হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান রাহ. ॥
কর্মে কীর্তিতে অমর থাকবেন যিনি
হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেবকে চেনা ও দেখা তো সেই ১৯৮১ সাল থেকেই। যখন হাফেজ্জী হুজুর রাহ. রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই বছর মে মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেওয়া হয় তখন রাষ্ট্রপতি পদে আলেমদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি দাঁড় করানোর প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা এবং দীর্ঘ পরামর্শ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ. নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। আমাদের চোখের সামনেই লালবাগ শাহী মসজিদে জুমার নামাযের পর মরহুম মাওলানা আমীনুল ইসলাম হাফেজ্জী হুযুরের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা প্রদান করেন।
তখন ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। রাষ্ট্রপতি হতেন দেশের সরকারপ্রধান। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ওলামা-তলাবা এবং দ্বীনদ্বার শ্রেণির মাঝে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখনো হুজুর কোনো দল গঠন করেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তিনি। যাহোক, সে নির্বাচনের সময় থেকেই প্রফেসর হযরতকে দেখা ও চেনা।
এরপর যখন আমি ঢাকা আজিমপুরের ফয়জুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতায় যোগদান করি, তখন থেকে হযরতের সাথে পরিচয় এবং বারবার দেখা। সেসময় তাঁর বুয়েটের বাসায়ও যাওয়া হয়েছিল একাধিকবার। এই ফয়জুল উলূম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও মুরব্বি ছিলেন ঢাকার প্রবীণ আল্লাহওয়ালা আলেম মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ.।
প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেবের দ্বীনের পথে অগ্রসর হওয়া, দ্বীনী শিক্ষা অর্জন, সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে অগ্রসর করা— এসবের গোড়ায় রয়েছেন মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ.। এজন্য হযরত তাঁর কথা বারবার বলতেন। তাঁর সাথে একটা মহব্বত ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের ইন্তেকাল হয়েছে তো বেশ কয়েক বছর হয়েছে। কিন্তু বারবার প্রফেসর ছাহেব তাঁর কথা বলতেন। আমার সাথে যতবার দেখা হয়েছে, খুব কমই এমন হবে যে, তিনি একথা বলেননি— ‘আপনি মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের কাছে কত বছর ছিলেন?’ কোনো না কোনোভাবে তিনি আবদুল্লাহ ছাহেবের গল্প টেনে আনতেন। তাঁর গল্প আমার মুখে শুনতে পছন্দ করতেন। সে সুযোগে আমিও হুযুরের বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর ঘটনা তাঁকে শোনাতামা।
প্রফেসর হযরতের শৌর্য-বীর্য, তাঁর মহলে তাঁর যে জৌলুস, যে নাম ও গুণগান— বাহ্যিক বিচারে তো নিজ পেশায় একাগ্র থেকে তিনি বুয়েটে আরো অনেক কিছু হতে পারতেন। জাগতিক আরো উঁচু ডিগ্রি, আরো উঁচু পদ-পদবিও পেতে পারতেন। তাঁর সন্তানাদিকেও হয়তো অন্য প্রফেসরদের মতো প্রফেসর বানাতে পারতেন। বিদেশে পাঠাতে পারতেন। তারা বড় বড় ডিগ্রীধারী হত। নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নামিদামি কোনো কাজ করত। বড় কোনো পদ-পদবি পেত। তা না করে তিনি নিজের সন্তাসহ পরিবারের সবাইকে আল্লাহর দ্বীন এবং ইলমেদ্বীনের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন এসব কিছুর গোড়ায় যে সকল বুযুর্গানে দ্বীন রয়েছেন তাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন এই আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ.।
এই সেদিনও তালীমুদ্দীন একাডেমি বকশিবাজারের উদ্বোধনী মজলিসে তাঁর বড় ছেলে মাওলানা রিজওয়ানুর রহমান ছাহেব বলছিলেন সেই কাহিনী। কীভাবে তাদেরকে মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর নির্দেশে মাদরাসা করে পড়ানো হয়। যদিও চারদিক থেকে বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য লোকজন তাঁর এ কাজকর্মকে পাগলামো আখ্যা দিতে থাকে।
কিন্তু মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের নির্দেশকে তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। শেষে তিনি এর ফলও উপভোগ করে গেছেন। তাঁর জীবনে মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের যে অবদান- সেটা আজীবন মনে রেখেছেন এবং বলে গেছেন।
যাইহোক, ফয়জুল উলূম মাদরাসার মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের তিনি কেবল শাগরেদই ছিলেন না; ছিলেন সে মাদরাসার মজলিসে আমেলার সদস্যও। সেই সূত্রে মাঝে মাঝেই তাঁর সেখানে যাওয়া হত। সে মাদরাসায় আমার পাঁচ বছর পড়ানো হয়।
এরপর দারুল উলূম করাচিতে আমার ভাই মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব এবং প্রফেসর হযরতের বড় ছেলে মাওলানা রিজওয়ানুর রহমান একইসাথে তাখাসসুস ফিল ইফতা পড়েন। সেই সূত্রেও বিভিন্ন কারণে চিঠিপত্র আদান-প্রদান এবং আরো বিভিন্ন কারণে তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং তাঁর বাসায় যাওয়া হয়।
ফয়জুল উলূম মাদরাসার তখন মুহতামিম ছিলেন খতীব মাওলানা উবায়দুল হক ছাহেব রাহ.। তাঁকে মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ. এ মাদরাসায় এনে মুহতামিম বানিয়েছেন। মাওলানা উবায়দুল হক ছাহেবও প্রফেসর ছাহেবের খুব কদর করতেন। আমাদের কাছে তাঁর আলাদা তারিফ করতেন। ‘পরফেসার সাহেব’ এভাবে উচ্চারণ করতেন। ‘পরফেসার সাহেবকে দাওয়াত দেন, নিয়ে আসেন।’ কোনো সময় বলতেন, ‘মাওলানা হামীদুর রহমান।’
আমি খতীব সাহেবের এসব ঘটনা একাধিকবার প্রফেসর হযরতকে শুনিয়েছি। তিনি মুচকি মুচকি হাসতেন। বলতেন, হুজুর আমাকে মহব্বত করেন।
এরপর আমি ঢাকায় আরেকটি মাদরাসায় কয়েক বছর পড়াই। ঘটনাক্রমে প্রফেসর হযরত সে মাদরাসার মজলিসে আমেলার সদস্য ছিলেন। তাই সে মাদরাসায়ও তাঁর আসা-যাওয়া হত।
সময় যত গড়িয়েছে, তাঁর সাথে, তাঁর সন্তানদের সাথে আমাদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তত বেড়েছে। এরপর যখন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু হয়, আমার ওয়ালিদ ছাহেব রাহ.-এর সাথে মশওয়ারা হয়। তিনি আমাদেরকে আরো যাঁদের সাথে মশওয়ারার কথা বলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ.।
মারকাযের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মজলিসে অন্য আরো কয়েকজন মুরব্বি আলেমের সাথে তিনি উপস্থিত থেকে দুআ করেছিলেন। এমনকি মারকাযুদ দাওয়াহর জন্য যখন প্রথম ঘর ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন ঘর খোঁজ করার মধ্যে হযরতের বড় ছেলে মাওলানা রিজওয়ান ছাহেব এবং মাওলানা হুসাইন আহমদ হেলাল (যিনি আমার কাছে পড়েছিলেন) যুক্ত ছিলেন।
ছাত্র যমানায় হযরতকে দেখার পর যখন কর্মজীবন আসে, তখন আমাদের পুরো কর্মজীবন জুড়েই তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। তাঁর অভিভাবকত্বের ছায়া বরাবরই আমাদের ওপর ছিল।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবেও তাদের সাথে অত্যন্ত মহব্বত ও শফকতের মুআমালা ছিল। সেই ১৯৯৮ সালের কথা। যখন আমার মেয়ের জন্ম হয় তখন হযরত, চাচিআম্মা এবং তাঁদের বড় মেয়ে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন।
আমার দুই ছেলে মুহিব্বুল্লাহ নুরুল্লাহকে হযরত বলতেন, মানিকজোড়। যেকোনো একজনকে দেখলে বলতেন, আরেকজন কোথায়? তাদেরকে যখন একেবারে শুরু সময় কিছুদিনের জন্য উত্তরা দারুল উলূমে পড়তে দেওয়া হয়েছিল, তাদের সবক শুরুর দুআর মজলিসেও তিনি ছিলেন। এভাবে বরাবরই তাঁর শফকত এবং মহব্বতের মুআমালা আমাদের ওপর ছিল।
আমার ভাই মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের সাথে হযরতের মহব্বত ও সম্পর্কের মুআমালা তো সবাই জানেন। আমাদেরকে তিনি স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। আপনজনের মতো দেখতেন।
তাঁর যে কারনামা, যে কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্য- সেগুলো নিয়ে অবশ্য বড় ব্যক্তিরা, হযরতের খাস মানুষরা বলবেন। তাঁরা সঠিক শব্দে, সঠিক মূল্যায়ন হয়তো করবেন। মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব যখন লিখবেন এবং হুযুরের সাথে মুতাআল্লিক অন্যান্য বড় ব্যক্তিরা যখন লিখবেন, তাঁরা হয়তো এর সঠিক মূল্যায়ন করবেন।
আসলে তিনি কেন ব্যতিক্রম। আমি হযরতের ইন্তেকালের পরের সপ্তাহে উত্তরা তালীমুদ্দীনের প্রোগ্রামে বলেছিলাম, ‘অমর হয়ে থাকা’ নামে একটা বাক্য আছে। তিনি অমর হয়ে আছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত অমর হয়ে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
তিনি ইলেক্ট্রিক বিষয়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁর বক্তব্যে-আন্দাযে বোঝা যায়, তিনি দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। খোদ বুয়েট থেকে যখন তিনি একক সিদ্ধান্তে চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাফেজ্জী হুযুরের সাথে লন্ডন সফরে যান। তখনো ভিসি সাহেব তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন, তাঁর ইস্তফার দরখাস্ত অনুমোদন করেননি। এর মাধ্যমেও তাঁর বিষয়ে তাঁর দক্ষতার কথা স্পষ্ট হয়। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের মোড়টা যেদিকে ঘুরিয়েছেন এবং যেভাবে জীবন পরিচালিত করেছেন সেটাতেই আসলে তাঁর মূল কৃতিত্ব এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য।
তাঁর জীবন বোঝার জন্য প্রেক্ষাপটটাও বোঝা দরকার। তিনি কোন পরিবেশের, কোন সমাজের, কোন লাইনের ছিলেন। সমাজে প্রফেসর হিসেবে মশহুর হলেও তিনি প্রফেসর হননি। এসিট্যান্ট প্রফেসর পর্যন্ত হয়েছিলেন। পিএইচডি না করলে প্রফেসর বানানো হয় না। এটা তিনি বিভিন্ন জায়গায় বারবার বলতেন। তিনি পিএইচডি করায় মনোযোগ দেননি। সাধারণত বুয়েটের সকল শিক্ষকই পিএইচডি করে ফেলেন। তিনি এর পরিবর্তে দ্বীন শেখার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। দ্বীনী শিক্ষাটা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং জেনারেল শিক্ষিত সমাজের মুরব্বি শ্রেণির লোক, জেনারেল শিক্ষিত হরেক পেশার যুবক ছেলেদেরকে দ্বীনী বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া, তাদেরকে হেদায়েতের রাস্তা দেখানো, আলোর দিশা দেওয়ার পেছনেই তাঁর জীবন ওয়াক্ফ করেছেন।
এজন্য প্রথমে তিনি নিজে দ্বীন হাসিল করেছেন। হাফেজ্জী হুজুরসহ অন্যান্য বুযুর্গদের সোহবত লাভ করেছেন। মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের সাথে লেগে থেকেছেন। আবদুল্লাহ ছাহেব যা যা নির্দেশ দিয়েছেন সবকিছুর ওপর আমল করেছেন।
যে বিশ্বাস তিনি করেছেন, যে পথে তিনি হেঁটেছেন তাতে তিনি তাঁর কাছের লোকজন ও সহকর্মীদের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করে চলেছেন। আশপাশের সমাজকে এড়িয়ে তিনি তাঁর সকল সন্তানকে দ্বীন শিখিয়েছেন, হাফেজে কুরআন বানিয়েছেন। এই যে কুরবানী, এই আত্মত্যাগ- বিরূপ পরিবেশে অন্য সবাই যা ‘পাগলামি’ মনে করেছে- সে কাজ তিনি করেছেন। তাঁকে এসব করতে দেখে অনেকেই মনে করেছে, লোকটার দেমাগ মনে হয় ঠিক নেই। অনেকে ভেবেছে, তিনি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছেন। কেন তাঁর সন্তানকে মাদরাসায় দিলেন, তারা অফিসার হবে, প্রফেসর হবে। তিনি দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাঁর সন্তানরা সেসব লাইনে যাবে। তাঁর এ আত্মত্যাগ অসাধারণ।
সেটা তো ছিল। শুরুর দিকে। তিনি সন্তানদেরকে মাদরাসায় পড়ালেন। নিজেও দ্বীন শিখলেন। তিনি তাঁর জীবনের মোড় ঘোরালেন, জীবনটা ওয়াক্ফ করলেন! মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখানোর জন্য সাপ্তাহিক মাহফিলের আয়োজন শুরু করলেন। চাকরির জায়গায় চাকরি ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠল বিশিষ্ট ও সাধারণের এবং পরবর্তীতে বড় বড় উলামায়ে কেরামেরও কেন্দ্রবিন্দু।
মানুষের প্রতি এত দরদ এত মহব্বত! আত্মীয়-স্বজন না, নিজের কেউ নয়; কিন্তু মনে হয় যেন সবাই তাঁর। যে তাঁর কাছে যাচ্ছে, কোনো কথা জিজ্ঞেস করছে, মনে হয় যেন তাঁর সন্তান জিজ্ঞেস করছে, তাঁর আপন ছেলেরই সমস্যা! তিনি সেভাবেই সমাধান করে দিতেন। এই ছিল তাঁর মানসিকতা।
ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে, সামান্য কাজ নিয়ে তিনি দৌড়াতেন। এক শহর থেকে আরেক শহর, শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। কারো সামান্য একটা মাসআলা দরকার। কারো সামাজিক, পারিবারিক কিংবা ঘরোয়া কোনো সমস্যা- তিনি দৌড়াচ্ছেন, আলেমদের কাছে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে যাচ্ছেন। একবার নয়। অনেকবার।
অনেকবার আমরা দেখেছি, ছোট ছোট কাজ নিয়ে তিনি চলে এসেছেন হযরতপুর মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের কাছে। দশ বিশ মিনিট থাকতেন। আবার চলে যেতেন।
এই ঐকান্তিকতা, আন্তরিকতা! অনেকে হয়তো ভাববে, এটা কী! এই সামান্য কাজের জন্য...!
আমাদের সাধারণের দৃষ্টিতে তো এরকমই মনে হয়; কিন্তু বাস্তবে কেন তিনি দৌড়াতেন? তিনি না দৌড়ালেও পারতেন, ফোনে বলে দিলেও পারতেন। তিনি সকলের মুরব্বি, সবাই সেভাবেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। কাজ হয়তো হয়ে যেত। কিন্তু না, তিনি নিজে দৌড়াতেন। এটা এযুগের জন্য অন্তত অসাধারণ। এরকম অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কথা, এমন সিফাত ও গুণের লোকদের কথা কিতাবাদিতেই পাওয়া যায়। আমরা বলতে পারি, তাঁরা আগের সময়ের অনন্য গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে এযুগে জন্ম নেওয়া মানুষ।
সামাজিক কাজ এবং মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানে তিনি সব সময় অগ্রগামী, আন্তরিক ও অসাধারণ ছিলেন।
আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধা
তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষকে আলেম-মুখী করা, তাদের দিলে আলেমদের প্রতি আস্থা তৈরি করা। সম্পর্ক তাঁর সাথে, কিন্তু তিনি মাসআলার জন্য, পরামর্শের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন বা নিয়ে যাচ্ছেন কোনো আলেমের কাছে। আলেমদের দোষ ধরতেন না। কতজনের কত নেতিবাচক বিষয়ই তো দেখেছেন, কিন্তু তিনি বোঝা সত্ত্বেও সেসব আলোচনায় আনতেন না, আলেমদের নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধা করতেন, নিজের লোকদের তা করার তাগিদ দিতেন। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা প্রতিষ্ঠার পূর্বে আমি একটি কর্মস্থলে ছিলাম। সেখানে একবার দায়িত্বশীলরা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং কমিটিকে দিয়ে তা পাকাও করিয়ে নেন। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-সহ সকল মুরব্বি উস্তাযই এতে কষ্ট পেয়েছিলেন। যেহেতু কমিটিতে প্রফেসর হযরতও ছিলেন, তাই তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি আস্থাবান আমরা অনেকে অবাকও হয়েছিলাম, কীভাবে কমিটিতে তা পাশ করানো হল, কিন্তু পরে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি নিজেই বিষয়টি উল্লেখ করে মাযেরাত করেছিলেন। বলেছিলেন, মাওলানা! আমার কিছু করার ছিল না। ভেবেছিলাম অমুক ... কোনো ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু তাও হলো না।
এমনই ঘটনা ঘটেছে তাঁর একটি ইসলামী শরীয়া মোতাবেক চলার দাবিদার ব্যাংকের শরীয়া এডভাইজরী কাউন্সিলে যোগদান নিয়েও। এটি তো তাঁর বিষয় ছিল না, তিনি এসবে যেতেনও না; কিন্তু একজন প্রবীণ আলেম ব্যক্তিত্ব (যাকে তিনি মুরব্বি মানতেন) তিনি নির্দেশ করেছিলেন বিধায় প্রফেসর হযরত আর না করতে পারেননি।
গণমানুষের দ্বীন শিক্ষা
গণমানুষের দ্বীন শিক্ষার জন্য তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর চেষ্টা ও অবদান অব্যাহত ছিল। তাঁর শায়েখ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর চিন্তার সাথে মিলিয়ে তিনিও পুরো দেশে কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র এবং মক্তব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
কুরআনের শিক্ষাকেন্দ্র করার জন্য, ছোট একটা মক্তব করার জন্য তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে- দেশের জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। হুইল চেয়ারে করে বহু জেলায় গিয়েছেন। দূর দেশেও গিয়েছেন। মক্তব কীভাবে পরিচালিত হবে সে ফিকিরও করেছেন।
হাফেজ্জী হুজুর রাহ. চেয়েছিলেন, ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব হবে। তাঁর সেকথার আমলী বাস্তবায়নে অনন্য অবদান প্রফেসর ছাহেব রেখে গেছেন। এখন তো গ্রামের সংখ্যাও বেড়েছে।
তিনি চলন্ত মাদরাসা বানিয়ে ছিলেন। সন্তান বা আত্মীয়দের কাউকে পড়াতে হবে, বড়লোকের কোনো শিশুকে পড়াতে হবে, তাদেরকে এমনি পড়ানো যাচ্ছে না, তিনি তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। হয়তো কাউকে গাড়িতে করে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেছেন, চকলেট চিপস খাওয়াচ্ছেন, আইসক্রিম খাওয়াচ্ছেন, মাঝে একটা কালিমা শিখিয়ে দিলেন। তাদের দুটো শব্দ শিখিয়ে দিলেন। এই যে চিন্তার ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা! ভিন্ন চিন্তা!! একটু খেলতে নিয়ে গেলাম, ঘুরতে নিয়ে গেলাম, খাওয়ালাম। পাশাপাশি মাত্র একটা শব্দ শিখিয়ে দিলাম! একটা শব্দ শেখাবার জন্য কত সময় এবং কত আয়োজন! একটা কালিমাই শুধু শেখাবেন, একটা আয়াতই শুধু শেখাবেন! এজন্য এত আয়োজন! এসব জায়গাতেই আমাদের মনে হয় তিনি অসাধারণ ছিলেন। এগুলোর ফল ইনশাআল্লাহ সদকায়ে জারিয়া হিসেবে অব্যহত থাকবে।
তালীমুদ্দীন একাডেমির কার্যক্রম যখন শুরু হয়, কুমিল্লার উদ্বোধনী মজলিসেও আমরা হযরতকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে সর্বস্তরের মানুষের দ্বীন শেখার আয়োজন হবে। তিনি পরিকল্পনা শুনে খুবই খুশি হয়েছিলেন। দুআ করেছিলেন।
আমি বললাম, আমরা স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আলাদা ফিকির করতে চাই। তারা স্কুলে যাবে। স্কুল থেকে ফিরে দ্বীন শিখতে আসবে। হযরত খুশি হয়ে বললেন, এ পরিকল্পনা তো ভালো, কিন্তু বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? এদেরকে ধরে রাখবে কে? অর্থাৎ হযরত বলতে চেয়েছেন, প্রথম দিকে অনেকেই তো আসে; কিন্তু তাদেরকে ধরে রাখা যায় না।
পরবর্তীতে তো আল্লাহর ফযলে বিভিন্ন জেলায় ও জায়গায় তালীমুদ্দীনের কাজ বাড়তে থাকে। স্কুলের বাচ্চারাও নিয়মিত আসতে থাকে। হযরত যখন পরবর্তীতে বিভিন্ন তালীমুদ্দীনে গিয়েছেন এবং সেখানের শিশুদের পড়া শুনেছেন, খুব খুশি হয়েছেন, কেঁদেছেন। অনেক দুআ করেছেন।
শিশুদের মধ্যে যারা কুরআন শরীফ শিখে ফেলত তাদের কাছে তিনি কুরআন শুনতেন আর কাঁদতেন। এই কান্নার মধ্যে অনেক কিছুই নিহিত ছিল। কুরআনের মর্মার্থও চিন্তা করতেন। আবার আল্লাহর বান্দারা তাঁর ওসীলায় কুরআন শিখছে, তাঁর মনের আশা পূরণ হচ্ছে এ খুশিতেও তিনি কাঁদতেন।
কুরআনের প্রতি তাঁর মহব্বত, অনবরত কুরআন শুনতে থাকা, কুরআন পড়তে থাকা, কুরআনের তরজমা, কুরআনের বাণী বলতে থাকা- এগুলো তো ছিলই। কিন্তু অন্যকে কুরআন মাজীদ শেখানো, কুরআনের আলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং অন্য মানুষও কীভাবে কুরআনের ওপর আমল করবে সেই কামনা করতে থাকা- এটা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যেই তিনি জীবিত থাকবেন, অমর থাকবেন, ইনশাআল্লাহ।
ঠিক এক বছর আগে উত্তরা ৭ নং সেক্টরে তালীমুদ্দীন একাডেমির শাখা কাজ শুরু হয়। উদ্বোধনী মজলিসে আমরা তাঁকে কষ্ট দিয়ে নিয়ে এসেছি। আসলে আমরা তো বাহ্যিকভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে এগুলোকে কষ্ট মনে করতাম। কিন্তু তিনি এর মধ্যেই শান্তি পেতেন। যাহোক হযরত এলেন, প্রথম সবক দিলেন, দুআ করলেন। সে মজলিসেই উপস্থিত হয়েছিলেন হযরতের বুয়েটের ছাত্রকালিন বন্ধু বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব নাজমুল আহসান খালেদ সাহেব। দুজনই হুইল চেয়ারে মঞ্চে পাশাপাশি বসা, সেখানে একে অপরকে ধরে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কি যে কান্না! জানি না তাদের কান্নায় কী কী বিষয় নিহিত ছিল। দ্বিতীয়জন এখনো হায়াতে আছেন। হুইল চেয়ারে করেই এসেছেন হযরতের জানাযায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা হযরতের এ বন্ধুকে সিহহাত ও আফিয়াত এবং ঈমান ও আমলের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন।
বাইতুল্লাহর প্রতি ইশক
বাইতুল্লাহ শরীফের প্রতি তাঁর ইশকের কথা তো সবারই জানা। অনেকবার হজ্ব করেছেন। আল্লাহর রহমতে হুইল চেয়ারে করে সর্বশেষ ২০২৩ সালেও তিনি হজ্ব করেছেন। এই হুইল চেয়ারে করেই অনেকবার উমরায় গিয়েছেন। হারামাইনের প্রতি তাঁর ইশক, এটাও ছিল তাঁর অসাধারণ এক বিষয়।
সম্ভবত ২০১৯ সালের হজ্বের সফর। হযরত হজ্বে আছেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার যাওয়া হয়েছে। আমি মসজিদুল হারাম থেকে বের হয়ে চিন্তা করছি, হযরত কোথায় কোন্ হোটেলে উঠেছেন- যদি একটু দেখা করতে পারতাম! এরমধ্যে রাস্তায় হযরতের মুতাআল্লিক সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এরশাদুল হক সরকারের সাথে দেখা। তিনি হযরতের কাফেলায় ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত কোথায়?
বললেন, এই সামনের হোটেলেই।
বললাম, নিয়ে চলেন।
গিয়ে দেখি, হযরত ওযুর জন্য গিয়েছেন। বের হয়ে আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। কী মহব্বতের সাথে আদর করলেন। বসালেন। কী খাওয়াবেন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এটা সেটা দিয়ে মেহমানদারি করালেন। এরপর বিভিন্ন কথা হল। সাথে তিনি মাসিক আলকাউসারের প্রসঙ্গ ওঠালেন। বুঝতে পারলাম, আলকাউসারের বিভিন্ন লেখা তিনি নিয়মতি পড়েন। আমার মতো সাধারণ মানুষের লেখাও পড়েন। আমার লেখার কিছু ভালো ভালো দিকও উল্লেখ করলেন। আর বললেন, রাজনীতির বিষয় না লিখলে হয় না?
আমি বললাম, আসলে আমারও এর প্রতি কোনো টান নেই। রাজনীতি করিওনি কখনো। আলকাউসারের পাঠকদের ব্যাপার-স্যাপার থাকে অনেক সময়। তারা চায়, এজন্য প্রসঙ্গের টানে কখনো একটু বলি।
কিন্তু হযরতের কথার এত প্রভাব পড়েছে যে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক লেখা এবং সেসব বিষয়ে ঢোকা একেবারে কমিয়ে দিয়েছি।
এখানেও তাঁর একটা বিষয় নিহিত ছিল। তিনি তো জানতেনই, আমরা রাজনীতি করি না বা রাজনীতি বিষয়ক কলাম লিখলেও সেখানে আমাদের চিন্তাটা ইসলাহী থাকে; আক্রমণ উদ্দেশ্য থাকে না। তাঁর এ কথা বলার পেছনে উদ্দেশ্য এটাই হবে, সবাইকে জুড়ে রাখা। এমন যেন না হয়, আমরা লিখলাম, কেউ হেদায়েতের পথে আসতে পারত; এর দ্বারা বিগড়ে গেল। নিশ্চয় তাঁর চিন্তায় এরকম কিছুই ছিল।
কত খুঁটিনাটি বিষয় খেয়ালে রাখতেন! যে কাজগুলোকে তিনি ভালবাসেন, পছন্দ করেন, সেগুলো সঠিক ও সুন্দরভাবে চলুক, সে ব্যাপারে খুব ফিকির করতেন। আমাদের মারকাযের যেহেতু মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মুরব্বি ছিলেন, তাই আমাদের ব্যাপারেও খুব ফিকির করতেন। হযরতপুরের প্রথম স্থাপনা বাঁশের মসজিদের প্রথম মাটি কাটার দুআ মজলিস থেকে শুরু করে বহুবার তিনি তাশরীফ এনেছেন।
আমাদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত স্নেহ-মমতার কথা তো আগেই বলেছি। হযরতপুরে আমাদের ঘর করা হলে সে খবর তিনি পেয়ে যান।
এরপর যখনই দেখা হত, মজা করে বলতেন, মুফতী ছাহেব বাড়ি করেছে আমাদের বিরিয়ানি খাওয়ায়নি।
আমি আমার ভাইকে বলে রেখেছিলাম, কখন সুযোগ হয়, কখন আমরা এই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। হযরতের ব্যস্ততার কারণে তা আর হচ্ছিল না। অবশেষে একবার সুযোগ মিলে গেল। তিনি দাওয়াত কবুল করলেন। সেখানে তাঁর ছেলে-জামাতা, তাঁর মুতাআল্লিকীন এবং আমাদের বন্ধু-বান্ধবদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। হযরতের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই এসেছিলেন সেদিন। সে দাওয়াতে আমরা অন্যান্য খাবারের সাথে বিরিয়ানিও করেছিলাম। হযরত সব আইটেম থেকেই কিছু কিছু খেয়েছেন। খুব দুআ করেছেন। খুশি হয়েছেন।
সেদিন একটু অসুবিধা হয়েছিল। চাচিআম্মা (হযরতের আহলিয়া মুহতারামা) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। সেজন্য তিনি আসতে পারেননি। হযরত ফেরার সময় খুব দুঃখ প্রকাশ করতে থাকেন, রিজওয়ানের আম্মা আসতে পারেননি।
আমি বললাম, চাচিআম্মা সুস্থ হয়ে যাক। তখন পুরো পরিবারকে নিয়ে আবার দাওয়াত হবে, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আফসোস, চাচিআম্মাসহ আর হযরতকে দাওয়াত দেওয়া হল না। দীর্ঘদিন হযরতের শরীর অসুস্থ ছিল। হযরত আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন। হযরতকে দাওয়াত দিয়ে কষ্ট দিয়ে এখানে আনব, সে অবস্থা আর তৈরি হয়নি। সে কথা কথাই থেকে গেছে।
প্রফেসর হযরত চলে গেছেন। পৃথিবীর সব মানুষই চলে যায়। কিন্তু তিনি যে এভাবে চলে যাবেন মনেই হয়নি। তিনি শারীরিক যে অবস্থা নিয়ে, জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়েও বছরের পর বছর দ্বীনের আলো ছড়িয়ে গেছেন; গণ মানুষকে, বিভ্রান্ত লোকদেরকে হেদায়েতের দিশা দিয়ে গেছেন, মনে হয়েছিল, তিনি এভাবে আরো অনেকদিন থাকবেন।
কত পরিকল্পনা যে করে রেখেছি! এটা তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করাব, ওটা করাব। তাঁর পছন্দের কাজগুলোর মধ্যে একটা তালীমুদ্দীন একাডেমি। তিনি যেমন চাইতেন- তালীমুদ্দীন একাডেমি সেধরনের একটা কাজ। তালীমুদ্দীন একাডেমির কেন্দ্রীয় ভবনের কাজ আল্লাহর ফযলে শুরু হয়েছে। আশা ছিল এক-দুই তলা সম্পন্ন করে কার্যক্রম শুরু করে দেওয়া হবে। সেখানে তাঁকে আনব দুআ করানোর জন্য। এরপর ইউনিভার্সিটি এলাকায় তালীমুদ্দীনের শাখার উদ্বোধনী মজলিস (যা হযরতের ইন্তেকালের এক সপ্তাহ পরেই শুরু হয়েছে) সেখানে তাঁকে দিয়ে দুআ করানো হবে। মারকাযুদ দাওয়াহর আরো বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁকে আনা হবে, তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করাব। এসবই অসম্পূর্ণ থেকে গেল।
ما كُلُّ ما يَتَمَنّى المَرءُ يُدرِكُه
تَجري الرِياحُ بِما لا تَشتَهي السُفُنُ
মানুষ যা আশা করে তার সব পায় না/বাতাস সব সময় নৌকার অনুকূলে প্রবাহিত হয় না।
তিনি চলে গেছেন। চলে তো যেতে হয় সবাইকে। ইন্তেকালের আগের দিন তার পরিবারের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল, হযরত গুরতর অসুস্থ। সবাইকে দুআ করতে বলা হয়েছিল। অসুস্থ তো তিনি বহুদিন ধরে। বহুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, বের হয়েছেন। কিন্তু সে বার্তাটা দেখেই বুকে কামড় দিয়ে উঠেছিল। এরপর সে রাত খুবই অস্বস্তিতে কেটেছে। বারবার মনে হয়েছে, হযরতের যেন কী অবস্থা! ফজরের পর ছেলে নুরুল্লাহকে বললাম, হযরতের নাতিকে ফোন করে হযরতের একটু খবর নাও।
এটা বলে মারকাযে চলে এলাম। কাজে বসলাম। বারবারই মনে হচ্ছিল, হযরতের না জানি কী অবস্থা!
বিকেলের দিকে মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব ছোট মানুষের মতো হাউমাউ করে কান্না করে ঢুকলেন আমার কাজের জায়গায়। শুধু বলতে পারলেন, হযরতের... আমি জিজ্ঞেস করলাম, চলে গেছেন!
তিনি বললেন, হাঁ, চলে গেছেন।
তিনি খুব কাঁদছিলেন। সাথে সাথেই বের হয়ে পড়লেন হযরতের উদ্দেশে। এভাবে কতবারই তো তিনি গেছেন তাঁর উদ্দেশে; কিন্তু আজকের যাওয়াটি তো ব্যতিক্রম। আজ তো হযরত তাঁকে দেখে স্নেহভরা, খুশিভরা আলিঙ্গন করবেন না, অভিবাদন জানাবেন না।
কখনো মাথায় আসেনি, তিনি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। আসলেই সত্যিকার অর্থেই তিনি এতীম করে গেলেন। তিনি এ সমাজের যেমন সাধারণ লোকদের রাহবার ছিলেন, মুরব্বি ছিলেন, অভিভাবক ছিলেন, তেমনি আমাদের মতো লোক, যারা তাঁর মনের ইচ্ছাগুলো, তিনি যে কাজের স্বপ্ন দেখতেন সে কাজগুলো করতে চাই— তাদেরকেও একা ছেড়ে গেলেন। এসব কাজের মূল্য তাঁর থেকে বেশি আর কেউ বুঝত না। সবকিছু রেখে তিনি হঠাৎই চলে গেলেন।
আগেই বলেছি, এধরনের অসাধারণ কীর্তি যাদের তারা অমরই থাকেন।
ہرگز نمیرَد آنکہ دلَش زندہ شد بعشق
ثبت است بر جریدۂ عالم دوامِ ما
যার অন্তর প্রভুর ভালবাসায় প্রাণবন্ত তার কোনো মৃত্যু নেই/পৃথিবীর বুকে তার স্থায়ীত্ব সুলেখিত আছে।
তিনি তাঁর চলে যাওয়ার পরের বিষয়গুলোও রেখে গেছেন অসাধারণ। অসিয়ত করে গেছেন, তাঁকে যেন খুব দ্রুত জানাযা দেওয়া হয়। সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করা হয়। কাফন-দাফনে দেরি না করা হয়। তাঁর সুযোগ্য সন্তান ও জামাতারা তাঁর কথার ওপর হুবহু আমল করেছেন।
এত বড় ব্যক্তিত্ব- পরের দিন জাতীয় ঈদগাহে জানাযার আয়োজন করা হলেও নিশ্চয় আগত মানুষদের জায়গা হত না। কিন্তু এ ব্যক্তিত্বের বিকেলে ইন্তেকাল হল, তাঁরা এশার পর জানাযার আয়োজন করলেন। উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে। সেই মাঠ ভরে রাস্তা-ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।
তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব এখানেও প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ কত জায়গায় কত কারামত খোঁজ করে। কারামত তো আসলে সুন্নতের মাঝেই নিহিত থাকে। দ্রুত তাঁর জানাযা বাস্তবায়ন করা তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছে। কেউ এর ব্যতিক্রম করেনি। এটাও তাঁর ঐকান্তিকতার সাথে দ্বীনের ওপর চলা, সুন্নাহর ওপর চলার বরকত।
হযরতের ইন্তেকালের পর আমরা দুই ভাই আলোচনা করেছিলাম। মারকাযে একটা ছোট্ট কবরস্থান আছে। নীতিমালাতেও লেখা আছে, জায়গা থাকলে উলামায়ে কেরাম ও বিশিষ্ট দ্বীনী ব্যক্তিত্বদের কবরের ব্যবস্থা করা। আর তিনি তো মারকাযের অন্যতম মুরব্বি। আমরা তাঁর সন্তানদের কাছে সে অনুরোধ রেখেছিলাম। তাঁরা বললেন, তিনি বলে গেছেন, তাঁকে যেন সাধারণ কবরস্থানে দাফন করা হয়। অসাধারণ হয়েও সাধারণদের সাথে মিশে থাকার এ গুণ তাঁর জীবদ্দশায়ও ছিল এবং ইন্তেকালের পরের জন্যও তিনি তার সে ওসীয়ত রেখে গেছেন।
জীবনে কোনো স্থাবর সম্পত্তি তিনি গ্রহণ করেননি এবং রেখে যাননি। ঋণ-করজ বহু করেছেন, কিন্তু তা মক্তব করার জন্য। দুঃখী মানুষের জন্য।
অতএব চলে গিয়েও তিনি অমর। তাঁর কীর্তিতেই তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
আল্লাহ তাআলা হযরতের ভরপুর মাগফেরাত করুন। জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন। তাঁর রেখে যাওয়া সদকায়ে জারিয়াগুলো কেয়ামত পর্যন্ত বহাল রাখুন। তাঁর ফয়েয ও বরকত বহাল রাখুন। সেই ফয়েয ও বরকতের মাধ্যমে যেন, তাঁর ঐকান্তিক চাওয়াগুলো বাস্তবায়িত হয়। গণমানুষের হেদায়েত ও আলোর দিশা পাওয়া, সর্বস্তরে কুরআনের শিক্ষা, কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত, দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা ছড়িয়ে যাওয়া, এগুলো যেন তাঁর আশানুরূপ ত্বরান্বিত হয়। আল্লাহ সে ব্যবস্থা করে দিন।
رفتم و از رفتنے من اک جہاں معدوم شد
من مگر شمعم چوں رفتم بزم برہم ساختم
আমি বিদায় নিয়েছি, আমার বিদায়ে এক পৃথিবী হারিয়ে গেছে/ আমি তো ছিলাম বাতি, যখন চলে গেলাম, মাহফিল ভেঙে দিয়ে গেলাম।