসরত লাভের ওসিলা হয়। এমনিভাবে বিপদ মসিবতে আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক সমর্পণ আল্লাহর রহমত ও দয়াকে আবশ্যক করে।
আর সালাত মুমিনের সর্বপ্রধান ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে যেমন ইবাদত আদায় করা হয়, তেমনি তার প্রভাবে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাও সহজ হয়; যেমনটি সূরা আনকাবূতের ৪৫ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
তাছাড়া নামাযের মধ্যেও বিভিন্নভাবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। যেমন সূরা ফাতেহায় তিলাওয়াত করা হয়―
اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ.
(আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য চাই।)
এখানে ব্যাপকভাবে মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার সকল প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা রয়েছে।
এমনিভাবে নামাযের বিভিন্ন দুআ-তাসবীহতেও রয়েছে বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের নানা প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা।
হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা সিজদারত অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সবচে বেশি নিকটে থাকে। তাই সেই অবস্থায় বেশি বেশি দুআ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, সে সময়ের দুআ অবশ্যই কবুল হয়। এমনকি এ সময়ে কৃত নবীজীর একটি দুআও বর্ণিত হয়েছে―
اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهٗ، دِقَّهٗ وَجِلَّهٗ، وَأوَّلَهٗ وَآخِرَهٗ، وَعَلَانِيَتَهٗ وَسِرَّهٗ.
[হে আল্লাহ! আপনি আমার ছোট-বড়, প্রথম-শেষ, প্রকাশ-অপ্রকাশ্য সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮২, ৪৮৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১১২০)]
সালাতুল হাজত
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে অনুমিত হয় যে, আল্লাহ তাআলার কাছে ছোট বড় কোনো প্রয়োজন প্রার্থনা করা, বিশেষ কোনো কিছু চাওয়া কিংবা বিপদ মসিবত ও দুঃখ পেরেশানী থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে দু-চার রাকাত নামায পড়ে দুআ করা―একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এ আমলের ব্যাপারে কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে যেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তেমনি হাদীস শরীফেও পাওয়া যায় বেশ কিছু বর্ণনা। ফিকহের পরিভাষায় এই নামাযকে বলে ‘সালাতুল হাজত’।
বিখ্যাত সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. বলেন―
كَانَ النَّبيّ صَلّى الله عَلَيهِ وسَلَّم إِذَا حَزَبَه أَمْرٌ صَلَّى.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সমস্যা বা পেরেশানীর সম্মুখীন হতেন, নামাযে মগ্ন হতেন। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৯
হাদীসটির সনদ হাসান। [দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ৩/১৭২ (১৩০২ নং হাদীসের অধীনে।)]
হযরত আলী রা. বলেন―
لَقَدْ رَأَيْتُنَا لَيْلَةَ بَدْرٍ، وَمَا مِنَّا إِنْسَانٌ إِلا نَائِمٌ، إِلا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، فَإِنَّه كَانَ يُصَلِّي إِلَى شَجَرَةٍ، وَيَدْعُو حَتَّى أَصْبَحَ.
আমি বদরযুদ্ধের রাতে দেখেছি, আমরা সকলে ঘুমিয়ে আছি কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত। তিনি একটি গাছের কাছে দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া পর্যন্ত নামায পড়ছিলেন এবং দুআ করছিলেন। ―মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৬১; মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস ১১৮; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৮২৫ (হাদীসটির সনদ সহীহ)
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আ. ও ঈসা আ.-কে বিপদ ও মসিবতের কঠিন পরিস্থিতিতে নামাযের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন―
وَ اَوْحَيْنَاۤ اِلٰي مُوْسٰي وَ اَخِيْهِ اَنْ تَبَوَّاٰ لِقَوْمِكُمَا بِمِصْرَ بُيُوْتًا وَّ اجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قِبْلَةً وَّ اَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَ بَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ.
আমি মূসা ও তার ভাইয়ের প্রতি আদেশ পাঠালাম যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিশরে ঘর-বাড়ি স্থাপন কর এবং তোমাদের ঘরগুলোকে নামাযের স্থান বানাও এবং যথাযথভাবে নামায আদায় কর। আর ঈমান আনয়নকারীদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর। ―সূরা ইউনুস (১০) : ৮৭
এই আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, যখন মূসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়ের ওপর ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কঠিন জুলুম-নির্যাতন শুরু হল এবং তারা তাঁদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করল, তাঁদের জন্য চারপাশ সংকীর্ণ করে দিল, তখন আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে নামায আদায়ের নির্দেশ দিলেন। যেমন নির্দেশ দিয়েছেন একথা বলে যে, (তরজমা) ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য চাও’। [―সূরা বাকারা (২) ১৫৬] আর আয়াতের শেষে বলেছেন―‘ঈমান আনয়নকারীদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর।’ অর্থাৎ তাদেরকে সওয়াব ও প্রতিদান এবং সাহায্য ও বিজয়ের সুসংবাদ দাও। ―তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/২৮৯
সালাতুল হাজত বিষয়ে জামে তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহতে বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত একটি বর্ণনা আছে। কিন্তু শাস্ত্রীয় মান বিচারে বর্ণনাটি যয়ীফ বা দুর্বল। তবে এ বিষয়ে ‘হাসান’ পর্যায়ের বর্ণনাও রয়েছে। যেমন মুসনাদে আহমাদে উল্লেখিত হয়েছে, সাহাবী আবুদ দারদা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি―
مَنْ تَوَضَّأَ، فَأَسْبَغَ الْوُضُوءَ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ يُتِمُّهُمَا، أَعْطَاهُ اللهُ مَا سَأَلَ مُعَجَّلًا، أَوْ مُؤَخَّرًا.
যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করে, এরপর পূর্ণাঙ্গরূপে দুই রাকাত নামায আদায় করে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার প্রার্থিত বিষয় দান করবেন। শীঘ্রই অথবা কিছুকাল পর। ―মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৪৯৭
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন, এই হাদীসটি হাসান। (দ্রষ্টব্য : নাতাইজুল আফকার ফী তাখরীজি আহাদীসিল আযকার ৫/১৫০)
আরেকটি সহীহ হাদীসে আছে যে, দৃষ্টিশক্তিহীন এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরয করল, আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন, যেন তিনি আমাকে সুস্থতা দান করেন।
নবীজী বললেন, তুমি চাইলে আমি দুআ করব। তবে তুমি চাইলে ধৈর্য ধরতে পার, সেটা তোমার জন্য উত্তম হবে।
সে বলল, আপনি দুআ করুন।
তখন নবীজী তাকে উত্তমরূপে ওযু করে দুই রাকাত নামায পড়তে বললেন। এরপর নিম্নোক্ত দুআর মাধ্যমে তার কাক্সিক্ষত বিষয়টি আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে বললেন। দুআটি এই―
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهٖ لِتُقْضَى لِيَ، اَللّٰهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ.
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাচ্ছি এবং আপনার অভিমুখী হচ্ছি আপনার নবী, রহমতের নবী মুহাম্মাদের ওসিলায়। [হে নবী] আমি আপনার মাধ্যমে আমার রবের অভিমুখী হচ্ছি আমার এই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, যেন তা পূরণ করা হয়। হে আল্লাহ! আপনি আমার বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করুন। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৫; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ১০৪২০
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন―
هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ.
উল্লিখিত হাদীসটি থেকে অনেকগুলো বিষয় উঠে আসে। তন্মধ্যে নির্দিষ্ট প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নামায পড়ে দুআ করার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
কয়েকটি ঘটনা
ইসলামী ইতিহাসে এবং ইসলামপূর্ব যুগেও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাওয়ার অনেক ঘটনা পাওয়া যায়। তন্মধ্য থেকে দুয়েকটি ঘটনা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
১. সহীহ বুখারী ও মুসলিমসহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য অনেক কিতাবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একবার তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ রাযিয়াল্লাহু আনহাকে নিয়ে এক দুশ্চরিত্র দাপুটে শাসকের এলাকা অতিক্রম করছিলেন। তখন সেই শাসক লোক পাঠিয়ে হযরত ইবরাহীম আ. ও তাঁর মুহতারামা স্ত্রীকে ডেকে নিল। আল্লাহর নবী ইবরাহীম আ. ঐ প্রতাপশালী শাসকের চরিত্র সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতেন। তাই তিনি এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন।
এরইমধ্যে ঐ শাসক যখন হযরত সারা রা.-এর দিকে হাত বাড়াতে গেল, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার হাত বাধাগ্রস্ত হল এবং মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এঁটে গেল। তখন সে অনুতপ্ত হয়ে সারা রা.-এর কাছে দুআ চাইল, যেন তার হাত স্বাভাবিক হয়ে যায়। তিনি দুআ করলে হাত স্বাভাবিক হয়ে গেল। এভাবে কয়েকবার হাত বাড়ানোর পর আরো কঠিন অবস্থা হওয়ায় সে তাঁকে ছেড়ে দিল। সঙ্গে একজন দাসীকেও উপঢৌকন হিসেবে পেশ করল।
হযরত সারা রা. তার কাছ থেকে ফিরে এসে দেখলেন হযরত ইবরাহীম আ. নামাযে মগ্ন। এরপর তাঁকে জানালেন যে, আল্লাহ তাআলা পাপাচারী কাফেরের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৭১; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৫৮)
২. ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. হাফেয ইবনে আসাকির রাহ.-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, দামেশকে এক ব্যক্তির একটা গাধা ছিল। সেটাকে সে ভাড়ায় খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। একদিন সে মালপত্র নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, এমন সময় এক লোক এসে বলল, আমাকে অমুক জায়গায় নিয়ে চলো। গাধার মালিক তাকে সাথে নিয়ে নিল। পথিমধ্যে সেই যাত্রী বলল, ওই পথ দিয়ে চলো, ওদিক দিয়ে পথ খুব সংক্ষিপ্ত।
গাধার মালিক বলল, আমি তো ওই পথ চিনি না।
সে বলল, আমি চিনি।
কিছু দূর যাওয়ার পর একটা বিরানভূমি দেখা গেল। আশপাশে কোনো লোকজন নেই। সেখানে গিয়ে ওই যাত্রী গাধার পিঠ থেকে নেমে পড়ল এবং কোমড় থেকে খঞ্জর বের করে গাধার মালিককে আঘাত করতে উদ্যত হল।
গাধার মালিক ভয় পেয়ে বলল, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ছেড়ে দাও, এই গাধা ও সমস্ত মালামাল নিয়ে যাও।
কিন্তু সে মানল না। বলল, এগুলো তো নেবই, সাথে তোমাকেও হত্যা করব। গাধার মালিক কাকুতি মিনতি করে প্রাণভিক্ষা চাইল। কিন্তু কাজ হল না। তারপর দিশেহারা হয়ে বলল, তাহলে আমাকে অন্তত দুই রাকাত নামায পড়তে দাও।
সে বলল, আচ্ছা, তাড়াতাড়ি কর।
গাধার মালিক নামাযে দাঁড়াল।
নামায শেষ হতে না হতেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। জনমানবহীন সেই উপত্যকায় অচেনা এক অশ্বারোহী হাজির হল এবং বর্শা দিয়ে ওই যাত্রীরূপী ডাকাতকে হত্যা করল। ―তারীখে দিমাশক ৬৮/২৫১; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/২০৪-২০৫
৩. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে মারফূ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, বনী ইসরাইলে একজন বুযুর্গের নাম ছিল জুরাইজ। তাঁর ওপর একবার এক নারী ব্যভিচারের অপবাদ দিল। এমনকি তার প্রসবকৃত সন্তানকে নিয়ে এসে বলল―এটি জুরাইজের মাধ্যমে হয়েছে।
এই অপবাদের কথা শুনে লোকজন ছুটে এল এবং তাঁর ইবাদতখানা ভেঙে দিল। তাঁকে তাঁর ইবাদতখানা থেকে বের করে আনল এবং বিভিন্ন মন্দ কথা বলতে লাগল।
এমতাবস্থায় জুরাইজ ওযু করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামায শেষ করে সেই শিশু বাচ্চাটির কাছে গিয়ে বললেন―
হে শিশু! তোমার বাবা কে?
বাচ্চাটির জবান খুলে গেল এবং সে জানাল যে, তার বাবা অমুক রাখাল।
এ কথা শুনে লোকজন খুব অনুতপ্ত হল এবং তার ইবাদতখানাটি স্বর্ণ দিয়ে পুনঃনির্মাণের প্রস্তাব দিল। কিন্তু জুরাইজ রাজি হলেন না। বরং আগে যেমন ছিল তেমনি, মাটি দিয়ে নির্মাণের অনুমতি দিলেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৬
এসব ঘটনা থেকে সালাতুল হাজতের আমল ও তার ফায়েদা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
সালাতুল হাজতের নিয়ম
সালাতুল হাজতের নামায কমপক্ষে দুই রাকাত। তবে একই প্রয়োজনে বারবার দুই রাকাত করে অনেক রাকাত পড়তেও সমস্যা নেই।
এই নামায যেকোনো সাধারণ নফল নামাযের মতোই। সূরা কেরাত ও বিভিন্ন তাসবীহ একই। নিয়তের সময় শুধু খেয়াল থাকবে যে, আমি আমার নির্দিষ্ট প্রয়োজন/সকল প্রয়োজন/উম্মতের সকল প্রয়োজন পুরা হওয়ার জন্য দুই রাকাত নামায আদায় করছি।
নামাযের আগে অন্য নামাযের মতোই প্রথমে উত্তমভাবে ওযু করে নেবে। আগে থেকে ওযু অবস্থায় থাকলে তো ঠিক আছে। তার পরও নতুন ওযু করে নিলে ভালো।
উত্তমভাবে ওযু করার অর্থ হল, সুন্দরভাবে, ওযুর সব ফরয সুন্নত ও মুস্তাহাবের প্রতি পূর্ণ যত্নবান হয়ে, গুরুত্বের সাথে ওযু করা। দায়সারাভাবে কিংবা কোনো রকম শুধু অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ধোওয়া নয়।
সুযোগ থাকলে একথাও স্মরণ করা যে, ওযু হল পবিত্রতা অর্জনের একটি শরয়ী মাধ্যম। এটি মহিমান্বিত অনেক ইবাদতের পূর্ব প্রস্তুতি এবং এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। ওযুর মাধ্যমে পবিত্রতা হাসিল হয় এবং বান্দার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা কৃত বিভিন্ন গোনাহ ধুয়ে যায়।
ওযুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে হয়। শেষে পড়তে হয়―
أَشْهَدُ أَنْ لا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَهٗ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه، اَللّٰهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ، وَاجْعَلْنِي مِنَ المُتَطَهِّرِينَ.
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক। তাঁর কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার বান্দা ও রাসূল।
হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৫
এভাবে যত্নের সাথে ওযু করার পর পূর্ণ ধ্যান ও মনোযোগ এবং পূর্ণ খুশু ও খুযূর সাথে দুই রাকাত নামায পড়বে।
নামাযের পর আল্লাহ তাআলার হামদ ও প্রশংসা করবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করবে। এটা সকল দুআর ক্ষেত্রেই কাম্য।
আল্লাহ তাআলার হামদ ও প্রশংসার মাধ্যমে মূলত তাঁর শোকর আদায় করা হয়। বান্দার প্রতি তাঁর সার্বক্ষণিক ও সীমাহীন নিআমতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। যা আল্লাহ তাআলার খুব পছন্দ।
দরূদ ও সালামের মাধ্যমে নবীজীর প্রতি যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়, তেমনি প্রভূত কল্যাণ ও রহমত লাভ করা যায়। এছাড়াও দরূদ-সালামের অনেক ফায়েদা ও ফযীলত রয়েছে।
হামদ ও ছানা এবং দরূদ ও সালাম পেশ করার পর হাজত ও প্রয়োজন পূরণের প্রেক্ষিতে বর্ণিত হাদীসে শেখানো যে কোনো দুআ পড়বে। কিংবা নিজের মতো করে নিজের সব প্রয়োজন আল্লাহ তাআলার কাছে তুলে ধরবে। কাকুতি মিনতি করে আল্লাহ তাআলার কাছে নির্দিষ্ট বিষয়ে এবং জীবনের সকল প্রয়োজনের ক্ষেত্রে খায়ের ও কল্যাণ প্রার্থনা করবে।
হাজত পূরণের দুআ
হাদীস ভাণ্ডারে বান্দার হাজত ও প্রয়োজন পূরণের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দুআ বর্ণিত হয়েছে। জামে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে একটি দুআর কথা এসেছে, সেটি খুব প্রসিদ্ধ। অত্যন্ত মর্মসমৃদ্ধ সেই দুআটি এখানে তুলে দিচ্ছি―
لَا إِلهَ إِلّا اللهُ الحَلِيمُ الكَرِيمُ، سُبْحَانَ اللهِ رَبِّ العَرْشِ العَظِيمِ، الحَمْدُ لِلهِ رَبِّ العَالَمِينَ، أَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ، وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ، وَالغَنِيمَةَ مِنْ كُلِّ بِرٍّ، وَالسَّلَامَةَ مِنْ كُلِّ إِثْمٍ، لَا تَدَعْ لِي ذَنْبًا إِلّا غَفَرْتَهٗ، وَلَا هَمًّا إِلّا فَرَّجْتَهٗ، وَلَا حَاجَةً هِيَ لَكَ رِضًا إِلّا قَضَيْتَهَا يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ
দুআটির অর্থ :
আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। যিনি অত্যন্ত সহনশীল ও পরম মমতাময়। আল্লাহ পবিত্র, যিনি আরশে আযীমের মালিক। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জগতসমূহের রব।
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ঐসব জিনিস প্রার্থনা করি, যেগুলো আপনার রহমতকে অবধারিত করে এবং ঐসব জিনিস প্রার্থনা করি, যেগুলো আপনার ক্ষমাকে অনিবার্য করে। (প্রার্থনা করি) সকল নেককাজের তাওফীক এবং সকল গোনাহ থেকে নিরাপত্তা। আপনি আমার কোনো গোনাহ ক্ষমা না করে ছাড়বেন না এবং কোনো পেরেশানী দূর করা থেকে বাদ রাখবেন না। আর আমার কোনো প্রয়োজন―যাতে আপনার সন্তুষ্টি রয়েছে- তা অপূরণ অবস্থায় রেখে দিবেন না; হে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু! ―জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৭৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪
]وفي إسناده فائد، وهو ضعيف، ولكن باب الدعوات والأذكار مما يتسامح فيه، والمتن ليس فيه شيء يستنكر -محمد عبد المالك (حفظه الله تعالى ورعاه([
ইসমে আযমের মাধ্যমে দুআ করা
যেকোনো প্রয়োজন পূরণ এবং যে কোনো দুআ কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি পদ্ধতি হল ‘ইসমে আযম’-এর মাধ্যমে দুআ করা। হাদীস শরীফে ইসমে আযমের বিভিন্ন শব্দ-বাক্য বর্ণিত হয়েছে। যেমন―
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللهُ، لَا إِلَهَ إِلّا أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا أَحَدٌ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে (আমার কাক্সিক্ষত বিষয়) কামনা করছি। যেহেতু আমি সাক্ষ্য দেই যে, আপনিই আল্লাহ। আপনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই। আপনি এক ও অদ্বিতীয়। আপনি চির অমুখাপেক্ষী। (আপনি এমন সত্তা,) যিনি কাউকে জন্ম দেন না, কারো থেকে জন্ম নেন না। যার সমকক্ষ সমতুল্য কেউ নেই। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৭৫
এমনিভাবে―
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ، لَا إِلهَ إِلَّا أَنْتَ، وَحْدَكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ، الْمَنَّانُ، بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে (আমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়) কামনা করছি। যেহেতু সকল প্রশংসা আপনার। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি এক। আপনার কোনো শরীক নেই। আপনি মহা অনুগ্রহশীল। যমীন ও আসমানসমূহের অতুলনীয় স্রষ্টা। আপনি মহিমময়, মহানুভব। ―সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮৫৮
আরো আছে―
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، الْمَنَّانُ، يَا بَدِيعَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ، إِنِّيْ أَسْأَلُكَ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে (আমার কাক্সিক্ষত বিষয়) কামনা করছি। যেহেতু সকল প্রশংসা আপনার জন্য। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি মহা অনুগ্রহশীল। হে যমীন ও আসমানসমূহের অতুলনীয় স্রষ্টা! হে মহিমময়, মহানুভব! হে চিরঞ্জীব হে মহানিয়ন্ত্রক! আমি আপনার কাছে (আমার কাক্সিক্ষত বিষয়) প্রার্থনা করছি। ―মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৫৭০
এইসব দুআর কোনো একটি পড়ে দুআ করা যায়। তাতে দুআ কবুল হওয়ার দৃঢ় আশা হয়।
আল্লাহর কাছে চাওয়া বিফলে যায় না
বান্দার দুআ ও প্রার্থনা আল্লাহ তাআলার কাছে খুব পছন্দ। আল্লাহ তাআলা চান, বান্দা নিয়মিত তাঁর কাছে দুআ করুক। সকল প্রয়োজন তাঁর কাছেই পেশ করুক। বান্দার এই আল্লাহমুখিতা ও মুখাপেক্ষিতা আল্লাহ তাআলার খুব প্রিয়। এ মর্মেই কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে―
وَ قَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِيْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِيْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِيْنَ .
তোমাদের রব বলেছেন, আমাকে ডাক; আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ওরা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ―সূরা গাফির (৪০) : ৬০
এই আয়াতে ‘আমাকে ডাক’ অর্থ হল, আমার বন্দেগী কর এবং আমার কাছে চাও। ―তাফসীরে কাশশাফ ৪/১৭৫
‘সাড়া দেব’ অর্থ হল, আমি তোমাদের ইবাদতের প্রতিফল দেব এবং তোমাদের দুআ কবুল করব, তোমাদের চাওয়া পূর্ণ করব। ―প্রাগুক্ত
আয়াতের শেষাংশে বলেছেন, যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে অর্থাৎ সকল ইবাদাত, দুআ ও আল্লাহকে ডাকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
নিঃসন্দেহে অন্যান্য ইবাদতের মতো আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর কাছে দুআ করা স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। বরং আল্লাহর কাছে চাওয়া ও দুআ করাকে হাদীসে ইবাদতের মূল বলা হয়েছে। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৭৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৪৭)
দুআর ক্ষেত্রে কিছু আদব যেমন আছে, তা কবুল হওয়ার কিছু শর্তও আছে। এ বিষয়ে অনেকগুলো বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন―
لَا يَزَالُ يُسْتَجَابُ لِلْعَبْدِ، مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ، مَا لَمْ يَسْتَعْجِلْ.
আল্লাহ তাআলা বান্দার দুআ কবুল করে থাকেন―যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো গোনাহ কিংবা আত্মীয়তা ছিন্ন করার দুআ না করে এবং দুআ কবুলে তাড়াহুড়ো না করে।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, তাড়াহুড়ো কীভাবে হয়? অথবা কাকে তাড়াহুড়ো বলা হয়?
নবীজী বললেন―
يَقُولُ: قَدْ دَعَوْتُ وَقَدْ دَعَوْتُ، فَلَمْ أَرَ يَسْتَجِيبُ لِي، فَيَسْتَحْسِرُ عِنْدَ ذَلِكَ وَيَدَعُ الدُّعَاءَ.
বান্দা বলে, আমি তো দুআ করেছি, আমি তো দুআ করেছি; কিন্তু কবুল হতে দেখিনি। তাই সে নিরাশ হয়ে যায় এবং দুআ করা ছেড়ে দেয়। ―সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৩৫
অন্য হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ لَيْسَ فِيهَا إِثْمٌ، وَلَا قَطِيعَةُ رَحِمٍ، إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ بِهَا إِحْدَى ثَلَاثٍ: إِمَّا أَنْ تُعَجَّلَ لَه دَعْوَتُه، وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَه فِي الْآخِرَةِ، وَإِمَّا أَنْ يَصْرِفَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا . قَالُوا: إِذًا نُكْثِرُ؟ قَالَ: اللهُ أَكْثَرُ.
মানুষ যে কোনো দুআ করে, যদি তাতে কোনো গোনাহ কিংবা আত্মীয়তা ছিন্ন করার বিষয় না থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে তিনটি বিষয়ের কোনো একটি দান করেন। হয়তো তৎক্ষণাৎ তার দুআ কবুল করা হয় অথবা তার দুআর ফল আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়া হয় কিংবা তাকে কোনো মন্দ বিষয় থেকে হেফাযত করা হয়।
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, তাহলে তো আমরা অনেক দুআ করব।
নবীজী বললেন, তাহলে আল্লাহও অনেক দেবেন এবং আল্লাহর দেওয়াই বেশি। ―মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১১৩৩
মোটকথা, দুনিয়া ও আখেরাতের যে কোনো প্রয়োজনে মুমিন প্রথমেই আল্লাহ-অভিমুখী হবে। আল্লাহ তাআলার কাছেই নিজের সকল প্রয়োজন পেশ করবে। তাঁর কাছ থেকেই কল্যাণের ফায়সালা গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে নামায ও দুআর মাধ্যম অবলম্বন করবে। পাশাপাশি সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। মনে রাখবে, আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দার দুআ-মুনাজাতের যেমন প্রতিদান রয়েছে, চেষ্টা মেহনতেরও রয়েছে অনেক মূল্য ও প্রতিদান। নিঃসন্দেহে বান্দার যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তাআলার হুকুমেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।