চাই কষ্ট প্রকাশে সংযম আর সহনশীলতার মহৎ গুণ
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনকে সুন্দর রাখতে কুরআন মাজীদে যে মৌলিক নির্দেশনাগুলো এসেছে, তন্মধ্যে একটি হল, ছোট বড় যে কোনো কষ্ট সকলের কাছে বলে না বেড়ানো। ধৈর্য ও সহ্যের মানসিকতা অর্জন করা। সম্ভব হলে সর্বক্ষেত্রেই ক্ষমানীতি অবলম্বন করা। একান্তই জুলুমের শিকার হলে এবং ক্ষমার নীতিতে অবিচল থাকতে না পারলে উপযুক্ত ব্যক্তিকে সেই কষ্টের কথা জানানো।
বিষয়টি অত্যন্ত কোমল ও বিজ্ঞোচিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে কুরআন মাজীদে। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
لَا يُحِبُّ اللهُ الْجَهْرَ بِالسُّوْٓءِ مِنَ الْقَوْلِ اِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَ كَانَ اللهُ سَمِيْعًا عَلِيْمًا.
আল্লাহ মন্দ কথা প্রকাশ (বা অন্যের দোষ চর্চা) করাকে পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে ভিন্ন কথা। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। Ñসূরা নিসা (৪) : ১৪৮
দুনিয়ার জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। অন্যের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। কারো না কারো কাছাকাছি থাকতে হয়, পাশাপাশি চলতে হয়। এটা দুনিয়ার অমোঘ রীতি। আর বাস্তবতা হল, প্রত্যেকের রুচি ও স্বভাব, মেজাজ ও পছন্দ এবং আগ্রহ ও মানসিকতায় কিছু না কিছু ভিন্নতা থাকে। ফলে সহযোগী, সহকর্মী, সহযাত্রী এবং কাছের ও দূরের ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে কখনো কোনো ক্ষেত্রে মতভিন্নতা যেমন হতে পারে, মনোমালিন্যও হতে পারে। এমনকি একে অপর থেকে কষ্ট পাওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। তখন সেই কষ্ট সয়ে নেওয়া এবং নিজের মধ্যেই তাকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। ছোট বড় যে কোনো কষ্ট অন্যের কাছে প্রকাশ না করা উচিত। মনে রাখতে হবে, তার কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটেছে, আনন্দ পাওয়ার ঘটনাও হয়তো ঘটেছে। অতএব কষ্ট প্রকাশের চেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশেই বেশি আগ্রহী হওয়া কাম্য। তবে হাঁ, কারো পক্ষ থেকে কোনো জুলুম হয়ে থাকলে তা অন্যের কাছে প্রকাশ করা যায়। জুলুমের সমাধান যে করতে পারবে তার কাছে, এমনকি যে সমাধানে সক্ষম নয় তার কাছেও।
সে বিষয়টিই উল্লেখিত হয়েছে এভাবে যে, ‘আল্লাহ তাআলা মন্দ কথা প্রকাশ করাকে পছন্দ করেন না।’ বলেননি যে, তোমরা মন্দ বিষয় প্রকাশ করো না। কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে দুর্বল। কষ্ট ও মনোবেদনার কথা সে প্রকাশ করতে চায়। তা অন্যকে জানাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। অতএব বান্দা যেন আল্লাহর পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে, সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে জুলুমের প্রসঙ্গকে আলাদা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, ‘আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ অর্থাৎ তুমি কারো কাছে তা প্রকাশ করো বা না করো, ‘আল্লাহ তাআলা সব শোনেন’ এবং তোমার ধৈর্য ও সহ্যের কথা ‘খুব ভালোভাবে জানেন।’
এখানে এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে, জুলুমের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে অতিরঞ্জন যেন না হয়। যতটুকু জুলুম হয়েছে, তোমার বিবরণে যেন তার চেয়ে বেশি প্রকাশ না পায়। কারণ আল্লাহ তাআলা তোমার বিবরণও খুব ভালোভাবে শোনেন এবং বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে সবিস্তার জানেন।
পরের আয়াতে বান্দার কষ্ট পাওয়া ও মজলুম হওয়ার ক্ষেত্রেও ক্ষমানীতি অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলা হয়েছেÑ
اِنْ تُبْدُوْا خَيْرًا اَوْ تُخْفُوْهُ اَوْ تَعْفُوْا عَنْ سُوْٓءٍ فَاِنَّ اللهَ كَانَ عَفُوًّا قَدِيْرًا.
তোমরা যদি কোনো সৎকাজ প্রকাশ্যে কর বা গোপনে কর কিংবা কোনো দোষ (ও মন্দ আচরণ) ক্ষমা কর, তবে নিশ্চয় আল্লাহ অত্যধিক ক্ষমাকারী, পূর্ণ ক্ষমতাবান। Ñসূরা নিসা (৪) : ১৪৯
এখানে মৌলিকভাবে ক্ষমা করার প্রসঙ্গ থাকলেও শুরুতে প্রকাশ্য-গোপন সব ধরনের নেককাজের প্রতিই উৎসাহিত করা হয়েছে। পরে স্পষ্টভাবে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে। শেষে বলা হয়েছেÑ ‘নিশ্চয় আল্লাহ অত্যধিক ক্ষমাকারী, পূর্ণ ক্ষমতাবান’। অর্থাৎ যে কোনো অন্যায় অপরাধের শাস্তিদানে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা অনেক বেশি ক্ষমা করেন। ক্ষমাকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তাই ক্ষমাকারী বান্দা, আশা করা যায় আল্লাহর নৈকট্যলাভে খুব দ্রুত অগ্রসর হবে।
মানুষ যেসব কারণে অন্যের প্রতি কষ্ট পেয়ে থাকে তন্মধ্যে একটি হল, কারো প্রতি অনুগ্রহ করার পর তার অকৃতজ্ঞতা কিংবা অন্যায় কোনো আচরণ। এ আয়াতে সেদিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, কারো প্রতি অনুগ্রহ-অবদান থাকলে সেটা অবশ্যই বড় নেক কাজ। সেই নেক কাজ প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে, আল্লাহ তাআলা তার যথাযথ প্রতিদান দেবেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তি কৃতজ্ঞ হোক বা না হোক।
উপরিউক্ত দুটি আয়াতে সমাজ জীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিময় করার জরুরি কিছু নির্দেশনা রয়েছে।
ক. যেকারো থেকে পাওয়া যে কোনো কষ্ট ও মন্দ আচরণের কথা প্রকাশ না করা উচিত।
খ. জুলুমের শিকার হলে প্রকাশ করা যায়। তবে সেক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবেÑ বিবরণ দিতে গিয়ে যেন বাস্তব ঘটনার চেয়ে বেশি বলা না হয়।
অর্থাৎ জুলুমের বিপরীতে জুলুম করার অনুমতি নেই। ইনসাফের সাথে বদলা নেওয়ার সুযোগ আছে।
গ. জুলুমের বদলা নেওয়ার অনুমতি আছে। তবে ক্ষমা করে দেওয়াই বেশি উত্তম।
মোটকথা, ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উত্তম আখলাক ধারণÑ উভয়ক্ষেত্রেই ভারসাম্য রেখে নসীহত করা হয়েছে। যার পরিণাম হবে এমন, যা অন্য একটি আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে এভাবেÑ
فَاِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَ بَيْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ.
ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সহসাই সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। Ñসূরা হা-মীম সাজদা (৪১) : ৩৪
আল্লাহ তাআলা আমাদের পুরো জীবনে উপরিউক্ত নির্দেশনা মেনে চলার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।