আমি কিংবদন্তিতুল্য আকাবির দেখিনি প্রফেসর হামীদুর রহমান রাহ.-কে দেখেছি
হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান রাহ.। দ্বীনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে কৈশোর ও যৌবনেই যাঁর অন্তরে তাকওয়া ও তাহারাত, আল্লাহভীরুতা ও চারিত্রিক নির্মলতা শেকড় গেড়ে নিয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকার বেশ কিছু আল্লাহওয়ালা আলেমের সংসর্গ লাভ করে যাঁর তাকওয়া ও তাহারাত দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল। এর পরের কাহিনী তো বিস্ময়কর। তিনি সোহবত লাভ করলেন বাংলাদেশের সর্বজনস্বীকৃত বুযুর্গ হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের, যিনি ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সোহবতধন্য এবং তাঁর খলীফা।
হযরত হাফেজ্জী হুজুরের সোহবত ও সংসর্গ লাভ করে হযরত হামীদুর রহমান রাহ. সৌভাগ্য ও সুযোগ লাভ করলেন নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার, নিজেকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলার। এমনভাবেই নিজেকে তিনি গড়ে তুললেন যে, তাঁকে দেখলে, তাঁর কাছে কিছু সময় বসলে, তাঁর আচার-আচরণ দেখলে, তাঁর কথা শুনলে মনে হত, আমি কোনো সাহাবীকে দেখিনি, পূর্ববর্তী কোনো বুযুর্গকে দেখিনি, দেখিনি আমাদের কিংবদন্তিতুল্য আকাবিরের কাউকে, কিন্তু আমি দেখতে সক্ষম হয়েছি হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমানকে। মনে হত যে, সাহাবীরা তো এমনই ছিলেন, আমাদের আকাবির বুযুর্গগণ তো এমনই ছিলেন। এই অনুভূতি বোধকরি আমার একার নয়, অনেকের। তাঁর স্বভাব ও চরিত্র, তাঁর মেযাজ ও প্রকৃতি, তাঁর মন ও মানসিকতা তেমনটাই ছিল, যেমনটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাম্য।
তাকওয়া ও তাহারাত, দুনিয়াবিরাগ, দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ততা, আখেরাতের প্রতি ধ্যানমগ্নতা, আখেরাতকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্যদান, সর্বক্ষেত্রে নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দান, অন্যের আরাম-আয়েশকে নিজের আরাম-আয়েশের ওপর প্রাধান্যদান, আত্মবিলোপ, প্রচারবিমুখতা, সকলের প্রতি স্নেহ ও মমতাপ্রবণতা, সকলকে সমচোখে দেখার উদার মানসিকতা, শরীয়তের দিকনির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে মধ্যপথ অবলম্বন ও পরিমিতিবোধ, ছোট বড় সকল হক্কানী আলেমের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ, এমনকি শত শত যেসব আলেমের তিনি পীর ও মুর্শিদ তাদের প্রতিও বয়সভেদে স্নেহ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ ইত্যাদি প্রশংসনীয় প্রায় বহু গুণের অধিকারী ছিলেন আমাদের হযরত হামীদুর রহমান রাহ.।
সকল কর্ম আল্লাহর জন্য, কাজে ও কর্মে স্বার্থহীনতা— যাকে আমরা ইখলাস বলে জানি, সেই গুণের এক প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। বে-লাওছ ও বে-গরজ-কেই বলা হয় ইখলাস। ব্যক্তির মধ্যে স্বার্থের লেশমাত্রও যখন থাকে না তখনই ঐ গুণকে ইখলাস বলা যায়। যিনি মুখলিছ হন তাঁর এই অনুভূতিও থাকে না, তাঁর মধ্যে ইখলাস-গুণটি বিদ্যমান আছে। অতিশয়োক্তি হবে না, যদি বলি যে, আমাদের প্রফেসর হযরত এরকমই মুখলিছ বান্দা ছিলেন।
কুরআন কারীমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আশিকানা। কুরআন তিলাওয়াত, অন্যের মুখে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ ছিল তাঁর নিয়মিত আমল। জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরবী ব্যাকরণ ও প্রয়োজনীয় শাস্ত্রের শিক্ষা তিনি লাভ করতে পারেননি; কিন্তু কুরআনের মর্ম হৃদয়ঙ্গম করার জন্য যতটুকুন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রাদির জ্ঞান, ততুটুকু পরিমাণ তিনি ঠিকই অর্জন করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভা তো ছিলই। তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। বয়ান ও বক্তব্যে সাবলীলভাবে একের পর এক আয়াতের উদ্ধৃতি দিতেন। যেভাবে কুরআনের আয়াত উপস্থাপন করতেন, তা থেকে অনুমান করা যেত, কুরআনের প্রতি তাঁর কী অগাধ ভালবাসা ছিল, কুরআন কারীমে তাঁর কী পরিমাণ জ্ঞানগত দখল ছিল। আয়াতের তরজমা বলার পর তিনি প্রায়শই যেসব শব্দ ব্যবহার করতেন তা ছিল, ‘অপূর্ব!, ‘আল্লাহ তাআলা কত চমৎকার বলেছেন!’ ইত্যাদি। এ থেকে কুরআনের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথাও বোঝা যেত। কুরআনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি রূহ ও প্রাণের মর্যাদা রাখে তা হল, তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর। হযরত তাফাক্কুর ও তাদাব্বুরের সঙ্গে কুরআন অধ্যয়ন করতেন।
এতদসংক্রান্ত আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার শোকর বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমার উস্তায ও জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হযরতকে উদ্ধৃত করে বললেন, হযরত হামীদুর রহমান রাহ. শোকরের ব্যাখ্যায় এক কথায় বলেছেন, শোকর হল তাকওয়া। বিষয়টি অনেকদিন ভেবেছি, খুব ভালো বুঝে আসেনি। হঠাৎ একদিন সূরা আলে ইমরানের ১২৩ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, হযরত কেন এরকম বলেছেন। আয়াতটিতে বলা হয়েছে—
وَ لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَّ اَنْتُمْ اَذِلَّةٌ ۚ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.
আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে বদরে বিজয় দান করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে তখন সহায়-সম্বলহীন। অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, তাহলে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারবে।
এখানে আল্লাহ তাআলা বিজয়দান করার অনুগ্রহ জাহির করেছেন। এরপরে স্বাভাবিকভাবেই সাহাবায়ে কেরাম যেন আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন— ক্ষেত্রটি ছিল সেই কথা বলার। কিন্তু আল্লাহ তাআলা শোকর আদায় করার কথা না বলে বিজয়দানের অনুগ্রহ জাহির করার অব্যবহিত পরেই তিনি তাঁর তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলেছেন। এরপর বলেছেন, তাহলে তোমরা শোকর আদায়কারী হয়ে যাবে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করার উপায় হল তাঁর তাকওয়া অবলম্বন।
আমি হযরতের সংসর্গ কাক্সিক্ষত পরিমাণ লাভ করতে পারিনি। আমার সে সৌভাগ্য হয়নি। আমার অলসতাই এর জন্য দায়ী। উত্তরায় হযরতের মাহফিলে কোনোদিন যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আজিমপুরের শনিবারের সাপ্তাহিক মাহফিলে মাঝে মাঝে এবং ধানমন্ডিতে হযরতের ছেলে আমাদের প্রিয় মাসীহ ভাইয়ের মাদরাসার মাসিক মাহফিলে কখনো কখনো যাওয়া হয়েছে। বাসা থেকে আমি আজিমপুরে যেতাম রিকশায়। ফেরার সময় কখনো আমি রিকশায় আসতে পারিনি। প্রতিবারই হযরত কারো কোনো গাড়িতে আমাকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। কখনো কখনো নিজের গাড়িতেই আমাকে পৌঁছে দিতে তাঁর ছেলে মাসীহ ভাইকে নির্দেশ দিয়েছেন।
একবারের ঘটনা। আমি হযরতকে বললাম, হযরত, আপনার গাড়িতে আমি গেলে আপনার কষ্ট হবে। কারণ, গাড়ি আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আজিমপুরে ফিরে আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যাবে। আর আপনি যাবেন উত্তরায়। বাসায় পৌঁছতে আপনার অনেক দেরি হবে।
তিনি উত্তরে যা বললেন, তা রীতিমতো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে আমার অন্তরে। তিনি বললেন, ‘আমার আরো বেশি কষ্ট হবে, যদি আপনি রিকশায় যান।’
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। আর কিছু না বলে আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
আরেকবারের ঘটনা। হযরতের নির্দেশ অনুযায়ী মাহফিলে আমি কিছু কথা বললাম। মাহফিল তখনো শেষ হয়নি। হযরতকে বললাম, হযরত, আমি চলে যেতে চাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
আমি বললাম, হযরত আপনি বসেন, আমি চলে যাই। তিনি কোনো কথা বললেন না। আমার হাত ধরে এভাবে উঠে দাঁড়ানোর কারণ কী— তা তখনো আমি বুঝতে পারছিলাম না। বুঝলাম তখন, যখন তিনি আমার হাত ধরে ধীর পায়ে কামরার বাইরে এলেন এবং হাত ধরা অবস্থাতেই তিনি তাঁর গাড়ির সামনে আসলেন। বুঝলাম যে, তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে দিতে এসেছেন। তিনি আমাকে তাঁর গাড়ির সামনে নিয়ে এসে নিজেই গাড়ির দরজা খুললেন। আমাকে বসতে বললেন। সুবোধ বালকের মতো আমি তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। গাড়িতে বসার পর তিনি নিজেই দরজাটা বন্ধ করলেন। ড্রাইভারকে বললেন আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দিতে। একা ছাড়লেন না। হযরত তাঁর নাতি উসমান ও তাঁর খাদেমকে বললেন, যাও সঙ্গে যাও, পৌঁছে দিয়ে আসো। শুধু তা-ই নয়, বরং যতক্ষণ না গাড়ি গেটের বাইরে আসল ততক্ষণ তিনি জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। যেন তিনি প্রিয় কাউকে অনেকদিনের জন্য বিদায় দিচ্ছেন। আমি অভিভূত, বিমুগ্ধ। ভাবলাম এরকম পীরও হয়! যিনি তাঁর স্বল্প কয়েকদিনের সোহবতে আসা নগণ্য একজন মুরীদের প্রতি এতটা ভালবাসা পোষণ করেন!
আরেকটি স্মৃতিচারণ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। বছর দুয়েক পূর্বে আমি বেশ পেরেশান ছিলাম। পেরেশানীটা ছিল এই, ঢাকায় কোনো আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। আমার মৃত্যুর পরে ছেলে ও স্ত্রী কোথায় যাবে? কোথায় থাকবে? সেই সময়ে কোনো একদিন আজিমপুরের মাহফিলে গেলাম। মাহফিল শেষে হযরতের কামরায় গেলাম। হযরত জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকায় কোনো কিছু করেছেন?
আমার উত্তর নেতিবাচকই ছিল। হযরত বললেন, একটা ফ্ল্যাট খরীদ করে নেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। প্রথম কথা, আমি তো এ বিষয়ে তাঁকে কোনোদিন কিছু বলিনি এবং ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি তো ঐ বিষয়ে কোনো চিন্তাও করছিলাম না। হযরত তাহলে কীভাবে আমার পেরেশানীর কথা জানলেন? কাশফ? তাই বোধহয়। তারপর এজাতীয় কথা তো তাঁর বলার কথা না। কেন বললেন? আমার চিন্তা ও পেরেশানী দূর করার জন্য? ঠিক তা-ই। কারণ, হযরতের ঐ কথা শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই আমার অন্তরে এই কথা উদিত হতে পারত যে, হযরত যখন বলেছেন তখন কোনো না কোনোভাবে একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়েই যাবে। কিন্তু আমার অন্তরে তা উদিত হয়নি; বরং হযরত এ কথা বলার পর আমার অন্তরে ফ্ল্যাট-ক্রয় বিষয়ে যে চিন্তা ও পেরেশানী ছিল— তা দূরীভূত হয়ে গিয়েছে। এটাকে কী বলব— তা জানি না। কারামত? হতে পারে। রূহ ও আত্মার চিকিৎসা এরকম মানুষের সাহচর্যে খুব সহজেই হয়ে যায়।
যতদিন জীবিত ছিলেন কদর করতে পারিনি। এরকমই হয়। আমরা এরকমই। আমরা নয়, আমি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন বর্তমানে যেসকল আলেম ও বুযুর্গ আমাদের মাঝে জীবিত আছেন তাঁদেরকে ভালবাসার, তাঁদেরকে মূল্যায়ন করার। তাঁদের কাছে কিছু সময় বসার।
আমার চেয়ে সকলেই ভালো— এই অনুভূতি যদি অন্তরে বিদ্যমান থাকে তাহলে আল্লাহর যেকোনো নেক বান্দা (সালিহ ও মুসলিহ)-এর মাধ্যমেই আমার নফস ও কলবের চিকিৎসা হতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে রোগমুক্ত করে নেওয়াটাই শ্রেয়।
وما توفيقي إلا بالله، حسبي الله ونعم الوكيل، نعم المولى ونعم النصير.