আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ॥
হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান রাহ.
ভাইজান ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব তাঁর গ্রামেই কাটে। তখনই কথাবার্তায় এমন চটপটে ছিলেন যে, বড়রা তাকে ‘পাহাড়ী ময়না’ বলে ডাকতেন।
আমার দাদাভাই, নানাভাই দুজনই নামাযী ও কুরআন তিলাওয়াতে পারদর্শী ছিলেন। দাদাভাই উঠাবসা, খাওয়া দাওয়ায় দৈনন্দিনের সুন্নতগুলো পাবন্দির সাথে পালন করতেন।
ছোটবেলায় মক্তবের উস্তায হিসেবে জনাব মকবুল হোসাইন সাহেব রাহ.-কে পেয়েছিলেন। যিনি ফজরের পর থেকে যোহর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বীনী তালীমে মগ্ন থাকতেন। তিনি ও আমাদের গ্রামের অধিকাংশ লোক জৈনপুরী পীর সাহেবের সাথে সম্পর্ক রাখতেন।
আমার আব্বা রেলওয়ের মেইল সার্ভিসের সর্টার হিসেবে চাকরি করতেন। সে সুবাদে তাকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিশেষ করে চাঁদপুর, দোহাজারী, আসাম ইত্যাদি স্থানে অবস্থান করতে হত।
বড় ভাইজানের চাঁদপুর অবস্থানের স্মৃতি অত্যন্ত মধুর। বৃদ্ধ বয়সেও চাঁদপুর গেলে গনি স্কুলের পাশে আমাদের যে পুরোনো বাড়িটা আছে, যে মসজিদে মুআযযিনের অনুপস্থিতিতে ভাইজান আযান দিতেন, যে খালে তার প্রিয় ‘ছাবেদ নানাভাই’ (আব্বার দূরসর্ম্পকীয় আত্মীয়— যিনি আব্বার কাছে থাকতেন)-এর সাথে মাছ ধরতেন, তা সফরসঙ্গীদের দেখাতেন এবং পুরোনো স্মৃতির কথা বলতেন।
আমার আব্বা আলেম-ওলামাদের খুব সম্মান করতেন, তাদেরকে বাসা থেকে তরি-তরকারী রান্না করে পাঠাতেন। আওলাদে রাসূল মুস্তফা আলমাদানী সাহেবকে বেদআতীরা হত্যার নিয়তে জখম করে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেয়। তাকে মাঝিরা উদ্ধার করে চাঁদপুর হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসাকালে তাঁর সেবার জন্য আমার বাবা-মা বড়ভাইজানকে হাসপাতালে পাঠাতেন।
তরুণ বয়স থেকেই ভাইজান কুরআন পাঠে পারদর্শিতা অর্জন করেন। আমার আব্বার অভ্যাস ছিল, সময় পেলেই কুরআন তিলাওয়াত করা। এরপর বড় ভাইজান আমাদের পড়ার নেগরানি করতেন।
ভাইজান যখন ক্লাস সেভেন/এইটে পড়েন, তখনকার একটা ঘটনা প্রায়ই বলতেন। ঢাকা ভার্সিটির কার্জন হলের পূর্ব দিকে (এখন যেখানে ড. শহীদুল্লাহর মাকবারা আছে, তার পাশে) দোতলা মসজিদে আসরের নামায আদায় করতে যান। নামায শেষে আবদুল হাকিম সাহেবের তাফসীরের একটি পাতা উল্টাতে তার চোখে পড়ে, আমার কী যুক্তি আছে যে, আমি সেই সত্তার এবাদত করব না, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন? এবং তাঁরই দিকে তোমাদের সকলকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। [সূরা ইয়া সীন (৩৬) : ২২]
এর পর থেকে তাঁর তিলাওয়াত কমে যায়; তাফসীর পড়ার প্রতি মন ঝুঁকে পড়ে। বিষয়টি আব্বার নজরে পড়ে। আব্বা ভাইজানকে তাম্বীহ করেন, যেন তিনি তিলাওয়াতে মগ্নতা বাড়ান।
আব্বা বড় ভাইজানকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে ভৈরব, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় কেরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পাঠাতেন। তিনি এসব প্রতিযোগিতায় একা একাই সফর করতেন। কখনো সফরের স্থানে আত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতেন।
১৯৫১ হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আমরা ঢাকাতেই থাকতাম। নবাবকাটারা রোডে নিমতলীতে আমাদের বাসা ছিল। বড় ভাইজান বড় কাটারা মাদরাসা সংলগ্ন ইসলামিয়া হাইস্কুলে পড়তেন। স্কুলটা সমসাময়িক শিক্ষার্থীদের কাছে ‘পচা’ স্কুল হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে মাওলানা দ্বীন মুহাম্মাদ সাহেবের মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রধান শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক হযরত মাওলানা আতহার আলী ছাহেব রাহ.-কে নিজেদের শায়েখ হিসেবে বিবেচনা করতেন। মাওলানা আতহার আলী ছাহেব রাহ.-এর বড় কাটারা মাদরাসার সাথে অবস্থিত এই স্কুলেও আসা যাওয়া ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভাইজানের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ ছিলেন। ভাইজান ওই স্কুলে পড়তে অনীহা প্রকাশ করলেও শিক্ষকদের পরামর্শে আর স্কুল পরিবর্তন করেননি। এখান থেকেই মেট্রিক পাশ করে ঢাকা কলেজে আইএসসি ক্লাসে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে আব্বাজান কলেরা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। আব্বাজানের ইন্তেকালের পর আমাদের ঢাকা ছেড়ে মুন্সিগঞ্জ চলে যেতে হয়। মুন্সিগঞ্জে আমাদের ঘর ছিল। মা আমাদের নিয়ে আলাদা বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। বড় হুজুরের (প্রফেসর হযরত রাহ.) মুখে শুনেছি, বাবার মৃত্যুর পরদিন এক ভদ্রলোক আমাদের ঘরের দরজায় নক করলেন। বড় হুজুর রাহ. দরজা খুললেন। সালাম দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, তোমার আব্বা গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। তারপর বললেন, তিনি অনেক ভালো লোক ছিলেন। তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর চলে গেলেন। যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ভাইজান তাকে কখনো দেখেননি, তাকে চেনেনও না।
বড় ভাইজান ঢাকা কলেজের হোস্টেলে সিট পাচ্ছিলেন না। কলেজের রেজিস্টার সাহেবের কাছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সুপারিশ করেছে। কিন্তু তিনি সিটের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। তবে বিষয়টি তিনি প্রিন্সিপাল সাহেবকে জানালেন। প্রিন্সিপাল জনাব ফজলুর রহমান, পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তাকে কিছু বলতে যাওয়া অনেক সাহসের কাজ ছিল। কিন্তু বড় হুজুরের করুণ অবস্থা দেখে রেজিস্টার সাহেবের অনেক মায়া হয়েছিল। তাঁর সুপারিশে প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, তাকে ক্লাস শেষ হলে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন।
ক্লাস শেষে বড় ভাইজান তার সাথে দেখা করলেন। তিনি বাসায় যেতে গাড়িতে উঠছিলেন। বড় ভাইজানকে বললেন, গাড়িতে ওঠ।
বড় ভাইজান গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে করে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। বললেন, দোতলায় গ্যারেজের উপরতলার রুমটাতে থাকবি। পড়াশুনা করবি, কলেজে যাবি আর খাওয়ার সময় হলে ড্রয়িংরুমে এসে খেয়ে যাবি। তোর আর কোনো দায়িত্ব নেই।
ঢাকায় এ ঠিকানা প্রাপ্তির পর বড় ভাইজান মাকে জানালেন। সদ্য এতীমের এমন অপ্রত্যাশিত ঠিকানায় অভিভূত হয়ে মা বললেন, যাও ওখানেই থাক। মানুষের মতো মানুষ হয়ে থেক।
এই পরিবারের সাথে পরবর্তীতে বড় ভাইজান ও আমাদের এমন সম্পর্ক হয়, যা আপনজনের মধ্যেও হয় না। বড় হুজুর এই পরিবারের বড় সন্তানের মতো বিবেচিত হতেন। প্রিন্সিপাল সাহেব ও তাঁর স্ত্রী বড় ভাইজানকে আপন সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তাঁর সন্তানরা বড় ভাইজানকে আপন বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করত। পরিবারের যেকোনো সমস্যায় বড় ভাইজানকে ডেকে পাঠাত। বড় ভাইজানের ফায়সালা সবাই মেনে নিত।
১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ওয়াপদার চাকরির সুবাদে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে পোস্টিং ছিল। এ সময় মা ও আমাদের দুই ভাইসহ পাওয়ার হাউজের একটা সি টাইপ বিল্ডিংয়ে বাসা পেলেন। এ সময় পরিশ্রমী, মেধাবী ও চৌকষ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন একদল ইঞ্জিনিয়ার জানপ্রাণ শ্রম দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজকে ত্রুটিমুক্তভাবে সচল রেখেছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে তাদের অধিকাংশই একে একে চাকরি ছেড়ে চলে যান, এর মধ্যে বড় হুজুরও ছিলেন। তখন তিনি মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বাসা ভাড়া করলেন মগবাজার এলাকায়। চাকরি নিলেন ব্রিটিশ কোম্পানিতে। ভালো বেতন। কোম্পানি থেকে গাড়িও পেলেন। এ সময় মায়ের পরামর্শে বাড়ি থেকে রোগে শয্যাগত দাদাভাইকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। দাদি আগেই ইন্তেকাল করেছেন। দাদাভাইকে দেখাশোনা ও পরিচর্যার দায়িত্ব গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজন বহন করতে পারছিল না।
সকাল-সন্ধ্যায় অফিসে যাওয়ার আগে ও অফিস থেকে এসে দাদাভাইয়ের সার্বিক খেদমতে ঐকান্তিকভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতেন। দাদাভাইয়ের আন্তরিক দুআ পেলেন, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে কাজে এসেছে। এ সময় দাদাভাই বড় ভাইজানের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন-
‘আমার খেদমত করে কী পেলি- তা শীঘ্রই দেখতে পাবি।’
বুয়েট কোয়ার্টারে থাকাকালে অসুস্থ অচল নানাভাইকেও আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। তিনিও আমৃত্যু আমাদের বাসায় ছিলেন। মা ও ভাইজানের আত্মীয়-বাৎসল্য ছিল অতুলনীয়।
বড় হুজুর নিকট আত্মীয়দের জন্য এতটা আন্তরিক ছিলেন যে, কে ছোটবেলায় বাবার অবর্তমানে আমাদের খোঁজ নিয়েছে বা নেয়নি- তার দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল করতেন না। আত্মীয়-পরিজনে সদা ভরপুর থাকত আমাদের বাসা। সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে বিন্দুমাত্র অনীহাবোধ করতেন না তিনি। এ কাজে আমার মা তাঁকে সর্বদা উৎসাহিত করতেন।
উপরে যা লিখলাম, তা ভাইজান ও মায়ের সংগ্রামী জীবনের সামান্য আলেখ্য মাত্র। লেখা সংক্ষিপ্ত করার জন্য এবার আমার সাথে সরাসরি ঘটেছে এমন কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি-
এক. ঊনিশ শ একাত্তর সালের ২৬ মার্চ পাকসেনাদের ক্র্যাকডাউনের পর ২৯ তারিখে আমাদের পরিবার ও ভাইজানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোলাইমানুল মাহদীর পরিবার ঢাকা ত্যাগ করে জিঞ্জিরা চলে যায়। বুড়িগঙ্গা অতিক্রমে বাধা দিচ্ছিল পাকসেনারা। গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটে এ সময়। আমার এক চাচাতো ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা জনসংখ্যার ভীড় বাড়তে থাকলে জিঞ্জিরা পাকসেনাদের আক্রমণের টার্গেটে পরিণত হয়। এ পরিস্থিতিতে পরদিন নৌকা ভাড়া করে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হই আমরা। নৌকায় দুটি পরিবার ছাড়াও কাজের বুয়াদের পরিবারও ছিল। মানুষ বোঝাই নৌকা বৈঠা বেয়ে অগ্রসর হতে দেরি হচ্ছিল। গুন টেনে নৌকা সামনের দিকে অগ্রসর করতে হচ্ছিল। এ গুন টানায় বড় ভাইজানও শামিল হয়েছিলেন। সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই বড় ভাইজান বড় চাচির সকাতর অনুরোধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চাচাতো ভাইয়ের খোঁজে ঢাকায় ফিরে আসেন।
দিনে নদীর তীরে লাশের স্তুপে ভাইয়ের লাশ খোঁজা আর রাতে কাকরাইল মসজিদে অবস্থান। এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার একপর্যায়ে আমাদেরকে না জানিয়ে তিনি তিন চিল্লার জামাতে পাকিস্তান চলে যান। এ খবর নিয়ে কাকরাইলের মুরব্বিদের এক জামাত মুন্সিগঞ্জে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
দুই. পানির প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব টান। বিগত বছরগুলোতে মুন্সিগঞ্জে, আমাদের গ্রামের বাড়ীতে যেতেন প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবারে। ‘মৌলভী মকবুল হোসাইন মক্তবে’র বাচ্চাদের সাথে বসবেন, তাদের জন্য আলাদা আলাদা বোর্ডে বিভিন্ন কায়দার বিভিন্ন ‘তখতি’ লিখে পড়াবেন। বাড়িতে এসে বেশ কয়েকবার নদীতে গোসল করতে সাঁতার কাটতে গেছেন। লক্ষ্মীপুরের এক সফরে পুকুরে গোসল করতে নেমেছেন।
একদিন ফজরের নামাযের জন্য তৈরি হচ্ছি ঢাকায়। মোবাইলে অনেকগুলো মিসড্কল। গতরাতে ভাইজান মুন্সিগঞ্জে ছিলেন, সাথের খাদেমদের নম্বর থেকে কল এসেছে। কিছুটা হতভম্ব হলাম। কী হল। ভাইজানের কিছু হল নাকি! ফজর পড়ে এসেই কল ব্যাক করলাম। ভাইজান বললেন, মুন্সিগঞ্জ আসো।
ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠলাম। কী হল। ড্রাইভার ডেকে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম। রাস্তা ফাঁকা ছিল। অল্প সময়েই পৌঁছলাম ভাইজানের কাছে। কাছে গেলাম, কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজান আপনি কেমন আছেন?
বললেন, আলহামদু লিল্লাহ, খুব ভালো আছি।
এরপর আমাকে তার পাশে শুতে বললেন। শুয়ে পড়লাম নিঃশব্দে। বললেন, ঘুমাও।
ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কই কিছু তো বললেন না, কী জন্য আসতে বলেছেন। চোখ বুজে কাটালাম ঘণ্টাখানেক। ঘণ্টাখানেক পর বললেন, ওঠ।
উঠলাম। আমার যে চাচাতো ভাই গ্রামে গেলে ভাইজানের কাছাকাছি থাকত, তাকে বললেন, লুঙ্গি আনো, গামছা আনো, আমাকে নিয়ে নদীরঘাটে চলো। আমি সাঁতরাব।
আজীব হালত। ভাইজানের সঙ্গীরা সবাই সাঁতার জানে, তার পরও আমাকে ঢাকা থেকে ডেকে আনা হল! কী কারণ!
হয়তো এজন্য যে, নদীতে নামার সময় মাশহুদ যেন কাছে থাকে। এটা আমার জন্য কত সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। সেদিন নামলেন নদীতে, সবার সহযোগিতায় কতক্ষণ সাঁতার কাটলেন, এক সময় বললেন, হয়েছে, চল বাড়িতে যাই।
হযরতের যিন্দেগীতে সাদামাটা এমন অনেক ঘটনা আছে। যেগুলোকে আমরা হযরতের শুধু ঘটনাই মনে করি। কিন্তু এতে উনার অনেক উঁচু ও সূক্ষ্ম নিয়ত থাকে।
হযরতের যিন্দেগীর আরেকটি বড় দিক ছিল কারো ‘বারে খাতের’ না হওয়া। নিজের কোনো বিষয়ে যাতে অন্যের জন্য কষ্ট বা বোঝার কারণ না হয়- এটার প্রতি এত সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন যা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। আর যার সঙ্গে পূর্ণ ‘বে তাকাল্লুফ’ ছিলেন এবং এই ‘বে তাকাল্লুফি’ উভয় দিক থেকে হওয়ার পূর্ণ ইতমিনান থাকত তার সঙ্গে কখনো ‘বে তাকাল্লুফ’ আচরণও করতেন।
তিন. তারার সাথে যেন ছিল তাঁর মহব্বতের সম্পর্ক। বলতেন, আকাশের তারাগুলো সাহাবীদেরকে দেখেছে। তাই ওদের দেখতে আমি ভালবাসি। প্রায় প্রতি রাতেই তারা দর্শনে খোলা আকাশের নিচে যেতেন।
বহু তারায় সুশোভিত রাতের আকাশ দর্শনের জন্য একবার রাজশাহীর এক সফরে রাস্তার পাশে গাড়ি থামানো হল। কয়েকটি গাড়ির বহুসংখ্যক সফরসঙ্গীর এমন সমাবেশ দেখে হাইওয়ে পুলিশ তাদের গাড়ি থামাল। কাছে এল। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানল, আমরা তারা দর্শনে বিভোর এক জামাত, যাদেরকে বড় হুজুর দেখাচ্ছেন, কোন্ তারা কোথায়, কী তাদের নাম?
পুলিশ বাকরুদ্ধ, এ আবার কেমন সমাবেশ!
এ সমাবেশের হাকীকত তো তারাই বুঝবে যাদের কুরআনে বর্ণিত ‘উলুল আলবাব’-এর সিফাত সম্পর্কে ধারণা আছে। এসব মুহূর্তে হযরত অনেক সময় কুরআন শরীফের এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন-
اِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الَّيْلِ وَ النَّهَارِ وَ الْفُلْكِ الَّتِيْ تَجْرِيْ فِي الْبَحْرِ ...
নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে, রাত দিনের একটানা আবর্তনে, সেই সব নৌযানে যা মানুষের উপকারী সামগ্রী নিয়ে সাগরে বয়ে চলে, সেই পানিতে যা আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেছেন এবং তার মাধ্যমে ভূমিকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেছেন ও তাতে সর্বপ্রকার জীব-জন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং সেই মেঘমালাতে যা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে আজ্ঞাবহ হয়ে সেবায় নিয়োজিত আছে, বহু নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য যারা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগায়। -সূরা বাকারা (০২) : ১৬৪
চার. বগুড়ার খলিল চাচার বাড়ির ছাদে গিয়ে তারা দর্শনের সেশনটি ছিল অদ্ভুত। চারদিকে খলিল চাচার ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্সের সকল বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করা হল। বড় হুজুরকে ছাদে শোয়ানো হল। কেননা বসে বসে তারা দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর নির্দেশে তাঁর শোয়ার দিক পরিবর্তন করা হল।
তিনি সবাইকে শেখাচ্ছেন, ওই যে আদম সুরত। ওই যে প্রক্সিমা সেন্টুরাই। ওই দেখা যায় ধ্রুব তারা।
আঁধার রাতের এই প্রহরীদের চেনানোর সেশনে উপস্থিত সকলে অনুভব করল, তাঁর সম্পর্ক কাদের সাথে? যারা দিনে কোলাহলে অদৃশ্যমান আর রাতের অন্ধকারে বিদিশার দিশা। নিরিবিলি কাজ করে যাচ্ছেন প্রভুর হুকুমে। মেনে যাবেন তাঁর নির্দেশনা কিয়ামত অবধি।
বড় হুজুরের সাথে চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল, চরফ্যাশন (ভোলা) ইত্যাদি সফরের সময় গভীর রাতে লঞ্চের ডেকে বসে বসে চাঁদ দেখার সেশনগুলো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
পাঁচ. বড় হুজুর যাত্রাবাড়ি যাচ্ছেন দাওয়াতুল হকের মাসিক উমারাদের সভায় উপস্থিতির জন্য। আমিও আছি একই গাড়িতে। গাড়িতে দাওয়াতুল হকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমার কথায় গীবত হচ্ছিল আমার অজান্তে। ভাইজান আমাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। আমার কথা বন্ধ হচ্ছিল না। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে এই বলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন, তোমার যাত্রাবাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই; তুমি বাসায় চলে যাও।
গীবত কোনোক্রমেই সহ্য করতে পারতেন না বড় হুজুর।
ছয়. হজ্বের সফরে আমি যতবারই বাথরুমে যাই, ফিরে ইহরামের কাপড় পাল্টাই। ভাইজান বিষয়টা খেয়াল করে আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, কী কারণে আমি এমন করছি।
বললাম, পরনের কাপড়টাতে নাপাকি লেগেছে কি না- এই সন্দেহে।
ভাইজান বললেন, এমন ওয়াসওয়াসা ঠিক নয়। নাপাকির ব্যাপারে নিশ্চিত না হলে নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ইহরাম বা অন্য পরিধেয় কাপড় পাল্টানোর বাড়তি কাজে অভ্যস্ত হয়ো না।
এভাবে ওয়াসওয়াসা রোগের চিকিৎসা করলেন বড় হুজুর।
সাত. অন্য এক হজ্বের সফরে। মিনা থেকে আরাফার ময়দানে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। সে সফরে বেশ কয়েকজন মাস্তুরাত ছিল। একটা করে বাস আসে, হাজ্বী সাহেবরা হুড়মুড় করে ঠেলে ধাক্কিয়ে মহিলা পুরুষ গাদাগাদি করে বাসে উঠে যায়। আর বড় হুজুর আমাদের বললেন, সবর করো।
বাস আসে, বাস যায়। মিনা খালি হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু আমরা বাস পাচ্ছিলাম না। পুলিশ হাঁকডাক করছে, আর বাস নেই, বাস নেই। বাস আর আসবে না, ঠেলে ধাক্কিয়েই উঠতে হবে।
একসময় আমরাও হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বড় হুজুর বললেন, সবর কর, মেয়েদের নিয়ে আমরা কখনো গাদাগাদি করে উঠব না।
দুপুর হয়ে গেল, বাস নেই। পুলিশ, মুআল্লিমের লোক সবাই চিৎকার করছে— হাজ্বী, হজ্ব পাবে না; বাসের জন্য দেরি করলে আরাফায়ে যেতে পারবে না।
বহুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি মিনার ময়দানে। সত্তর-আশি জন নারী ও পুরুষ। হতাশার এই পর্যায়ে হঠাৎ দেখি একসাথে কয়েকটা বাস চলে এসেছে, একদম খালি। আল্লাহু আকবার। ধীরেসুস্থে সবাই উঠে বসলাম বাসে। মাশাআল্লাহ যথাসময়ে আরাফাতের ময়দানে গিয়ে পৌঁছলাম।
ভাইজান হজ্বের সফরে এসব পরিস্থিতিতে সকল কাজে সবার শেষে থাকতেন। শুধুই সবরের তালীম দিতেন। হজ্বের সফরে সাথীদের বাদ এশা একটু আরাম করে নিতে বলতেন। গভীর রাতে তাওয়াফ-সাঈ করতে বেরুতেন। তাওয়াফ-সাঈ শেষে জামাতকে ঘড়ি চত্বরে এসে জড়ো হতে বলতেন। বড় হুজুরের সাথে হজ্ব করার সময় আজীব এক অবস্থা বিরাজ করত।
আট. পারিবারিক সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে বড় হুজুরের উদ্যোগ ছিল অতুলনীয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনায় শরীক থাকতেন। সমাধানের চূড়ান্ত পর্যায়ে হযরত মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবকে ডাকতেন। চূড়ান্ত ফায়সালার জন্য মাওলানার ওপর নির্ভর করতেন।
এধরনের কয়েকটি ঘটনায় বড় ভাইজানের নির্দেশে আমিও উপস্থিত ছিলাম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া নিষ্পত্তি হত। এক দম্পতির দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের মধ্যে মিল হবে কল্পনায়ও আসেনি আমার।
আলহামদু লিল্লাহ! সেই সংসারে মিল হয়েছে, নতুন সন্তান জন্ম নিয়েছে। তারা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে।
আলোচনাগুলোতে লক্ষ করতাম বড় হুজুর মেয়েদেরকে, মেয়েদের মতামতকে কল্পনাতীত সম্মান দিতেন। একইসাথে পারিবারিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আলেমদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের উদ্বুদ্ধ করতেন।