পরিবারবর্গের স্মৃতিচারণায় প্রফেসর হযরত রাহ.
بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা
الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد :
সালাফে সালিহীনের এই বাণী প্রসিদ্ধ আছে-
عنْدَ ذِكْرِ الصَّالِحِيْن تنْزل الرَّحْمَة.
‘যখন নেককারদের গুণ আলোচনা হয়, তখন আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।’ নেককার বলতে ওইসকল লোক উদ্দেশ্য, যারা ঈমানের সাথে তাকওয়ার যিন্দেগী যাপন করে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণ করে এবং শরীয়ত ও সুন্নতের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়। মূলত এগুলোই আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের সিফাত। এজন্য ওই বাণীর তরজমা এভাবেও করা হয়, ‘আল্লাহওয়ালা লোকদের আলোচনায় আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।’
এর চেয়ে বড় রহমত আর কী হবে যে, তাঁদের আলোচনা দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়, আখেরাতের স্মরণ তাজা হয়, আমলের জযবা তৈরি হয় এবং হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভূত হয়। এধরনের নেককার, আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ ছিলেন আমাদের প্রফেসর হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব চাইলেন, আলকাউসারের চলমান সংখ্যায়ই হযরতের পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং হযরতের ঘনিষ্ঠজনেরা যেন হযরতকে নিয়ে কিছু লেখেন-বলেন। উদ্যোগটি আমার কাছেও ভালো লাগল। কারণ এধরনের কাজ ইন্তেকালের পরপর যত দ্রুত করা যায়, পরবর্তীতে আর এত দ্রুত করা হয়ে ওঠে না। তার একটি বাস্তব উদাহরণ হল- মারকাযুদ দাওয়াহর তত্ত্বাবধায়ক হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকালের সময় চিন্তা করা হয়েছিল- হযরতের জীবনী স্বতন্ত্র কিতাব প্রস্তুত করা হবে। কিন্তু আজও পর্যন্ত সেই কাজে বিলম্বই হয়ে চলেছে। অথচ সে সময়ই যদি যতটুকু সম্ভব করা হত, তাহলে অন্তত কিতাবের ভিত্তি দাঁড়িয়ে যেত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই যিম্মাদারী সহজে ও সুন্দরভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
যাইহোক, হযরত মুদীর ছাহেবের এই ফায়সালা যথার্থ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকেও মাশাআল্লাহ খুব সাড়া পাওয়া গেছে। যদিও খান্দানের দ্বিতীয় প্রজন্মের সকলে তাঁদের লেখা ও স্মৃতিচারণা পাঠাননি। তবে প্রথম প্রজন্মের সবাই এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকাংশজনই পাঠিয়েছেন। খান্দানের ও একান্ত ঘনিষ্ঠজনদের মধ্য থেকে যাদের লেখা এ সংখ্যায় আসেনি, আশা করি, তারা খুব শীঘ্রই আগামী কোনো সংখ্যায় লিখবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উত্তম তাওফীক নসীব করুন।
মনে হল, পরিবারের সকলের লেখা একই শিরোনামের অধীনে নিয়ে আসা যায়। পরে এমনই করা হয়েছে। পরিবারের সকলের লেখা ও বক্তব্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাওলানা সুহাইল বিন রিজওয়ানুর রহমান ও মাওলানা সা‘দ বিন হাবীবুর রহমানকে। মাওলানা সা‘দের কিছু ওযরের কারণে এই যিম্মাদারির প্রায় পুরোটাই মাওলানা সুহাইলকে পালন করতে হয়েছে। মাশাআল্লাহ, তিনি সবার কাছ থেকে তাঁদের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি শুনে শুনে সেগুলো অত্যন্ত যত্নের সাথে সংকলন করেছেন এবং লিখিত আকারে প্রস্তুত করে পেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই বিরাট মেহনতকে ভরপুর কবুল করুন। আলকাউসার পরিবার ও আলকাউসারের সকল পাঠকবর্গের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
এই লেখাগুলোর বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল, এখানে প্রত্যেকে হযরতের জীবনী এবং হযরত সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার পরিবর্তে হযরতের বিভিন্ন ঘটনা এবং হযরতের সাথে ঘটে যাওয়া নানা গল্প ও স্মৃতিকথা উল্লেখ করেছেন। জীবনচরিত থেকে প্রধানত এসবই অর্জন করার বিষয়।
ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেন-
الحِكَايَاتُ عَنِ العُلَمَاءِ وَمَحَاسِنِهِمْ أَحَبُّ إِليَّ مِنْ كَثِيرٍ مِنَ الفِقْهِ؛ لِأَنَّهَا آدَابُ القَوْمِ.
এর অর্থ হল, আল্লাহওয়ালাদের ঘটনা ও তাদের জীবনের সুন্দর বিষয়গুলোর আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর মাধ্যমে সালাফে সালিহীনের আখলাক ও আদবের ইলম হাসিল করা যায়। -তারতীবুল মাদারিক, কাযী ইয়ায ১/২৩; আলই‘লান বিত তাওবীখ লিমান যাম্মা আহলাত তাওরীখ, পৃ. ১৪৭
আমার কাছে মনে হয়েছে, এই লেখাগুলো থেকে পাঠক এধরনেরই অনেক উপকারী কথা পেয়ে যাবেন। প্রাসঙ্গিকভাবে কোথাও কোনো মাসআলার আলোচনা এসে গেলে, উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেবেন।
লক্ষ করার মতো একটি বিষয় হল, এ সংখ্যায় তো মাশাআল্লাহ, স্মৃতিচারণার বেশ বড় একটি অংশ জমা হয়ে গেছে। তবে হযরতের গুণ ও বৈশিষ্ট্য, কর্ম ও কীর্তি এবং মৌলিক জীবনী বিষয়ে লেখা এখনো বাকিই রয়ে গেছে। আশা করি, হযরতের উত্তরসূরিগণ এদিকেও মনোযোগ নিবদ্ধ করবেন।
কয়েকদিন আগে হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (আদীব হুজুর) দামাত বারাকাতুহুমের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, ‘ইখলাস, উদ্যম, আত্মবিলুপ্তি (ফানাইয়্যাত)- এই তিনটি জিনিস উনার মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখেছি।’
হযরতের বয়ানের বেশ কয়েকটি সংকলন একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তুত হয়ে ছেপে এসেছে। তবে অপ্রকাশিত বয়ানও অনেক রয়ে গেছে। সেগুলোও সংকলিতরূপে প্রকাশিত হওয়া উচিত।
আল্লাহ তাআলা মাসিক আলকাউসার-এর এই সংক্ষিপ্ত খেদমতকে কবুল করুন। এর ওসিলায় এই পত্রিকা ও মারকাযুদ দাওয়াহকে কবুল করুন। আল্লাহ তাআলা একে নিজ হেফাযতে রাখুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত দ্বীন, ইলমে দ্বীন ও দাওয়াতে দ্বীনের খেদমতে কামিয়াবির সাথে সফর জারি রাখার তাওফীক দান করুন- আমীন।
সবশেষে এ কাজে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি খুব শুকরিয়া আদায় করছি। সবাই আলকাউসারকে উত্তমভাবে সহায়তা করেছেন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
তথ্যে খুব বেশি পুনরাবৃত্তি না হয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে যাদের লেখা সংক্ষেপ করা হয়েছে তাদের কাছে মা‘যেরাত পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকল মেহনত ও নেক জযবাকে ভরপুর কবুল করুন- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
‘তিনি ঘরে একাকী ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে আমল করাকে বড় নেক আমল মনে করতেন’
—প্রফেসর হযরত রাহ.-এর আহলিয়া মুহতারামা
* দাদাভাই সম্পর্কে আপনার অনুভূতি যদি আমাদের বলতেন...।
** আল্লাহ..., আমার তো কোনো কথাই নেই। তিনি ছিলেন আল্লাহওয়ালা। আল্লাহওয়ালার সাথে ছিলাম শুধু। পেছনে ছিলাম। নিজে কিছু পারি না। খালি তাঁকে সহযোগিতা করেছি, এতটুকুই। কিছুই নাই আমার। বুঝিও নাই— এভাবে চলে যাবেন।
* দ্বীনী চেতনা লালন করে দাদাভাইয়ের বেড়ে ওঠা নিয়ে আমাদের কিছু শোনান।
** তোমার দাদাভাইয়ের আব্বা হযরত ইয়াসীন সাহেব রাহ. তোমার দাদাভাইয়ের দ্বীনদারীর ব্যাপারে অনেক সচেতন ছিলেন। সাথে করে মসজিদে নিয়ে যেতেন। ফজরের পর মক্তবে পাঠাতেন। মসজিদ ঝাড়ু দেওয়াতেন। কখনো কখনো আযান দেওয়াতেন। প্রায়ই ইমাম সাহেবদের জন্য বাসা থেকে খাবার দিয়ে পাঠাতেন। নিয়মিত কুরআন কারীম তিলাওয়াতের তাগিদ দিতেন। বিভিন্ন জায়গায় কুরআন কারীম তিলাওয়াত করানোর জন্য নিয়ে যেতেন। ঐ সময় মাসিক ‘নেয়ামত’ নামে একটি পত্রিকায় থানভী রাহ.-এর মাওয়ায়েয ছাপানো হত। ওই পত্রিকাটি তোমার দাদাভাইয়ের আব্বা নিয়মিত বাসায় রাখতেন। তখন তোমার দাদাভাইও ওই পত্রিকাটি পড়তেন। আবার ছোটবেলায় মৌলভী মকবুল হুসাইন রাহ.-এর কাছে মক্তবে পড়তেন। তাঁর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছিলেন। এগুলো ছিল তোমার দাদাভাইয়ের ছোট থেকে দ্বীনী চেতনা লালন করে বেড়ে ওঠার মূল কারণ।
* জীবনের বিভিন্ন ধাপে দাদাভাইয়ের দ্বীনের সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল?
** তোমার দাদাভাই ইসলামিয়া হাইস্কুলে যখন পড়তেন, তখন স্কুলের হেডমাস্টার আব্দুল বারী সাহেব খুব গাইড করতেন। অনেক স্নেহ করতেন। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খান সাহেব রাহ.। ওই স্কুলে তোমার দাদাভাই থানভী রাহ.-এর খলীফা হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ.-কে বহুবার দেখেছেন। হেডমাস্টার আব্দুল বারী সাহেব অনেক দ্বীনদার মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের হাফপ্যান্ট পরা পছন্দ করতেন না। পায়জামা পরে স্কুলে আসার হুকুম দিতেন সবাইকে। তাঁর পক্ষ থেকে সবার জন্য রহমতগঞ্জ গনি মিয়ার হাট মসজিদে যোহরের নামায আদায় করার কড়া নির্দেশ ছিল। সেখানে তোমার দাদাভাই হাফেজ্জী হুজুর রাহ., ছদর ছাহেব হুজুর রাহ. এবং পীরজী হুজুর রাহ.-কে বহুবার দেখেছেন। ওই সময়ে তোমার দাদাভাইয়ের খুব প্রিয় দুইজন শিক্ষক ছিলেন। একজন হলেন জনাব আযীযুর রহমান সাহেব। আরেকজন হলেন জনাব শামসুল হক সাহেব। তাঁরা দুজন তখন দ্বীনী লাইনে খুব বেশি অগ্রসর ছিলেন না; কিন্তু খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁরা দুজনই তোমার দাদাভাইকে খুব গাইড করেছেন। নামাযের সময় মসজিদে পাঠিয়ে দিতেন। পড়াশোনার ব্যাপারে তো অকল্পনীয়ভাবে খেয়াল রাখতেন। পরবর্তীতে তাঁরা দুজনই তোমার দাদাভাইয়ের সাথে হজ্ব করেছেন। দাড়ি রেখেছেন।
তোমার দাদাভাই ঢাকা কলেজে পড়াকালে প্রিন্সিপাল জনাব ফজলুর রহমান সাহেবের বাসায় থাকতেন। তিনি অনেক আদর করতেন। তোমার দাদাভাইকে বলেছিলেন, তুমি আমার বিবিকে ‘আম্মা’ বলে ডাকবে। তিনিও তোমার দাদাভাইকে অনেক গাইড করতেন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। বর্তমানে যার নাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়; সংক্ষেপে বুয়েট। ১৯৬১ সালে বুয়েট শেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে চাকরি করেন। তারপর ইংলিশ ইলেকট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ পুরো সময়টাতে নামায, রোযা ও কুরআন কারীমের তিলাওয়াতের সাথে তোমার দাদাভাইয়ের ভালোই সম্পর্ক ছিল। সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের দ্বীনী কিতাবাদীও পড়তেন। ইংলিশ ইলেকট্রিক কোম্পানিতে চাকরি অবস্থায় ১৯৬৮ সালে হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর সাথে তোমার দাদাভাইয়ের পরিচয় হয়। কোম্পানির গাড়িতে আব্দুল্লাহ ছাহেব হুজুরকে নিয়ে ফরিদাবাদ যেতেন। তখন হুজুর তোমার দাদাভাইকে তাইসীর, মীযান, রওজাতুল আদব, নাহবেমীর কিতাবগুলো পড়াতেন। ওই সময় তাবলীগ জামাতে অনেক সময় লাগাতেন। একদিন আব্দুল্লাহ ছাহেব বললেন, আপনি তাবলীগ করেন, ভালো কথা; কিন্তু আল্লাহ রেখেছেন আল্লাহর এক ওলী, তাঁর কাছেও যাবেন। ১৯৭৪ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কাছে বাইআত হন। তারপর থেকে তো হাফেজ্জী হুজুর রাহ. যা বলতেন তাই করতেন। তাঁর হুকুম পালনে কোনোরূপ ত্রুটি করতেন না। দ্বীনের ব্যাপারে কারো সাথে আপোষ করতেন না।
সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে আমার এক ভাইয়ের বিবাহের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কিছু শরীয়তবিরোধী বিষয় তোমার দাদাভাইয়ের নযরে পড়ে। তিনি নীরবে এর প্রতিবাদ করতে চাইলেন। তাই আমাকে বললেন, আমি ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছি। আমি রাগ হয়ে কিছুই বললাম না। কোনো রাগারাগিও করলাম না; বরং বললাম, তাহলে আমিও চলে যাই।
তারপর আমরা সবাই বাসায় চলে এলাম। শুধু তোমার দাদাভাইয়ের আম্মা আমার আম্মার কাছে রয়ে গেলেন। যেহেতু সেখান থেকে আমরা রাতের খাবার খেয়ে এসেছিলাম, তাই বাসায় এসে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর তোমার দাদাভাই বললেন, চলো তোমাদেরকে বনানী নামিয়ে দিয়ে আসি।
আমার এই ভাই তখন বনানী থাকতেন। আমি বললাম, অনুষ্ঠান তো করেই এসেছি। এখন আর যাওয়ার দরকার নেই।
তোমার দাদাভাই বললেন, আমার আম্মা তো ওই বাসায় আছেন। আমাদের যাওয়া দরকার। না হলে মা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন।
প্রথমে তো প্রতিবাদ করলেন ঠিকই; কিন্তু সাথে সাথে মুরব্বিদের সম্মানের প্রতিও পরিপূর্ণ খেয়াল রাখলেন। তারপর আমরা সবাই আবার বনানীতে ভাইয়ের বাসায় গেলাম।
* সাংসারিক জীবনে দাদাভাই কেমন ছিলেন? দাদাভাই কি কখনো আপনার সাথে রাগারাগি করতেন?
** আমাদের মাঝে তেমন ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আমি যেহেতু ভিন্ন পরিবার এবং ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসেছিলাম, তাই অনেক কিছু বুঝতাম না। ফলে তোমার দাদাভাই মাঝে মাঝে রাগ হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তাঁর থেকে রাগের চূড়ান্ত পর্যায়ের বহিঃপ্রকাশও ঘটে যেত; কিন্তু আমি কখনোই ওইরকমভাবে রাগ করতে পারতাম না। রাগ করতামও না। তোমার দাদাভাই রাগ হলে আমি কিছুই বলতে পারতাম না। চোখ দিয়ে টস টস করে পানি পড়ত। তিনি বলতেন, তুমি শুধু কাঁদতেই পারো, কিছু বলতে পারো না।
সাধারণত তোমার দাদাভাই রাগ হলে এই হুকুম করতেন— آمَنْتُ بِاللّٰهِ وَرَسُوْلِه এই দুআ পড়বে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবে আর পারলে ওযু করে দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে। এগুলো আর কী, তাঁর আসল জীবন তো অন্যরকম ছিল। রাতে উঠে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কী করা দরকার, এর সবই করতেন।
* আপনার পরিবর্তনে দাদাভাইয়ের অবদান কী?
** বিয়ের প্রথম দিকে তো আমি একটু মডার্নই ছিলাম। দ্বীনী বিষয়ে তেমন কিছু বুঝতাম না। তোমার দাদাভাই আস্তে আস্তে বুঝাতেন। আমার পরিবর্তন তো পুরোটাই তার কারণে হয়েছে। দ্বীনী কিতাবাদি নিয়ে এসে পড়াতেন। পড়তে বলতেন। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি তো অনেক ভালো মানুষ ছিলেন, তাই কখনো দ্বীনী বিষয় নিয়ে রাগারাগি করতেন না, চাপাচাপিও করতেন না। শুধু বলতেন, এভাবে করে চললে ভালো হবে।
* দাদাভাই কি বিয়ের আগ থেকেই তাহাজ্জুদগুযার ছিলেন? তাঁর মাঝে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব কি অনেক আগে থেকেই ছিল?
** হাঁ, তাহাজ্জুদগুযার ছিলেন। রাতে উঠে অনেক কান্নাকাটি করতেন— আমার কী হবে? আমাকে বলতেন, আমি কী করব? আল্লাহকে পাওয়ার জন্য অনেক কান্নাকাটি করতেন। তারপর আমাকেও বলতেন, ওঠো, নামায পড়ো। তখন আমি কিছুই জানতাম না ভালো করে। তিনি যা বলতেন সাথে সাথে তাই করার চেষ্টা করতাম।
* দাদাভাই কি দুনিয়া নিয়ে কখনো ভাবতেন?
** না, দুনিয়ার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণই ছিল না। এটা লাগবে, সেটা লাগবে— কখনোই বলতেন না। কোম্পানি থেকে তোমার দাদাভাইয়ের অনেক সুযোগ-সুবিধা ছিল। লেটেস্ট মডেলের একটি গাড়ি ছিল। গাড়ির ফুয়েলের খরচেরও নির্দিষ্ট কোনো সীমা ছিল না। অফিসিয়াল ও পার্সোনাল সব কিছুর জন্যই ফুয়েল ফ্রি ছিল। অফিসিয়াল কাজে ঢাকার বাইরে হেলিকপ্টার, প্লেনে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। দেখা যেত, সকালে প্লেনে চড়ে চট্টগ্রাম গিয়েছেন, আবার বিকেলে কাজ শেষ করে প্লেনেই ঢাকা ফিরে এসেছেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানিতে ঘুষের প্রচলন শুরু হয়। তখন তোমার দাদাভাই কোম্পানিতে আর চাকরি করতে চাইলেন না। এত সুযোগ সুবিধা সব ছেড়ে বুয়েটে শিক্ষকতায় যোগ দিলেন। পরিবারের অনেকে আমাকে বলেছিলেন, আপনি তাকে চাকরি ছাড়তে কেন বাধা দিলেন না? বুয়েটে ঢোকার পর গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন। আমাকেও জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম, দরকার নেই। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তো অনেক বেশি। তোমার দাদাভাইয়ের তো আর অত আয় ছিল না। তাই আমি সায় দেইনি।
* দ্বীনের জন্য দাদাভাইয়ের কুরবানীর আরো কিছু ঘটনা শোনান। দ্বীনের পথে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পাড়ি দিলেন কীভাবে?
** তোমার দাদাভাই যখন তাবলীগ করতেন তখন অনেক জোশ ছিল। মুস্তাফীয তখন গর্ভে। তোমার আব্বা একদম ছোট। আমি অনেক অসুস্থ। তোমার দাদাভাই চাইলেন, পাকিস্তানে তাবলীগ জামাতের সফরে যাবেন। মুরব্বিরা অনেক নিষেধ করলেন; কিন্তু তার পরও তোমার দাদাভাই অটল। যাবেনই। তোমার আম্মুর নানাভাই ইঞ্জিনিয়ার হাজ্বী আব্দুল মুকীত সাহেব রাহ. বললেন, হামীদুর রহমান সাহেব! জোশ থাকা ভালো, কিন্তু সাথে হুঁশ থাকা চাই।
তার পরও চলে গেলেন। আমরা জানতামও না। আমাদেরকে পরে ডক্টর খোরশেদ সাহেব খবর দিলেন।
রিযওয়ান, মুস্তাফীয যখন আজিমপুর ফয়যুল উলূম মাদরাসায় পড়ত তখন অনেক কষ্ট করতেন। ওদের জন্য বাসা থেকে খাবার-দাবার, বিছানা-পত্র নিয়ে যেতেন। পাশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে ওদেরকে নিয়ে থাকতেন। এসব কারণে আবদুল্লাহ হুজুর অনেক খুশি ছিলেন।
* দাদাভাইয়ের ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন, যাতে আমরাও অনুপ্রাণিত হই।
** তোমার দাদাভাই নিজে একাকী ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়ে বিবি-বাচ্চা, ছেলেমেয়ে সবাই যাতে ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে সচেষ্ট হয়- এর পেছনে মেহনত করাকে সবচেয়ে বড় নেক আমল মনে করতেন। অনেক যিকির-আযকার, লম্বা লম্বা তাসবীহ পাঠ, দীর্ঘ সময় নফল নামায- বাহ্যিকভাবে এসব নেক আমলের পেছনে সময় ব্যয় করার তুলনায় বাচ্চাদের পেছনে সময় ব্যয় করতেন অনেক বেশি। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ, আল্লাহ তাআলার দরবারে কান্নাকাটি, ওই সময় দ্বীনী কিতাবাদি মুতালাআ এবং বাদ ফজর কিছুক্ষণ কুরআন কারীমের তিলাওয়াত- এই আমলগুলো করতেন নিয়মিত। নিজে তিলাওয়াত করার তুলনায় বাচ্চাদের থেকে তিলাওয়াত শুনতেন অনেক বেশি। বাচ্চাদেরকে নিজেই মাদরাসায় নিয়ে যেতেন। নিজের বাচ্চাদের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের পেছনেও অনেক মেহনত করেছেন। যাতে তারাও হাফেয-আলেম হতে পারে, দ্বীনদার হতে পারে।
পারিবারিক সমস্যা নিরসনের ব্যাপারেও অনেক গুরুত্ব দিতেন তোমার দাদাভাই।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :
মাওলানা সুহাইল বিন রিজওয়ানুর রহমান
সাথে ছিলেন মাওলানা সা‘দ বিন হাবীবুর রহমান
মাওলানা রিজওয়ানুর রহমান
[হযরতের বড় ছাহেবযাদা]
এক. আমার দাদাভাই ইয়াসীন সাহেব রাহ. এবং তাঁর আব্বা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুন্সী রাহ.। তাঁরা দুজনই নেককার ছিলেন। সৎ মানুষ ছিলেন। উলামায়ে কেরামের অনেক সম্মান করতেন। আল্লাহওয়ালা, বুযুর্গানেদ্বীনের খেদমত করতেন। ফলে আমার আব্বা হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান সাহেব রাহ. এত বড় বুযুর্গ হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার এমন একজন মাকবূল বান্দা হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ كَانَ اَبُوْهُمَا صَالِحًا.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হযরত খাযির আ.-এর মাধ্যমে যে দুই নাবালেগ সন্তানের গুপ্তধনের হেফাযত করেছিলেন, তাদের বাপ-দাদা বা পূর্বপুরুষদের কেউ নেককার মানুষ ছিলেন।
আমাদের মাদরাসাগুলোতে ‘তালীমুল মুতাআল্লিম’ নামক একটি কিতাব পড়ানো হয়। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে বহু বছর এই কিতাবটি পড়ানোর তাওফীক হয়েছে। এই কিতাবে আছে, যে ব্যক্তি চায় যে, তাঁর বংশে আল্লাহওয়ালা, বুযুর্গানে দ্বীন তৈরি হোক, সে যেন উলামায়ে কেরামের সম্মান করে।
আমার কাছে মনে হয়, আমার আব্বা এত বড় বুযুর্গ, এত মাকবূল বান্দা হওয়ার পেছনে আব্বার পূর্বপুরুষদের নেককার হওয়া এবং উলামায়ে কেরামকে সম্মান করার বিশাল প্রভাব রয়েছে।
তিনি বলতেন, হযরত মাওলানা মুস্তফা মাহমূদ আলমাদানী রাহ. নামক একজন বুযুর্গ ছিলেন। তিনি আওলাদে রাসূল ছিলেন। সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি কঠোরভাবে বয়ান করতেন। বিদআতী সম্প্রদায় এটা পছন্দ করত না। একপর্যায়ে তারা হযরতকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারাত্মকভাবে আহত করে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে রেখে চলে যায়। জেলেরা তাঁকে উদ্ধার করে চাঁদপুর হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। আমার দাদাভাই হযরত ইয়াসীন সাহেব রাহ. আব্বাকে নিয়ে হুজুরকে দেখতে যেতেন। সাথে করে হুজুরের জন্য ঘরে বানানো কিছু খাবার নিয়ে যেতেন।
আব্বা আরো বলতেন, আমার দাদাভাই হযরত আব্দুল ওয়াহ্হাব মুন্সী রাহ. তাহাজ্জুদগুযার এবং খুব শোকরগুযার মানুষ ছিলেন। ছোটবেলায় যখন ক্ষেতে দাদাভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম, তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেতাম। গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ক্ষেত। ক্ষেতের পাশে একটা খাল। টলটলে পরিষ্কার খালের পানি। খাওয়ার আগে দাদাভাই খালে নেমে ওযু করতেন। ক্ষেতের আইলে গামছা বিছিয়ে খেতে বসতেন। প্রতি লোকমার শুরুতে বিসমিল্লাহ আর শেষে আলহামদু লিল্লাহ বলতেন। খুবই সাদামাটাভাবে জীবনযাপন করতেন। একবার কোনো এক জায়গা থেকে ফেরার পথে তাঁর প্রচণ্ড ঘুম পায়। রাস্তার পাশে এক বাড়ির বেড়ায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যান। গ্রামের প্রহরীরা তাঁকে দেখে চোর মনে করে পাকড়াও করে। অতঃপর তিনি তাঁর বিয়াই মাদবর সাহেবের পরিচয় দিলে তারা তাঁকে ছেড়ে দেয়।
আমার নানাভাই হযরত ইয়াকুব আলী মাতবর রাহ.-ও ছিলেন তাহাজ্জুদগুযার। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং খুব যিকির করতেন।
দুই. আব্বা আমাদের খুব আদর করতেন। সব সময় সবাইকে নিজের কাছেই রাখতে চাইতেন। কখনোই আলাদা করতে চাইতেন না। রাস্তাঘাটে বা কোথাও গেলে আমাদের হাত ধরে রাখতেন। সব সময় নিজের নেগরানিতে রাখতেন। নিজের চোখের সামনেই রাখতেন। চোখের আড়াল হতেই দিতেন না। মুরগি যেমন তার বাচ্চাদের ডানাতলে রেখে আদর আর নেগরানি করে। আব্বাও মৃত্যু পর্যন্ত সারাজীবন তেমনিভাবে আমাদের আগলে রেখেছেন, লালন-পালন করেছেন। আদর করে আমাদের একেক জনকে একেক নামে ডাকতেন। আমাকে বলতেন ‘রিযা বেটা’। আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য মুনিয়া পাখি কিনে আনতেন। কিছুক্ষণ রেখে আমরা আনন্দ করার পর আবার ছেড়ে দিতেন। প্রতি সপ্তাহে আমাদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতেন। পারোটা ভাজি আর হালুয়া দিয়ে আমাদের চিড়িয়াখানার ভেতরে নাস্তা করাতেন।
সীরাত এবং সাহাবীদের জীবনী থেকে আমাদের অনেক গল্প শোনাতেন। ঘটনাগুলো আব্বা এত সুন্দর করে, এত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন যে, যুদ্ধের ময়দানগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত। আমার এখনো খুব মনে পড়ে, রজী‘ নামক যুদ্ধের দুঃখজনক ঘটনা আব্বা আমাদের কেঁদে কেঁদে খুব সুন্দর করে বহুবার শুনিয়েছেন। ওই যুদ্ধে কাফেররা যে হযরত আসেম ইবনে সাবিত রা.-এর লাশ নিতে ঘোড়ায় করে এসেছিল তারপর আল্লাহ তাআলা যে মৌমাছির ঝাঁক পাঠিয়ে তাঁর লাশকে হেফাযত করেছিলেন, সেগুলো আব্বা আমাদের অভিনয় করে দেখাতেন। দুই হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে মাঝখানের শক্ত হাড্ডিগুলো দিয়ে চৌকিতে ঠক্র ঠক্র শব্দ করে ঘোড়ার আওয়াজ কেমন হয়, আর মুখে হাত দিয়ে একটা গুনগুন শব্দ করে মৌমাছির ঝাঁক আসার শব্দ কেমন হয় তা বোঝানোর চেষ্টা করতেন। আব্বার এই সুন্দর আর চমৎকার উপস্থাপনের কারণে আমরা এই ঘটনা শোনার জন্য সব সময় খুব আগ্রহী হয়ে থাকতাম। বারবার আব্বার কাছ থেকে এ ঘটনা শুনতে চাইতাম। আমার খুব ভালোভাবেই মনে আছে, তখন আমার চতুর্থ ভাই মাওলানা মাসীহুর রহমান খুব ছোট ছিল। কান্নাকাটি করত। আব্বা ওকে কোলে নিয়ে আমাদেরকে কাছে বসিয়ে এই গল্প শোনাতেন। আব্বা যখন ঘোড়ার আওয়াজ আর মৌমাছির ঝাঁকের গুনগুনানির অভিনয় করতেন তখন মাসীহ খুব আনন্দ পেত। ওর কান্না থেমে যেত।
দাওরায়ে হাদীসে যখন ‘কিতাবুল মাগাযী’ পড়তাম, তখন দেখতাম যে, বেশিরভাগ ঘটনা আব্বার কাছ থেকে শুনে শুনে আমার আগে থেকেই মুখস্থ হয়ে আছে। (আল্লাহু আকবার!)
হিফযখানায় পড়ার সময় সকালে অনেক সময় পেছনে তাকিয়ে দেখতাম, আব্বা নাস্তা নিয়ে বসে আছেন। আমরা যখন হিফযখানায় পড়তাম, আব্বা পাশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। ওই ঘরে আব্বা আমাদেরকে নিয়ে থাকতেন। হিফযখানায় আমাদের অনেক ভোরে ওঠানো হত। আমাদের চোখে অনেক ঘুম থাকত। উঠতেই পারতাম না। অনেক কষ্ট হত। আব্বা আমাদের কষ্ট করে ওঠাতেন। ঘুম তাড়ানোর জন্য বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চাপ দিতেন। আব্বা আমাদের একটা নসীহত খুব করতেন-
لَا یَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا فِی الْبِلَادِ.
এই আয়াতটা পড়ে পড়ে এভাবে অর্থ বলতেন-
নগরে নগরে অবিশ্বাসীদের দম্ভভরে চলাফেরা তোমাদের যেন কক্ষনো ধোঁকায় না ফেলে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯৬
দ্বীনী বিষয়ে হিম্মত আর সাহস দেওয়ার জন্য আমাদের-
قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِیْ مَعَكُمَاۤ اَسْمَعُ وَ اَرٰی.
[আল্লাহ বললেন, ভয় করো না। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনি ও দেখি। -সূরা ত্বহা (২০) : ৪৬]
-এই আয়াতটা পড়ে পড়ে শোনাতেন আর বলতেন, দ্বীনের কাজের সাথে লেগে থাকলে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন।
তিন. একবার আমি বুয়েটের এক বাসায় একটা খেলনা দেখি। তখন আমি অনেক ছোট। ওই খেলনাটা আমার খুব পছন্দ হয়। আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা! আমাকে ওই খেলনাটা কিনে দিয়েন। তারপর আব্বা আমার জন্য হযরত শাহ আব্দুল কাদের দেহলবী রাহ.-এর রচিত ‘তাফসীরে মূযিহুল কুরআন’ কিনে আনলেন।
আব্বা নিজস্ব একটি বিশেষ ভাষায় লেখালেখি করতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘পিঠাম ভাষা’। ওই ভাষায় তাফসীরে মূযিহুল কুরআনের শুরুতে লিখে দিলেন, ‘চেয়েছিলে খেলনা, কী এনেছি দেখো!’
আমি আব্বার কাছে বায়না ধরেছিলাম, আমার হিফয শেষে আমাকে একটা ময়না পাখি, পাখি শিকার করার জন্য একটা বন্দুক, আরেকটা সাইকেল কিনে দিতে হবে। হিফয শেষ হওয়ার পর যখন আমি মীযান পড়ি, তখন আব্বা আমাকে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। দাওরার বছর আমার জন্য হজ্ব থেকে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ নিয়ে এসেছিলেন।
এভাবেই আব্বা আমাদের নিজের নেগরানিতে রেখে আদর করে করে লালনপালন করে বড় করে তোলেন। একদিন আব্বা হঠাৎ আমাকে বললেন, তুমি কি তোমার মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারবে? আব্বার হঠাৎ এ প্রশ্ন শুনে আমি বড়ই আশ্চর্য হলাম। পরে জানতে পারলাম, মুফতী মনসূরুল হক সাহেব হুজুর দা. বা. আব্বাকে সন্তানদের আলাদা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদেরকে আলাদা করে দিতে আব্বার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তাই আমাকে হঠাৎ এই প্রশ্ন করে ফেলেছেন।
চার. আমি তখন অনেক ছোট। আমার এক খালার বিবাহ। আব্বার সাথে বি. বাড়িয়ায় নানাভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। খুব আনন্দের সাথেই সময় কাটছিল। আমার এক মামা নানাভাইয়ের সাথে থাকতেন। তাঁর ঘরে একটি টিভি ছিল। ওই টিভিটি বিয়ে উপলক্ষে মামার ঘর থেকে নানা ভাইয়ের ড্রয়িং রুমে কেউ এনে চালু করে দিল। আব্বা দেখে অনেক রাগ হয়ে এ অন্যায়ের প্রতিবাদে আমাকে সাথে করে নিয়ে রাতেই বি. বাড়িয়া রেলস্টেশনে চলে গেলেন। রাতে দুধ আর লম্বা একটি টোস্ট-বিস্কুট আব্বা আর আমি খেলাম। রাত একটায় ভৈরবগামী একটি লোকাল ট্রেন আসল। আব্বা আমাকে নিয়ে ওই ট্রেনে উঠে ভৈরব চলে গেলেন। ভৈরবে নেমে আব্বা আমাকে নিয়ে স্টেশনের আশেপাশে কোনো এক মসজিদের বারান্দায় অবস্থান করলেন। আমার যে খালার বিবাহ হয়েছিল, সে খালাকে ভৈরবে একটি বাসায় ওঠানো হয়েছিল। আব্বা আমাকে নিয়ে বাদ ফজর সে বাসায় গেলেন। কিছুক্ষণ সেখানে থেকে খালাকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন।
পাঁচ. আমার চতুর্থ মামা ইঞ্জিনিয়ার এহসানুল হক সাহেব বিমানের একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। একবার সার্ক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবকে নিয়ে ইসলামাবাদ গেলেন। যাওয়ার পূর্বে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তান থেকে তোমার জন্য কী আনব?
আমি বললাম, মামা! আমার জন্য মাআরিফুল কুরআন নিয়ে এসো। সফর শেষে মামা আমার জন্য মাআরিফুল কুরআন নিয়ে আসলেন। এ কিতাবটা আব্বার অনেক পছন্দের। আগে আব্বা এর অনুবাদ খুব পড়তেন। অনুবাদ করেছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাহেব রাহ.। এখন এই কিতাবটি পেয়ে আব্বা আরও অনেক খুশি হলেন। মূল কিতাব পড়তে তো অনেক বেশি মজা। তারপর থেকে আব্বা আমার এই কিতাবটি শেষ রাতে অনেক মুতালাআ করতেন।
ছয়. ছোট থেকেই পাকিস্তানে দারুল উলূম করাচিতে পড়ার আমার খুব আগ্রহ ছিল। দারুল উলূম করাচী নিয়ে স্বপ্নও দেখেছি। পরবর্তীতে দারুল উলূমে গিয়ে স্বপ্নের কিছু মিলও পেয়েছি। দিন যত যায় আগ্রহ তত বাড়ে। সম্ভবত ১৯৮০ সালে হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী ছাহেব দা. বা. বাংলাদেশ সফরে আসলেন। হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। হুজুর আব্বাকে বললেন, ইনি হলেন হযরত মাওলানা মুফতী শফী ছাহেব রাহ.-এর ছেলে মাওলানা তাকী উসমানী ছাহেব। আইনশাস্ত্রে (খখই) তিনি অনেক পারদর্শী। আব্বা হযরতকে নিয়ে বুয়েটে ডক্টর ইহসানুল হক সাহেবের বাসায় প্রোগ্রাম করালেন। তারপর বার এসোসিয়েশনে বয়ানের ব্যবস্থা করলেন। হযরত ডক্টর ইহসানুল হক সাহেবের বাসায় প্রোগ্রাম করে বুয়েটের বাইতুস সালাম মসজিদে যোহরের নামায পড়লেন। মসজিদে আমিও যোহরের নামায পড়তে এসেছিলাম। নামায শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি, একজন মাওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা ছোট ব্যাগ। আব্বা বললেন, ইনার সাথে মুসাফাহা করো। ইনি হলেন, মুফতী শফী রাহ.-এর ছেলে মাওলানা তাকী উসমানী ছাহেব দা. বা.। হুজুরকে দেখে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে আমি দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পৌঁছে যাই। জামিআ রহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদরাসায় আমি দাওরায়ে হাদীস পড়ি। এর মধ্যে হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী ছাহেব দা. বা. বাংলাদেশে আবার তাশরীফ আনলেন। রহমানিয়ার পঞ্চম তলায় একদিন সকালে হুজুরের বয়ান হল। বয়ান শেষে হুজুরকে বিদায় দেওয়ার জন্য আব্বার সাথে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। তখন রহমানিয়ায় আসা-যাওয়া করতে হলে সাত মসজিদের সাথের গলি দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হত। মূল রাস্তা থেকে রহমানিয়ায় আসার সরাসরি কোনো রাস্তা ছিল না। হুজুর যে গাড়ি করে চলে যাবেন সে গাড়ির মালিক ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব রাহ.। তিনি ছিলেন মাসিক মদীনার সম্পাদক, মদীনা পাবলিকেশন্সের মালিক এবং মাআরিফুল কুরআনের অনুবাদক। তিনি আব্বাকে বললেন, আজ রাতে আমার বাসায় হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী ছাহেব দা. বা. হুজুরের দাওয়াত। আপনারও দাওয়াত। রিজওয়ানকে নিয়ে চলে আসবেন। আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন। মুহিউদ্দীন খান ছাহেব তাকী উসমানী ছাহেবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এটা হল প্রফেসর ছাহেবের ছেলে আমার নাতি। আপনি ওকে দারুল উলূমে ভর্তি করে নেন। তাকী সাহেব বললেন—
ٹھیک ہے، بھیج دیجیئے، امتحان ہوگا، اگر کامیاب ہوا تو انشاءاللہ ہم داخلہ دے دینگے۔
[ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন। ভর্তি পরীক্ষা হবে। যদি কামিয়াব হয়, ইনশাআল্লাহ ভর্তি করে নেব।]
দাওরা শেষ হয়ে গেল। প্রতি রমযানে করাচির হযরত হাকীম আখতার ছাহেব রাহ. বাংলাদেশ আসতেন। আব্বা আমাকে নিয়ে হযরতের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। হযরত আব্বাকে বললেন-
رضوان مىاں کادورہ ہو گىا، ابھى وہ کىا کرے گا؟
[রিযওয়ানের তো দাওরা শেষ হয়ে গেছে এখন ও কী করবে?]
আব্বা বললেন-
مىں اس کو ہندوستان بھىجوں گا، دارالعلوم دىوبند مىں پڑھے گا اور حضرت کے ىہاں چھٹىاں گزارے گا۔
[আমি ওকে হিন্দুস্তানে পাঠাব, দারুল উলূম দেওবন্দে পড়বে আর হযরত শাহ আবরারুল হক হরদূঈ হযরত রাহ.-এর কাছে ছুটি কাটাবে।]
করাচির হযরত বললেন-
نہىں نہىں، مىں اس کو کراچى لے جاؤں گا، کىونکہ ہندوستان کى چورنگىوں مىں مورتىاں کھڑى ہىں، رضوان مىاں کو وہاں وحشت محسوس ہوگى، مىں اپنے پىڈ مىں اس کے لىے سفارش نامہ لکھ دوں گا، انشاءاللہ اس کو وىزا مل جائے گا۔
[না, না, আমি ওকে করাচি নিয়ে যাবো। কেননা হিন্দুস্তানের চৌরাস্তায় মূর্তি থাকে, তাই রিজওয়ানের সেখানে কষ্ট হবে। আমি আমার প্যাডে ওর জন্য সুপারিশনামা লিখে দিব। ইনশাআল্লাহ ওর ভিসা হয়ে যাবে।]
কোনো ব্যস্ততার কারণে তখন হুজুর লিখে দিতে পারলেন না। আমরা চলে আসলাম। পরে আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা! করাচির হযরতের তো যাওয়ার সময় হয়ে আসছে। আপনি হযরতের কাছ থেকে লিখিয়ে নিলেন না?
আব্বা বললেন, উনি আমাদের মেহমান। কীভাবে তাঁর কাছ থেকে লেখাই! করাচির হযরত চলে গেলেন।
শাওয়াল মাস শুরু হয়ে গেল। আব্বা আব্বার স্যার আব্দুল মতীন পাটোয়ারী সাহেবের কাছে বললেন, আমি আমার ছেলেকে করাচি পাঠাতে চাই। পাটোয়ারী সাহেব তখন আইইউটির মহাপরিচালক ছিলেন। এর আগে তিনি বুয়েটের ভিসিও ছিলেন। পাটোয়ারী সাহেব পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে আব্বার কথা বলে দিলেন। আব্বা আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রদূতের বাসায় গেলেন। উনি আমাদের ভবনের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে ভিসা অফিসারের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ভিসা লাগবে?
আমার আর তর সইল না। মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ল-
وزٹ وىزا مل جائے تو بھى کافى ہے۔
[ভিজিট ভিসা হলেও চলবে।]
আমি কথা বলায় আব্বা আর কিছু বললেন না। আমাকেও বকাঝকা করলেন না। ভিসা হয়ে গেল। কিন্তু এখানে আমার বিরাট ভুল হয়ে যায়। আমার উচিত ছিল, চুপ থেকে আব্বাকে কথা বলতে দেওয়া। হয়তো তখন আব্বা কথা বললে, স্টাডি ডাবল এন্ট্রি ভিসা হয়ে যেত। কিন্তু আমি কথা বলায় আব্বা কিছু বললেন না। ফলে পরবর্তীতে দুই বছর আব্বার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তারপর আলহামদু লিল্লাহ আব্বা আমার জন্য স্টাডি ডাবল এন্ট্রি ভিসা জোগাড় করতে সক্ষম হন।
যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। দুআ নেওয়ার জন্য আব্বা আমাকে আমার উস্তাদজী শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ.-এর কাছে নিয়ে গেলেন। হুজুর তাকী উসমানী ছাহেব বরাবর আমার নামে বিশাল একটা চিঠি লিখে দিলেন। তারপর আব্বা আমার উস্তাদজী মুফতী মনসূরুল হক ছাহেব দা. বা.-এর কাছেও নিয়ে গেলেন। হুজুর বাড়ি যাচ্ছিলেন। বাসস্ট্যান্ডে চলে গেছেন। আব্বা আমাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলেন। গিয়ে দেখি, হুজুর বাসে বসে পড়েছেন। এখনই বাস ছেড়ে দেবে। জানালা দিয়েই হুজুরের সাথে কথাবার্তা হল। হুজুর আমাকে বললেন, ওখানে গিয়ে তোমার আর দাওরা পড়ার দরকার নেই, উলূমুল হাদীস পড়তে পারো।
আসাতিযায়ে কেরামের সাথে সন্তানদের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে অভিভাবকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, একইভাবে সন্তানদের ভালো আলেম বানাতে চাইলে তাদের আসাতিযায়ে কেরামের সাথে অভিভাবকদের সম্পর্ক, আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত— সেগুলো এইসব ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
পাকিস্তান চলে গেলাম। হাকীম আখতার ছাহেব রাহ.-এর খানকায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে প্রায় দশ দিনের মতো ছিলাম। তারপর দারুল উলূম করাচিতে গেলাম। বিদায়ের সময় হাকীম ছাহেবও তাকী উসমানী ছাহেব বরাবর আমার নামে একটা বড় চিঠি লিখে দিলেন। ভর্তি পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে দারুল উলূমে উপস্থিত হলাম। তাকী উসমানী ছাহেবের কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলাম। হুজুর আমাকে চিনে ফেললেন। আমার বয়স তখন একুশ কি বাইশ। দেখতে অনেক ছোট ছোট লাগে। দাড়িও তেমন একটা বড় হয়নি। হয়তো হুজুরের আমাকে দেখে খুব মায়া লাগল। পাশে নিয়ে নিজের গদির ওপর বসালেন। পরীক্ষার সময় আমাকে বললেন-
ىوں سمجھو کہ مىں تمہارا شاگرد ہوں اور تم مىرے استاذ، پھر مجھے سمجھاؤ۔
অর্থাৎ এরকম মনে কর যে, আমি তোমার ছাত্র আর তুমি আমার উস্তায। এটা ভেবে আমাকে বুঝাও।
আলহামদু লিল্লাহ মৌখিক পরীক্ষা ভালো হল। লিখিত পরীক্ষায় আমার একটা ভুল হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষায় হুজুর খুশি হয়ে বললেন-
اب تم نے اتنا مشکل مسئلہ حل کر دىا ،اور امتحان مىں اتنے آسان مسئلے مىں غلطى کى! کىا تم نے خود ىہ لکھا تھا!
[এখন এত কঠিন মাসআলা হল করতে পারলে, বুঝিয়ে দিতে পারলে; কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় এমন ভুল করে বসলে!]
মানে, লিখিত পরীক্ষার ওই ভুলটা হুজুর মেনে নিতে পারছিলেন না। আমি জবাব দিলাম—
حضرت ىہ تو مىں نے بہت پہلے پڑھا تھا، اچھى طرح ىاد نہىں تھا اسلئے غلطى ہو گئى۔
অর্থাৎ হুজুর! এই মাসআলাটা তো আমি অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। ভালোভাবে মনে ছিল না। তাই ভুল হয়ে গেছে। হুজুর বললেন, ঠিক আছে।
যাইহোক দারুল উলূমে হুজুর আমাকে ভর্তি করে নিলেন।
প্রতি বৃহস্পতিবার আমি হাকীম আখতার ছাহেব রাহ.-এর খানকায় চলে যেতাম। শনিবার বাদ ফজর আবার দারুল উলূমে ফিরে আসতাম।
আব্বা আমাদের এমনভাবে তরবিয়ত করে বড় করেছিলেন যে, আমরা কখনো কোথাও গিয়ে কারো কষ্টের কারণ হইনি। হাকীম ছাহেব রাহ. একবার আব্বাকে বললেন-
رضوان مىاں ہمىں کوئى تکلىف نہىں دىتا۔
[রিযওয়ান আমাদেরকে কোনো কষ্ট দেয় না।]
করাচি থাকতে আব্বা আমার পেছনে যে কী পরিমাণ খরচ করেছেন— তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়! প্রতি শুক্রবার রাতে খানকায় আব্বা আমাকে ফোন করতেন। ফোন আসার সময় হলে হাকীম ছাহেবের ছেলে মাওলানা মাযহার ছাহেব দা. বা. আদর করে বলতেন—
ابھى رضوان مىاں کا فون آنے والا ہے۔
–কিমনাচু? বালু আচি। কিমনাচু? বালু আচি।–
(বাংলাভাষায় ফোনালাপের ‘কেমন আছো-ভালো আছি’ এর উর্দু উচ্চারণ।)
আমার ভাইবোন সবাই কথা বলত। আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো? ভালো আছি। আব্বা-আম্মার সাথে একটু লম্বা কথা হত। আর বাকিদের সাথে খুব সংক্ষেপে কথা হত। তাই মাযহার সাহেব এভাবে বলতেন। ফোনের পেছনেই আব্বা অনেক টাকা খরচ করতেন।
দেশে আসলে বুয়েটের অপারেটররা বলতেন, অন্যান্য স্যারের ছেলেরাও তো বিদেশ পড়ে। আপনার আব্বার মতো তো অন্য কোনো স্যারের এত বিল আসে না! স্যারকে আপনি এত খরচ করান কেন?
আমি বলতাম, আপনি আপনার স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন। আমি কি জানি, উনি এত খরচ করেন কেন?
আব্বা প্রতি সপ্তাহে ফোন করার পরেও ‘আব্বা আমার কাছে চিঠি লেখেন’- এটা আমার খুব ইচ্ছা করত। কারণ ফোনের কথা তো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু চিঠি তো সব সময়ই কাছে রয়ে যায়। একবার আব্বাকে বললাম, আব্বা! আমাকে চিঠি লিখবেন।
আব্বা বললেন, আমি তো প্রতি সপ্তাহে ফোনই করি। চিঠি লেখার দরকার কী?
একবার আব্বা মাদারীপুরে হযরত মাওলানা ফযলুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর বাড়িতে লঞ্চে করে যাচ্ছিলেন। শীতকাল ছিল। অনেক কুয়াশা। হঠাৎ লঞ্চ একটি চরে আটকে গেল। তিন ঘণ্টা যাবৎ ওই চরেই লঞ্চ আটকে রইল। আব্বা সেখানে ঝালমুড়ি খেলেন। তারপর ঝালমুড়ির ঠোঙায় আমার কাছে চিঠি লিখলেন- ‘আল্লাহ আমাকে হায়াতান ত্বয়্যিবাহ দান করেছেন। তুমি হলে আমার বড় সন্তান, নৌকার হাল, তুমি যেদিকে যাবে, বাকি সন্তানরাও সেদিকে যাবে।’
উলামায়ে কেরামকে আব্বা কী পরিমাণ সম্মান করতেন! তাঁদের সাথে আব্বার কী গভীর সম্পর্ক ছিল। এসব কারণে আমাদের কী লাভ হয়েছে। মুরব্বিদের থেকে কেমন আদর পেয়েছি। আব্বা আমাদের কীভাবে নেগরানি করতেন। কী পরিমাণ আদর করতেন। মুরব্বিদের কাছে কীভাবে করে নিয়ে যেতেন- ইনশাআল্লাহ, উল্লিখিত আলোচনা থেকে এগুলো ভালোভাবেই বুঝে আসবে।
মাওলানা মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান খান
[হযরতের বড় জামাতা]
আমার মুহতারাম শ্বশুর আব্বা, আমাদের মুরব্বি, আমাদের মুহসিন, হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ.। তাঁর ইন্তেকালের হৃদয়বিদারক সংবাদ আলকাউসারের পাঠকবৃন্দ গত নভেম্বর ২০২৩ ঈ. সংখ্যায় মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের ‘দুআয়ে মাগফিরাত : চলে গেলেন আমাদের সকলের মুরব্বি প্রফেসর হযরত!’ শীর্ষক লেখা থেকে জেনেছেন।
গত ১৭ রবিউল আখির ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ২রা নভেম্বর ২০২৩ ঈ. বৃহস্পতিবার বেলা আনুমানিক তিনটার দিকে তিনি আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
প্রফেসর হযরত রাহ.-এর মৃত্যুতে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা শোকাহত ও ব্যথিত হয়েছেন। হযরতের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত-অনুরক্ত ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের ব্যথা-বেদনা যে কত গভীর— তা ব্যক্ত করার মতো শব্দ এ মুহূর্তে আমার কাছে নেই। বিশেষত হযরতের আহলিয়া যিনি হযরত রাহ.-এর সকল দ্বীনী, দুনিয়াবী, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, সঙ্গ দিয়েছেন এবং হিম্মত জুগিয়েছেন, তিনি তো শোকে মুহ্যমান। তাঁর সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনিসহ আত্মীয়-পরিবারের সকলে যদিও হিম্মতের পাহাড় হয়ে একে অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, সাহস জোগাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সকলের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ অধম যে কিনা (নিজের দৃষ্টিতে) প্রস্তরহৃদয়— তার ভেতরেও ভাঙন ও অশ্রু-তরঙ্গের শব্দ শোনা যাচ্ছে... আল্লাহ হেফাজত করুন।
হযরত রাহ.-এর বিদায়ের পর নিজেকে বড় অসহায়, আশ্রয়হীন মনে হচ্ছে। কারণ হযরত রাহ.-এর জীবন ছিল আমাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার রহমতের প্রকাশস্থল। তার জীবন ছিল দ্বীনী আখলাকের আদর্শ নমুনা। পূর্ণাঙ্গ মুমিনের বাস্তব রূপ। তিনি দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালবাসা, উদারতা, ক্ষমাপ্রবণতা, পরার্থপরতা, দান-খয়রাত, অন্যের হিতকামনা, অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্যদান ইত্যাদি নববী আখলাকের ক্ষেত্রে বেনজীর ও বেমেছাল ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যারই পরিচয় ও সম্পর্ক হয়েছে, স্বদেশে হোক বা প্রবাসে, দীর্ঘ সময়ের হোক বা ক্ষণিকের, সে ব্যক্তি হৃদয়ের গভীরে তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আন্তরিক টান অনুভব করেছেন।
কারণ যারাই তাঁর সাথে সম্পর্ক রাখতেন তিনি তাদের সকল বিষয়ের খোঁজ-খবর এমনভাবে রাখতেন, যার আওতায় ব্যক্তিগত জীবন, সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনের সবকিছু এসে যেত, তিনি তাঁদের সকল ব্যাপারে সর্ব অবস্থায় এমনভাবে কল্যাণকামনা ও উপকারিতার বিষয়ে লক্ষ রাখতেন, যেটা অনেক সময় তারা নিজেরাও নিজেদের ব্যাপারে লক্ষ রাখতে পারতেন না। এখন তারা নিজ জীবন ও জগতে একধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। স্পষ্টত বুঝতে পারছেন, তাঁদের জীবনের সবচেয়ে হিতাকাক্সক্ষী কল্যাণকামী ব্যক্তিটিকে হারিয়ে তারা বড়ই অসহায় ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল তারা হারিয়ে ফেলেছেন। দুশ্চিন্তায় ও মনোবেদনায় যার কাছে ছুটে গিয়ে শীতল সান্ত্বনা লাভ করে প্রফুল্ল হৃদয়ে, সহাস্যবদনে ফিরে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে লেগে যেতে পারতেন, আজ আর সেই আশ্রয়ের সাহসী মানুষটি এ জগতে নেই...।
বিগত প্রায় ত্রিশ বছর তিনি আমাদের পরিবারের প্রধান মুরব্বি ছিলেন এবং তিনি তাঁর আচরণ ও উচ্চারণে সর্বাপেক্ষা হিতকামনা ও দুআর প্রকাশ ঘটাতেন। সব সময় এবং সকল সংকটে তিনি ছিলেন আমাদের আশ্রয়স্থল ও পরামর্শদাতা। সব ব্যাপারেই আমার বড় ভাইয়েরা তাঁর সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। পারিবারিক কত সমস্যা ও সংকটের তিনি সহজ সমাধান দিয়ে আমাদেরকে উপকৃত করেছেন— তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।
আলহামদু লিল্লাহ! এই হৃদয়বিদারক ঘটনা যদিও হযরতের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনের জন্য অসহনীয় ও হৃদয়ভাঙ্গা বেদনাবহ। কিন্তু হযরত রাহ. সর্বদা হাদীস শরীফের এ শিক্ষাই আমাদেরকে দিয়েছেন যে, মুমিনের জীবনে যা কিছু ঘটে, তা সুখের হোক বা দুঃখের, সব কিছুতেই বান্দার জন্য কল্যাণ নিহিত আছে, যদি বান্দা সে বিষয়ে শরীয়তের বিধান মেনে চলতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আমাদেরকে (অর্থাৎ হযরতের সন্তান ও আত্মীয়দেরকে) হযরতের মৃত্যুপরবর্তী সকল কাজ— (বিশেষত গোসল, কাফন, জানাযা ও দাফন ইত্যাদি) শরীআহ এবং সুন্নাহ মোতাবেক— যেমনটি হযরত রাহ. সারাজীবন চেষ্টা করেছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন— মজবুতির সাথে আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দিয়েছেন।
আলহামদু লিল্লাহ! আমাদের ভাইয়েরা (হযরত রাহ.-এর পুত্রগণ) হযরত রাহ.-এর ইন্তেকালের পরই হাসপাতালের কামরায় বসেই পরামর্শ করেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে হযরত রাহ.-এর শেখানো পথ-পন্থা তথা শরীয়ত ও সুন্নাহ মোতাবেক সব কাজ সম্পন্ন করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হযরত রাহ. যেহেতু তাঁর মুরব্বিদের শিক্ষানুযায়ী চাইতেন— কোনোভাবেই যেন জানাযায় বিলম্ব না হয়। তাই ঐ রাতে দশটায় জানাযা এবং উত্তরা বারো নম্বর সেক্টর কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ হযরত রাহ. সব সময় সাধারণ ও আড়ম্বরহীনতাকে পছন্দ করতেন। হযরত রাহ.-এর তৃতীয় ছাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ আরিফুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম জানালেন, আব্বাজান অনেকবার বলেছেন, ‘আমাকে বিশেষ কোনো জায়গা বা বিশেষ কোনো কবরস্তানে নয়, সাধারণ কবরস্তানে কবর দেবে।’
হযরত রাহ. যেহেতু জানাযা ও দাফন কাজে বিলম্ব পছন্দ করতেন না, তাই পরবর্তী দিন জুমাবার হওয়া সত্ত্বেও (এবং এতে করে সময় পাওয়ার দরুণ দূর-দূরান্ত থেকে এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ জানাযায় অংশগ্রহণ করতে পারত।) ঐ রাতে দ্রুত সবকিছু সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। সকলে এ ব্যাপারেও একমত হন যে, জানাযার পূর্বে লাশ সামনে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বয়ান বক্তৃতাও হযরতের পছন্দ ছিল না এবং উলামায়ে কেরামও এই রেওয়াজ পছন্দ করেন না। তাই হযরতের পরিবারের এক-দুজন ব্যতীত অন্য কাউকে আমরা কথা বলার জন্য অনুরোধ করব না।
আলহামদু লিল্লাহ! পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী রাত দশটায় হযরতের বড় ছাহেবযাদার ইমামতিতে জানাযা সম্পন্ন হয়। রাত এগারোটার মধ্যে সুন্দরভাবে দাফন কাজও সমাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে আমাদের আত্মীয়-স্বজনসহ উত্তরা ও তার আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের স্বতঃস্ফূর্ত সেবাদান ছিল বিস্ময়কর।
হযরত রাহ.-এর জানাযায় অল্প সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে এসে প্রায় দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানেদ্বীন অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
প্রফেসর হযরত রাহ.-এর সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক
হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সর্বপ্রথম কোথায় দেখেছি স্পষ্ট মনে নেই। যতটুকু এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ১৯৭৮ সালে যখন কামরাঙ্গীরচর নূরিয়া মাদরাসায় ভর্তি হই, হয়তো সেবছর রমযানে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে তিনি যখন ইতেকাফরত ছিলেন তখন মু‘তাকিফদের সামান্য কিছু খেদমতের তাওফীক এ অধমের হয়েছে। সে সময়ই হয়তো প্রথম দেখেছি।
ভালোভাবে পরিচয় ও সঙ্গ লাভ হয়েছে ১৯৮১ সনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. যখন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেন কেউই কোনোভাবে তাঁকে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারলেন না। শেষে কেউ কেউ হযরতের সঙ্গও ত্যাগ করলেন। কিন্তু হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সঙ্গে যেসকল সৌভাগবান লোকদের লেগে থাকার তাওফীক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা দান করেন, তাদেরকে নিয়ে তিনি ‘হাফেজ্জী হুজুর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করলেন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য হযরতের লালবাগ কেল্লার মোড়স্থ বাড়ির রাস্তা সংলগ্ন দু-তিনটি কামরাকে ‘নির্বাচন পরিচালনা অফিস’ বানানো হল। তখন নূরিয়া মাদরাসার কয়েকজন ছাত্রকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সেখানেই থাকতে বলা হল, তাদের মধ্যে এ অধমের নামও ছিল। হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ. ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ‘আমীনুল মাল’ বা কোষাধ্যক্ষ। সে সুবাদে তিনি এ অফিসে অনেক সময় দিতেন। তখন তাঁর ছোটোখাটো কিছু খেদমতের সুযোগ এ অধমের হয়েছে। কোনো কোনো সময় জরুরি মিটিংয়ের দাওয়াতি চিঠি নিয়ে বড় বড় আলেমের বাসায় এ অধমকে পাঠানো হত। দুজনের কথা তো খুব ভালোভাবে মনে আছে। একজন হযরত মাওলানা রেজাউল কারীম ইসলামাবাদী রাহ.। যিনি সে সময় ‘নবাব বাড়ী মসজিদ’-এর খতীব ছিলেন। আরেকজন আমার মুহতারাম উস্তায হযরত মাওলানা সাদেক আহমাদ সিদ্দীকী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। তিনি তখন মালিবাগে অথবা তার আশপাশের কোনো এলাকায় থাকতেন।
নির্বাচন পরবর্তীকালে খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা এবং উত্থান-পতনকালেও আমার এ মুরব্বিকে দেখেছি বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে খুব ছোটাছুটি করতেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে যখন কিতাব বিভাগের তাইসীর (প্রথম) জামাতে ভর্তি হই, তখন হযরত প্রফেসর রাহ.-এর মেজো ছেলে হাফেজ মাওলানা মুস্তাফীযুর রহমান ছাহেব আমার সহপাঠি হওয়ায় হযরতের সাথে মাঝে-মধ্যেই সাক্ষাৎ হত। তখনই হযরতের বড় সাহেবযাদা মাওলানা রিজওয়ানুর রহমান সাহেব দা. বা.সহ অন্যান্য ভাইদের সাথে পরিচয় হয় এবং ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সে সময় হযরতের যে ছবি আমার হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে আছে, সেটা অনেকটা এমন যে, বিস্কিট কালারের কলারবিহীন হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, মাথায় সাদা পাঁচকল্লি টুপি, পায়ে কালো রংয়ের প্লাস্টিকের জুতো। হাতে একটি কালো রংয়ের চামড়ার তৈরি ভারি অফিসিয়াল ব্যাগ।
হযরত রাহ.-কে দেখতাম, সকলের সাথেই হাসিমুখে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে কথা বলছেন, খুব দ্রুত নিজ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। সাথে অন্যদের খেদমতও করছেন। সকলেই তাঁর সাথে আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সমীহের আচরণ করছেন।
আসলে হযরতের সাথে আমার স্মৃতির ধারা অনেক দীর্ঘ। ১৪১৪ হিজরীতে যখন হযরতের বড় মেয়ের সাথে আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে আমার বিয়ের আকদ সম্পন্ন হয় তখন থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর তো আল্লাহর মেহেরেবানীতে হযরতের কাছে এবং অতি কাছে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আত্মীয়তার আগেও হযরতের সঙ্গে রয়েছে এই অধমের বহু স্মৃতি। যেগুলো ইনশাআল্লাহ অন্য কোনো অবসরে লেখার ইচ্ছা আছে।
হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান রাহ. ৯ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে মুন্সিগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম মুহাম্মাদ ইয়াসীন সাহেব তাঁকে মসজিদের ইমাম ছাহেব, মুয়ায্যিন ছাহেব, মক্তবের উস্তাযসহ অন্যান্য দ্বীনী ব্যক্তিত্বদের খেদমতে নিয়োজিত করেন। তিনি গ্রামে কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তবের উস্তায হিসেবে পেয়েছিলেন হযরত মাওলানা মকবুল হুসাইন রাহ.-কে, যিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্রিশ টাকা বেতনে গ্রামের মক্তবে পড়াতেন। তিনি প্রতিদিন সকালে ফজরের পরে কুরআন শরীফ পড়াতে বসতেন, আর প্রায় দিনই দুপুর বারোটায় উঠতেন। তার তাকওয়া ও পরহেযগারির কথা প্রফেসর হযরত রাহ. সব সময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন।
হযরত প্রফেসর ছাহেব রাহ. ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে মেট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। পরবর্তীতে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঢাকা থেকে ১৯৬১ সালে প্রথম বিভাগে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। অতঃপর তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে প্রায় দুই বছর এবং ইংলিশ ইলেকট্রিক কো¤পানিতে প্রায় ছয় বছর চাকরি করার পর ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় দক্ষতা ও সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে ১৯৯৫ সালে বুয়েট থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ওআইসি কর্তৃক স্থাপিত ও পরিচালিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) বোর্ডবাজার, গাজীপুরে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাজুর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে (খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে) নিয়োজিত থাকেন।
তিনি তাবলীগ জামাতে অনেক সময় লাগিয়েছেন। এ কাজে সময় লাগানোর একপর্যায়ে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাবলীগে সময় লাগানোর সাথে সাথে ইমাম গাযালী রাহ. ও হাকীমুল উম্মাত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর লিখিত কিতাবাদি পাঠ করার ফলে তাঁর মধ্যে দ্বীনের প্রতি আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা আলতাফ হোসাইন ছাহেবের খেদমতে হাজির হয়ে কোনো হাক্কানী পীরের নিকট বাইআত হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। তাঁর এ কথা শুনে হযরত মাওলানা আলতাফ হোসাইন ছাহেব তাঁকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর খেদমতে নিয়ে যান। তখন তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর নিকট বাইআত হন।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর নিকট মুরিদ হওয়ার পর হযরতের বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেব রাহ. বার বার হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর খেদমতের জন্য তাঁকে এগিয়ে দেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সাথে ১৯৮০ সালে তাঁর হজ্ব করারও সৌভাগ্য হয়েছে। সে সফরে তিনি হুযুরের খাদেম হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
প্রফেসর হযরত রাহ.-এর দ্বীনের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর আরেক ওলী (আজীমপুরের) হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এরও বিরাট অবদান রয়েছে। কারণ তাঁর সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষা, তাঁর নিজের আরবী গ্রামার শিক্ষা এবং পরবর্তীতে কুরআন কারীমের সাথে এত ব্যাপক পরিচিতির সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছে।
হযরত প্রফেসর ছাহেব রাহ. ইসলামী জ্ঞানে প্রজ্ঞাবান হয়েও নিজের সম্পর্কে বলতেন—
‘আমি আলেম নই। কিন্তু উলামায়ে কেরামের জুতা বহন করতে পারাটা আমি নিজের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করি। আলেমদের কাছ থেকে কুরআন-হাদীসের আলোচনা শুনে সেগুলোই নকল করে থাকি। এক্ষেত্রে আমার কোনো ভুল-ভ্রান্তি কারো দৃষ্টিগোচর হলে আমাকে বললে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে নেব। তার প্রতি চির-কৃতজ্ঞ থাকব।’
নিজের সম্পর্কে যার এরকম ধারণা, তিনি তো দ্বীনের পথে অগ্রসর হবেনই। তাছাড়া প্রফেসর হযরত রাহ.-এর দ্বিতীয় শায়েখ ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সর্বশেষ খলীফা মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক হারদূঈ ছাহেব রাহ.।
প্রফেসর হযরত রাহ. এ উভয় বুযুর্গের অত্যন্ত প্রিয় ও আস্থাভাজন ছিলেন। উভয় হযরতই তাঁকে খেলাফত এবং ইজাযত দান করেন। তিনিও সমগ্র জীবন মুরব্বিদের এ আমানতের যথাযথ মূল্যায়ন করে উম্মাহর কল্যাণের জন্য জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
আমাদের দৃষ্টিতে প্রফেসর হযরত রাহ.-এর যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য তাঁকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে, তা হল উলামায়ে কেরামের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি, দুনিয়াবিমুখতা, দ্বীন ও দ্বীনী ইলমের প্রচার ও প্রসারের জন্য পাগলপারা মেহনত, সকল কুসংস্কার ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে বর্জন করে শরীয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের ফলে তাঁর ইখলাসপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বয়ানে যে গভীর অনুভূতি শ্রোতাদের অন্তঃকরণে হয়, দীর্ঘ সময়ে অনেক আকর্ষণীয় জ্বালাময়ী বক্তৃতায়ও তা হয় না।
হযরত রাহ.-এর বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিবর্তীতে আরো বিস্তারিত কিছু লেখার এবং হযরত রাহ.-এর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং ভক্ত-অনুরক্তদের লেখা, স্মৃতি ও অভিব্যক্তি নিয়ে একটি স্বতন্ত্র স্মারক প্রকাশের ইচ্ছা আমাদের আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা কবুল করুন, তাওফীক দিন— আমীন।
মাওলানা মুস্তাফীযুর রহমান
[হযরতের মেজো ছাহেবযাদা]
এক. আব্বা বুয়েটে আমাদের নিয়ে যেভাবে জীবনযাপন করেছেন সেটা অবিশ্বাস্য। চিন্তা করলে হয়রান লাগে। আব্বার আয়ের চেয়ে সব সময় ব্যয় অনেক বেশি থাকত। সব সময়ই ধার-কর্য করে চলতে হত। আমাদের কিতাব কিনে দেওয়ার মতো টাকা থাকত না। এ কারণে ভাইয়া সাধারণত আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিতাব কিনতে পারতেন না। আব্বার কাছে টাকা চাইতে তাঁর সংকোচ লাগত।
ভাইয়া বলেন, ‘আব্বার হালত দেখে আমি আব্বার কাছে কিতাব কেনার জন্য টাকা চাইতে পারতাম না।’
তাই তিনি মাদরাসা থেকে কিতাব উঠিয়ে পড়তেন। আমার আবার মাদরাসা থেকে কিতাব উঠিয়ে পড়তে কেমন কেমন লাগত। নিতে পারতাম না। কষ্ট হত। আল্লাহ পাক সবাইকে এক রুচি আর এক তবীয়তে সৃষ্টি করেন না। একেকজনকে একেক রকম স্বভাব আর মেযাজ দেন। তাই আমি আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে অনেক কিতাব কিনেছিলাম। জালালাইন, মেশকাত, দাওরার প্রায় সমস্ত কিতাব কিনেছিলাম। আল্লাহ পাক সেই কিতাবগুলোতে অনেক বরকত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেগুলো (সেজো ভাই) আরিফ, (চতুর্থ ভাই) মাসীহ, (ছোট চাচার ছেলে) হাসান এবং কামাল সাহেবের ছেলেরাসহ অনেকেই পড়েছেন। অনেক সময় আব্বার কাছে কিতাব কেনার জন্য টাকা চাইলে আব্বার কাছে নগদ টাকা থাকত না। তখন আব্বা বলতেন, তুমি তোমার চাচা মাওলানা ইসমাইল যশোরী সাহেবের কাছে গিয়ে কিতাব কিনে নাও। পরে আমি আস্তে আস্তে টাকা শোধ করে দেব।
মাওলানা ইসমাইল যশোরী সাহেব হলেন কুতুবখানায়ে রশীদিয়ার মালিক। আব্বার সাথে উনার গভীর সম্পর্ক ছিল। একদিন আমি চাচার লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, আল্লাহর এক বান্দা বসে আছেন। তিনি বললেন, এই বেটা! তোমার হাসিটা দেখি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মতো লাগে?
মাওলানা ইসমাইল সাহেব বললেন, আরে এটা তো হল প্রফেসর সাহেবের ছেলে।
উনি বললেন, এজন্যই তো বলছি।
মাওলানা ইসমাইল সাহেব বললেন, তিনি হলেন হাটহাজারী মাদরাসার মাওলানা মুমতাযুল করীম (বাবা হুজুর) রাহ.। তিনিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন, আব্বার সাথে আমার চেহারার মিল লাগে। কিছুদিন আগেও আরেকজন বলেছিলেন। এছাড়াও আরো অনেকে এ কথা বলেছেন। আমার অন্যান্য ভাইদেরকেও অনেকে একই কথা বলেছেন। আমরা সবাই তো আব্বারই সন্তান। তাই সবার চেহারার মধ্যে আব্বার চেহারার মিল পাওয়া যাওয়াটা স্বাভাবিক।
দুই. আব্বার ঘটনা বলে তো আর শেষ করা যাবে না। কত আজীব আজীব ঘটনা যে আছে আব্বার!
নাতি-নাতনিদের অনেকের আকীকার সময় আব্বা নিজেই খাসি কিনে এনেছিলেন। সালমানের আকীকার জন্যও আব্বা নিজে গিয়ে খাসি কিনে আনলেন। সালমানের মা সালমানকে নিয়ে বাবার বাসা মিম টাওয়ারে ছিল। আব্বা খাসি নিয়ে মিম টাওয়ারের সামনে এসে বললেন, সালমানের মাকে বলো, বারান্দা দিয়ে দেখতে।
তারপর আব্বা উপরে উঠে বললেন, আজ আমি তাহাজ্জুদের সময় সূরা মারইয়াম পড়ছিলাম। সেখানে আছে—
قَالَ اِنِّيْ عَبْدُ اللهِ .
তাই ওর নাম ‘আব্দুল্লাহ’ রাখতে চাই, কী বলো?
আমি বললাম, আব্বা, ঠিক আছে আলহামদু লিল্লাহ।
সাথে ডাক নাম রাখলেন সালমান।
তিন. কুরআনের অর্থ ও তাফসীর পড়ার প্রতি আব্বার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আব্বা মুতালাআ করতেন। দিনে মুতালাআ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। ওই সময় তাঁর সামনে বিভিন্ন ধরনের অভিধানসহ অনেক কিতাবাদি থাকত। সেগুলোর মধ্যে মাআরিফুল কুরআন উল্লেখযোগ্য। আব্বা সেটি অনেক মুতালাআ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আলহামদু লিল্লাহ, মাআরিফুল কুরআন পুরোটাই মুতালাআ করেছি। কিতাবটি দেখলে বোঝা যায়, আব্বা কী গভীরভাবে মুতালাআ করতেন। কিতাবটির জায়গায় জায়গায় আব্বার দাগানো আছে।
যত রাতেই ঘুমাতেন তাহাজ্জুদের সময় ঠিকই উঠে যেতেন। সত্য কথা হল, আব্বা জীবনে ঘুমিয়েছেনই কম। বড় অবাক লাগে, কীভাবে যে পারতেন! আল্লাহর কুদরত ছাড়া কিছুই নয়। না হয় কীভাবে একটা মানুষ এভাবে চলতে পারে! আমাদের তো এক-দুদিন ঘুম কম হলেই অবস্থা কাহিল হয়ে যায়।
চার. একবার আব্বা গাড়িতে বসে সূরা ত্বহার ১১৮-১১৯ নং আয়াতদুটি পড়ছিলেন—
اِنَّ لَكَ اَلَّا تَجُوْعَ فِيْهَا وَ لَا تَعْرٰي، وَ اَنَّكَ لَا تَظْمَؤُا فِيْهَا وَ لَا تَضْحٰي.
জান্নাতে তুমি ক্ষুধার্তও হবে না, বিবস্ত্রও হবে না। আর তাতে তুমি পিপাসাও বোধ করবে না, রোদের কষ্টও পাবে না। এখানে—
اَلَّا تَجُوْعَ، لَا تَعْرٰي، لَا تَظْمَؤُا، لَا تَضْحٰي.
শব্দগুলোর মাফহুম বোঝার জন্য আব্বা পেরেশান হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হয় এক সপ্তাহের বেশি সময় পর্যন্ত আব্বা বিভিন্ন তাফসীর-অভিধান দেখেছিলেন। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করেছেন এই দুই আয়াতের তরজমা!
পাঁচ. প্রতিদিন ফজরের পরে আব্বা ঘরের মানুষদের পড়াতেন। আমরা ওই সময় আব্বার কাছে অনেক কিছু পড়েছি। আম্মাও পড়েছেন। পুত্রবধূদের সবাই কম-বেশ তাঁর কাছে পড়েছেন। হাফেযাদের থেকে কুরআন কারীমের তিলাওয়াত শুনতেন। লিখে লিখে নাহু-সরফসহ আরো অনেক কিছু পড়াতেন। আব্বার পড়ানোর ধাঁচ খুবই সুন্দর এবং বড়ই চমৎকার ছিল। এ কারণে যারাই তাঁর কাছে পড়তেন সবাই বেশ আগ্রহী হয়ে উঠতেন।
সালমানের মায়েরও পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তার আগ্রহ দেখে আব্বা অনেক খুশি ছিলেন।
আসলে আব্বা সবার প্রতিই খুশি প্রকাশ করতেন। যার বহিঃপ্রকাশ একেকজনের সাথে একেক রকমভাবে ঘটত।
মাওলানা আরিফুর রহমান
[হযরতের সেজো ছাহেবযাদা]
এক. আল্লাহ তাআলা আব্বার অন্তরটাকে বানিয়েছিলেন একদম স্বচ্ছ, খাঁটি আল্লাহওয়ালাদের দিল। আব্বা একদম দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। দুনিয়া আব্বার আশেপাশে ঘুরঘুর করত; কিন্তু কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। দুনিয়াবিমুখ হওয়ায় আব্বা অনেক সময় অনেকের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। কিন্তু সেটাও করতেন আজীবভাবে। যিনি হাদিয়া নিয়ে আসতেন, উনি যেন কষ্ট না পান তার প্রতিও খুব খেয়াল রাখতেন।
ডক্টর ইখলাস সাহেবের ‘ইয়ামাগাতা হাসপাতালে’ আব্বা একবার দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসা গ্রহণ করেন। প্রায় তিন মাস ভর্তি ছিলেন সেখানে। তখন বাংলাদেশের অনেক বড় এক ব্যবসায়ী আব্বার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি আব্বাকে বিরাট অংকের হাদিয়া দিতে চাইলেন। কিন্তু আব্বা গ্রহণ করলেন না। আগে একবার আব্বা তার হাদিয়াও গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু এবার না করে দিলেন। উনি অনেক পীড়াপীড়ি করলেন। তার পরও আব্বা গ্রহণ করলেন না। ফেরার সময় তিনি আমাকে বেশ জোর দিয়ে বললেন, তিনি তো গ্রহণ করলেন, না আপনি গ্রহণ করুন।
আমি বললাম, অসম্ভব। যে জিনিস আব্বা গ্রহণ করেননি, সেটা আমি কখনোই গ্রহণ করতে পারি না। এ সাহস আমার নেই।
উনি চলে গেলেন। সেদিন রাতেই আব্বা আমাকে বললেন, সে কি এসেছিল?
বললাম, জী আব্বা!
আব্বা বললেন, যাওয়ার সময় তোমার সাথে দেখা হয়েছিল?
বললাম, জী আব্বা!
আব্বা বললেন, উনি কি তোমাকে কিছু বলেছেন?
বললাম, যাওয়ার সময় আমাকে একটা খাম দিয়ে বলেছেন, হযরতকে তো দিতে পারিনি আপনাকে দিয়ে যেতে চাই।
আব্বা বললেন, তুমি কী করেছ?
বললাম, উনাকে বলেছি, আব্বা নেননি, তাই আমিও নিতে পারব না।
আব্বা বললেন, মাশাআল্লাহ।
তারপর একটু দুআ করলেন।
প্রায় দেড় মাস পর আব্বা আমাকে বললেন, তোমার কাছে কি সেই লোকের নম্বর আছে?
বললাম, জী না আব্বা! আমার কাছে তো নেই।
আব্বা বললেন, কার কাছে পাওয়া যাবে?
বললাম, অমুকের কাছে পাওয়া যেতে পারে।
আব্বা বললেন, তাকে আসতে বল।
উনি আসলেন। আব্বা ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি তার সাথে যোগাযোগ আছে?
উনি বললেন, জী আছে।
আব্বা বললেন, তাকে ফোন কর।
ফোন করা হল। আব্বা তাকে ফোনে বললেন, তুমি না আমাকে হাদিয়া দিতে চেয়েছিলে? আমার জন্য ২০ টাকা হাদিয়া নিয়ে আসো।
দুই. আব্বা দুনিয়াকে ত্যাগ করেননি; বরং দুনিয়ার ভেতরে থেকে দুনিয়াকে মহব্বত করেননি। আব্বা বুয়েটে ২৬ বছর চাকরি করেছেন। এরপর আইইউটিতেও ছিলেন অনেক বছর। আরো কিছু জায়গার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, সেসব জায়গায়ও কাজ করেছেন। দুনিয়া আব্বার পায়ের কাছে এসেও তাঁকে ছুঁতে পারেনি। যখন ৫৪ নাম্বার বাড়ি নিয়ে মহা পেরেশানি হচ্ছিল তখন আব্বাকে অনেকে বলেছিলেন, হযরত! আপনাকে অমুক সেক্টরে একটি বাড়ি লিখে দিতে চাই। কিন্তু আব্বা গ্রহণ করেননি। আমি তখন হজ্বে ছিলাম। পরে আব্বা নিজে আমাকে এগুলো শুনিয়েছেন।
আরো অনেক আগে আব্বার এক বন্ধু আব্বাকে একটা ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিলেন, তখন আব্বা তাঁকে মাযেরাত করে দিয়েছেন। আসলে হাদিয়া কবুল করা তো সুন্নত। কিন্তু তারও রয়েছে শরঈ বিধান এবং উসূল ও আদাব। কোনো দ্বীনী কাজের জন্য হাদিয়া কবুল করতেও সেই বিধান ও উসূলের প্রতি লক্ষ রাখতেন।
তিন. আর্থিক হোক বা সামাজিক— যেকোনো কঠিন থেকে কঠিন হালতে আব্বা খুব অটল অবিচল থেকে নিজের কাজগুলো অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আঞ্জাম দিয়ে যেতেন।
করোনার সময় কত মাদরাসা বন্ধ! কত আতঙ্ক! আমাদের মাদরাসায় বারবার পুলিশ আসছে। সোমবারের মাহফিল চালাতে পারছি না।
আব্বা একদিন আমাকে বললেন, এটা আমাদের হিম্মত। একজন বক্তা হামীদুর রহমান। একজন শ্রোতা হামীদুর রহমান। সোমবারের মাহফিল চলবে।
আব্বার কথায় মাহফিল চলতে থাকল। পুরো বাসা অন্ধকার করে লুকিয়ে লুকিয়ে মাহফিল চালাতাম। পুলিশ আসত। কিছুক্ষণ ঘুরত ফিরত। আমরা বলতাম, আল্লাহর ওলী তো! কিছু মুরীদান এসেছেন।
তখন উনারা বলতেন, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে।
আজিমপুরের মাহফিল তখনো আমরা চালু করতে পারিনি। আমাকে আব্বা এক বৃহস্পতিবারে জিজ্ঞাসা করলেন, আজিমপুরের কী খবর? আব্বার এ প্রশ্ন শুনে আমি বুঝতে পারলাম, আব্বা আজিমপুরের মাহফিল চালু করতে যাচ্ছেন। তাই বললাম, আব্বা! একজন বক্তা হামীদুর রহমান। একজন শ্রোতা হামীদুর রহমান। আজিমপুরের মাহফিল চলবে। আব্বা বললেন, মাশাআল্লাহ! জাযাকাল্লাহ!! তুমি আমার অন্তরের কথাটাই বলেছ। সে সপ্তাহ থেকে আজিমপুরের মাহফিলও শুরু হয়ে গেল।
চার. আমার আব্বার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে কঠিন সময়ের সহযোগী ছিলেন আমার আম্মা। তিনি বলেন, তোর আব্বাকে আমি পেরেশানির কথা বললে তিনি বলতেন, রাতের আঁধারে ওঠো, নামায পড়ো, কান্নাকাটি করো, সব হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
পাঁচ. আব্বা নিজের কোনো মাহফিলকে কখনোই ইসলাহী মাহফিল বলা পছন্দ করতেন না। আব্বা বলতেন, তালীমী হালকা, আজিমপুরের মাহফিল, সোমবারের মাহফিল। এরকম করে আব্বা বলতেন। আমি একবার ইসলাহী মাহফিল লিখেছিলাম, পরে আব্বা নিজ হাতে সেটা কেটে দিয়ে বললেন, এভাবে লিখেছ কেন? আমার ইসলাহ করার যোগ্যতাই নেই।
আসলে আব্বা আলেম-উলামাদের সাথে থেকে নিজেকে এত মুতাওয়াযে ও বিনয়ী বানিয়েছিলেন বলেই আল্লাহ তাআলা আব্বাকে দিয়ে এত কাজ নিয়েছেন।
মাওলানা মাসীহুর রহমান
[হযরতের চতুর্থ ছাহেবযাদা]
এক. প্রতি বৃহস্পতিবারে আব্বাজান রাহ. নিমতলীতে খুবই ইহতিমাম ও পাবন্দির সাথে আসতেন। আব্বা রওয়ানা হওয়ার পর আম্মা আমাকে ফোন করতেন, তোমার বাবা রওয়ানা হয়েছেন।
আব্বাও এসে আমাকে ফোন করতেন, মাসীহুর রহমান, তুমি আসবে না? এসো, আমি বসে আছি তোমার জন্য। তুমি আসবে, এসে মুসাফাহা করে চলে যাবে। এসো, আমাকে দেখে চলে যাও!
এমন অনেক হয়েছে, আব্বা আসার পরে আমি সিএনজিতে করে রওয়ানা দিয়েছি। পৌঁছতে পৌঁছতে কখনো সাড়ে নয়টা, দশটা, এমনকি সাড়ে দশটাও বেজে যেত। কখনো আবার আব্বা নিজেই আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।
গিয়ে বলতাম, আব্বা, আজ তো অমুক আছে, তিনি তিলাওয়াত করুক!
আব্বা বলতেন, না, তিলাওয়াত তুমি করবে! অন্য সবাই করুক, তুমি তোমারটা করো।
আল্লাহ তাআলা আব্বাজান রাহ.-কে কবরে কেবল মাসীহুর রহমানের প্রতি তাঁর এই এহসান ও অনুগ্রহের কারণে ক্ষমা করে দিন! এছাড়া তো আরও অনেক ওসিলাই আছে। তাঁকে আল্লাহ তাআলা জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন।
দুই. সম্ভবত ১৯৯৯ বা ২০০০ সালের কথা। খতম তারাবী পড়াতে পারিনি। আব্বা করাচিতে গিয়েও জিজ্ঞেস করেছেন, তারাবী পড়াচ্ছি কি না?
বললাম, আব্বা, নফল নামাযে পড়ি বা একা একা পড়ি।
আব্বা সব সময় তারাবী পড়ানোর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতেন। তারাবী না পড়ালে হাফেয সাহেবদের হিফজ কমজোর হয়ে যায়, একথা আব্বা সব সময় বলতেন। করাচি থেকে ফিরে এসে হারদুঈ গিয়েছিলাম। সেখানে হযরত হারদুঈ রাহ. জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারাবী পড়াবে কি না?
আমি সেখানেও ফাঁকিবাজি করেছিলাম। বলেছি, আমি ঢাকায় চলে যাব।
বড় ভাইয়া হাত তুলেছিলেন এবং তিনি তারাবী পড়িয়েছেন। আমি চিন্তা করলাম, ঢাকায় এসে দশ দিনে তারাবী পড়িয়ে নেব। কিন্তু ঢাকায় নামার পরেই আব্বা জিজ্ঞেস করেছেন, তারাবীর কী করবে?
আমি বললাম, আব্বা, দশ দিনে পড়ব।
বললেন, হাঁ, নিজে নিজে মাদবরি কর, আমি তোমার জন্য নিমতলীতে ঠিক করে রেখেছি।
আখের নিমতলীতেই পড়ানো হল। নিমতলীতে তারাবী পড়ানোর সময় আমার যে হালত হয়েছিল, সেটা আমাদের মোশাররফেরও স্মরণ থাকার কথা। একটা পৃষ্ঠা পড়তেই আমার পায়ে কাঁপাকাঁপি শুরু হত। আব্বা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিছুই বলতেন না। মদ-গুন্না বা কোনো ধরনের কোনো ভুলের জন্য আব্বা মুআখাযা করতেন না। তিনি বলতেন, হারদুঈ হযরত রাহ.-ও বলতেন, রওয়ানেগী চাই! ভুল তো যাবেই। ভালো ভালো হাফেয সাহেবদেরও ভুল হয়। এমনকি মক্কা-মদীনার ইমাম সাহেবদেরও হয়।
আলহামদু লিল্লাহ, এভাবে ওই বছর আর মসজিদে খতম তারাবী পড়ানো থেকে বিরত থাকার সুযোগ পাইনি। এখন তো সবার দুআর বরকতে পুরো কুরআন শরীফই এক বসায় পড়ার মতো হিম্মত আছে, আলহামদু লিল্লাহ।
তিন. বুয়েটে যখন খতম তারাবী পড়াতাম, একদিন আমি সূরা মায়িদার ৫৮ নম্বর আয়াত পড়ছিলাম। একটা ভুল করেছিলাম। আব্বা অর্থসহ বুঝিয়ে ভুল শুধরে দিলেন। এমন কত যে ঘটেছে! কুরআন কারীমের আয়াতগুলোর অর্থ ও মর্ম আব্বা যেভাবে পারেন, আমরা কিন্তু সেভাবে পারতাম না।
চার. উস্তাযকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার যে তরবিয়ত আব্বা করতেন, সেটি ছিল অবর্ণনীয়। একটা ঘটনা মনে পড়ে। একদিন আমাদের এক উস্তায আমাকে খুব মেরেছিলেন, এখন ঠিক মনে নেই। আমি কাঁদছিলাম। এমন সময় আব্বাও সেখানে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছেন, কী হয়েছে?
বললাম, হুজুর আমাকে মেরেছেন।
আব্বা রাগ হয়ে গেলেন। তারপর হুজুরকে উদ্দেশ করে বললেন, হুজুর, আপনার লাঠিটা আমার কাছে দিন। ‘হুজুর মেরেছেন’ একথা সে কেন বলল? আমি ওকে ধরে পিটাই!
এই ছিল আব্বার তরবিয়ত। অথচ আজ আমাদের অবস্থা কী, হুজুর মেরেছে তো, ওই হুজুরকে পারলে জেলে ঢুকাব। নয়তো গালমন্দ করব।
তরবিয়তের বিষয়ে এই ঘটনা আমার কাছে খুবই অবাক লাগে! আব্বা নিজেও উস্তাযের অনেক সম্মান করতেন। আমার যতটুকু জানাশোনা ও উপলব্ধি, আব্বা হিন্দু শিক্ষকদেরও অনেক সমীহ করতেন। কারণ হিন্দু হোক আর যেই হোক, উস্তায উস্তাযই।
অনেকেই জানেন, আব্বাজান রাহ. আমাদের উস্তায বুয়েট মসজিদের ইমাম সাহেবকে সেইসময় প্রায় এক হাজার টাকা করে হাদিয়া দিতেন। এছাড়া আরো আমাদের অন্যান্য উস্তাযকেও শুকরিয়াতান মাঝেমধ্যেই হাদিয়া প্রদান করতেন।
আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন আল্লাহওয়ালাদের সংস্পর্শ লাভের তাওফীক দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা শিক্ষাগুলোও মনে রাখার তাওফীক দান করুন।
পাঁচ. মাদরাসা সম্পর্কে আব্বা একদিন আমাকে বলেছেন, আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হল, প্রথম মুন্সিগঞ্জ, দ্বিতীয় নিমতলী। অথবা বলেছেন, এক নম্বর নিমতলী, দ্বিতীয় মুন্সিগঞ্জ।
একদিন বলেছিলেন, নিমতলী মাদরাসায় যখন আমি ঢুকি, তখন আমার আব্বার তিলাওয়াত আমার কানে ভাসে। (অর্থাৎ আমার দাদাভাই ইয়াসীন সাহেবের তিলাওয়াত আব্বার কানে ভাসে।)
ছয়. আমার সাথে আব্বার একটা ঘটনা খুবই সুন্দর! বলা যায়, আব্বার একটা কারামতি। সেটা হল ইংরেজি শেখার বিষয়। আব্বা তো প্রায়ই ইংরেজি পড়াতেন এবং তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল, আমরা ইংরেজিটা শিখি। সওয়াব বা ফায়দা ভিন্ন কথা, কিন্তু আব্বা চাইতেন, আমরা যেন ইংরেজি শিখি। বর্তমান সময়ে মাওলানা তাকী উসমানী ছাহেবসহ অন্যরাও বলেন, দ্বীনের খেদমতের জন্যই এখন প্রয়োজনমাফিক ইংরেজি শেখা চাই।
আব্বা আমাকে একদিন ইংরেজির জন্য দরসে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আমি আম্মার কাছে নালিশ করেছিলাম যে, আব্বা আমাকে ইংরেজির জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছেন; ইংরেজি পড়া কি জায়েয আছে?
আম্মা তখন আব্বাকে বলেছিলেন, তুমি যে তোমার ছেলেদের ইংরেজি পড়াচ্ছ এবং এর জন্য দাঁড় করিয়ে রাখছ, এটা কি জায়েয আছে?
আব্বা চুপ হয়ে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে; মাসীহ তার শায়েখকে জিজ্ঞেস করুক।
সুবহানাল্লাহ, ১৯৯৯ বা ২০০০ সনে যখন হারদুঈ গিয়েছিলাম, একদিন হযরত আমাদের কামরায় এসেছেন। এরইমধ্যে তাঁর কাছে আমেরিকা থেকে ফোন এসেছে। হযরত বললেন, ‘ভাই মুঝে তো ইংরেজি নেহী আতী; ইন সে পু-ছো!’ ইন সে বাত করো, ইয়ে প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহাব কা বে-টা হ্যায়!’
আমি বললাম, জী বলেন।
হযরত বললেন, ‘আরে ইংরেজি সে বোলো!’
আমি বললাম, ইংরেজি নেহী আতী!
হযরত বললেন, ধুর!
তখনই আব্বার সেদিনের ইংরেজি শেখানোর প্রতি গুরুত্বের কারণ আমার ভালো করে বুঝে এসে গেল। আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। পাকিস্তানে যাওয়ার পরও আব্বা আমাকে ইংরেজি শেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেখানে ইন্টারমিডিয়েট দেওয়া সহজ ছিল। আব্বা বললেন, এখানে নাকি অনেকে মেট্রিক, ইন্টার পরীক্ষা দেয়, পাশ করে; তুমি পারলে তুমিও দিয়ে দাও।
জানি না, এটা কি আমাকে তাঁর পরীক্ষা করা উদ্দেশ্য ছিল, না আসলেই আমি ইংরেজি শিখি— এটা তিনি চাইতেন, তা বলতে পারব না।
সাত. দাদুর সাথে আমাদের খুনসুটি হত, কিন্তু দাদু কখনো বিচার দিতেন না। একদিন সম্ভবত বিচার দিয়েছিলেন। এজন্য আব্বা আমাকে কঠিন শাসন করেছেন, ‘এত বড় সাহস, আমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছ!’
মার তো প্রায়ই খেতাম, কিন্তু সেদিন অনেক বেশি মার খেয়েছিলাম।
আরেক দিনের মার খাওয়ার কথা মনে পড়ে। আব্বার নীতি হল, মাগরিবের পরে আর কোনো খেলা নেই। কিন্তু সেদিন আমি মাগরিবের পরে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেছিলাম। আব্বা এসে শাসন করে ঘরে ঢুকিয়েছেন। অথচ আমার যখন কোনো খেলার সঙ্গী থাকত না, আব্বা নিজেই আমার সাথে খেলতেন। একদিন আব্বা আমার সাথে খেলছিলেন। এমন সময় আমাদের মাহবুবুল হক ভাই এসে বললেন, চাচা, আমি খেলব। আপনি কাজে যেতে পারেন!
সেদিন তিনি আমার সাথে খেলেছেন। যাইহোক, আব্বার এই শফকতগুলো এখন বুঝে আসে। আসলে শফকত একেক সময় একেকভাবে প্রকাশ পেত। একেক সময় একেক ধরনের শফকত ছিল। কখনো শাসনের মাধ্যমে, কখনো আদর সোহাগের মাধ্যমে।
আল্লাহ তাআলা আব্বাকে কবরের মধ্যে শান্তিতে রাখুন। আমাদেরকে আব্বার মতো হওয়ার তাওফীক দান করুন।
আট. একেবারে ছোটবেলার কথা। আমার এক আত্মীয়ের কাছে আমি ইংরেজি বর্ণমালা শিখছিলাম। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, মুহসিন, এদিকে এসো! যাওয়ার পর বললেন, না, তোমার উস্তায কেবলই আমি। অন্য কেউ নয়। তোমার কারো কাছে ইংরেজি শেখার দরকার নেই। শুধু আমার কাছে শিখবে! এগুলো আমরা শিখব একমাত্র আল্লাহর জন্য। শিখতে গিয়ে মন যেন দুনিয়ার দিকে চলে না যায়। মন থাকবে শুধুই আল্লাহর দিকে। কাজেই এখানে সেখানে গিয়ে তোমার ইংরেজি শেখার প্রয়োজন নেই।
আরেক দিন আমার এক চাচ্চুর কাছে ড্রাইভিং শিখতে চেয়েছিলাম সম্ভবত। আব্বা বললেন, না না, অন্য কেউ তোমার উস্তায হতে পারবে না; আমিই তোমাকে ড্রাইভিং শেখাব!
আল্লাহ তাআলা আব্বাকে ক্ষমা করে দিন। তার কবরকে মাগফিরাত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন এবং জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন— আমীন।
নয়. আব্বার গল্পের শেষ নেই। নানাভাইয়ের বাড়ি বি.বাড়িয়া। নানাবাড়িতে সব সময়ই যাই। একবারের ঘটনা। নানাভাই সেজো খালাকে টেলিভিশন কিনে দিয়েছেন।
আব্বা, আমি, আরিফ ভাই মসজিদ থেকে ফিরছি। আব্বা বাম দিকে তাকিয়ে বলেন, এন্টিনা দুইটা কেন? এন্টিনা দুইটা কেন? তোমার নানার বাসায়ও টেলিভিশন?
জী আব্বা! নানার বাসায়ও টেলিভিশন।
আব্বা এবার আম্মাকে ডাকলেন, রিজওয়ানের আম্মু!
আম্মার সাথে নানুও আসলেন— হয়তো কিছু একটা হয়েছে। জানেন, জামাই রাগ হলে এমন করে।
নানুকে বললেন, আম্মা আমি চললাম! মুস্তাফীয চলো, আরিফ চলো।
আমি বললাম, আব্বা আমিও যাব।
বললেন, না, তুমি যেয়ো না। তুমি তোমার আম্মার জন্য কাঁদবে।
না আব্বা, আমি যাব।
চার ভাইকে নিয়ে সোজা বি.বাড়িয়া স্টেশন। স্টেশনে গিয়ে একটা হোটেল ভাড়া করলেন। হোটেলের নাম গ্রিন। হোটেলে থাকলাম। এরপর রাতের একটা লোকাল ট্রেনে ঢাকা চলে এলাম। পরের দিন থেকে আমার কান্না শুরু হয়ে গেল। আম্মার কাছে যাব, আম্মার কাছে যাব। আব্বা আমাকে নিয়ে এক-দুইদিন পরে এসে আম্মাকে নিয়ে ঢাকা চলে এলেন। কেন? কী জন্য এমন করলেন?
টেলিভিশনের জন্য। নানার বাসায় টেলিভিশন কিনেছেন বিধায় এ কাজ করলেন। আব্বা আপোস করতেন না।
এটা খুব একটা শিক্ষণীয় বিষয় যে, গুনাহের মধ্যে কোনো আপোস নাই। কোনো একটা কাজে আল্লাহ খুশি, বান্দা নাখোশ— কোন্টা মানতে হবে? আল্লাহ যেটাতে খুশি, সেটা।
শিক্ষা : টেলিভিশন থেকে সতর্ক থাকব। যেখানে গুনাহ সেখানে আমরা থাকব না, বসব না। গুনাহ হচ্ছে, সেখানে কেউ বসে আছে, হঠাৎ মৃত্যু হয়ে গেল। এরচে বড় দুর্ভাগ্য আর নেই।
দশ. আব্বার সাথে একদিন নীলক্ষেত থেকে ফিরছিলাম। একজনকে দেখিয়ে বললাম, আব্বা! বেদআতী।
আব্বা বললেন, না, কাউকে বেদআতী বলবে না। কারণ, কার শেষ অবস্থা ঈমানের সাথে ভালো অবস্থায় হবে— তা কে বলতে পারবে? আল্লাহ ছাড়া কেউ পারবে না। তাই কাউকে বেদআতী বলে কটাক্ষ করা ঠিক না। আল্লাহ তাআলা কখন কী ফায়সালা করেন? কোন্টার মধ্যে অহংকার, কোন্টার মধ্যে হিংসা খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমলের তাওফীক দান করুন।
এগারো. উত্তরা ৫৪ নম্বর বাসার নিচ তলার এক নম্বর ঘর; আমার আব্বাজান তখনো ওই ঘরে স্থানান্তরিত হননি। এত মাজুর হননি। মাজুর হওয়ার পরে আব্বা এক নম্বর ঘরে চলে গেছেন। ওই ঘরে একদিন রাত্রিবেলা, আমি বাসায় ফিরে আসব।
আব্বা বললেন, না, তুমি যাবে না। থাকো আজকে। কী হয় থাকলে?
হঠাৎ রাত্রিবেলা তিনটার সময় কট্ কট্ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল; কী যেন পুড়ছে। কী ব্যাপার? পরে দেখি, মাদরাসার তিন তলায় আগুন লেগে গেছে! আল্লাহু আকবার! আগুন কাকে বলে! আমি দৌড়ে আব্বাকে ডাকলাম। বললাম, আগুন লেগেছে।
আব্বা একদম বিচলিত হলেন না। সনটা আমার মনে নেই। আব্বা তখন সুস্থ। আমি উপরে গিয়ে বাচ্চাদেরকে বললাম, তোমরা তাড়াতাড়ি বের হও। সবাই বের হও। ভাই আরিফুর রহমান পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। তাঁকে জানাতেই ফায়ার সার্ভিসে কল করলেন। আমি সবাইকে এক এক করে বের করলাম। বাসার মেয়েরা বোরকা পরে সবাই বের হয়ে গেল। আমি আব্বাকে ডাকলাম, আব্বা আপনি বের হয়ে আসেন, আব্বা আসেন। আব্বা আস্তে আস্তে উপরে চলে গেল। যেহেতু আগুন তিন তলায়। তিন তলা ছিল টিনের। সব পুড়ে শেষ— ফোম-টিন-কাঠ যা ছিল সব পুড়ে গেছে। দোতলায়ও আগুন এসেছে। দোতলার তেমন ক্ষতি হয়নি। এরমধ্যেই ফায়ার সার্ভিস এসেছে, আলহামদু লিল্লাহ। ছোট ভাই ফিরদাউসও এসেছে। ফেরদাউস গাড়িতে করে সবাইকে মাদরাসার আরেক বাসায় নিয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলার খাস রহমত, কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি যা হওয়ার মালের ওপর দিয়ে গেছে। কারো জানের কোনো ক্ষতি হয়নি। তো এটা আব্বার কারামতই বলা যায়।
বারো. আব্বা একবার তাঁর এক বন্ধু মেহেদী চাচার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন। পাত্র ঠিক হয়েছে। আব্বার এক ছাত্র। বাড়ি বগুড়া। তারা আমাদেরকে ওলীমার দাওয়াত দিয়েছেন। আব্বার সাথে আমিও গেলাম। রাস্তায় সারা রাত পার হয়ে গেল। বগুড়া তো অনেক দূরে। সেখানে পৌঁছেই আমরা একটা হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে ওলীমায় গেলাম। একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। প্রবেশমাত্রই শুনি, গান চলছে। আব্বা বললেন, মাসীহ, চলো!
এত কষ্ট করে গেলাম ওলীমা খেতে। আর আব্বা বলছেন, মাসীহ, চলো!
মেয়ে পক্ষের একজন বেশভূষায় হুজুর মানুষ। বললেন, আপনাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করছি। আপনাদের সেখানে যাওয়ার দরকার নেই।
চিন্তা করেন, আব্বা গান-বাজনা হচ্ছে এজন্য বের হয়ে যাচ্ছেন। চাইলে তো তারা পারত, প্রফেসর হামীদুর রহমান সাহেব চলে যাচ্ছেন, গান বন্ধ করে দেই। না, উল্টো বলল, আপনারা বসেন আপনাদেরকে আলাদা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কেমন যেন আব্বা খাওয়ার জন্যই সেখানে গেছেন। আব্বা এমন কত দাওয়াত থেকে উঠে চলে এসেছেন!
আব্বা আমার হাত ধরে বললেন, চলো। সোজা চলে গেলেন বগুড়ার জামিল মাদরসায়। সেখানে মাওলানা মুফতী আরশাদ ছাহেব, যিনি মুফতী আব্দুর রাহমান ছাহেব রাহ.-এর বড় ছাহেবযাদা, ওই মাদরাসার তৎকালীন শাইখুল হাদীস, তাঁর মেহমান হলাম। আরশাদ ছাহেব আমাকে বগুড়ার দই খাওয়ালেন। খাওয়ার মধ্যেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। আব্বা সাথে সাথে আব্বার এক ছাত্রকে ফোন করলেন। তখন সে এ এলাকার বড় বিদ্যুৎ-অফিসার। ফোন করে আব্বা বললেন, কী ব্যাপার? আমি বগুড়ায় এসেছি, আর তুমি কারেন্ট বন্ধ করে রেখেছো। সে ফোন ধরেই বলছে, স্যার স্যার। স্যার এখনই বিদ্যুৎ চালু করে দিচ্ছি। একটু পরেই কারেন্ট চলে এল।
পরে আমরা জামিল মাদরাসাতেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি, বিয়ে বাড়ির সবাই চলে এসেছে। তাদের এতক্ষণে খবর হয়েছে, প্রফেসর হামীদুর রহমান সাহেব রাগ করে বের হয়ে গেছেন। তারা পরস্পর বলাবলি করছিল, আরে হামীদুর রহমান সাহেব কোথায়? তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে এত কষ্ট করে এলেন, এখন তিনি নেই!
ওদিকে বিদ্যুতের সেই অফিসারও দাওয়াত খেতে গিয়েছেন সেখানে। তিনি বললেন, আমি জানি, স্যার কোথায় আছেন। স্যার আছেন জামিল মাদরাসায়।
তারা এসে আমাদের নিয়ে আবার হোটেলে গেল। হোটেলের রেস্ট-হাউজে নিয়ে ওলীমার খাবার খাওয়াল। এই হল, আমাদের আব্বাজান। তিনি আমাদের পাঁচ ভাই দুই বোনের জন্য— আমাদের সবার জন্য দুনিয়াটা পুরোপুরি ত্যাগ করেছেন। এভাবেই করেছেন তিনি।
কীভাবে? বুয়েটে আব্বা পিএইচডি করেননি। অনেক উপায় ছিল। অনেক সুন্দর সুযোগও ছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন বড় বড় জায়গায় আব্বা যাননি; তিনি বলতেন, আমি আমার সন্তানদেরকে সময় দিচ্ছি। এজন্য তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। কারো মনে হতে পারে, তিনি ঠকেছেন! এক জানাযা দিয়েই তো আমরা বুঝতে পারি, হামীদুর রহমান ছাহেব কী ছিলেন! উত্তরায় এ জানাযার ঘটনা এ সপ্তাহেও আলোচনা হয়েছে। তরকারীওয়ালা, রিক্সাওয়ালা এমন অনেককে পেয়েছি, যারা সেখানে ছিলেন।
মাওলানা আব্দুর রহমান ফিরদাউস
[হযরতের ছোট ছাহেবযাদা]
এক. আমরা কোনো অপরাধ করে ফেললে আব্বা ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়তেন। ইসলাহ করে দিতেন। সব সময় মারতেন না। কখনোই রাগ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের মারতেন না। সময় নিতেন। ভালো মনে করলে পরে কখনো বকাঝকা করতেন। আবার কখনো মারতেন।
দুই. বুয়েটে থাকতে আমি বাইতুস সালাম মসজিদের মক্তব পড়তাম। একদিন মসজিদে সম্ভবত এশার নামাযের মধ্যে আমি এক ছাত্রের সাথে দুষ্টুমি করি। মূলত সে-ই আমার সাথে দুষ্টুমি করেছিল। পরে সে হুজুরের কাছে আমার নামে বিচার দিয়ে বলে, আমি তার সাথে নামাযে দুষ্টুমি করেছি। তার কথা শুনে হুজুর আমাকে শাস্তি দেন। মসজিদের বারান্দায় মক্তবের বাচ্চাদের পড়ানো হত। বারান্দা থেকে ভেতরে ঢোকার জন্য কয়েকটি দরজার খোপ ছিল। হুজুর আমাকে শাস্তিস্বরূপ একটি খোপের মধ্যে কেবলামুখী করে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর আব্বা এলেন। তখন মক্তবে কয়েকটি গ্রুপে ছাত্রদের পড়ানো হত। আব্বা এসে সব গ্রুপে আমাকে খুঁজলেন। কিন্তু আমাকে কোথাও পেলেন না। আব্বা হুজুরদের জিজ্ঞাসা করলেন, ফেরদাউস কোথায়?
হুজুররা চুপ করে থাকলেন। উনারা জানতেন যে, আব্বা যদি এই কথা শোনেন তাহলে আব্বা খুব রাগ হবেন। কঠিন অবস্থা হয়ে যাবে। আমাকে পিটনি দেবেন। তাই তারা প্রথমে বলতে চাইলেন না। পরে আব্বার চাপাচাপিতে বললেন— আমি কোথায় আছি।
আব্বা সেখানে গিয়ে দেখেন, আমি কান ধরে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তো আব্বাকে দেখে ভয়ে শেষ! আব্বা হুজুরদের জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছিল বলেন! তখন একজন হুজুর বললেন, নামাযের মধ্যে অমুকের সাথে একটু দুষ্টুমি করেছে। আব্বা আমাকে কিচ্ছু বললেন না।
আব্বা হুজুরদের বললেন, আপনারা আসেন। আমি এখন ওকে বাসায় নিয়ে যাই। আব্বা আমাকে মসজিদ থেকে বাসায় নিয়ে আসলেন। রাস্তায় আব্বার মধ্যে তেমন রাগ বোঝা যাচ্ছিল না। তাই আমি বুঝতে পারিনি, আব্বা কী পরিমাণ রাগ হয়ে আছেন! বাকি এতটুকু জানতাম, নামায নিয়ে অবহেলা, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ আব্বা একদম পছন্দ করেন না। আমাদের নামে আব্বার কাছে কোনো অভিযোগ আসা আব্বা একদম সহ্য করতেন না। বাসায় এসে বললেন, নামাযে কেন পচা হলে? হুজুর তোমার নামে কেন বিচার দিলেন?
এগুলো বলতে বলতে আব্বা আমাকে খুব পেটালেন।
তিন. আব্বা তিনজন একসাথে একটা রিকশায় চড়া খুব অপছন্দ করতেন। একদিনের ঘটনা, আমি তখন মেশকাত জামাত শেষ করে দাওরায় ভর্তি হব। মাদরাসায় পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা রিকশায় উঠে উত্তরা বাসায় ফিরছি। মাসকট প্লাজার সামনে এসে রিকশাটা কোনো কারণে উল্টে যায়। আমি উপরে ছিলাম। তাই আমি কোমরে ভালো একটা চোট পাই। বাসায় আসার পর আব্বা কোনোভাবে বুঝে ফেলেন— আমার কোমরে চোট পাওয়ার কারণ কী? কিন্তু তখন কিছুই বলেননি। কয়েকদিন পর আমরা মুস্তাফীয ভাইয়ার বাসায় গেলাম। তখন মুস্তাফীয ভাইয়া ধানমন্ডি ৭/এ-তে থাকতেন। যেটা কোচিংহোম নামে পরিচিত।
আব্বা হাজ্বী হাবীব সাহেব রাহ.-এর বাসায় ছিলেন। আমাদের সেখানে যেতে বললেন। যাওয়ার সময় আমরা তিন বন্ধু আবার একসাথে রিকশায় চড়ে রওয়ানা হলাম। হাজ্বী সাহেবের বাসার কাছাকাছি পৌঁছলে আব্বা আমাদের দেখে ফেলেন। আমরা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিলাম। আব্বা কিচ্ছু বললেন না। সম্ভবত পনেরো নম্বর মোড়ের দিকে আমাদের নিয়ে গেলেন। মোড়ে গিয়ে আব্বার রাগ প্রকাশ পেল। আমাকে বকা দেওয়া শুরু করলেন— ‘বেশি আহ্লাদ হয়ে গেছে! পচা ছেলে! এখনই কান ধরে উঠবস করো!’
আমি একটু দেরি করছিলাম। আব্বা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে আমিই করছি। এটা বলে আব্বা কানে হাত দিতেই আমি বললাম, জী না, আব্বা! আমি করছি। বলে আমি কান ধরে উঠ্বস্ শুরু করে দিলাম। চার থেকে পাঁচবার কান ধরে উঠ্বস্ করলাম। আশেপাশে অনেক লোকজন ছিল। টঙের দোকানের মানুষ চা-বিস্কুট খাচ্ছিল। মোড়ের মধ্যে অনেকগুলো রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। সবার সামনে এভাবে কান ধরে উঠ্বস্ করায় আমি অনেক লজ্জা পেলাম। খুব অপমানবোধ করলাম। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তারপর আব্বা আমাদের নিয়ে গাড়িতে ওঠালেন। গাড়িতে ওঠার পর আমাকে আদর করা শুরু করলেন। বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কী খাবে বাবু? কী খাবে মানিক? গাড়ি থামিয়ে পানীয় কিনে আনলেন। বললেন, নাম তোমার কাম আমার। মানে তোমার নাম দিয়ে আমরাও খাচ্ছি।
এদিকে আমি তো শুধু কাঁদছিই। আব্বার কথার দিকে পাত্তা দিচ্ছিলাম না।
আব্বা বললেন, আর কাঁদতে হবে না, এবার খাও।
অপরাধ করেছি বলে শাস্তি দিলেন ঠিক, কিন্তু আবার আদরও করলেন। আমার বন্ধু ড. লুৎফুল কবীর চাচার ছেলে সানীন আমার সাথেই ছিল। সে তখন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, বড় হুজুর তোকে অপমান করার উদ্দেশ্যে এমনটি করেননি। হুজুরের কথা শুনেছিস বলে হুজুর তোর জন্য অনেক দুআ করবেন। আজকে তুই যে নিজেকে ছোট করে হুজুরের কথা শুনেছিস, দেখবি, এখন আল্লাহ তাআলা তোকে কত হজ্ব-উমরায় নিয়ে যান।
পরে ঠিকই আল্লাহ তাআলা আমাকে বহুবার আব্বা-আম্মার খাদেম বানিয়ে হজ্ব-উমরা করার তাওফীক দিয়েছেন, আলহামদু লিল্লাহ।
চার. ছোট থাকতে আব্বা আমাদেরকে চুল কাটাতে নাপিতের কাছে নিয়ে যেতেন। বড় হওয়ার পর যখন আমি একা একা নাপিতের কাছে গিয়ে চুল কাটা শুরু করলাম। সেসময়ের একটি ঘটনা।
আমি নাপিতের কাছে গিয়ে চুল কাটালাম। সামনের দিকের চুল কিছুটা বড় ছিল। আব্বা দেখলেন, কিচ্ছু বললেন না।
পরেরবার যখন চুল কাটব তখন আব্বা আগ থেকেই বুঝতে পারলেন। মাদরাসা থেকে ফেরার পথে আমাকে সেলুনে নিয়ে গেলেন। সেলুনে গান চলছিল। আব্বাকে দেখামাত্রই নাপিত সাহেব গান বন্ধ করে বললেন, আসেন আসেন হুজুর! আসসালামু আলাইকুম।
সালাম-কালামের পর আব্বা নাপিত সাহেবকে বললেন, ওর মাথা একেবারে ন্যাড়া করে দেবেন।
আমি তো বুঝতেই পারলাম না, কেন আব্বা ন্যাড়া করে দিতে বললেন। ন্যাড়া করার পর যখন বাসায় ফিরব, তখন আব্বা মালেক বেকারি থেকে আমাকে নাস্তা কিনে দিলেন। সেখানকার নাস্তা আমি অনেক পছন্দ করতাম। নাস্তার পর বাসায় যাওয়ার সময় আব্বা বললেন, আগেরবার যে চুল বড় রেখেছিলে তাই এবার ন্যাড়া করে দিয়েছি। সামনে থেকে আমার মতো ছোট ছোট করে চুল কাটবে। আর ন্যাড়া করতে হবে না।
আমাদের থেকে যত মারাত্মক ভুলই হোক না কেন, যত বড় ভুলই হোক না কেন, ‘ভুল হয়ে গেছে’ আব্বাকে শুধু এতটুকু বললেই ক্ষমা করে দিতেন। অনেক খুশি হয়ে যেতেন।
পাঁচ. আব্বা কখনো গালি-গালাজ পছন্দ করতেন না। নিজেও গালি দিতেন না। পচা, বোকা— এধরনের শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন। একবার কেউ আব্বার সামনে গালি দিয়েছিল, তখন তিনি অনেক রাগ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তোমার জিভ কেটে দিতে ইচ্ছে করছে।
ছয়. একদিন আমি আব্বার সাথে আব্বার এক মহব্বতের মানুষের বাসায় গেলাম। ঢুকতেই আমরা দেখতে পেলাম, একটা বাবু সোফায় বসে বসে গেম খেলছে আর ওর ফোন থেকে জোরে জোরে গেমের মিউজিকের আওয়াজ আসছে। আব্বা ঘরের কর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে? উনি বললেন, আমার বিবি সাহেবার বোনের ছেলে। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ও কী করছে?
বিষয়টি তাঁর কাছে তেমন গুরুতর বলে মনে হচ্ছিল না বলে স্বাভাবিকভাবে উনি জবাব দিলেন, স্যার! ও একটু গেম খেলছে।
আব্বা তখনো বসেননি। দাঁড়িয়েই ছিলেন। আব্বা তো একটু কুঁজো হয়ে থাকতেন। ওনার এই জবাব শুনে একদম সোজা হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। খুব রাগ হয়ে ওনাকে বললেন, আগামীকালই মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের কাছে চলো। এটা আর টেলিভিশনের মাঝে কোনো ব্যবধান আছে কি না? এই ব্যাপারে উনার কাছ থেকে ফতোয়া নিয়ে আসি।
উনি বললেন, স্যার! এমনিই খেলছে।
আব্বা ওনাকে আরো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, আবার তুমি কথা বলছ! টিভির চেয়েও খারাপ এটা! কালকেই চলো।
সাত. এমনিতে আলহামদু লিল্লাহ আব্বার অনেক খেদমত করতে পেরেছি। কিন্তু অনেক সময় ঠিকমতো খেদমত করতে পারতাম না। উল্টাপাল্টা হয়ে যেত। আব্বা কখনো বকা দিতেন। খেদমত কীভাবে করতে হয়, শিখিয়ে দিতেন। আবার কখনো কিছুই বলতেন না।
এখন থেকে প্রায় আট-দশ বছর আগের কথা। তখন আব্বার নিয়মিত কোনো খাদেম ছিল না। আরিফ ভাইয়া আমাকে বলেছিলেন, আব্বার সাথে তুমি আইইউটি যাবে আর সময়মতো দরস করতে না পারলে সকাল-দুপুর-রাতে যখন পারবে দরস করাবে।
তারপর আব্বার সাথে আমি বহুবার আইইউটি গিয়েছি। আব্বা বের হওয়ার আগে আম্মা আমাকে ফোন করতেন। তারপর আমি বাসা থেকে এসে আব্বার সাথে যেতাম। আমি তখন উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরের ষোল নম্বর রোডের একটি বাসায় থাকতাম। বাসার নাম ছিল ‘সালামা’।
একবার আম্মা আমাকে ফোন করে বললেন, তাড়াতাড়ি আয়! তোর আব্বা বের হবেন।
আমি দ্রুত চলে এলাম। আব্বাকে সালাম দিলাম। কেমন আছো-ভালো আছি— এরকম কিছু কথা হল। তারপর আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমার সাথে আইইউটি যাবে?
আমি বললাম, জী আব্বা!
তোমার কি সবক নেই?
আমি বললাম, আব্বা পরে করতে পারব। আরিফ ভাইয়া আমাকে আপনার সাথে আইইউটি যেতে বলেছেন। আর বলেছেন, সময়মতো দরস করতে না পারলে পরে কোনো সময় দরস করে নেবে।
আব্বা বললেন, আমার সাথে আইইউটি যাওয়ার তুলনায় তোমার আলিফ-বা-তা পড়ানো আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয়। তোমার আজকে আমার সাথে যেতে হবে না। সবকে যাও।
আমি আবার বলতে গেলাম, আব্বা! আপনার সাথে এখন গেলে তো কোনো অসুবিধা নেই!
এই কথা বলতেই আব্বা অনেক রাগ হয়ে গেলেন।
বললেন, আহ্লাদ কর! আহ্লাদ! যেটা বলছি সেটা কর। মাদরাসায় যাও। সবক পড়াও।
আট. অনেক সময় আম্মা বা ড্রাইভারদের বলে রাখতাম, আব্বা বের হলে বাসা থেকে আমাকে উঠিয়ে নিতে বলবেন। এটা আব্বা খুব অপছন্দ করতেন। আব্বা চাইতেন, আমি যেন খাদেমদের মতো খেদমত করি। আগে থেকে নিজে প্রস্তুত থাকি এবং আব্বাকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করি। কিন্তু আমি এমন না করে বাসা থেকে আমাকে উঠিয়ে নিতে বলতাম বলে আব্বা অনেক কষ্ট পেতেন। অনেকবার বলেছেন, তুমি যে এমন করো আমার অনেক কষ্ট লাগে। তোমাকে বাসা থেকে আমার উঠিয়ে নিতে হয়, তুমি কি খাদেম না মাখদূম?
একবার অনেক বেশি রাগ হয়েছিলেন। সেদিন আব্বার খুব ব্যস্ততা ছিল। রাগ হয়ে আমাকে বলেছিলেন, এটা কোন্ ধরনের আদব! তুমি আমাকে নিয়ে যেতে বলো! তুমি আমার সাথে যাবে, না আমি তোমার সাথে যাব?
আব্বার খেদমতকে অবহেলা করে এমন করতাম— বিষয়টা এমন নয়। মাঝে মাঝে আমার কোনো সমস্যা হলে এরকম হয়ে যেত। বাচ্চারা অনেক বেশি ছোট ছিল, যার কারণে অনেক সময় ঠিকমতো ঘুম হত না। এধরনের কোনো ঝামেলা থাকলে এরকম হয়ে যেত।
নয়. আব্বা গাড়ি থেকে নামার সময় তাঁর সাথে যে খাদেম থাকতেন তাঁর হাতের ওপর ভর করে নামতেন। আমি তো অনেক সময়ই আব্বার সাথে খাদেম হয়ে আইইউটিতে আসা-যাওয়া করতাম। তো কখনো কখনো গাড়ি থেকে নামার সময় আব্বার দিকে খেয়াল না করে অন্যদিকে আমার মনোযোগ চলে যেত। আব্বা অনেক সময়ই বলতেন, আশ্চর্য! কোন্ দিকে তাকিয়ে আছ? এমন খাদেম আমার দরকার নেই।
এখন খুব আফসোস হয়, তখন কেন মনোযোগ দিয়ে, পরিপূর্ণরূপে, সুন্দরভাবে আব্বার খেদমত করিনি!
উম্মে সা‘দ
[হযরতের বড় কন্যা]
এক. আমরা তখন অনেক ছোট ছিলাম। আব্বা ক্লাসের ফাঁকে বাসায় নাস্তা খেতে আসতেন। হাতে খুব অল্প সময় থাকত। আম্মা পানি গরম করে নিয়ে আসতেন। আব্বা গরম পানি প্লেটে ঢেলে, রুটি ছোট ছোট টুকরো করে, গুঁড়া দুধ দিয়ে মেখে নিজেও খেতেন আমাদেরও খাওয়াতেন। এখনো চোখে ভাসছে, আব্বা রুটি টুকরো টুকরো করছেন। গুড়া দুধের ডিব্বা থেকে গুঁড়া দুধ নিচ্ছেন। তারপর গরম পানি ঢেলে সুন্দর করে মাখাচ্ছেন। আবার কখনো ডিম পোচ আর রুটি দিয়ে নাস্তা করতেন। তখনো নিজেও খেতেন, আমাদেরও খাওয়াতেন।
দুই. সূরা ছদের তিন নম্বর পৃষ্ঠা—
اَمْ نَجْعَلُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ كَالْمُفْسِدِيْنَ فِي الْاَرْضِ اَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِيْنَ كَالْفُجَّارِ.
—এই পৃষ্ঠাটা মুখস্থ করতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। কয়েকদিন সময় লেগেছিল। পরে যখন এই পৃষ্ঠাটা মুখস্থ হয়ে গেল, আব্বা অনেক খুশি হলেন। আমি যে মুসহাফ দিয়ে হিফয করতাম সেই মুসহাফের এই পৃষ্ঠায় স্টার চিহ্ন দিয়ে— কত তারিখে, কোন্ মাসে, কোন্ সালে আমি এই পৃষ্ঠা হিফয করেছি— তা লিখে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, এর পুরস্কার হিসেবে আমি তোমাকে প্লেনে চড়াব।
এর বেশ কিছুদিন পর আব্বা আমাকে বললেন, তোমার সাথে প্লেনে চড়ানোর আমার যে ওয়াদা ছিল তা পূরণ করে আসি। চলো, তোমাকে প্লেনে করে চট্টগ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
আমি বললাম, জী না... আব্বা! প্লেনে করে চট্টগ্রাম যাব না; বাইতুল্লাহর সফরেই যাব। তারপর ২০০৬ সালে আব্বা আমাকে হজ্বে নিয়ে এ ওয়াদা পূরণ করলেন।
তিন. আব্বা অনেক অতিথিপরায়ণ ছিলেন। সবাইকে নিয়ে চলতে খুব পছন্দ করতেন। আত্মীয়-স্বজনের খুব খোঁজখবর রাখতেন। দুই হাত ভরে মেহমানদের জন্য প্রচুর খরচ করতেন। উলামায়ে কেরামকে বাসায় আনতেন। তাই আমাদের বাসায় অধিকাংশ সময়ই মেহমান দিয়ে ভরা থাকত। আব্বা সব সময়ই অন্যের জন্য ভালোটা রেখে নিজে কষ্ট করতেন। নিজের ঘর বিছানা সব ছেড়ে ড্রয়িং রুমে এমনকি রান্নাঘরেও বহুবার ঘুমিয়েছেন। কখনো কোনোরকম অভিযোগ, কোনোরূপ কষ্ট প্রকাশ করতেন না। অনেক সময়ই এমন হয়েছে যে, আব্বা তাহাজ্জুদ পড়তে উঠেছেন, কিন্তু কোথাও জায়গা নেই। একমাত্র রান্নাঘর খালি আছে। ওইখানে গিয়ে তাহাজ্জুদ পড়তেন। ইবাদত-বন্দেগী করতেন। মুতালাআ করতেন।
وَ ابْتَغِ فِيْمَاۤ اٰتٰىكَ اللهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ.
[আল্লাহ তাআলা তোমাকে যা দিয়েছেন, যতটুকু দিয়েছেন, তা দিয়ে আখেরাত তালাশ করো। —সূরা কাসাস (২৮) : ৭৭]
—এই আয়াতের ওপর পরিপূর্ণরূপে আমল করতেন।
‘আমার একটা খালি রুম লাগবে, নিরিবিলি জায়গা লাগবে, না হলে আমি ইবাদত-বন্দেগী করতে পারব না’— আব্বা একদমই এরকম স্বাভাবের ছিলেন না। নিরিবিলি খালিঘর পাওয়ার আশায় ইবাদত-বন্দেগী কখনোই ছেড়ে দিতেন না। যখন যেভাবে পারতেন সেভাবেই, যতটুকু পারতেন ততটুকুই আমল করতেন। যখন যে হালতে থাকতেন সে হালতেই আপন গতিতে নিজের কাজ চালিয়ে নিতেন।
চার. আব্বা তো সব সময়ই খুব খেয়াল রাখতেন, যাতে অন্যদের কষ্ট না হয়। অন্যদের আরামের ব্যাঘাত না ঘটে। তাহাজ্জুদ পড়তে যখন উঠতেন, তখনো খুব খেয়াল রাখতেন।
আব্বা খুব চাইতেন, ঘরের লোকেরাও যেন তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠে। শেষরাতে উঠে আল্লাহ তাআলার কাছে কান্নাকাটি করতেন। সাধারণত এটা নিয়ে মুখে কিছু বলতেন না। বাকি ঘুমন্ত ব্যক্তিদের সরাসরি না জাগিয়ে এমন কিছু করতেন, যাতে তাঁরা বুঝতে পারে যে, তাহাজ্জুদের সময় হয়েছে। উত্তরার ৫৪ নম্বর বাসায় আব্বা খাবার ঘরে গিয়ে তাহাজ্জুদ পড়তেন। ঘরের পর্দা সরিয়ে সোফার ওপর রেখে দিতেন, যাতে খাবার ঘরের আলো আব্বার ঘরে হালকাভাবে যাওয়ায় ভেতরের মানুষ বুঝতে পারে, তাহাজ্জুদের সময় হয়েছে। এবং তাঁরাও উঠে কিছু ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে।
পাঁচ. আব্বা অনেক ইহতিমামের সাথে তাহাজ্জুদের সময় উঠতেন। শারীরিক অসুস্থতা, দুর্বলতা বা সফরের ক্লান্তির কারণে কখনো যদি সময়মতো উঠতে না পারতেন, তাহলে শোয়া থেকে উঠে পা দুটো নিচের দিকে ঝুলিয়ে বিছানার ওপর বসে থাকতেন। কিছুক্ষণ দুআ ইস্তেগফার করে আবার শুয়ে পড়তেন।
تَتَجَافٰي جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّ طَمَعًا.
[(রাতে) মুমিনদের পার্শ্ব বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় এমতাবস্থায় যে, তাঁরা ভয় আর আশা নিয়ে তাঁদের প্রতিপালককে ডাকতে থাকেন।) —সূরা সিজদাহ (৩২) : ১৬
এই আয়াতের ওপর আব্বা পরিপূর্ণরূপে আমল করতেন।
আমি এক বইয়ে পড়েছি। বি. বাড়িয়ায় অনেক বড় একজন আল্লাহওয়ালা ছিলেন। তার টাইফয়েড হয়ে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না। কিন্তু খাদেম সাহেবকে তাহাজ্জুদের সময় আ্যলার্ম দিয়ে রাখতে বলতেন। তাহাজ্জুদের সময় তিনি খুব জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকতেন। উনি সুস্থ হয়ে উঠলে খাদেম সাহেব ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর আপনি এমন করতেন কেন? তখন ওই বুজুর্গ বললেন, আমি তো ওই সময় আল্লাহ তাআলার সামনে থাকতাম। আল্লাহ তাআলার সামনে তো খুব জড়সড়ো হয়ে থাকতে হয়।
আব্বাও ঠিক এরকমভাবে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠতে না পারলে শোয়া থেকে উঠে বসতেন, কিছুক্ষণ দুআ-ইস্তেগফার করে আবার শুয়ে পড়তেন।
উম্মে আম্মার
[হযরতের ছোট কন্যা]
এক. আমার ছোট মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। আব্বা-আম্মা তখন হজ্বের সফরে ছিলেন। তাঁরা দূরে থাকায় খুব মন খারাপ ছিল। আম্মাকে এ সময় কাছে পেতে আমার মন ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। মাওলার দরবারে যারপরনাই রোনাযারি করতে থাকলাম; কিন্তু আমার আশা আশাই রয়ে গেল, তা আর বাস্তব হল না।
সময় ঘনিয়ে এল। আমরা হাসপাতালে চলে গেলাম। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগ দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ আব্বা চলে এলেন। প্লেন থেকে নামতে গিয়ে আম্মা পায়ে ব্যথা পেলেন, তাই তিনি আর আসতে পারলেন না। দুঃখ-কষ্টে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার ছোট্ট মন। অঝোরে অশ্রুধারা বইয়ে দিল আমার দুই নয়ন।
আব্বা বললেন—
اَلَيْسَ اللهُ بِكَافٍ عَبْدَهٗ .
আল্লাহ্ই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নন? —সূরা যুমার (৩৯) : ৩৬
আব্বার এই কথা শুনে আমার কান্না একদম উধাও হয়ে গেল। সবরকম ভয়-ভীতি কেটে গিয়ে আমার হৃদয়ে জেগে উঠল অন্যরকম এক সাহস আর শক্তি।
অপারেশন শেষে আমি যখন কেবিনে এলাম। আব্বা বললেন, তুমি তো অনেক দুআ করেছ, যাতে তোমার আম্মা ফিরে আসেন। কিন্তু আম্মা যাতে সুস্থতার সাথে ফিরে আসেন এই দুআ করনি। তাই তোমার আম্মা ফিরে এসেছেন ঠিকই; কিন্তু অসুস্থ হয়ে।
আমি চিন্তা করে দেখলাম, তাই তো, আমি তো অনেক দুআ করেছি, যাতে আম্মা ফিরে আসেন। কিন্তু আম্মা যাতে সুস্থতার সাথে ফিরে আসেন— এই দুআ তো করিনি।
اَلَيْسَ اللهُ بِكَافٍ عَبْدَهٗ .
আয়াতের অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?!
আব্বা আমাকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, আম্মা আসেননি তো কী হয়েছে! আল্লাহ পাকই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এমনিভাবে সকলের জন্যই সমস্ত অবস্থায় একমাত্র আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।
দুই. একবার আমি শামি কাবাব বানিয়েছিলাম। আমরা গরুর গোশত ছোট ছোট টুকরো করে বুটের ডালের সাথে সেদ্ধ করে পাটায় বেটে শামি কাবাব বানিয়ে থাকি। তো আমি কাবাব বানানোর সময় সূরা ইউসুফ পড়ছিলাম। তারপর কাবাব ভেজে আব্বাকে দিলাম।
আব্বা খেতে খেতে বললেন, তুমি কি এটা বানানোর সময় যিকির করেছিলে?
তখন আমি বললাম, জী আব্বা, সূরা ইউসুফ পড়েছিলাম।
আব্বা বললেন, এজন্যই তো এত মজা হয়েছে।
সুবহানাল্লাহ! কত তাকওয়া ও ত্বহারাত ছিল তাঁর যে, আগে থেকে না জেনেও উপলব্ধি করতে পেরেছেন! তাকওয়া-ত্বহারাত ও কুরআনের প্রতি কতটা মহব্বত থাকলে মানুষ এমন আন্দায করতে পারে!
তিন. আব্বা প্রতি বুধবার ছেলের ঘরের এবং মেয়ের ঘরের সকল নাতনিদের পড়াতেন। এক বুধবার দুই নাতনি তাঁকে শোয়া থেকে উঠাচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, তোমরা খুব বেশি বেশি এই দুআ করবে যে, আল্লাহ! আমাদের নেক সঙ্গী মিলিয়ে দিন। আর ছেলেদেরকে এই দুআ করতে বলবে যে, আল্লাহ! নেক সঙ্গিনী মিলিয়ে দিন।
চার. আব্বা বলেন, একবার হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আমাকে বললেন, আপনি কি আমার কাছে কিছু চান?
আমি বললাম, জী হুজুর! তিনটি দুআ চাই। প্রথমটি হল, আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে কুরআন কারীমের মহব্বত ও লয্যত দান করেন এবং তা বোঝার যোগ্যতা দেন...।
দুটি দুআ কবুল হয়েছে। আরেকটা বাকি আছে। যে দুটি দুআ কবুল হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হল প্রথম দুআ। (অর্থাৎ কুরআন কারীম বোঝার দুআ।)
আরেকটির কথাও আব্বা বলেছিলেন; কিন্তু আমি ভুলে গেছি। আর আব্বা যে দুআটির কথা বলেছিলেন— বাকি আছে— সেটা বলেননি।
পাঁচ. একবার আব্বা সূরা হা-মীম সাজদার প্রথম পৃষ্ঠার নয় নম্বর আয়াত থেকে এক নম্বর আয়াত পর্যন্ত পুরো উল্টো ভাবে অর্থসহ পড়লেন। প্রথমে নয় নম্বর আয়াত, এরপর আট নাম্বার, এরপর সাত.. এভাবে এক নম্বর আয়াত পর্যন্ত পুরো উল্টোভাবে অর্থসহ পড়লেন।
তখন আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা আপনি কি হাফেয? তিনি বললেন, না মানিক! কিছু কিছু জায়গা মুখস্থ পারি। আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে আপনি কীভাবে এমন করে পড়লেন?
পুরো বিষয়টাই ছিল অবাক হওয়ার মতো।
(স্পষ্ট যে, এটা কেবলমাত্র হিফযের অনুশীলনের জন্য। তিলাওয়াত তো স্বাভাবিক নিয়মে করা জরুরি।)
ছয়. একবার আমরা আব্বার সাথে উত্তরা থেকে আজিমপুর যাচ্ছিলাম। গাড়িতে আমি ও আমার বাচ্চারা ছিল। আব্বা গাড়িতে বসে সূরা ইয়াসীন পড়তে লাগলেন।
একবার পড়ে বললেন, এটা আমার আব্বার জন্য।
আরেকবার পড়ে বললেন, এটা আমার আম্মার জন্য।
আবার পড়ে বললেন, এটা থানভী রাহ.-এর জন্য।
এরপর পড়ে বললেন, এটা হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জন্য।
এভাবে করে আব্বা ছয়-সাতবার একেক বার একেকজনের জন্য পুরো পথ সূরা ইয়াসীন পড়তে থাকলেন।
সাত. আব্বা ভেতরে ভেতরে ছোটখাটো অনেক নেক আমল করতেন। আমরা বাহ্যিকভাবে বুঝতে পারতাম না। কারণ সাধারণত সেগুলোকে আমরা তেমন একটা গুরুত্ব দেই না। যেমন গরিবদের সম্মান করা। তাদের সহযোগিতা করা। আব্বা তাদের সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করতেন না। তাদের সাথে ভালো আচরণ করার এবং তাদেরকে কাছে টেনে নেওয়ার প্রতি খুব ইহতিমাম করতেন। একদিন আমরা গাড়ি করে কোথাও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আব্বা বললেন, গাড়ি থামাও। তারপর দেখলাম, আব্বা একজন অন্ধ মানুষকে রাস্তা পার করিয়ে দিলেন।
রাস্তার মধ্যে কলার ছিলকা পড়া দেখলে সরিয়ে দিয়ে আসতেন।
আট. একদিন দুপুরে আব্বা অফিস করে বাসায় আসলেন। দুপুরের খাবার শুধু ডাল-ভাত। আব্বা খাবার মুখে দিয়েই ছন্দে ছন্দে বলে উঠলেন, কী মজা, তোমার আম্মু কী যেন দেয়নি।
মানে লবণ হয়নি। খাবার-দাবার নিয়ে কখনো রাগারাগি করতেন না। কেন খাবারে লবণ হয়নি? এরকম প্রশ্ন কখনো করতেন না। হাসতে হাসতে বলতেন, কী মজা, তোমার আম্মু কী যেন দেয়নি।
নয়. একবার রিকশায় আব্বা বুয়েটের বাসায় এলেন। আব্বার কাছে তখন ভাংতি ছিল না। তাই আব্বা ভাংতির জন্য বাসায় ঢুকলেন। রিকশাওয়ালা বাইরে বসে ছিলেন। বাসায় ঢুকে আব্বা রিকশাওয়ালার কথা ভুলে গেলেন। আব্বা যখন যোহরের নামায পড়ার জন্য বাইরে গেলেন তখন আব্বার মনে পড়ল। আব্বার তখন সে কী আফসোস! কপাল চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে বারবার বলছিলেন, আহ, আফসোস! কেন আমার মনে পড়ল না? আহ, আফসোস! কেন আমার মনে পড়ল না? কেন তোমরা আমাকে মনে করিয়ে দিলে না?
আমরা বললাম, আব্বা! আমরা তো জানিই না।
আমরা পরে বহুবার দেখেছি যে, আব্বা রিকশাওয়ালাদেরকে নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে বেশি দিতেন। আমার মনে হয়, আব্বা যে ওই রিকশাওয়ালাকে দিতে পারেননি। সেই আফসোসেই রিকশাওয়ালাদের ভাড়া বেশি দিতেন।
তার পরও প্রায়ই বলতেন, আহ আমি কী করেছিলাম। ওই বুড়ো মানুষটা কতক্ষণ বসে ছিল! কেন এমন হয়ে গেল!
দশ. আমরা যদি কখনো আব্বার সামনে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতাম তখন আব্বা মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকতেন। আমাদের সাথে যোগও দিতেন না, কোনো মন্তব্যও করতেন না। না শোনার ভাব করে থাকতেন।
এগারো. আমার বুঝ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মনে পড়া একটা ঘটনা হল, আমি আব্বাকে ছোটবেলায় অনেকবার ওযু করিয়ে দিয়েছি। মনে পড়ে, বুঝ হওয়ার পর থেকেই আব্বাকে আমি একটা বদনা দিয়ে ওযু করিয়ে দিতাম।
আমাদের বাসায় একটা সবুজ রঙের বোল ছিল, আব্বা ওযু করার আগে ওই বোল দিয়ে বাথরুমের প্যান ঢেকে দিতেন। আব্বার ওযুর একটা ছোট চৌকি ছিল। ওযু করার জন্য সেটায় বসতেন আর আমি বদনা দিয়ে আব্বাকে পানি ঢেলে দিতাম। আব্বা অনেক যত্নের সাথে ওযু করতেন। সবগুলো অঙ্গ ভালোভাবে ঘষে ঘষে ধুতেন। ওযুর আগে খুব ইহতিমামের সাথে মিসওয়াক করতেন।
বারো. আমি, আমার বড় বোন ও ছোট ভাই— আমরা তিনজন মিলে আব্বার পা টিপতাম। আর আব্বা দুআ করতেন— আয় আল্লাহ! আমার মানিককে ঈমান দেন। ‘ঈমানান কামিলা’ দেন। ‘ইয়াকীনান সাদিকা’ দেন। ‘লিসানান যাকিরা’ দেন। ‘কলবান খশিআ’ দেন। ‘ইলমান নাফিআ’ দেন। ‘আমালাম মুতাকব্বালা’ দেন। ‘রিযকান ওয়াসিআ’ দেন। ‘আলফাওযা বিলজান্নাহ’ দেন। ‘আননাজাতা মিনান নার’ দেন।
তেরো. আব্বার সাথে রিকশায় করে মাদরাসায় আসা-যাওয়া করতাম। আব্বা তো কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেনই, পাশাপাশি প্রায়ই এই দুআগুলো পড়তেন—
اَللّهُمَّ اجْعَلْنِيْ فِيْ عَيْنِيْ صَغِيْرًا، وَفِيْ أَعْيُنِ النَّاسِ كَبِيرًا.
إِلَيْكَ رَبِّيْ فَحَبِّبْنِيْ، وَفِيْ نَفْسِيْ لَكَ فَذَلِّلْنِي.
এই দুআগুলোসহ এ ধরনের ছোটখাট আরো যত দুআ আছে সেসব দুআ আব্বার মুখ থেকে এত শুনেছি এত শুনেছি যে, ওই সময়ই আব্বার সাথে আসা-যাওয়া করতে করতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
চৌদ্দ. এত ছোট থেকেই আব্বা আমাদের ওযু করিয়ে দিতেন যে, আমরা বেসিনের নাগাল পেতাম না। তখন আব্বা বালতি উল্টো করে বালতির ওপর আমাদের দাঁড় করিয়ে মধ্যমা আঙুল দিয়ে মিসওয়াক করাতেন। ওযু করাতেন। তারপর বিছানায় দাঁড় করিয়ে তোয়ালে দিয়ে আমাদেরকে পেঁচিয়ে দিয়ে আদর করে বলতেন, ‘পোটা পোটা বানিয়ে দিলাম’ অর্থাৎ পোটলা বানিয়ে দিলাম।
পনেরো. আমার জীবনে দুইবার শীতের সময় রমযান হয়েছিল। আব্বা আমাদেরকে সেহরী খাওয়ার জন্য ওঠাতেন। শীতের মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হবে দেখে আব্বা আমাদেরকে পিঠে করে খাওয়ার ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। প্রথমে একজনকে নিয়ে যেতেন, তারপর এসে আরেকজনকে। এভাবে আব্বা আমাদেরকে সেহরী খাওয়ার জন্য ওঠাতেনও। পাশাপাশি আমাদের কষ্ট যেন না হয় সেদিকেও পরিপূর্ণ খেয়াল রাখতেন।
ষোলো. আব্বার একটি বড় গুণ ছিল, আব্বা নিজে একা নামায-রোযা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না। বরং আমাদের নামায-রোযার ব্যাপারেও খুব খবরা-খবর রাখতেন। শুধু ছোটবেলায় না। বড় হওয়ার পরেও। এমনকি বিবাহের পরেও। নামাযের জন্য সব সময় ডাক দিতেন। কখনো এরকম মনে করতেন না যে, এখন ওরা বালেগ হয়ে গেছে। এখন নামায ঠিকমতো আদায় করা ওদের দায়িত্ব। আমার আর দায়িত্ব নেই। আমি করব কেন? কোনোদিন এমন করেননি। যতদিন সাধ্যে ছিল, শরীরে কুলিয়েছে, রুমে রুমে গিয়ে গিয়ে নামাযের জন্য ডেকে আসতেন।
সতেরো. শুধু নামায-রোযাই না, যাবতীয় সব বিষয়ে আব্বা আমাদের খবরা-খবর রাখতেন। রিকশা দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় প্রতিদিন আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করতেন, কোন্ উস্তাযের কাছে আজকে পড়া দেবে? কী পড়া দেবে?
মাদরাসায় আজ কী কী পড়ানো হয়েছে? কোন্ হুজুর তোমাকে আদর করেছেন? এগুলো সব সময় জিজ্ঞেস করতেন।
আঠারো. আব্বা পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন চাপ দিতেন না। কিন্তু দরসে উপস্থিতির প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, ছুটি হয়ে যাক, তার পরও মাদরাসায় যেতে হবে। যাবে-আসবে এতেই তোমার বরকত হবে ইনশাআল্লাহ। সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে না।
অনেক সময় আমাদের মাদরাসায় নিয়ে যেতে আব্বার দেরি হয়ে যেত। কিন্তু অল্প একটু সময়ের জন্য হলেও আব্বা আমাদের মাদরাসায় নিয়ে যেতেন। বেশি দেরি হয়ে গেলে আমাদের যেতে ইচ্ছা করত না। ভয়ে আমরা কিছু কলতে পারতাম না; কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকত। এরকমও হয়েছে যে, আমরা মাদরাসায় গিয়ে দেখি, ছুটি হয়ে গেছে। এখন সবাই রেহাল উঠাচ্ছে। লজ্জায় আমরা কেঁদে ফেলতাম। আর আব্বা বলতেন, তুমি যে কষ্ট করে এসেছ, আল্লাহকে খুশি করার জন্য এসেছ, সেজন্য আল্লাহ খুশি হয়েছেন, ল্যাংড়া শয়তান খুশি হতে পারেনি।
উনিশ. একবার কোনো এক বিষয় নিয়ে আমার খুব মন খারাপ ছিল। আব্বা সেই বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আমার সে কী কান্না! আমার কান্না দেখে আব্বা বললেন, তুমি কি দুনিয়াতেই সব পেতে চাও? আখেরাতের জন্য কি কিছু রাখবে না? তাহলে তুমি এত তিলাওয়াত কী জন্য শোনো? সাহাবীদের জীবনী কী জন্য পড়ো? আখেরাতেও তো কিছু পাওয়ার আছে, তাই না!
আব্বার এই কথা আমার মনে ভীষণভাবে দাগ কাটল। সাথে সাথে আমার কান্না বন্ধ হয়ে গেল।
ক্যাসেট প্লেয়ারে আমরা অনেক তিলাওয়াত শুনতাম। আব্বা সেদিকে ইশারা করে বলেছিলেন, তাহলে তুমি এত তিলাওয়াত কী জন্য শোনো?
বিশ. একদিন দুপুরে আমি আব্বার ঘরে আব্বাকে খাবার খাওয়াচ্ছিলাম। আমার ছোট ছেলে স্মার্টফোন নিয়ে এসে আব্বার সামনেই আমাকে দিল। আব্বা দেখে ফেললেন। খুব রাগ হয়ে গেলেন। আমাকে বকা দিয়ে বললেন, জানো, এটা কী? এটা বিষ! বিষের চেয়েও খারাপ! ওর সর্বনাশ করছ!
উম্মে সুহাইল
[হযরতের বড় বৌমা]
এক. পড়াশোনায় যেন বাচ্চাদের কোনো ধরনের বিরক্তিবোধ না আসে, যেন আনন্দের সাথে নিজেরাই উৎসাহী হয়ে পড়াশোনা করতে পারে, কোনো বকাঝকা যেন তাদের করতে না হয়, বিষয়গুলোর প্রতি বাবা বিশেষভাবে লক্ষ রাখতেন। প্রতিদিন এক জায়গায় পড়াশোনা করতে বাচ্চাদের হয়তো ভালো লাগবে না, সেজন্য তাদেরকে জায়গা পরিবর্তন করিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে পড়াতেন। কখনো কোচিংহোম ধানমন্ডি, কখনো বুয়েট, কখনো আইইউটি, কখনো বোর্ডবাজার, কখনো আবার আজিমপুর। প্রতিদিন একটা কলম আর একটা খাতা কিনে দিতেন। যে পড়া একদিন পড়াতেন দ্বিতীয় দিন আর সে পড়া পড়াতেন না। নতুন কিছু পড়াতেন। বোর্ডে লিখে লিখে ছন্দে ছন্দে পড়াতেন। এসব কারণে বাচ্চারা খুব আনন্দ পেত। নিজেরাই উৎসাহী হয়ে পড়াশোনা করত। এত আনন্দ-উৎসাহ পেয়ে পড়াশোনা করতে তারা একটুও বিরক্তিবোধ করত না। যেন খেলতে খেলতেই অনেক কিছু শিখে ফেলত!
দুই. আমার বড় মেয়ে উম্মে ইসমাঈল তার দাদার দেওয়া প্রথম খাতায় তাঁর দেওয়া কলম দিয়ে ‘নুন’ লিখে ভরিয়ে ফেলল। নুনের নুকতাটা নুনের চেয়ে বেশ বড় ছিল। বাবা দেখে খুব হাসলেন এবং অনেক খুশি হলেন।
তিন. বাবা উত্তরায় পাঁচ নম্বর সেক্টরে একটি গ্যারেজ ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে বাবা আমাকে পড়ানোর জন্য নিয়ে যেতেন। একবারের কথা মনে পড়ে, বাবা আমাকে সূরা শু‘আরার
وَ اِنَّهٗ لَتَنْزِيْلُ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْاَمِيْنُ.
—এখান থেকে বাচ্চাদেরকে বানান করে পড়াতে বললেন। আমি বাচ্চাদের বানান করে পড়ানোর পর ছোট চাচ্চুর ছোট মেয়ে বলল, আজকে ভাবির কাছ থেকে বানান করে পড়া শিখলাম।
চার. বাবার একটি মাইক্রোবাস ছিল। গাড়ির সামনে লেখা ছিল ‘মুহাম্মাদিয়া মাখযানুল উলুম মাদরাসা’। যখনই সুযোগ পেতেন, প্রিয় মানুষদের বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিজের গাড়িতে করে আজিমপুর, কোচিংহোমসহ আরো বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। অনেক সময় ওস্তাদজী হিসেবে আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন।
পাঁচ. ঘরের প্রতিটি সদস্য যেন ইবাদত-বন্দেগী সুন্দরভাবে আদায় করতে পারে— সেদিকে তিনি খুব খেয়াল রাখতেন। ফজরের সময় বাসার সবাইকে জাগিয়ে মসজিদে যেতেন। প্রতিটি ঘরের দরজায় গিয়ে আওয়াজ করতেই থাকতেন। ঘরে যারা থাকতেন তাঁদের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে যতক্ষণ পর্যন্ত ভেতর থেকে জাগ্রত হওয়ার সাড়া না পেতেন, আওয়াজ করতেই থাকতেন। নামায পড়ে খুব দ্রুত বাসায় এসে ছোট বাচ্চাদের আগলে রাখতেন, যেন তাদের মায়েরা ইতমিনানের সাথে নামায আদায় করতে পারে। রমযানে তারাবী পড়ে বাসায় এসে বাচ্চাদের ধরতেন। যাতে হাফেযা মায়েরা তারাবীতে খতম করতে পারে।
একদিন আমি ফজর নামায পড়ছিলাম। তখন আমার ছেলে খুব কান্নাকাটি করছিল। বাবা এসে তাকে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মানিক তুমি কী খাবে?
সে বলেছিল, রুটি খাব।
বাবা নিজে ড্রাইভ করে তাকে নিয়ে রুটির খোঁজে বের হলেন। বহু জায়গায় খুঁজলেন, কিন্তু রুটি পেলেন না। এক জায়গায় কলা পেলেন। কলা নিয়ে আমার কাছে এসে বললেন, তোমার মানিক রুটি খেতে চেয়েছিল। অনেক খুঁজেছি, কিন্তু রুটি পাইনি। এক জায়গায় কলা পেয়েছিলাম। তাই কলা নিয়ে এসেছি। এখন কলা খাক। ইনশাআল্লাহ, পরে রুটি এনে দিব।
এরপর দশটা-এগারোটার দিকে আবার রুটি নিয়ে এলেন। এভাবেই তিনি পরিবারের সকলকে আগলে রাখতেন।
ছয়. বাবা শ্বশুর হিসেবে অনেক মিষ্টি ছিলেন। খোলামেলা মন নিয়ে থাকতেন। হাসি মজা করতেন। কিন্তু অনর্থক আজেবাজে কথা বলতেন না। আবার গম্ভীর হয়ে বা ভাব নিয়ে থাকতেন না। মাটির মানুষ হয়ে থাকতেন।
একবারের ঘটনা। তখন আমার বড় মেয়ে উম্মে ইসমাইল আমার কাছে হিফয পড়ত। বাবা আমাদের নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। আমাকে বাচ্চাদের নিয়ে পেছনের সিটে বসিয়ে নিজে সামনের সিটে বসলেন। গাড়িতে আমি আমার বড় মেয়ের সাতসবক শুনছিলাম। ও সূরা হুজুরাতের—
لَا تَنَابَزُوْا بِالْاَلْقَابِ.
—এই আয়াতটি পড়লে বাবা আমাকে বললেন, এই আয়াতের অর্থ বলো। আমি অর্থ বললাম, ‘তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধিতে, কষ্টদায়ক উপাধিতে ডেকো না।’
বাবা বললেন, কষ্টদায়ক উপাধি, মন্দ উপাধি মানে কী?
এরপর বউ-শাশুড়ির ঝগড়ার সময় যেসমস্ত কষ্টদায়ক উপাধি বলে বলে একে অপরকে ডাকে, নিজেই হাসতে হাসতে সেগুলোর কয়েকটি দিয়ে উদাহরণ দিলেন— ‘নবাবের ঝি হয়া গেসে!’ ‘লাট সাহেবের মাইয়া নাকি!’— এধরনের আরো কিছু শব্দ বললেন।
তখন আমার সাথে আমার বড় ছেলে ছিল। বাবা বললেন, যখন তুমি মুসআবের (সুহাইল) বউ আনবে তখন দেখা যাবে, তুমি কেমন শাশুড়ি?
আমি বললাম, বাবা! তাহলে কি আমি এখন বউ হিসেবে পাশ?
আমার এই কথা শুনে বাবা অনেক জোরে সন্তোষমূলক হাসি হাসলেন।
উম্মে আহমাদ
[হযরতের সেজো বৌমা]
এক. আমার বড় ছেলে আহমাদ। সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় অনেক চেষ্টা করেও নরমাল করা যায়নি। শেষমেষ সিজার করতে হয়। আমার মেজো ছেলেও সিজারে হয়। ওই সময় আমার মন খুব খারাপ ছিল। হাসপাতালে থাকতেই (শ্বশুর) আব্বা আমার দিকে ইশারা করে শাশুড়িকে বললেন, এ যুগের মুজাহিদদের দেখো, তারা পেট কেটে মা হচ্ছে। আব্বার এই কথা শুনে আমার মনের সব দুঃখ চলে যায়। অনেক সান্ত্বনা লাভ করি।
দুই. আব্বাকে আমি বেশ কয়েকবার বলেছিলাম, আব্বা আমাকে কিছু নসীহত করুন। প্রতিবারই আব্বা আমাকে একটিই নসীহত করেছেন। আব্বা বলেন, হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আমাকে বলতেন, হামীদুর রহমান সাহেব! তৈয়ারি করেন, তৈয়ারি করেন, কবরের ঘাঁটি কঠিন ঘাঁটি। আব্বা আমাকে বলতেন, আমিও তোমাকে এই নসীহতই করছি।
তিন. আব্বার অনেক প্রয়োজনীয় একটি ডায়েরি ছিল। ওই ডায়েরিতে আব্বা নিজের সমস্ত প্রোগ্রাম লিখে রাখতেন। একদিন আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি, আব্বা অনেক পেরেশান হয়ে আমার ঘর থেকে বের হচ্ছেন। মনে হচ্ছিল খুব জরুরি কিছু একটা খুঁজছেন?
আমি বললাম, আব্বা কী হয়েছে? আপনি এত পেরেশান কেন?
আব্বা বললেন, আমি আমার খুব জরুরি একটা ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছি। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি বললাম, আব্বা ডায়েরিটা কী রংয়ের ছিল?
আব্বা বললেন, লাল লাল, খয়েরি খয়েরি রংয়ের।
আমি বললাম, আব্বা! আমার মনে হচ্ছে, আমি কোথাও না কোথাও এই রংয়ের একটি ডায়েরি দেখেছি।
আব্বা বললেন, তুমি কোত্থেকে দেখবে মা! আমি তো এই ডায়েরিটা হারিয়েই ফেলেছি।
এরমধ্যেই আমার মনে পড়ল, আমি দাদুর ঘরের টেবিলে এ রংয়ের একটি ডায়েরি দেখেছিলাম। দৌড়ে দাদুর ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা এনে আব্বার হাতে দিলাম। আব্বা ডায়েরিটা পেয়ে খুব খুশি হলেন।
আমাকে বললেন, মা! তুমি এটা কীভাবে পেলে? আল্লাহ তোমার সব নেক আশা পুরা করেন।
আমি বললাম, আব্বা দুআ করেন, যাতে আমার আব্বা-আম্মা আগামী বছর হজ্বে যেতে পারেন।
আব্বা বললেন, আল্লাহুম্মা আমীন।
আলহামদু লিল্লাহ, আব্বার এই দুআর বরকতে আল্লাহর রহমতে ঠিক পরের বছর আমার আব্বা-আম্মা হজ্বে গেলেন।
সুহাইল বিন রিজওয়ানুর রহমান
এক. দাদাভাই মনেপ্রাণে চাইতেন আমরা যেন দ্বীনদার হতে পারি। দ্বীনের ওপর অটল অবিচল থাকতে পারি। দ্বীনদার হতে পারাকে সবচেয়ে বড় সফলতা মনে করতে পারি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া ওয়া তাআলাকে খুব ভালোভাবে চিনতে পারি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালবাসতে পারি। কালামুল্লাহ শরীফের হিফয করার তাওফীক হওয়াকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, কুরআন কারীমকে সুন্দর থেকে সুন্দর করে তিলাওয়াত করতে পারাকে সবচেয়ে দামী বিষয়, ইলমে দ্বীন অর্জন করতে পারাকে জীবনের একমাত্র অর্জনের বিষয়, দ্বীনের বুঝ লাভ করাকে জীবনের একমাত্র কামিয়াবীর বিষয় মনে করতে পারি। জাগতিক শিক্ষার প্রতি মনোযোগী না হয়ে দূরদর্শিতার সাথে, একনিষ্ঠভাবে, একাগ্রচিত্তে, মনোযোগী আর অনুরাগী হয়ে ইলমে দ্বীনের শিক্ষা আঁকড়ে ধরতে পারি— এসবের জন্য দাদাভাই ছিলেন সদা সর্বদা ফিকিরমানদ, চিন্তিত ও পেরেশান।
এ জন্য শেষ রাতে মাওলার দরবারে রোনাজারি করতেন। তাহাজ্জুদ পড়ে রবের দরবারে ভিখারির মতো অশ্রু ঝরাতেন। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়াতেন। সাহাবা-তাবেয়ীনের ঘটনাবলি শোনাতেন। তালীম করতেন বড়দের গল্প ও কথা। আমাদের বহুভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিতেন। আয়োজন করতেন পুরস্কার বিতরণীর। হাদিয়া-তোহফা দিয়ে আমাদের ভরে রাখতেন।
দূর-দূরান্তের সফরে নিয়ে গেছেন বহুবার। সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন আল্লাহওয়ালা বুযুর্গানে দ্বীনের দরবারে। হারিয়ে যেন না যাই তাই রাখতেন নিজ পাখার ছায়ায়। সামান্য ভালো কিছু করলে তার প্রশংসা করতেন বহুভাবে। মেহনত-মুজাহাদা যত ছোটই হোক না কেন, মূল্য দিতেন অনেক বড় করে। বকা-ঝকা করতেন খুবই কম। আদর-সোহাগ দিতেন অনেক বেশি। অন্যায় করলে অবশ্যই বিচার করতেন। সেটাও ছিল বড় মধুর। অন্যায়ের ক্ষেত্রে তাঁর শাস্তিরও ছিল বিভিন্ন প্রকার। ব্যক্তিবিশেষ তাঁর সাজাও ছিল নানা রকম।
আমাদের যেন লোভ-লালসা পেয়ে না বসে সেজন্য তাঁর কৌশল ছিল বিভিন্ন রকমের। কোনো বাসায় নিয়ে গেলে আগেই পেট ভরে খাইয়ে নিতেন। যাতে সেখানকার রকমারি খাবার দেখেও খাবারের প্রতি সামান্যতম আগ্রহ না জাগে।
দুই. আমার সাথে দাদাভাইয়ের অধিকাংশ স্মৃতি কুরআন কেন্দ্রিক। কুরআন কারীমের তিলাওয়াত শোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও শওক উপলব্ধি করা যাবে সামনের ঘটনাগুলো থেকে। সুযোগ ও অবসর পেলেই তিনি অন্যদের থেকে, বিশেষ করে নাতি-নাতনিদের থেকে তিলাওয়াত শুনতেন। সফরে-হযরে সুযোগ পেলেই তিলাওয়াত শুনতেন। এমনকি বাইরে বেড়াতে গিয়ে একবারে তিন পাড়া শোনার ঘটনাও আছে।
কখনো আবার কুরআনের তরজমা নিয়েও মুযাকারা করতেন আমাদের সাথে। আমাদেরকেও তরজমা জিজ্ঞেস করতেন।
আমি তখন হেদায়াতুন্নাহু জামাতে পড়ি। দাদাভাইয়ের সাথে নিমতলী থেকে সম্ভবত বুয়েটে যাচ্ছিলাম। নিমতলী পেট্রোলপাম্পের কাছে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তাই দাদাভাই আমাকে নিয়ে রিকশায় রওয়ানা হন। সুযোগ পেয়ে দাদাভাইকে বলি, দাদাভাই! আমাকে কিছু নসীহত করুন।
দাদাভাই আমাকে দুটি নসীহত করলেন,
ক. হাফেয সাহেব মানুষ, চলতে ফিরতে উঠতে বসতে সর্বাবস্থায় কুরআন কারীমের তিলাওয়াত করতে থাকবে।
খ.
وَ ابْتَغِ فِيْمَاۤ اٰتٰىكَ اللهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা দিয়েছেন, যতটুকু দিয়েছেন তা দিয়ে আখেরাত তালাশ করবে। [সূরা কাসাস (২৮) : ৭৭]
মাসখানেক পর আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি ভরা মজলিসে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করছি। আমার অনেক ভুল হচ্ছে। ভুলের কারণে আমি পড়তেই পারছি না। অনেক পেরেশান হলাম। বুঝতে পারলাম, দাদাভাইয়ের নসীহত অনুযায়ী আমি চলছি না। কুরআন কারীমের তিলাওয়াত ঠিকমতো হচ্ছে না।
তিন. আমাদের শ্যামলীর বাসায় প্রতি আরবী মাসের দ্বিতীয় বুধবার মাহফিল হত। আমরা তৃতীয় তলায় থাকতাম। আমাদের বাসায় ছেলেরা বসত। দোতলায় বাড়িওয়ালীর বাসায় মহিলারা বসত। এখনো বাড়িওয়ালীর বাসায় মাহফিল হয়। এক বুধবারে দাদাভাই এলেন। ওই বাসায় লিফট ছিল না। দাদাভাই আমাকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন। প্রথম সিঁড়ি ওঠার পর দাদাভাই আমাকে বললেন, সূরা আনআমের প্রথম আয়াত পড়ো। আমি তিলাওয়াত করলাম—
اَلْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ جَعَلَ الظُّلُمٰتِ وَالنُّوْرَ ثُمَّ الَّذِيْنَ کَفَرُوْا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُوْنَ.
দাদাভাই বললেন,
ثُمَّ الَّذِيْنَ کَفَرُوْا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُوْنَ.
এর অর্থ কী?
আমি উত্তর দেওয়ার আগে দাদাভাই নিজেই বললেন, তারপরও ওই সকল ব্যক্তি, যারা তাদের রবকে অস্বীকার করে তারা শিরক করে।
তারপর আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন, يَعْدِلُوْنَ -এর ‘তারা শিরক করে’— এই অর্থ করা হল কীভাবে? এরপর নিজেই জবাব দিলেন— عَدَلَ يَعْدِلُ عَدْلًا -এর অর্থ হল, ইনসাফ বা সমান সমান করা।الَّذِيْ خَلَقَکَ فَسَوّٰىکَ فَعَدَلَکَ এখানে فَعَدَلَکَ -এর অর্থ হল, তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সমান সমান এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। দাদাভাই আমার কান, নাক এবং চোখ ধরে ধরে বোঝালেন, কীভাবে আল্লাহ তাআলা আমার কান, নাক ও চোখ সমান সমান এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। আর মুখে বললেন, একটা কান ছোট আরেকটা কান বড় হলে বা একটা চোখ ছোট আরেকটা চোখ বড় হলে কেমন দেখা যেত? নাকের একটা ছিদ্র ছোট আরেকটা বড় হলে কেমন দেখা যেত?
তারপর বললেন, অতঃপর যারা কুফরি করে তারা তাদের রবের সাথে অন্যদেরকে সমান সমান করে, সামঞ্জস্যপূর্ণ করে। আল্লাহ তাআলার সাথে অন্যদেরকে সমান সমান বা সামঞ্জস্যপূর্ণ করার অর্থই হল শিরক করা।
চার. একবার দাদাভাইয়ের কাছে এক ইসলাহী চিঠিতে অনেক হতাশার কথা লিখলাম। দাদাভাই আমাকে বকা দিয়ে বললেন, তওবার পর আবার একই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার সাথে বিদ্রূপ করা। আল্লাহ তাআলার সাথে মশকারি করা। তাই তওবার ওপর অটল অবিচল থাকা চাই। আর বললেন—
قُلْ يٰعِبَادِيَ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤي اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ اِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.
—এই আয়াতটি সুযোগ পেলেই পড়তে থাকা। ইনশাআল্লাহ হতাশা দূর হয়ে যাবে।
পাঁচ. ছোট থেকেই আমাকে কারী মুসআব বলে ডাকতেন। একবারের ঘটনা। আমার চতুর্থ চাচা হলেন হযরত মাওলানা মাসীহুর রহমান সাহেব দা. বা.। তাঁর বিয়ে হয় ২০০৩ সালে। বিয়ের পর নতুন চাচিকে নিয়ে আমরা উত্তরায় ফিরছিলাম। দাদাভাই আমাকে নিজের সাথেই রাখলেন। কিছু দূর চলার পর বললেন, এখন আমাদের তিলাওয়াত করে শোনাবেন কারী মুসআব।
আমি তিলাওয়াত করে শোনালাম। ছোটবেলা দাদাভাইয়ের এই আদরের ডাক এখনো আমার কানে ভাসে। আহ সেই ডাক কতই না মধুর ছিল!
ছয়. সাধারণত দাদাভাই আমাকে নিজের সাথেই রাখতেন। অন্য কোনো গাড়িতে দিতেন না। বেশিরভাগ সময় আমাকে সামনের সিটে বসাতেন। দাদাভাইয়ের সাথে কোনো সফরে যাওয়া হলে আম্মু আমাকে একটা মোটা গেঞ্জি দিয়ে দিতেন। যেন এসি গাড়ি হলে সামনের সিটে বসার দরুণ আমার ঠাণ্ডা লেগে না যায়।
একবার আমরা বুয়েটে গিয়েছিলাম। দাদাভাই আমাকে অন্য সময়ের মতো নিজ গাড়িতেই রেখেছিলেন। অন্য গাড়িতে আমার অন্য ভাইয়েরা এবং আরো কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল, আমি অন্য গাড়িতে যাই। অন্য গাড়িতে কত আনন্দ হচ্ছে! আর এখানে আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে! মনে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।
সাধারণত দাদাভাই গাড়িতে সফরসঙ্গী সবার কাছ থেকেই তিলাওয়াত শুনতেন। অন্য গাড়ি থেকে মোবাইল করে শুনতেন। আর নিজ গাড়িতে সরাসরি শুনতেন। কখনো আবার মাইক লাগিয়েও শুনতেন।
সাত. আরেকবার আমার বড় ফুফাতো ভাই মাওলানা উবায়দুর রহমান খান সাদের মেজো চাচ্চুর বাসা পাটুয়াটুলি যাচ্ছিলাম। অন্যান্য দিনের মতো এবারও দাদাভাই আমাকে নিজের সাথে গাড়িতে ওঠালেন। আমাকে বসালেন সামনের সিটে। পেছনে বসলেন দাদাভাই ও দাদু। অন্য গাড়িতে মাওলানা সাদসহ আরো অনেকে ছিলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল অন্য গাড়িতে যাই। মুরব্বিদের সাথে থাকলে কি আর মজা লাগে?
পথে দাদাভাই আমার আর সাদের পড়া শুনছিলেন। আমার কাছ থেকে ১-২ পৃষ্ঠা শুনলে সাদের কাছ থেকে ৫-৬ পৃষ্ঠা শুনছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে, তখন আমার খুব কষ্ট লাগছিল, দাদাভাই কেন আমার থেকে পড়া কম শুনেছেন আর সাদ থেকে বেশি শুনছেন!? আসলে আমি দাদাভাইকে খুব পড়া শোনাতে চাইতাম, তাই আমার এরকম লাগছিল। এখন মনে হয়, হয়তো দাদাভাই তখন আমার নেগরানী করতেন আমাকে নিজের সাথে রেখে আর সাদের নেগরানী করতেন পড়া শুনে। ওই সময়ে সাদের পড়া শুনতে শুনতে একপর্যায়ে দাদাভাই দাদুকে বললেন, দেখেছ মানিকের পড়া কত সুন্দর!
আট. একবার দাদাভাই হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর দাওয়াতে ভোলায় গিয়েছিলেন। আমি তখন তাইসীর কি মীযান পড়ি। ওই সফরে দাদাভাইয়ের সাথে আমি, আব্বু, আমার ছোট চাচ্চু মাওলানা আব্দুর রহমান ফেরদৌস সাহেব এবং ফুফাতো ভাই সাদ ছিল। গাড়িতে কে কোথায় বসবে বেশিরভাগ সময় দাদাভাই নিজেই ঠিক করতেন। ওই সফরেও দাদাভাই আমাকে সামনের সিটে আব্বুর সাথে বসিয়েছিলেন। ফজরের পর দাদাভাই সবার আগে মাইক্রোবাসে উঠে পেছনের সিটে বসে পড়লেন। সবার অনেক পীড়াপীড়িতেও দাদাভাই পেছনের সিট ছেড়ে সামনে এলেন না। অথচ তার কয়েকদিন আগে দাদাভাই কোমরের ব্যথার কারণে দীর্ঘ সময় বিছানায় পড়ে ছিলেন।
গাড়িতে ওঠার পর প্রথমে আমার কাছ থেকে সূরা ইয়াসীন শুনলেন। তারপর আরো অন্যান্য জায়গা থেকেও শুনলেন। আমি ছাড়া আরো যারা যারা ছিলেন তাদের কাছ থেকেও শুনলেন। আমরা লক্ষ্মীপুর পৌঁছি। লক্ষ্মীপুর থেকে আমাদের ফেরি করে ভোলায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নদী খুব উত্তাল থাকায় আমরা ফেরি করে যেতে পারিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা প্রায় ৪০-৫০ জন একটা বড় ট্রলারে করে ভোলার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। আমাদেরকে ট্রলারের দুই পাশে দুই ভাগে বিভক্ত করা হল। মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকা রাখা হল। প্রথমদিকে খুব ভালোই লাগছিল। আঁকাবাঁকা খাল। দুই পাশে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি। বিভিন্ন রকম ক্ষেত-খামার আর ঠাণ্ডা বাতাস সবাইকে খুব আনন্দ দিচ্ছিল। একটু পর ট্রলার মূল নদীতে চলা শুরু করলে পরিস্থিতি একদম পাল্টে যায়। বড় বড় ঢেউ আমাদের ট্রলার নিয়ে খেলা শুরু করে। মনে হচ্ছিল ঢেউ ট্রলারটিকে আছাড় দিচ্ছে। ঢেউ যখন ট্রলারের ওপর আছড়ে পড়ে আমাদের উপরে উঠাত, তখন মনে হত আমরা পানি থেকে অনেক উপরে। যখন ট্রলারটিকে আছাড় দিয়ে পানিতে ফেলে, তখন মনে হত, আমরা পানির নিচে। মনে হচ্ছিল, এখনই ডুবে যাচ্ছি। সবাই পেরেশানিতে পড়ে যান। কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়।
নিমতলীর মরহুম হাজ্বী আব্দুল মালেক চাচাও ওই সফরে দাদাভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন। ঢেউ যখন আমাদেরকে উপরে উঠাত তখন তিনি কালিমা পড়ছিলেন। কিন্তু দাদাভাই তখনো ছিলেন একদম শান্ত। তাঁর মধ্যে কোনোরকম পেরেশানি ছিল না। তাঁর চেহারায় ভয়-ভীতির লেশ মাত্র পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। একদম শান্তভাবে, নির্বিঘ্নে ট্রলারের মাঝখানে হাতলবিহীন একটি চেয়ারে বসে ছিলেন। একপাশে আমি অন্য পাশে সাদ। দুইজন দুই দিক থেকে দাঁড়িয়ে দাদাভাইকে ধরে ছিলাম। দাদাভাই ছোট একটি প্যাডে ম্যাপ এঁকে এঁকে আমাদের মানচিত্র দেখাচ্ছিলেন। লক্ষ্মীপুর থেকে ভোলা পর্যন্ত নদীর দৈর্ঘ্য কতটুকু, পাড়ি দিতে কতক্ষণ লাগে, নদী এখানে কেন এত উত্তাল থাকে— এসব আমাদের বুঝাচ্ছিলেন। আর আমাদের পড়ে শোনাচ্ছিলেন এবং আমাদের থেকেও শুনছিলেন সূরা লুকমানের এ দুই আয়াতে কারীমা—
اَلَمْ تَرَ اَنَّ الْفُلْكَ تَجْرِيْ فِي الْبَحْرِ بِنِعْمَتِ اللهِ لِيُرِيَكُمْ مِّنْ اٰيٰتِهٖ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُوْرٍ، وَ اِذَا غَشِيَهُمْ مَّوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ ۚ۬ فَلَمَّا نَجّٰىهُمْ اِلَي الْبَرِّ فَمِنْهُمْ مُّقْتَصِدٌ وَ مَا يَجْحَدُ بِاٰيٰتِنَاۤ اِلَّا كُلُّ خَتَّارٍ كَفُوْرٍ.
[তুমি কি দেখনি জলযানসমূহ আল্লাহর অনুগ্রহে সাগরে বিচরণ করে, তিনি তোমাদেরকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখাবেন বলে? নিশ্চয়ই এর ভেতর আছে সেই ব্যক্তির জন্য বহু নিদর্শন, যে প্রচণ্ড ধৈর্যশীল, পরম কৃতজ্ঞ।
তরঙ্গমালা যখন মেঘচ্ছায়ার মতো তাদেরকে আচ্ছন্ন করে তখন তারা আল্লাহকে ডাকে ভক্তি-বিশ্বাসকে তাঁরই জন্য খালেস করে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে নিয়ে আসেন, তখন তাদের কিছুসংখ্যক সরল পথে থাকে। (অবশিষ্ট সকলে পুনরায় শিরকে লিপ্ত হয়) আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল প্রত্যেক এমন লোক, যে ঘোর বিশ্বাসঘাতক, চরম অকৃতজ্ঞ। —সূরা লুকমান (৩১) : ৩১-৩২]
এরপর আমাদেরকে অর্থও বলে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে আমরা আলহামদু লিল্লাহ ভোলায় পৌঁছে যাই।
প্রোগ্রাম শেষ করে আমরা রাতেই ঢাকার পথে রওয়ানা হই। আব্বু ও আরো অনেকে লঞ্চে করে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। আমি, সাদসহ আরো অনেকে দাদাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর সাথে ফেরি করে রওয়ানা হই। দাদাভাই ফেরিতে উঠেই ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের চাঁদ, তারা, গ্রহ-নক্ষত্র দেখাতে লাগলেন।
নয়. শরহে জামীর বছর আমাদের তরজমাতুল কুরআন পড়াতেন উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুল হামীদ খুলনার হুজুর দা. বা.। আমাদের দরসগাহ ছিল জামিআতুল আবরার। হুজুর থাকতেন জামিআ রহমানিয়ার টিনশেডে। প্রতিদিন হুজুর দরসের আগে এসে উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আনওয়ারুল হক সাহেব হুজুরের কামরায় মুতালাআ করতেন। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই আমরা দুই তিনজন সাথী হুজুরের কাছে যেতাম। একদিন হুজুর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার দাদাভাইয়ের কাছে যাও?
আমি বললাম, হুজুর সব সময় যাওয়ার তো সুযোগ হয় না, মাঝেমধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করি।
হুজুর একটু ধমকের সুরে বললেন, এমন একজন দাদা পেয়ে এখন মূল্যায়ন করছ না, যখন তিনি থাকবেন না তখন বুঝবে...! মনে মনে বলবে, একজন বুযুর্গ ছিলেন। বহু মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজেদের আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে তাঁর থেকে অনেক ইস্তেফাদা করতেন। তাঁর একজন নাতি ছিল। সে দাদার আদর-সোহাগ, মায়া-মমতা, মহব্বত-ভালবাসা, দাবি-দাওয়া সবকিছু ঠিকই আদায় করে নিত, কিন্তু নিজের আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে গুরুত্বের সাথে দাদার কাছ থেকে তেমন একটা ইস্তেফাদা করত না। দাদার ইন্তেকাল হয়ে গেলে বুঝে আসবে, আফসোস করবে। তাই তুমি এখন থেকে যত বেশি পারো তোমার দাদার সোহবত ওঠাও। তাঁর সাথে ইসলাহী সম্পর্ক কায়েম করো।
উত্তরে আমি বললাম, হুজুর! ইনশাআল্লাহ আমল করার চেষ্টা করব। আপনার কাছে খুব দুআ চাই।
সত্যিই দাদাভাই চলে গেলেন, কিন্তু আমি দাদাভাইয়ের কাছ থেকে তেমন ইস্তেফাদা করতে পারিনি। দাদাভাই যেভাবে চাইতেন সেভাবে চলতে পারিনি। এখন শুধু হুজুরের সে কথাটাই মনে পড়ছে, ‘পরে আফসোস করে লাভ হবে না!’
দশ. একদিন আমি দাদাভাইয়ের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, দাদাভাইয়ের কাছে ডক্টর লুৎফুল কবীর দাদাভাই, তার বড় বিয়াই এবং তাঁর ছেলে আলী আব্দুল্লাহ। আলী আব্দুল্লাহ তখন কোনো একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত ছিল। দাদাভাইয়ের দুআ নেওয়ার জন্য ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি যখন ঘরে ঢুকি তখন দাদাভাই আলী আব্দুল্লাহর তিলাওয়াত শুনছিলেন। দাদাভাই আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। নিজের পাশে বসালেন। তারপর আলী আব্দুল্লাহকে বললেন, তুমি কি ওকে চেন? ও হল আমার বড় ছেলের বড় ছেলে, আমার বড় নাতি, সুহাইল। দেখতে শুনতে ছোট হলেও বাস্তবে অনেক বড় আলেম। তুমি কি ওর পরীক্ষা নিতে চাও?
আলী আব্দুল্লাহ আমাকে সূরা শুরা থেকে প্রশ্ন করল। আলহামদু লিল্লাহ আমি পূর্ণ সূরা শুনিয়ে দিলাম। দাদাভাই খুব খুশি হলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কত নম্বর দেবে?
সে বলল, ৯৯। দাদাভাই খুব খুশি হলেন।
এগারো. দাদাভাই আমার তিলাওয়াত অনেক পছন্দ করতেন। বলতেন, আমার পড়ায় শায়েখ শুরাইমের তিলাওয়াতের ঘ্রাণ পান।
এক রমযানে আমরা দাদাভাইয়ের সাথে মাসীহ চাচ্চুর বাসায় যাচ্ছিলাম। তখন চাচ্চুরা আজিমপুরে থাকতেন। দাদাভাই অনেক লম্বা সময় ধরে আমার তিলাওয়াত শুনলেন। গাড়িতেও শুনলেন চাচ্চুর বাসায় গিয়েও শুনলেন। সময়টা ছিল আসরের পর। প্রায় তিন পারা তিলাওয়াত শুনলেন। তিলাওয়াত করতে করতে যখন সূরা আম্বিয়ার ৯১ নম্বর আয়াত—
وَالَّتِيْۤ اَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيْهَا مِنْ رُّوْحِنَا وَجَعَلْنٰهَا وَابْنَهَاۤ اٰيَةً لِّلْعٰلَمِيْنَ.
[এবং দেখ সেই নারীকে, যে নিজ সতীত্ব রক্ষা করেছিল, তারপর আমি তার ভেতর আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে সমগ্র জগদ্বাসীর জন্য এক নিদর্শন বানিয়েছিলাম। —সূরা আম্বিয়া (২১) : ৯১]
পর্যন্ত পৌঁছলাম তখন আম্মুকে ফোন করে বললেন, তোমার ছেলে আজকে আমাকে অনেক তিলাওয়াত শুনিয়েছে। তিলাওয়াতও অনেক সুন্দর। ইয়াদও অনেক পাকা। ওর পড়ার ভেতর আমি শায়েখ শুরাইমের ঘ্রাণ পাই।
এই কথাগুলো বলতে বলতে দাদাভাই খুশিতে কাঁদছিলেন। এরপর আম্মুকে বললেন, এখন কি আমাকে সুহাইলের আম্মা একটু তিলাওয়াত শোনাবে? তারপর আম্মুর কাছ থেকেও একটু তিলাওয়াত শুনলেন।
কোনো এক রোযার ঈদের নামাযের পর এগারটার দিকে আম্মু ও আমার ভাইবোনদের উত্তরায় নিয়ে আসার জন্য দাদাভাই আমাকে নিয়ে আমাদের বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তখন আমরা শ্যামলী থাকতাম। গাড়িতে আমি, দাদাভাই, রিয়ায ভাই এবং তাঁর ছেলে আবরার ছিল। রিয়ায ভাই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। দাদাভাই প্রথমে আবরারের পড়া শুনলেন, তারপর আমার। এরপর রিয়ায ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, কার পড়া বেশি সুন্দর?
রিয়ায ভাই বললেন, সুহাইলের পড়া বেশি সুন্দর।
দাদাভাই বললেন, ইনশাআল্লাহ আবরারের পড়াও অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। এরপর আবার আমার পড়া শুনলেন।
এই ছিল কালামে পাকের তিলাওয়াত শোনার প্রতি দাদাভাইয়ের যওক ও শওকের কিছু ঘটনা। আল্লাহ আমাদের অন্তরেও কালামে পাকের মহব্বত দান করুন।
বারো. সম্ভবত দাদাভাই সর্বশেষ যখন ইয়ামাগাতা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন আমি দাদাভাইকে বলেছিলাম, দাদাভাই! আপনার বংশ পরম্পরা বলুন তো! দাদাভাই বলতে শুরু করলেন, হামীদুর রহমান বিন ইয়াসীন বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব মুন্সী বিন হাজ্বী ইমামুদ দ্বীন বিন আব্দুল জলীল মাহমুদ বিন গাযী মাহমুদ বিন মাগুন শেখ। তারপর বললেন, আমি আর জানি না।
দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাগুন শেখ’ মানে কী?
দাদাভাই বললেন, আমি জানি না।
আমি বললাম, এটি কোন্ ভাষার নাম দাদাভাই?
তিনি বললেন, সম্ভবত ফার্সী নাম।
কয়েকদিন পরে আমি দাদাভাইয়ের কাছে ‘মাগুন শেখ’ নামটি তাহকীক করে নিয়ে গেলাম। বললাম, দাদাভাই! আপনি আপনার বংশপরম্পরার সর্বশেষ যে নামটি বলেছিলেন ‘মাগুন শেখ’; আমি সেই নামটির তাহকীক করেছি।
দাদাভাই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আচ্ছা, তাই নাকি! কী পেয়েছ মানিক?
আমি বললাম, ‘মাগুন’ এটি ফার্সী শব্দ। এর অর্থ, আনন্দিত, রূহানী আনন্দে আনন্দিত— এমন। দাদাভাই আমার এই তাহকীক শুনে খুবই আনন্দিত হলেন। হাসলেন এবং কাঁদলেন।
সালমান বিন মুস্তাফীযুর রহমান
এক. আমি মিশকাতের বছর বেফাক পরীক্ষার আগে দাদাভাইয়ের কাছে পরীক্ষার বিষয়ে অনেক পেরেশানি জাহির করি। দাদাভাই আমাকে বললেন, ‘কোনো পেরেশানি নেই, আল্লাহ ভরসা’।
আরো বললেন, আমার নানা আমাকে পরীক্ষার সময় পড়ার জন্য এটা শিখিয়েছিলেন—
ہست قليد در گنج حکيم # بسم اللہ الرحمن الرحيم
—এটা পড়ে পরীক্ষা দেবে।
বেফাক পরীক্ষায় আমি এটা পড়ি এবং লেখা শুরু করার আগে লিখেও নিই। আলহামদু লিল্লাহ, এরপর থেকে আমার মতো নগণ্য ছাত্রের ফলাফল কল্পনাতীত হতে শুরু করল।
দুই. আম্মু আমাকে বলেছেন, তোমার দাদাভাই রাহ. তোমার বাবা-চাচা-ফুফুদের দিকে লক্ষ করে আমাকে বলতেন, ‘মা! আমি, তুমি ও তোমার শাশুড়ি, আমরা হলাম গুয়ের টালের (অর্থাৎ মূল্যহীন সাধারণ) মানুষ আর ওরা সবাই হল বনেদি’ অর্থাৎ তখন পরিবারে তাঁরা তিনজন ছাড়া বাকিরা সবাই হাফেয আলেম ছিলেন। তাই তাদেরকে সম্মান করে বলতেন ‘বনেদি’ (সম্ভ্রান্ত, সুপ্রতিষ্ঠিত)। আর আমরা যারা ইংরেজি শিক্ষিত ছিলাম, তাদের বলতেন, গুয়ের টালের মানুষ।
এ থেকেই বোঝা যায়, তাঁর অন্তরে হাফেজ-আলেমের মূল্য ও কদর কত বেশি ছিল, তাঁদের প্রতি কেমন শ্রদ্ধা ছিল এবং ইলমে ওহীর প্রতি কেমন ভক্তি ছিল।
আহমাদ বিন আরিফুর রহমান
এক শুক্রবার জুমার পর দাদাভাইয়ের বাসায় গেলাম, তখন দাদাভাই ৫৪ নং বাসায় থাকতেন। সেদিন আমি দাদাভাইয়ের সাথে খেতে বসলাম। সেখানে দুই পিস মুরগির রোস্ট ছিল; তার মধ্যে একটি ছিল মুরগির লেগ পিস আর অপরটি নরমাল পিস ছিল। দাদাভাই প্রথমেই লেগ পিসটি আমার প্লেটে দিলেন আর অন্য পিসটি নিজের প্লেটে রাখলেন।
মুহাম্মাদ বিন রিজওয়ানুর রহমান
এক. কিতাবখানার প্রথম বছর শেষ করে রমযানে তারাবীর নামায দাদাভাইয়ের কাছে পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমাকে দাদাভাইয়ের তারাবীর গ্রুপে নেওয়াও হল। আমার ইয়াদ তখন অনেক কাঁচা। প্রতি রাকাতেই অনেক লোকমা যেত। দাদাভাই কোনোদিন কিছু বলেননি। একদিন কোনোভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, অন্য যারা হাফেয সাহেব এবং মুসল্লি আছেন, তারা আমার বেশি লোকমা যাওয়ার কারণে বিরক্ত। ওই দিন তারাবীর নামাযের সময় আমাকে ইমামতির জন্য পাঠানোর সময় সবাইকে শুনিয়ে আমাকে বললেন, নামাযের মধ্যে লোকমা যাবেই। মক্কা শরীফের ইমামদেরও লোকমা যায়। ভয় পাবা না। আমি আলহামদু লিল্লাহ দাদাভাইকে ৭ বছর তারাবী পড়িয়েছি। শেষ বছর অনেক কম লোকমা গিয়েছে। এই যে ইয়াদ হয়েছে আমার, পুরোটাই দাদাভাইয়ের কারণে। তিনিই আমাকে অভয় দিয়ে এ পর্যন্ত এনেছেন।
দুই. তারাবীর বাইরেও দাদাভাই আমার তিলাওয়াত শুনতেন। একবারের ঘটনা। আমি আর আব্বু গাড়িতে করে একসাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। আব্বু দাদাভাইয়ের কথা বলছিলেন, আব্বা যখন-তখন, যাকে-তাকে কল করে বলেন, ওই সূরা পড়ে শোনাও। অমুক জায়গা থেকে পড়ো।...
আব্বু এই কথা বলছিলেন, এর মধ্যেই ফোন বেজে উঠল। কল রিসিভ করে দেখি, দাদাভাইয়ের খাদেম। তিনি আমাকে বললেন, দাদাভাই কথা বলবেন।
দাদাভাই ফোন নিয়ে কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলেন, কী করছ?
বললাম, গাড়িতে। বাসায় যাচ্ছি।
বললেন, তাহলে সূরা মুহাম্মদ শোনাও।
কী আজীব ঘটনা! আব্বুর কথা প্রমাণসহ সামনে এল। অথচ সময়টা রমযানও ছিল না।
তিন. দাদাভাইয়ের শাসনের কোনো তুলনা হয় না! আমি একবার দাদাভাইকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে দাদাভাইকে বসানোর জন্য বিছানার ওপর থেকে জিনিসপত্র সরাচ্ছি। তখন দাদাভাই অনেকটা মাজুর। একটি জিনিস আমি দূরে রাখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু হাত যাচ্ছিল না। আমি ওই জিনিসটি ছুঁড়ে মারলাম। দাদাভাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এটা এভাবে ছুঁড়লে কেন? এভাবে ছুঁড়তে হয়! সামনে কখনো এমনটি করা যাবে না।
এরকম সামান্য থেকে সামান্য জিনিসও ধরিয়ে দিতেন। বুঝিয়ে বলতেন।
চার. দাদাভাই আমাদের কয়েকজন নাতিকে নিয়ে আইইউটিতে গেলেন। ২০১৭ কিংবা ২০১৮ সালের কথা। ওখানে গিয়ে আমাদেরকে নিয়ে গাড়ি চালালেন। দাদাভাইয়ের ড্রাইভিং দেখে বুঝাই যাচ্ছিল না, এত বয়স্ক একজন মানুষ! শারীরিকভাবে শক্তি কমে যাওয়ার কারণে প্রথমে তো গিয়ার চেঞ্জই করতে পারছিলেন না। পরে দাদাভাইয়ের প্রবীণ ড্রাইভার রিয়াজ ভাই চেঞ্জ করে দিলেন। অল্প জায়গার মধ্যে গাড়ি ৬০ কিলোমিটার স্পীডে চালালেন। গোলচক্কর ঘোরার সময় ৪০ কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি টার্ন নিলেন।
আমার বয়স তখন ১৩ অথবা ১৪। আমি ড্রাইভিংয়ের পাগল। দাদাভাইয়ের গাড়ি চালানো দেখে আমারও আগ্রহ জেগে উঠল। আমিও গাড়ি চালাব। দাদাভাইকে তো আর বলতে পারি না। আইইউটির একজন শিক্ষক আছেন, দাদাভাইয়ের মুরীদ। আমাদের শ্যামলী বাসার প্রতিবেশী। তাঁর গাড়ি ছিল। আমি দাদাভাইকে না জানিয়ে আইইউটির ভেতরে তাঁর গাড়ি চালালাম। ফেরার পথে আমরা যখন গাড়িতে উঠছিলাম, তখন যার গাড়ি চালিয়েছিলাম তিনি বললেন, দাদাভাইয়ের গাড়ি চালাতে চাও?
আমি বললাম, কোনো দরকার নেই।
তিনি বললেন, আমি বলে দেখি, কী বলেন?
বলতে বলইে দাদাভাইকে বলেই দিলেন যে, আমি তাঁর গাড়ি চালিয়েছি। এই কথা বলার পর দাদাভাই তাঁকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। আমাকে বকা দেওয়া শুরু করলেন, ইন্না লিল্লাহ! পচা ছেলে। তুমি এত পচা হইস? তোমাকে আমি নিয়ে এসেছি। তুমি আমাকে না জিজ্ঞেস করে এই কাজ কেন করলে?
আরো অনেকক্ষণ বকা দিলেন। এরপর দাদাভাই আমাদেরকে বোর্ড বাজার মাদরাসায় নিয়ে গেলেন। ওখানে আমরা যারা হাফেয ছিলাম তাদের থেকে—
وَ اِنْ كُنْتُمْ عَلٰي سَفَرٍ وَّلَمْ تَجِدُوْا کَاتِبًا فَرِهٰنٌ مَّقْبُوْضَةٌ فَاِنْ اَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ اَمَانَتَهٗ وَلْيَتَّقِ اللهَ رَبَّهٗ وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَّكْتُمْهَا فَاِنَّهٗۤ اٰثِمٌ قَلْبُهٗ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ، لِلهِ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْاَرْضِ وَ اِنْ تُبْدُوْا مَا فِيْۤ اَنْفُسِكُمْ اَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَّشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَّشَآءُ وَاللهُ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ.
—এই একই আয়াত শুনলেন। মক্তবের বাচ্চারা যে যার মতো কিছু শোনালো। দাদাভাই আমাদেরকে মিষ্টি খাওয়ালেন। ওই এলাকায় দাদাভাইয়ের একটা বাসা আছে, যেখানে কেউ থাকে না, ওই বাসায় নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় আমরা যারা ছিলাম সবাইকে খাতা কলম কিনে দিলেন। সম্ভবত আমাদেরকে জুস এবং চিপস কিনে দিয়েছিলেন। ওই বাসায় গিয়ে আমাদের প্রত্যেকের খাতায় নিজ হাতে যার যার নাম লিখে দিলেন। এরপর আমাদেরকে পড়ালেন। কী পড়িয়েছিলেন সেটা মনে নেই। কিন্তু ওই যে আমাকে বকা দিয়েছিলেন সেজন্য এত কিছু করলেন। তাঁর তারবিয়াতের কোনো তুলনা হয় না।
পাঁচ. একবার আমি এবং আরো কয়েকজন নাতি দাদাভাইয়ের সাথে মুন্সিগঞ্জে যাচ্ছিলাম। সেদিন আমরা সাইনবোর্ডে এক জায়গাতেই সাত ঘণ্টা জ্যামে বসে ছিলাম। ওইদিন দাদাভাই আমাদের সবার থেকে তিলাওয়াত শোনার পর নিজে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করেছিলেন।
يٰحَسْرَةً عَلَي الْعِبَادِ مَا يَاْتِيْهِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِهٖ يَسْتَهْزِءُوْنَ.
এই আয়াত পর্যন্ত পড়ার পরে (আফসোস করে) বললেন, আমার এত খানি তিলাওয়াত শুনে সবাই হাফেয মনে করবে, অথচ আমি হাফেয না!
উসমান বিন মাসীহুর রহমান
দাদাভাই শিশুকালে আমাকে খুব আদর করতেন। আমার ‘উসমান’ নামও তিনি রেখেছেন। তিনি আমাকে ‘জামিউল কুরআন’ ও ‘যুন্নূরাঈন’ ডাকতেন। ৩ বছর পর্যন্ত তাঁর ও দাদুর মাঝখানে নিয়ে ঘুমাতেন। প্রায়ই বলতেন, সেইদিন না আল্লাহর কাছে ছিলে, এখন এত পাকা...!
একবার আমার ছোট বোনের নিউমোনিয়া হলে আব্বু আম্মু ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দাদু আমাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে বসে থাকতেন।
দাদাভাই খেলার ছলে আমল শেখাতেন। গাড়িতে উঠে দুআ পড়তে শুরু করতেন। শুনে শুনেই আমাদের মুখস্থ হয়ে যায়। কখনো বলতেন, কে শোনাবে? বা বলতেন, মানিক কি আমাদের শোনাবে?
দাদাভাই বাসায় ফিরলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁর হাত ধরে ঘরে ঢুকতাম সবাই। আমার সাইকেল ছিল না; অন্যদের চালানো দেখতাম। আমার নেই জেনে নিজে কিনে দিয়েছিলেন। বাসায় ফিরলে তাঁর পা টিপতে যেতাম; তিনি বেশ কিছু সুন্দর দুআ বলতেন।
তিনি প্রায়ই আমাদের দোকান থেকে কিনে খাওয়াতেন। বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন; করতেন হাসি-মজাও। তবে তাঁর সামনে অন্যায়ের সাহস পেতাম না। তাঁর অনুপস্থিতিতে অপরাধ করলে নাম শোনামাত্র সুবোধ হয়ে যেতাম। খুব আদর করতেন। তবে বুঝমানদের টুকটাক শাসনও করতেন। কেউ মারও খেয়েছে; তবে আমার নসীব হয়নি। একবার আম্মু পড়তে বসতে বললেন। বসছিলাম না বলে আম্মু ভয় দেখানোর জন্য আমাকে শুনিয়ে ‘পচা হচ্ছে’ বলে নালিশ দিলেন। দাদাভাইয়ের এক ধমকে ১০ মিনিটে সূরা ক্বফ-এর প্রথম পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে গেল। ধমক বলতে হল— ভীষণভাবে চোখ গরম করে কঠিন গলায় বললেন, কোনো খাতির নাই। পড়। পচা হও কেন? পচা ছেলেকে ভালবাসি না।
পরে আদর করে দিয়েছেন। আইসক্রিম খাইয়েছেন। এমনটাই করতেন শাসন করে কিছু একটা খাওয়াতেন।
দাদাভাই খুব বিচক্ষণ ছিলেন। আমি তখনও একপ্রকার শিশু। বয়স নয়-দশ। ছোট বোনদের সাথে খেলছিলাম। দেখে খুব রাগ হলেন। বললেন, ছি ছি! মেয়েদের সাথে খেলছ! কী লজ্জার কথা! সেই থেকে মেয়েদের সাথে খেলা বন্ধ।
দাদাভাই বাচ্চাদের ইংরেজি লেখা ও ছবিযুক্ত কাপড় পরানো অপছন্দ করতেন। শার্ট-প্যান্টও অপছন্দ করতেন।
তাঁর সাথে সফর হত প্রাণবন্ত। কোন্ গাড়ি আগে, কোন্টা পরে, তিনি ঠিক করতেন। সবাই একসাথে চলতে হত। যার যার মতো যাওয়া যাবে না। বারবার সব গাড়ির সাথে ফোনে যুক্ত হতেন। বলতেন, একে ফোন লাগাও, ওকে ফোন লাগাও। তাঁর গাড়ি থাকত সামনে। কেউ পিছিয়ে পড়লে ‘গাড়ি থামাও’ বলে সব গাড়ি থামিয়ে দিতেন। ঐ গাড়ি এলে পরে যেতেন।
সফরে অবশ্যই কোনো এক দোকানে থেমে খেতেন। সফর যত ছোটই হোক। ঢাকার ভেতরও এমন করতেন। এক দোকানে খুব বেশি খেতেন বলে এর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দাদাভাইয়ের দোকান’। সফরে অন্যদের বাথরুমের প্রয়োজনের প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। বাথরুমের প্রয়োজন জানা মাত্রই যত দ্রুত সম্ভব থামতেন। এজন্য বিরক্ত বা রাগ হতেন না সামান্যও। একবার সফরে হোটেল থেকে বেরোবার ১০ মিনিট পরই আমাকে বাথরুম করিয়েছেন। সে হোটেলে বাথরুম ছিল; প্রয়োজন হয়নি বলে যাইনি।
দাদাভাই কুরআনের ‘আশেক’ ছিলেন। তাঁর মতো কুরআনের প্রতি ইশক কারো মাঝে দেখিনি। খুব কুরআন পড়তেন। পড়াও ছিল দিলকাশ। তাঁর মুখে শুনে শুনে আব্বু-চাচ্চুদের বহু জায়গা মুখস্থ হয়েছে। আমাদেরও হয়েছে। কুরআন শুনতেনও খুব। যখন তখন, যার তার থেকে, যেখানে সেখানে। এমনকি রাস্তায় বসে শোনারও নজির আছে। দাদাভাই কুরআন পড়া ও ইয়াদ রাখার প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। ভুলে গেলে রেগে যেতেন। ইয়াদের জন্য তারাবীর প্রতি গুরুত্ব দিতেন।
আব্বুর ইবতিদায়ীর বছর নাকি ইয়াদ কাঁচা হয়ে যায়। তাই দাদাভাই বলেছিলেন, দরকার নাই আমার কিতাবের; আগে কুরআন। বলতেন, মচমচা হাফেয হতে হবে। কুরআনের মহব্বতে নসলের সবাইকে হিফয করিয়েছেন। এখন সন্তান ও নাতি-নাতনি মিলিয়ে হাফেযের সংখ্যা ৩০। বাকিরাও হিফয করছে। তাঁর সাথে সম্পৃক্তদের সন্তানরাও অধিকাংশ হাফেয। তিনি সাধারণ শিক্ষিতদের থেকেও কুরআন শুনতেন। তাঁর ড্রাইভারদের থেকেও। আমি তাঁকে অনেক কুরআন শুনিয়েছি। তবে মৃত্যুর আগে একদিন হাসপাতালে কয়েকজনের পড়া শুনে আমাকে বললেন, তোমারটা তো শোনা হল না। তুমি বাকি রইলে। সত্যিই বাকি রয়ে গেলাম। আমার পড়া না শুনেই চলে গেলেন তিনি।
আল্লাহ! জান্নাতে তাঁর পাশে বসে তিলাওয়াতের তাওফীক দিন।
কুরআনের প্রতি অসাধারণ আযমত ছিল। কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত সকল ব্যক্তি ও বস্তুকে সম্মান করতেন। কুরআনের আদবপরিপন্থী কিছু সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর রুচি ছিল তিলাওয়াতকারী মজলিসের সর্বোচ্চ আসনে বসবে। এক মজলিসে একটিমাত্র ভালো চেয়ার ছিল। অন্যগুলো অনুন্নত। তিনি নিজে সরে গেলেন। আরেকবার তো একটিমাত্র চেয়ার থাকায় নিচেই বসে পড়লেন। কুরআনের জন্য হাত খুলে খরচ করতেন। তিলাওয়াত শুনলেই কিছু খাওয়াতেন।
يٰۤاَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبٰتِ وَ اعْمَلُوْا صَالِحًا .
হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসমূহ হতে (যা ইচ্ছা) খাও ও সৎকর্ম কর। —সূরা মুমিনূন (২৩) : ৫১
এই আয়াত পড়ে বলতেন, আল্লাহ বলছেন, ভালো খাবার খাও, নেক কাজ করো। আমরাও কিছু খেয়ে নেক কাজ করব। নেক কাজ হল তিলাওয়াত।
দাদাভাই আমাদের আবদার পূরণ করতেন। প্রায়ই নানাকিছুর আবদার করতাম; তিনি পূরণ করতেন। একবার বি.বাড়িয়া থেকে ফেরার সময় ভাই-বোনরা নিকুঞ্জ মেরিডিয়ান ফাইভ স্টারে খেতে চাইলাম। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আব্বু ও ফুপ্পি ‘দাম বেশি’ বলে আটকাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে— ‘পরিবেশ বাজে’ বলে থামালেন।
দাদাভাইয়ের আখলাক ছিল খুব উঁচু। সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করতেন। যাদেরকে সমাজ নিম্নস্তরের মনে করে তাদেরকে খুব গুরুত্ব দিতেন। ড্রাইভারদের এক দস্তরখানে খাওয়াতেন। আলাদা দিলে অপছন্দ করতেন। তাঁর আখলাকে প্রভাবিত হয়ে মানুষ দ্বীনের বুঝ পেত। একবার মগবাজারে গাড়ি থামিয়ে খাচ্ছি। পাশে এক বাসার দারোয়ান বসা। ১০০০ টাকা দিয়ে বললেন, আমরা যা খেয়েছি, তাকেও তা কিনে দাও। তাঁকে খাবার কিনে দিলে তিনি আনন্দে কেঁদে দিলেন। খুব দুআ করলেন দাদাভাইয়ের জন্য।
এবার ভিন্নরকম একটা গল্প বলি। আজিমপুর ১৩৬ নং বাসায় কেউ একজন বাথরুমের মেঝে ‘ময়লা’ করে ফেলেছেন। এটা দেখে কেউ বাথরুমে যেতে পারছে না। দাদাভাই জেনে পুরো বাথরুম পরিষ্কার করলেন।
এক সফরে পাম্পের বাথরুম পরিষ্কার করেছেন। প্রায়ই ঘটেছে এমন। তিনি অদ্ভুৎ রকম মানবিক ছিলেন। একবার রাস্তায় কুকুর মরে পড়ে থাকতে দেখে কুকুরকে নিজ হাতে পাশে সরিয়েছেন। দাদাভাই মজলিসে কিছু খেলে ছোট জিনিসও উপস্থিত সবাইকে ভাগ করে দিতেন। একটা দশ টাকার কেকও আট-দশজনকে দিয়ে খেতেন।
আমি হিফযের শুরুর সবক তাঁর থেকে নিয়েছি। শেষটাও তাঁকেই শুনিয়েছি। সেদিন নিজে উত্তরা থেকে এনে মিষ্টি খাইয়েছেন।
তিনি মক্তবে পড়াতে পছন্দ করতেন। আমাদের দিয়েও পড়াতেন। ছোট ছোট কাজ করতে পারলে খুব উৎসাহ দিতেন। একদিন একটা পড়া জিজ্ঞেস করলেন। পারলাম। বললেন, মাশাআল্লাহ। এ প্লাস।
সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়ে সুন্নত পালন করতেন। ভালো কাজে ডান, কম ভালোতে বামটার খুব গুরুত্ব দিতেন। একবার বাম পায়ে জুতা আগে পরানোয় ‘আহ’ করলেন।
চুপিসারে খুব দান করতেন। খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষকে বেশি দান করতেন। রিকশাওয়ালা, হোটেল বয় এদেরকে দান করতেন। আত্মীয়দের সহযোগিতা করতেন।
দ্বীনী জীবন গ্রহণে চাপাচাপি করতেন না। একজন মহিলা দাদাভাইয়ের সাথে ইসলাহী সম্পর্ক রাখতেন। সন্তানদের মাদরাসায় পড়িয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বামী প্রথমে দাদাভাইকে বেশি পছন্দ করত না। দাদাভাই কিছুই বলেননি কোনোদিন। পরবর্তীতে দাদাভাইয়ের আচরণেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। খুব মহব্বত তৈরি হয়েছিল।
তিনি সন্তানের উস্তাযদের আজীবন খেদমত করেছেন। হাদিয়া দিয়েছেন। দাদাভাই ফাঁকে ফাঁকে যিকির করতেন। হঠাৎ লা ইলাহা ইল্লাহ, সুবহানাল্লাহ বলে উঠতেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। থানভী রাহ.-এর শের তাঁর খুব পছন্দ ছিল।
দাদাভাইয়ের মধ্য কৃতজ্ঞতা স্বীকারের গুণ ছিল খুব। ইহসানের বদলা দিতেন সব সময়। মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতেন।
এসব করতেন দ্বীনের জন্য। দ্বীনের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। সারা বছর পুরো দেশজুড়ে সফর করেছেন। একবার এক মক্তবে যাবেন। তাঁর প্রচণ্ড জ্বর। আব্বু সাথে ছিলেন। যাওয়ার বাহন নৌকা। তিনি গেলেন।
আলেমদের অদ্ভুত কদর করতেন। বলতেন, ‘আমি আলেমদের জুতাবাহক’।
মেহমানের গাড়ি ব্যবস্থার প্রতিও খুব খেয়াল রাখতেন। নিজ গাড়িতে করে পৌঁছে দিতেন।
আমাকে করা তাঁর তিনটি নসীহত—
এক.
وَ لَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهٗ عَنْ ذِكْرِنَا.
এমন কোনো ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি। —সূরা কাহ্ফ (১৮) : ২৮
দুই.
وَ يَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰي يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا.
এবং যেদিন জালেম ব্যক্তি (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে এবং বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ ধরতাম! —সূরা ফুরকান (২৫) : ২৭
তিন. এ উপদেশটি হাফেজ্জী হুযুরের। তিনি বলতেন, ‘তৈয়ারি করেন তৈয়ারি করেন। সামনে কঠিন দিন আসতেছে।’
দাদাভাইয়ের ইন্তেকালের মুহূর্তে সামনে ছিলাম। আহা, কী মায়াবী চেহারা! কোনো কষ্ট ছাড়া আল্লাহর কাছে চলে গেলেন।
মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মৃত্যুর সাথে সাথে মুখে এমন এক সুন্দর হাসি দেখা গেল! সারাজীবন তো এ হাসিটুকুর জন্যই কষ্ট করলেন।
আল্লাহ দাদাভাইয়ের কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দিন। আমাদেরকে তাঁর আদর্শে চলার তাওফীক দিন।
আম্মার বিন আবদুল্লাহ আনওয়ারুল কারীম
আমার বয়স যখন পাঁচ কি ছয়, একদিন নানাভাইয়ের ঘরে ঢুকলাম। আম্মু আর নানাভাই সামনা-সামনি বসা ছিলেন। আমার মাথায় টুপি ছিল না, হাতে একটা বই ছিল। নানাভাই বললেন, টুপি কোথায়? তখন আমি টুপি আনতে যাওয়ার সময় এমনিই বইটা মাথায় দিলাম। তখন নানাভাই বললেন, এটা তো টুপি না!
উম্মে ইসমাঈল বিনতে রিজওয়ানুর রহমান
এক. ছোটবেলা ঈদের সময়গুলোতে অথবা দাদাভাইয়ের হজ্ব বা উমরার সফরের আগে-পরে আমরা সব ভাইবোন একত্র হলে, আমাদের গল্প শেষই হত না। রাত পার হয়ে যেত, কিন্তু আমাদের গল্প শেষ হত না। দাদাভাইয়ের ঘরের নিচে কখনো ছেলেদের জন্য বিছানা করা হত আবার কখনো মেয়েদের জন্য। দাদাভাই তো আগেই শুয়ে পড়তেন। তিনি ঘুমিয়ে গেলে আমরা নিচে শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে গল্প করতে থাকতাম। আবার কখনো চুপিসারে অন্যত্র গিয়ে গল্প করতাম। দাদাভাইয়ের ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করলে হুড়োহুড়ি করে যে যেভাবে পারতাম শুয়ে পড়তাম। অনেক সময় আমাদের জুতোগুলো দাদাভাইয়ের হাঁটার পথে এলোমেলো হয়ে থাকত। ফলে দাদাভাইয়ের হাঁটতে অনেক কষ্ট হত। তখন আমাদের কেউ উঠে জুতোগুলো ঠিক করে দিত। দাদাভাই তো সব সময় বুঝতেই পারতেন, আমরা ঘুমাইনি। তার পরও সাধারণত আমাদের বকাঝকা করতেন না। মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলতেন, তুমি না ঘুমাচ্ছিলে, টের পেলে কীভাবে?
কেউ কেউ আবার অনেক সময় দুষ্টুমি করে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিত। যেন ঠিক সময় অ্যালার্ম না বাজে। দাদাভাইও সময় মতো উঠতে না পারেন। আমাদের গল্পের সময়ও লম্বা হয়। কিন্তু দাদাভাই যে সময় চাইতেন ঠিক সে সময়ই উঠে যেতেন।
দুই. দাদাভাই আমাদের বিভিন্ন জায়গায় পড়াতে নিয়ে যেতেন। IUT-এ যখন তিনি পড়াতেন তখন প্রায়দিন ভোরবেলা IUT-এ ক্লাস নিতে যাওয়ার সময় নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন। অনেক সময় হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আমাদের সাথে মজা করে বলতেন, দেখো দেখো গাড়িটা একা একাই চলছে! IUT-এ ঢোকার একটু পর একটা বাঁক পড়ে। ওই বাঁকটাতে দাদাভাই বেশ জোরে গাড়ি ঘুরাতেন। আমরা এক পাশ থেকে অন্য পাশে হেলে পড়তাম। গাড়ি পার্ক করার পর অনেক সময় দাদাভাই আমাদেরকে শিউলি ফুল গাছের নিচে নিয়ে যেতেন। তারপর আমাদেরকে নিয়ে ফুল কুড়াতেন।
তিন. IUT-এর ক্যান্টিনে সকালের নাস্তায় কখনো খিচুড়ি আর ডিম থাকত—ডিমপোচ বা ডিমভাজি। দাদাভাই আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, কে ডিমপোচ খাবে আর কে ডিমভাজি?
যে যেটা চাইত, দাদাভাই তার জন্য সেটাই নিয়ে আসতেন। একবার কেউ বললেন, সবার জন্য একরকম আনলেই তো হয়! এত ঝামেলা করার কী দরকার? কিন্তু দাদাভাই আমাদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিতেন।
উম্মে আউফ বিনতে রিজওয়ানুর রহমান
এক. আমার দাদাভাই আমাদের কত আদর করতেন। হাফেযা নাতনিদের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ টান। যখন সবল ছিলেন, নিজেই হাফেজা নাতনিদের বাসায় গিয়ে তাদেরকে নিজের বাসায় নিয়ে আসতেন। কয়েকদিন রেখে দিতেন পড়ানোর জন্য। এক রাতে আমাদের ঘুমাতে অনেক দেরি হয়। এত দেরি যে, দাদাভাইয়ের তাহাজ্জুদের সময় হয়ে যায়। দাদাভাইয়ের ঘড়ির এলার্ম শুনে আমরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর দাদাভাইয়ের পায়ের শব্দ শুনে আমরা ঘুমের ভান করি। দাদাভাই আওয়াজ দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। এরপর বললেন, এতো পচা তোমরা! এত পচা হয়েছ! ওঠো, ওঠো, এখন আর ঘুমের ভান ধরতে হবে না! ওঠো!
বলতে বলতে পায়ের কাছে এসে বসলেন। সবাই উঠে গেল। আমি ভান ধরেই থাকলাম। দাদাভাই পায়ে সুরসুরি দিলেন, তাও আমি নড়ি না। দাদাভাই বললেন, ঘুম থাকলে তো পা নাড়াতেন! আর ঢঙ করতে হবে না। ওঠেন, খাতা কলম আনেন, আমি তাহাজ্জুদ না পড়ে আপনাদের পড়াতে চলে এসেছি।
দুই. আমার মেজো চাচ্চু মাওলানা মুস্তাফীযুর রহমান সাহেব দা. বা. ঝিগাতলায় থাকেন। বাসাটি তিন তলা। তৃতীয় তলায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। নিচের দুই তলায় মাদরাসা। প্রতি আরবী মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার তাঁর বাসায় মাসিক মাহফিল হয়ে থাকে। দ্বিতীয় তলায় পুরুষরা বসেন আর তৃতীয় তলায় চাচ্চুর বাসায় মহিলারা বসেন। একবার আমরা সবাই মাহফিলে গেলাম। দাদাভাইও গেলেন। সেদিন দাদাভাই শারীরিকভাবে অনেক বেশি দুর্বল ছিলেন। উপরে উঠতে পারেননি। নিচতলাতেই ছিলেন। মাহফিল শেষে নিচ তলায় মুস্তাফীয চাচ্চুর সাথে আমরা সবাই দাদা ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি, দাদাভাই একটি বড় ঘরে শুয়ে আছেন। আমরা অনেকেই ছিলাম। একে একে আমরা সবাই তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর আশেপাশে বসে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছিলাম। একপর্যায়ে আমি মুস্তাফীয চাচ্চুকে জিজ্ঞাসা করলাম, এত বড় ঘর! এই ঘরটাতে কী হয়?
চাচ্চু বললেন, এই ঘরটা তোমার দাদা ভাইয়ের জন্য নির্ধারিত। তিনি এলে এ ঘরে থাকেন। তিনি চলে গেলে ঘরটি তালাবদ্ধ থাকে।
আমি বললাম, তাহলে তো আমরা মাঝে মাঝে এই ঘরে এসে খেলাধুলা করতে পারি।
এদিকে দাদাভাই আমাদের সব কথাই শুনছিলেন। মুস্তাফীয চাচ্চুর সাথে আমার এই কথোপকথন শুনে বললেন, দেখ তো সামনের কী বার খালি আছে? ওইদিন আমি আমার নাতনিদের এই ঘরে পড়াব।
খোঁজ করে যে বারটি খালি পাওয়া গেল সেটি ছিল বুধবার। প্রথম বুধবারে আমরা সবাই ঠিকঠাকভাবে উপস্থিত হই। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, দাদাভাই হয়তো মাসে একবার এই প্রোগ্রামটি করবেন, তাই পরের বুধবারে আমরা কেউ যাইনি। দাদাভাই চাচ্চুর বাসায় এসে নাতনিদের খোঁজেন, জিজ্ঞেস করেন কেউ আসেনি কেন?
পরে আমরা সবাই উপস্থিত হই। এরপর থেকে প্রতি বুধবারেই দাদাভাই আমাদের পড়াতেন আর বুধবারের নাম দিয়ে দিলেন, ‘নাতিন্স ডে’। অর্থাৎ নাতিনদের পড়ানোর দিন। আলহামদু লিল্লাহ, এরপর থেকে প্রতি বুধবারেই দাদাভাই আমাদের পড়াতে থাকেন।
তিন. বুধবারের এই প্রোগ্রামকে দাদাভাই অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। অন্য সব কাজের ওপর এই প্রোগ্রামকে অগ্রাধিকার দিতেন। কখনো উপস্থিত হতে দেরি হলে বারবার ফোন করে তাড়াতাড়ি উপস্থিত হওয়ার তাকিদ দিতেন। তিনি খুব চাইতেন, আমরা যেন খুব গুরুত্বের সাথে বুধবারের এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। এক বুধবারে আমরা আগে থেকেই দাদাভাইয়ের বাসায় ছিলাম। যেহেতু বুধবার পর্যন্ত থাকার পুরোপুরি নিয়ত ছিল না, বাসায় গিয়ে বুধবারে আবার আসার বড় একটা সম্ভাবনা ছিল, তাই কেউ কেউ বুধবারের প্রস্তুতি ছাড়াই এসেছিল। পড়াতে বসে দাদাভাই দেখলেন, কয়েকজন খালি হাতে পড়তে বসেছে।
জিজ্ঞেস করলেন, কিতাব কোথায়?
তারা বলল, নিয়ে আসা হয়নি, দাদাভাই!
দাদাভাই বললেন, কেন নিয়ে আসনি? জানো না পড়া হবে?
এরপর অন্যদের বললেন, ওদেরকে খাতা কলম দাও!
চার. দাদা ভাই আমাদেরকে উর্দু ‘বেহেশতী জেওর’ পড়াতেন। একবার একটা জায়গার অর্থ দেখার জন্য বাংলা ‘বেহেশতী জেওর’ আনতে বললেন। তারপর সেটা থেকে আমাদেরকে পড়ালেন আর বললেন, এটা অনেক জরুরি কিতাব। সবার কাছে থাকা চাই। পরের বুধবারে আমাদের সবাইকে বাংলা ‘বেহেশতী জেওর’ দেওয়া হল।
আরেক বুধবারে বললেন, এই কিতাবটা এত জরুরি, আগে তো খেয়ালই করিনি! এই কিতাব সবার পড়া উচিত।
পাঁচ. আমার বিয়ের পর বুধবারের এই মজলিসে প্রথমবার যখন উপস্থিত হই তখন দাদাভাই আমাকে দেখে খুব খুশি হন। আমাকে বললেন, তুমি এসেছ! তোমার স্বামী তোমাকে আসার অনুমতি দিয়েছে! তোমার স্বামীকে আমার পক্ষ থেকে ‘জাযাকাল্লাহ’ দিও। তুমি এসেছ বলে আমি খুব খুশি হলাম, জাযাকিল্লাহ!
ছয়. একবার সবাই মিলে একসাথে আমাদের কক্সবাজার যাওয়ার খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু দাদাভাইয়ের সামনে আমাদের এই ইচ্ছার কথা কে পেশ করবে? কীভাবে পেশ করবে? দাদাভাই কি কষ্ট পাবেন? আরো অনেক প্রশ্ন জাগতে থাকে। যার কারণে আমরা প্রথম প্রথম কেউ সাহস করছিলাম না। একপর্যায়ে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, ইংরেজিতে লিখে দাদাভাইয়ের সামনে পেশ করব। তারপর কোনো এক বুধবারে আমরা বোনেরা একসাথ হলাম। দাদাভাই আমাদের কিছুক্ষণ পড়ালেন। তারপর ‘আমরা সবাই মিলে কক্সবাজারে গিয়ে আপনার কাছে পড়তে চাই’ কথাটি আমি ইংরেজিতে লিখে দাদাভাইয়ের সামনে পেশ করি। দাদাভাই কিছুক্ষণ লেখাটি দেখে বললেন, লিখতে তো পেরেছ, কিন্তু কী লাভ হল?
তারপর সম্ভবত বলেছিলেন, আরবীতে লিখলে খুশি হতাম। বা আমরা নিজেরাই বলাবলি করছিলাম, আরবীতে লিখলে দাদাভাই খুশি হতেন।
সাত. বুধবারের নিয়মিত মজলিস চালু হওয়ার আগে আমার পড়াশোনা বিষয়ে দাদাভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়। সে দিনটিও ছিল বুধবার। ১৪৪০ হিজরীর ১৫ই রবিউল আউয়াল।
আমি বললাম, দাদাভাই!
দাদাভাই বললেন, বলো, মানিক!
আমি বললাম, মানুষ বলে, কী পড় তোমরা? কোনো নিয়ম নেই, সিলেবাস নেই, ধারাবাহিকতা নেই!
দাদাভাই বললেন, যেসব মেয়ে দাওরা পাশ করে তারা কি খুব পারে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, দাদাভাই! মানুষ বলে, বুখারী খতম করলে কী সমস্যা?
দাদাভাই বললেন, কোনো সমস্যা নাই। তোমরা যেভাবে ঘরে থেকে পড়াশোনা করছ, সেভাবেই পড়াশোনা করো। তুমি মজবুত থাকো! খুব মজবুত থাকো! যারা এসব বলে তাদের বলবে, দাদাভাইয়ের কাছে পড়ি, আব্বুর কাছে পড়ি। ওদের কথায় কষ্ট পেয়ো না!
আট. দাদাভাই ৫৪ নং বাসা থেকে ৪০ নং বাসায় যাওয়ার পর প্রথম সোমবারে ৫৪ নং বাসাতেই মাহফিল হয়। মাহফিল শেষে দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাদুকে ৪০ নং বাসায় নিয়ে আসার পর দাদাভাই দাদুকে দেখতে আসেন। সেখানে আব্বু-আম্মু, আমিসহ আরো কে কে যেন ছিল! দাদু তখন অনেকটাই স্বাভাবিক। মাহফিলে কে কী বয়ান করেছেন তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছেন।
আব্বু দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, আম্মা, আমার বয়ান শুনতে পেরেছিলেন?
দাদু বললেন, হাঁ, আমি তো সবার বয়ানই শুনেছি।
আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, বয়ান কি ঠিক ছিল, আম্মা!
তখন দাদাভাই খুব খুশি হয়ে জোরে জোরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আর কত দিন বাবু থাকবা? কেবল আব্বা আব্বা করো, কবে বড় হইবা?’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, পিতা পুত্র দুইজনেরই দাড়ি সাদা; কেমন পিতা হলে এই বয়সেও পুত্রের সাথে এমন সম্পর্ক থাকতে পারে?!
নয়. আমি একদিন দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদা ভাই! আপনি কীভাবে তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠেন, আমি তো পারি না?
দাদাভাই বললেন, আল্লাহকে বলবে। দুআ করে ঘুমাবে, ‘আয় আল্লাহ! আমাকে তাহাজ্জুদ পড়ার তাওফীক দিন!’ তখন উঠতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
দশ. বেশিরভাগ সময় আমরা কিছু করলে দাদাভাইকে দেখাতাম বা জানাতাম। এক রমযানে আমাদের তারাবীতে খতম হওয়ার পর দাদাভাইকে জানাই। দাদাভাই শুনে বললেন, তোমাদেরকে পুরস্কার দিতে হবে। বলো কী পুরস্কার চাও?
আমরা একটু চিন্তা করে বললাম, আমরা সবাই একসাথে ঘুরতে যেতে চাই!
দাদাভাই বললেন, হবে ইনশাআল্লাহ।
এরপর আমাদের সবার একসাথে কক্সবাজারে যাওয়া হয় আলহামদু লিল্লাহ।
প্রোগ্রাম ঠিক করার সময় সবার ইচ্ছা ছিল, একসাথে বাসে বা ট্রেনে যাওয়া হোক। এরইমধ্যে এটা বাতিল হয়ে গেল। কিছুদিন পর আবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে দাদাভাই বললেন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের আব্বা ইয়াকুব আ. তাঁর সন্তানদের কী বলেছিলেন? বলেছেন—
وَ قَالَ يٰبَنِيَّ لَا تَدْخُلُوْا مِنْۢ بَابٍ وَّاحِدٍ وَّ ادْخُلُوْا مِنْ اَبْوَابٍ مُّتَفَرِّقَةٍ.
হে আমার পুত্রগণ! তোমরা (নগরে) সকলে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না; বরং ভিন্ন-ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। —সূরা ইউসুফ (১২) : ৬৭
পরে আমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে গেলাম, আলহামদু লিল্লাহ।
কক্সবাজারে যাওয়ার পর দাদাভাই আমাদের দরস করিয়েছিলেন। দরসে আমাদেরকে একটা বাক্যের আরবী করতে বললেন। বাক্যটা ছিল, ‘সমস্ত প্রশংসা তাঁর, যিনি আমার দাদাভাইকে তাঁর দেওয়া ওয়াদা পূরণ করার তাওফীক দিয়েছেন।’
আমাতুল গফূর
[হযরতের ছোট মেয়ের বড় কন্যা]
আমার বয়স ছয় কি সাত বছর। আমরা তখন দেড় তলায় থাকি। একদিন আম্মু কোনো কারণে আমাকে বকা দিয়েছেন। তখন আমি রাগ করে বাসার ভেতরে একতলা থেকে দেড় তলায় যাওয়ার যে দরজা, সেটা বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলাম। নানাভাই বাসার বাইরের দিক দিয়ে দেড় তলায় যাওয়ার যেই দরজা সেটা খুলে আমাকে ডাকা শুরু করলেন। আমি নিচে নেমে আসার পর আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়েছেন; কেন আমি আম্মুর সাথে রাগ করেছি?
আমাতুল গাফফার
[হযরতের ছোট মেয়ের ছোট কন্যা]
এক. কয়েকদিন আগেই মাত্র ৫৪ নম্বর বাসা ছেড়ে চলে এসেছি। নতুন বাসায় একদিন আমি নানাভাই রাহ.-কে নানুর ঘর থেকে নানাভাইয়ের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। নানাভাই আশেপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন...। হঠাৎ দেখি, নানাভাই নিচের দিকে চোখ নামিয়ে ফেলেছেন। খেয়াল করলাম, রান্নাঘরের দরজা খোলা, বুয়াকে দেখা যাচ্ছে।
এরপর আমি নানাভাইকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিলাম ।
এটা দেখে আমার মনে হল, নানাভাই এই বয়সেও চোখের কত হেফাযত করেন।
দুই. আমরা প্রতি বুধবার নানাভাইয়ের কাছে পড়তাম। তিনি বেশিরভাগ আরবী-উর্দু পড়াতেন। ইংরেজি একদম পড়াতে চাইতেন না। প্রসঙ্গ আসলেও বলতেন, এগুলো পড়ে কী লাভ? কোনো সওয়াব নাই! কোনো ফায়দা নাই!!
যদি আমরা কখনো অনুরোধ করতাম তখন একটু পড়াতেন। তখনো একই কথা বলতেন, এগুলা পড়ে কী লাভ? কোনো সওয়াব নাই! কোনো ফায়দা নাই!!...
আর যদি আমরা একজন অন্যজনকে কিংবা নানাভাইকেই কোনো ইংরেজি বা বাংলা শব্দের বানান জিজ্ঞেস করতাম, নানাভাই বলতেন, আমি কি তোমাদেরকে এগুলো শিখিয়েছি? যা পারো তাই-ই লেখো!
নানাভাই আমাদের দশ জনকে GEOMETRY-BOX দিয়েছিলেন। কিন্ত কখনো ওটা পড়াতেন না। আমরা যদি বলতাম, নানাভাই এটা পড়ান, তাহলে শুধু কোন্টা দিয়ে কী করতে হয়, সেটা দেখাতেন! সাথে এ-ও বলতেন, এগুলো পড়ে কী লাভ? কোনো সওয়াব নাই! কোনো ফায়দা নাই!
আমাতুর রহমান বিনতে রিজওয়ানুর রহমান
এক বুধবারে আমরা পড়ছিলাম। আমাদের যে পড়াচ্ছিল তার একটা ভুল হয়ে গেল। আমাদেরও খুব হাসি পেল। সবাই খুব হাসতে থাকি। আমি ছিলাম দাদাভাইয়ের একদম চোখের সামনে। কিতাব দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখি, দাদাভাই আমাকে দেখে ফেলেছেন। দাদাভাই রাগ হয়ে বললেন, এত হাসি কেন? তারপর আয়াতটা পড়লেন—
فَلْيَضْحَكُوْا قَلِيْلًا وَّ لْيَبْكُوْا كَثِيْرًا.
সুতরাং তারা (দুনিয়ায়) কিঞ্চিৎ হেসে নিক। অতঃপর তারা (আখিরাতে) অনেক কাঁদবে। —সূরা তাওবা (৯) : ৮২
দাদাভাইয়ের রাগ দেখে আমাদের হাসি থেমে গেল। কিছুক্ষণ দরস চলার পর দাদাভাই তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজনের কথা জানালেন। তাঁকে শোওয়ানোর ব্যবস্থা করা হল। এরই মধ্যে দাদাভাই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এরপর কী যেন বলছিলেন! পরে বোঝা গেল আমাকে ডেকেছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। দাদাভাই আবার আমার হাত ধরে আয়াতটি পড়লেন—
فَلْيَضْحَكُوْا قَلِيْلًا وَّ لْيَبْكُوْا كَثِيْرًا.
তারপর আরো কী কী যেন বললেন, আমি বুঝতে পারিনি।
বিনতে মাসীহুর রহমান
এক. ছোটবেলায় দাদাভাই যখন হজ্ব-উমরাহ করে বাসায় ফিরতেন তখন আমরা সবাই দাদাভাইয়ের সাথে মুসাফাহা করার জন্য আগে থেকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তারপর দাদাভাইকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যেতাম। দাদাভাই আমাদের দেখে খুব খুশি হতেন।
দুই. আমার বয়স তখন তিন কি চার। একদিন আমাদের আজিমপুরের বাসায় দাদাভাই গিয়েছেন। দাদাভাই বাসার ভেতর জুতা নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। আমি দাদাভাইকে দেখে বললাম, আমরা বাইরের জুতা নিয়ে ঘরে ঢুকি না।
আব্বু-আম্মু বললেন, কিছু হবে না।
দাদাভাই তখন হাসলেন। জুতাটা ওখানে রেখেই আমার হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন। এর কয়েকদিন পর যখন দাদাভাই আমাদের বাসায় এলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, জুতা কি এখানে রেখে যাব, নাকি ঘরে নিয়ে যাব?
আমি বললাম, এখানেই রেখে যান!
দাদাভাই কিছুই বললেন না; বরং জুতা রেখে হাসিমুখে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আমাতুর রহীম বিনতে রিজওয়ানুর রহমান
পড়াশোনার জন্য দাদাভাই কখনো আমাদের বকাঝকা করতেন না। সব সময় উৎসাহ দিতেন। না পারলেও পুরা নম্বর দিতেন। রাইট দিতেন। এ+ দিতেন। শুরুর দিকে আমি একদমই বাংলা পারতাম না। বাংলা বর্ণমালার নামও জানতাম না। এখনো অনেক বর্ণের নাম জানি না। আমরা যেসব বোনেরা দাদাভাইয়ের কাছে পড়তাম তাদের মধ্যে আমিই সবার ছোট। প্রতি বুধবারে দাদাভাই আমাদের ‘মুনাজাতে মাকবুল’ থেকে বুধবারের মনযিল পড়াতেন। শুরুর দিকে আমার পড়তে অনেক কষ্ট হত। প্রচুর ভুল হত। তার পরও দাদাভাই বেশিরভাগ সময়ে ‘মুনাজাতে মাকবুল’ আমাকে দিয়েই পড়াতেন। আলহামদু লিল্লাহ, ধীরে ধীরে খুব সহজ হয়ে যায়। এখন বুধবারের মনযিল কেমন যেন মুখস্থ!
আরেক বুধবারের কথা। দাদাভাই আমাকে ‘বেহেশতী জেওর’-এর বাংলা তরজমা থেকে পড়তে দিলেন। আমি বাংলা ঠিকমতো পড়তে পারতাম না, তাই অনেক ভুল হচ্ছিল। একপর্যায়ে আমি পড়লাম, মস মস্তা মস্তাহাব। দাদাভাই শুনে অনেক হাসলেন। তাঁর হাসিতে হুইলচেয়ার নড়া শুরু করল।
প্রথম প্রথম দাদাভাই যখন অনিয়মিতভাবে বোনদের পড়াতেন, তখন কেবল হাফেযা বোনদের পড়াতেন। আমি যেহেতু হাফেযা নই, তাই প্রথম বুধবারে আমাকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু দাদাভাই অন্য বোনদের বললেন, ওকে নিয়ে আসনি কেন?
আমার বোনেরা বলল, ও তো এখনো হাফেযা হয়নি।
দাদাভাই বললেন, আমি কি ওকে আনতে নিষেধ করেছি?
আলহামদু লিল্লাহ, পরের বুধবার থেকে আমি নিয়মিত যেতে থাকি।
মাওলানা আব্দুল্লাহ আকরাম
[হযরতের বড় ছেলের বড় জামাতা]
এক. দাদাভাই রাহ.-এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ২০০২ সালে হজ্বের আগের এক রবিবার বুয়েটের হজ্ব মাহফিলে। সে বছরই দাদাভাইয়ের সাথে হজ্বের সফরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়।
দাদাভাই সফরে থাকা অবস্থায় সবার প্রতি সমান খেয়াল রাখতেন। ১২০ জনের পুরো কাফেলার মাঝে আমি সবার ছোট। তখনো পর্দার বয়স হয়নি। তাই দাদাভাই আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন— আমাকে পুরুষ এবং মহিলাদের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে হবে।
এছাড়া পুরুষদের কাছে কোনো খাবার আসলে তা বণ্টন করা, মহিলাদের কোনো ধরনের অসুবিধা হচ্ছে কি না— তা জানা। মাহফিলের সময় মাইক ঠিকভাবে চলছে কি না— দেখা।
সাধারণত বাইতুল্লাহর সফরে দাদাভাইয়ের কাফেলায় প্রতিদিন মাহফিলের ব্যবস্থা থাকত। মাহফিলের আলোচনার মাঝে মহিলাদের কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে তা শুনে দাদাভাইয়ের কাছে পৌঁছানো এবং কারো কোনো কিছু বোঝার থাকলে দাদাভাইকে জানানো। কেউ কোনো চিরকুট দিলে তা দাদাভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি।
এভাবে সফরটা খুবই বরকতপূর্ণ হয়ে গেল। অনেক ছোট থাকার কারণে হয়তোবা এদিক-সেদিক ঘুরে ফিরে সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তিনি আমার সফরটাকে শিক্ষণীয় সফরে রূপান্তরিত করে দিলেন।
দুই. ঐ সফরেই ১০ যিলহজ্ব কুরবানীর দিন দাদাভাই রাহ. ফায়সালা দিলেন, পুরুষরা সবাই মাযবাহে গিয়ে নিজ হাতে নিজের এবং তার মাস্তুরাতের কুরবানী করবে। তাই হলুদ রঙের দুটি বাস ভাড়া করা হল। সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমিও প্রস্তুত। কিন্তু ছোট বলে আমাকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না।
সবার অবস্থা দেখে আব্বুও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আমি তো নাছোড়বান্দা, যাবই। তাই সরাসরি দাদাভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না শুরু করলাম। তিনি আমার কান্নার কারণ জানতে পেরে হেসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। একেবারে বাসের ছাদে তুলে বুয়েটের এক চাচার পাশে বসিয়ে দিলেন। বাস মাযবাহে যাওয়ার পথে সবাই তেলের পাম্পে থামল। সেখানে হালকা নাস্তা করল। আমার নাম ছিল مُصَوِّر (মুসাওভির)। দাদাভাই আব্বুকে ডেকে বললেন, ওর নামটা সরাসরি আল্লাহর নাম হয়ে যায়, তাই শুরুতে আবদুন যুক্ত করো।
মুসাওভির আল্লাহর নাম। তাই ওর নামটা পরিবর্তন করা দরকার। শুরুতে আবদ যোগ করতে পারো। আব্বু বললেন, আপনি একটা নাম ঠিক করে দেন।
দাদাভাই বললেন, আল্লাহর কাছে প্রিয় নাম হল— ‘আবদুল্লাহ’ ও ‘আবদুর রহমান’, তুমি যে কোনো একটি নাম রাখতে পারো।
আব্বু বললেন, স্যার আপনি নির্ধারণ করে দেন।
তখন দাদাভাই আমার নাম রাখলেন ‘আবদুল্লাহ’।
সাথে সাথে মজা করে বললেন, সেলিম! ওর নতুন নাম রেখেছি, এখন তাহলে আরেকটি দুম্বা জবাই কর; বলে হেসে দিলেন।
যদিও দুম্বা জবাই করা জরুরি ছিল না; কিন্তু আব্বু আমার একটি সুন্দর নাম রাখা হয়েছে, এজন্য খুশিতে আল্লাহর শোকর আদায়ের জন্য একটি দুম্বা জবাই করলেন।
দাদাভাই রাহ. সব সময় সবার নামের প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। নাম সুন্দর কি না, নামের অর্থ সুন্দর কি না। নাম সুন্দর না হলে একটি সুন্দর নাম রেখে দিতেন। এগুলোর প্রতি খুব গুরুত্বারোপ করতেন। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের নাম, নবীদের নাম— এগুলো দাদাভাই খুব পছন্দ করতেন।
আল্লাহ তাআলা দাদাভাই রাহ.-এর কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন— আমীন।
মাওলানা আব্দুল্লাহ আফীফ
[হযরতের বড় ছেলের মেজো জামাতা]
এক. সম্ভবত ২০০৩ সালেই দাদাভাইকে ভালোমতো চিনতে পারি। আমার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। দাদাভাই মাদরাসার নাম লেখা মাইক্রোবাস পাঠিয়েছিলেন আমাকে আর আমার ভাইকে ধানমন্ডিতে মাওলানা মুস্তাফীয চাচ্চুর মাদরাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর বা তার কিছু বেশি সময় সম্পূর্ণ নিজ-খরচে এবং মাদরাসা থেকে উস্তাযদেরকে পাঠিয়ে সকাল-বিকাল যাতায়াতের ব্যবস্থা করতেন। ভাবলে খুব অবাক লাগে, হযরত আমাদের মতো নগণ্য থেকে নগণ্য ব্যক্তিবিশেষের পেছনে কী অকল্পনীয় মেহনত করে গিয়েছেন।
দুই. ২০০৬ সাল। আব্বু মনস্থির করলেন, আমাদের বাসা শেওড়াপাড়া থেকে মাদরাসার কাছাকাছি ধানমন্ডিতে নিয়ে আসবেন। বাসাও ঠিকঠাক। শুধু এ্যাডভান্স করা বাকি। এমতাবস্থায় আব্বু হযরতকে বিষয়টা জানালেন। হযরত বললেন, বাসা যখন পাল্টাবে, উত্তরাতেই চলে আসো। তাতে করে মাস্তুরাতরাও দ্বীনের ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারবে, ইনশাআল্লাহ। তখন থেকেই আমাদের উত্তরাতে পথচলা।
তিন. উত্তরাতে হিফযখানায় পড়ছি; আমার হিফযখানার উস্তায বললেন, পড়াশোনার অগ্রগতির জন্য মাদরাসায় থেকে পড়াশোনা করা জরুরি। একপর্যায়ে আব্বু হযরতের কাছে আমাকে মাদরাসায় রেখে পড়াশোনা করানোর অনুমতি চাইলেন।
হযরত স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আমার দিল চায়, মানিকরা তাদের আম্মুর আদরেই পড়াশোনা করুক, এমনটা করলেই ওদের জন্য ভালো হবে।
হযরত বললেন, ইনশাআল্লাহ, একদিন ওরা হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে হাফেয হয়ে যাবে। এরপর থেকে আমার শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময়ই বাসায় থেকে পড়াশোনা করার তাওফীক হয়েছে, আলহামদু লিল্লাহ।
চার. আব্বু নিজের কর্মক্ষেত্র বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করার পর হযরত আব্বুকে বলেছিলেন, ‘পাথরের ওপর কখনো শৈবালের জন্ম হয় না।’ অর্থাৎ পাথর যেহেতু স্থির থাকে না, তাই তার ওপর শৈবাল জন্ম নিতে পারে না। তিনি এর দ্বারা যেকোনো কাজের ওপর ইস্তেকামাতের সাথে লেগে থাকার প্রতি নির্দেশ করেছিলেন।
পাঁচ. কিতাব বিভাগে আসার আগ দিয়ে আমি মাদরাসা পরিবর্তন করার জন্য জেদ ধরেছিলাম। আম্মু বিষয়টা হযরতকে অবগত করেছিলেন। মনে পড়ে, সময়টা ছিল বাদ মাগরিব। হযরত ডেকে পাঠালেন। আমি ৫৪ নম্বর বাসার নিচ তলার বড় রুমে আব্বুসহ প্রবেশ করলাম। হযরত একাই রুমে শুয়ে ছিলেন। আমাদেরকে দেখে উঠে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মানিক?
যা বলার বললাম। হযরত পুরো কথা মন দিয়ে শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর ছোট একটা কথা বললেন, ‘শয়তানে কি চায় তার শত্রু তৈরি হোক।’
কয়েকবার কথাটা বললেন। এরপর বরকতের দুআ করে দিলেন। এরপর মাদরাসা পরিবর্তনের চিন্তা আমার মাথা থেকে পুরোপুরি গায়েব হয়ে গিয়েছিল।
ছয়. ২০০৬ সালের শেষ দিকে আমরা উত্তরায় হযরতের মাদরাসায় ভর্তি হই। ফজরের সময় আব্বুর সাথে ৩ নং সেক্টর জামে মসজিদে ফজরের নামায পড়তাম। এরপর মাদরাসায় উপস্থিত হয়ে সবক শুনাতে হত। হযরতের তখন একটি ছোট গাড়ি ছিল। সেডান গাড়ি। এরকম বহুবার হয়েছে, হযরত তাঁর সে গাড়িতে আমাদেরকে নিয়ে ৭ নং সেক্টরের লেক ও আশপাশে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। নিজেই গাড়ি চালাতেন। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর হযরত বলতেন, আজকের মতো এটুকুই থাক। মাদরাসায় যেতে বেশি দেরি করলে তোমার হুজুর আমাকে বকা দেবে। এ বলে আমাদেরকে মাদরাসায় নিয়ে আসতেন।
তখন খুব অবাক লাগত এই ভেবে, হযরতকে আবার কে বকা দিতে পারে?!
সাত. ২০০৮ সাল। আব্বুর কাছে একটি বড় অফার এল। আব্বুকে সৌদি আরবে একটি চাকরির প্রস্তাব করা হল। ওখানে বাড়ি-গাড়ি সবকিছুই বরাদ্দ থাকবে। এই হিসেবে আমাদের পরিবারের জন্য দুনিয়াবী দিক দিয়ে অনেক বড় অফার ছিল। আব্বু হযরতের কাছে সম্পূর্ণ বিষয়টা উপস্থাপন করলেন। হযরতের মতামত জানতে চাইলেন। হযরত কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর বললেন, আমি আর কী বলব?! মানিকদেরকে যদি আল্লাহর ওলী বানানোর ইচ্ছা না থাকে তাহলে ওখানে যেতে পার। আর যদি ওলী বানাতে চাও তাহলে দেশে থেকেই উপার্জন কর। আল্লাহ বরকত দেবেন ইনশাল্লাহ।
এরপর আলহামদু লিল্লাহ! আব্বুর কাছে ফিলিপাইনসহ আরো কিছু জায়গা থেকে অফার এসেছিল, কিন্তু আব্বু দ্বিতীয়বার আর বিদেশে গিয়ে উপার্জন করার কথা ভাবেননি। আল্লাহ আব্বুকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।
উম্মে উসাইদ
[হযরতের বড় ছেলের বড় বৌমা]
এক. ১৪৪৩ হিজরীর ১৮ই শাবান আমাদের বিবাহ হয়। বিয়ের পর প্রথম দিন দাদাভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। সাথে আমার ননদ উম্মে আউফসহ আরো অনেকে ছিলেন। সালাম কালামের পর দাদাভাই আমাকে বললেন—
وَ نَادٰۤي اَصْحٰبُ النَّارِ اَصْحٰبَ الْجَنَّةِ اَنْ اَفِيْضُوْا عَلَيْنَا مِنَ الْمَآءِ اَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ.
এখান থেকে পড়ো।
আমি বললাম, দাদাভাই আমি তো হাফিযা নই।
দাদাভাই উম্মে আউফকে বললেন, তুমি পড়ো। তিনি পড়লেন। তারপর দাদাভাই আমাকে বললেন, এই আয়াতের তরজমা করে শোনাও। আমি তরজমা করে শোনালে দাদাভাই অনেক খুশি হলেন। বললেন, মাশাআল্লাহ। এরমধ্যে আমার বড় ফুফু শাশুড়ি ঘরে ঢুকলেন। দাদাভাই তাকে বললেন, ও এ-প্লাস পেয়েছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কার কাছে পড়েছ? তখন আমার বড় ফুফু শাশুড়ি বললেন, ওর মামা মাওলানা ইমদাদুল হক সাহেবের কাছে ঘরে থেকেই পড়াশোনা করেছে। দাদাভাই এটা শুনে আরো খুশি হলেন।
মেয়েদের বাইরে না গিয়ে ঘরে থেকেই পড়াশোনা করাটা দাদাভাই খুব বেশি পছন্দ করতেন।
দুই. আরেকদিন আমরা দাদাভাইয়ের বাসায় গেলাম। দাদাভাই তখন বাইরে ছিলেন। আমরা খেতে বসার পর দাদাভাই ঘরে ঢুকলেন। আমি উঠে দাদাভাইয়ের কাছে গেলাম। দাদাভাই আমাকে বললেন, বসো, খাও, আমি তোমার খাওয়া দেখি। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন, তোমার শাশুড়ির ঘরে গায়রে হাফেয কেউ নেই, তুমিও হিফয করে ফেলো।
আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ।
তারপর আমি হিফয শুরু করে দিলাম।