Rabiul Awal 1445   ||   October 2023

বৃষ্টি এক মহা নিআমত

Mawlana Shibbir Ahmad

বৃষ্টি- আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক মহা নিআমত। এ নিআমতে সিক্ত হয় না এমন কে আছে! আমাদের জনজীবন যখন প্রচণ্ড গরমে অস্থির হয়ে পড়ে, একটুখানি বৃষ্টির পরশে তখন শীতল হয়ে যায় আমাদের দেহ-মন সবকিছু। তৃষ্ণার্ত জীবন রহমতের বারিধারায় পরিতৃপ্ত হয়। সজীব হয়ে ওঠে ফসলের মাঠ, প্রান্তর, আমাদের চারপাশ। বৃষ্টির পানিতে আমাদের দেহ-মন শীতল হয়- কথা এখানেই শেষ নয়। বৃষ্টির পানিতে সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে এ পৃথিবী। ফল-ফসলে পূর্ণ হয়ে ওঠে। সেখান থেকেই আমরা সংগ্রহ করি আমাদের জীবনধারণের অন্যতম প্রধান উপকরণ- খাবার। শুধু মানুষই নয়, পশুপাখিরাও রিজিক পায় এ বৃষ্টি থেকেই, বৃষ্টিতে জীবন্ত হয়ে ওঠা মাঠঘাটপ্রান্তর থেকে। এক বৃষ্টির মধ্যে তাই লুকিয়ে আছে বহু নিআমত।

বৃষ্টি কীভাবে হয়- আমাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর তো অনেক সহজ। নদীনালা আর সাগরের পানি রোদের তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আকাশে। সেখানে মেঘ হয়ে জমে থাকে। একসময় তা বৃষ্টির ফোঁটায় ঝরে পড়ে মাটিতে। সমীকরণটা তো সহজ, কিন্তু এ সহজ কাজটি করার শক্তি কি কারো আছে- এক আল্লাহ ছাড়া? তিনিই পারেন সাগরের পানিকে উড়িয়ে নিয়ে মেঘ আকারে জমা করতে। সে মেঘ তিনি হাঁকিয়েও নিয়ে যান। সেখান থেকে বর্ষণ করেন বৃষ্টি। এটা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। তিনিই জানেন- বৃষ্টি কখন হবে। তাঁর ইচ্ছা ক্ষমতা ও জ্ঞানের বাইরে নেমে আসতে পারে না এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি। এজন্যেই তো আমরা দেখি, কখনো ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ, শোনা যায় মেঘের গর্জন, পৃথিবীবাসী চমকে ওঠে বিদ্যুতের ঝলকানিতে, কিন্তু এতকিছুর পরও বৃষ্টি হয় না। ঘন কালো মেঘ কোথায় যেন হারিয়ে যায়! আবার কখনো রোদঝলমলে আকাশও হঠাৎ করে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। নেমে আসে ঝুপঝাপ বৃষ্টি। কখনো আবার রোদেলা আকাশ থেকেও ঝড়ে বৃষ্টি। এসবই মহামহিম আল্লাহর ক্ষমতা। তাঁর ইচ্ছাতেই হয় সবকিছু।

পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে বৃষ্টির নানামুখী মুগ্ধকর বিবরণ এসেছে। কোথাও বৃষ্টি বর্ষণকে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও কুদরতের নিদর্শন হিসেবে। কোথাও বৃষ্টি আল্লাহ তাআলার পরিচায়ক। বৃষ্টিকে কোনো কোনো আয়াতে আল্লাহর রহমত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বৃষ্টি কোথাও উল্লেখিত হয়েছে হৃদয়ছোঁয়া উপমায়। এমন কিছু আয়াত আমরা এখানে তুলে ধরছি।

এক. বৃষ্টি আল্লাহর রহমত এবং তাঁর পরিচায়ক

আল্লাহ তাআলার বাণী-

وَ هُوَ الَّذِیْ یُنَزِّلُ الْغَیْثَ مِنْۢ بَعْدِ مَا قَنَطُوْا وَ یَنْشُرُ رَحْمَتَهٗ    وَ هُوَ الْوَلِیُّ الْحَمِیْدُ.

তিনিই সে সত্তা, যিনি তারা নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং স্বীয় রহমতকে ছড়িয়ে দেন। তিনিই অভিভাবক, প্রশংসিত। -সূরা শূরা (৪২) : ২৮

এখানে স্বীয় রহমত মানে বৃষ্টি। বৃষ্টি বর্ষণ করার পর তিনি তা ছড়িয়েও দেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, বৃষ্টিকে তিনি নিজের রহমত হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন! তাঁর দয়া ও রহমতেই তো সংঘটিত হয় আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্ব। ছোট-বড় সবকিছু তাঁর অনুগ্রহেই হয়। আমাদের জীবন ও জীবন ধারণের সকল উপকরণ-সবই তাঁর রহমত। এ নিয়ে আল্লাহবিশ্বাসী কারো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু সবকিছুকে কি আল্লাহ তাআলা এভাবে নিজের রহমত বলে প্রকাশ করেছেন? বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অল্প কিছু বিষয়ই পেয়েছে এ মর্যাদা, আল্লাহর রহমতে ভূষিত হওয়ার মর্যাদা। বৃষ্টি সে গুটিকয়েক বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক-দুটি আয়াত নয়, অনেক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এ অনুগ্রহের কথা।

আয়াতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়- বৃষ্টি বর্ষণকে এখানে আল্লাহ তাআলার পরিচায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ তো সেই সত্তা, যিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এ পরিচয়ও ফুটে উঠেছে পবিত্র কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে। আরেকটি আয়াত লক্ষ করুন-

وَ هُوَ الَّذِیْ یُرْسِلُ الرِّیٰحَ بُشْرًۢا بَیْنَ یَدَیْ رَحْمَتِهٖ .

তিনিই সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রহমতের পূর্বে সুসংবাদস্বরূপ বাতাস প্রেরণ করেন-সূরা আরাফ (৭) : ৫৭

এখানেও আল্লাহ তাআলার রহমত মানে বৃষ্টি। আয়াতে বলা হয়েছে বৃষ্টির পূর্বে বয়ে যাওয়া হিমশীতল বাতাসের কথা। প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম যে কোনো বাতাসই হোক, বৃষ্টির পূর্বে যে শীতল বাতাস বয়ে যায় তার কি কোনো তুলনা হয়! কড়া রোদ, উত্তপ্ত পরিবেশ, প্রচণ্ড গরম- সব যেন মুহূর্তে শীতল হয়ে যায় এ বাতাসে। রোদের তাপে মানুষ যখন একপ্রকার সেদ্ধ হতে থাকে, একটুখানি শীতলতার আশায় তারা অধীর অপেক্ষমাণ থাকে বৃষ্টির, সে সময় বৃষ্টিপূর্ব এক ঝাপটা বাতাস মুছে দিয়ে যায় রোদ আর গরমের সব ছাপ। বৃষ্টি বর্ষণ করার ক্ষমতা যেমন একমাত্র আল্লাহ তাআলার, বৃষ্টিপূর্ব এ শীতল বায়ু দিয়ে সবরকম উষ্ণতার ছাপ মুছে দেয়ার ক্ষমতাও একমাত্র তাঁরই। তিনিই আল্লাহ, যিনি এ বাতাস সৃষ্টি করেন, যিনি এ বাতাস পাঠিয়ে থাকেন। এটাও আল্লাহ তাআলার এক পরিচয়।

আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ یُّرْسِلَ الرِّیَاحَ مُبَشِّرٰتٍ وَّ لِیُذِیْقَكُمْ مِّنْ رَّحْمَتِهٖ.

তাঁর অন্যতম নিদর্শন- তিনি বাতাস পাঠান, যেন তা (বৃষ্টির) সুসংবাদ দিতে পারে এবং তিনি তোমাদেরকে স্বীয় রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাতে পারেন। -সূরা রূম (৩০) : ৪৬

স্বীয় রহমত বলে এ আয়াতেও বৃষ্টিই উদ্দেশ্য। নিজ বান্দাদের জন্য তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন আর সে বৃষ্টির সুসংবাদস্বরূপ আগে পাঠিয়ে থাকেন বাতাস। এ আয়াতে এ বিষয়দুটিকে তাঁর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর কুদরত তো সর্বব্যাপী। জগতের ছোট-বড় যত ঘটনা, সব তো তাঁর ইশারাতেই হয়। বাহ্যত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অনেক কিছু করার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে সেসব কাজও যখন তাঁর ইচ্ছার অনুগামী হয়, তখনই সম্পাদিত হয়। তাঁর ইচ্ছার অনুকূল না হলে আমাদের সকল চেষ্টা বৃথা। কিন্তু পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার নিদর্শন হিসেবে এমনসব কাজের কথা আলোচিত হয়েছে, যেখানে মানুষের চেষ্টা বাহ্যিকভাবেও কার্যকর নয়। তাঁর কুদরতের এমনই দুটি নমুনা- তিনি প্রথমে বাতাস পাঠিয়ে থাকেন, এরপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন।

দুই. বৃষ্টির পানি বরকতময়

জগতে কত কিছু থেকে আমরা উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করি! আর আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করে দিয়েছেন- তিনি যে বৃষ্টি দিয়ে থাকেন, এর পানি বরকতময়। মানে এতে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও উপকার। এ বরকত কল্যাণ ও উপকারের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পবিত্র কুরআন থেকে পড়ুন-

وَ نَزَّلْنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً مُّبٰرَكًا فَاَنْۢبَتْنَا بِهٖ جَنّٰتٍ وَّ حَبَّ الْحَصِیْدِ،وَ النَّخْلَ بٰسِقٰتٍ لَّهَا طَلْعٌ نَّضِیْدٌ،رِّزْقًا لِّلْعِبَادِ  وَ اَحْیَیْنَا بِهٖ بَلْدَةً مَّیْتًا .

আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি বরকতপূর্ণ পানি, তারপর তার মাধ্যমে উদগত করি উদ্যানরাজি ও এমন শস্য, যা কাটা হয়ে থাকে। এবং সৃষ্টি করি এমন উঁচু উঁচু খেজুর গাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ দানা। (এসব) বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ এবং (এমনিভাবে) আমি সেই পানি দিয়ে এক মৃত নগরকে সঞ্জীবিত করেছি। -সূরা ক্বাফ (৫০) : ৪৫

এ আয়াতে বৃষ্টির পানিকে যেমন বরকত ও কল্যাণের ধারক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি এ পানি আমাদের জনজীবনকে কতটা উপকৃত ও আন্দোলিত করতে পারে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।

তিন. হক-বাতিলের উপমায় বৃষ্টি

পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা অনেক উপমা দিয়েছেন। উপমার বিষয়বস্তু হিসেবে হক-বাতিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হক-বাতিলের এক উপমায় তিনি বৃষ্টির প্রসঙ্গও এনেছেন। পড়ুন-

 اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَالَتْ اَوْدِیَةٌۢ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّیْلُ زَبَدًا رَّابِیًا  وَ مِمَّا یُوْقِدُوْنَ عَلَیْهِ فِی النَّارِ ابْتِغَآءَ حِلْیَةٍ اَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِّثْلُهٗ  كَذٰلِكَ یَضْرِبُ اللهُ الْحَقَّ وَ الْبَاطِلَ  فَاَمَّا الزَّبَدُ فَیَذْهَبُ جُفَآءً وَ اَمَّا مَا یَنْفَعُ النَّاسَ فَیَمْكُثُ فِی الْاَرْضِ        كَذٰلِكَ یَضْرِبُ اللهُ الْاَمْثَالَ.

তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। ফলে নদীনালা নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী প্লাবিত হয়েছে, তারপর পানির ধারা স্ফীত ফেনাগুলোকে উপরিভাগে তুলে এনেছে। এ রকমের ফেনা তখনও ওঠে, যখন লোকেরা অলংকার বা পাত্র তৈরির উদ্দেশ্যে আগুনে ধাতু উত্তপ্ত করে। আল্লাহ এভাবেই সত্য ও মিথ্যার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন যে, (উভয় প্রকারে) যা ফেনা, তা তো বাইরে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে থেকে যায়। এ রকমেরই দৃষ্টান্ত আল্লাহ বর্ণনা করে থাকেন। -সূরা রাদ (১৩) : ১৭

আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে হক-বাতিলের উপমা দিয়েছেন। যখন আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয় প্রবলভাবে, এরপর প্রতিটি উপত্যকা নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী পানি নিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। পানি যখন জমিনের উপর দিয়ে যেতে থাকে, তখন নানা রকমের আবর্জনা পানির সঙ্গে মিশে যায়। পানি ঘোলা হয়ে পড়ে। একসময় সকল আবর্জনা ফুলে ফেঁপে পানির উপরে চলে আসে। কিন্তু সামান্য সময় পরই তা আবার নিঃশেষ হয়ে যায়। যা উপকারী তা-ই জমিনে থেকে যায়। ঠিক একইভাবে আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে ওহী নাযিল করেন। সত্যধর্ম নিয়ে যখন আসমানী ওহী অবতীর্ণ হয় তখন মানুষের অন্তরগুলো নিজ নিজ ধারণক্ষমতা অনুসারে সেখান থেকে উপকৃত হতে থাকে, ফয়েজ হাসিল করতে থাকে। একপর্যায়ে হক-বাতিলের সংঘর্ষে অসত্যের আবর্জনা ফুলে ওঠে এবং দৃশ্যত হকের ওপর উঠে আসেকিন্তু এ ওপরে উঠে আসা খুবই সাময়িক। কিছু সময় পরই বাতিলের সব কারসাজি শেষ হয়ে যায়। হারিয়ে যায় তার সকল শৌর্যবীর্য। যা সত্য, তা-ই শেষ পর্যন্ত থেকে যায়।

চার. বৃষ্টি আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের প্রমাণ

সূরা ওয়াকিয়ায় আল্লাহ তাআলা অতি পরিচিত কিছু বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিষয়গুলো সত্যিই আমাদের অতি পরিচিতি, অতি ঘনিষ্ঠ, কিন্তু তা সত্ত্বেও তা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ তাআলা বারবার আমাদের সতর্ক করেছেন এ বলে-এগুলো কি তোমরা কর, না আমি করি?’ এ প্রসঙ্গেই তিনি আমরা যে পানি খাই, সে সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন করেছেন-

اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ،ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ،لَوْ نَشَآءُ جَعَلْنٰهُ اُجَاجًا فَلَوْ لَا تَشْكُرُوْنَ.

আচ্ছা বলো তো, যে পানি তোমরা পান কর, মেঘ থেকে তা কি তোমরা বর্ষণ কর, না আমিই বর্ষণ করে থাকি? আমি ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি, অতএব কেন তোমরা শোকর আদায় কর না? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৮-৭০

মেঘ থেকে যদি বৃষ্টি না ঝরতো, তবে আমরা কি খাওয়ার পানি পেতাম? আধুনিক বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার কি আমাদেরকে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে দিতে পারত? বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত পানি দিয়ে কি আমরা আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারতাম? সবগুলো প্রশ্নের একই উত্তর- না। আমাদের এ শক্তি নেই। আকাশে জমে থাকা মেঘ থেকে বৃষ্টি নামিয়ে আনার সক্ষমতাও আমাদের নেই, সে বৃষ্টির পানি বড় কোনো জলাধারে সংরক্ষণ করে তা পান-উপযোগী করে রাখার মতো সক্ষমতাও আমাদের নেই। আল্লাহ তাআলা সহজ ব্যবস্থা আমাদের জন্যে করে দিয়েছেন। বৃষ্টির পানি চলে যায় মাটির গভীরে। সেখান থেকে গভীর নলকূপ দিয়ে উঠে আসে পানি। এই যে বৃষ্টি বর্ষণ আর পানি সংরক্ষণ- এ একমাত্র আল্লাহ তাআলার পক্ষেই সম্ভব। তিনিই একমাত্র মাবুদ, তিনিই রাব্বুল আলামীন।

পাঁচ. বৃষ্টি অদৃশ্যের এক চাবি

হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مفاتيح الغيب خمس، لا يعلمها إلا الله.

অদৃশ্যের চাবি পাঁচটি বিষয়। এগুলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।

এরপর তিনি পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেছেন-

 اِنَّ اللهَ عِنْدَهٗ عِلْمُ السَّاعَةِ وَ یُنَزِّلُ الْغَیْثَ وَ یَعْلَمُ مَا فِی الْاَرْحَامِ وَ مَا تَدْرِیْ نَفْسٌ مَّا ذَا تَكْسِبُ غَدًا وَ مَا تَدْرِیْ نَفْسٌۢ بِاَیِّ اَرْضٍ تَمُوْتُ اِنَّ اللهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ.

সন্দেহ নেই, আল্লাহর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের ইলম। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। মাতৃগর্ভে যা আছে, তা কেবল তিনিই জানেন। কেউ জানে না- আগামীকাল সে কী করবে এবং কেউ জানে না- সে কোথায় মারা যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত। -সূরা লুকমান (৩১) : ৩৪

ছয়. বৃষ্টির পানিই রিযিক

উপরে আলোচিত হয়েছে, বৃষ্টির পানি দিয়ে আল্লাহ তাআলা ফল-ফসল উৎপন্ন করেন। সে হিসেবে বলা যায়, আমাদের রিযিক ও জীবনোপকরণ অনেকাংশেই বাহ্যত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় আল্লাহ তাআলার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-

وَ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخْرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّكُمْ.

এবং তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এরপর তা দিয়ে তোমাদের জীবিকাস্বরূপ বিভিন্ন প্রকার ফলমূল উৎপন্ন করেন। -সূরা বাকারা (২) : ২২

এরকম বর্ণনার পাশাপাশি কুরআনে বৃষ্টির পানিকেও রিযিক বলা হয়েছে। লক্ষ করুন-

هُوَ الَّذِیْ یُرِیْكُمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُنَزِّلُ لَكُمْ مِّنَ السَّمَآءِ رِزْقًا.

তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে স্বীয় নিদর্শনাবলি প্রত্যক্ষ করান এবং তোমাদের জন্যে আকাশ থেকে রিজিকঅবতীর্ণ করেন। -সূরা গাফির (৪০) : ১৩

সাত. বৃষ্টি আমাদের পবিত্র করে দেয়

বৃষ্টি যেমন আমাদের উষ্ণতা দূর করে শীতলতার পরশ বুলিয়ে দেয়, তেমনি বৃষ্টির পানি আমাদের বাহ্যিক ও শারীরিক অপবিত্রতাও দূর করে। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে-

وَ یُنَزِّلُ عَلَیْكُمْ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً لِّیُطَهِّرَكُمْ بِهٖ.

তিনি তোমাদের ওপর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যেন তা দিয়ে তোমাদেরকে তিনি পবিত্র করতে পারেন। -সূরা আনফাল (৮) : ১১

আট. বৃষ্টি সজীবতা নিয়ে আসে

রোদের তাপে কৃষি জমি যখন শুকিয়ে যায়, কখনো অত্যধিক গরমে মাটি ফেটে যায়, সে শুকনো জমিতে ফসলের আশা করা বৃথা। কিন্তু যখন বৃষ্টি নামে, এ নির্জীব জমি তখন সজীব হয়ে ওঠে। ভরে ওঠে ফল-ফসলে। হয়ে ওঠে সবুজ-শ্যামল। এটা আল্লাহ তাআলার কুদরতের এক নমুনা। জমি দৃশ্যত নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়ার পরও বৃষ্টির পানিতে তা আবার প্রাণ ফিরে পায়। মৃত জমিনকে তিনি যেমন জীবিত করতে পারেন, মৃত মানুষকেও কিয়ামতের দিন তিনি জীবিত করবেন। এ উদাহরণটি পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতেই বর্ণিত হয়েছে। একটি আয়াত লক্ষ করুন-

وَ اللهُ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَحْیَا بِهِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا  اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّسْمَعُوْنَ.

আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং জমির মৃত্যুর পর তা দিয়ে আবার তাতে প্রাণসঞ্চার করেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন আছে এমন লোকদের জন্য, যারা কথা শোনে। -সূরা নাহল (১৬) : ৬৫

বিভিন্ন সূরায় নানা আঙ্গিকে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। সূরা আবাসায় বলা হয়েছে এভাবে-

فَلْیَنْظُرِ الْاِنْسَانُ اِلٰى طَعَامِهٖۤ، اَنَّا صَبَبْنَا الْمَاءَ صَبًّا، ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ شَقًّا، فَاَنْۢبَتْنَا فِیْهَا حَبًّا،وَّ عِنَبًا وَّ قَضْبًا،وَّ زَیْتُوْنًا وَّ نَخْلًا،وَّ حَدَآىِٕقَ غُلْبًا،وَّ فَاكِهَةً وَّ اَبًّا،مَّتَاعًا لَّكُمْ وَ لِاَنْعَامِكُمْ.

মানুষ যেন তার খাবারের প্রতি লক্ষ করে। আমি উপর থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। তারপর ভূমিকে বিস্ময়করভাবে বিদীর্ণ করেছি। তারপর আমি তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর, শাকসবজি, যায়তুন, খেজুর, নিবিড় ঘন বাগান এবং ফলমূল ও ঘাসপাতা। তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের গবাদি পশুর ভোগের জন্য। -সূরা আবাসা (৮০) :  ২৪-৩২

বৃষ্টি আমাদের অতি পরিচিত একটি বিষয়। বৃষ্টি যখন নামে, সকলেই তা উপভোগ করে। এখানে ধনী-গরীব কিংবা অন্য কোনো প্রকারের বিভাজন নেই। এ এক অতি সাধারণ নিআমত। এ নিআমতটির মধ্যেও আমাদের জন্যে নিহিত রয়েছে আরো শত প্রকারের নিআমত। পবিত্র কুরআনে সেসব বর্ণিত হয়েছে নানা প্রসঙ্গে, বিচিত্র উপস্থাপনায়। যা উল্লেখ করা হল, তা কয়েকটি মাত্র। এগুলো নিয়ে যখন আমরা খুলে দেব আমাদের ভাবনার দুয়ার, আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতের সামনে তখন অবচেতনভাবেই নত হবে আমাদের শির। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হব আমরা। নিআমতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে তখনই।

 

advertisement