ট্রান্সজেন্ডারবাদ : বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ
ট্রান্সজেন্ডারবাদ নামে একটি ঈমান বিধ্বংসী ও শরীয়ত পরিপন্থী এমনকি গোটা মানবতার জন্য ধ্বংসাত্মক মতবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু হয়েছে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশ, যেখানে এমনিতেই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ রয়েছে, তারাও এখন এ মতবাদের খপ্পরে পড়েছে এবং এর ভয়াবহ পরিণতিগুলোর মুখোমুখি হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ চিন্তা-চেতনা ও এ ধরনের কাজ শুধু আখেরাতের কঠিন আযাবেরই কারণ নয়; বরং তা গোটা মানবতার জন্যই হুমকি স্বরূপ। আমাদের এদেশেও কিছু কিছু প্রচার মাধ্যম, এনজিও এবং একটি চিহ্নিত ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণি এ মতবাদের প্রচার-প্রসারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। যার প্রভাব পড়েছে ক্ষমতাসীন মহলেও। এমনকি ‘ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০২৩ (খসড়া)’ নামে একটি আইন সংসদে পাশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এহেন প্রেক্ষাপটে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন দেশের সচেতন নাগরিকগণ। তাদের অনেকে দ্বীনী মহলগুলোতে এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করানোর আবেদন-নিবেদন নিয়েও দৌড়াচ্ছেন। এরই প্রেক্ষিতে একটি সম্মিলিত ফতোয়া তৈরির কাজও অগ্রসরমান রয়েছে। সময়ের প্রয়োজন বিবেচনায় ট্রান্সজেন্ডারবাদ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ মাসিক আলকাউসারের পাঠকদের সচেতনতা ও সতর্কতার জন্য পেশ করা হল। ―সম্পাদক
সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই বাংলাদেশ। যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৯১.০২ শতাংশ। অধিকাংশ মানুষই ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে সচেষ্ট। এদেশের আদালতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। প্রকাশ্যে বেহায়াপনা ও অসামাজিক কার্যকলাপ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু তার পরও এদেশে ধর্ষণ, পরকীয়া ও এর জেরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। প্রিয় পাঠক! চলুন, এ সম্পর্কিত একটি পরিসংখ্যান দেখে নেই।
সময় নিউজ-এ ‘লাইট হাউস’-এর বরাতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে―
২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩৬০ নারী : লাইট হাউস
দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে আবার ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩ উপলক্ষে সোমবার (৬ মার্চ) ‘মিডিয়া অ্যাডভোকেসি’ শীর্ষক এক সভায় এসব তথ্য জানায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইট হাউস। ―সময় নিউজ, ৬ মার্চ ২০২২
ডেইলি স্টার বাংলার শিরোনাম হল, ‘১০ বছরে দেশে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি ধর্ষণ, করোনাকালে সবচেয়ে বেশি।’
মূল সংবাদে বলা হয়েছে, ‘দেশে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণ হয়েছে ২০২০ সালে। সে বছর দেশে করোনা মহামারি শুরু হয়। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে দেশে ৯ হাজার ৬৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৭৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।... গত ১০ বছরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭২ জনকে এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০৩ জন।...’ ―দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৬ নভেম্বর ২০২২
এবার হাল আমলের বিশ্বে ঘটে যাওয়া কিছু বিচিত্র সংবাদ দেখে নেওয়া যাক।
গত ৫ জানুয়ারি ২০২৪, কলারোয়া নিউজ-এর প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম―‘কলারোয়ায় দুই কিশোরীর সমকামী প্রেম, বিয়ে করতে অনড়, অবশেষে আটক।’ মূল সংবাদ থেকে জানা যায়, এক বিবাহিত বান্ধবীর প্রেমের টানে সাতক্ষীরার কলারোয়ার এক কিশোরীর কাছে ছুটে আসে সুনামগঞ্জের এক কিশোরী।
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সংবাদে আশুলিয়ার রাকিব হাসান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই ঢাকা জেলার এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, গ্রেপ্তারের পর চম্পা ওরফে স্বপ্না জানিয়েছেন, তিনি একজন স্বাভাবিক পুরুষ ছিলেন। তাঁর নাম ছিল নওশাদ। তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে রয়েছে। তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন এবং কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবনযাপন করেন। ওইসময় দেলু হিজড়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দেলু প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক পুরুষ। হিজড়া সেজে নানা অপকর্ম করেন। তিনি নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেন। দেলু জানান, হিজড়া হলে তিনি সহজে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। সেই সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তিতে দিনযাপন করতে পারবেন। তাঁর কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেন। ―দৈনিক সমকাল, ২৮ নভেম্বর ২০২৩
দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম, ‘নারী থেকে পুরুষ হয়েছেন তিনি, এখন জটিলতা বাংলাদেশ রেলওয়ের চাকরিতে’
বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়েছে, শারমিন আক্তার ঝিনুক ওরফে ঝিনুক সওদাগর নামের মেয়েটির বর্তমান নাম জিবরান সওদাগর। শুধু নাম পরিবর্তন নয়, অস্ত্রোপচার করে ৩০ বছর বয়সী ঝিনুক এখন একজন পুরুষ। নারী-পুরুষের ফেরে রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না তিনি। এক নারীকে ভালোবাসলেও তিনি অন্য পুরুষকে বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন। ―দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মার্কিন টিভি উপস্থাপক ড. ফিলের উপস্থাপনায় একটি টিভি লাইভ শোতে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় গ্যারি নামের জনৈক বাবা নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি তার ছেলেকে সেখানে প্রথমবারের মতো একজন নারী হিসেবে দেখতে পান।
ইন্টারভিউয়ে গ্যারি বলেন, আমি শুধু ক্ষতিই অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি। ...ওকে মেয়ে হিসেবে কীভাবে গ্রহণ করব বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ভুল হয়েছে।
ড. ফিল প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি এটা আপনার দোষ?
জবাবে গ্যারি বলেন, আমি বিশ্বাস করি এটা আমারই দোষ।
এরপর ড. ফিল ইনসাইড ইডিশনকে বলছিলেন, তিনি বিষয়টি উদ্যাপন করছিলেন না। তার কাছে বিষয়টি ছিল এ রকম যে, মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ। বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি।
উল্লেখ্য, গ্যারির ট্রান্স মেয়ের নাম স্টেফ (Steph)। যে পূর্বে ছেলে ছিল এবং তার নাম ছিল জ্যাক (Zach)। সে একজন বিবাহিত ও মার্কিন সেনা এমপি ছিল। ―ইনসাইড এডিশন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
নিউ ইয়র্ক পোস্টে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘নিউজার্সি কারাগারে দুই সহবন্দিকে গর্ভবতী করলেন ডেমি মাইনর নামের এক ট্রান্স নারী’
বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়েছে, খুনের দায়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ২৭ বছর বয়সী ডেমি মাইনর (Demi Minor) নামের এক ট্রান্স নারীকে মহিলা কারাগারে রাখার পর তার দ্বারা সেখানে দুইজন নারী সহবন্দি গর্ভবতী হওয়ার ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বার্লিংটন কাউন্টিতে অবস্থিত তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের একটি কারাগারে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছেন। যেখানে সে একমাত্র নারী হিসেবে আছে। ―নিউ ইয়র্ক পোস্ট, ১৭ জুলাই ২০২২
যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত দেশ স্কটল্যান্ডে পুরুষ থাকাকালে দুজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে একজন ট্রান্স নারীকে গ্রেপ্তারের পর তাকে নারী কারাগারে পাঠানো হয়। এ নিয়ে সেদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ―ফক্স নিউজ, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩
সম্প্রতি জাপানের কিয়োটোর অধিবাসী জ্যাকি (Jackie) একটি অ্যামেবা প্রাইম (AMEBA Prime) রিয়েলিটি শোতে তার গল্প শেয়ার করার সময় নিজেকে ২৮ বছরের ট্রান্স-এজ দাবি করেছেন। যার মূল বয়স ৩৯ বছর, জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৮৪ সালে। ―মাস্ট শেয়ার নিউজ, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩; নেক্সট শার্ক, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মেলোডি ওয়াইজহার্ট (Melody Wiseheart) নামের ৫০ বছর বয়সী একজন পুরুষ নিজেকে ট্রান্স-এজ ও ট্রান্স নারী দাবি করে ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৯ জন তরুণীর সাথে কানাডার একটি আঞ্চলিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ―দ্য ওয়েস্টার্ন জার্নাল, ২৭ অক্টোবর ২০২৩; বেরেল নিউজ, ২৪ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির বার্লিন পটসামের প্লাটজ রেলপথ স্টেশনে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রায় ১০০০ মানুষ জড়ো হয়েছিল। যারা নিজেদেরকে ‘কুকুর’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে এবং তারা সেখানে একে অপরের সাথে চিৎকার বা ঘেউ ঘেউ করে যোগাযোগ করছিল। ―নিউ ইয়র্ক পোস্ট, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩; ডেইলি মেইল, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ফক্স নিউজ-এর শিরোনাম ‘ট্রান্সজেন্ডার থেকে ট্রান্সঅ্যাবলড : মানুষ এখন নিজেকে প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচিত হওয়াকে বেছে নিচ্ছে।
মূল সংবাদে বলা হয়েছে, বর্তমানে ট্রান্সঅ্যাবলবাদ নামে একটি ঝামেলাপূর্ণ সামাজিক সমস্যা উদ্বেগ তৈরি করছে।
ট্রান্সঅ্যাবলবাদ হল BIID বা বডি ইন্টিগ্রিটি আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার-এর জন্য ব্যবহৃত একটি নতুন পরিভাষা। যেখানে একজন ব্যক্তি নিজেকে প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচয় দেয়। ―ফক্স নিউজ, ২৮ এপ্রিল ২০২৩
জী, পাঠক! এটাই এখন বাস্তবতা!! একদিকে বিশ্ব যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উৎকর্ষের দাবিদার। চাঁদ-মঙ্গল জয় করে মানুষ যখন ছুটছে সমুদ্রের অতলে, ঠিক তখনই কিছু মানুষ নিজের পরিচয় নিয়েই সংশয়ের শিকার। কেউ তো নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের পরিচয় দিচ্ছে, কেউবা আবার কুকুর, প্রতিবন্ধী পরিচয় দিতে পছন্দ করছে।
ট্রান্সজেন্ডারবাদ
বর্তমান বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডারবাদ নামে নতুন একটি উদ্ভট মতবাদের সূচনা হয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য হল, একজন পুরুষের যদি নিজেকে নারী বলে মনে হয় ,তাহলে সে নারী। অনুরূপ কোনো নারীরও যদি নিজেকে পুরুষ মনে হয়, তাহলে সে পুরুষ। সমাজ ও আইন তাদেরকে সে হিসেবেই বিবেচনা করবে। আর তারা চিকিৎসার মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করারও অধিকার রাখে।
ট্রান্সজেন্ডারবাদের সূচনা
মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে ট্রান্সজেন্ডার তথা জেন্ডার আইডেন্টিটি শব্দটি একটি গোষ্ঠী বা আম্ব্রেলা টার্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা নন-বাইনারি ও এলজিবিটি-এর সমার্থক শব্দ। ১৯৬৫ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সাইক্রিয়াটিস্ট প্রফেসর John F. Oliven ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। এটা (Transsexualismus) জার্মান শব্দ হিসেবে ১৯২৩ সালে প্রথম প্রবর্তন হয়। এরপর এই শব্দের বিবর্তন ঘটে Transsexual হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ছিল। শুরুর দিকে ট্রান্সজেন্ডার বলতে যারা লিঙ্গ পরিবর্তন করতে হরমোন ও সার্জারির আশ্রয় নিত, তাদেরকে বোঝানো হত। ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞা এখন অনেক ব্যাপক; এমনকি যারা ক্রসড্রেসার (যারা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক ও বেশভূষা গ্রহণকারী অর্থাৎ ছেলে যদি মেয়েদের ড্রেস পরতে আকর্ষিত হয়)।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এটা বর্তমানে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা মেডিক্যাল প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে না; মনের ইচ্ছাধীন বিষয়। অর্থাৎ যে কেউ যে কোনো সময় নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার ঘোষণা দিতে পারে। যেদিন থেকে কারো মনে হয় যে, সে জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ে আগ্রহী বা বিশ্বাসী নয়, সেদিন থেকে নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে পরিচয় দিতে পারে। ―ট্রান্সজেন্ডারিজম মতবাদ এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপট, ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, পৃষ্ঠা : ৭-৮
মতবাদটির প্রভাবশালী এক প্রচারক সংস্থার ভাষায়―
Transgender is a term used to describe people whose gender identity differs from the sex they were assigned at birth. Gender identity is a person’s internal, personal sense of being a man or a woman (or boy or girl.) For some people, their gender identity does not fit neatly into those two choices. For transgender people, the sex they were assigned at birth and their own internal gender identity do not match. ...
As part of the transition process, many transgender people are prescribed hormones by their doctors to change their bodies. Some undergo surgeries as well. But not all transgender people can or will take those steps, and it’s important to know that being transgender is not dependent upon medical procedures.
অর্থ : ট্রান্সজেন্ডার একটি পরিভাষা। যার দ্বারা এমন লোকদের বোঝানো হয়, যাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মের সময় নির্ধারণ হওয়া লিঙ্গ পরিচয় থেকে ভিন্ন। লিঙ্গ পরিচয় হল, সে কি পুরুষ, না নারী―এ ব্যাপারে তার মানসিক বোধ। আর এই শ্রেণির মানুষের সেই মানসিক বোধ তার জন্মের সময় যে লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ হয়েছিল এর থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। ...আর কিছু কিছু ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি হরমোন থেরাপি গ্রহণ করে থাকে, আবার তাদের কেউ সার্জারিও করে। তবে সব ট্রান্সজেন্ডার এগুলো করে না বা করতে পারে না। এবং এটি জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তন করে ট্রান্সজেন্ডার হওয়া―কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল নয়। দেখুন― https://glaad.org/transgender/transfaq/
ট্রান্সজেন্ডারবাদের শরয়ী দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনার পূর্বে জাগতিক বিচারে এর অসারতা, অযৌক্তিকতা ও মানব সম্প্রদায়ের জন্য এর ভয়াবহতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা দরকার।
পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত গোটা মানব সম্প্রদায়কে আল্লাহ তাআলা পুরুষ ও নারী দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে দিয়েছেন। আবার নারী-পুরুষ সৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পাশাপাশি প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও ভিন্ন করে দিয়েছেন। আর নিজ নিজ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব-কর্তব্যের উপযোগী করে নারী-পুরুষের প্রত্যেককে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভিন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকের জন্য দিয়েছেন পৃথক পৃথক জীবনব্যবস্থা, বিধিবদ্ধ করেছেন শরীয়তে ইসলামীর পৃথক বিধিবিধান। যার ওপর ভিত্তি করেই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ মহাজগতের সবকিছু সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছে।
বলাবাহুল্য, ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি অনুযায়ী পৃথিবীতে কোনো লিঙ্গ পরিচয় থাকবে না। শারীরিক লিঙ্গ বিবেচনায় মানুষের পরিচয় নির্ণয় হবে না; বরং মানসিক ইচ্ছাটাই হবে তার প্রধান পরিচয়। কেউ যদি তার জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ে আগ্রহী বা বিশ্বাসী না হয়, তাহলে সে মনের ইচ্ছাধীন যে কোনো সময় নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার ঘোষণা দিতে পারবে। অর্থাৎ একজন পুরুষের যদি নিজেকে নারী বলে মনে হয়, তাহলে সে নারী। অনুরূপ কোনো নারীরও যদি নিজেকে পুরুষ মনে হয়, তাহলে সে পুরুষ।
ভাবতে অবাক লাগে, এটিও একটি মতবাদ হতে পারে! আধুনিক বিশ্বেও ট্রান্সজেন্ডারবাদকে মানুষ মেনে নিতে পারে! আরো অবাক হই, যখন দেখি, এই মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য বিশ্ব মোড়লরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এবং দেশে দেশে এর স্বীকৃতি আদায়ে রীতিমতো চাপ প্রয়োগ করে।
বস্তুত ট্রান্সজেন্ডারবাদ মতবাদটি এতটাই অসার ও অযৌক্তিক যে, এর ফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র; বরং গোটা পৃথিবীতেই বিপর্যয় নেমে আসবে। যেমন ধরুন, রফিক সাহেবের ৪ মেয়ে। তাদের একটি ছেলের খুব শখ। অনেক দুআ-প্রার্থনার পর তার ঘরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হল। রফিক সাহেব তো মহা খুশি। এলাকার সবাইকে তিনি দাওয়াত করে খাইয়েছেন। ছেলের আদর-যত্নের যেন কোনো কমতি নেই। ছেলেকে নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন! ছেলেকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করাবেন। লেখাপড়া শেষে ভালো একটা চাকরি করবে। এরপর ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ ঘরে আনবেন। শেষ বয়সে তারা ছেলে ও ছেলের বউ এবং তাদের নাতি-নাতনি নিয়ে মহাসুখে দিন কাটাবেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ছেলেকে নামকরা একটা স্কুলে ভর্তি করালেন। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেল। ছেলের বন্ধু-বান্ধব, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ এলাকার সবার মুখেই তিনি ছেলের প্রশংসা শোনেন। এমন একটি ছেলের পিতা হতে পেরে নিজেকে তিনি গর্বিত বোধ করেন। কিন্তু ছেলেকে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করানোর জন্য রফিক সাহেব যখন খুব উদ্বিগ্ন। ঠিক তখনই যেন তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। কারণ একদিন তিনি শুনতে পারলেন, তার ছেলেটি নাকি মেয়ে হয়ে গিয়েছে! এখন থেকে রফিক সাহেবের ছেলের নিজেকে মেয়ে মনে হচ্ছে। তাই আইন ও সমাজসহ সকলের তাকে মেয়ে হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
আচ্ছা ধরে নিলাম, সে এখন মেয়ে। সমাজ ও আইনের চোখেও সে এখন থেকে মেয়ে হিসেবেই বিবেচিত হবে। কিন্তু এই বিবেচনাতেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? ধরুন, রফিক সাহেব তাকে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে একটা ওমেন্স কলেজে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে গেলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে আইনী কারণে মেয়ে হিসেবেই বিবেচনা করলেন এবং ভর্তিচ্ছু অন্যান্য মেয়েদের মতো তার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণের জন্য এসএসসির সার্টিফিকেট, মার্কশিট ইত্যাদি কাগজপত্র দেখলেন। কিন্তু সেখানে সবকিছুতেই তো ছেলের নাম লেখা। তাহলে কলেজ কর্তৃপক্ষ কীভাবে নিশ্চিত হবেন যে, এই মেয়েই আগে ছেলে ছিল আর এই সার্টিফিকেট, মার্কশিটসহ সকল কাগজপত্র এই মেয়ের?
হয়তো কেউ সমাধান বাতলে দিতে পারেন যে, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তার পূর্বের সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো সংশোধন করে নেবে।
আবার কলেজের পাঠ চুকিয়ে যখন সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে, তখন যদি আবার সে নিজেকে ছেলে মনে করে বসে? এমনিভাবে যখন চাকরির সময় হবে তখনো আবার সে নিজেকে মেয়ে মনে করে বসতে পারে। আচ্ছা, তার জীবনের এসব ধাপ ও পর্যায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি অনুযায়ী, যার যখন নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের মনে হয় তখন থেকেই সে ওই লিঙ্গের বলেই বিবেচিত হবে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো সময় বা পর্যায় নেই এবং বিপরীত লিঙ্গের মনে করার নির্দিষ্ট কোনো সীমা-পরিসীমাও নেই। এটাই যদি হয় অবস্থা, তাহলে সবার আগে তার ব্যক্তিগত জীবনটাই প্রভাবিত হবে। কেননা, একটা ছোট্ট ছেলেকে তার বাবা-মা কত যত্ন করে ছেলে হিসেবে প্রতিপালন করেছেন। ছেলেদের যত বিষয়-আশয় থাকে সবকিছু তার জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তার কাপড়-চোপড়, পোশাক-আশাক, বন্ধু-বান্ধব ও চলাফেরা সবকিছুই ছিল ছেলেদের মতো। এখন হঠাৎ করে সে মেয়ে হওয়ায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ, বন্ধু-বান্ধব, চলাফেরা সবকিছুই পরিবর্তন করতে হবে। আর মেয়ে হিসেবে তার জন্য বাবা-মায়েরও মেয়েদের সকল আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কদিন পর যখন আবার সে নিজেকে ছেলে মনে করবে তখন আবার নতুন করে তার জন্য ছেলেদের ব্যবস্থাপনা দরকার হবে।
আচ্ছা, চাকরি-বাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার যখন বিয়েশাদির বিষয় আসবে তখন তার অভিভাবকগণ কি তাকে ছেলে মনে করে তার জন্য মেয়ে খুঁজবে, নাকি মেয়ে ভেবে ছেলে খুঁজবে? ধরে নিলাম, অভিভাবকরা বিয়ের সময় তাকে ছেলে মনে করেই তার জন্য পছন্দের একটি মেয়েকে বউ হিসেবে ঘরে আনলেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর দুয়েকটি বাচ্চা-কাচ্চা হওয়ার পর যদি ছেলের বউ নিজেকে ছেলে মনে করে কিংবা এই ছেলেই আবার নিজেকে মেয়ে মনে করে বসে?
তাহলে দেখা গেল, এতে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি তার সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের আচার-ব্যবহার নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে। কেননা, মহল্লার একটি ছেলে যখন সবার সামনে বেড়ে ওঠে। এলাকার সমবয়সী অন্যান্য ছেলেদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। এলাকার বড় ভাই, মুরব্বি ও অন্যান্য লোকজনের সাথে তার একটা যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। সবাই তাকে একটি ছেলে হিসেবেই তার সাথে ব্যবহার করে। এখন হঠাৎ করে যদি এই ছেলেটি নিজেকে মেয়ে মনে করার কারণে তাকে মেয়ে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে তার এতদিনের বন্ধু-বান্ধব, মুরব্বি ও অন্যান্য লোকজনের সাথে তার সম্পর্কের অবস্থা কী দাঁড়াবে? আবার এলাকার একটি মেয়ে যখন হঠাৎ করে নিজেকে ছেলে মনে করে এবং এলাকার অন্যান্য ছেলেদের সাথে ওঠাবসা করতে থাকে, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে?
আর যদি কারো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে কিংবা কেউ তার কোনো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এমনটি করে থাকে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের অবস্থা তো হবে আরো ভয়াবহ। যেমন, কোনো অসাধু ছেলে যদি কোনো মেয়ের সাথে প্রতারণা করে। তার সাথে সম্পর্কে জড়ায়। কৌশলে তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় এবং তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এরপর মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ তৈরি করলে ছেলেটি নিজেকে মেয়ে দাবি করে বসল এবং মেয়েটির নামে থানায় নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিল। তাহলে এর মীমাংসার কোনো পথ বা উপায় কি কেউ একটু বাতলে দিতে পারবেন?!
মোটকথা, কোনো ছেলে বা মেয়ে যখন তখন নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের মনে করলেই যদি তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপরীত লিঙ্গের বলেই মেনে নিতে হয়, তাহলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপর্যয় কোন্ স্তরে গিয়ে পৌঁছবে, কেউ কি তা একটু ভেবে দেখেছেন?
প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা এড়ানোর জন্য কেউ হয়তো পরামর্শ দেবেন, যখনই কারো বিপরীত লিঙ্গের মনে হবে তখন সাথে সাথেই তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে লিঙ্গ পরিবর্তনের ঘোষণা দেবেন এবং অন্যান্য তথ্য সংশোধন করে নেবেন। জী, এটাও একটা সহজ(?) সমাধান। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট দেশে পদার্পণের দাবিদার বাংলাদেশে বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা স্মার্ট কার্ডে কারো নাম ভুল হলে কিংবা ভুল বানান সংশোধনের জন্য যে সময় ও প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে সকাল-বিকাল; বরং যখন তখন একজন নাগরিকের তথ্য সংশোধন ও হালনাগাদকরণ সত্যি অনেক সহজ সমাধানই বটে।
আচ্ছা, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট না হয় বাদই দিলাম। কোনো মুসলিম দেশের কথাও না হয় না-ই বললাম। অবাধ মেলামেশার দেশগুলোর কথাই একটু ভেবে দেখুন তো। যেসব দেশে অবাধ মেলামেশা ও বিকৃত উপায়ে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সুযোগ থাকে এবং আইনী ও সামাজিকভাবেই তা বৈধ, ঐসব দেশের অবস্থাটাইবা কী হবে? আর অবাধ মেলামেশার দেশ বা সমকামিতাকে আইনীভাবে বৈধতা দেয়া দেশগুলোতেইবা কেন প্রয়োজন পড়বে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠা করার? সেসব দেশে তো যে কেউ যথেচ্ছভাবে প্রবৃত্তি চরিতার্থের সুযোগ পায়। এর পরও কেন সেখানে ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন থাকে? আর সেসব দেশগুলোতে কি আসলেই ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব? না। সেসব দেশেও এটাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে খুনের দায়ে ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ২৭ বছর বয়সী ডেমি মাইনর নামের এক ট্রান্স নারীকে মহিলা কারাগারে রাখার পর তার দ্বারা সেখানে দুইজন নারী সহবন্দি গর্ভবতী হওয়ার ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের একটি কারাগারে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছেন।
কেউ হয়তো বলবেন, কারা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য পৃথক সেলের ব্যবস্থা করা। আচ্ছা, মেনে নিলাম এটিও একটি সহজ ব্যবস্থা। কিন্তু প্রশ্ন হল, ট্রান্সজেন্ডারদের সবাইকে যদি পৃথক সেলেই রাখা হয়, তাহলে কি এতে ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রতিষ্ঠা হল? কারণ ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি তো হল, কোনো ছেলে নিজেকে মেয়ে মনে করলে তাকে মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করতে হবে আর কোনো মেয়ে নিজেকে ছেলে মনে করলে তাকে ছেলে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে বাস্তবে তো তাদের দাবি মানা হল না। তাদেরকে বরং তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেই বিবেচনা করা হল। তাহলে আদৌ কি ট্রান্সজেন্ডারবাদকে সেসব দেশে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব?
এবার দেখা যাক, যুক্তির বিচারেও কি ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব? না। সাধারণ যুক্তির বিচারেও ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা আমরা দেখি, মানুষ সাধারণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। পুরুষ ও নারী। প্রত্যেকের শরীর ও মন ভিন্ন ভিন্ন। মেয়েরা নিজেকে যতই পুরুষের সমান বলে দাবি করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা কখনও সম্ভব নয়। কারণ শারীরিক গঠন, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও মন-মানসিকতায় নারীর পক্ষে কখনও পুরুষের সমান হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়াও মেয়েদের রয়েছে বহুবিধ দুর্বলতা। এতকিছুর পরও একজন মেয়ে নিজেকে ছেলে দাবি করলে বা মনে করলেই সে ছেলে হয়ে যেতে পারে না। এমনকি সার্জারি করে ছেলেদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলেও এবং হরমোনের পাওয়ারফুল ঔষধ সেবনের পরও তার পক্ষে ছেলের সমান হওয়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে একজন ছেলে সার্জারির মাধ্যমে মেয়েদের সকল অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে নিলেও সে মেয়ে হয়ে যায় না। আর এ কারণেই দেখা যায়, ট্রান্স নারীর সাথে সাধারণ নারীরা পেরে উঠতে পারে না। যেমন, আউট স্পোর্টস নামের একটি ওয়েব সাইটে ২৩ জন ট্রান্স নারীর উল্লেখ করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে জয়ী হয়েছে। ―আউট স্পোর্টস, ৬ আগস্ট ২০২১
এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন ট্রান্স নারী নারীদের ইভেন্টে অংশগ্রহণ করলেও বাস্তবে সে তো পুরুষ। তাই সাধারণ নারীরা তার সাথে পেরে উঠবে কীভাবে? ফলে স্বাভাবিকভাবেই মহিলা ইভেন্টে ট্রান্স নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
আর সঙ্গত কারণেই অবাধ মেলামেশা ও সমকামিতার দেশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোতেও ট্রান্সজেন্ডারবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ঘোষণা দিয়েছেন, কেউ চাইলেই লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না। ―দৈনিক প্রথম আলো, ০৬ অক্টোবর ২০২৩
রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত ‘আন্তর্জাতিক এলজিবিটি পাবলিক মুভমেন্ট’কে একটি চরমপন্থী সংগঠন ঘোষণা করেছে এবং দেশজুড়ে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। ―বিবিসি, ৩০ নভেম্বর ২০২৩; সিএনএন, ৩০ নভেম্বর ২০২৩; দ্য গার্ডিয়ান, ৩০ নভেম্বর ২০২৩
ফেব্রুয়ারিতে সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে রঙধনু পতাকা বিতরণের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। ―দ্য ডিপ্লোমেট, ২৮ এপ্রিল ২০২৩; নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৩ জুন ২০২৩
উগান্ডায় সমকামিতা আগে থেকেই অবৈধ ছিল। কিন্তু মে মাসে নতুন আইনের মাধ্যমে এর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক উগান্ডার নতুন ঋণ স্থগিত করেছে। ―বিবিসি নিউজ, ৯ আগস্ট ২০২৩; রয়টার্স, ৯ আগস্ট ২০২৩
মালয়েশিয়ায় সমকামিতা নিষিদ্ধ। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মে মাসে দেশের ১১টি শপিং মলের সোয়াচ স্টোরে এলজিবিটি উপাদান সম্বলিত টাইমপিস উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কেউ এ ধরনের সামগ্রী মুদ্রণ, আমদানি, উৎপাদন করলে ... অথবা কারো কাছে এ ধরনের সামগ্রী পাওয়া গেলে তার ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আর কেউ এ ধরনের ঘড়ি পরলে বা বিতরণ করলে তার ২০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা হতে পারে। ―দ্য গার্ডিয়ান, ১০ আগস্ট ২০২৩
কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে ট্রান্সজেন্ডারদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ―সিএনএন, ১৯ নভেম্বর ২০২২; দ্য গার্ডিয়ান, ১৩ মে ২০২২
১৯ মে ২০২৩ শুক্রবার পাকিস্তানের ফেডারেল শরীয়ত কোর্ট (এফএসসি) কোনো ব্যক্তি ইচ্ছামতো তার লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবেন না এবং ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি (অধিকার সুরক্ষা) আইন, ২০১৮-এর কয়েকটি ধারা শরীয়া পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি (অধিকার সুরক্ষা) আইন, ২০১৮ পাশের পর সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে দায়ের করা পিটিশনের জবাবে আদালত এই রায় প্রদান করেন।
বিস্তারিত রায়ে বলা হয়েছে, আমরা এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, কুরআন ও সুন্নাহর ইসলামী বিধান অনুসারে একজন ব্যক্তির লিঙ্গ তার জৈবিক লিঙ্গের অধীন। সুতরাং একজন ব্যক্তির লিঙ্গ অবশ্যই তার জৈবিক লিঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।...
রায়ে আরো উল্লেখ করা হয় যে, আমরা লক্ষ্য করেছি, ধারা-২ (এন) ও ইমপ্লিমেন্টেড অ্যাক্টের পাঁচটি ভিন্ন পরিভাষা; যথা (১) উভলিঙ্গ, (২) নপুংসক (৩) রূপান্তরকামী পুরুষ, (৪) রূপান্তরকামী নারী এবং (৫) খাজাসিরা ব্যক্তিদেরকে ‘হিজড়া ব্যক্তি’র একই সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ উভলিঙ্গ, নপুংসক ও খাজাসিরা শব্দগুলি কোনো ব্যক্তির যৌন বৈশিষ্ট্যের জৈবিক বৈচিত্র্যকে বোঝায়, যা পুরুষ বা মহিলা শ্রেণিবিন্যাসের সাথে খাপ খায় না। অন্যদিকে রূপান্তরকামী পুরুষ ও রূপান্তরকামী নারী বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায়, যার স্ব-অনুভূত লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গ বা জৈবিকভাবে তাদের লিঙ্গ থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। ―ডন, ১৯ মে ২০২৩
বোঝা গেল, সাধারণ যুক্তির বিচারেও ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো একটি উদ্ভট ও অসার মতবাদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়।
বস্তুত এটা কোনো মতবাদই নয়; বরং স্রেফ কোনো পাগলের পাগলামি ও তার বিকৃত মন-মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
ট্রান্সজেন্ডারবাদের শরয়ী দৃষ্টিকোণ
জাগতিক বিচারে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এবার শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অবস্থান আলোচনা করা হচ্ছে।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি স্পষ্ট কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদ। এতে রয়েছে সৃষ্টির বিকৃতি ও শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও এটি সাধারণ রীতি-প্রকৃতি ও ইসলামের সুমহান আদর্শ পরিপন্থী একটি মতবাদ। নিম্নে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হল।
এক. ‘যিনার নিকটেও যেও না’ বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন
দুনিয়াতে মানুষের বংশধারা অব্যাহত রাখা ও বংশ পরিচয় সংরক্ষণ এবং পরিবার ও সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইসলাম যেসব যুগান্তকারী বিধান দিয়েছে তার মধ্যে একটি হল যিনা-ব্যভিচার থেকে সর্বতোভাবে বেঁচে থাকা। শুধু ব্যভিচার থেকেই নয়; বরং যেসব কাজকর্ম ও আচার-আচরণ মানুষকে ব্যভিচারে প্রলুব্ধ করে এবং মানুষকে ধীরে ধীরে ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে, সেসব থেকেও বেঁচে থাকার আদেশ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের অমোঘ ঘোষণা―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর তোমরা যিনার নিকটবর্তীও হয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। ―সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩২
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, বান্দাদের জন্য ব্যভিচার ও এর নিকটবর্তী হওয়াকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর ব্যভিচারের উপকরণ ও উপলক্ষগুলোতে জড়ানোই হল তার নিকটবর্তী হওয়া। ―তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৭২
উক্ত বিধানটি নিশ্চিত করার জন্য যিনা-ব্যভিচারের সকল উপলক্ষগুলোকেও শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, যিনা-ব্যভিচারের একটি প্রধান উপলক্ষ হল দৃষ্টি। অর্থাৎ কোনো পুরুষ পরনারীকে দেখলে কিংবা কোনো নারী পরপুরুষকে দেখলে তার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। মনের অজান্তেই তার প্রতি আকর্ষণ জাগ্রত হতে পারে। যা একসময় ব্যভিচার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। তাই পর-নারী পুরুষের পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ ও একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে। তেমনিভাবে নারীকে পর-পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে―
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْنَ، وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوْبِهِنَّ.
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তাদের কৃত কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চয়ই অবগত। আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। সাধারণত যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। আর তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে...। ―সূরা নূর (২৪) : ৩০-৩১
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন―
لَا يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ، وَلَا الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ، وَلَا يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى الرَّجُل فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ، وَلَا تُفْضِي الْمَرْأَةُ إِلَى الْمَرْأَةِ فِي الثَّوْبِ الْوَاحِدِ.
কোনো পুরুষ অপর পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোনো নারী অপর নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। কোনো পুরুষ এক কাপড়ের নিচে অপর পুরুষের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না এবং কোনো নারী এক কাপড়ের নিচে অপর নারীর শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না। ―সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৯৩
তেমনিভাবে পর-নারী ও পর-পুরুষের সাথে নির্জনে বা একান্তে অবস্থানকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
لاَ يَخْلُوَنّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ.
কোনো পুরুষ যেন অপর নারীর সাথে একান্তে অবস্থান না করে। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৬৫
এমনকি নারীকে তার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত একাকী কিংবা অন্য নারীর সাথে হজে¦র মতো ফরয বিধান পালন করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا تَحُجّنّ امْرَأَةٌ إِلّا وَمَعَهَا ذُو محْرمٍ.
মাহরাম ব্যতীত কোনো নারী যেন হজ¦ না করে। ―সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ২৪৪০
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬
আর সঙ্গত কারণেই সন্তানের বয়স দশ বছর হলে তাদের শয্যা পৃথক করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ.
তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাযের আদেশ করো। আর দশ বছর হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরের শয্যা পৃথক করে দাও। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের এক স্বভাবজাত প্রকৃতি। নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষের মাঝে এই আকর্ষণ জাগ্রত হয়। পৃথিবীর শুরু থেকে সকল যুগে ও সকল ধর্মে এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিধান ছিল। সর্বশেষ শরীয়ত ইসলামে যেমন ধর্ষণ-ব্যভিচার হারাম ও নিষিদ্ধ তেমনি পূর্ববর্তী ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ সকল ধর্মেও তা নিষিদ্ধ ছিল। দুনিয়ার সাধারণ রীতি, জ্ঞান-যুক্তি ও বিজ্ঞান সকল বিচারেই তা যথার্থ।
ইসলামী শরীয়ত একদিকে যেমন এই আকর্ষণকে নিয়ন্ত্রিত রাখার আদেশ করে অন্যদিকে তা চরিতার্থ করার জন্যও দিয়েছে সুন্দর ও সুমহান বিধান। একদিকে যেমন ঘোষণা হয়েছে―
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ.
যে তার দুই চোয়াল ও দুই উরুর মধ্যস্থিত অঙ্গের (জিহ্বা ও লজ্জাস্থান) জামানত দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪
অন্যদিকে ইরশাদ হয়েছে―
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ.
হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে। আর যার বিয়ের সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোযা তার প্রবৃত্তির চাহিদা প্রশমনকারী। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৬৫
বস্তুত শরীয়তের এই একটি বিধান যদি নিশ্চিত করা যায় এবং ব্যভিচার ও এর সকল উপলক্ষ থেকে মানুষ নিজেকে সংযত রাখতে পারে, তাহলে ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রসহ সর্বত্রই শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। সুখী ও সমৃদ্ধ একটি সমাজ গড়ে উঠবে।
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদ মূলত অবাধ, যথেচ্ছ ও বিকৃত উপায়ে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার দ্বার উন্মোচন করে। যার ফলে সমাজে সমকামিতা, বেহায়াপনা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। বস্তুত মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো সুযোগ তো এতে থাকছেই না; বরং যথেচ্ছ প্রবৃত্তি-চারণের সুযোগ তৈরি হয়।
তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদে সন্তান ধারণ ও সন্তান লালন-পালনের মতো কোনো বিষয় নেই। এগুলো থেকে বরং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডারবাদ শুধু নিজের প্রবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করতে শেখায়। সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের ঝামেলায় জড়াতে উৎসাহিত করে না। এতে করে একদিকে যেমন দুনিয়ায় মানবের বংশধারা ব্যাহত হবে, তেমনি তার বংশবিস্তারও লোপ পাবে। যার দরুন সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বে এক মহাবিপর্যয় তৈরি হবে। অথচ ইসলামী শরীয়তে মানবের বংশ বৃদ্ধিই কাম্য। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
تزوجوا الودود الولود، فإني مكاثر بكم الأمم يوم القيامة.
তোমরা অধিক মহব্বতকারী ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী নারীকে বিয়ে করো। কেননা, কিয়ামতের দিন তোমাদের নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর আধিক্যের গর্ব করব। ―সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৫৯৪
দুই. সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় সুরক্ষিত রাখার বিধান লঙ্ঘিত হয়
ইসলামী শরীয়ত সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এর জন্য সব রকমের সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
الوَلَدُ لِلْفِرَاشِ، وَلِلْعَاهِرِ الحَجَرُ.
সন্তান হল বৈধ স্ত্রীর জন্য আর ব্যভিচারিণীর জন্য হল বঞ্চনা। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৫৮
একারণে বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা ও ব্যভিচারের মাধ্যমে জন্ম লাভকারী সন্তানকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না; বরং তার জন্য ইসলামের পৃথক বিধিবিধান রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
أَيُّمَا رَجُلٍ عَاهَرَ بِحُرَّةٍ أَوْ أَمَةٍ فَالوَلَدُ وَلَدُ زِنَا لَا يَرِثُ وَلَا يُورَثُ.
যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন নারী অথবা বাদীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় (আর এতে কোনো সন্তানের জন্ম হয়) তাহলে সেটা জারজ সন্তান। সে ব্যভিচারী থেকে মিরাস পাবে না এবং ব্যভিচারীও তার থেকে মিরাস পাবে না। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ২১১৩
আর সঙ্গত কারণেই ইসলামে পরকীয়া ও বহুগামিতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ؟ ... قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ.
আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলাম, সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ কী?...
আমি আবারো আরয করলাম, এরপর কোন্টি? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬
রুফাই ইবনে সাবেত আনসারী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا يَحِلُّ لِامْرِئٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يَسْقِيَ مَاءَه زَرْعَ غَيْرِه، يَعْنِي: إِتْيَانَ الْحُبَالَى.
আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির জন্য অন্যের ক্ষেতে সেচ দেওয়া অর্থাৎ গর্ভবতী নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া বৈধ নয়। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৩১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে মানবের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় বলতে কিছুই থাকবে না। কেননা, এই মতবাদ অনুসারে একজন ব্যক্তি ফন্দি খাটিয়ে যখন তখন নিজেকে একেক লিঙ্গের ঘোষণা করে অবাধ বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে পারে।
তিন. নারী-পুরুষ একে অপরের নিষিদ্ধ সাদৃশ্য অবলম্বন
ইসলাম নারী-পুরুষকে একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বন করতেও নিষেধ করেছে। এটি জঘন্যতম কবীরা গুনাহ ও লানতযোগ্য কাজ। হাদীসে এ ধরনের নারী ও পুরুষের প্রতি অভিস¤পাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত―
لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء، والمتشبهات من النساء بالرجال.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর সাদৃশ্য ধারণকারী পুরুষ ও পুরুষের সাদৃশ্য ধারণকারী নারীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৫, ৬৮৩৪
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
ليس منا من تشبه بالرجال من النساء، ولا من تشبه بالنساء من الرجال.
পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারী ও নারীর সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষ আমাদের দলভুক্ত নয়। ―আলজামিউস সগীর, হাদীস ৭৬৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৮৭৫
বলাবাহুল্য, উপরোক্ত সাদৃশ্য দুই ধরনের হতে পারে। যথা : সাময়িক ও অস্থায়ী এবং স্থায়ী। উভয় প্রকারের সাদৃশ্যই নিষিদ্ধ। সাময়িক সাদৃশ্য সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
لعن الله الواشِمات والمستوشمات، والمتنمصات والمتفلجات للحسن، المغيرات خلق الله... .
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য উল্কি আঁকিয়ে ও যে এঁকে দিতে বলে, ভ্রূ উত্তোলনকারী নারী ও দাঁত সরু করে মাঝে ফাঁক সৃষ্টিকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন। কেননা, এগুলো আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেয়। ... ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৫
আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, জনৈকা নারী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! বসন্ত রোগে আমার এক মেয়ের মাথার চুল পড়ে গিয়েছে। আমি তাকে বিয়ে দিয়েছি। আমি কি তার মাথায় পরচুলা স্থাপন করব? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন―
لعن الله الواصلة والمَوصولة.
পরচুলা স্থাপনকারী নারী ও পরচুলা ব্যবহারকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলার অভিসম্পাত। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪১
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫০৯৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪১৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৩
আর স্থায়ী সাদৃশ্য (যা ‘তাবদীলু খালকিল্লাহ’ তথা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত।) হল, অঙ্গ সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে পুরুষের জন্য নারীর অথবা নারীর জন্য পুরুষের আকৃতি ধারণ করা। যেমন কোনো পুরুষের খোজা হওয়া। ইসলামে এটিও নিষিদ্ধ।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের সঙ্গে স্ত্রীগণ থাকত না। তাই আমরা আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি খোজা হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে এই অভিশপ্ত সাদৃশ্যই ধারণ করা হয়। কখনো অস্থায়ী ও সাময়িক সাদৃশ্য ধারণ করা হয়। যেমন, পুরুষ হয়ে নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ইত্যাদি অবলম্বন করা হয়। আবার কখনো সার্জারির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। যেমন, ছেলে হয়ে মেয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা কিংবা মেয়ে হয়ে ছেলের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ও নিজের মেয়েলি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপসারণ করা ইত্যাদি।
চার. ট্রান্সজেন্ডারবাদে রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি
ট্রান্সজেন্ডারবাদের সবচেয়ে জঘন্য ও গর্হিত দিক হল, এতে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি ঘটে। অথচ আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধন সম্পূর্ণ হারাম ও জঘন্যতম কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیْدًا، اِنْ یَّدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖۤ اِلَّاۤ اِنٰثًا وَ اِنْ یَّدْعُوْنَ اِلَّا شَیْطٰنًا مَّرِیْدًا، لَّعَنَهُ اللهُ وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِیْبًا مَّفْرُوْضًا، وَّ لَاُضِلَّنَّهُمْ وَ لَاُمَنِّیَنَّهُمْ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُبَتِّكُنَّ اٰذَانَ الْاَنْعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَ مَنْ یَّتَّخِذِ الشَّیْطٰنَ وَلِیًّا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِیْنًا، یَعِدُهُمْ وَ یُمَنِّیْهِمْ وَ مَا یَعِدُهُمُ الشَّیْطٰنُ اِلَّا غُرُوْرًا، اُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ وَ لَا یَجِدُوْنَ عَنْهَا مَحِیْصًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এটি ব্যতীত যাকে ইচ্ছা সবকিছু ক্ষমা করেন। আর কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। তাঁর পরিবর্তে তারা দেবীরই পূজা করে এবং বিদ্রোহী শয়তানেরই পূজা করে। আল্লাহ তাকে লানত করেন। আর সে বলে, আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব। তাদের অন্তরে মিথ্যা আশা-ভরসা সৃষ্টি করব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই পশুর কর্ণচ্ছেদ করবে। তাদেরকে আরো আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। আর কেউ আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্ত। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশা-ভরসা দেয়। আর শয়তান তাদেরকে শুধু প্রবঞ্চনারই প্রতিশ্রুতি দেয়। ওদের বাসস্থান জাহান্নাম এবং তারা সেখান থেকে পলায়নের কোনো পথ পাবে না। ―সূরা নিসা (৪) : ১১৬-১২১
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রাহ. উপরে বর্ণিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করার পর বলেন―
وَهَذِه الْأُمُورُ كُلُّهَا قَدْ شَهِدَتِ الْأَحَادِيثُ بِلَعْنِ فَاعِلِهَا، وَأَنَّهَا مِنَ الْكَبَائِرِ. وَاخْتُلِفَ فِي الْمَعْنَى الَّذِي نُهِيَ لِأَجْلِهَا، فَقِيلَ: لِأَنَّهَا مِنْ بَابِ التَّدْلِيسِ. وَقِيلَ: مِنْ بَابِ تَغْيِيرِ خَلْقِ اللَّهِ تَعَالَى، كَمَا قَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ، وَهُوَ أَصَحُّ.
হাদীসসমূহ থেকে সাদৃশ্যের উপরোক্ত সকল কাজ লানতযোগ্য হওয়া ও কবীরা গুনাহ হওয়া প্রতীয়মান হয়। তবে এসব কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে কী তাৎপর্য রয়েছে, সে সম্পর্কে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। কেউ বলেন, এটি তাদলীস। আর কারো মতে, এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. উল্লেখ করেছেন। আর এটিই বিশুদ্ধ মত। ―তাফসীরে কুরতুবী ৫/২৫২; আলমুফহিম লিমা উশকিলা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম ৫/৪৪৪
পাঁচ. সর্বোপরি ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি ঈমান বিধ্বংসী কুফরি মতবাদ
ট্রান্সজেন্ডারবাদ ইসলাম ও মুসলমানদের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেননা সন্তান হওয়া-না হওয়া, সন্তানের ছেলে বা মেয়ে হওয়া একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ন্ত্রণে। এতে কারো কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কোনো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ওষুধ-পথ্য কিংবা কোনো ডাক্তার-কবিরাজের এতে কোনো এখতিয়ার নেই। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَ، اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ.
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। ―সূরা শূরা (৪২) : ৪৯-৫০
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে যখন তখন ছেলে বা মেয়ে বনে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়। যা সৃষ্টির বিকৃতির পাশাপাশি ঈমান বিধ্বংসীও বটে। তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন সুন্নাহ্র অসংখ্য বিধানে ব্যাপক পরিবর্তন ও চরম বিকৃতি ঘটবে। এর মাধ্যমে ইসলামের সালাত, হজ¦, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়, পর্দা, সতর, শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি), রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধানের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুমতি দান করুন। ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা ও এর ভয়াবহতা অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। বিশ্বের গোটা মুসলিম উম্মাহ্কে এর ভয়াল গ্রাস থেকে হেফাযত করুন। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীল মহলকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন এবং ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো একটি কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!