তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন
এক. বড় হুজুর ওফাতের দুই বছর আগেও শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। এতদসত্ত্বেও প্রায় রাতে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। আগেও যত রাত আমি তাঁকে দেখেছি, কখনো তাহাজ্জুদ কাযা করতে দেখিনি। এমনকি প্রচণ্ড শীত, যখন পানিতে হাত দেওয়া যায় না, তখনো যদি গরম পানির ব্যবস্থা না থাকত, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। আমি যখন খেদমত শুরু করি তখন তাঁর বয়স ৮০ বছর। এই বয়সেও তিনি খাদেমের খেদমত না নিয়ে নিজের কাজ নিজে করতে চেষ্টা করতেন।
এরই ধারাবাহিকতায় তিনি খুব আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করতেন, যাতে আমার ঘুম না ভেঙে যায়। তার যখন ৮১ বছর, সে সময়ের এক প্রচণ্ড শীতের রাতের কথা। আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাঁর জন্য ইলেকট্রিক ফ্লাস্কে গরম পানি করে এমন একটি জায়গায় রেখে দিই, যেখান থেকে তিনি সহজেই গরম পানি ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ আমার ঘুম না ভাঙলে তো তিনি আমাকে গরম পানির জন্য ডাকবেন না। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই রাতে আমার ঘুমও ভাঙল না। তিনি চেষ্টা করেও গরম পানি ব্যবহার করতে পারলেন না। ফলে তাহাজ্জুদ আদায় করতে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করলেন। যখন তিনি ওজু করে রুমে ঢুকলেন তখনই আমার ঘুম ভাঙল। সাথে সাথে তার কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো আপনার জন্য গরম পানি করে রেখেছিলাম, আপনি আমাকে ডাকলেন না কেন?
তিনি বললেন, আমার কষ্ট হয়নি। আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। তার পর আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে ফ্লাস্ক থেকে পানি বের করার নিয়ম শিখলেন। কিছু তিলাওয়াত করলেন। তাহাজ্জুদ আদায় করে শুয়ে পড়লেন। আলহাদু লিল্লাহ, এই ঘটনার পর আমি সতর্ক হয়ে যাই।
তিনি এতটাই তাহাজ্জুদের পাবন্দ ছিলেন, যখন রাতে লঞ্চে সফর করতেন তখনো সাধারণ কেবিন থেকে বের হয়ে বাইরে ওজু করতেন। কেবিনে এসে ছোট্ট জায়গায় বসে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। লঞ্চে সফরকালে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে তিনি সব সময় মাওলানা আরিফ সাহেবের কাছ থেকে কম্পাস চেয়ে রাখতেন, যেন কেবলা খুঁজতে সহজ হয়।
দুই. একবার এক ভদ্রলোক বড় হুজুরকে বললেন, আমার তিলাওয়াত করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু কর্মব্যস্ততার কারণে সময় হয়ে ওঠে না।
বড় হুজুর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাঁচ ওয়াক্তের নামায তো আদায় করা হয়?
ভদ্রলোক বললেন, জী।
হযরত বললেন, প্রত্যেক নামাযের আগে বা পরে ১০ মিনিট করে তিলাওয়াত করলে দিন শেষে আপনার একটা পরিমাণ তিলাওয়াত করা হয়ে যাবে।
তিন. বড় হুজুরের দীর্ঘদিনের একটি রুটিন হল, তিনি প্রতি মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জ তাঁর গ্রামের বাড়িতে অবস্থিত মক্তবে যেতেন। সেখানে দুপুরের খাবার অধিকাংশ সময় মক্তবের উস্তাদজীর বাসা থেকে আসত। মুন্সিগঞ্জ মক্তবের প্রথম পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পুরস্কার কেনার ব্যাপারে বড় হুজুর অনেক উৎসাহী ছিলেন। সকল বাচ্চা যেন পুরস্কার পায়, সেজন্য উস্তাদজিকে বার বার লক্ষ রাখতে বললেন।
এই পুরস্কার কেনাসহ অন্যান্য বেশ কিছু দায়িত্ব বড় হুজুর আমাকে পালন করতে বললেন। একদিন দুপুরে উস্তাদজীর বাসায় বড় হুজুরসহ আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাব তখন মক্তবের উস্তাদজী বড় হুজুরের অনুপস্থিতিতে আমার কানে কানে বললেন, আমার বিবি বলেছে, সবাইকে পুরস্কার দেওয়া হবে! আমরা যে এত কষ্ট করে রান্নাবান্না করি, আমাদেরকে পুরস্কার দেওয়া হবে না!?
ওইদিন যখন উস্তাদজীর বাসায় গেলাম, সকলের খানা শেষ হওয়ার পর বড় হুজুর উস্তাদজীকে ডেকে বললেন, মাওলানা তোমার বউ আমাদের এত কষ্ট করে রান্নাবান্না করে খাওয়ায়! তোমার বউকে বইল, আল্লাহ পুরস্কার দেবেন।
এর আগে পরে আমি আর এমন কথা বলতে শুনিনি।
চার. আমি যতদিন বড় হুজুরকে দেখেছি; তাঁর মোবাইলে কখনো ফোন অথবা মিসডকল এলে তিনি কখনো উপেক্ষা করতেন না। ইনকামিং কল চাই পরিচিত হোক বা অপরিচিত, সবার সাথে মন খুলে কথা বলতেন। একদিন এক ভদ্রলোক তাকে ফোন করে বলল, আমি অমুক (যার সাথে বড় হুজুরের কোনো পরিচয় নেই)
বড় হুজুর জবাবে বললেন, জী বলুন।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি নাকি এই কথা বলেছেন, কেউ যদি ব্যাংকার কোনো আত্মীয়-স্বজনের বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায় (যাদের দাওয়াত উপেক্ষা করা যায় না) তাহলে মেহমান যেন হাদিয়াস্বরূপ কোনো কিছু মেজবানের বাড়িতে নিয়ে যায়। আর মেহমান যেন সেটা খাবারের বিনিময় হিসেবে গণ্য করে!
বড় হুজুর বললেন, জী আমি এই কথা বলেছি।
পাঁচ. একবার বড় হুজুরের সাথে এক মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাযের পর একটি জানাযা ছিল। মসজিদে বড় হুজুরের জুতা ও আমার জুতা একসাথে রাখি। নামায শেষে বের হয়ে দেখি, বড় হুজুরের জুতা আছে, আমার জুতা জোড়া হারিয়ে গেছে। জুতা ছাড়াই বড় হুজুরের সাথে চলতে শুরু করলাম। বড় হুজুর দেখলেন, আমার পায়ে জুতা নেই! জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জুতা কোথায়?
বললাম, হারিয়ে গেছে।
হুজুর আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন, এই টাকা দিয়ে তোমার জন্য জুতা কিনবে।
ওই দিনই আমি ২৫০ টাকা দিয়ে জুতা কিনে ব্যবহার শুরু করি। পর দিন বাকি ২৫০ টাকা ফেরত দিতে গেলে তিনি বললেন, তুমি কী জুতা কিনেছ, আমাকে দেখালে না!?
আমি সাথে সাথে বড় হুজুরকে জুতাজোড়া দেখালাম।
তিনি বললেন, মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর জুতা হয়েছে।
লেখক : প্রফেসর হযরত রাহ.-এর খাদেম