প্রফেসর হযরত রাহ.-এর কুরআন ও সীরাত চর্চার কিছু দিক
হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান সাহেব রাহ.-এর জীবনাচার এতই অকৃত্রিম, সহজ-সরল ও সাদামাটা ছিল যে, তা দ্বারা সিক্ত ও তৃপ্ত তো হওয়া যায়, কিন্তু ভাষার আঁচড়ে চিত্রিত করা যায় না। শুধু উপলব্ধি হয়—
بہار عالم حسنش دل و جاں تازہ مى دارد
برنگ اصحاب صورت را ببو ارباب معنى را
‘তার রূপের বসন্ত মন-প্রাণকে
উজ্জীবিত করে রাখে/
বাহ্যপন্থীদেরকে রং ও রূপ দ্বারা,
অন্তরপন্থীদেরকে রস ও সুবাস দ্বারা।’
তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রচার-বিমুখ একজন মানুষ।
তিনি ছিলেন এক ক্ষণজন্মা মনীষী। যেকোনো ক্ষণজন্মা মনীষীর মধ্যে এত অধিক উন্নত চরিত্রের সমাহার ঘটে যে, সংখ্যা নির্ণয় করা, উৎকর্ষ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা, সর্বোপরি কোনোটার ওপর কোনোটাকে প্রাধান্য দেওয়া— এক জটিল বিষয় হয়ে থাকে। তাছাড়া রুচি, বোধ, বিচার ও বিশ্লেষণের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও একটি সহজাত প্রকাশ। তবে হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান সাহেব রাহ.-এর সবগুলো গুণের মধ্যে ‘সিদ্ক’ ও ‘ইখলাস’ যে পূর্ণ মাত্রায় ছিল, তা নির্দ্বিধায় বলা যায় এবং তা ছিল সকলের কাছেই সুস্পষ্ট বিষয়।
‘সিদক’ ও ‘ইখলাস’ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. তারবিয়াতুস সালিক কিতাবে লেখেন—
‘উদ্দিষ্ট ইবাদতে পূর্ণতার স্তর অবলম্বন করাকে ‘সিদ্ক’ বলা হয় ইবাদতের মধ্যে গাইরে ইবাদতকে উদ্দেশ্য না বানানোকে বলা হয় ‘ইখলাস’। উদাহরণস্বরূপ, যেই নামাযকে শরীয়ত পরিপূর্ণ নামায আখ্যা দিয়েছে, সেভাবে নামায আদায় করা হল, ‘সিদ্ক’। অর্থাৎ, নামাযের জাহেরী ও বাতেনী আদবসমূহ পালন করে নামায আদায় করা হল, নামাযের ‘সিদ্ক’ নামাযের মধ্যে গাইরে ইবাদত, যথা ‘রিয়া’ এবং গাইরুল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছা না থাকা হল ‘ইখলাস’।
কুরআন ছিল হযরতের জন্য ‘আবে হায়াত’
কুরআন কারীম যে প্রফেসর হযরতের জন্য ‘আবে হায়াত’ (সঞ্জীবনী সুধা) ও প্রাণশক্তি ছিল, তা তো দিবালোকের ন্যায়ই সুস্পষ্ট বিষয়। এক্ষেত্রে হযরতের ‘সিদ্ক’ ও ‘ইখলাস’ ছিল শিক্ষণীয়, অনুসরণীয়, আদর্শ ও প্রবাদতুল্য। হযরতের ব্যক্তিগত কুরআন চর্চা, কুরআন তিলাওয়াত, তরজমা ও তাফসীর অধ্যয়ন, তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর তথা কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা, অন্যের কাছ থেকে প্রচুর কুরআন শ্রবণ করা, কুরআনকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা, কুরআনে বর্ণিত ঈমানদারগণের গুণাবলি দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করা, যেকোনো প্রসঙ্গে অতি সহজে এবং নিপুণ ও নিখুঁতভাবে কুরআনের উদ্ধৃতি তুলে ধরা, নাহ্ব, সরফ, ইরাব ও বালাগাত শাস্ত্রের তাহকীক করা, সম্ভাব্য একাধিক তাফসীর উল্লেখ করা, কুরআনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, উৎসাহিত করা ও সাহস যোগানো, কুরআনকে সহজভাবে উপস্থাপন করা, কুরআনের মক্তব প্রতিষ্ঠা করা, সেগুলোর দেখভাল করা, এর জন্য সফর করা, উস্তায, পরিদর্শক ও নেগরান প্রেরণ করা, এ সবের জন্য অর্থ যোগান দেওয়া— হযরতের জন্য এসব বিষয় ছিল মাছের জন্য পানির ন্যায়। এগুলো তো ছিল এ বিষয়ে হযরতের বাহ্যিক দিকের প্রতি সামান্য ইঙ্গিত, কিন্তু এসব বিষয়ে হযরতের যেই দরদ, মমতা, ফিকির, আহাজারি, পেরেশানি, কষ্ট স্বীকার ও অস্থিরতা, তা ছিল বে-মিছাল ও বে-নজীর।
হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর সরাসরি প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্নজন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মক্তবের সংখ্যা অনেক। এসব মক্তব সারা দেশে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং দরিদ্র, অবহেলিত ও নানাভাবে আক্রান্ত মফস্বলে ছড়িয়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে হযরত নিজে যেতেন, খোঁজ-খবর রাখতেন, প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন। হযরত যখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল, নিজে উঠতে পারেন না, বসতে পারেন না, খেতে পারেন না, জরুরত সারতে পারেন না, তখনো শত শত কিলোমিটার পথ সফর করে এগুলোর দেখাশোনা করতেন। সমস্যার সমাধান করতেন। প্রয়োজন ও চাহিদা পূর্ণ করতেন। আলহামদু লিল্লøাহ, সেসব কার্যক্রম এখনো যথারীতি চালু রয়েছে।
কুরআন তিলাওয়াত সহীহ-শুদ্ধ করা, নিয়মিত তিলাওয়াত করা এবং হিফয করার বিষয়ে হযরত অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। যে যে অবস্থানে আছে, তাকে সেখান থেকে উপরের স্তরে ওঠানোর জন্য অনেক বেশি হিম্মত দিতেন এবং তাগিদ দিতেন। কুরআন হিফয করার ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত ছেলে-মেয়ে, সবল মেধা ও দুর্বল মেধা এবং বয়সের ছোট-বড়র বিষয়টি মূখ্য হিসেবে দেখতেন না। তাঁর দৃঢ়তা এবং উৎসাহের কারণে অনেকে মাঝপথে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। তারাবীহের নামাযে হাফেযগণের কুরআন খতম করার ব্যাপারে হযরত অনেক বেশি তাগিদ দিতেন। এর অন্যথা করলে তিনি অনেক কষ্ট পেতেন। যারা হিফয করার পর ভুলে গিয়েছে, তাদেরকে নানা কৌশলে পুনরুদ্ধার করতে বলতেন। সাহস যোগাতেন। উৎসাহ দিতেন। গুরুত্ব বুঝাতেন। বলতেন, প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা মুখস্থ করে নামাযের মধ্যে সেই এক পৃষ্ঠা শুনিয়ে দাও। হযরত এদেরকে দিনমজুরের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতেন, দেখো না! দিন মজুররা দিন এনে দিন খায়। কাউকে বা বলতেন, তোমার হারানো জমি উদ্ধার করো। যাদের মোটামুটি মুখস্থ আছে, তাদেরকে মজবুত করার জন্য খুব তাগিদ দিতেন এবং বলতেন, মচমচা হাফেয চাই। সাধারণ মানুষকে এক-দুই আয়াত করে মুখস্থ করতে বলতেন। সূরা ইয়াসীন, ওয়াকিয়া, মুলক ইত্যাদি সূরা একটি একটি করে মুখস্থ করতে বলতেন। সেগুলোর অর্থ শিখতে বলতেন।
কোনো ছাত্র যখন হিফযের শেষ সবক শোনাতো, সেই মজলিসটি হত দেখার মতো। কী যে এক অভূতপূর্ব নূরানী ও অপার্থিব পরিবেশ সেখানে কায়েম হত, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আনন্দে হযরতের চেহারা ঝলমল করে উঠত। খুশিতে হযরত কেবলই কাঁদতে থাকতেন। যেন রাজ্য জয়ও এর কাছে অতি গৌণ বিষয়। মজলিসের শুরুতেই ছাত্রের নাম-পরিচয় ঘোষণা করা হত। ছাত্রকে অভিভাবককে সবার সামনে সসম্মানে দাঁড় করানো হত। এ দৃশ্য দেখে কত জনের অন্তরে যে বাসনা সৃষ্টি হত, আহা! আমি যদি এমন সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতাম! আগে হযরত নিজেই সাধারণত শেষ সবক শুনতেন। মাজুর হওয়ার পর হযরতের নির্দেশে অন্য কেউ শেষ সবক শুনত।
কুরআন হিফয করার সময় অন্য কিছু পড়ানো হযরত পছন্দ করতেন না। এতে করে হিফযের মান ঠিক থাকে না। অনেকে তো শেষ পর্যন্ত আর হিফযই করতে পারে না। হযরত বিভিন্ন মক্তব ও কিন্ডার গার্টেনের বাস্তব দৃষ্টান্ত সামনে এনে বলতেন, তাদের হাতের লেখা সুন্দর হয়। তারা বাংলা-অঙ্ক-ইংরেজিতে ভালো করে ঠিকই, কিন্তু তাদের কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত কাক্সিক্ষত পর্যায়ের হয় না।
হযরত একেকটি বাচ্চাকে মক্তব ও হিফযখানায় নিয়ে আসার জন্য এবং তাদেরকে এ পথে টিকিয়ে রাখার জন্য কী পরিমাণ যে কষ্ট করেছেন এবং দৌড়-ঝাঁপ করেছেন— বলে শেষ করার মতো নয়। হযরত চাইতেন, বাচ্চাদেরকে হাসি-আনন্দের মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হোক। হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে যেন তারা হাফেয হয়ে যায়। আর এটা শুধু হযরতের স্বপ্নই ছিল না, বরং নিজে এটা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। বর্ণ পরিচয় লাভের পূর্বেই অনেক শিশু কুরআনের অংশ কেবল মুখে মুখে শুনে শুনে মুখস্থ করেছে। এমন নজির অনেক। হযরত বাচ্চাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ইজতিমায়ী মজলিসে মাইকে কুরআন পড়াতেন। এতে তারা অনেক উৎসাহ বোধ করত। ছোট শিশুরা মানুষের সামনে মাইকে তিলাওয়াত করতে ভয় পেত বা লজ্জা বোধ করত, তখন হযরত তাদের চোখ চেপে ধরে তিলাওয়াত করতে বলতেন। শিশুদেরকে হযরত নিয়মিত বার্ষিক পুরস্কার দিতেন। এজন্য মরহুম খতীব মাওলানা উবায়দুল হক ছাহেব রাহ.-এর উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত বলতেন, আমরা আগে বাচ্চাদেরকে বই পুরস্কার দিতাম, কিন্তু তিনি বলতেন, বাচ্চাদেরকে এমন কিছু পুরস্কার দিন, যাতে তারা নগদে আনন্দ বোধ করে। বইয়ের মর্ম ওরা কী বোঝে?
একারণে পরবর্তীতে সিরামিকের বাসন পুরস্কার দিতেন। অকৃতকার্য শিশুদেরকেও হযরত গুরুত্বের সাথে পুরষ্কৃত করতেন। মানুষ সাধারণত এটাকে সান্ত্বনা পুরস্কার বলে থাকে, কিন্তু হযরত এটাকে উৎসাহ পুরস্কার নাম দিতেন। ছাত্রদের ছাড়াও অতিথি শিশুদেরকেও হযরত পুরস্কার দিতেন।
অনেক ঘরোয়া মাহফিলে এমনও হয়েছে, হযরত উপস্থিত হাফেযগণ দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত করিয়ে দুআর মাধ্যমে মাহফিল শেষ করে দিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বয়ান করানোর প্রতি বিশেষ ইহতিমাম করতেন না। হাফেযদের সংখ্যা কখনো দশ-বারো-পনেরো জনও হত।
হযরত কখনো কুরআন কারীমের একই অংশ একাধিক হাফেযের দ্বারা তিলাওয়াত করাতেন, আবার একের পর এক ধারাবাহিক তিলওয়াতও শুনতেন। অনেক সময় তিলাওয়াতকৃত কোনো অংশের অর্থ ও তাফসীর আলোচনা করতেন। বিশেষ করে কোনো আলেম সেখানে উপস্থিত থাকলে এ বিষয়ে তার দ্বারা বয়ানও করাতেন।
যারা শুধু কুরআনের খেদমতে নিয়োজিত, হযরত তাদেরকে অনেক বেশি ভালবাসতেন এবং পছন্দ করতেন। তাদের বিশেষভাবে খেদমত করার চেষ্টা করতেন। হযরত কোনো কোনো সময় বলতেন, আমার মন চায়, সব ব্যস্ততা বাদ দিয়ে নিমতলীর মক্তবে পড়ে থাকি।
হযরতের এ বিষয়টি তো সর্বজনবিদিত যে, মক্তবের বাচ্চাদেরকে ‘আলিফ-বা’ পড়ান— একথা শুনে প্রফেসর হযরতের শায়েখ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তার কপালে চুম্বন করেছেন।
প্রফেসর হযরতের কুরআন অধ্যয়ন ও চর্চা বিশেষ কিছু আয়াত, সূরা বা জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং পুরো কুরআন শরীফের উপরেই হযরতের অসাধারণ দখল ছিল। যে কারণে যেকোনো পরিস্থিতি এবং যেকোনো বিষয়ে হযরত কুরআন দ্বারা অতি চমৎকার দলীল পেশ করতেন। বয়ানের মধ্যে একের পর এক বিষয়ভিত্তিক আয়াত উল্লেখ করে তার ওপর সাবলীলভাবে আলোচনা করতেন। হযরতের কুরআনের তরজমা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, প্রাঞ্জল ও প্রভাবক।
একই বিষয়ে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আয়াতের মধ্যে ভাষা, উপস্থাপনা ও পূর্বাপরের ভিন্নতা সম্পর্কে হযরত সবিশেষ ওয়াকিফহাল ছিলেন। সেগুলো নিয়ে তিনি তুলনামূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণ করতেন, যা উলামায়ে কেরামের জন্য বড়ই বিস্ময়ের এবং আনন্দের বিষয় হত।
হযরতের অতি প্রিয় এবং অতি আগ্রহের একটি আমল ছিল, তাফাক্কুর ফী খালকিল্লাহ তথা আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা। রাতের বেলা সফরের মাঝে গাড়ি থামিয়ে এবং গ্রামে রাত্রি যাপন করা হলে সন্ধ্যা রাতে, মধ্য রাতে এমনকি গভীর রাতে খোলা মাঠে গিয়ে হযরত নিজে তারকা দেখতেন, অন্যদেরকে দেখাতেন এবং এ বিষয়ে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে সপ্তর্ষীমণ্ডল বা আদমসুরতের পরিচয়, এগুলোর নাম ও নামকরণ বিষয়ে আলোকপাত করতেন। রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে বা অন্য কোনো কারণে বিরক্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হযরত তারকামণ্ডলির বিষয়ে আলোচনা আরম্ভ করলে সকলের বিরক্তিও কেটে যেত, সময়ও পার হয়ে যেত, উপরন্তু তা হয়ে উঠত আনন্দ ও শিক্ষার উপকরণ।
কুরআন ও বিজ্ঞান বিষয়ে হযরতের আলোচনা হত অত্যন্ত সহজবোধ্য, হৃদয়গ্রাহী, চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। হযরত একসময় এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারও দিয়েছেন। হযরত সাধারণত আকাশ, সৌরজগৎ, নক্ষত্র, সূর্য, আলো, পানি, পাহাড়, সাগর, নৌযান, ভ্রূণ, লোহা ও সম্প্রসারণশীল বিশ্ব ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করতেন এবং বলতেন, কত বার সুবহানাল্লাহ বলবেন! বলুন, সুবহানাল্লাহ! বলুন, আল্লাহু আকবার! বলুন, আলহামদু লিল্লাহ!
হযরত আয়াত পাঠ করতেন—
فَفِرُّوْا اِلَى اللهِ
আল্লাহর দিকে দৌড়াও! আল্লাহর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করো! আল্লাহর দিকে পালাও! হযরত বলতেন, আল্লাহর কুদরতের এসব আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহর অভিমুখী হওয়া।
হযরত এজাতীয় বিষয়কে সীমার মধ্যে রাখার শিক্ষা দিতেন। অতিরঞ্জন করতে নিষেধ করতেন। একবার হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর গ্রামের বাড়ির মাদরাসায় হযরত গেলেন। সকলে আবদার করল, কুরআন ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে। হাফেজ্জী হুজুরের আপনজনদের আবদার! হযরত আবদার রক্ষা করলেন। এ বিষয়ে আলোচনা করলেন এবং যথারীতি পরিপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর আলোচনা করলেন। সকলে বিমুগ্ধ ও অভিভূত হল।
এবার সকলের জোর দাবি, প্রতি মাসে এই ক্লাস একবার করে করতে হবে।
হযরত বললেন, সাহাবায়ে কেরাম কি এসব গবেষণা করে ঈমান এনেছিলেন! তাঁদের ঈমান ছিল সহজ-সরল। তাঁরা বলেছেন—
رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ.
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা এক ঘোষককে ঈমানের দিকে ডাক দিতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনো’ সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। কাজেই হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন, আমাদের মন্দসমূহ আমাদের থেকে মিটিয়ে দিন এবং আমাদেরকে পুণ্যবানদের মধ্যে শামিল করে নিজের কাছে তুলে নিন। —সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৯৩
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত দিয়েছেন, আর সাহাবায়ে কেরাম সরলভাবে ঈমান এনেছেন।
বিজ্ঞান ও কুরআন বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শরীয়তের শিক্ষা ও রুচি-প্রকৃতির প্রতি হযরত অত্যধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং বিষয়টিকে সংবেদনশীল মনে করতেন। এ বিষয়ে হযরতের মুখেই তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনুন—
“মুসলমানদের অনেকের মধ্যে ফেরেশতাদের বিষয়ে জঘন্য অবিশ্বাস আছে। আমাদের বুয়েটে একবার সেমিনার হল। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত পদার্থবিদ, নাম বললে চিনে ফেলবেন। তিনি সেমিনার করলেন। সেমিনারের বিষয়বস্তু— ফেরেশেতারা হল প্রাকৃতিক শক্তি। নাউযু বিল্লাহ বলেন। তিনি ইংরেজিতে বয়ান করলেন। আমি কেবল কান চেপে ছিলাম। আমি তো মৌলভিদের গোলাম। আমি একটা প্রশ্ন করব, যদি চান্স মেলে।
আল্লাহর মেহেরবানী, উপস্থাপক বলল, সেমিনারের বক্তার কথা শেষ। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারেন।
আমি একটা প্রশ্ন করলাম। আমরা ফেরেশতাদের সম্পর্কে জানি যে, তারা ঈমানদারদের জন্য দুআ করে। মুসলমানদের ঘেরাও করে রাখে এবং দুআ করে। যারা বিজ্ঞান পড়ি, তারা সবাই জানি যে, প্রাকৃতিক শক্তি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবার সাথে সমান ব্যবহার করে। ঈমানের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই। প্রাকৃতিক শক্তির মানুষের সাথে ব্যবহার কি ঈমানের ওপর নির্ভরশীল? আমি কুরআনের আয়াত বললাম—
الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ.
যারা (অর্থাৎ যে ফেরেশতাগণ) আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে— হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার রহমত ও জ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যপ্ত। সুতরাং যারা তওবা করেছে ও তোমার পথের অনুসারী হয়েছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষ করো। —সূরা মু’মিন (৪০) : ৭
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন, আমার ফেরেশতারা ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে। আপনি যে বললেন, প্রাকৃতিক শক্তি, তাহলে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেন!
বুয়েটের ঐতিহাসিক ঘটনা। ডক্টর ওয়াহীদুজ্জামান তখন ভিসি। আমার মৌলভি সাবদের কাছ থেকে শেখা জওয়াবের পরে তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। সেমিনারে উপস্থিত এক শ’র উপরে পিএইচডি-ধারী লোক, কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। সেমিনার ওখানেই শেষ হয়ে গেল। নামাযী মানুষ, দাড়িওয়ালা মানুষ, টুপিওয়ালা মানুষ, কিন্তু আকীদার কী সর্বনাশ হয়ে আছে! তার আকীদা হল, ফেরেশতা আছে ঠিকই, ফেরেশতা কোন্টা? প্রাকৃতিক শক্তিগুলোই ফেরেশতা।”
“এর পরের ঘটনা আরও জঘন্য! তিন মাস পর তিনি বই প্রকাশ করলেন ঐ বিষয়ের ওপর। বইয়ের মধ্যে ভূমিকা লিখে দিয়েছে ডক্টর আব্দুস সালাম। নোবেল প্রাইজ বিজেতা বিজ্ঞানী। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিউরিটিক্যাল ফিজিক্স-এর প্রধান। তিনি ভূমিকার মধ্যে প্রশংসা করেছেন যে, এই পদার্থবিদের কুরআন সম্পর্কে যে ধারণা, তা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এটা কে বুঝাবে যে, আব্দুস সালাম একজন কাদিয়ানী ছিলেন।
আপনাদের মধ্যে অনেকে চেতে যাবেন। আপনারা মৌলভি সাবদের সাথে থাকেন, মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, এটার কোনো দামই দিতে চান না।
তিনি বিজ্ঞানী হতে পারেন। তাঁর বিজ্ঞান সাধনা প্রশ্নাতীত। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তিনি কী জানেন? বিজ্ঞানী হলে কি ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান হয়ে যায়? বাংলায় কথা আছে— মদ্যশালায় চুরি হয়েছে। মদবিক্রেতা নালিশ করেছে। এখন তার নালিশের সাক্ষী কে হবে? মদবিক্রেতার সাক্ষী মাতালেরা। শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। এটা কে বুঝাবে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেই জিনিসের কথা বলেছেন, আমরা ফেরেশেতাদের নাম নিলে বলি, আলাইহিস সালাম। প্রাকৃতিক শক্তির নাম নিলে আমরা কি আলাইহিস সালাম বলি? ঝড় আলাইহিস সালাম, তুফান আলাইহিস সালাম, পানির স্রোত আলাইহিস সালাম— এই রকম কি বলেন? ফেরেশতা ব্যক্তি, নাকি শক্তি? তারা ব্যক্তিসত্তা। তাদের নাম নিলে নবীদের নামের মতো আমরা বলি, জিবরাইল আলাইহিস সালাম, মিকাইল আলাইহিস সালাম। তাহলে কী দাঁড়াল? আমাদের পদার্থবিদ অতি সম্মানিত ব্যক্তি। পদার্থবিদ বিরাট। কিন্তু আকীদার ব্যাপারে কোনো খবর নাই।”
প্রফেসর হযরত রাহ. বারবার বলতেন, হাকীমুল উম্মত রাহ. বলতেন, কুরআনে ইতিহাসের আলোচনা রয়েছে, কিন্তু এটি ইতিহাসের গ্রন্থ নয়। কুরআনে বিজ্ঞানের আলোচনা রয়েছে, কিন্তু এটি বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয়। কুরআন হল, আত্মার রোগের হাসপাতাল।
হযরত বলতেন, আল্লাহ তাআলা কালামে পাকে কাফেরদের কুফ্র ভরা উক্তি বারবার উল্লেখ করে খণ্ডন করেছেন আমাদের ঈমানকে মজবুত করার জন্য, নিখাদ করার জন্য। এর উদাহরণস্বরূপ হযরত অনেকগুলো আয়াতই পেশ করতেন। তার মধ্যে অধিক আলোচিত কয়েকটি আয়াত তুলে ধরা হল—
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ.
তারা বলে, জীবন বলতে যা কিছু তা ব্যস আমাদের এই পার্থিব জীবনই। আমরা এখানেই মরি এবং বাঁচি। আর আমাদেরকে কেবল কালই ধ্বংস করে। —সূরা জাছিয়া (৪৫) : ২৪
وَإِذَا قِيلَ إِنَّ وَعْدَ اللٰهِ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ لَا رَيْبَ فِيهَا قُلْتُم مَّا نَدْرِي مَا السَّاعَةُ إِن نَّظُنُّ إِلَّا ظَنًّا وَمَا نَحْنُ بِمُسْتَيْقِنِينَ .
এবং যখন তোমাদেরকে বলা হত, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত এমন এক বাস্তবতা, যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলতে, আমরা জানি না— কিয়ামত কী! এ সম্পর্কে আমরা মনে করি— এটা একটা ধারণামাত্র। এ সম্পর্কে আমরা বিলকুল বিশ্বাসী নই। —সূরা জাছিয়া (৪৫) : ৩২
এরকম আরো অনেক আয়াত উদ্ধৃত করতেন।
প্রফেসর হযরত রাহ. কুরআন কারীম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সহজে ব্যাপক জানাশোনার জন্য, বিশেষভাবে তাসহীহে কুরআনের জন্য এবং যারা সাধারণত কুরআনের মজলিস এবং উলামায়ে কেরামের সোহবত থেকে দূরে অবস্থান করে তাদেরকে কুরআনের দিকে এবং ওলামায়ে কেরামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য Learning the Language of Holy Quran (LLHQ) নামে কুরআনের ক্লাস আরম্ভ করেন। সময় ও সুযোগমতো বিভিন্ন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় এ ক্লাস হয়। দীর্ঘ একটি সময় বুয়েটের বাইতুস সালাম মসজিদে প্রতি মঙ্গলবারে এ ক্লাস চলে। আলহামদু লিল্লাহ, এখনো ক্লাসটি যথারীতি চালু রয়েছে। হযরতের জীবদ্দশা থেকেই দীর্ঘদিন ধরে হযরতের নির্দেশ ও দিকনির্দেশনায় হাফেয মাওলানা মুশাররফ ক্লাসটি পরিচালনা করছেন। বর্তমানে বুয়েটের কেন্দ্রীয় মসজিদে এই ক্লাস হয়ে থাকে।
এই ক্লাসে তাসহীহে কুরআন এবং তিলাওয়াতে কুরআনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। সাথে সহজভাবে নাহ্ব, সরফ ও ইশতিকাক বিষয়ে প্রাথমিক কিছু আলোচনা ও চর্চা করা হয়ে থাকে। হযরত বলতেন, Beginning With a Beginner (BWB)। যাতে করে যেকোনো সময় নতুন কেউ এলে সেও এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। সবার জন্য এ ক্লাস অবারিত। বেশভূষা ও পোশাক-পরিচ্ছদ ভিন্ন ঘরানার হওয়ার কারণে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। এ ধরনের মানুষকে হযরত সাদরে গ্রহণ করতেন এবং সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন। যে কারণে যে কেউ নিঃসঙ্কোচে এখান থেকে উপকৃত হতে পারত।
হযরতের সীরাত অধ্যয়ন
হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান সাহেব রাহ.-এর দ্বিতীয় প্রধান অধ্যয়ন, অনুশীলন ও আলোচনার বিষয় ছিল, সীরাতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সীরাতে সাহাবায়ে কেরাম রা.। প্রতিদিন নিয়মিত এর মজলিস হত। সীরাতের আলোচনায় হযরত কী পরিমাণ যে প্রভাবিত হতেন এবং অঝোরে, অবিরাম ও অকৃত্রিম কাঁদতেন, তার নিত্যদিনের সাক্ষী সেই মজলিসের নিয়মিত অংশগ্রহণকারীগণ। সেই মজলিসের আলোচনায় সাহাবায়ে কেরাম জীবন্ত হয়ে উঠতেন। সাহাবায়ে কেরামের পূতপবিত্র আলোচনার সুবাসে শ্রোতাগণ বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হয়ে উঠত। ঈছার, মুওয়াসাত ও কুরবানীর জযবা উজ্জীবিত হয়ে উঠত। সাহসে বলীয়ান হয়ে উঠত। ইয়াকীন, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠত। সর্বোপরি এক অপার্থিব পবিত্র ও স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় আবহ দেহ-মন ও পরিবেশকে বিমোহিত করত। প্রত্যেক শ্রোতা আপন আপন যোগ্যতা অনুপাতে পরিতৃপ্ত ও পরিতুষ্ট হয়ে বিদায় নিত। যা কেবল আস্বাদন করার বিষয়; বর্ণনার বিষয় নয়। বিশেষ করে হযরত মুসআব রা. এবং জা‘ফর রা.-এর ঘটনা পড়ার সময় হযরত তো পুরোপুরিই আত্মহারা হয়ে পড়তেন। অঝোরে শুধু কাঁদতেই থাকতেন। তাঁদের বিষয়ে হযরতের উপস্থাপনও ছিল বড় হৃদয়গ্রাহী। শ্রোতারা এতে আপ্লুত অশ্রু-সিক্ত হয়ে উঠত।
আল্লাহ তাআলা হযরতের এসমস্ত নেক আমল কবুল করুন। আমাদেরকে তাঁর অনুসরণ করার এবং এ ধারাকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার তাওফীক দান করুন— আমীন।