পাঁচশ রুপি
কয়েকদিন আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আমার কাছে আসেন। তাঁর ছোট একটা প্রয়োজন ছিল। সাধ্যমতো তাঁকে সহযোগিতা করি। আলাপচারিতায় তাঁকে জীবনের বিস্ময়কর কোনো গল্প বলতে অনুরোধ করি।
আমার অনুরোধে তিনি একটি ঘটনা বলেছিলেন, যা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবলাম, ঘটনাটি আপনাদের সাথেও শেয়ার করা উচিত।
পুলিশ অফিসার বলেন, আমি ১৯৯৬ সালে লাহোরে এসএইচও ছিলাম। আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে সার্ভিস হাসপাতালে ভর্তি করি। এক শীতের রাতে ডিউটিতে ছিলাম। বাবা হাসপাতালে একা ছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেল। তিনি বমি করতে শুরু করেন। আমার পরিবারের কেউ তাঁর সাথে ছিল না।
তিনি যে কেবিনে ছিলেন তা ছিল দুজন রোগীর একটি রুম। তাঁর সাথে অন্য বিছানায় একজন রোগী ভর্তি ছিল। সেই রোগীর সঙ্গে একজন এটেন্ডেন্টও ছিল। সে উঠে এল। ডাস্টবিন ও তোয়ালে এনে বাবাকে সাহায্য করতে শুরু করে। সারারাত আব্বুর বমি পরিষ্কার করে। তাকে কফি পান করায়। মাথা ও বাহু টিপে দেয়। সকালে ডাক্তার এলে তাকে আমার বাবার অবস্থা বলে নিজ রোগীর সেবায় মনোযোগী হয়।
আমি সকাল নয়টায় ইউনিফর্ম পরে রেডি হয়ে বাবার সাথে দেখা করতে হাসপাতালে যাই।
ততক্ষণে আব্বুর স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গেছে। তিনি এটেন্ডেন্টের দিকে ইশারা করে আমাকে বললেন, এই মৌলভী রাতে আমার অনেক সেবা করেছেন।
এটেন্ডেন্টের দিকে তাকিয়ে দেখি, শশ্রুমণ্ডিত মধ্যবয়সী হ্যাংলা-পাতলা কর্মচারির মতো একজন মানুষ। আমি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। ভাবলাম, ও সারারাত আমার বাবার সেবা করেছে। ওকে বখশিশ দেওয়া উচিত। আমি পকেট থেকে পাঁচ শ রুপি বের করে তার কাছে গেলাম। সে চেয়ারে বসা ছিল।
আমি আমার এক হাত ওর কাঁধে রাখলাম। অন্য হাতে ওর পকেটে পাঁচ শ রুপি গুঁজে দিতে লাগলাম। সে চেয়ারে বসে ইতস্তত করতে লাগল। আমি অহংকারের সুরে বললাম, লে মৌলভী, এই টাকাটা রাখ, তোর কাজে লাগবে।
সে নরম কণ্ঠে বলল, না ভাই, না। আমার কোনো বদলার প্রয়োজন নেই। আমি আপনার বাবার সেবা করেছি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
আমি জোর করে নোটটি তার পকেটে ঢুকিয়ে দিই। সে টেনে বের করে আমার হাতে গুঁজে দেয়।
আমি তার কাঁধে চাপ দিই আর পীড়াপীড়ি করি। তাকে বলছিলাম, ও মৌলভী ছাড়, জিদ করিস না, রেখে দে, কাজে লাগবে।
কিন্তু সে বারবার একই কথা বলছিল, আমার কাছে আল্লাহর দেওয়া অনেক আছে। আমার পয়সার দরকার নেই। রাতে দেখলাম, আপনার বাবা একা। কষ্টে আছেন। আমি অবসর ছিলাম, তাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর খেদমত করেছি, আপনারা শুধু আমার জন্য দুআ করে দিন ইত্যাদি।
কিন্তু আমি থামিনি। যে করেই হোক তাকে পয়সা দিয়েই ছাড়ব।
পুলিশ অফিসার থামলেন। তাঁর ভেজা চোখ ও ভারী গলা পরিষ্কার করলেন।
তারপর বললেন, মানুষ ক্ষমতায় থাকলে তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়েও গোঁ ধরে। সে সব উপায়ে বাধ্য করতে চেষ্টা করে। আমিও গোঁ ধরে বসেছিলাম, কিন্তু মৌলভী আমার চেয়েও জেদি ছিল। সে মানছিল না। আমি তার পকেটে রুপি রাখছিলাম আর সে কখনো আমার পকেটে আবার কখনো হাতে গুঁজে দিচ্ছিল।
এই ধস্তাধস্তির মধ্যে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, মৌলভী, তুমি কী কর?
সে উত্তর দিল, এমনি মানুষের সেবা করি।
সে আমাকে তার পেশা বলতে চাচ্ছিল না। তখন আমি তার জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম জানতে জেদ করি। আমি বারবার তার পেশার কথা জিজ্ঞেস করতে থাকি। কিছুক্ষণ ঘুরানোর পর বলল, আমি কাছারিতে কাজ করি।
মনে হল, আদালতের কোনো ‘আরদালি’ অথবা কোনো ওকিলের চাপরাশি হবে হয়তো। আমি আবার তার মুঠিতে পাঁচ শত রুপি গুঁজে দিয়ে তার মুঠিটি ওপর থেকে চেপে ধরি। অহংকারের সুরে আবার জিজ্ঞেস করি, মৌলভী তুমি কাছারিতে কী কর?
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিচু স্বরে বলল, আল্লাহ আমাকে ইনসাফের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি লাহোর হাইকোর্টের একজন বিচারক।
বিশ্বাস হল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী বললে? তুমি একজন বিচারক!
সে ধীর কণ্ঠে বলল, হাঁ, আমার নাম মুনির আহমদ মুঘল। লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি।
এ কথা শুনে আমার হাত থেকে পাঁচ শ রুপি পড়ে গেল। আমার যে হাত পনেরো মিনিট ধরে তাঁর কাঁধে ছিল তা কাঁধের ওপরই জমে গেল। আমার চোখে অন্ধকার ছেয়ে গেল। কণ্ঠস্বর ফ্রিজ হয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম না, এখন কী করব?
বিচারপতি বড় আদর করে কাঁধ থেকে আমার হাত নামিয়ে আনলেন। উঠে দাঁড়ালেন। ঝুঁকে পাঁচ শ রুপি তুলে আমার পকেটে রাখলেন। তারপর পরম মমতায় তাঁর রোগীর দিকে ইশারা করে বললেন, তিনি আমার বাবা। আমি সারারাত তাঁর সেবা করি। মল-মূত্রও পরিষ্কার করি। রাতে দেখলাম, আপনার বাবা একা। স্বাস্থ্য অনেক খারাপ। আমি তাঁকে নিজের বাবা মনে করে সেবা করি। এজন্য শুকরিয়া জানানোর প্রয়োজন নেই।
একথা শুনে আমি লজ্জায় মাটির নিচে চাপা পড়ছিলাম। কারণ আমি সামান্য এসএইচও, আর আমার কাছে বাবার জন্য সময় নেই। আমি তাঁকে একা হাসপাতালে ফেলে গিয়েছি। অথচ হাইকোর্টের বিচারক নিজ বাবার সঙ্গে আমার বাবারও সেবা করেছেন। তাঁর বমিও পরিষ্কার করেছেন। আমার তখন ডুবে মরার অবস্থা। আমি তাঁর পায়ে পড়ে যাই, কিন্তু এই মহান ব্যক্তি আমাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
পুলিশ অফিসার কাঁদতে লাগলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কি বিচারপতির সাথে আপনার আর দেখা হয়েছে?
তিনি ধরা গলায় বললেন, অনেক বার। জীবনে আমি তারচেয়ে ভালো দ্বীনদার, ঈমানদার ও নির্ভীক মানুষ দেখিনি। তাঁর পুরো নাম বিচারপতি ড. মুনির আহমদ খান মুঘল। তিনি দুটি পিএইচডি করেছিলেন। একটি পাকিস্তান থেকে। অন্যটি জামিয়া আল-আযহার মিশর থেকে। দ্বিতীয় পিএইচডি করার জন্য তিনি নিয়মতান্ত্রিক আরবী শেখেন। এছাড়াও তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ২৪টি বই লিখেছেন। এই সমস্ত কাজের পাশাপাশি তিনি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
আমি চুপচাপ শুনছিলাম। পুলিশ অফিসার বলেন, বিচারপতি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের। এলএলবি করার পরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান। কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে কাজ কম ছিল, তাই আদালতের কাগজের অপর পাশে কালেমা লিখতে শুরু করেন। তিনি সারাদিন কালেমা তায়্যিবা লিখতেন।
সম্ভবত এটাই সেই অনুশীলনের প্রতিদান যে, আল্লাহ তাঁর শক্তি ও সময়ে বরকত দান করেন। চাকরির সময় একটি পিএইচডি করেন। তারপর আরবী শেখেন। জামিয়া আল-আযহারে ভর্তি হন। আদালত শেষে আরবী ভাষায় থিসিস লিখে মিশর থেকেও পিএইচডি লাভ করেন। তিনি প্রতিটি নতুন আইন পড়তেন এবং এর ওপর দ্রুত বই লিখতেন। নিজেই কম্পোজ করতেন। এই সমস্ত কাজের কারণে আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হত না। তিনি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতেন।
তিনি সারাজীবন বাবার সেবা নিজে করেছেন। তাঁর মল-মূত্র পর্যন্ত পরিষ্কার করতেন। বাবা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিছানায় পায়ের কাছে একটি বেলের বোতাম লাগিয়ে দেন। বেলটি রাখেন তাঁর ঘরে। প্রয়োজন হলে বাবা বোতাম চাপতেন, তিনি দৌড়ে বাবার কাছে চলে যেতেন। নিজ স্ত্রীকেও বাবার সেবা করতে দিতেন না।
আমি তাঁর কাছে বিচারপতি সাহেবের আরো ঘটনা বলতে অনুরোধ করি।
পুলিশ অফিসার হেসে বললেন, একবার তাঁর আদালতে সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি মামলা আসে। একদিকে স্যুটেড-বুটেড ধনী ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সাথে ছিল দামি আইনজীবী। অন্য পাশে একজন জীর্ণশীর্ণ প্রবীণ লোক। তাঁর ওকিলও গরীব ও সস্তা। বিচারপতি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবাজী, আপনি কী করেন?
প্রবীণ লোকটি উত্তর দিলেন, আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
একথা শুনে বিচারপতি দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, মাশাআল্লাহ, আজ আমাদের আদালতে একজন শিক্ষক এসেছেন। তাই এই শিক্ষক চেয়ারে বসবেন। তাঁর সম্মানার্থে আদালত আজ সারাদিন দাঁড়িয়ে কাজ করবে।
এরপর তাই ঘটেছিল। সেই প্রবীণ শিক্ষক চেয়ারে বসে ছিলেন। আর বিচারপতি, তাঁর স্টাফ ও আইনজীবীদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেন। বিচারপতি সব মোকাদ্দমা নিষ্পত্তি করার পর বৃদ্ধ শিক্ষকের মামলা শোনেন এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিষ্পত্তি করে দেন।
জিজ্ঞেস করলাম, বিচারপতি সাহেব কি হায়াতে আছেন?
উত্তর ছিল, হাঁ, তবে তিনি অসুস্থ এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
পুলিশ অফিসার মানিব্যাগ থেকে পাঁচ শ রুপির পুরোনো নোট বের করলেন। আমার সামনে রেখে বললেন, এই সেই পাঁচ শ রুপি। আমি আজও আমার পকেটে তাবিজের মতো রাখি।
আমি নোট হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে ফেরত দিলাম। তিনিও চুমু খেলেন। আবার মানিব্যাগে রেখে দিলেন।
ওটা আসলেই তাবিজ ছিল। একজন সত্যিকারের মানুষ তা স্পর্শ করেছিলেন।
[এক্সপ্রেস নিউজ (১০ ডিসেম্বর ২০২৩) থেকে
অনুবাদ : ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]