রাব্বুল আলামীনের গুণ-পরিচয়
আল্লাহর সত্তা ও সিফাতের অনন্যতা সম্পর্কে তফসীলী আকীদা
মহামহিম আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও একত্বের এবং তাঁর তাসবীহ ও পবিত্রতার অপরিহার্য দাবি হল, তিনি মাখলূকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে সর্বোতভাবে চিরপবিত্র। একথা আমরা মাসিক আলকউসারের গত জুলাই ২০২৩ সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
বস্তুত স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিকে শরীক করা যেমন শিরক, তেমনি সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যকে- যা মূলত তার সীমাবদ্ধতার প্রকাশ- স্রষ্টার জন্য আখ্যা দেওয়াও শিরক। তার মানে, ‘নফীয়ে তাশবীহ’ অর্থাৎ মাখলূকের সঙ্গে খালিকের সাদৃশ্যকে নাকচ করা- তাওহীদের আকীদার অপরিহার্য অংশ।
‘আল্লাহু আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ পরম একক সত্তা। তো বলার অপেক্ষা রাখে না, যিনি পরম একক; কোনো বিষয়ে তার কোনো সদৃশ থাকা অসম্ভব। কারণ যে বিষয়ে যার সদৃশ থাকে তিনি সে বিষয়ে এক-অদ্বিতীয় নন। একথা একে একে দুই-এর মতো স্বতঃসিদ্ধ সমীকরণ, যা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী একজন মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এককত্ব ও সাদৃশ্য পরস্পরবিরোধী দুটি ধারণা। তাই খালেস তাওহীদের আকীদার আপরিহার্য দাবি হল, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের এবং তাঁর গুণাবলির অনন্যতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা।
তাঁর অস্তিত্বের অনন্যতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে তফসীলী আকীদা জানার গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলার মহান সত্তার অনন্যতা ও সাদৃশ্যহীনতা সম্পর্কে এজমালী আকীদা সাধারণত সকলেরই আছে। সকলেই বিশ্বাস করে এবং বলে, আল্লাহর সত্তা ও গুণ কোনো মাখলূকের মতো নয়; তিনি মাখলূকের সাদৃশ্য থেকে সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকেই কোনো গুণ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বা গুণ সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে মাখলূকের সাথে সাদৃশ্য সাব্যস্ত করে। এমনকি আলোচনার শুরুতে বা শেষে সাদৃশ্যহীনতার কথা স্বীকার করলেও মাঝখানে ব্যাখ্যা ও তফসীল বয়ানের সময় কার্যত মাখলূকের সাথে সাদৃশ্যায়ন করে থাকে।
অনেকেই আছেন, এজমালীভাবে মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তার অনন্যতা ও সাদৃশ্যহীনতা বিশ্বাস করা সত্ত্বেও সিফাত সম্পর্কে তফসীলী আলোচনার সময় তফসীলীভাবে তাঁর অনন্যতা ও সাদৃশ্যমুক্ত হওয়ার কথা বলতে চান না; বরং তফসীলীভাবে মহান সত্তার অনন্যতা বয়ান করাকে অস্বীকার করেন, অপছন্দ করেন এবং এটাকে বিদআত মনে করেন। আর তাই তাদেরকে বলতে শোনা যায়, আল্লাহ তাআলাকে ‘নিরাকার-নিরাধার’ বলা যাবে না। কিংবা বলেন, অল্লাহকে সাকারও বলা যাবে না, নিরাকারও বলা যাবে না। এসব দাবি ও ধারণা আসলে অজ্ঞতাপ্রসূত এবং কূটতর্কের অন্তর্ভুক্ত। তারা ধরে নিয়েছে, দ্বীনুল ইসলামে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যে পবিত্রতা এবং সাদৃশ্যহীনতা ও অনন্যতার বিশ্বাস, তা এক মুজমাল ও অস্পষ্ট ধারণা। নাউযুবিল্লাহ। অথচ আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্যহীনতা সম্পর্কে কুরআন কারীমের বক্তব্য মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন এবং আম ও ব্যাপক-
وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
(তাঁর সদৃশ কেউই নেই।)
এবং-
لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ
(তাঁর অনুরূপ বলতে কিছুই নেই।)
কুরআন কারীমের এসব বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ও ব্যাপক অর্থবোধক। ভাষাগত বিচারে এতে কোনো দ্ব্যর্থতা ও অস্পষ্টতা নেই। আরবী ভাষার উসলূব ও বাকরীতি সম্পর্কে সচেতন যে কেউ বুঝবেন, পূর্বোক্ত আয়াতদুটির নফী সর্বব্যাপী। অর্থাৎ কেউই বা কোনো কিছুই কোনো দিক থেকেই তাঁর সদৃশ নয়, তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই, থাকতে পারে না। তাই এর দ্ব্যর্থহীনতা ও ব্যাপকতার বিষয়ে সলফের যামানা থেকে অজ পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকল ইমামের ইজমা ও ঐকমত্য রয়েছে। কেউই এর ব্যাপকতাকে অস্বীকার করেননি। আয়াতের এধরনের উমূম ও ব্যাপকতা কতয়ী ও অকাট্য। আয়াতের এধরনের ব্যাপকতাকে অস্বীকার করা গোমরাহী।
এখন একটু ভাবুন, মাখলূকের যেকোনো কিছুর সাথে খালিকের সাদৃশ্যহীনতার এই সর্বব্যাপী বক্তব্যের ওপর আপনি কীভাবে আমল করবেন? এর প্রায়োগিক রূপ কী?
একথা স্পষ্ট যে, এই সর্বব্যাপী বক্তব্য সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য; তাঁর অস্তিত্বের ক্ষেত্রে, স্থিতির ক্ষেত্রে, প্রতিটি গুণের ক্ষেত্রে এবং তাঁর প্রতিটি ক্রিয়ার ক্ষেত্রে। এখন এই সর্বব্যাপী নীতি সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় প্রত্যেক ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ কোনো নস থাকা আবশ্যক নয়; বরং আকলে সলীম তথা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে এই সর্বব্যাপী নীতির প্রয়োগ করা জরুরি। আকীদার কথা বলুন কিংবা ফিকহী বিধানের কথা বা আখলাকের কথা- সর্বক্ষেত্রেই তো ইসলামের এধরনের মৌলিক ও সর্বব্যাপী শিক্ষা রয়েছে, যেগুলোকে আকলে সালীমের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়। যদিও এই সাদৃশ্যহীনতার অনেক দিক ও ক্ষেত্র সম্পর্কে খাস আয়াত ও হাদীস এবং আছারে সাহাবাও পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, যখনই কোনো ব্যক্তি বিদআত ও গোমরাহীর শিকার হয়ে আল্লাহ সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা বা ভুল কথা উদ্ভাবন করেছে তখনই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুজতাহিদ ইমামগণ তার খণ্ডনে এধরনের ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত ও হাদীস প্রয়োগ করেছেন।
সর্বোপরি বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের জন্য একটি বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাশবীহ বা সাদৃশ্য নফী করার অর্থ কখনোই সিফাত ও গুণাবলিকে নফী করা নয়। অতীতে এমন গোমরাহ ফেরকা ছিল এবং বর্তমানেও এমন ভ্রান্ত ধর্ম ও মতবাদে বিশ্বাসী রয়েছে, যারা মনে করে, সৃষ্টিকর্তার যে কোনো গুণ বর্ণনা করার মানেই হল সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা, তাই তারা স্রষ্টাকে নির্গূণ সত্তারূপে ধারণা করে এবং তাঁর জন্য গুণবাচক যে কোনো শব্দ ও অভিধা ব্যবহার করাকে পরিহার করে। নাউযুবিল্লাহ।
সঠিক কথা হল, আল্লাহ তাআলা যেমন সকল উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী, তদ্রূপ তিনি গুণাবলির ক্ষেত্রে মাখলূকের সাদৃশ্য হতেও চিরপবিত্র। কুরআন মাজীদের বিখ্যাত এই আয়াতটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন-
فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا وَّ مِنَ الْاَنْعَامِ اَزْوَاجًا يَذْرَؤُكُمْ فِيْهِ لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ.
তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া। এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। তাঁর অনুরূপ বলতে কিছু নেই। তিনিই সব কথা শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা শূরা (৪২) : ১১
লক্ষ করুন, এতে শুরুতে ও শেষে আল্লাহ তাআলার গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে। আর মাঝখানে মাখলূকের সাথে তাঁর সাদৃশ্য সম্পূর্ণরূপে নাকচ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শব্দে আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার পাশাপাশি সেসব সিফাতের অর্থ ও মর্মের ক্ষেত্রে মাখলূকের সাদৃশ্য হতে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করাও জরুরি। এ দুয়ের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই।
তাই তো প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (ওফাত : ৩২১ হি.) এব্যাপারে সতর্ক করে বলেন-
ومن لم يتوقَّ النفيَ والتشبيهَ زلَّ ولم يُصِب التنزيهَ، فإن ربَّنا جل وعلا موصوفٌ بصفات الوحدانية، منعوتٌ بنُعوت الفردانية، ليس في معناه أحدٌ من البرية .
যারা সিফাতের ক্ষেত্রে যুগপৎভাবে অস্বীকৃতি এবং সাদৃশ্যায়ন থেকে পরহেয করে না, তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং যথার্থভাবে রবের পবিত্রতা বর্ণনায় এবং পবিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থ হয়। কেননা আমাদের মহামহিম রব অনন্য সব গুণে গুণান্বিত এবং অনুপম সব বিশেষণে বিশেষিত। সৃষ্টিজগতের কেউই তাঁর সমার্থক নয়। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৩, হিন্দুস্তানী নুসখা
ইমাম তহাবী রাহ. তাঁর বর্ণিত উপরোক্ত নীতিটি যথাযথ প্রয়োগও করেছেন।
যেমন তিনি আল্লাহ তাআলার কালাম গুণ সম্পর্কে বলেন-
وإن القرآن كلامُ الله، منه بدا بلا كيفية قولاً، وأنزله على رسوله وَحيًا.
নিশ্চয়ই কুরআন হল আল্লাহর কালাম; যা সবধরনের কাইফিয়্যাত ও ধরন-ধারণমুক্ত বাণী হিসেবে তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং ওহী মারফত তিনি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৪-৫৫, হিন্দুস্তানী নুসখা
গযব ও ক্রোধ এবং রিযা ও সন্তুষ্টি- এই দুই গুণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
والله يغضب ويرضى لا كأحد من الورى.
তিনি ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন, কিন্তু সেই ক্রোধ ও সন্তুষ্টি কোনো মাখলূকের মতো নয়। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৩৫-১৩৬ হিন্দুস্তানী নুসখা
এমনিভাবে জান্নাতে মুমিন বান্দাগণ আল্লাহ তাআলার দর্শন লাভে ধন্য হবে- এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
والرؤية حق لأهل الجنة بغير إحاطة ولا كيفية.
জান্নাতবাসীরা আল্লাহর দর্শন লাভ করবে- একথা সত্য, কিন্তু সেই দর্শন হবে দৃষ্টিসীমা দ্বারা পরিবেষ্টন করা ছাড়া এবং কোনো কাইফিয়্যাত ও ধরন-ধারণ ছাড়া। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৮-৫৯, হিন্দুস্তানী নুসখা
এতক্ষণের আলোচনার সারসংক্ষেপ হল, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের এবং তাঁর গুণাবলির অনন্যতা সম্পর্কে আকীদা রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। তবে সেই আকীদা সাধারণত এজমালীভাবে থাকাই যথেষ্ঠ, যতক্ষণ না কোনো ব্যক্তির মনে কোনো বিষয়ে এর বিপরীত কোনো ধারণা ও কথার জন্ম হয়। তখন সেই ব্যক্তির উপর আকীদা বিশুদ্ধ করার জন্য ঐ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও অনন্যতার তফসীলী আকীদা জানা ও আকীদা রাখা জরুরি হয়ে যায়। এমনিভাবে যখন কোনো ব্যক্তির কাছে আল্লাহ তাআলার যাত বা সিফাত সম্বন্ধে বিদআতী ও বাতিলপন্থীদের কোনো ভ্রান্ত ধারণা ও কথাবার্তা পৌঁছে, তখন ঈমানের হেফাজতের জন্য তফসীলীভাবে তাঁর যাত ও সিফাতের অনন্যতার আকীদা সম্পর্কে জানা জরুরি হয়ে পড়ে।
তাঁর পবিত্র সত্তা সবকিছু থেকে অনন্য এবং সকল ধারণা ও কল্পনার ঊর্ধ্বে
মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব আমাদের দৃষ্টিগোচর ও দৃষ্টির অগোচর যত অস্তিÍত্ব আছে সব অস্তিত্বের অতীত। তাঁর অস্তিত্ব অন্য কোনো অস্তিত্বের মতো নয়। তাঁর অস্তিত্ব সর্বোতভাবে অনন্য। তাই তাঁর অস্তিত্বের অনন্যতা সম্পর্কে আকীদা রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। আমরা এখন তাঁর সত্তাগত অনন্যতার আলোচনার শুরতেই এ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সম্পর্কে জানব।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (ওফাত : ৩২১ হি.) তাঁর বিখ্যাত আকীদা গ্রন্থে মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তার অনন্যতা সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ ভাষায় সর্বব্যাপী মূলনীতি উল্লেখ করেছেন-
لا تَبْلُغُه الأَوهامُ ولا تُدْرِكُه الأفهامُ، ولا يُشبِهُ الأنامَ.
কারও কল্পনা তাঁর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, মানুষের সমঝ-বুঝ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না এবং তিনি জগতের অন্য কোনো কিছুর মতো নন -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৫-৩৬, হিন্দুস্তানী নুসখা
লক্ষ করুন, ইমাম তহাবী রাহ. উপরোক্ত মূলনীতিটিতে মাখলূকের সাথে আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্য কত ব্যাপকভাবে ও সূক্ষ্মভাবে নাকচ করেছেন! যার সারমর্ম হল, আমরা দুচোখ দিয়ে যা কিছু দেখি, কান দিয়ে যা কিছু শুনি, নাক দিয়ে যত ঘ্রাণ অনুভব করি, জিহ্বা দিয়ে যত স্বাদ অনুভব করি, ত্বক দিয়ে যা কিছু উপলব্ধি করি, অন্তর দিয়ে যা কিছু কল্পনা করি, তিনি সেরকম কিছু নন; তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।
অথচ কল্পনার পরিধি পঞ্চেন্দ্রিয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। কারণ যেসব বস্তু ও বিষয়কে বাস্তবে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না, কল্পনাশক্তি দিয়ে সেসব অনুমান করা যায়। এই কল্পনা শক্তি দিয়ে মানুষ কত অবাস্তব বিষয়ের ছবি আঁকে, অনুমান করে এবং পরিকল্পনা করে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহর সত্তার হাকীকত এতটাই অনন্য যে, কল্পনা দিয়ে তাঁকে অনুমান করা যায় না। করা সম্ভবও নয়। কেননা তিনি তো অন্য কিছুর মতো নন, যে তার সাথে তুলনা করে তাঁকে অনুমান করা যাবে। তিনি তো দেহধারী কোনো সত্তা নন, যে তাঁর কোনো রূপ বা আকৃতি অনুমান করা যাবে; বরং তিনি হলেন নিরাকার-নিরাধার অনুপম সত্তা।
আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য যে জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন তা কেমন- সে সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ، وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ.
যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি, কোনো কান কখনো শোনেনি এবং যা কোনো মানুষের অন্তর কখনো কল্পনাও করেনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২৪
একটু ভাবুন, গায়েবের জগতের জান্নাত, যা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, তা যখন এত বেমিছাল, তখন মহান আল্লাহ তাআলা, যিনি সব গায়েবের চেয়ে বেশি গায়েব, তিনি কত বেমেছাল, তিনি মানুষের কল্পনার কত ঊর্ধ্বে।
মনে রাখতে হবে, উপরোক্ত মূলনীতিটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সর্বজন স্বীকৃত মূলনীতি। আল্লাহ তাআলার সত্তাগত যেকোনো সিফাতের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা জরুরি। তাঁর যেকোনো সিফাতের এমন ব্যাখ্যা পরিহার করা জরুরি, যা মানুষের কল্পনাযোগ্য এবং কোনো মাখলূকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এরপর দেখুন, ইমাম তহাবী রাহ. আল্লাহ তাআলার ওপর মানবীয় গুণ আরোপের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন-
ومن وَصَفَ الله بمعنى من معاني البشر فقد كفر، فمن أبصر هذا اعتبر، وعن مثل قول الكفار انزجر، وعلم أنه بصفاته ليس كالبشر.
যারা আল্লাহ তাআলাকে মানবীয় কোনো বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত করে তারা মূলত কুফরে লিপ্ত হয়। সুতরাং যারা এবিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তারা সঠিক শিক্ষা লাভ করে, তারা কাফেরদের মতো কথা বলা থেকে বিরত থাকে এবং তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর গুণাবলির ক্ষেত্রে মানুষের মতো নন। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৭-৫৮, হিন্দুস্তানী নুসখা
তিনি দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র
আল্লাহ তাআলার সত্তাগত অনন্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র। কেননা দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং আকার-আকৃতি থাকা মাখলূকের বৈশিষ্ট্য এবং তার মুখাপেক্ষিতা, সীমাবদ্ধতা ও নশ্বরতার প্রকাশ। বরং এসব হল সাদৃশ্যের প্রকাশ্য দিক এবং কল্পনার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। তাই কুরআন ও হাদীসের এবং অকাট্য যুক্তি-বুদ্ধির যেসব দলীল-প্রমাণ দ্বারা তাঁর সাদৃশ্যহীনতা, অমুখাপেক্ষিতা, অকল্পনীয়তা, অসীমতা ও চিরন্তনতা প্রমাণিত, সেসব দলীল-প্রমাণ দ্বারা একথাও প্রমাণিত যে, তিনি দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র।
আমরা জানি, জগতে যত মাখলূক ও সৃষ্টি রয়েছে তার অন্যতম প্রকার হচ্ছে পদার্থ বা বস্তু এবং এই পদার্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দেহধারী হওয়া। দেহ বলা হয় অংশবিশিষ্ট বা অঙ্গবিশিষ্ট এমন যেকোনো বস্তুকে, যা কোনো স্থান দখল করে অবস্থান করে এবং যার বিস্তৃতি রয়েছে অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা রয়েছে। জগতে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ রয়েছে; কঠিন, তরল, বায়বীয় ইত্যাদি। কিছু পদার্থ রয়েছে, যা স্থূলদেহী, যেমন মানুষসহ সকল দৃশ্যমান প্রাণী, উদ্ভিদ ও অন্যান্য জড়পদার্থ। আর কিছু আছে সূক্ষ্মদেহী, যেমন আলো, বাতাস, রূহ ও আত্মা এবং আগুনের তৈরি জিন ও নূরের তৈরি ফিরিশতা ইত্যাদি।
তো দেহধারী হওয়া যেহেতু একশ্রেণির মাখলূকের বৈশিষ্ট্য, তাই আল্লাহ তাআলকে যদি দেহধারী বলা হয় তবে তা হবে আল্লাহকে মাখলূকের সমশ্রেণি বিশ্বাস করার নামান্তর। এমনিভাবে আল্লাহকে যদি সাকার বলা হয় তবে তা হবে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য সদৃশ ও সমশ্রেণি সাব্যস্তের নামান্তর, যা ওহীর শিক্ষা ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাছাড়া দেহত্ব হল সীমাবদ্ধতা এবং নশ্বরত্বের প্রমাণ। সুতরাং আল্লাহ তাআলা দেহধারী হওয়া কিংবা সাকার হওয়া অসম্ভব। তাই তিনি দেহধারী নন; স্থূলদেহীও নন, সূক্ষ্মদেহীও নন, তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা যেহেতু দেহধারী নন তাই দেহগত যত বৈশিষ্ট্য আছে, তা থেকে তিনি চিরপবিত্র। আমরা জানি, দেহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অংশবিশিষ্ট হওয়া, বিভাজ্য হওয়া, স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ হওয়া এবং আকার-আকৃতিবিশিষ্ট হওয়া। সুতরাং আল্লাহ তাআলা অংশ বা অঙ্গবিশিষ্ট নন, স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন এবং আকার-আকৃতিবিশিষ্টও নন; বরং তিনি নিরাকার- নিরাধার বেমেছাল সত্তা।
বস্তুত দ্বীনুল ইসলাম হল শিরকমুক্ত খালেস তাওহীদের ধর্ম। এতে স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিকে শরীক করার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে স্রষ্টাকে শরীক করারও কোনো অবকাশ নেই। সর্বোপরি ইসলামে মূর্তিপূজা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। তাই বাস্তবে ইলাহ ও ঈশ্বরের মূর্তি বানানো যেমন হারাম, তেমনি অন্তরে তাঁর মূর্তি কল্পনা করাও হারাম। কেউ মাটি বা পাথর দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করলে তা যেমন শিরক, তেমনি মনের মধ্যে ভাবমূর্তি তৈরি করে তার পূজা করাও শিরক। আর তাই ইসলামে স্রষ্টাকে সাকার ও মূর্তিরূপে কল্পনা করার কোনো সুযোগ নেই।
সুতরাং কেউ যখন স্রষ্টাকে মাখলূকের মতো সাকার ও দেহধারী মনে করেন, মানুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী মনে করেন তখন সে মূলত স্রষ্টাকে মূর্তিরূপেই কল্পনা করেন। এখন সে যত ক্ষুদ্র মূর্তিই কল্পনা করুক, যেমন সরিষাদানার মতো আর যত বৃহৎ মূর্তিই কল্পনা করুক, যেমন পাহাড়ের সমান বা আসমানের সমান; মূর্তিকে সে যমীনে স্থাপন করুক বা সপ্ত আসমানের ওপরে স্থাপন করুক- সর্বাবস্থায় তা মূর্তিপূজারূপেই বিবেচিত হবে। এ বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম গাযালী রাহ.। তিনি বলেছেন-
فإِنَّ مَنْ خَطَر ببَالِه أنَّ اللهَ جِسمٌ مُرَكَّبٌ من أَعضاءٍ، فهو عابدُ صَنَمٍ، وأنَّ كلَّ جِسمٍ مخلوقٌ، وعبادةُ الصنمِ كفرٌ، لأنَّه مخلوقٌ، وكان مخلوقاً، لأنه جسمٌ، فمن عَبَدَ جسماً فهو كافرٌ بإجماعِ الأئمةِ؛ السلفِ منهم والخلفِ.
سواءٌ كان ذلك الجسمُ كَثِيفاً كالجِبالِ الصُمِّ الصلابِ، أو لَطِيفاً كالهَواءِ والمَاءِ، وسواءٌ كان مُظْلَماً كالأرضِ،
أو مُشْرِقاً كالشمسِ والقمرِ والكواكبِ، أو مُشِفًّا لا لونَ له كالهواءِ، أو عظيماً كالعرشِ والكرسيِ والسماءِ،
أو صَغِيراً كالذَّرَّةِ والهَباءِ، أو جَمَاداً كالحِجارةِ، أو حَيْواناً كالإنسانِ، فالجِسْمُ صَنَمٌ، فَبِأَن يُقدَّرَ حُسْنُه وجَمالُه،
أو عِظَمُه أو صِغَرُه، أو صَلابتُه ونَقَاؤُه...، لا يَخْرُجُ عن كونِه صنماً.
যার অন্তরে এই ধারণা হয় যে, ‘আল্লাহ হলেন বিভিন্ন অঙ্গযুক্ত দেহধারী সত্তা’ সে মূলত মূর্তিপূজারী। কেননা প্রত্যেক দেহধারীই হল মাখলূক এবং যেকোনো মূর্তির ইবাদত কুফর হওয়ার কারণ এটাই যে, মূর্তি হল মাখলূক। আর যেকোনো মূর্তিই মাখলূক হওয়ার প্রমাণ এটাই যে, সে দেহধারী। তাই যে ব্যক্তি দেহধারী বস্তুর ইবাদত করে সে সকল ইমামদের মতে কাফের; অর্থাৎ সালাফ ও খালাফ সকল ইমামদের মতেই সে কাফের।
এখন সেই ধারণাকৃত দেহধারী মাবূদ শক্ত কঠিন পাহাড়সম স্থূলদেহী হোক কিংবা বায়ু বা বাতাসের মতো নরম ও সূক্ষ্মদেহী হোক। ভূমি ও মাটির মতো অন্ধকার বস্তু হোক কিংবা চাঁদ-সুরুজ-তারকার মতো আলোকিত বস্তু হোক কিংবা বাতাসের মতো বর্ণহীন স্বচ্ছ পাতলা বস্তু হোক। আসমান-আরশ-কুরসীর মতো বৃহৎ বস্তু হোক কিংবা যাররা ও অণু-পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র বস্তু হোক। পাথরের মতো নিষ্প্রাণ জড়পদার্থ হোক কিংবা মানুষের মতো কোনো প্রাণী হোক। মোটকথা, প্রত্যেক দেহধারী বস্তুকেই ‘সনাম’ বা মূর্তি বলা হয়; এখন সেই দেহধারী বস্তুর সৌন্দর্য যা-ই হোক, তার কলেবর যত ছোট বা বড় হোক এবং তা যত স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ হোক সর্ব অবস্থায় তা মূর্তি বা মূর্ত বস্তু। -ইলজামুল আওয়াম আন ইলমিল কালাম, ইমাম গাযালী, পৃ. ৫২, (দারুল মিনহাজ)
এটা শুধু ইমাম গাযালীর বক্তব্য নয়, বরং এর আগে ও পরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আরও অনেক আলেম এমন কথা বলেছেন। কোনো কোনো সালাফ সংক্ষেপে বলতেন-
المُمَثِّل يَعْبُدُ صَنَماً.
(দেহবাদী মূলত মূর্তিপূজা করে।)
আর তাই সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মুজমা আলাইহি ও মুতাওয়ারাছ আকীদা হল, আল্লাহ তাআলা মাখলূকের মতো সব ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সীমা ও পরিসীমা থেকে চিরপবিত্র।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (ওফাত : ৩২১ হি.), যিনি ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর অনুসৃত মাসলাক অনুসারে আকীদার কিতাব সংকলন করেছেন, যা আরব ও অনারব সকল দেশে ইসলামী আকীদার মাকবূল ও গ্রহণযোগ্য কিতাব হিসেবে স্বীকৃত, তাতে তিনি এব্যাপারে বলেন-
وتَعَالَى عَنِ الحُدُودِ والغَايَاتِ، والأَرْكَانِ والأَعْضَاءِ والأَدَوَاتِ، لاَ تَحْوِيه الجِهاتُ السِتُّ، كسَائرِ المُبْتَدعاتِ.
আল্লাহ তাআলা বহু ঊর্ধ্বে- সকল সীমা ও প্রান্ত থেকে, দৈহিক সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে এবং দৈহিক সকল উপায়-উপকরণ থেকে। জগতের ছয় দিক যেভাবে সৃষ্টবস্তুসমূহকে বেষ্টন করে আছে সেভাবে কোনো দিক আল্লাহ তাআলাকে বেষ্টন করে না। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৫-৬৮, হিন্দুস্তানী নুসখা
একইভাবে ইমাম তহাবীর সমসাময়িক আরেক ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাহ. (ওফাত : ৩২৪ হি.) মুহাদ্দিসদের এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অন্যান্য আলেমদের এই আকীদা বর্ণনা করেছেন যে-
اللهُ لَيْسَ بِجِسْمٍ وَلَا يُشْبِهُ الْأَشْيَاءَ.
তিনি শরীরী নন এবং তিনি জগতের অন্য কোনো বস্তুর মতোও নন। -মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন, পৃ. ১২৫
এমনিভাবে হাদীসশাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম আবু বকর আলইসমাঈলী রাহ. (ওফাত : ৩৭১ হি.) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী হাদীসশাস্ত্রের ইমামদের অনুসৃত আকীদার ওপর একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা লিখেছেন, যার নাম-
اعتقاد أئمة أهل الحديث
এতে তিনি হাদীসের ইমামদের আকীদা নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন-
ولا يعتقد فيه الأعضاء، والجوارح، ولا الطول، والعرض، والغلظ، والدقة مثله في الخلق، وأنه ليس كمثله شيء.
আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকার বিশ্বাস রাখবে না এবং বিশ্বাস রাখবে না, তাঁর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ এবং স্থূলতা ও সূক্ষ্মতা ইত্যাদি থাকার, যেমনটা মাখলূকের মধ্যে থাকে। বরং দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ তাআলার মতো কোনো বস্তু নেই। -ইতেকাদু আইম্মাতিল হাদীস, পৃ. ২
এছাড়াও ইমাম আবু বকর আলইসমাঈলী রাহ. উক্ত পুস্তিকায় জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দর্শনলাভের আকীদা প্রসঙ্গে বলেছেন-
وذلك من غير اعتقاد التجسيم في الله عز وجل ولا التحديد له، ولكن يرونه جل وعز بأعينهم على ما يشاء هو بلا كيف.
মুহাদ্দিসগণ আল্লাহ তাআলাকে জান্নাতে দর্শনলাভের আকীদা রাখেন তাঁকে দেহধারী ও সসীম বিশ্বাস করা ছাড়া। তাদের বিশ্বাস হল, তারা আল্লাহকে জান্নাতে স্বচক্ষে দেখতে পাবেন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছানুযায়ী; কোনো কাইফিয়্যাত ও ধরণ ছাড়া। -প্রাগুক্ত, পৃ. ৯
একইভাবে সাদৃশ্য ও কাইফিয়্যাত বা ধরণ-ধারণ নফীর ব্যাপারে সালাফের যত বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে তা সবই একথার স্পষ্ট প্রমাণ যে, তাদের আকীদা হল, আল্লাহ তাআলা দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র।
তিনি নিরাকার অনন্য সত্তা
আল্লাহ তাআলা দেহধারী নন, তাই সাকারও নন, তাহলে কি তিনি নিরাকার ও অশরীরী কোনো পদার্থ? নাউযুবিল্লাহ, না, কখনোই না। পদার্থ, মেটাল, মাদ্দাহ, জওহর- এধরনের কোনো শব্দ দিয়েই তাঁর পরিচয় দেয়া যায় না। কারণ পদার্থই হচ্ছে দেহের উপাদান; পদার্থের অণু-পরমাণু মিলেই তো দেহ গঠিত হয়। এমনিভাবে সৃষ্টিজগতে পদার্থ ছাড়াও যতরকম শক্তি রয়েছে যেমন, আলো-শক্তি, তাপ-শক্তি, গতি-শক্তি, বিদ্যুৎ-শক্তি, চুম্বক-শক্তি ইত্যাদি এবং অবস্তুগত যত বিষয় রয়েছে, যেমন- আকল ও বুদ্ধি এবং কল্পিত ও বোধগম্য যত ভাব ও বিষয় রয়েছে- আল্লাহ তাআলা সেরকম কিছু হওয়া থেকেও চিরপবিত্র।
মোটকথা, জগতে যত রকম অস্তিত্ব রয়েছে, সবকিছু থেকে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র অনন্য সত্তা। তিনি বেমেছাল ও বেনযীর। কুরআন কারীমের ভাষায়-
لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ.
(তাঁর সদৃশ বলতে কিছুই নেই।)
এবং-
وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
(তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।)
-কুরআন কারীমের এই গভীর ও ব্যাপক অর্থবোধক উক্তির ভাব ও মর্মকে পরবর্তী সময়ে মুসলিম কালামশাস্ত্রবিদগণ যুক্তিবিদ্যার ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
ليس بعَرَضٍ ولا جِسْمٍ، ولا جَوهرٍ ولامُصَوَّرٍ، ولا مَحْدُوْدٍ ولا مَعْدُوْدٍ، ولامُتبَعِّض ولامُتَجَزِّئٍ، ولا مُترَكِّبٍ
ولا مُتَناهٍ، ولا يُوْصفُ بالمائيَّةِ ولا بالكَيفيةِ، ولا يَتمَكَّنُ في مكانٍ، ولا يَجْري عليه زمانٌ، ولا يُشْبِهُه شيءٌ،
ولا يَخْرُجُ عن علمِه وقدرتِه شيءٌ.
অর্থাৎ তিনি পরনির্ভর অস্থায়ী কোনো বস্তু নন, দেহধারী বস্তু নন, জওহর বা স্বনির্ভর মৌল পদার্থও নন, সাকার নন, সসীম নন, গণনাভূক্ত বস্তু নন, অংশবিশিষ্ট নন, বিভাজ্য নন, যৌগ বস্তু নন, অন্তযুক্ত নন। তাঁর স্বরূপ বর্ণনা করা যায় না, কোনো কাইফিয়্যাত বা ধরণ দ্বারা বিশেষিত করা যায় না। তিনি কোনো স্থানে স্থিত নন। তাঁর উপরে কোনো সময় অতিবাহিত হয় না। তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই। তাঁর ইলম ও কুদরতের আওতার বাইরে কিছুই নেই। -আলআকীদাতুন নাসাফীয়্যাহ, আবু হাফস উমার আননাসাফী, পৃ. ২১ (দারুল বাশায়ির আলইসলামিয়্যাহ)
তিনি অন্য কোনো সত্তায় প্রবিষ্ট ও একীভূত হওয়া থেকে পবিত্র
আল্লাহ তাআলা তাঁর অস্তিত্বে একক ও অনন্য। সুতরাং তিনি অন্য কোনো অস্তিত্বে প্রবিষ্ট ও একীভূত হওয়া থেকে চিরপবিত্র। তিনি অন্য কোনো সত্তার সাথে (সমসত্ত্বরূপে বা অসমসত্ত্বরূপে) মিশে থাকা ও মিশে যাওয়া থেকে চিরপবিত্র। অন্য কোনো অস্তিত্বের সাথে একীভূত হওয়া বা অন্য কোনো অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকার বিশ্বাসকে আরবীতে ‘আকীদাতুল হুলূল ওয়াল ইত্তিহাদ’ বলা হয়। আল্লাহর পবিত্র সত্তার ব্যাপারে এধরনের আকীদা রাখা কুফরী। কেননা-
১. অন্য কোনো অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকার আকীদা ‘তাওহীদ ফিয-যাত’ অর্থাৎ সত্তাগত একত্ব ও এককত্বের পরিপন্থী। তাঁর সিফাত হল ‘আহাদুন’ (পরম একক), ‘সমাদুন’ (পূর্ণ বে-নিয়ায) এবং ‘বিতরুন’ (বেজোড়)। তো যিনি পরম একক, যিনি বেজোড়, যিনি পূর্ণ বেনিয়ায তাঁর অন্য কোনো অস্তিত্বের সাথে একীভূত হওয়া বা মিশে থাকা কীভাবে সম্ভব। অন্য কিছুর সাথে একীভূত হলে বা মিশলে তো সত্তাগত একত্ব বাকি থাকে না। আমরা এবিষয়টি সূরা ইখলাসে বর্ণিত ‘আহাদুন’ সিফাতের ব্যাখ্যায় গত (জুলাই ২০২৩ সংখ্যায়) সংক্ষেপে উল্লেখ করে এসেছি।
হাদীস শরীফে আল্লাহ তাআলার একটি সিফাত বর্ণিত হয়েছে- ‘বিতরুন’। এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম খাত্তাবী রাহ. লেখেন-
ومَعْنَى الوِتْرِ في صِفَةِ اللهِ جل وعَلَا: الواحدُ الذي لا شَرِيكَ لَهُ، ولا نظيرَ له، المتفردُ عنْ خَلْقِهِ، البائنُ منهم بِصِفَاتِهِ : فهو سبحانه وِتْرٌ، وَجَميعُ خَلْقِهِ شَفْعٌ، خُلِقُوا أزْوَاجَاً، فَقَالَ سبحانه: وَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ. الذاريات:৪৯<
‘বিতর’ বা বেজোড় বিশেষণের অর্থ হল, তিনি এক-অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি বেনযীর। সকল মাখলূক থেকে তিনি অনন্য, তিনি তাঁর গুণাবলিসহ সব মাখলূক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সম্পূর্ণ বেজোড়। আর সকল মাখলূক হল জোড়, তাদেরকে তো জোড়া জোড়া করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘আমি সব বস্তুকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি।’ [সূরা যারিয়াত (৫১) : ৪৯] -শা’নুদ দুআ, ইমাম খাত্তাবী, পৃ. ২৯-৩০
২. অন্য কোনো সত্তার সাথে মিশে থাকা বা একীভূত থাকার আকীদা মূলত স্রষ্টাকে সৃষ্টির সমশ্রেণি, সমতুল্য ও সদৃশ মনে করারই নামান্তর। স্রষ্টাকে অন্য কোনো অস্তিত্বের সাথে গুলিয়ে ফেলার পর স্রষ্টার সত্তাগত একত্ব, পবিত্রতা ও সাদৃশ্যহীনতার আর কিছু কি বাকি থাকে?!
৩. অন্য কিছুর সাথে মিশে থাকা, একীভূত হওয়া- কোনো সম্মানজনক বা পূর্ণতাবাচক গুণ নয়; বরং অসম্মানজনক এবং তা ত্রুটি, দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতাকেই প্রকাশ করে।
৪. হুলূল ও ইত্তেহাদ দ্বীনুল ইসলামের আকীদা নয়; বরং তা বিভিন্ন কাফের-মুশরিক জাতির এবং বিভিন্ন বেদ্বীন ও মুলহিদ দার্শনিকদের আকীদা। ইসলাম খালেস তাওহীদের আকীদার মাধ্যমে হুলূল ও ইত্তেহাদের আকীদাকে বাতিল আখ্যায়িত করেছে।
৫. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকল ইমামের ইজমা ও ঐকমত্য হল, হুলূল ও ইত্তেহাদের আকীদা কুফরী আকীদা। (দ্রষ্টব্য : তানযীহুল ইতেকাদ আনিল হুলুল ওয়াল ইত্তেহাদ, জালালুদ্দীন সুয়ূতী; মাকতুবাতে মুজাদ্দিদে আলফে সানী, মাকতুব নং ২৬৬)
তিনি কোনো দিক বা স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন
মহামহিম আল্লাহ তাআলা নিজের অস্তিত্ব ও স্থিতির জন্য অন্য কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল নন। তিনি হলেন- الْحَيُّ الْقَيُّومُ চিরঞ্জীব ও স্বয়ম্ভূ। সুতরাং তিনি নিজের অস্তিত্ব ও স্থিতির জন্য কোনো স্থানের মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ হলেন স্রষ্টা আর স্থান-কাল হল আল্লাহর সৃষ্টি। তো স্রষ্টা কীভাবে সৃষ্টের মুখাপেক্ষী হবেন। বরং যখন কিছু ছিল না; আরশ-কুরসি ছিল না, আসমান-যমীন ছিল না, চাঁদ-সূর্য ছিল না, দিন-রাত ছিল না, স্থান-কাল বলতে কিছুই ছিল না, কোনো আকার-আকৃতিও ছিল না- তখনো তিনি ছিলেন। আমরা জানি, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু ধ্বংসশীল; সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন। স্থান-কাল ধ্বংস হয়ে গেলও তিনি থাকবেন। সুতরাং তাঁর অস্তিত্ব কোনো স্থান-কালের মুখাপেক্ষী নয়।
তাহলে কি তিনি কোনো মুখাপেক্ষিতা ছাড়াই স্থান সৃষ্টির পর কোনো স্থানের গণ্ডিতে অবস্থান করছেন?! না, কখনোই না। কেননা আল্লাহর পবিত্র সত্তা হল অসীম এবং তিনি ছাড়া অস্তিত্বের জগতের সবকিছু হল সসীম। আর সসীম সত্তা অসীম সত্তাকে ধারণ করা অসম্ভব- তা কে না বোঝে!
সর্বোপরি কোনো স্থান বা কোনো আধারের গণ্ডিতে অবস্থান করা মাখলূকের বৈশিষ্ট্য। স্থান-কাল সৃষ্টবস্তুর অপরিহার্য মাত্রা। আর আল্লাহ তাআলা মাখলূকের সমশ্রেণিতা ও সাদৃশ্য হতে চিরপবিত্র- একথা ইসলামের অকাট্য আকীদা। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মাখলূকের মতো স্থানের গণ্ডিতে অবস্থানকারী নন; বরং আল্লাহ তাআলা জগৎ সৃষ্টির আগেও স্থান-কালের ঊর্ধ্বে ছিলেন, এখনো তেমনি আছেন এবং থাকবেন।
উপরন্তু, আমরা একটু আগেই আলোচনা করে এসেছি, ‘হুলূল’ ও ‘ইত্তেহাদ’ উভয়টি বাতিল ও কুফরী আকীদা। আর আল্লাহকে কোনো স্থানের গণ্ডিতে অবস্থানকারী মনে করা হুলূলের আকীদারই একটি অংশ। কেননা হুলূল মানে হল, কোনো বস্তু নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রেখে অন্য বস্তুতে অবস্থান করা; তা সেই বস্তুর ভেতরে অবস্থান করুক, কিংবা বস্তুর উপরিতলে অবস্থান করুক- সর্বাবস্থায় তাকে আরবীতে ‘হুলূল’ বলা হয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলাকে কোনো বস্তুর ভেতরে প্রবিষ্ট মনে করা যেমন ভ্রান্ত ধারণা, তেমনি তাঁকে কোনো বস্তুর পিঠে বা উপরিতলে অবস্থানকারী মনে করাও ভ্রান্ত ধারণা। এ কথাগুলো এমনিতেই স্পষ্ট। তার পরও আমরা সামনে এবিষয়ে কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ থেকে কিছু প্রমাণ পেশ করার এবং উলামায়ে সালাফের বিভিন্ন উক্তির আলোকে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করার চেষ্টা করব।
সূরা হাদীদের ৩ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
هُوَ الْاَوَّلُ وَ الْاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الْبَاطِنُ وَ هُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ.
তিনিই সবার আগে, তিনিই সবার শেষে এবং তিনিই সবচেয়ে জাহের, তিনিই সবচেয়ে বাতেন। তিনি সবকিছু পরিপূর্ণভাবে জানেন। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ৩
লক্ষ করুন, উপরোক্ত আয়াতে একসঙ্গে পাঁচটি সিফাত বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে- তিনিই ‘আল-আওয়াল’ বা সবার আগে অর্থাৎ যখন কিছুই ছিল না তখনো তিনি ছিলেন। তিনিই ‘আল-আখির’ বা সবার শেষে অর্থাৎ সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন।
এরপর বলা হয়েছে- ‘তিনিই সবচেয়ে জাহের এবং তিনিই সবচেয়ে বাতেন।’ আরবী ভাষার বাকরীতি ও তাফসীরশাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে ‘জাহির ও বাতিন’-এই দুটি সিফাতের প্রসিদ্ধ দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে :
এক. জাহির মানে হল, তাঁর অস্তিত্ব ও বিদ্যমানতা দলীল-প্রমাণের বিচারে সবচেয়ে প্রকাশ্য ও সুষ্পষ্ট বিষয়। আর বাতেন মানে হল, স্বরূপগত বিচারে তাঁর মহান সত্তা সবচেয়ে বাতেন ও গুপ্ত, ফলে কেউ তাঁর সত্তা ও সিফাতের স্বরূপ ও রহস্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
দুই. জাহির মানে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তাঁর ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। আর বাতিন মানে হল, তিনি সবকিছুর সবচেয়ে নিকটবর্তী ও সবচেয়ে অন্তস্থলে, তাঁর অন্তরালে কিছু নেই, তাঁর চেয়ে নিকটবর্তী কিছু নেই, তিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত।
উপরোক্ত দুটি ব্যাখ্যাই সহীহ। তাছাড়া ব্যাখ্যা দুটির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই, বরং একটি আরেকটির সমার্থক ও সম্পূরক। তবে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি একটি সহীহ মারফূ হাদীসে বর্ণিত দুআর শব্দ দ্বারা সমর্থিত, যা আমরা একটু পরে বিস্তারিত উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফাসসির ইমাম আবু জাফর তবারী রাহ. (ওফাত : ৩১০ হি.) লেখেন-
)هو الأول) قبل كل شيء بغير حد، (والآخر) يقول: والآخر بعد كل شيء بغير نهاية. وإنما قيل ذلك كذلك، لأنه كان ولا شيء موجود سواه، وهو كائن بعد فناء الأشياء كلها، كما قال جل ثناؤه: (كل شيء هالك إلا وجهه( .
وقوله: (والظاهر) يقول: وهو الظاهر على كل شيء دونه، وهو العالي فوق كل شيء، فلا شيء أعلى منه. (والباطن) يقول: وهو الباطن جميع الأشياء، فلا شيء أقرب إلى شيء منه، كما قال: وَ نَحْنُ اَقْرَبُ اِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ.وبنحو الذي قلنا في ذلك جاء الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، وقال به أهل التأويل. (انظر: تفسير الطبري২৩/১৬৮).
অর্থাৎ তিনি আল-আওয়াল মানে হল, তিনি সবকিছুর আগে সর্বদা বিদ্যমান অসীম সত্তা। আর আল-আখির মানে হল, তিনি সবকিছুর পরে বিদ্যমান অনন্ত সত্তা। এভাবে বলার কারণ হল, যখন কিছুই ছিল না তখনো তিনি ছিলেন এবং সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি থাকবেন। যেমনটা আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেছেন- ‘সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত তাঁর সত্তা ছাড়া।’
তিনি জাহির মানে হল, তিনি সকল বস্তুর ঊর্ধ্বে, তাঁর চেয়ে ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। আর তিনি ‘বাতিন’ মানে হল, তিনি সবকিছুর অন্তস্থলে; ফলে কোনো বস্তুর অতি নিকটবর্তী তাঁর চেয়ে আর কেউ নেই। যেমনটা আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে নিজেই বলেছেন- ‘আমি তার গলদেশের শিরা অপেক্ষাও তার বেশি নিকটবর্তী।’ [সূরা কাফ (৫০) : ১৬]
উপরোক্ত ব্যাখ্যা উল্লেখ করার পর ইমাম তবারী বলেন- ‘আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা যা বললাম তার অনুরূপ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং মুফাসসিরগণও অনুরূপ তাফসীর করেছেন।’
ইমাম তবারী যে হাদীসটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তা মূলত একটি দীর্ঘ দুআর একটি অংশ যার শব্দমালা এই-
اللهُمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ، وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ. (انظر: صحيح مسلم، برقم: ২৭১৩، و سنن أبي داود، برقم: ৫০৫১)
অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনিই সবার অগ্রবর্তী, তাই আপনার পূর্বে কিছু নেই। আপনি সবার পরবর্তী, তাই আপনার পরে কিছু নেই। আপনি সবচেয়ে জাহির, তাই আপনার ঊর্ধ্বে কিছু নেই। আপনি সবচেয়ে বাতিন (বা অন্তস্থ) আপনার পশ্চাতে বা অন্তরালে কিছু নেই।...
দেখুন, এই দুআয় বর্ণিত শব্দ অনুসারে জাহির হল, আল্লাহ তাআলার সেই সিফাত, যার কারণে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আর বাতিন হল তাঁর সেই সিফাত, যার কারণে তিনি সবকিছুর সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং সবচেয়ে অন্তস্থলে; কোনো কিছু তাঁর অন্তরালে নেই।
তাহলে এখন একটু চিন্তা করে দেখুন, আওয়াল, আখির, জাহির ও বাতিন- এই চার সিফাতের যুগপৎ দাবি কী? যখন কিছুই ছিল না তখনো তিনি ছিলেন। যখন কিছু থাকবে না তখনো তিনি থাকবেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকা স্বত্ত্বেও সবকিছুর অতি নিকটবর্তী তিনি। তো যখন তাঁর আগেও কিছু নেই, তাঁর পরেও কিছু নেই, তাঁর উপরেও কিছু নেই এবং তাঁর নিচে ও অন্তরালেও কিছু নেই তখন তিনি যে কোনো বস্তুর গণ্ডিতে কিংবা কোনো স্থান ও কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নন; বরং স্থান ও কালের গণ্ডি থেকে তিনি সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই তো উপরোক্ত দুআর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকী রাহ. লেখেন-
والذي روي في آخر هذا الحديث إشارة إلى نفي المكان عن الله تعالى، وأن العبد أينما كان فهو في القرب والبعد من الله تعالى سواء، وأنه الظاهر، فيصح إدراكه بالأدلة؛ الباطن، فلا يصحُّ إدراكُه بالكون في مكان.
واستدل بعضُ أصحابنا في نفي المكان عنه بقول النبي صلى الله عليه وسلم: >أنت الظاهر فليس فوقك شيءٌ، وأنت الباطن فليس دونك شيءٌ<، وإذا لم يكن فوقه شيء ولا دونه شيء لم يكن في مكانٍ.
অর্থাৎ উপরোক্ত হাদীসের শেষাংশে যা বর্ণিত হয়েছে, তাতে আল্লাহ তাআলার মহান সত্তা থেকে স্থান নাকচ করার প্রতি ইশারা রয়েছে। এতে এই ইশারাও রয়েছে যে, বান্দা যেখানেই থাক সেখানেই সে দূরত্ব ও নৈকট্যের বিচারে আল্লাহ তাআলার কাছে সমান। সর্বোপরি এতে এই ইশারাও রয়েছে যে, আল্লাহ সবচেয়ে জাহির হওয়ার কারণে তাঁকে দলীল-প্রমাণ দ্বারা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আর সবকিছু থেকে সবচেয়ে বাতিন ও গুপ্ত হওয়ার কারণে তিনি কোনো স্থানে বিরাজমান থাকার ধারণা কখনোই সঠিক নয়।
‘মহান আল্লাহ তাআলা যে কোনো স্থানে বিরাজমান নন’- একথার পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে আমাদের মাশায়েখের মধ্যে কেউ কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীটি পেশ করেছেন-
وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ.
কেননা আল্লাহ তাআলার উপরেও যখন কিছু নেই এবং তাঁর নিচেও যখন কিছু নেই তখন তিনি তো কোনো স্থানে বিরাজমান নন। (বরং স্থান-কালের ঊর্ধ্বে বিরাজমান)। -আলআসমা ওয়াস সিফাত, ইমাম বায়হাকী, ২/২৮৯
এছাড়াও কোনো স্থান বা দিকের গণ্ডিতে অবস্থান করা আল্লাহ তাআলার مُحِيطٌ এবং وَاسِعٌ অর্থাৎ সর্বব্যাপী গুণের পরিপন্থী। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ لِلهِ الْمَشْرِقُ وَ الْمَغْرِبُ فَاَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ اِنَّ اللهَ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ.
পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই; সুতরাং তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও না কেন সেদিকই আল্লাহর দিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ। -সূরা বাকারা (০২) : ১১৫
সূরা নিসায় ইরশাদ হয়েছে-
وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُّحِيْطًا.
আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। -সূরা নিসা (০৪) : ১২৬
সূরা হা-মীম সাজদায় ইরশাদ হয়েছে-
اَلَاۤ اِنَّهٗ بِكُلِّ شَيْءٍ مُّحِيْطٌ
জেনে রেখ, তিনি অবশ্যই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন। -সূরা হা-মীম সাজদাহ (৪১) : ৫৪
সূরা বুরূজে ইরশাদ হয়েছে-
وَّ اللهُ مِنْ وَّرَآىِٕهِمْ مُّحِيْطٌ.
আল্লাহ তাদেরকে তাদের পেছনে থেকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। -সূরা বুরূজ (৮৫) : ২০
বলার অপেক্ষা রাখে না, যে মহান আল্লাহ তাআলা সর্বব্যাপী; সব কিছুকে যিনি নিজ কুদরতে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন তিনি কি কখনো কোনো বস্তুর গণ্ডিতে বা কোনো স্থান ও দিকের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হতে পারেন?! কখনোই না।
তাই তো ইমাম আবু হানীফা রাহ., ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-সহ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকল ইমামদের আকীদা হল-
وتَعَالَى عَنِ الحُدُودِ وَالْغَايَاتِ وَالأَرْكَانِ، وَالأَعْضَاءِ والْأَدَوَاتِ، لا تَحْوِيْهِ الْجِهَاتُ السِّتُّ كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বহু ঊর্ধ্বে সকল সীমা ও প্রান্ত থেকে, দৈহিক সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে এবং দৈহিক সকল উপায়-উপকরণ থেকে। জগতের ছয় দিক যেভাবে সৃষ্ট বস্তুসমূহকে বেষ্টন করে আছে সেভাবে কোনো দিক আল্লাহ তাআলাকে বেষ্টন করে না। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৫-৬৮, হিন্দুস্তানী নুসখা
তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর উপরোক্ত বক্তব্য অনুসারে আল্লাহ তাআলা যেহেতু সকল সীমা ও পরিসীমার ঊর্ধ্বে এবং সৃষ্টিজগতের সকল দিকের বেষ্টনী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তখন তিনি ঊর্ধ্বস্থ ও নিম্নস্থ সকল স্থানের গণ্ডি থেকে মুক্ত ও পবিত্র- তা সহজেই বোঝা যায়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)