জুলুমের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিশাপ
জুলুম ও অপরাধের সঙ্গে সংযুক্তির বিষয়টি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ-দুভাবেই হতে পারে। একজন সরাসরি জুলুম-নির্যাতন করলে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জুলুমকারী। অপর একজন তার জুলুম-নির্যাতন ও অপরাধে সহযোগিতা করলে, তাকে নৈতিক ও বাস্তব সমর্থন জোগালে তিনি পরোক্ষ জুলুমকারী। প্রথমজনের কৃত জুলুমের দায় থেকে দ্বিতীয়জন মুক্ত থাকতে পারে না। কিন্তু সমাজে পরোক্ষ জুলুম-সংযুক্ত মানুষেরা নিজেদের দায়বদ্ধতার কথাটি মনেই করতে চান না। যেন দৃশ্যমান প্রথম জুলুমকারী ব্যক্তিটিই একমাত্র জুলুমকারী, তাকে মদদ ও সমর্থনদাতার সেখানে কোনো দোষ-জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণ নেই। অথচ এটি একটি বিভ্রম ও ভ্রান্ত চিন্তা। মূলত জুলুমের দায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের, পরোক্ষ ভূমিকা-রাখা মানুষের দায়ও কোনো অংশে কম না।
জুলুম ও অন্যায়-অপরাধের কৌশল কখনো কখনো একশ্রেণির মানুষের কতৃর্ত্ব ও শক্তি বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জুলুম করে নিরীহ মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে জুলুমের প্রধান নির্দেশদাতা বা প্রেরণাদাতা ব্যক্তিটি থেকে নিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত সর্বশেষ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি সচেতন ব্যক্তি কিংবা স্তরই জুলুমের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যক্ষ সত্তা। সমাজে সেই জুলুমের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও পরিচালনা, সমর্থন, শক্তির জোগান কিংবা সমর্থনসূচক নীরবতা জুলুমের সঙ্গে যুক্ত দ্বিতীয় কিংবা পরোক্ষ শ্রেণির কাজ। এই অপ্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শ্রেণিটির সমর্থনেই জুলুমের জমিন আবাদ করা হয়। কতৃর্ত্ব ও নিপীড়ন অবাধে চালানোর সুযোগ তৈরি হয়। এবং মাঠ পর্যায়ের জুলুম ও অপরাধে যুক্ত শ্রেণি তার জুলুম-পূর্ণ কর্মকাণ্ডে নিঃশঙ্ক ও বাধাহীন হওয়ার সুযোগ পায়। অথচ জুলুম-সমর্থকদের ধারণা ও ভাবনা এমন থাকে যে, আমরা তো জুলুমটি করছি না। এখানে আমাদের কোনো দায়-দোষ নেই। এরকম ধারণা একদমই ভিত্তিহীন ও অমূলক।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَ تَعَاوَنُوْا عَلَي الْبِرِّ وَ التَّقْوٰي وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَي الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ.
তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে-অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে-অন্যের সহযোগিতা করবে না। —সূরা মায়িদা (৫) : ২
এ থেকে বোঝা যায়, অপরাধ কিংবা জুলুমের মূল ব্যক্তি হওয়া যেমন নিষেধ, তেমনি অপরাধ ও জুলুম, অন্যায় ও পাপের সহযোগী হওয়াও নিষেধ। মন্দ কাজে সহযোগিতা কোনো নিদোর্ষ বিষয় না।
কোনো কোনো জুলুমের চরিত্র আরো একটু বিস্তৃত। কতৃর্ত্ব ও নিপীড়নের পাশাপাশি আর্থিক জুলুমও পরিচালনা করা হয়। অন্য কথায় জুলুম ও পীড়নের মধ্য দিয়ে নানারকম আয়-উপার্জনের পথ গ্রহণ করা হয়। জুলুমই যেন হয়ে ওঠে জুলুমকারীর জীবিকার মূলধন। অত্যাচার-নিপীড়ন কতৃর্ত্ব ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে অর্থ-উপার্জন করা হয়। এই জুলুম আরো মারাত্মক। গায়ের জোরে টাকাকড়ি হাতিয়ে নেওয়া বা ডাকাতি করার চেয়ে এটি কোনো অংশে কম নয়। কতৃর্ত্ব ধরে রাখার পাশাপাশি নিজের অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলার পেছনে যারা জুলুমের অনুশীলন কাজে লাগায়— তারা তো অপরাধীই; যারা এসব ক্ষেত্রে সমর্থন-সহযোগিতা দিয়ে জুলুমকারীদের পথচলাকে নিষ্কণ্টক করে দেয়— তারাও অপরাধী।
আর একথা তো মিথ্যা নয় যে, সমাজে প্রত্যক্ষ জুলুমকারীদের যারা সমর্থন জোগায়- যারা পরোক্ষ জুলুম-অপরাধে যুক্ত থাকে, তাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ জুলুমকারীর পক্ষ থেকে সাহায্য-স্বার্থ আদায় করে থাকে। জুলুমে সমর্থনের সঙ্গে যুক্ত থাকে সুবিধা ও মুনাফা। পরোক্ষ জুলুমবাজদের এটি হচ্ছে দ্বিতীয় অপরাধ। কোনো স্বার্থ-সুবিধা ছাড়াই যদি কেউ অপরাধ, পাপ ও জুলুমের সমর্থন করে তবে সে জুলুমে সংযুক্তির দায় ভোগ করবে। কিন্তু সমর্থন আর সমর্থনের বদৌলতে ধনদৌলত ও সুবিধা অর্জন করলে সমর্থনদাতা পরোক্ষ জুলুমকারীর দ্বিগুণ দায় ও গোনাহও ভোগ করতে হবে।
অবিস্তারযোগ্য ব্যক্তিগত পাপ ব্যক্তির করা এবং সেই পাপে সহযোগিতা করার তুলনায় সৃষ্টির প্রতি কোনো জুলুম সংগঠিত করা এবং সেই জুলুমে সহযোগিতা করার মন্দত্ব অনেক বেশি। অথচ ব্যক্তিগত পাপও নিষেধ এবং তাতে সহযোগিতা করাও নিষেধ।
এতে স্পষ্ট হয়- জুলুম-নির্যাতনের মতো সংক্রমিত সামাজিক পাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংযুক্তি কতটা আত্মবিনাশী ও ক্ষতিকর।
গত ১০ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জে নিলামে একটি কাঁঠাল কেনাবেচার দ্বন্দ্বে ৩ জন নিহত হয় এবং আহত হয় আরো অর্ধশত মানুষ। ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যায়, একই এলাকার দুই গোষ্ঠীর পুরনো জেদ, শত্রুতা ও জুলুমের কারণেই এ ঘটনাটি ঘটেছে। এখানে কাঁঠালের নিলামের বিষয়টিকে উপলক্ষ্য হিসেবে সামনে আনা হলেও বাস্তবে এটি ছিল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামাজিক জুলুমপ্রবণতার ভয়ংকর উদাহরণ। ঘটনাটিতেও বিবদমান দুটি পক্ষে বিরোধ ও শত্রুতায় নেতৃত্বদানে অল্প কয়েকজন ব্যক্তির কারসাজি থাকলেও ঘটনাটি বড় ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে উভয় পক্ষে যুক্ত অনুসারী, সমর্থক ও মদদদাতাদের উপস্থিতির কারণে। আড়াইশ টাকার একটি কাঁঠাল কিনতে পারা-না পারার ইগো ও দ্বন্দ্ব অনেকগুলি জীবনের ক্ষতি করেছে; প্রাণ সংহার করেছে, আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করেছে।
ছোট-বড় এমন বহু ঘটনায় জীবন ও সমাজের বহু অঙ্গনে জুলুম কিংবা উৎপীড়ন টিকে থাকার একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে জুলুমের প্রতি নানা পর্যায়ের মানুষের অসচেতন কিংবা সুবিধাভোগী সমর্থন। প্রত্যক্ষ জুলুম তার সক্রিয়তা ও দাপট ধরে রাখতে পারে— সমাজের ভেতর থেকে পাওয়া সমর্থন-সহযোগিতার কারণেই। ভেতর থেকে যাওয়া এই সমর্থনই অপরাধ ও জুলুমের দ্বিতীয় স্তর; পরোক্ষ জুলুম। সমাজে বিরাজমান নেক কাজ, সততা ও সরলতার ওপর জুলুমের কালো মেঘ বিস্তৃত হয়ে গেলে ইতিবাচকতার শুভ্রতা ঢাকা পড়ে যায়। জীবনের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ে জুলুমের হাহাকার এবং কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে পরোক্ষ জুলুমের হাতগুলি গুটিয়ে নেওয়া। পাপাচার ও জুলুমে যুক্ত ব্যক্তিরা সমর্থন-সহযোগিতা পেতে পারে— এমন সব আচরণ বন্ধ করে দেওয়া। মদদ-সমর্থন না থাকলে প্রত্যক্ষ জুলুমের চাবুক এমনিতেই শক্তিহীন হয়ে যায়।
একটি সমাজকে রহম ও রহমতহীন করে অভিশাপের বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম উপলক্ষ্য হল, সমাজ জুড়ে নানামাত্রিক জুলুম-অপরাধের অনুশীলন। এতে বান্দার হক নষ্ট হয়, মানুষের হাহাকারে বাতাস ভারি হয়। এর কুফল ও দুভোর্গ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী জালিমকে সহযোগিতা করতে হয় তাকে নিবৃত্ত করে আর মজলুমকে সহযোগিতা করতে হয় তাকে জুলুম থেকে রক্ষা করে।
জুলুমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অপরাধের দরজা বন্ধ হয়ে যাক। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন— জুলুমে যুক্ত মানুষেরা হুঁশ ফিরে পাক আর জুলুমের শিকার হওয়া থেকে মজলুমরা লাভ করুক সুরক্ষা।