শীতকাল : ইবাদতের সহজ সুযোগ কাজে লাগাই
আমাদের দেশ ষড়্ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাস পরপর ঋতুর পালাবদল হয়। পৌষ ও মাঘ শীতকাল হলেও শীতের আবহ বইতে শুরু করে আরেকটু আগে থেকেই।
প্রতিটি ঋতুর মতো শীতকাল নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। শীতকালে প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। বাগ-বাগিচা সমৃদ্ধ হয় ফল-ফুলে। মাঠ-ঘাট ছেয়ে যায় শাক-সবজি-ফসলে।
একইভাবে শীতকাল মুমিনের জন্য নিয়ে আসে ইবাদতের সহজ সুযোগ। শীতকালে কিছু কিছু নেক কাজ সহজে করে নেওয়া যায়। চলুন, জেনে নিই, শীতকাল আমাদের জন্য কী কী সুযোগ নিয়ে আসে।
আল্লাহর পরিচয় লাভের সুযোগ
আল্লাহ তাআলার কুদরতের নিদর্শনাবলিতে চিন্তা-ফিকির করে তাঁর পরিচয় লাভ করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসমান-জমিন ও এ দুয়ের মাঝে এবং খোদ আমাদের মাঝে তাঁর কুদরতের ছোট-বড় অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
একটি নিদর্শন হচ্ছে ঋতুর পালাবদল। যেমন শীতের পর গ্রীষ্ম আসে এবং গ্রীষ্মের পর শীত। শীত-গ্রীষ্ম আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। যেহেতু এ দুই ঋতু দীর্ঘ সময় থাকে এবং দুটোর চরিত্রও সম্পূর্ণ আলাদা। গরমের সময় হালকা-পাতলা কাপড় গায়ে জড়িয়ে পাখা চালিয়েও স্বস্তি মেলে না। বিদ্যুৎ চলে গেলে তো নাভিশ্বাস উঠে যায়। পক্ষান্তরে শীতে দরজা-জানালা বন্ধ করে ভারি-মোটা শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক ঢেকেও শীত শীত লাগে।
এ আবর্তন আমাদের জন্য আল্লাহর পরিচয় লাভের সুযোগ নিয়ে আসে। এই আবর্তনে চিন্তা করে আমরা আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারি, তাঁর প্রতি বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করতে পারি। আমরা উপলব্ধি করতে পারি, আল্লাহ কত শক্তিমান! তিনি কত নিপুণ, কত কুশল! আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলি থেকে যারা তাঁর পরিচয় লাভ করে, কুরআনের ভাষায় তারা বুদ্ধিমান—
اِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الَّيْلِ وَ النَّهَارِ لَاٰيٰتٍ لِّاُولِي الْاَلْبَابِ، الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيٰمًا وَّ قُعُوْدًا وَّ عَلٰي جُنُوْبِهِمْ وَ يَتَفَكَّرُوْنَ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًا سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِِ.
নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে বহু নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য, যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (এবং বলে,) হে আমাদের রব! আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। —সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০-১৯১
জাহান্নাম থেকে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ
আল্লাহ তাআলার নির্দেশমতো জীবনযাপন করলে তিনি জান্নাত দান করবেন আর তাঁর নির্দেশ অমান্য করলে জাহান্নাম দেবেন। জাহান্নামের শাস্তি অতি ভয়াবহ। জাহান্নামে বিভিন্নভাবে শাস্তি দেওয়া হবে। উত্তপ্ত আগুনের শাস্তি যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে তীব্র শীতের শাস্তিও।
হাদীসে এসেছে—
اشْتَكَتِ النَّارُ إِلَى رَبِّهَا فَقَالَتْ: رَبِّ أَكَلَ بَعْضِي بَعْضًا، فَأَذِنَ لَهَا بِنَفَسَيْنِ: نَفَسٍ فِي الشِّتَاءِ وَنَفَسٍ فِي الصَّيْفِ، فَأَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الحَرِّ، وَأَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الزَّمْهَرِيرِ.
জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করল, হে রব, আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। অতঃপর তিনি তাকে দুটি নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন, একটি নিঃশ্বাস শীতে আরেকটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মে। তোমরা গরমের যে প্রচণ্ডতা অনুভব কর তা জাহান্নামের উত্তপ্ততা থেকে আর শীতের যে তীব্রতা অনুভব কর তা জাহান্নামের যামহারীর (শীতলতা) থেকে। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৫; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৭৭২২
শীতকাল আমাদের জন্য জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তাআলার আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ নিয়ে আসে। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে নিবেদন করতে পারি, ইয়া আল্লাহ! দুনিয়ার ‘সামান্য’ শীতেই তো আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, জাহান্নামের ‘তীব্র’ ঠাণ্ডা ও শীত কীভাবে সহ্য করব?
জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তার মধ্যে এ দুটি দুআ অন্যতম—
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ.
হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে জাহান্নামের শাস্তি থেকে পানাহ চাই।
اَللّهُمَّ أَجِرْنِيْ مِنَ النَّارِ.
হে আল্লাহ, আমাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর।
শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও ইবাদতের সুযোগ
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শেষ রাত অত্যন্ত বরকত ও রহমতপূর্ণ সময়। এ সময় বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত নিবিষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা শেষরাতে ডাকতে থাকেন—
مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.
আছে কি কেউ, যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কেউ আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দিয়ে দেব। কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব!
রাতের দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ এভাবে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮
কিন্তু এই বরকতপূর্ণ সময় অনেকের ঘুমে কেটে যায়। গরমের ছোট রাতে দেরিতে ঘুমালে কখন যে এই মুবারক মুহূর্ত চলে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না। কারো কারো ঘুমের অবস্থা দেখে মনে হয় এটা মধ্য রাত, শেষ রাত নয়।
আচ্ছা! আমাদের কি ইচ্ছা হয় না রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দেওয়ার! আমাদের কি কোনো প্রয়োজন নেই তাঁর কাছে নিবেদন করার! আমাদের কি কোনো গোনাহ নেই তাঁর থেকে মাফ করিয়ে নেওয়ার!!
যারা শেষ রাতে উঠে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে চান, কিন্তু রাত ছোট হওয়ায় উঠতে পারেন না, শীতকাল তাদের জন্য এই সুযোগ নিয়ে আসে। কেননা শীতকালে রাত বেশ বড় হয়। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে সহজে শেষ রাতে উঠে যাওয়া সম্ভব। সবার চেষ্টা করা উচিত, শীতকালে যেন এই সুযোগ হাতছাড়া না হয়। আমরা অন্তত শীতকালে তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করি, যাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেছেন—
كَانُوْا قَلِيْلًا مِّنَ الَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ، وَ بِالْاَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ.
তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থনা করত। —সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৭-১৮
আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ বছর জুড়ে এই বরকতপূর্ণ সময়ের প্রতি যত্নবান থাকেন। তাদের কাছে রাত ছোট ও বড় হওয়ার মধ্যে ফারাক নেই। তারা ছোট রাতেও অল্প ঘুমিয়ে বিছানা ত্যাগ করেন এবং আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে যান। নামায পড়েন, ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তওবা করেন, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য দুআ করেন। রাত ছোট হওয়ায় বরং তাদের ইবাদতের তৃষ্ণা থেকে যায়। শীতের বড় রাতে তারা এই তৃষ্ণা নিবারণ করতে সক্ষম হন এবং প্রশান্তি লাভ করেন।
প্রখ্যাত তাবেয়ী মি‘যাদ ইবনে ইয়াযীদ রাহ. বলেন—
لَوْلَا ظَمَأُ الْهَوَاجِرِ، وَطُولُ لَيْلِ الشِّتَاءِ، وَلَذَاذَةُ التَّهَجُّدِ بِكِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، مَا بَالَيْتُ أَنْ أَكُونَ يَعْسُوبَا.
যদি উত্তপ্ত দুপুরের (রোযাজনিত) তৃষ্ণা, শীতের দীর্ঘ রাত এবং তাহাজ্জুদে কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ না থাকত, তাহলে আমি মৌমাছি হয়ে যেতে পরোয়া করতাম না। —আযযুহদ ওয়ার রাকাইক, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক, পৃ. ২৭৮
অপর তাবেয়ী আমের ইবনে আবদে কায়েস রাহ. বলেন—
مَا أَبْكِي عَلَى دُنْيَاكُمْ رَغْبَةً فِيهَا، وَلَكِنْ أَبْكِي عَلَى ظَمَأِ الْهَوَاجِرِ وَقِيَامِ لَيْلِ الشِّتَاءِ.
আমি তোমাদের দুনিয়ার জন্য কাঁদি না; আমি কাঁদি উত্তপ্ত দুপুরের (রোযাজনিত) তৃষ্ণা এবং শীতের রাতের ইবাদতের জন্য। —হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১০৪
বেশি বেশি রোযা রাখার সুযোগ
রোযা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর অনেক ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রোযার প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে দেবেন এবং বিনা হিসাবে দেবেন। রোযাদারকে তিনি কিয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। রোযাদার ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সিদ্দিকীন ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে। রোযাদারের দুআ কবুল হয়। রোযা জান্নাত লাভের পথ। জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ। আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। গোনাহের কাফফারা। রোযা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।
রোযার বিভিন্ন প্রকার রয়েছে :
১. ফরয রোযা। ২. নফল রোযা।
নফল রোযা সারা বছর রাখা যায়। তবে কিছু নফল রোযা আছে, যেগুলো বিশেষ সময়ের সঙ্গে নির্দিষ্ট এবং হাদীসে এগুলোর বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন সোমবার, বৃহস্পতিবার ও আইয়ামে বীযের রোযা।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন—
كَانَ النبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার ইহতিমাম করতেন। —জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৫
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.
সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলসমূহ পেশ করা হয়। আমার পছন্দ, আমার আমল যেন পেশ করা হয় আমি রোযাদার অবস্থায়। —জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৭
আবু হুরায়রা রা. থেকে আরো বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
شَهْرُ الصَبْرِ وَثَلَاثَةُ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ صَوْمُ الدّهْرِ.
সবরের মাস (রমযান) এবং প্রতি মাসে তিন দিন রোযা সারা বছর রোযার সমতুল্য। —সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৫৭৭
আবু যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إِذَا صُمْتَ مِنْ شَهْرٍ ثَلَاثًا، فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ، وَخَمْسَ عَشْرَة.
তুমি যদি মাসে তিন দিন রোযা রাখ তাহলে তেরো তারিখ, চৌদ্দ তারিখ ও পনেরো তারিখ রোযা রেখো। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৪৩৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৬১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪২৪
কিন্তু এই ফযীলত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রোযার ব্যাপারে অনেকের বেশ অবহেলা ও উদাসীনতা। কেউ কেউ তো ফরয রোযাই রাখে না (নাউযুবিল্লাহ)। আর কেউ কেউ কষ্ট-ক্লেশ করে ফরয রোযা রাখেন, কিন্তু গরমের বড় দিনে নফল রোযা রাখার হিম্মত পান না।
যারা নফল রোযা রাখতে চান, কিন্তু গরমকালে দিন বড় হওয়ায় রাখতে পারেন না, শীতকাল তাদের জন্য এই সুযোগ নিয়ে আসে। কেননা শীতকালে দিন বেশ ছোট হয়। এসময় সহজে রোযা রাখা সম্ভব। তাই আমরা এসময় বেশি বেশি রোযা রাখতে পারি। বিশেষত সোমবার, বৃহস্পতিবার ও আইয়ামে বীযের রোযাসমূহ। শীতকালে যেন এই সুযোগ হাতছাড়া না হয়।
বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রা. একদিন তাঁর শিষ্যদের বললেন—
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى الْغَنِيمَةِ الْبَارِدَةِ؟
আমি কি তোমাদেরকে সহজ গনীমত সম্পর্কে অবহিত করব না?
তারা বললেন, অবশ্যই।
তিনি বললেন—
الصَّوْمُ فِي الشِّتَاءِ.
শীতকালে রোযা রাখা। —সুনানে বায়হাকী ৪/২৯৭
আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ রোযার প্রতি যত্নবান থাকেন। তাদের কাছে শীত ও গরমের মধ্যে পার্থক্য নেই। তারা প্রচণ্ড গরমের লম্বা দিনেও রোযা রাখেন। বরং তাদের কাছে শীতকালের রোযার চেয়ে গরমের রোযা বেশি প্রিয়। রোযার কারণে উত্তপ্ত দুপুরে যে তৃষ্ণা অনুভূত হয় তাতে তারা প্রশান্তি অনুভব করেন।
বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. মৃত্যুর সময় বলেছিলেন—
مَا تَرَكْت خَلْفِي شَيْئًا مِنَ الدُّنْيَا آسَى عَلَيْهِ، غَيْرَ ظَمَأِ الْهَوَاجِرِ وَغَيْرَ مَشْيٍ إِلَى الصَّلاَةِ.
দুনিয়ার কোনো কিছুর জন্য আমার আক্ষেপ নেই। তবে উত্তপ্ত দুপুরের (রোযাজনিত) তৃঞ্চা এবং নামাযের জন্য হাঁটা ব্যতীত। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৩৬৭২৮
দান-খয়রাতের সুযোগ
শীতে সুস্থ থাকার জন্য দরকার পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র এবং শীতজনিত রোগের নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন সুচিকিৎসা ও ওষুধপথ্য। কিন্তু এই সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না। বিভিন্ন জায়গায় বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য অনেক মানুষের প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রও থাকে না। আমাদের আশপাশেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। রাস্তার পাশে, বাস ও ট্রেন স্টেশনে, বাজার-ঘাটে রাতের বেলা এমন অনেক অসহায় মানুষ দেখা যায়। আমরা যখন লেপ-কম্বল গায়ে জড়িয়ে সুখ নিদ্রায় বিভোর তখন তাদের রাত কাটে নির্ঘুম, শীতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে। শীতে গরীব-অসহায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে এবং নানা রকম রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় আমাদের উচিত শীতার্ত গরীব-অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ানো। এটা আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। আমাদের সামান্য সহযোগিতা তাদের জীবনে এনে দিতে পারে এক টুকরো সুখ। কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপা মানুষের গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে হাসি ফোটানোর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে?
অধিক সওয়াব অর্জনের সুযোগ
শীতকালের জন্য বিশেষ কোনো বিধান নেই। গরমকালে যা করণীয় শীতকালেও তাই করণীয়। উপরে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে তা গরমেও করণীয়। হাঁ, শীতকালে তা অধিক প্রাসঙ্গিক বা সহজ। আবার কিছু নেক কাজ এমন আছে, যা শীতকালে কষ্ট হয়। বিশেষত যখন শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়, শৈত্যপ্রবাহ বইতে থাকে। যেমন ওযু করা, ফজর নামাযে মসজিদে যাওয়া ইত্যাদি।
এটা আমাদের জন্য অধিক সওয়াব অর্জনের সুযোগ নিয়ে আসে। আমরা যদি এজাতীয় আমলগুলো শীতকালেও সুন্দরভাবে করি, তাহলে অধিক সওয়াব মিলবে ইনশাআল্লাহ। ওই আমল করার সওয়াব মিলবে, সঙ্গে শীতের কষ্টের কারণে অতিরিক্ত সওয়াব মিলবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟
আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করব না, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন?
তাঁরা বললেন, হাঁ, অবশ্যই। তিনি বললেন—
إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذلِكُمُ الرِّبَاطُ.
(তা হল-) কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদের দিকে বেশি বেশি হাঁটা এবং এক নামায আদায়ের পর পরবর্তী নামাযের জন্য অপেক্ষায় থাকা। এটাই রিবাত (সীমান্ত প্রহরা)। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫১
লক্ষ করুন, কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে ওযু করলে কত বড় প্রতিদান পাওয়া যাবে। এই কষ্টের মধ্যে শীতের কষ্টও অন্তর্ভুক্ত। কনকনে শীতে পানির স্পর্শ কষ্ট বৈকি।
সারকথা হল, শীতকাল মুমিনের জন্য ইবাদতের সহজ সুযোগ নিয়ে আসে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা ঈমান ও কল্যাণের পথে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারব। আমীরুল মুমিনীন উমর রা. যথার্থই বলেছেন—
الشِّتَاءُ غَنِيمَةُ الْعَابِدِ.
শীতকাল ইবাদতগুজারের জন্য গনীমত। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৯৮৩৫
প্রখ্যাত তাবেয়ী উবাইদ ইবনে উমাইর রাহ. শীতকালে বলতেন—
يَا أَهْلَ الْقُرْآنِ! طَالَ اللَّيْلُ لِصَلاَتِكُمْ، وَقَصُرَ النَّهَارُ لِصِيَامِكُمْ، فَاغْتَنِمُوا.
হে কুরআনওয়ালারা, নামাযের জন্য রাত বড় হয়েছে এবং রোযার জন্য দিন ছোট হয়েছে। সুতরাং তোমরা (একে) গনীমত মনে করো। —প্রাগুক্ত, বর্ণনা ৯৮৩৬
আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন।