কুরআনের মাধুর্য যেভাবে আকর্ষণ করত উদ্ধত মুশরিককেও
আলকুরআনুল কারীম আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম। এর শব্দ-বাক্যে রয়েছে আসমানী নূরের ছটা ও অলৌকিক দ্যুতি। একজন মুমিন দিবানিশি স্নাত হতে থাকে কুরআনের অপার্থিব স্নিগ্ধ আলোয়। ঈমানী নূরে বিধৌত হয় তার দেহ-মন। মহান আল্লাহ মুমিন বান্দার এ দৃশ্যটির চিত্রায়ণ করেছেন এ ভাষায়―
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ اِذَا ذُكِرَ اللهُ وَ جِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَ اِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ اٰيٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِيْمَانًا وَّ عَلٰي رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ، الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجٰتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَ مَغْفِرَةٌ وَّ رِزْقٌ كَرِيْمٌ.
বস্তুত মুমিনগণ তো এমনই যে, যখন তাদের সামনে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তখন তাদের অন্তর শিউরে ওঠে। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয়। আর তারা তাদের রবের ওপর ভরসা রাখে।
তারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।
এরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের নিকট রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। ―সূরা আনফাল (৮) : ২-৪
তবে কুরআন যেহেতু সর্বজনীন তাই এর লালিত্য ও মাধুর্য স্পর্শ করে যায় মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সবাইকে। এমনকি স্রষ্টার বিদ্রোহী গোলাম উদ্ধত মুশরিকের হৃদয়েও তা নাড়া দিয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে কুরআনের পথে ডাকতেন, কুরআন পড়ে পড়ে মানুষকে শোনাতেন। কাফেররা তখন এই কুরআনের বিরোধিতায় সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে অবতীর্ণ হত। আল্লাহ তাআলা তাদের অবস্থা কুরআনে বলে দিয়েছেন―
وَ قَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَا تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْاٰنِ وَ الْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ.
আর কাফেররা (একে অন্যকে) বলে, এই কুরআন শুনো না এবং এর (পাঠের) মাঝে হট্টগোল করতে থাক, যাতে তোমরা জয়ী থাক। ―সূরা হামীম সাজদা (৪১) : ২৬
কিন্তু কুরআনের শক্তির বিরুদ্ধে কি কখনো জয়ী হওয়া যায়?! ফলে তারা দিনদিন পরাজিতই হতে থাকল।
একদিকে কুরআনের বিরোধিতা অপরদিকে তাদের অবস্থা ছিল―রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রকাশ্যে নামাযে তিলাওয়াত করতেন তখন কাফেররা দূরে সরে যেত। কিন্তু দূর থেকে আবার আড় কানে চুপে চুপে শোনার চেষ্টা করত। যখন কেউ দেখে ফেলত, আস্তে কেটে পড়ত। (দ্রষ্টব্য : আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৪/১৬৪)
মক্কার প্রতাপশালী মুশরিক নেতারা দিনের বেলায় কুরআনের ধ্বনি স্তিমিত করতে মরিয়া হলেও রাতের অন্ধকারে তাদের আচরণ ছিল ভিন্ন। যেই কুরআনকে মিটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে তারা তৎপর ছিল, সেই কুরআনেরই তিলাওয়াত শুনতে তারা চলে আসত চুপে চুপে, রাতের অন্ধকারে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনভর কুরআনের দাওয়াত দিতেন আর রাতের আঁধারে একান্ত নিভৃতে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন কুরআন তিলাওয়াতে।
আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস ইবনে শারীক। মক্কার তিন মুশরিক সরদার। নবীজী যখন রাতে নামাযে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করতেন তারা লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে চলে আসত কুরআন শুনতে। নবীজীর ঘরের বাইরে ঘাপটি মেরে বসে কান পেতে থাকত। সবাই একা একা আসত। কেউ কারো খবর জানত না। ভাবত―আমি একাই শুনতে এসেছি।
এভাবে সারা রাত তন্ময় হয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনত তারা।
একবারের ঘটনা। এভাবে তারা সারারাত কুরআন তিলাওয়াত শুনল। যখন ভোর ঘনিয়ে এল। চারিদিক ফর্সা হতে আরম্ভ করল। তড়িৎ ঘর পানে ছুট দিল। কিন্তু পথে তিনজন একে অপরের মুখোমুখি হয়ে গেল। অপ্রস্তুত অবস্থা। ধরা খেয়ে গেল সবাই সবার কাছে―তিন জনই একই অপরাধের অপরাধী! দিনভর যেই কুরআনের বিরোধিতায় যারা জোর প্রচারণা চালায় তারাই কিনা রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে এভাবে কুরআন শুনতে আড়ি পেতে বসে! সাধারণ জনতা ব্যাপারটা টের পেলে তো কুরআনের প্রতি তারা আরো ধাবিত হয়ে পড়বে! জনগণকে যেভাবে তারা ভুলভাল বুঝিয়ে কুরআনের সংস্পর্শ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চাইছে―তা মাঠে মারা পড়বে। না না এরকম আর আসা যাবে না―তারা প্রতিজ্ঞা করল। নিজেরাই নিজেদের ভর্ৎসনা করে ঘরে ফিরে গেল।
দিন গড়িয়ে ফের রাত এল। চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। সবাই সবার জায়গা থেকে চিন্তা করল, কাল যেহেতু সবাই ধরা পড়ে গিয়েছে তাই আজ তিলাওয়াত শুনতে কেউ যাবে না। আমি একা গিয়ে কিছুক্ষণ শুনে আসি। এভাবে তিনজনই একই চিন্তা নিয়ে প্রতিজ্ঞা ভেঙে চলে গেল কুরআন শুনতে। ভোরের আলো ফুটতেই একে অপরের হাতে আবার ধরা পড়ল। আবার আগের দিনের মতো নিজেদের ভর্ৎসনা করে যে যার মতো ঘরে চলে গেল। ওয়াদা করল, আর আসবে না।
তৃতীয় রাত। প্রথম ও দ্বিতীয় রাতের মতো কেউ বিছানায় থাকতে পারল না। অন্ধকার নেমে এলে আজও তারা লুকিয়ে লুকিয়ে চলে গেল কুরআন শুনতে। বরাবরের মতো দেখা হয়ে গেল তিনজনের। এখন তারা শক্ত হল। বলল, আমরা মজবুত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ না হলে হবে না। এভাবে তারা পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরল। (দ্রষ্টব্য : সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩১৫; দালায়েলুন নুবুওয়াহ, বাইহাকী ২/২০৬; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৭৭)
প্রিয় পাঠক! কী এমন আকর্ষণ রয়েছে কুরআনের তিলাওয়াতে, যার কারণে এমন চিহ্নিত কুরআনের শত্রু রাতের অন্ধকারে ঘরে থাকতে পারত না! বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পরিবর্তে সারারাত কষ্ট করে কুরআন শুনতে অস্থির হয়ে পড়ত! এটা ছিল মূলত কুরআনের অলৌকিকত্ব।
কুরআনের অপার্থিব মাধুর্য ও অনিন্দ্য লালিত্যে বিমোহিত থাকত মক্কার মুশরিকরা প্রতিনিয়ত। সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও কুরআনের অলৌকিকত্বে তারা যারপরনাই আকর্ষণ বোধ করত। এমনই আরেকটা ঘটনা শুনুন সীরাতের কিতাব থেকে―
কাফেররা যখন দেখল শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে কুরআনের বার্তা ও বাণী ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে, ক্রমশ ভারী হতে চলেছে মুসলিম কাফেলা, উমর রা. ও হামযা রা.-এর মতো বীর বাহাদুর অভিজাত আরব যুবকরাও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে, তখন তারা ষড়যন্ত্রের কৌশল পরিবর্তন করল। এখন পথ ধরল প্রলোভনের।
আরবের অত্যন্ত বিচক্ষণ ও কূটকৌশলী নেতা ছিল উতবা ইবনে রাবীআ। যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন, বিচক্ষণ ও বাকপটু। একবার মক্কার মুশরিক নেতারা একত্রে শলা-পরামর্শে বসল―কীভাবে কুরআনের স্পন্দনকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়া যায়। নবীজী তখন একাকী অবস্থান করছিলেন। উতবা বলল, আমি গিয়ে মুহাম্মাদের সাথে আলাপ করে আসি। তাকে কিছু লোভ-লাভ দেখাই। দেখি সে কোনোটাতে রাজি হয়ে যায় কি না! উতবার এ প্রস্তাবে সবাই সমস্বরে সমর্র্থন জানাল।
উতবা গিয়ে নবীজীকে খুব খাতির করে কথা বলতে লাগল―দেখ ভাতিজা! তুমি আমাদের মধ্যমণি। তোমার মতো সৌম্য শান্ত ভদ্র ও সজ্জন ব্যক্তি হতে পারে না। কিন্তু এখন তুমি যা শুরু করলে এতে তো দেখতেই পাচ্ছ, সমাজে কেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিবাদ তৈরি হচ্ছে। বিভেদ দেখা দিচ্ছে। তুমি আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি তোমার কাছে কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই। আশা করি, তুমি তা নিয়ে ভাববে। প্রত্যাখ্যান করবে না।
নবীজী বললেন―আপনি বলতে থাকুন, আমি শুনছি।
উতবা বলা শুরু করল―ভাতিজা! তোমার এই প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম যদি অর্থ লাভের উদ্দেশ্যে হয়, তবে আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে তোমাকে দেখতে আমরা প্রস্তুত। এর জন্য আমরা যা যা করার সব করব।
তুমি যদি সম্মান চাও, তবে তোমাকে আমরা সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে সাদরে সমাসীন করব।
তুমি যদি রাজত্ব ও নেতৃত্ব চাও, তাও মাথা পেতে মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত।
আর যদি মানসিক কোনো অসুস্থতার কারণে এগুলো করো, তাহলে যত অর্থই লাগুক তোমার জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে আমরা কুণ্ঠিত হব না।
এভাবে একে একে প্রলোভন দিয়ে চলল উতবা ইবনে রাবীআ। নবীজী কথাগুলো শান্তভাবে শুনে যাচ্ছিলেন।
উতবার যখন বলা শেষ হল, নবীজী বললেন, আপনার কথা কি শেষ?
উতবা বলল, হাঁ।
নবীজী বললেন, তাহলে এখন আমার কিছু কথা শুনুন।
উতবা বলল, ঠিক আছে।
নবীজী নিজ থেকে কিছু বললেন না। কুরআন থেকে তিলাওয়াত শুরু করলেন―
حٰمٓ، تَنْزِيْلٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ،كِتٰبٌ فُصِّلَتْ اٰيٰتُهٗ قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ، بَشِيْرًا وَّ نَذِيْرً فَاَعْرَضَ اَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُوْنَ.
[হা-মীম। এ বাণী সেই সত্তার পক্ষ হতে অবতীর্ণ, যিনি সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু। এটি এমন কিতাব, আরবী কুরআনরূপে, জ্ঞান অর্জনকারীদের জন্য যার আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। যা অবতীর্ণ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। তা সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফলে তারা শুনতে পায় না। ―সূরা হা-মীম সাজদা (৪১) : ১-৪]
নবীজী আরো তিলাওয়াত করলেন―
قُلْ اَىِٕنَّكُمْ لَتَكْفُرُوْنَ بِالَّذِيْ خَلَقَ الْاَرْضَ فِيْ يَوْمَيْنِ وَ تَجْعَلُوْنَ لَهٗۤ اَنْدَادًا ذٰلِكَ رَبُّ الْعٰلَمِيْنَ، وَ جَعَلَ فِيْهَا رَوَاسِيَ مِنْ فَوْقِهَا وَ بٰرَكَ فِيْهَا وَ قَدَّرَ فِيْهَاۤ اَقْوَاتَهَا فِيْۤ اَرْبَعَةِ اَيَّامٍ سَوَآءً لِّلسَّآىِٕلِيْنَ، ثُمَّ اسْتَوٰۤي اِلَي السَّمَآءِ وَ هِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَ لِلْاَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا اَوْ كَرْهًا قَالَتَاۤ اَتَيْنَا طَآىِٕعِيْنَ، فَقَضٰىهُنَّ سَبْعَ سَمٰوَاتٍ فِيْ يَوْمَيْنِ وَ اَوْحٰي فِيْ كُلِّ سَمَآءٍ اَمْرَهَا وَ زَيَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ وَ حِفْظًا ذٰلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ.
[বলে দাও, সত্যিই কি তোমরা সেই সত্তার সাথে কুফরী করছ, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুদিনে এবং তার সাথে অন্যকে শরীক করছ? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক! তিনি ভূমিতে সৃষ্টি করেছেন অবিচলিত পাহাড়, যা তার ওপর উত্থিত রয়েছে। আর তাতে দিয়েছেন বরকত এবং তাতে তার খাদ্য সৃষ্টি করেছেন সুষমভাবে―(সবকিছুই) চারদিনে―সকল যাচনাকারীর জন্য সমান। তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দান করলেন, যা ছিল ধোঁয়া রূপে। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা চলে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল, আমরা ইচ্ছাক্রমেই আসলাম। অতঃপর তিনি নিজ ফায়সালা অনুযায়ী দুদিনে তাকে সাত আকাশে পরিণত করলেন এবং প্রতি আকাশে তার উপযোগী আদেশ প্রেরণ করলেন। আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সাজিয়েছি এবং তাকে করেছি সুরক্ষিত। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)-এর পরিমিত ব্যবস্থাপনা। ―সূরা হা-মীম সাজদা (৪১) : ৯-১২]
নবীজী যখন কুরআন থেকে তিলাওয়াত করছিলেন উতবা তন্ময় হয়ে শুনছিল। আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে নবীজী বললেন, আমার যা শোনানোর আমি শুনিয়ে দিয়েছি। এখন আপনি বিবেচনা করুন।
যবানে নববী থেকে পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াতে উতবার হালত পরিবর্তন হয়ে গেল। সে উঠে চলে গেল গোত্রের কাছে। অপেক্ষায় থাকা মক্কার সরদাররা দূর থেকে উতবার চেহারা দেখেই বুঝতে পারল, এ আগের উতবা নয়। তারা জিজ্ঞাসা করল, ঘটনা কী ঘটল, হে আবুল ওয়ালীদ! (উতবার উপনাম)
উতবা তখন ইতিহাসের চির সত্যটি তাদের সামনে স্বীকার করে বলল―
‘আল্লাহর কসম, আমি এতক্ষণ যা শুনে এলাম জীবনে কখনো এধরনের কথাবার্তা শুনিনি। আল্লাহর কসম, তা কোনো কবিতা নয়, কোনো জাদুর মন্ত্রও নয়, নয় কোনো গণকের কথা। হে কুরাইশ! তোমরা আমার কথা মেনে নাও। তোমরা তার ব্যাপারটি তার মতো করে ছেড়ে দাও। তোমরা আর তার পেছনে পড়ো না। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি তার থেকে যা শুনেছি, তাতে মহাসংবাদ রয়েছে।
যদি আরবের অন্যরা তাকে পরাস্ত করে ফেলে তবে তো তোমাদের কাজটি অন্যরাই করে দিল। আর যদি সে সফল হয়, তাহলে তার রাজত্ব তো তোমাদেরই রাজত্ব। তার সম্মান তো তোমাদেরই সম্মান। আর তোমরা তখন মহা সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হবে।’
উতবার এমন বক্তব্যে তারা আশাহত হল। হতবিহ্বল হয়ে বলল, অবশেষে তোমার ওপরও মুহাম্মাদের জাদু ভর করেছে বুঝি!
উতবা খুব সরলভাবে উত্তর দিল, আমি আমার মত ব্যক্ত করলাম। এখন তোমাদের যা মনে চায় তাই করতে পার। (দ্রষ্টব্য : সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৯৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/১৪৮)
প্রিয় পাঠক! উতবা জাদুগ্রস্ত হয়নি। কোনো ঘোরে বিভোরও হয়নি। সে চির সত্যটি স্বীকার করেছে মাত্র। তার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে কুরআনের অলৌকিক মাধুর্য, তাওহীদের সত্যতা এবং প্রকাশিত হয়েছে শিরক ও কুফরের গান্দেগী। ফলে সে তার গোত্র ও গোত্রপতিদের এমন সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছে।
কুরআনের অলৌকিকত্বে বিমুগ্ধ হওয়ার আরো ঘটনা রয়েছে। ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার মতো কট্টর মুশরিক নেতাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ওয়ালীদ ছিল অত্যন্ত সম্পদশালী, বিজ্ঞজন ও বয়োবৃদ্ধ পণ্ডিত সরদার। শিল্প-সাহিত্যে যথেষ্ট পারদর্শী। একবার সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল। নবীজী তাকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন। বর্ণনায় পাওয়া যায় আয়াতটি ছিল―
إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاء ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। ―সূরা নাহল (১৬) : ৯০
আয়াতের মর্ম ও ব্যঞ্জনায় সে আপ্লুত হয়ে পড়ল। ব্যাপারটি যখন আবু জেহেলের কানে পৌঁছল, সে শঙ্কিত হয়ে পড়ল―ফের না ওয়ালীদ কুরআনের প্রতি ঈমান এনে ফেলে!
তখন সে ওয়ালীদকে নানাভাবে প্ররোচিত করতে থাকল এবং জাহেলী জাত্যভিমান জাগ্রত করে ইসলাম, ইসলামের নবী এবং ইসলামের কিতাব কুরআনের বিরুদ্ধে উসকানি দিতে থাকল। আবু জেহেলের প্ররোচনা ও উসকানিতে ওয়ালীদ জাহেলী জাত্যভিমানে আটকে পড়লেও কুরআনের ব্যাপারে তার অভিব্যক্তি ছিল উল্লেখ করার মতো। ওয়ালীদ আবু জেহেলকে বলে দিল―
‘আল্লাহর কসম, কাব্য ও ছন্দের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে ভালো জানি। জিনের প্রলাপ সম্বন্ধেও আমি ভালো জানি। আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ যা বলে তা এগুলোর কোনোটাই নয়। আল্লাহর কসম, তার বক্তব্যে রয়েছে রস ও মিষ্টতা। তা পত্র-পল্লবে সুশোভিত, প্রকাণ্ড একটি ফলদায়ক বৃক্ষের ন্যায়। যা কেবল উঁচুই থাকে, নমিত হয় না।’
কুরআনের সত্যতা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও সে ঈমান আনতে পারল না। সূরা মুদ্দাসসিরের ১১ থেকে ২৬ নং আয়াতে তার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য : দালায়েলুন নুবুওয়াহ ২/১৯৮; আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৪/১৫২)
মোটকথা, কুরআনের বড় একটি মুজেযা হচ্ছে, উদ্ধত মুশরিক এবং কট্টর কাফেরও এর মাধুর্য ও অলৌকিকত্বে আন্দোলিত ও বিমোহিত হয়। আর এমন বাঘা বাঘা শিল্পী কবি-সাহিত্যিক এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও প্রতিভায় প্রসিদ্ধ দাপুটে অহংকারী সরদার শ্রেণির লোকেরা প্রভাবিত হওয়া―এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, কুরআন একমাত্র আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম। মানবীয় কোনো বাণী নয়। কেননা কোনো ধরনের মানবীয় বাণীর সামনে পরাস্ত হবার পাত্র তারা ছিল না। আল্লাহর কালাম বলেই তারা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের অপূর্ব সৌন্দর্য সবাইকে ছুঁয়ে গেলেও এর বার্তা ও শিক্ষার হাতছানি কেন সবাইকে স্পর্শ করেনি? কুরআনের সত্যাসত্যির ব্যাপারে এতটা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা থাকার পরও কেন কুরআনকে দিল থেকে কবুল করে নিতে পারেনি তারা?
এর উত্তর খোদ কুরআনই দিয়ে রেখেছে। অহংকার, হঠকারিতা, জেদ, জাত্যভিমান, প্রতিশোধপ্রবণ মনোভাব, ভোগবাদি মানসিকতা, অন্যায় বাদানুবাদ ইত্যাদি জাহেলী বৈশিষ্ট্যগুলোই তাদের জন্য কুরআনের আলো গ্রহণে বড় বাধা হয়েছিল।
উন্মুক্ত হৃদয়ে কুরআনের কাছে এলেই কুরআন তাকে ঢেকে নেয় হেদায়েতের চাদরে। আল্লাহ তাআলা বলেন―
اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَذِكْرٰي لِمَنْ كَانَ لَهٗ قَلْبٌ اَوْ اَلْقَي السَّمْعَ وَ هُوَ شَهِيْدٌٌ .
নিঃসন্দেহে এতে উপদেশ রয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য, যার আছে (উন্মুক্ত) হৃদয় কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে। ―সূরা ক্বাফ (৫০) : ৩৭