উস্তায ও শাগরিদের সম্পর্ক : কিছু নমুনা
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!
আল্লাহ তাআলা তাআল্লুক ও সম্পর্কের যে নিআমত দান করেছেন এর মধ্যে অত্যন্ত বরকতপূর্ণ একটি সম্পর্ক হল উস্তায-শাগরিদের সম্পর্ক। এটাই সে পবিত্র সম্পর্ক, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দ্বীন ও শরীয়তকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করবেন। যতদিন এ সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং যতদিন এ সম্পর্কের হক যথাযথ আদায় করা হবে ততদিন দ্বীন ও শরীয়তের ইলম দুনিয়াতে বাকি থাকবে। আর এ সম্পর্ক যত হালকা হবে এবং এ সম্পর্কের যত না-কদরী করা হবে, দুনিয়া থেকে ইলম তত বিদায় নেবে এবং একপর্যায়ে দুনিয়া ইলমশূন্য হয়ে যাবে।
মনে রাখবেন, এক হল সম্পর্কের সুরত, আরেক হল সম্পর্কের হাকীকত। কেবল সুরত দিয়ে কখনো হাকীকত হাসিল হয় না। হাদীস শরীফে আছে, বিদায় হজে¦র খুতবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ خُذُوا مِنَ الْعِلْمِ قَبْلَ أَنْ يُقْبَضَ الْعِلْمُ، وَقَبْلَ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ.
লোকসকল! ইলম উঠিয়ে নেওয়ার আগে ইলম হাসিল করে নাও।
এক আ‘রাবী জিজ্ঞেস করল-
يَا نَبِيَّ اللهِ، كَيْفَ يُرْفَعُ الْعِلْمُ مِنَّا وَبَيْنَ أَظْهُرِنَا الْمَصَاحِفُ وَقَدْ تَعَلَّمْنَا مَا فِيهَا، وَعَلَّمْنَا نِسَاءَنَا وَذَرَارِيَّنَا وَخَدَمَنَا؟
আল্লাহর নবী! আমাদের থেকে ইলম কীভাবে উঠিয়ে নেওয়া হবে, অথচ আমাদের মাঝে কুরআন আছে, আমরা নিজেরা কুরআন শিখেছি এবং আমাদের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও খাদেমদেরও শিখিয়েছি?
তখন তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন-
أَيْ ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ وَهَذِهِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى بَيْنَ أَظْهُرِهِمُ الْمَصَاحِفُ لَمْ يُصْبِحُوا يَتَعَلَّقُونَ بِحَرْفٍ مِمَّا جَاءَتْهُمْ بِهِ أَنْبِيَاؤُهُمْ.
আরে, ইহুদী-নাসারাদের কাছেও তো কিতাব আছে, কিন্ত তাদের নবীগণ তাদের কাছে যা নিয়ে এসেছিলেন, তার এক হরফের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক নেই।
এরপর তিনবার বললেন-
أَلَا وَإِنَّ مِنْ ذَهَابِ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ.
শুনে রাখো, ইলম চলে যাওয়ার অর্থ- তার বাহকগণ চলে যাওয়া। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২২৯০
উস্তাযের সামনে কিতাব নিয়ে বসা এবং কিছু শব্দ ও বাক্য মুখস্থ করে নেওয়া- এটা সম্পর্কের সুরত; হাকীকত নয়। হাকীকত তো সেটা, যেটা আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের মধ্যে ছিল। আর সে কারণেই আমাদের পর্যন্ত দ্বীন ও শরীয়তের ইলম যথাযথভাবে পৌঁছেছে।
উস্তায-শাগরিদের হাকীকী সম্পর্কের ফলাফল কেমন হয়- তার একটা নমুনা উদ্ধৃত করেছেন ইমাম যাহাবী রাহ.। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর জীবনীতে লেখেন-
قَالَ حُمَيْدُ بنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الرُّؤَاسِيُّ: يُقَالُ: لَمْ يَكُنْ أَحَدٌ مِنَ الصَّحَابَةِ أَشبَهَ هَدْياً وَسَمْتاً وَدَلاًّ مِن ابنِ مَسْعُوْدٍ بِالنَّبِيِّ - صلَّى اللهُ عليَهِ وَسلَّمَ - وَكَانَ أَشبَهَ النَّاسِ بِهِ عَلْقَمَةُ، وَكَانَ أَشبَهَ النَّاسِ بِعَلْقَمَةَ إِبْرَاهِيْمُ، وَكَانَ أَشبَهَهُم بَإِبْرَاهِيْمَ مَنْصُوْرُ بنُ المُعْتَمِرِ، وَأَشبَهَ النَّاسِ بِهِ سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، وَأَشبَهَ النَّاسِ بِهِ وَكِيْعٌ، وَأَشبَهَ النَّاسِ بوَكِيْعٍ -فِيْمَا قَالَهُ مُحَمَّدُ بنُ يُوْنُسَ الجَمَّالُ- أَحْمَدُ بنُ حَنْبَلٍ.
অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ছিলেন আচার-আচরণ, চলাফেরা ও বেশভূষায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। আর তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন আলকামা। আলকামার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য ছিল ইবরাহীম নাখাঈর। ইবরাহীম নাখাঈর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য ছিল মানসুর ইবনে মু‘তামিরের। তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য ছিল সুফিয়ান সাওরীর। সুফিয়ান সাওরীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য ছিল ওয়াকী-এর। আর ওয়াকী-এর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য আহমাদ ইবনে হাম্বলের। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, যাহাবী ১১/৩১৬-৩১৭
সাদৃশ্যের এ ধারা তখনই তৈরি হয়, যখন উস্তায-শাগরিদের সম্পর্ক হাকীকী হয়। বর্তমানে ইলমী অঙ্গনে সবচেয়ে বড় ফেতনাগুলোর একটা হল, উস্তায-শাগরিদের সম্পর্কটা ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। হাকীকত তো দুর্বল হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন সুরতটাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আজকাল যে অনেক তালিবে ইলম থেকে বিভিন্ন রকমের আজনবী ও উদ্ভট কথা, চিন্তা ও আচরণ প্রকাশ পায়, তার মূল কারণ এটাই। বলাবাহুল্য, সম্পর্কের দুর্বলতা যত বাড়বে, উদ্ভট ও আজনবী কথাবার্তা ও চিন্তাধারা তত বৃদ্ধি পাবে।
অতএব ইলমের হাকীকত হাসিল করতে হলে প্রথমে উস্তায-শাগরিদের সম্পর্কটাকে হাকীকী করতে হবে। আর এর জন্য এ সম্পর্কের হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রিসালা-
استاد اور شاگرد کے حقوق اور تعلیم وتربیت کے طریقے
এটি মূলত এ বিষয়ে হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর বাণী সংকলন। এটি প্রস্তুত করেছেন হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ যায়েদ মাযাহেরী দামাত বারাকাতুহুম। এছাড়া শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর কিতাব ‘মাআলিমু ইরশাদিয়্যাহ’তেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। হযরত মাওলানা সায়্যিদ সিদ্দীক আহমাদ বান্দভী রাহ.-এর ‘আদাবুল মুতাআল্লিমীন’ ও ‘আদাবুল মুআল্লিমীন’ও মুতালাআযোগ্য কিতাব।
যাহোক এখানে কেবল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আদবের কথা মুযাকারা করা হবে।
১. উস্তাযের প্রতি আযমত, মহব্বত ও খেদমত
এটি উস্তাযের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদব। দিলে উস্তাযের প্রতি আযমত ও মহব্বত থাকতে হবে এবং বাইরে সেটার প্রকাশও ঘটাতে হবে, যাতে উস্তাযের দিলেও ছাত্রের প্রতি মহব্বত তৈরি হয়। সেইসঙ্গে উস্তায নারাজ হন ও কষ্ট পান- এমন যে কোনো কথা ও কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। কারণ এটা উস্তাযের কাছ থেকে ইলম হাসিলে অনেক বড় বাধা।
সালাফের জীবনীতে তো এ বিষয়ক ঘটনা অসংখ্য। এখানে কেবল একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হচ্ছে।
রবী ইবনে সুলায়মান রাহ.। জন্ম ১৭৪ হি., মৃত্যু ২৭০ হি.। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর খাস শাগরিদ। তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা কিতাবে (২/১৩২-১৩৯) তাঁর জীবনী আছে। সেখানে ইমাম সুবকী রাহ. (৭৭১ হি.) তার জীবনী শুরু করেন এভাবে-
صَاحِبُ الشافعي ورَاوِيةُ كُتُبِه، والثِّقةُ الثَّبْتُ فِيمَا يَروِيهِ، حَتَّى لقد تعَارض هُوَ وَأَبُو إِبْرَاهِيمَ المزنيُّ في رِوَايَةٍ، فَقَدَّم الْأَصْحَابُ رِوَايَتَه، مَعَ عُلُوِّ قَدْرِ أَبي إِبْرَاهِيمَ، عِلمًا ودِينًا وجلالةً، وموافقةِ مَا رَوَاهُ للقواعد.
‘ইমাম শাফেয়ীর শাগরিদ এবং তার কিতাবসমূহের বর্ণনাকারী। তিনি যা বর্ণনা করেন তাতে তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন। এমনকি ইমাম শাফেয়ীর এক বক্তব্য নিয়ে তার ও আবু ইবরাহীম মুযানীর মাঝে ইখতিলাফ হলে মাযহাবের আলেমগণ তার বর্ণণাকেই প্রাধান্য দেন। অথচ আবু ইবরাহীম মুযানীও ইলম ও দ্বীনদারির ক্ষেত্রে উঁচু স্তরের ব্যক্তিত্ব।’
অথচ শুরুর দিকে তার হালত কেমন ছিল?
সুবকী রাহ. লেখেন-
وَقَالَ الْقَفَّال في فَتَاوِيهِ : كَانَ الرّبيع بطيءَ الْفَهمِ، فكَرَّرَ الشافعيُّ عَلَيْهِ مَسْأَلَةً وَاحِدَةً أَرْبَعِينَ مرّةً، فَلَمْ يَفْهَمْ، وَقَامَ من الْمجْلس حَيَاءً، فَدَعَاهُ الشافعيُّ في خلْوَةٍ، وَكَرَّرَ عَلَيْهِ حَتَّى فَهِمَ.
‘কাফফাল তার ফাতাওয়ায় লেখেন, রবী ইবনে সুলায়মানের বুঝশক্তি ছিল ধীর। শাফেয়ী রাহ. একটি মাসআলা তাকে চল্লিশ বার বলেছিলেন; এর পরও তিনি বোঝেননি! একপর্যায়ে তিনি লজ্জায় মজলিস থেকে উঠে যান। শাফেয়ী রাহ. তাকে একান্তে ডেকে বোঝাতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তিনি বুঝতে সক্ষম হন।’
একটা মাসআলা চল্লিশবার বলার পরও বোঝেননি! আল্লাহ তাআলা ইমাম শাফেয়ী রাহ.-কে জাযায়ে খায়ের দান করুন; তিনিও হাল ছাড়েননি।
এখানে লক্ষণীয় হল, এই যে বিশাল পরিবর্তন- এর রহস্য কী? এর রহস্য হল, উস্তায-শাগরিদের গভীর সম্পর্ক। উস্তাযের প্রতি ছাত্রের আযমত, মহব্বত ও খেদমত আর ছাত্রের প্রতি উস্তাযের শফকত ও মহব্বত। ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেন-
مَا خَدَمني أحدٌ قطّ مَا خَدَمني الرّبيعُ بنْ سُلَيْمَان.
‘রবী ইবনে সুলায়মান আমার যে খেদমত করেছে, অন্য কেউ তা করেনি।’
রবী ইবনে সুলায়মান রাহ. বলেন-
والله ما اجترأتُ أن أشرب الماء والشافعيّ ينظر إليَّ هيبةً له.
আল্লাহর কসম! শাফেয়ী রাহ. আমার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় আমি পানি পান করারও সাহস করতাম না। -মানাকিবুশ শাফিয়ী, বায়হাকী ২/১৪৫
উস্তাযের প্রতি রবী ইবনে সুলায়মানের এ আযমত ও মহব্বতের কারণে ইমাম শাফেয়ী রাহ.-ও তাকে মহব্বত করতেন। এমনকি ইমাম শাফেয়ী রাহ. একবার তাকে বলেন-
مَا أَحَبَّكَ إِلَيَّ!
‘তোমার প্রতি আমার অন্তরে এত মহব্বত কীভাবে হল!’
আরেকবার বলেন-
يَا رَبِيع لَو أَمْكَنَنِي أَن أُطْعِمَكَ الْعلمَ لَأَطْعَمْتُكَ.
‘রবী! ইলম খাইয়ে দেওয়া সম্ভব হলে আমি তোমাকে খাইয়ে দিতাম।’
স্পষ্ট যে, উস্তাযের মহব্বত জোর করে আদায় করা যায় না। আর উস্তাযকে খুশী করা ও খুশী রাখা এবং উভয়ের সম্পর্ককে সজীব রাখা- এটা তালিবে ইলমেরই দায়িত্ব।
২. উস্তাযের আদব-আখলাক ও আফকার ধারণের চেষ্টা করা
উস্তাযের সঙ্গে সম্পর্ক করার এবং উস্তাযের খেদমত ও সোহবতে থাকার প্রধান একটি মাকসাদ এটা। উস্তাযের আদব-আখলাক ও আফকার ধারণের চেষ্টা করা। সালাফের যিন্দেগীতে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
‘মুসতাদরাক আলাসসহীহাইন’-এর মুসান্নিফ হাকিম আবু আবদিল্লাহ নিশাপুরী রাহ. বলেন-
كان شيخنا أبو بكر بن إسحاق إذا ذُكِرَ عقلُ أبي علي الثقَفي يقول : ذلك عقلٌ مأخوذٌ من الصحابة والتابعين، فإنَّ مالك بن أنس وَرِثَ ذلك عنهم، حتى شَهِد له به أهلُ الحَرَمين.
ثم إن يحيى بن يحيى التميمي خرج إلى مالك بن أنس، فأقام عنده سنةً، فقيل له : قد فَرَغْتَ من سَمَاعِكَ، فأَطَلْتَ القِيَامَ؟ فقال : إنّما أَقَمت مستفيداً لشمائله، فإنها شمائل الصحابة والتابعين.
ثم إن أبا عبد الله محمد بن نصر المروزي أقام عند يحيى بن يحيى لأخذ تلك الشمائل، فلم يكن بخراسان أعقل منه.
وكذلك أقام أبو علي الثقفي بسمرقند أربع سنين، فأخذ تلك الشمائل من محمد بن نصر.
অর্থাৎ আমাদের শায়েখ আবু বকর ইবনে ইসহাক (সিবগী)-এর সামনে আবু আলী সাকাফীর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও আদব-আখলাকের আলোচনা উঠলে তিনি বলতেন, এটা সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রাপ্ত। কারণ মালেক ইবনে আনাস এটা তাদের থেকে মীরাসসূত্রে পেয়েছেন। এমনকি হারামাইনের আলেমগণ এ সম্পর্কে তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এরপর ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া তামীমী মালেক ইবনে আনাসের নিকট এক বছর অবস্থান করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার তো (মুয়াত্তা) শোনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর পরও এতদিন অবস্থান করলেন?
বললেন, আমি অবস্থান করছিলাম তাঁর আদব-আখলাক শেখার জন্য। কারণ তা সাহাবা-তাবেয়ীনের আদব-আখলাক।
এরপর আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে নস্র মারওয়াযী ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়ার নিকট অবস্থান করলেন সে আদব-আখলাক গ্রহণের জন্য। ফলে খোরাসানে মারওয়াযীর চেয়ে অধিক আকলমান্দ আর কেউ ছিল না।
এরপর আবু আলী সাকাফীও দীর্ঘ চার বছর মুহাম্মাদ ইবনে নস্রের সোহবতে থেকে সে আদব-আখলাক শিখেছেন। -মানাকিবু মালিক ইবনি আনাস, ইবনে ফিহর মিসরী, পৃ. ২২৩
৩. উস্তায থেকে ইলম ও তাফাক্কুহ হাসিলে সচেষ্ট হওয়া
এটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। সালাফের জীবনীতে এমন দৃষ্টান্ত একদমই বিরল যে, একজন দীর্ঘদিন উস্তাযের খেদমতে ছিল অথচ উস্তাযের ইলমী মীরাসের ক্ষেত্রে তার ইমতিয়াযী শান নেই। সালাফের যামানায় ‘উস্তাযের খাস খাদেম’ আর ‘উস্তাযের ইলমী মীরাসের খাস ওয়ারিস’ প্রায় সমার্থক ছিল। কারণ তাঁরা খেদমতের পাশাপাশি উস্তায থেকে ইলম ও তাফাক্কুহ হাসিলেও সচেষ্ট থাকতেন।
ইমাম আবু হানীফা রাহ. ফকীহুল ইরাক হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মানের খাস শাগরিদ। একাধারে দীর্ঘ ১৮ বছর হাম্মাদ রাহ.-এর সোহবতে ছিলেন। এ দীর্ঘ সময় তিনি কীভাবে হাম্মাদ রাহ. থেকে ইলম ও ফিকহ হাসিল করেছেন? দেখুন-
عَنْ عَاتِكَةَ، أُخْتِ حَمَّادِ بْنِ أَبِي سُلَيْمَانَ قَالَتْ: كَانَ النُّعْمَانُ بِبَابِنَا يَنْدِفُ قُطْنَنَا وَيَشْرِي لَبَنَنَا وَبَقْلَنَا وَمَا أَشْبَهَ ذَلِكَ، فَكَانَ إِذَا جَاءَ الرَّجُلُ يَسْأَلُهُ عَنِ الْمَسْأَلَةِ قَالَ: مَا مَسْأَلَتُكَ؟ قَالَ: كَذَا وَكَذَا. قَالَ : الْجَوَابُ فِيهَا كَذَا، ثُمَّ يَقُولُ: عَلَى رِسْلِكَ، فَيَدْخُلُ إِلَى حَمَّادٍ فَيَقُولُ لَهُ: جَاءَ رَجُلٌ فَسَأَلَ عَنْ كَذَا فَأَجَبْتُهُ بِكَذَا، فَمَا تَقُولُ أَنْتَ؟ فَقَالَ: حَدَّثُونَا بِكَذَا وَقَالَ أَصْحَابُنَا كَذَا وَقَالَ إِبْرَاهِيمُ كذَا، فَيَقُولُ : فَأَرْوِيهِ عَنْكَ؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ، فَيَخْرُجُ فَيَقُولُ: قَالَ حَمَّادٌ كَذَا.
হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মানের বোন আতেকা বলেন, নুমান (আবু হানীফা রাহ.) আমাদের বাড়ির দরজায় আমাদের তুলা ধুনতেন এবং আমাদের দুধ-সবজি ইত্যাদি কিনে আনতেন। কেউ মাসআলা জিজ্ঞেস করতে আসলে বলতেন, আপনার কী প্রশ্ন? লোকটি প্রশ্ন বললে প্রথমে তিনি নিজেই উত্তর দিতেন। এরপর বলতেন, একটু অপেক্ষা করুন। তারপর তিনি হাম্মাদ রাহ.-কে গিয়ে বলতেন, একজন এটা জিজ্ঞেস করেছে আর আমি তার এ উত্তর দিয়েছি। এবার আপনি কী বলেন?
হাম্মাদ রাহ. বলতেন, আমাদের উস্তাযগণ এ সম্পর্কে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন, আমাদের মাশায়েখ এই বলেছেন, ইবরাহীম (নাখায়ী) রাহ. এই বলেছেন। সব শুনে নুমান বলতেন, এবার আমি কি লোকটিকে তা বলে আসব?
তিনি বলতেন, হাঁ।
তখন নুমান বের হয়ে লোকটিকে বলতেন, হাম্মাদ এই বলেছেন। -তাবাকাতুল মুহাদ্দিসীন বি আসবাহান ওয়াল ওয়ারিদীনা আলাইহা, আবুশ শায়খ ১/৩৩০
এ ঘটনায় অনেক শিক্ষা রয়েছে। এখানে দেখানোর বিষয় হল, আবু হানীফা রাহ. কীভাবে খেদমতের পাশাপাশি উস্তায থেকে ইলম ও ফিকহ হাসিলে সচেষ্ট ছিলেন। তাছাড়া এখান থেকে আরেকটি বিষয় বোঝা যায়। সেটি হল, উস্তায থেকে ইলম ও তাফাক্কুহ হাসিলের সুযোগগুলো ছাত্রকেই কৌশল করে বের করে নিতে হয়। তবে স্পষ্ট যে, এর জন্য তালিবে ইলমের মধ্যে ইলমের অদম্য আগ্রহ থাকতে হবে। সর্বদা এই ফিকিরে থাকতে হবে, কখন কীভাবে উস্তায থেকে ইস্তিফাদা করা যায়। নতুবা দেখা যাবে, বছরের পর বছর কেটে গেছে অথচ ঝুলি ফাঁকাই রয়ে গেছে। কিছুই হাসিল করতে পারেনি উস্তাযের কাছ থেকে।
৪. উস্তাযের আস্থা অর্জন
উস্তাযের আস্থা যিন্দেগীর মহা মূল্যবান পাথেয়। শাগরিদের প্রতি উস্তাযের আস্থা যত বেশি হবে, উস্তায-শাগরিদের সম্পর্ক তত অটুট হবে এবং ইফাদা ও ইস্তিফাদা তত সহজ ও বরকতময় হবে। সেজন্য তালিবে ইলমের কর্তব্য, ইলমের জন্য যথাযথ মেহনত, আদব, তাওয়াযু এবং হুসনে আখলাক ও হুসনে আ‘মালের মাধ্যমে উস্তাযের সুধারণা ও আস্থা অর্জন করা, যাতে তিনি শাগরিদের বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আমাদের নিকট আকাবিরের একটি ঘটনা দেখুন। আপবীতীতে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. নিজের ঘটনা লিখেছেন-
১৩৪৩ হি. মোতাবেক ১৯২৪ ঈ. সনে প্রবল বৃষ্টিপাতে নদী-নালা সব ভরে গেল। কোনো এলাকায় মারাত্মক বন্যা দেখা দিল। খানে আলমপুরা মহল্লায় শহরের কয়েকটি নালা ও নদী একাকার হয়ে সমুদ্র বনে গিয়েছিল। এ দুর্যোগপূর্ণ সময়েও ভ্রমণ বিলাসীরা ভ্রমণেই ব্যস্ত ছিল। উপদেশ গ্রহণ করবে কী, সারাদিন ঘোরাঘুরি ও আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকত। একবার হযরতের (হযরত মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ.) মজলিসে আলোচনা উঠল, খানে আলমপুরার নদীতে পানি এত বেড়ে গেছে যে, আশংকা হচ্ছে, কালই শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
হযরত এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জনাব আলহাজ্ব মকবুল আহমাদ সাহেব বললেন, মৌলভী যাকারিয়াও তো গতকাল দেখতে গিয়েছিল। তার থেকে জেনে নিন।
হযরত একদম স্বাভাবিকভাবে বললেন, না, ও যায়নি।
হাজ্বী সাহেবের রাগ এসে গেল। বললেন, এত সুধারণারও বা কী হল! সে তো সামনে আছে; জিজ্ঞেস করে দেখুন।
হযরত আবারও বললেন, না, ও যায়নি।
হাজ্বী সাহেব পুনরায় জোর দিয়ে বললেন, আখের তাকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন না!
তখন হযরত বললেন, তুমি কি গিয়েছিলে ওখানে?
আমি বললাম, হযরত, একদম না। আমি সংবাদ পেয়েছিলাম, (বাবার মুখলিস দোস্ত) হাজ্বী খলীল আহমাদ সাহেবের পাঠানপুরার ঘর ধ্বসে গেছে, তা দেখতে গিয়েছিলাম।
হযরত বললেন, এটা একদম ঠিক।
হাজ্বী সাহেব বললেন, কারও প্রতি সুধারণা হলে এমনই হওয়া উচিত। -আপবীতী ১/৩৮৪-৩৮৫
জানা কথা, এ সুধারণা ও আস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এটা দীর্ঘদিনের আমানতদারি, আদব, তাওয়াযু, হুসনে আ‘মাল ও হুসনে আখলাকের ফল।
আমরা যারা এ যামানার তালিবে ইলম, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন হওয়ার তাওফীক দান করুন। এমন হওয়ার তামান্না ও আকাক্সক্ষা দান করুন এবং এর জন্য চেষ্টা ও মেহনত করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
২৬ মুহাররম ১৪৪৫ হি.
১৪ আগস্ট ২০২৩ ঈ.
সোমবার