Rabiul Awal 1445   ||   October 2023

নামায : মুমিনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল

Mawlana Muhammad Tawheedul Islam Tayeib

দুনিয়ার জীবনে একজন মুমিনের সবচেয়ে  বেশি আনন্দের বিষয় কোনটি?

দেখা যায়, একেক মানুষ একেক বিষয়ে আনন্দ পেয়ে থাকে। একেকজন একেক বিষয়ে আগ্রহ অনুভব করে। কেউ ভ্রমণে। কেউ ভালো কোনো খাবারে। কেউ গল্প-আড্ডায়। কেউ বই পড়ায়। কেউবা ছোট-বড় আরো নানা কাজে। এই তালিকায় জীবনধারণের জন্য আবশ্যকীয় পর্যায়ের বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষয়ও। কোনো ধরনের কোনো লাভ-ক্ষতি নেই- এমন বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে অনর্থ অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ও।

মানুষের রুচি-পছন্দের এই পার্থক্য ব্যক্তিমাত্রই হয়ে থাকে। পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে।

জীবন ধারণের জন্য খাদ্যকে সবচেয়ে  বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এই খাদ্যে পুরো দুনিয়ার মানুষের পছন্দ-অপছন্দে কত পার্থক্য! প্রত্যেকের আগ্রহে-অনাগ্রহে কত তফাত! একই মায়ের সন্তান, একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা, একই ঘরে বসবাস। এরপরও দুজনের দুই খাবারে আগ্রহভিন্ন ভিন্ন দুই বিষয়ে দুজনের আনন্দ।

এই পার্থক্যগুলো হয় কখনো ব্যক্তিগত কারণে। কখনো পারিবারিক কারণে। কখনোবা সাথী-সঙ্গী কিংবা পরিবেশগত কারণে।

সেই সূত্রেই কারো আগ্রহ ও আনন্দের বিষয় হয়ে থাকে পড়াশোনা। কারো লেখালেখিকারো নামায, যিকির, কুরআন তিলাওয়াত ও দান সদকা!

প্রথমে শুনতে কিছুটা ব্যতিক্রম মনে হতে পারে। তবে একটু ভাবলেই বুঝে আসবে যে, এসবেও মানুষ আনন্দ পেতে পারে। এগুলোতেও মানুষের আগ্রহ থাকতে পারে। এমনকি সেই আগ্রহ-আনন্দ পাওয়াটা খুব স্বাভাবিকও বটে।

নামাযের গুরুত্ব

মুমিন হিসেবে একজন মানুষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহের, আনন্দের ও তৃপ্তির বিষয় কী হওয়া উচিত?

প্রথমত অবশ্যই ভালো কিছু হওয়া উচিত। সত্যিকারের কাক্সিক্ষত বিষয় হওয়া উচিত। এরপর সেই ভালো আর কাক্সিক্ষত হাজার বিষয়ের মধ্যে কোন্টি তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা জানার জন্য উচিত কুরআন ও হাদীসের শরণাপন্ন হওয়া।

কুরআনে মুমিন-মুত্তাকীর পরিচয় দিতে গিয়ে ঈমানের পরেই বলা হয়েছে নামাযের কথা। ইরশাদ হয়েছে-

الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ وَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ.

(মুত্তাকী তারা,) যারা গাইবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে। -সূরা বাকারা (২) : ৩

লক্ষ করার মতো বিষয় হল, আল্লাহ তাআলা ঈমান শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ওহী পাঠিয়েছেন। আর নামাযের বিধান দিয়েছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঊর্ধ্বালোকে নিয়ে। সাত আসমান পার করে আল্লাহর কাছে নিয়ে এই মহান গুরুত্বপূর্ণ উপহার ও ইবাদত দান করেছেন। অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। সুতরাং এই ইবাদত যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সেই ইবাদতেই মুমিনের বিরাট সফলতা নিহিত। সেজন্য কুরআন মাজীদে সফল মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছে-

الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ.

যারা নামাযে বিনয়াবনত। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ২

এরপর আরো কয়েকটি গুণ উল্লেখ করে শেষে আবার বলা হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ.

যারা নামাযের ব্যাপারে যত্নশীল। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ৯

আরেক জায়গায় আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাব ও মেযাজ প্রসঙ্গে  প্রথমে বলেছেন-

اِنَّ الْاِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوْعًا، اِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوْعًا، وَّ اِذَا مَسَّهُ الْخَیْرُ مَنُوْعًا، اِلَّا الْمُصَلِّیْنَ،الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَاتِهِمْ دَآىِٕمُوْنَ.

বস্তুত মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে লঘুচিত্তরূপে। যখন তাকে কোনো কষ্ট স্পর্শ করে, সে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়ে। আর যখন  তাকে স্বচ্ছন্দ স্পর্শ করে তখন সে হয়ে পড়ে অতি কৃপণ। তবে নামাযী ব্যক্তিরা ছাড়া। যারা তাদের নামায আদায় করে নিয়মিত। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ১৯-২৩

এখানে মানুষের সৃষ্টিগত দুর্বলতা ছাড়িয়ে অর্জনীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রসঙ্গে প্রথমেই বলেছেন নামাযের কথা। এরপর বেশ কয়েকটি গুণ উল্লেখ করার পর আবার বলেছেন-

وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَاتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ فِیْ جَنّٰتٍ مُّكْرَمُوْنَ .

এবং যারা তাদের নামাযের ব্যাপারে পুরোপুরি যত্নবান থাকে। তারাই জান্নাতে থাকবে। সম্মানজনকভাবে। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ৩৪-৩৫

নামাযের ফায়দা

নামাযের ফায়দা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ.

দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম করো। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ। -সূরা হুদ (১১) : ১১৪

এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, নামায বহু পাপ মিটিয়ে দেয়।

আরো ইরশাদ করেছেন-

وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ   اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ.

এবং নামায কায়েম করো। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫

অর্থাৎ নামায আদায় করতে থাকলে একসময় এই নামাযই মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে।

এছাড়া আল্লাহ তাআলার নুসরত ও সাহায্য প্রার্থনার জন্য নামাযকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-

وَ اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ وَ اِنَّهَا لَكَبِیْرَةٌ اِلَّا عَلَی الْخٰشِعِیْنَ.

তোমরা সবর ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় সালাতকে কঠিন মনে হয়; কিন্তু তাদের পক্ষে নয়, যারা খুশূ (অর্থাৎ বিনয় ও মনোযোগ)-এর সাথে আদায় করে। -সূরা বাকারা (২) : ৪৫

এখানে ধৈর্য ও নামাযের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার নুসরত ও সাহায্যের দৃঢ় আশ্বাস পাওয়া যায়।

নামাযে অবহেলা

কুরআন মাজীদে নামাযীদের যেমন প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নামাযে অবহেলাকারীদের প্রতি ধমকি ও হুঁশিয়ারীমূলক বক্তব্যও এসেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-

فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْنَ،الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ.

ধ্বংস রয়েছে সেই নামাযীদের জন্য, যারা তাদের নামাযে গাফলতি করে। -সূরা মাঊন (১০৭) : ৪-৫

এমনকি অলসতার সাথে নামায আদায়কে মুনাফিকদের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন-

وَ اِذَا قَامُوْۤا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا كُسَالٰی.

তারা যখন নামাযে  দাঁড়ায় অলসতার সাথে দাঁড়ায়। -সূরা নিসা (৪) : ১৪২

সূরা মারইয়াম-এ আল্লাহ তাআলা তাঁর নিআমতপ্রাপ্ত ও নৈকট্যশীল বান্দাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পর বলেছেন-

فَخَلَفَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ اَضَاعُوا الصَّلٰوةَ وَ اتَّبَعُوا الشَّهَوٰتِ فَسَوْفَ یَلْقَوْنَ غَیًّا.

তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হল এমন লোক, যারা নামায নষ্ট করল এবং ইন্দ্রিয় চাহিদার অনুগামী হল। সুতরাং তারা অচিরেই পথভ্রষ্টতার পরিণামের সম্মুখীন হবে। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৫৯

হাদীস শরীফে নামায প্রসঙ্গ

হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নামাযের কথা বলেছেনইরশাদ হয়েছে-

رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ.

দ্বীনের প্রধান বিষয় হল ইসলাম। এর খুঁটি হল নামায। আর তার উচ্চচূড়া  হল জিহাদ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬

এখানে নামাযকে বলা হয়েছে ইসলামের খুঁটি। যেকোনো অবকাঠামোর ক্ষেত্রে খুঁটির গুরুত্ব কতটুকু তা খুব সহজেই অনুমেয়।

মোটকথা, ঈমানের পর নামাযই প্রথম।  যেজন্য কুরআন-হাদীসে ঈমানের পর সর্বপ্রথম নামাযেরই উল্লেখ বারবার। আখেরাতেও সর্বপ্রথম বিষয় নামায।  হাদীস শরীফে এসেছে-

কিয়ামতের দিন বান্দার আমলগুলোর মাঝে সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে নামাযের। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪১৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৬৬

বোঝা গেল, দুনিয়াতে যেমন, তেমনি আখেরাতেও নামাযের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সতর্কতা উচ্চারণ করে বলা হয়েছে-

إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ.

নিশ্চয় একজন মানুষ ও কুফর-শিরকের মাঝে পার্থক্যরেখা হল নামায। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮২

এ আমলে অবহেলা যেমন বড় অন্যায়, যথাযথ আদায়ে নেকী ও প্রাপ্তিও অনেক বড়। এর মাধ্যমে বান্দার গোনাহ ধুয়ে-মুছে যায়। ইরশাদ হয়েছে-

مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ كَمَثَلِ نَهْرٍ جَارٍ غَمْرٍ عَلَى بَابِ أَحَدِكُمْ، يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ.

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত হল তোমাদের কারো (ঘরের) দরজার সামনে দিয়ে প্রবাহিত বড় নদীর মতো। যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৪

হাদীসটি অন্যত্র আরো বিস্তারিতভাবে আছে। তাতে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, এভাবে পাঁচবার গোসল করলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকতে পারে? পারে না। তারপর বলেছেন-

فَإِنَّ الصَّلَاةَ تُذْهِبُ الذُّنُوبَ كَمَا يُذْهِبُ الْمَاءُ الدَّرَنَ.

নিশ্চয় নামায গোনাহসমূহকে তেমনিভাবে দূর করে দেয়, যেমন পানি শরীরের ময়লা দূর করে দেয়। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩৯৭

অর্থাৎ নিয়মিত নামায পড়তে থাকলে নামাযী হবে পবিত্র ও গোনাহমুক্ত। তবে কবীরা গোনাহ হলে অবশ্যই তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা চাইতে হবে। ইরশাদ হয়েছে-

الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান- মধ্যবর্তী সকল গোনাহকে মিটিয়ে দেয়। কবীরা গোনাহ ছাড়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩

সাহাবীদেরকে নামাযে উৎসাহদান

হযরত রাবীআ ইবনে কাব আলআসলামী রা. বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রাত্রি যাপন করলাম। তখন আমি তাঁর কাছে ওযুর পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, আমার কাছে কোনো কিছু চাও।

আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সঙ্গ কামনা করছি।

তিনি বললেন, এছাড়া অন্য কিছু?

আমি বললাম, এটাই চাই। তিনি বললেন-

فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُود.

তাহলে অধিক পরিমাণে সিজদা (তথা নামায) আদায়ের মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৯

অর্থাৎ সিজদা ও নামায আদায়ের মাধ্যমে বান্দার মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকে।

একবার সাওবান রা.-কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلهِ، فَإِنَّكَ لَا تَسْجُدُ لِلهِ سَجْدَةً، إِلَّا رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً، وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً.

বেশি পরিমাণে আল্লাহ তাআলাকে সিজদা কর। নিশ্চয় তুমি একবার আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করলে তিনি তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং একটি গোনাহ ক্ষমা করে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৮

নবীজীর নামায

আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন-

أَنَّ نَبِيَّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُومُ مِنَ اللَّيْلِ حَتَّى تَتَفَطَّرَ قَدَمَاهُ، فَقَالَتْ عَائِشَةُ: لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُولَ اللهِ، وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ؟ قَالَ: أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا!

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামায পড়তেন। (এত দীর্ঘ নামায পড়তেন যে,) তাঁর উভয় পা ফুলে যেত। তখন আয়েশা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এমন (এত কষ্ট) করেন কেন? আল্লাহ তাআলা  তো আপনার পূর্বাপর সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন!

তিনি বললেন, আমি কি শোকরগুযার বান্দা হতে চাইব না? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭

এছাড়া যখনই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হতেন, নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। বর্ণিত হয়েছেÑ

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا حَزَبَهُ أَمْرٌ،صَلَّى.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সম্মুখীন হতেন নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৯

নামাযে তিনি যে শান্তি ও তৃপ্তি পেতেন সেকথাও বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলতেন-

يا بلالُ، أقِمِ الصَّلاةَ، أرِحْنا بها.

বেলাল! নামাযের ব্যবস্থা কর। নামাযের মাধ্যমে আমাকে প্রশান্ত কর। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৮৫

সর্বোপরি তিনি বলেছেন-

جُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ.

আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে নামাযে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩৯৪০

সাহাবায়ে কেরামের কাছে নামাযের গুরুত্ব

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযকে যেমন গুরুত্ব দিতেন, নামাযের প্রতি যেমন আগ্রহ ও অনুরাগ পোষণ করতেন সাহাবায়ে কেরামের অবস্থাও ছিল তেমনি। নামাযকে তারা মনেপ্রাণে ভালবাসতেন। নামাযকে জীবনের শ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন। তাঁরা মনে করতেন, নামায ঠিক থাকলে অন্যান্য কাজকর্ম ঠিক থাকবে। নামাযে ত্রুটি থাকলে অন্যান্য কাজকর্মেও ত্রুটি ও অবহেলার আশঙ্কা থাকবে।

আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রা. একবার ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন শহরে নিযুক্ত দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে ফরমান পাঠালেন। সেখানে লিখলেন-

إِنَّ أَهَمَّ أَمْرِكُمْ عِنْدِي الصَّلَاةُ مَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَفِظَ دِينَهُ وَمَنْ ضَيَّعَهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ.

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামায। যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হবে এবং গুরুত্বের সাথে নামায আদায় করবে সে তাঁর দ্বীনকে হেফাযত করবে। আর যে ব্যক্তি নামায নষ্ট করবে (নামাযের ক্ষেত্রে অবহেলা করবে) সে অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে অধিক নষ্টকারী (অবহেলাকারী) হয়ে থাকবে। -মুয়াত্তা মালেক, বর্ণনা  ৬

তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীন যুগে

সাহাবায়ে কেরাম থেকে দ্বীন শিখেছেন তাবিয়ীনে কেরাম। সাহাবায়ে কেরামকে দেখে দেখে তারা তাদের জীবন সাজিয়েছেন। তাঁদেরকে অনুসরণ করে করে জীবন গড়েছেন। তাই সাহাবায়ে কেরামের ছাপ ফুটে উঠেছে তাবিয়ীনে কেরামের মাঝে। জীবন যাপনের বাহ্যিক বিষয়াশয়ের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি আকীদা-বিশ্বাস ও আমল-ইবাদতের ক্ষেত্রেও।

বিখ্যাত তাবিয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-

مَا نُودِيَ بِالصَّلاةِ أَرْبَعِينَ سَنَةً إِلا وَسَعِيدٌ فِي الْمَسْجِدِ.

চল্লিশ বছর ধরে অবস্থা এমন ছিল যে, আযান হচ্ছে আর সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব (৯৪ হি.) রাহ. মসজিদে নেই- এমনটি ঘটত না।  -হিলইয়াতুল আউলিয়া ২/১৬৩; কিতাবুস সিকাত ইবনে হিব্বান ৪/২৭৪

ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রাহ. বলেন-

كَانَ الأَعْمَشُ قَرِيْباً مِنْ سَبْعِيْنَ سَنَةً لَمْ تَفُتْهُ التَّكْبِيْرَةُ الأُوْلَى.

প্রায় সত্তর বছর যাবৎ আমাশ রাহ. (১৪৮ হি.)-এর তাকবীরে উলা ছোটেনি। -তারীখে বাগদাদ ১০/৫, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/২২৮

ফিকহে হানাফীর বড় একজন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সামাআ রাহ. (২৩৩ হি.) বলেন-

مَكَثتُ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً لَمْ تَفُتْنِي التَّكبِيرَةُ الأُوْلَى، إِلاَّ يوما واحدا ماتت فيه أمي ففاتتني صلاة واحدة في جماعة.

চল্লিশ বছর যাবৎ আমার তাকবীরে উলা ছোটেনি, একদিন ছাড়া; সেদিন আমার মায়ের ইন্তিকাল হয়। তাই এক ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করতে পারিনি। -তারীখে বাগদাদ ৫/৩৪৩, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১০/৬৪৬

নামাযের ব্যাপারে এমনই ছিলেন আমাদের সালাফে সালিহীন। নামাযের ব্যাপারে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামে। তাই আমাদের জীবনেও নামাযের বিষয়ে এমন যত্ন ও গুরুত্ব থাকা উচিত।

নামায যেন হয় আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ আমল এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন- আমীন। 

 

advertisement