ফিলিস্তিন : অতীত থেকে বর্তমান
যারা পৃথিবীর ইতিহাস বর্ণনা করেন, তারা ইতিহাস শুরু করেন প্রস্তর যুগ থেকে। তখনো কোনো খনিজ পদার্থ আবিষ্কার হয়নি। শিকারের প্রয়োজনে মানুষ হাতিয়ার তৈরি করত পাথর দিয়ে। তাই এই যুগের নাম প্রস্তর যুগ। এই প্রস্তর যুগের চারটি পর্ব : ১. শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ পর্ব। ২. কৃষি ও জনপদ পর্ব। ৩. পেশা হিসেবে কৃষি ও জনপদ পর্ব। ৪. ধাতু আবিষ্কার পর্ব।
প্রস্তর যুগের এই সবগুলো পর্বের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ফিলিস্তিনে পাওয়া গেছে। এমনই প্রাচীন ও সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। কেনই বা হবে না! আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন-
وَ نَجَّيْنٰهُ وَلُوْطًا اِلَي الْاَرْضِ الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَا لِلْعٰلَمِيْنَ.
আমি তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে এমন এক ভূমিতে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৭১
এ অঞ্চলে বছর জুড়ে বৃষ্টি হয়। সারা বছর তাপমাত্রা থাকে স্বাভাবিক। শীত কিংবা গ্রীষ্ম সবসময়ই তাপমাত্রা থাকে ১৯-২৭ ডিগ্রির মধ্যে। ফিলিস্তিন হল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মিলনস্থল। এ দেশের অফুরান বরকতের দরুন স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষ এখানে বসবাস করে আসছে। নগরায়ণের জন্য এখানেই মানুষ সর্বপ্রথম সমবেত হয়েছিল। তা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দের কথা। সেই নগরের নাম আরীহা।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে মানুষ ব্রোঞ্জ যুগে প্রবেশ করে। এসময় মানুষ টিন আবিষ্কার করে। সেই সাথে তামা মেশানো ব্রোঞ্জ আবিষ্কার হয়। তখন মানুষ প্রচুর যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে থাকে। এই ব্রোঞ্জ যুগকেও তিন ভাগে ভাগ করা হয়- প্রাচীন (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০-২০০০), মধ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫৫০ পর্যন্ত) ও আধুনিক ব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১২০০)।
ফিলিস্তিনের আদিনিবাসী
প্রাচীন ব্রোঞ্জযুগে কেনআনীরা এসে ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করে। এ জাতির প্রতিটি শাখা আরব বংশোদ্ভুত। জাযিরাতুল আরব থেকে তারা ফিলিস্তিনে অভিবাসন গ্রহণ করেছিল। তারা ছিল মূর্তিপূজারি। এর সপক্ষে দলীল-দস্তাবেজ, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাব নেই। এতে ইহুদীরা যে দাবি করে, তারা ফিলিস্তিনের প্রথম বাসিন্দা- এর অসারতা প্রমাণ হয়। তাদের হাতে বিকৃত তাওরাতও স্বীকার করে, ইহুদীদের আগে কেনআনীরাই ফিলিস্তিনের বাসিন্দা ছিল। নাবলুস, বাইসান, আক্কা, আসকালান, হাইফাসহ দুই শতাধিক শহর তারা গড়ে তুলেছিল। ইহুদীদের ফিলিস্তিন প্রবেশের ১৪০০ বছর পূর্বে তারা আগমন করে। কেনআনীদের একটি শাখা হল, ফিনিশিয়ান সম্প্রদায়। তাদেরই অবদান ইতিহাসখ্যাত ফিনিশিয়ান সভ্যতা। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী ফিলিস্তিনী এলাকায় বসবাস করত।
আমোরীয়রা ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আরেকটি সম্প্রদায়। তাদের থেকেই এসেছে হেকসোস সম্প্রদায়। আলকুদসের গোড়াপত্তন তাদের অন্যতম কীর্তি। তারা এ শহরের নাম দিয়েছিল, উরসালিম।
এ যুগের কয়েক শ বছর পর ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ব্লেস্ট জনগোষ্ঠী। তারা এসেছিল ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রিট থেকে। এরাও ইহুদী ছিল না। তারা এ অঞ্চলের নাম রেখেছিল বালিস্তিন। সেখান থেকেই পরিবর্তন হয়ে ফিলিস্তিন হয়েছে।
ফিলিস্তিনে ইবরাহীম আ.-এর আগমন
মধ্যব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫৫০) ৪৫০ বছরের এই ধাপটি ফিলিস্তিনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ যুগেই এখানে ইবরাহীম আ.-এর মাধ্যমে প্রথম তাওহীদের প্রকাশ ঘটে। যখন তিনি ইরাক থেকে হিজরত করে (খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০) ফিলিস্তিনে আসেন তখন ছিল হেকসোসদের শাসনামল। তারা মূর্তিপূজারি হলেও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। তারা ইবরাহীম আ.-কে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ দেয়। এখানেই হযরত ইসমাঈল আ.-এর জন্ম। এ হিসেবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ফিলিস্তিনের শেকড়ের সম্পর্ক। ইসমাঈল আ.-এর জন্মের ১৩ বছর পর ইসহাক আ. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াকুব আ.। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে তিনি বেশ তাৎপর্যের অধিকারী। ইবরাহীম আ.-এর জীবদ্দশায়ই ইয়াকুব আ. জন্মগ্রহণ করেন। একসময় ইয়াকুব আ. হিজরত করে বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণ অঞ্চল হাররানে চলে যান। সেখানে তার এগার সন্তানের জন্ম। পরে আবার তিনি ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। ইয়াকুব আ.-এর আরেক নাম ইসরাইল (অর্থ আল্লাহর বান্দা)। সেই হিসেবে তার বংশধরদেরকে বনী ইসরাইল বলা হয়। ইউসুফ আ. একসময় ইয়াকুব আ.-কে সপরিবারে মিশরে নিয়ে যান। ইউসুফ আ. ও তাঁর ভাইয়েরা প্রায় ১৫০ বছর মিশরে বসবাস করেন। সেটা ছিল হেকসোসদের আমল। আগেই বলা হয়েছে, তারা ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।
একসময় ফারাও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট আহমোসের কাছে হেকসোসরা পরাজিত হয়। ফারাওরা বনী ইসরাইলকে মনে করত হেকসোসদের সহযোগী। তাই বনী ইসরাইলের ওপর নেমে আসে প্রচণ্ড জুলুম-নির্যাতন। এ নির্মমতা চলে ৩ শ বছর পর্যন্ত। এই সময়ে বনী ইসরাইলের স্বভাব-চরিত্রে ব্যাপক ধস নামে, যেসব স্বভাব-চরিত্রে বর্তমানে আমরা তাদের চিনি। ভয়, লাঞ্ছনা, মিথ্যা তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়। একপর্যায়ে তারা তাওহীদ ছেড়ে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়।
মূসা আ.-এর আগমন
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ সালের দিকে তাদের মাঝে মূসা আ. প্রেরিত হন। তার আগে জন্ম হয় হারুন আ.-এর। নানান জুলম-নির্যাতন অতিক্রম করে, ফেরাউনের লোহিত সাগরে সলিল সমাধির মধ্য দিয়ে বনী ইসরাইল মিশর ত্যাগ করে সিনাই উপত্যকায় আসে। সেখানে তারা নানান বিশৃঙ্খলা করে নবী মূসা ও হারুন আ.-কে যারপরনাই কষ্ট দেয়। একপর্যায়ে তারা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। শহর রক্ষা প্রাচীরের কাছে যাত্রাবিরতি দেয়। বিরতির পর মূসা আ. তাদেরকে শহরে প্রবেশ করতে বললে তারা এই বলে অস্বীকৃতি জানায়, এখানে এক পরাক্রমশালী জাতির বাস। এই পরাক্রমশালী যোদ্ধা জাতি ছিল কেনআনীরা।
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শাস্তিস্বরূপ তারা তীহ প্রান্তরে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকে। এসময়ে মূসা আ.-এর ইন্তেকাল হয়। মূসা আ.-এর ইন্তেকালের ১০ বছর পর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১৯০ সালে ইউশা আ. বনী ইসরাইলকে নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে ফিলিস্তিনে বসবাস করতে থাকেন। তার জীবদ্দশায়ই বনী ইসরাইল অনেক বিশৃঙ্খলা করে। ইউশা আ.-এর ইন্তেকালের পর ১৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়। এসময়ের মধ্যে তাদের অবাধ্যতা চরমে পৌঁছে। পৌত্তলিকতা তাদের ওপর চেপে বসে। তাদের প্রিয় তাবুত, যার মধ্যে মূসা আ.-এর লাঠি ছাড়াও অন্য আরও পবিত্র বস্তু ছিল, তারা হারিয়ে ফেলে। নানান ঘটনার পর তালুতের নেতৃত্বে জিহাদে অংশগ্রহণ করে। সে যুদ্ধে দাউদ আ.-ও অংশগ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। তিনি দুষ্ট শাসক জালুতকে হত্যা করেন। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি জালুতের ওপর বিজয় লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ ঈসাব্দে দাউদ আ. আলকুদস শহরে প্রবেশ করেন। তিনি সবচেয়ে বড় ইহুদী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তা ছিল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৭৪% অঞ্চল। এটাই ছিল ফিলিস্তিনে ঈমান ও আহলে ঈমানের প্রথম আধিপত্য। ফিলিস্তিনে ইবরাহীম আ. কেবল দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। ইউশা আ. ফিলিস্তিনের খুব বেশি এলাকা দখলে আনতে পারেননি। দাউদ আ. চল্লিশ বছর শাসন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সুলাইমান আ. উত্তরাধিকারী হন। তিনি দাপটের সঙ্গে শাসন করেন। তাঁর প্রভাবের সামনে বনী ইসরাইল মাথা নুইয়ে রাখলেও তাঁর ইন্তেকালের পরপরই ইহুদীরা পুরোনো চরিত্রে ফিরে যায়। সুলাইমান আ.-ও ৪০ বছর শাসন করেন। তিনি বাইতুল মাকদিস পুনঃনির্মান করেন। ইহুদীরা যে ওখানে সুলাইমানী ট্যাম্পল থাকার কথা দাবি করে, নানান অনুসন্ধান করেও তার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বনী ইসরাইলের ছিল ১২টি গোত্র। সুলাইমান আ.-এর ইন্তেকালের পর তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে। একজনের নেতৃত্বে ১০ গোত্র একত্রিত হয়। বাকি দুই গোত্র একত্রিত হয় অন্য একজনের নেতৃত্বে। ১০ গোত্র ফিলিস্তিনের উত্তরে গড়ে তোলে ইসরাইলী সাম্রাজ্য। অন্য দুই গোত্র দক্ষিণ ফিলিস্তিনে গড়ে তোলে ইয়াহুযা সাম্রাজ্য। এরা ছিল ইয়াহুযা ও বিনইয়ামিনের বংশধর। বিশৃঙ্খলা ও পৌত্তলিকতায় উভয় সাম্রাজ্যই বরাবর ছিল।
সেই ইসরাইলী সাম্রাজ্য ২০২ বছর টিকে ছিল। একপর্যায়ে তারা অ্যাসিরিয়ানদের হাতে পরাজিত হয়। অ্যাসিরিয়ানরা ছিল ইরাকের অধিবাসী। খ্রিস্টপূর্ব ৭২১ এ তারা ইসরাইলী সাম্রাজ্যে হামলা করে। তারা সবকিছু তছনছ করে দেয়। অধিকাংশকে বন্দি করে পৃথিবীর নানান প্রান্তে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এভাবে ইহুদীদের ১০ গোত্র ইতিহাস থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইয়াহুযা সাম্রাজ্য আরও ১৫০ বছর টিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে আল্লাহ তাদের ওপর আবার ধ্বংসলীলা চাপিয়ে দেন। ইরাকের সেনাপতি বখতে নসর ফিলিস্তিন আক্রমণ করে ইহুদীদের তছনছ করে দেয়। মসজিদে আকসা ধ্বংস করে দেয়। ৪০ হাজার ইহুদীকে বন্দি করে ইরাকে নিয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে ইহুদী শাসনের অবসান ঘটে। যা ৪১৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল। যার মধ্যে ৮০ বছর ছিল দাউদ ও সুলাইমান আ.-এর ঈমানী শাসন। বাকি ৩৩৮ বছর ছিল ফেতনা-ফাসাদ ও জুলুম-নিপীড়নের ইহুদী শাসন। বখতে নসরের ধ্বংসযজ্ঞের দীর্ঘ কাল পর তারা ফিলিস্তিনে ফিরে আসে।
ইরাকে যাওয়ার পর তারা তাওরাত সংকলন শুরু করে। এটা মূসা আ.-এর ইন্তেকালের ৭০০ বছর পরের কথা। কারণ তাবুত ও তাওরাতের ফলক চুরি হয়ে গিয়েছিল।
ইয়াহুযা সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনে ব্যাবিলন শাসনের সূচনা হয়। এ শাসন খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ থেকে ৫৩৯ পর্যন্ত ৪৭ বছর স্থায়ী হয়। তখন পারসিক ও ব্যাবিলনদের মাঝে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ ছিল চরম পর্যায়ে। ইহুদীরা সাইরাসের নেতৃত্বে থাকা পারসিকদের সহায়তা করলে ব্যাবিলনীরা পরাজয় বরণ করে। ফিলিস্তিন চলে যায় পারসিকদের দখলে। পারসিকরা ২০৭ বছর ফিলিস্তিন শাসন করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে রোমান সেনাপতি আলেকজান্ডার পারস্যকে পরাজিত করে। তারাও মুশরিক ছিল। ইহুদীরা তখন আলেকজান্ডারের অধীনে বসবাস করতে থাকে। রোমানরা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সাল থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন শাসন করে। রোমানরা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর। বেশির ভাগ ইহুদী রোমানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যায়। অল্প কিছু ইহুদী বিকৃত ধর্মের ওপর অটল থাকে।
এরপর ঈসা আ. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পর থেকে ৩০০ বছর পর্যন্ত ফিলিস্তিনে অল্প কিছু মানুষই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। ৩২৪ ঈসাব্দে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। তাঁর মা আগেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গোটা রোমান সাম্রাজ্যেই খ্রিস্টধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। পৌত্তলিকরাও দলে দলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাদের চিন্তা-চেতনার প্রভাব খ্রিস্টধর্মেও পড়ে। যার ফলে খ্রিস্টধর্ম এক বিকৃত রূপ নিয়ে গোটা রোমান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এসময় রোমানরা মসজিদে আকসার কাছেও যায়নি। ফিলিস্তিনে রোমান শাসন ৩১২ বছর স্থায়ী ছিল। একেবারে মুসলমানদের ফিলিস্তিন বিজয়ের আগ পর্যন্ত।
৫৭০ ঈসাব্দে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবুওত লাভ করেন (আনুমানিক) ৬০৯ ঈসাব্দে। কিছুকাল তিনি মসজিদে আকসা অভিমুখে নামায আদায় করেন। নবুওত লাভের দ্বাদশ বছর প্রথম বাইআতে আকাবা ও দ্বিতীয় বাইআতে আকাবার মাঝামাঝি সময়ে ইসরা (সশরীরে বাইতুল মাকদিস গমন) ও মিরাজ (বাইতুল মাকদিস থেকে ঊর্ধ্বাকাশ গমন) সংঘটিত হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে তখনকার বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্যের মাঝে যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে পারসিকরা বিজয়ী হয়। রোমানরা পরাজিত হয়। বিশ্বাসের দিক দিয়ে রোমানরা মুসলমানদের কাছাকাছি অর্থাৎ আহলে কিতাব হওয়ার কারণে তাদের পরাজয়ে নবীজী ও সাহাবায়ে কেরাম মর্মাহত হন। পরে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে রোমানরা পারসিকদের পরাজিত করে। আহযাব যুদ্ধের সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে ফিলিস্তিন জয়ের সুসংবাদ দেন।
অষ্টম হিজরীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিলিস্তিন, দামেশক ও পাশর্^বর্তী অঞ্চলের শাসক শুরাহবিল ইবনে আমর গাসসানীর কাছে ঈমানের দাওয়াত দিয়ে পত্র পাঠান। শুরাহবিল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতকে হত্যা করে। পরিণামে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় মনোযোগী ছিলেন। ওফাতের এক মাস আগে তিনি উসামা ইবনে যায়েদ রা.-এর নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। নবীজীর ওফাতের কারণে এ বাহিনী অভিযানে বের হওয়া থেকে বিরত থাকে। খেলাফতের বাইআত সম্পন্ন হওয়ার পর আবু বকর রা. সর্বপ্রথম এ বাহিনীকে অভিযানে প্রেরণ করেন। ৩০ রবিউল আউয়াল ১২ হিজরী/১৪ জুন ৬৩৩ ঈসাব্দে শাম জয়ের বিষয়ে পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। সভায় সবাই শাম অভিযানের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। শাম অভিযানের জন্য তিনি মুজাহিদ বাহিনী গঠনে মনোযোগী হন। আবু বকর রা.-এর খেলাফতকাল ছিল মাত্র ২ বছর ৬ মাস। এই অভিযান পূর্ণতা লাভের আগেই তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
ফিলিস্তিনে মুসলিম শাসন
উমর রা.-এর শাসনামলে রবিউল আখির ১৬ হিজরী/মে ৬৩৭ ঈসাব্দে আলকুদস শহর মুসলমানদের হস্তগত হয়। তখন উভয় পক্ষের মাঝে একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিনামাটি আলকুদসের কিয়ামাহ গির্জায় আজও সংরক্ষিত আছে। মুসলিম শাসকেরা বরাবরই এ চুক্তি বাস্তবায়ন করে চলেন। ১৯ হিজরীতে মুআবিয়া রা.-এর হাতে কায়সারিয়া জয়ের মধ্য দিয়ে গোটা ফিলিস্তিন মুসলমানদের হাতে চলে আসে। মুসলমানদের আগমনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। শাম অঞ্চলের প্রথম মুসলিম গভর্নর ছিলেন আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ রা.। তখন ফিলিস্তিনও শামের অংশ ছিল। ১৮ হিজরীতে আমওয়াস মহামারিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তারপর মুআয ইবনে জাবাল রা. গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনিও মহামারিতে ইন্তেকাল করেন। তারপর গভর্নর নিযুক্ত হন ইয়াযীদ ইবনু আবু সুফিয়ান রা.। তিনিও মহামারিতে ইন্তেকাল করেন। এরপর মুআবিয়া রা. গভর্নর নিযুক্ত হন। উসমান রা.-এর পুরো শাসনামল জুড়ে তিনি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। উসমান রা.-এর খেলাফতের শেষের দিকে ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওসব ফিতনায় শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন বলে শোনা যায় না। ফিতনার ওই সময়টাতে তাঁরা মুআবিয়া রা.-এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন।
মুআবিয়া রা.-এর মাধ্যমে উমাইয়া খেলাফতের [৪১-১৩২ হিজরী/৬৬০-৭৫০ ঈসাব্দ] সূচনা হয়। এসময়টা ছিল ফিলিস্তিনের জন্য উন্নতি ও অগ্রগতির সময়। ১৩২ হিজরী/৭৫০ ঈসাব্দে উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফত। ১৩২-৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত ৫২৪ বছর এ খেলাফত স্থায়ী হয়। ১৩২-২৪৭ হিজরী পর্যন্ত ১১৫ বছর ছিল আব্বাসী খেলাফতের সোনালী যুগ। ২৪৭-৬৫৫ হিজরী পর্যন্ত ৪০৯ বছর দুর্বলতার যুগ। উমাইয়াদের মতো আব্বাসীরাও ফিলিস্তিনকে খুব গুরুত্ব দিত। তবে সেটা উমাইয়াদের পর্যায়ে ছিল না। কারণ, উমাইয়াদের রাজধানী ছিল দামেশকে, যা ফিলিস্তিনের কাছে। আব্বাসীরা দারুল খিলাফত বাগদাদে স্থানান্তর করে। দূরত্বের কারণে যত্নে কিছুটা ঘাটতি পড়েছিল।
আব্বাসী খেলাফতের দুর্বলতার কালে আব্বাসীয় গভর্নর আহমদ ইবনে তুলুন ২৫৪ হিজরী/৮৬৮ ঈসাব্দে আব্বাসী শাসন থেকে বেরিয়ে যান। তিনি স্বাধীন তুলুনী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ২৬৪ হিজরী/৮৭৭ ঈসাব্দে তিনি ফিলিস্তিন অধিকার করেন। ফিলিস্তিন ৫৭ বছর তুলুনী রাজ্যের অধীনে ছিল। এ শাসনামলের সুনাম ইতিহাসে বেশ উজ্জ্বল। ৩২১ হিজরীতে মুহাম্মাদ ইবনে তুগজ ইখশীদীর হাতে তুলুন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ৩৮ বছর ইখশীদীরা ফিলিস্তিন শাসন করেন। এ আমল ফিলিস্তিনের জন্য উত্তম শাসনামল বলে বিবেচিত হয়। ইখশীদী সুলতানেরা ফিলিস্তিনকে এতটাই গুরুত্ব দিত যে, কোনো খলীফার ইন্তেকাল হলে লাশ দাফন করতে মসজিদে আকসায় নিয়ে যেত। এতকিছুর পরও এ আমলে এসে ফিলিস্তিনে সামরিক ও দাওয়াতী কার্যক্রম গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ৩৫৯ হিজরীতে ইখশীদীদের পতনের পর এসব দুর্বলতা ধরা পড়ে।
ফিলিস্তিনে শিয়া শাসন
৩৫৯ হিজরীতে উবায়দিয়ারা মিশর দখল করে। একই বছর তারা ফিলিস্তিন দখল করে। তারা ছিল নিকৃষ্টতম শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। কমবেশি একশ বছর তারা মুসলিম বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে। তারা অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে সুন্নী আলেমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। উবায়দিয়াদের দখলের মধ্য দিয়ে এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে ফিলিস্তিন। উবায়দিয়ারা প্রথমে একাধারে ১০৪ বছর ফিলিস্তিন শাসন করে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দাওয়াত শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। সুন্নী উলামায়ে কেরামকে হত্যা করে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে মিশর ও ফিলিস্তিনে। উবায়দিয়া সাম্রাজ্যে দীর্ঘ ৬০ বছরের শাসক মুস্তানসির লিদীনিল্লাহ-এর আমলে উবায়দিয়ারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- মুস্তালিয়া ও নিযারিয়া।
মুস্তানসিরের আমলেই ৪৩২ হিজরী/ ১০৪১ ঈসাব্দে উত্তর আফগানিস্তান ও পূর্ব ইরানে তুর্কী বীর সালজুক ইবনে দুক্কাকের হাত ধরে সালজুক সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। এরা ছিল আকীদায় সুন্নী। ৪৬৩ হিজরীতে সুলতান আল্প আরসালানের নির্দেশে তুর্কী সেনাপতি আতসিয ইবনে উভাক উবায়দিয়াদের হাত থেকে ফিলিস্তিন উদ্ধার করেন। তবে এই সেনাপতি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করে সেলজুক শাসন থেকে আলাদা হয়ে যান। একপর্যায়ে আল্প আরসালানের ছেলে তুতুশ ইতযিসকে পরাজিত ও হত্যা করেন। তিনি তার এক সেনাপতি আরতুক ইবনে আকসাবকে ফিলিস্তিনের দায়িত্ব দেন। আরতুক ৪৭১-৪৮৯ হিজরী পর্যন্ত ১৮ বছর ফিলিস্তিন শাসন করেন। দীর্ঘ দুঃশাসনের পর এই সময়টা ছিল ফিলিস্তিনের ইতিহাসে খুবই উত্তম সময়। তুতুশ জালিম হলেও তার নিযুক্ত শাসক আরতুক ছিলেন খুবই ন্যায়পরায়ণ।
৪৮৯ হিজরীতে ৩ বছরের জন্য উবায়দিয়াদের মুস্তালিয়া ফেরকা আবার ফিলিস্তিন দখল করে। সুকমান ইবনে আরতুক ও গাজী ইবনে আরতুককে ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কার করে। তাঁরা তুরস্কের দক্ষিণে হিজরত করেন। সেখানে তাঁরা আরতুক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে বিশাল অবদান। এবারও উবায়দিয়ারা সুন্নী আলেমদের হত্যায় মেতে ওঠে।
ক্রুসেডারদের কবলে ফিলিস্তিন
এবার নতুন আগ্রাসনের কবলে পড়ে উবায়দিয়ারা। ধেয়ে আসে ক্রুসেডাররা। ৪৯০ হিজরী/১০৯৭ ঈসাব্দে পাঁচটি বাহিনী ফ্রান্স থেকে কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। ক্রুসেডাররা প্রথমে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। তারা খুব সহজে কিলিজ আরসালানকে পরাজিত করে। কারণ, তখন তিনি ক্রুসেডারদের মোকাবেলায় মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ব্যস্ত ছিলেন গাজী ইবনু দানেশমান্দকে পরাজিত করতে। তখন সালজুক সাম্রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। তাছাড়া উবায়দী শিয়াদের দীর্ঘ গোমরাহীপূর্ণ শাসন মুসলিম চেতনাকে মিইয়ে দেয়। এসব কিছু ক্রুসেডারদের জন্য ফিলিস্তিন প্রবেশ সহজ করে দেয়।
৪৯২ হিজরী/৭ জুন ১০৯৯ ঈসাব্দে ক্রুসেডাররা আলকুদসে পৌঁছে। পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত অনবরত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ২০ শাবান ৪৯২ হিজরী/১৫ জুন ১০৯৯ ঈসাব্দে আলকুদসের পতন ঘটে। ক্রুসেডাররা ঘোড়ায় চড়ে মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে। ৭০ হাজার মুসলমানকে জবাই করে। পবিত্র শহরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। ইহুদীদেরকে গির্জায় একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ক্রুসেডারদের আনাগোনায় এ পর্যায়ে এসে মুসলিম বিশ্বে কয়েকটি ক্রুসেড রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৯০ হিজরীতে রুহা রাজ্য, ৪৯১ হিজরীতের আন্তাকিয়া রাজ্য, ৪৯২ হিজরীতে বাইতুল মাকদিস রাজ্য, ৫০৩ হিজরীতে তারাবলুস ও তার আশপাশ মিলিয়ে আরেকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭ মুহাররম ৫০৭ হিজরী/১১১৩ ঈসাব্দে ইরাকের বীর মওদুদ ইবনে তুনকাতিনের হাতে সিন্নাবরাহ রণাঙ্গনে ক্রুসেডাররা পরাজিত হয়। এ যুদ্ধেই আত্মপ্রকাশ ঘটে প্রখ্যাত বীর ইমাদুদ্দীন যেনকীর। তখন তার বয়স ২৪ বছর। তিনি এতীম অবস্থায় বেড়ে উঠেছিলেন।
ইমাদুদ্দীন যেনকী ইসলামী ভূখণ্ডগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার পর ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। ৫৩০ হিজরী/১১৩৬ ঈসাব্দে লাযিকিয়ায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। অকল্পনীয় গনীমত লাভ করেন। এরপর একে একে তিনি মুসলিম বিশ্বে গজিয়ে ওঠা ক্রুসেড রাজ্যগুলোকে পরাজিত করেন। এভাবে সূচিত হয় যেনকী সাম্রাজ্যের ভিত্তি। ৫৪১ হিজরীতে তিনি আততায়ীর হাতে শহীদ হন। রেখে যান চার সন্তান। এর মধ্যে নুরুদ্দীন যেনকী ও সাইফুদ্দীন গাজী বাবার অসমাপ্ত মিশন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। ৫৪৫ হিজরী পর্যন্ত নুরুদ্দীন রাহ. ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো বিজয় অর্জন করেন। ৫৪৮ হিজরীতে দুঃখজনকভাবে আসকালান ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায়। আসকালান ছিল ফিলিস্তিনের একমাত্র স্বাধীন মুসলিম অঞ্চল। যদিও শাসকরা ছিল উবায়দী। তারা নুরুদ্দীন রাহ.-এর কাছে সাহায্যের আবেদন পাঠায়। মাঝখানে প্রতিবন্ধক ছিল দামেশকের শাসক। তাই তিনি প্রথমে দামেশক জয় করেন। তিনি ফিলিস্তিন জয় করতে মিশরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আল্লাহ তাআলা সে ব্যবস্থাও করে দেন। উবায়দী শাসক আলআযিদ বিল্লাহ ২৭/২৮ বছর বয়সী সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকে মিশরের প্রধানমন্ত্রী বানান। তার ধারণা ছিল, তরুণ আইয়ুবীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর দৃঢ়তায় তার এ খায়েশ ভেস্তে যায়। তিনি ৫৬৭ হিজরী/১১৭১ ঈসাব্দে ২০৮ বছরের ওবায়দী শাসনের বিলুপ্তি ঘটান। উবায়দীরা ক্রুসেডারদের সঙ্গে আতাত করে বহুবার মিশর দখল করতে চাইলেও তা ব্যর্থ হয়। এর মাত্র ২ বছর পর ১১ শাওয়াল ৫৬৯ হিজরীতে নুরুদ্দীন রাহ. দামেশকে ইন্তেকাল করেন।
নুরুদ্দীন রাহ.-এর মৃত্যুর পর সালাহুদ্দীন আইয়ুবী জিহাদের হাল ধরেন। বিভক্ত মুসলিম রাজ্যগুলোকে একীভূত করেন। ২৪ রবিউল আউয়াল ৫৮৩ হিজরী/৪ জুলাই ১১৮০ ঈসাব্দে হিত্তীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুসলমান ছিল মাত্র ১২ হাজার। ক্রুসেডার ছিল ৬৩ হাজার। যুদ্ধের ফলাফল কল্পনাতীতভাবে মুসলমানদের অনুকূলে ছিল। হিত্তীন যুদ্ধের পরের দিন টাইবেরিয়াসের সবচেয়ে বড় দুর্গ জয়ে রওয়ানা হন। সহজেই তা বিজয় করেন। হিত্তীন যুদ্ধের ৫ দিন পর সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আক্কা অবরোধ করেন। এক দিনের মধ্যেই এই শহরের পতন ঘটে। আক্কার পর তিনি নাসিরিয়া জয় করেন। সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর ভাই আদিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ইয়াফা ও নাবলুস শহর জয় করেন। এসব ঘটনা হিত্তীন বিজয়ের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে। এরপর তিনি লেবানন অভিমুখে রওয়ানা হন। লেবাননের অর্ধেক তখন বাইতুল মাকদিস রাজ্যের অধীনে ছিল। তিনি চাচ্ছিলেন বাইতুল মাকদিস রাজ্যকে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে। ২১ জুমাদাল উলা তিনি সাইদা গিয়ে পৌঁছান। সাইদা জয় করে বৈরুত যাত্রা করেন। আট দিন অবরোধের পর বৈরুতের পতন হয়। জাবিলবাসী আত্মসমর্পণ করে। ১৬ জুমাদাল উখরা আসকালান অবরোধ করেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে আসকালানের পতন ঘটে। রামাল্লা অভিমুখে সৈন্য পাঠান। একে একে গাজা, তিবনিন, বেথেলহাম ও বাইত জিবরীন জয় করেন। আলকুদস বাদে গোটা ফিলিস্তিন তিনি মাত্র দুই মাসে জয় করে ফেলেন।
সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রাহ.-এর আলকুদস জয়
১৫ রজব ৫৮৩ হিজরীতে সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আলকুদস অবরোধ করেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহর হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শহরের পাদ্রী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সালাহুদ্দীন আইয়ুবী টানা ১২ দিন মিনজানিক দিয়ে অব্যাহত আক্রমণ করে যান। হামলার ভয়াবহতা দেখে ক্রুসেডাররা শান্তি প্রস্তাব করে। সালাহুদ্দীন আইয়ুবী প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তোমরা দীর্ঘ ৯২ বছর মুসলমানদের সাথে যে আচরণ করেছ, আমি তোমাদের সাথে সে আচরণই করব।
ক্রুসেডাররা জবাবে বলে, আমরা আমাদের সন্তান, নারী ও পশুদের হত্যা করব। তারপর বাইতুল মাকদিস জ্বালিয়ে দেব। আমাদের হাতে বন্দি ৫ হাজার মুসলমানকেও জবাই করব। তারপর মরণপণ লড়াই করব।
এ জবাব শুনে সালাহুদ্দীন আইয়ুবী দ্বিধায় পড়ে যান। পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, বাইতুল মাকদিস হস্তান্তরের পর জিযিয়ার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। ২৭ হিজরী রজব মাসে আলকুদস শহর মুসলমানদের হাতে আসে। ক্রুসেডাররা মসজিদে আকসাকে এতটাই অপরিচ্ছন্ন করেছিল যে, তা পরিষ্কার করতে এক সপ্তাহ লেগে যায়। সালাহুদ্দীন আইয়ুবী এ বছর ঈদুল আযহা আল-কুদসে উদ্যাপন করেন।
৫৮৫ হিজরীর রজব মাসের মাঝামাঝিতে ক্রুসেডাররা গাই ডি লুসিগনানের নেতৃত্বে সুরের নিকটবর্তী শহর আক্কা অভিমুখে রওয়ানা করে। লুসিগনানকে ফ্রান্সে চলে যাওয়ার শর্তে সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আট মাস বন্দি রাখার পর মুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ওয়াদা ভঙ্গ করে এবং সুরে গিয়ে পরাজিত ক্রুসেডারদের সঙ্গে মিলিত হয়। ওয়াদা ভঙ্গের দরুন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী খুবই ক্ষিপ্ত হন। তিনি আক্কায় পৌঁছার আগেই ক্রুসেডাররা আক্কায় পৌঁছে যায় এবং শহর অবরোধ করে। ক্রুসেডারদের কৌশলগত অবস্থান ও বিপুল শক্তিমত্তার দরুন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ব্যর্থ হন। পূর্ণ দুই বছর অবরুদ্ধ থাকার পর মুসলমানরা ক্রুসেডারদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়।
এর মধ্যে বাইতুল মাকদিসে ক্রুসেডারদের সহযোগিতা করার জন্য ইউরোপে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি হয়। এটা ছিল তৃতীয় বৃহত্তম ঐক্য। প্রথম ঐক্য ছিল প্রথম ক্রুসেড অভিযানের সময়। যা খুবই সফল হয়েছিল। তাদের মাঝে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঐক্য হয়েছিল রুহা রাজ্যের পতনের পর। ক্রুসেডের এ অভিযান নুরুদ্দীন যেনকী ব্যর্থ করে দেন। এর কোনো ফলাফল ছিল না। আক্কা শহর ক্রুসেডারদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পর ইয়াফা, আসকালান, কায়সারিয়া, আরসোফ, হাইফা ক্রুসেডারদের হাতে চলে যায়। ২৭ সফর ৫৮৯ হিজরীতে মহাবীর সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ইন্তেকাল করেন।
তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা চরম সংকটে নিপতিত হয়। ক্ষমতা নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। মুসলমানদের বিবাদ-বিসংবাদের নয় বছর পর সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর ভাই আদিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। এর মধ্যে ক্রুসেডারদের হাতে বৈরুতের পতন ঘটে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য দেখে ইউরোপীয়রা বিপদ আঁচ করতে পারে। ৫৯৯ হিজরী/১২০২ ঈসাব্দে চতুর্থ ক্রুসেড শুরু হয়। কিন্তু এ ক্রুসেড লক্ষভ্রষ্ট হয়। ক্রুসেডাররা আলকুদসের পরিবর্তে বাইজান্টাইনদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের দিকে ধাবিত হয়। তারা বাইজান্টাইন সম্রাটকে হত্যা করে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা স্বজাতির ওপর হত্যা ও লুটতরাজ চালায়। রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়।
আদিল ৫৯৮-৬১৫ হিজরী পর্যন্ত মুসলিমবিশ্ব শাসন করেন। তিনি এ দীর্ঘ সময়ে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে কোনো চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করেননি। অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হন। ফলে ৬১৫ হিজরীতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় পঞ্চম ক্রুসেড। অভিযানের কথা শুনে আদিল মিশর ছেড়ে ফিলিস্তিন রক্ষার্থে ছুটে আসেন। ক্রুসেডারদের বিপুল সংখ্যার কথা শুনে তিনি সৈন্য সংগ্রহের জন্য দামেশকে যান। আদিলের মিশর ত্যাগের কথা জেনে ক্রুসেডাররা মিশরের প্রধান বন্দর দিময়াতে অবতরণ করে। এসময় দামেশকে আদিলের ইন্তেকাল হয়। মিশরজুড়ে ক্রুসেডারদের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি হয়। মানসূরার সীমান্তে ইসলামী শক্তি ও ক্রুসেডারদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে কামিল ক্রুসেডারদের কাছে খুব অপমানকর এক প্রস্তাব পেশ করেন, ক্রুসেডাররা দিময়াত ছেড়ে চলে গেলে আলকুদসসহ সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর বিজিত সব অঞ্চল তাদেরকে দিয়ে দেবন। তবে কামিলের একটি শর্ত ছিল, কার্ক ও শোবাক অঞ্চল এর বাইরে থাকবে। এজন্য পোপের প্রতিনিধি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের দরুন উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়।
এমন অপমানকর প্রস্তাবের পরও আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন। পরাজয়ের মুখে ক্রুসেডাররা জান নিয়ে কোনোরকম বাড়ি যাওয়ার আকুতি জানায়। এভাবেই আল্লাহ সে সময় ফিলিস্তিনকে হেফাজত করেন।
৬২৪ হিজরীতে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় সম্রাট ফেডারিকের নেতৃত্বে ষষ্ঠ ক্রুসেড পরিচালিত হয়। মাত্র ৫০০ যোদ্ধা নিয়ে সে অভিযানে বের হয় তারা। দুর্বলচিত্তের শাসক দ্বিতীয় কামিল তাকে প্রস্তাব দেয়, যদি যুদ্ধ না করে সে ফিরে যায় তাহলে তাকে আলকুদস দিয়ে দেওয়া হবে। কামিল সত্যি সত্যিই ক্রুসেডারদের হাতে আলকুদস সোপর্দ করে। মাত্র ৫০০ সৈন্য নিয়ে ৬২৫হিজরী/১২৩৮ ঈসাব্দে ফেডারিক আলকুদস বুঝে নেয়। তবে কামিল একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল আলকুব্বাতুসা সাখরা ও আলআকসা মসজিদ তাদেরকে দেওয়া হবে না। কামিল ৬১৫-৬৩৫ হিজরী পর্যন্ত ২০ বছর শাসন করেন। সালহুদ্দীন আইয়ুবীর কুদস বিজয়ের ৪৩ বছর পর এই পতনের ঘটনা ঘটে। ৬৩৭ হিজরী/১২৩৯ ঈসাব্দে নাজমুদ্দীন আইয়ুব শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নেককার শাসক। তিনি সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজান। এসময় নাজমুদ্দীনের ভাতিজা ইসমাঈল দামেশকের ক্ষমতায় বসেন। সে ক্ষমতার জন্য হেন কোনো কাজ নেই করেনি। মিশর দখল করতে সে ক্রুসেডারদের সাথে হাত মেলায়।
৬৩৭ হিজরীতে নাসির দাউদ নিজস্ব বাহিনী নিয়ে আলকুদসে অভিযান চালান। তার এ অভিযান ইসলামের টানে ছিল না। সে শুধু নিজের সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছিল। সে ক্রুসেডারদের হাত থেকে আলকুদস ছিনিয়ে আনে। দ্বিতীয় কামিলের আলকুদস দিয়ে দেওয়ার ১১ বছর পর আবার ক্রুসেড শাসনের অবসান ঘটে। দাউদ আলকুদস দখল করতেই ইসমাঈল এসে হাজির হয়। সে আলকুদস তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দিতে চায়। বিনিময়ে সে পাবে মিশর দখলে ক্রুসেডারদের সহায়তা। এমনকি সে মসজিদে আকসা ও কুব্বাতুস সাখরাও দিয়ে দিতে রাজি হয়। ৬৩৮ হিজরী/১২৪০ ঈসাব্দে দ্বিতীয় বারের মতো আলকুদস ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সুলতান নাজমুদ্দীন আইয়ুব ৬৪২ হিজরী/১২৪৪ ঈসাব্দে আলকুদস পুনরুদ্ধার করেন। এরপর থেকে ৬৯৩ বছর প্রায় সাত শতাব্দী ধরে আলকুদসে ইসলামী শাসন চালু থাকে। ১৩৩৫ হিজরী/১৯১৭ ঈসাব্দে ব্রিটিশ-বাহিনীর আলকুদসে প্রবেশের মধ্য দিয়ে সেই ধারার অবসান ঘটে।
নাজমুদ্দীন আইয়ুবের কুদস জয়ের কথা শুনে ফরাসি সম্রাট নবম লুইসের নেতৃত্বে ক্যথলিক পোপ সপ্তম ক্রুসেডের ডাক দেন। ২ মুহাররম ৬৮৪ হিজরী/ ১২৫০ ঈসাব্দে ফারিস্কুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ক্রুসেডাররা চরমভাবে পরাজিত হয়। বন্দি হয় নবম লুইস। ক্রুসেডারদের প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
নাজমুদ্দীন আইয়ুবের মৃত্যুর পর নানান ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশরের ক্ষমতায় আসে মামুলুকেরা। মামলুকদের শ্রেষ্ঠ শাসক সাইফুদ্দীন কুতুয মুসলিম বিশ্বের জন্য তাতারীদের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। ৬৫৪ হিজরী/১২৬০ ঈসাব্দে গাজায় মোতায়েন করা তাতার বাহিনীকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি তাতারদের আইনুল জালুতের যুদ্ধে টেনে আনেন। ২৫ রমযান ৬৫৮ হিজরীতে আইনুল জালুতের প্রান্তরে মুসলমানরা ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে।
সাইফুদ্দীন কুতুযের পর ক্ষমতা লাভ করেন যহীরুদ্দীন বাইবার্স। চার বছরে শাসন-ক্ষমতা গোছানোর পর ৬৬৩ হিজরীতে ক্রুসেডারদের দিকে মনোযোগ দেন। একসাথে তিনি একাধিক ক্রুসেড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
এরপর ক্ষমতায় আসেন সাইফুদ্দীন কালাউন। তিনিও ক্রুসেডারদের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ৬৮৮ হিজরীতে তিনি ক্রুসেড রাজ্য তারাবলুস জয় করেন। ৬৮৯ হিজরীতে তাঁর ওফাত হয়। শাসন-ক্ষমতায় আসেন তাঁর পুত্র আশরাফ খলীল। তিনি মুসলিম বিশ্বে গড়ে ওঠা অবশিষ্ট ক্রুসেডারদেরও উচ্ছেদ করেন। মুসলমান শাসনাধীনে ইহুদীরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। যে সময়টাতে ৬৯০ হিজরী/১২৯০ ঈসাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড ইহুদীদের দেশ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। এর এক বছর পর ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম ফিলিপ ইহুদীদের ফ্রান্স ছাড়তে বিল পাশ করেন। তবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে ছিল ভিন্ন কথা। তখন দলে দলে ইহুদীরা খ্রিস্টধর্ম গহণ করতে থাকে। তাদের এ ধর্মগ্রহণ ছিল কেবলই নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য। এদের মাধ্যমেই জন্ম নেয় খ্রিস্টিয় জায়নবাদের।
মামলুক সাম্রাজ্যের শেষের দিকে উসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান হতে থাকে। উসমান ইবনে আরতুগ্রুলের হাত ধরে এ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা মিলিয়ে ৬৪৩ বছর এই সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়। ৯২২ হিজরী/১৫১৬ ঈসাব্দে মার্জ দাবিক ময়দানে উসমানী ও মামলুক বাহিনীর মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে উসমানী সুলতান প্রথম সেলিম বিজয়ী হন। মামলুক বাহিনী পর্যদুস্ত হয়। এ বিজয়ের পর সুলতান সেলিম একে একে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন জয় করে নেন। এরপর মামলুকদের শেষ আশ্রয় মিশরও দখল করেন।
ইহুদীদের অবান্তর দাবির সূচনা
ইউরোপ থেকে ইহুদীরা বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল উসমানী খেলাফতে। দীর্ঘকাল তারা সেখানে বসবাস করে। ১০৩৫ হিজরী/১৬৩০ ঈসাব্দে ‘সাব্বাতাই জেভি’ নামে এক ইহুদীর জন্ম হয়। সে নিজেকে মাসীহ দাবি করে। তার পাশে ইহুদী-খ্রিস্টানরা জড়ো হতে থাকে। সে দুনিয়াকে ৩৮ ভাগে বিভক্ত করে ইহুদীদের ভাগ করে দেয়। সে ভবিষ্যদ্বাণী করে- খুব শিগগির তারা আপন আপন অঞ্চলের সম্রাট হয়ে যাবে। সে একসময় উসমানী সাম্রাজ্য থেকে তার নিজের বণ্টন করা এলাকাগুলো দাবি করে বসে। এজন্য সে কিছু প্রতিবাদ সমাবেশ করে। প্রথম প্রথম প্রশাসন তাকে পাগল মনে করে এড়িয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ের তার দৃঢ়তা দেখে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগ মুহূর্তে সে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। সে ইহুদীদেরকেও ইসলাম গ্রহণ করতে বলে। তারা মুসলিমের ছদ্মবেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেয়। ইউরোপে তারা যেমন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ক্যাথলিক গির্জায় ঢুকে পড়ে, তেমনি উসমানী সাম্রাজ্যেও একই কাজ করে। তারা ডোনমে (ইহুদী ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে প্রত্যাবর্তন) আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা সেনাবাহিনীর উঁচু উঁচু পদগুলোতে ঢুকে পড়ে। তারা ‘ঐক্য ও প্রগতি সংঘে’ ঢুকে পড়ে। খেলাফত পতনে যাদের বড় ভূমিকা ছিল।
১৭৯৮-৯৯ সালে নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট মিশর অভিযান চালান। আক্কার প্রাচীর অবরোধকালে তিনি ইহুদীদের এখানে এসে জাতিগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। ফরাসিরা প্রোটেস্ট্যান্ট হওয়ার কারণে ক্যাথলিক ইংল্যান্ড ও রাশিয়া বিচলিত হয়ে পড়ে। উসমানী খেলাফতও নেপোলিয়নের কারণে বিচলিত ছিল। ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও উসমানী খেলাফত মিলে নেপোলিয়নকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। উসমানী খেলাফত মিশর উদ্ধারে মুহাম্মাদ আলী পাশাকে সেনাপতি করে পাঠায়। সে নিজের সাম্রাজ্য গড়ার লোভে সে ব্রিটিশদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। মুহাম্মাদ আলী পাশার শাসনামলে ফিলিস্তিনীরা চরম দুঃখ-কষ্ট ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়। ফিলিস্তিনীদের ওপর মোটা অংকের করারোপ করা হয়। ফিলিস্তিনীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। ব্রিটিশরা মুহাম্মাদ আলীর কাছে ফিলিস্তিনে একজন কনসাল নিয়োগের দাবি জানায়। এই কনসালের কাছে ব্রিটিশ রাজার প্রথম বার্তা ছিল, ‘ইহুদীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ ফিলিস্তিনের ঘটনাপ্রবাহে এই কনসালের অনেক ভূমিকা রয়েছে।
খলীফা দ্বিতীয় আব্দুল হামীদের শাসনামলের শুরুতে (১২৯৩-১৩২৮ হিজরী/ ১৮৭৪-১৯০৯ ঈসাব্দ পর্যন্ত) রাশিয়ায় চরম ইহুদী নির্যাতন হয়। তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সুলতান আব্দুল হামীদকে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের গ্রহণ করতে বাধ্য করে। নানা কারণে তিনি ইহুদীদের মেনে নিতে বাধ্য হন। তবে তিনি এ ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন যে, ইহুদীরা কিছুতেই ফিলিস্তিনে বসবাস করতে পারবে না।
তবে একপর্যায়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হস্তক্ষেপ শুরু করে। তখন সুলতান আব্দুল হামীদ সেই ঐতিহাসিক উক্তি করেন, ‘যতদিন উসমানী খেলাফত থাকবে, ততদিন ফিলিস্তিনে ইহুদীরা ঠাঁই পাবে না।’
১২৯৯ হিজরী/১৮৮২ ঈসাব্দে ব্রিটেন মিশর দখল করে নেয়। ফিলিস্তিন থেকে মিশরকে আলাদা করে ফেলে। খলীফা আব্দুল হামীদের আমলেই ‘তুর্কী যুব সংঘ’ গড়ে ওঠে। যারা ছিল ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত। তারা ছিল ধর্মহীন। লালন করত জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা। ‘ঐক্য ও প্রগতি’ নামে তাদের ছিল সামরিক ফ্রন্ট। উসমানী সেনাবাহিনীর বিরাট একটি অংশকে তারা নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। ডোনমে ইহুদীরাও তাদের সমর্থন দেয়। আরব বিশ্বেও তখন জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। সেইসাথে হার্জেল নামক এক ইহুদী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কাছে ইহুদী রাষ্ট্রের জন্য লবিং করতে থাকে। সে সুলতান আব্দুল হামীদের কাছেও গিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জমি দেওয়ার আবেদন করে। সুলতানকে অনেক প্রলোভনও দেখায়। সুলতান আব্দুল হামীদ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। সে রুশ সম্রাট জারের কাছে গিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে সে উসমানী খেলাফত ও রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়ার ফন্দি আঁটতে থাকে।
পতনের সূচনা
১৯০৯ সালে ঐক্য ও প্রগতি সংঘ সুলতান আব্দুল হামীদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। নামকাওয়াস্তে খলীফার আসনে বসানো হয় পঞ্চম মুহাম্মাদকে। ব্যক্তিত্বহীন এ মানুষটি ছিল কেবলই খেলাফত বিলুপ্তির মাধ্যম। তার মন্ত্রীসভার ১৩ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৩ জনই ছিল ইহুদী। মন্ত্রীসভায় ইহুদীদের উপস্থিতির কারণে গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। এ অসন্তোষ কঠোর হাতে দমন করা হয়।
১৯১৪-১৯১৮ ঈসাব্দ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐক্য ও প্রগতি সংঘ উসমানী খেলাফতকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়। পরিকল্পিতভাবে জার্মানির পক্ষে দাঁড় করায়। এসময় ইউরোপে থাকা উসমানী সেনাবাহিনীতে মড়ক দেখা দেয়। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে উসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলে এ বাহিনী একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখনো ফিলিস্তিনে উসমানী বাহিনীর ১ লাখ সৈন্য মোতায়েন ছিল। এতে বোঝা যায়, উসমানী খেলাফত ফিলিস্তিনকে কতটা গুরুত্ব দিত। দুঃখের বিষয় হল, এ বিপুল সৈন্যের নেতৃত্বে ছিল মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক, যার হাতে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফতের পতন ঘটে।
ব্রিটিশরা শরীফ হুসাইনকে খুঁজে বের করে আরব ও তুর্কীদের মুখোমুখি করতে। ১৯১৫ সালে মিশরে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ম্যাকমোহন ও শরীফের মাঝে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক শরীফ হুসাইন উসমানীদের অধীনে থাকা আকাবা বন্দর দখল করে নেবে, যেন ব্রিটিশদের ফিলিস্তিনে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। ৩০ রজব ১৩৩৪/১ জুলাই ১৯১৬ সালে শরীফ আরব বিপ্লব কায়েম করেন। তার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল ছেলে ফয়সাল। সঙ্গে ছিল ইহুদী সামরিক অফিসার আরব লরেন্স। আরব-বাহিনী আকাবা বন্দর দখল করার মাধ্যমে ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন প্রবেশের পথ সুগম হয়ে যায়।
১৯১৭ সাল ছিল মুসলমানদের জন্য চরম বিপর্যয়ের। ২৫ অক্টোবর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। সাত সদস্যের বিপ্লবী পরিষদের প্রধান লেলিন ছিল ইহুদী কার্ল মার্ক্সের আদর্শ লালনকারী। বাকি চারজন ছিল ইহুদী। পরিষদের সদস্য স্টালিন ইহুদী না হলেও তার স্ত্রী ছিল ইহুদী। বাকি একজন ছিল খ্রিস্টান। তাদের গঠন করা মন্ত্রী পরিষদের ২২ জনের ১৭ জনই ছিল ইহুদী। এ ছিল হার্জেলের স্বপ্ন ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এর এক সপ্তাহ পর আসে বেলফোর ঘোষণ। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এ সংখ্যায় পড়ুন হযরত মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ছাহেবের লেখা। পৃ. ২৭) ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে নিয়োজিত উসমানী সালতানাতের সেনাপতি মুস্তফা কামাল আতাতুর্ককে ফিলিস্তিন থেকে সরে যাওয়ার বিনিময়ে তুরস্কের সিংহাসনে বসানোর প্রলোভন দেয়। মুস্তফা কামাল সেই প্রলোভন ভালো করেই গলাধঃকরণ করে। এই বছরের ১৬ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার দুই সপ্তাহ পর ব্রিটিশ-বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে। কথামতে কামাল তুর্কী বাহিনী নিয়ে ফিরে আসে। আরব-বাহিনী ছিল ব্রিটিশদের সহায়ক। তখন ফিলিস্তিনের বিপুল জনগোষ্ঠী কোথায় ছিল? আফসোস, তখন তারাও আরব জাতীয়তাবাদে বুঁদ হয়ে ছিল। তাদের মাথায় ঢোকানো হয়েছিল, ব্রিটিশরা এসে তাদেরকে উসমানীদের হাত থেকে রক্ষা করবে! তখন ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, ‘ইসলামী খ্রিস্টিয় যুব সংঘ’। ফিলিস্তিনীদের মগজ ধোলাইয়ে এদেরও জঘন্য ভূমিকা ছিল। এদের কাছে অনেকেই তখন প্রতারিত হয়েছিল।
ইহুদীকরণ প্রকল্পের সূচনা
এরপর ১৯১৮-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে চলে ইহুদীকরণ প্রকল্প। ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীরা ছিল ৮%। ১৯৪৮ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৩২%। তারা নানা ছলচাতুরি, প্রলোভন ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জমি ক্রয় করতে শুরু করে। এত কিছুর পরও ইহুদীরা কেবল ১% জমি ক্রয় করতে পেরেছিল। ইহুদীরা ফিলিস্তিনের অর্থনীতিতে মারাত্মক আধিপত্য বিস্তার করে।
ফিলিস্তিনীদের মুক্তি-সংগ্রাম
ফিলিস্তিনীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র উভয় উপায়েই সংগ্রাম করেছে। স্বভাবতই প্রথম ধারার সংগ্রাম হয় ফলাফলশূন্য। শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম ছিল ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত। ১৯৩৩ সালে প্রথমবারের মতো সশস্ত্র জিহাদের সূচনা হয়। নেতৃত্ব দেন সিরিয়ান নাগরিক ইযযুদ্দীন কাসসাম রাহ.। যার নামে গঠিত হয়েছে কাসসাম ব্রিগেড। এই জিহাদী কাফেলা দীর্ঘদিন গোপনে সুসংগঠিত হয়। তারপর সামরিক অভিযান শুরু করে। ইযযুদ্দীন কাসসাম রাহ.-এর শাহাদাতের পর নেতৃত্বে আসেন ফারহান সাদী। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। রোযা অবস্থায় তিনি শহীদ হন। এই মুজাহিদ বাহিনী ১৯৩৬ সালে ৫০৬টি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৩৮ সালে করে ৫৭০৮টি। ১৯৩৯ সালে করে ৩৩১৫টি। ৩৭ থেকে ৩৯ সাল পর্যন্ত মুজাহিদদের হাতে ১০ হাজার ব্রিটিশ সেনা প্রাণ হারায়। ফিলিস্তিনী শহীদ হন ১২ হাজার। বন্দি হয় ৫০ হাজার। এমন প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ওয়াদা দেয়। এ ওয়াদা ছিল শুধুই প্রতারণা। এ ওয়াদায় প্রতারিত হয় মুসলমানেরা। স্তিমিত হয়ে যায় জিহাদী আন্দোলন।
ইহুদীকরণ প্রকল্পের দ্বিতীয় স্তর
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইহুদী নির্যাতনের অজুহাতে ফিলিস্তিন অভিমুখে আবার ইহুদীদের ঢল নামে। এসময় ৯০ হাজারেরও বেশি ইহুদী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। মানুষের সহানুভূতি কুড়াতে তারা হলোকাস্টের গল্প প্রচার করে। তারা দাবি করে, হিটলার ৬০ লাখ ইহুদী হত্যা করেছে। অথচ ইহুদীদের মোট সংখ্যাই তখন ওই পর্যন্ত গড়ায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনো রাষ্ট্র না থাকা সত্ত্বেও ইহুদীরা জাতিসংঘে নিজেদের নামে প্রতিরক্ষা ইউনিট তৈরি করে।
এদিকে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে আমেরিকা পরাশক্তি হিসেবে উত্থানের জানান দেয়। গ্রেট ব্রিটেনের সূর্য তখন অস্তগামী। ইহুদীরা এ সময়ে ব্রিটেনকে ত্যাগ করে আমেরিকার কোলে আশ্রয় নেয়। ব্রিটেনকে ত্যাগ করতে গিয়ে ইহুদীরা তাদের চিরাচরিত স্বভাব খেয়ানতেরই পরিচয় দেয়। ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-মার্কিন জোট গঠিত হয়। তারা তিনটি দাবি উত্থাপন করে : ১. এক লক্ষ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে আশ্রয় দিতে হবে। ২. ফিলিস্তিনে সবার জন্য জমি কেনা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ৩. ফিলিস্তিনে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার গঠন করতে হবে।
একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু
আরবদের প্রতিবাদের মুখে বিষয়টি জাতিসংঘের দায়িত্বে দেওয়া হয়। জাতিসংঘ দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব দেয়। ইহুদীরা ৩২% হয়েও তারা পাবে ফিলিস্তিনের ৫৬.৫% পার্সেন্ট, ফিলিস্তিনিরা পাবে ৪৩%। বাকি ০.৫% আলকুদস ভূখণ্ড। যা আন্তর্জাতিক অঞ্চল। ১৯৪৭ সালে বিভক্তির এ প্রস্তাব কার্যকর হয়। আরব লীগ দ্রুত বৈঠকে বসে। কয়েকটি আরব দেশ মিলে স্যালভেশন আর্মি গঠন করে। নেতৃত্ব দেওয়া হয় সন্দেহজনক এক ব্যক্তি ফাওজী কাউকজীকে। এক মিলিয়ন পাউন্ড বাজেট করা হয়। দামেশকের কাতনায় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়।
এ সংবাদ শুনে ব্রিটেন আরবলীগের কাছে এ মর্মে বার্তা পাঠায়, ‘ফিলিস্তিনীদের প্রশিক্ষণ, সশস্ত্রীকরণ ব্রিটেন বন্ধুত্ব পরিপন্থি মনে করে।’ এতেই আরবলীগ ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়। স্বেচ্ছাসেবকদের বের করে দেয়। স্যালভেশন আর্মির সংখ্যা ৭৭০০ তে নামিয়ে আনে। অথচ ইহুদী সশস্ত্র সংগঠন এক হাগানারই সদস্য সংখ্যা ছিল তখন ৬২ হাজার! আরবলীগের এমন সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ১৯৪৫ সালে আরবলীগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল ব্রিটেনের ইন্ধনে।
তখন আব্দুল কাদের হুসাইনীর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনের গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়। আন্দোলন মুসলিম বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম দেশগুলো ব্রিটিশ আগ্রাসনের মুখে থাকার দরুন আন্দোলন তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। কেবলমাত্র ইখওয়ানুল মুসলিমীন সক্রিয়ভাবে ফিলিস্তিন জিহাদে অংশগ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল আলকাস্তাল শহর অবরোধের সময় আরবলীগের কাছে অস্ত্র চাওয়া হলে কোনো সাড়া মেলেনি। ব্রিটিশ-বাহিনী ফিলিস্তিন ছাড়ার আগ পর্যন্ত আরব-বাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর একের পর এক শহর ইহুদীদের হাতে পতন হতে থাকে। ১৫ জুলাই ১৯৪৮ সালে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৬ দিনের মাথায় জাতিসংঘ শান্তির আহ্বান জানায়। আরব দেশগুলো প্রতারণাপূর্ণ শান্তি প্রস্তাবের ফাঁদে পা দেয়। ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ইহুদীদের অনুকূলে চলে যায়।
আরব শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা
ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ফোক বার্নাডট। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরলে ১৭ সেপ্টেম্বর ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করে। আরব-বাহিনী মুজাহিদদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বের করে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে পৌঁছতেই নিরাপত্তাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে। আরব-বাহিনী সেসব এলাকাতেই অভিযান চালায়, যেগুলো জাতিসংঘ ইসরাইলের ভাগে দিয়েছিল। আরব-বাহিনী সেসব এলাকা থেকে মুজাহিদদের হটিয়ে ইহুদীদের জন্য দখল করার পথ সুগম করে দিত। ৭ লক্ষ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনীকে বিভিন্ন আরব দেশে বিতাড়িত করা হয়। ইখওয়ানের প্রধান হাসানুল বান্নাকে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে শহীদ করা হয়। এভাবেই আরব-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির আয়োজন করা হয়। ১৯৪৯ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইহুদীরা মিশরের সাথে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে। ২৩ মার্চ লেবাননের সাথে চুক্তি হয়। ৪ এপ্রিল হয় জর্ডানের সাথে। সিরিয়ার সাথে চুক্তি হয় একই বছরের ১ এপ্রিলের পরে। ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ২২% ভূখণ্ড মিশর ও জর্ডানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। জর্ডানের ভাগে যায় পশ্চিম তীর। গাজায় আধিপত্য বিস্তার করে মিশর। আরব-ইসারাইলের এ সন্ধির পর জাতিসংঘ ইসরাইলকে সদস্যপদ দেয়। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একের পর এক জায়নবাদী এ রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিতে থাকে।
প্রিয় পাঠক, এতকিছুর পরও ফিলিস্তিন শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বাসঘাতকতার এমন পটভূমিতেই শুরু হয় মুনাফিক পরিবেষ্টিত ফিলিস্তিনীদের নিঃসঙ্গ মুক্তি-সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহ আন্দোলন শুরু হয়। গঠিত হয় পিএলও। ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ইয়াসির আরাফাত ছিটকে যান জিহাদ ও সংগ্রামের ধারা থেকে। শেখ আহমাদ ইয়াসীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হামাস। হামাসের নেতৃত্বে ইনতিফাদা ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনবাসী দিয়ে যাচ্ছে জিহাদ ও শাহাদাতের অন্তহীন নাজরানা। যা আজ বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখছে।
[তথ্যসূত্র : কাসাসুল কুরআন, হিফজুর রহমান সিহারবী রাহ.; কিসসাতু ফিলিস্তিন, রাগিব সারজানি; আকসা কে আঁসু, আবু লুবাবা শাহ মানসূর; আলজাজিরা, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য]