জায়নবাদের রূপ ও স্বরূপ
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমি ইহুদী নই, তবে আমি জায়নিস্ট। জায়নিস্ট হওয়ার জন্য ইহুদী হওয়া জরুরি নয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ অক্টোবর ২০২৩)
যদি সংজ্ঞা ও প্রেক্ষাপট ছাড়া শুধু উদাহরণের মাধ্যমে জায়নবাদ বুঝতে হয়, তাহলে ফিলিস্তিনে প্রায় এক মাস ধরে চলমান গণহত্যার দিকে তাকানোই যথেষ্ট। সহজেই জায়নবাদের রূপ ও স্বরূপ বুঝে আসবে।
জায়নবাদের আরবী নাম হল- الصَّهْيُوْنِيَّة (সাহ্য়ূনিয়্যা)। এটি ইহুদীদের একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। ‘সাহয়ূন’ জেরুজালেমে ইহুদীদের স্মৃতিবিজড়িত একটি পাহাড়। এর দিকে যুক্ত করে এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে সাহ্য়ূনিয়্যা। (দ্র. আসসাহ্য়ূনিয়্যা বি-ইজায, পৃ. ১৪)
এ আন্দোলনের মূলকথা, গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদীদেরকে একত্রিত করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এখান থেকে গোটা দুনিয়ায় রাজত্ব করা হবে। (দ্র. মুজাযু তারীখিল ইয়াহুদ, পৃ. ২৭২)
জায়নবাদ তথা ইহুদী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অনেক পুরোনো। অতীতে বিভিন্ন সময় ইহুদীরা ইহুদী-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। তবে সংগঠিতভাবে রাষ্ট্র্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় ১৮৯৭ সাল থেকে। এ বছর ইহুদী সাংবাদিক থিওডর হার্জেলের (১৮৬০-১৯০৪ ঈ.) নেতৃত্বে সুইজারল্যান্ডের বাসল নগরীতে ইহুদীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের মালিকানাধীন কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করা, কৃষি বসতি স্থাপন, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন দেশের সরকারকে জায়নবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলার প্রচেষ্টা ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। (দ্র. আসসাহ্য়ূনিয়্যা বি-ইজায, পৃ. ১৬-১৭; এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা, জায়নিযম)
এরপর ১৯১৭ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসনের করতলগত হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জায়নবাদী পরিকল্পনা আরেক ধাপ এগিয়ে যায়।
অবশেষে ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করলে জায়নবাদীদের পরিকল্পনা পুরো বাস্তবায়িত হয় এবং ঐ বছরের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে। (মুজাযু তারীখিল ইয়াহুদ, পৃ. ২৬৮-২৬৯)
এভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় মুসলিম বিশ্বে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল জন্ম লাভ করে। এই হল জায়নবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা।
এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে, কোনো মুসলিম দেশে ইহুদী হিসাবে বসবাস করা এক কথা আর জায়নবাদী চিন্তা লালন করা এবং মুসলিমদের পবিত্র নগরী দখল করে নিজেদের জায়নবাদী চিন্তা বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখা ভিন্ন কথা।
কিন্তু জায়নবাদ ইহুদী ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলিম দেশে বসবাস করে মুসলমানদের পবিত্র নগরী দখল করা এবং সেখানে ইহুদী রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখা- মুসলমানদের সাথে পরিষ্কার গাদ্দারি ও বিশ্বাসঘাতকতা। সেই বিশ্বাসঘাতকতাই করছে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। একসময় যেই আরবরা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল, আজকে তারাই সেই আরবদেরকে নিজ দেশে পরবাসী বা উদ্বাস্তু করে দিচ্ছে!
আজকাল জায়নবাদিরা প্রোপাগান্ডা চালায়- ফিলিস্তিন তাদের পিতৃভূমি। তাদের পিতৃপুরুষগণ এ এলাকা শাসন করেছেন। এই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে তারা মানুষের মনে তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করতে চায়। কিন্তু তাদের এ প্রোপাগান্ডার যুক্তিসঙ্গত কোনো ভিত্তি নেই। এটা ধর্মীয়ভাবেও প্রমাণিত নয়, ঐতিহাসিকভাবেও নয়।
যেই পূর্বপুরুষের কথা বলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে নিজেদের অধিকার দাবি করে, তারা আসলে সেই পূর্বপুরুষের কেমন সন্তান? তারা তো শত শত নবীকে হত্যা করেছে। তাওরাতকে বিকৃত করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের সাথে বেআদবী করা তাদের মজ্জাগত। যেই সুলাইমান আ.-এর দোহাই দিয়ে তারা বাইতুল মাকদিস ভেঙে কথিত হাইকালে সুলাইমানী (সুলাইমান আ. নির্মিত ইবাদতখানা) নির্মানের কথা বলে, তারা তো সেই সুলাইমান আ.-কে শুধু নবী নয়, একত্ববাদে বিশ্বাসী হিসেবেও গণ্য করে না। ইহুদীদের নিকট সুলাইমান আ. শেষ বয়সে মুরতাদ হয়ে যান, নাউযুবিল্লাহ। একথা তাদের বাইবেলে এখনো বিদ্যমান। [দ্র. বাইবেল, ১-বাদশানামা (১১) : ১-২১]
সবশেষে বলা যায়, জায়নবাদ মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে ইহুদী-খ্রিস্টানদের এক সম্মিলিত চক্রান্ত। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, সবশেষে আল্লাহর বাণীই সত্য বলে প্রমাণিত হবে-
وَ مَكَرُوْا وَ مَكَرَ اللهُ وَ اللهُ خَیْرُ الْمٰكِرِیْنَ.
কাফেররা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহও কৌশল করলেন। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ কৌশলী। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৫৪