Muharram 1445   ||   August 2023

একটি আয়াত : কিছু শিক্ষা কিছু বার্তা

Mawlana Mummadullah Masum

সূরা বাকারার ১৮৮ নম্বর আয়াত

وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَ تُدْلُوْا بِهَاۤ اِلَي الْحُكَّامِ لِتَاْكُلُوْا فَرِيْقًا مِّنْ اَمْوَالِ النَّاسِ بِالْاِثْمِ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.

তোমরা পরস্পরে সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনে-শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে। সূরা বাকারা (২) : ১৮৮

আয়াতের প্রথমাংশে তো সকল অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে সুদ-ঘুষ, জুলুম-আত্মসাৎ, চুরি-ডাকাতিসহ সবকিছু।

কিন্তু দ্বিতীয়াংশে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তোমরা এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনে-শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে। এখান থেকেই আজ আমরা কুরআনী আলো ও হেদায়েত গ্রহণের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

আলোচ্য আয়াতে আমরা স্পষ্ট বার্তা পাই বাকপটুতা, কৌশলী যুক্তি-তর্ক এবং মিথ্যাসাক্ষী, ক্ষমতার প্রভাব বা অন্য কোনো কারণে প্রভাবিত হয়ে বিচারক অন্যের হক যদি আমাকে দিয়েও দেয়, বা আমার পক্ষে ভুল রায় এসে যায়, শরীয়তের দৃষ্টিতে এই রায় আমার জন্য গ্রহণ করা হালাল ও বৈধ নয়; সেটি হারাম বলেই বিবেচিত। কারণ মিথ্যা মিথ্যাই। অন্যায় অন্যায়ই। বিচারিক ফয়সালার মাধ্যমে মিথ্যা সত্য হয় না, অন্যায় ন্যায় হয়ে যায় না!

আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. এই আয়াতের তাফসীরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চমৎকার একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হযরত উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ وَإِنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ إِلَيَّ، وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ، فَأَقْضِي عَلَى نَحْوِ مَا أَسْمَعُ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ شَيْئًا، فَلاَ يَأْخُذْهُ، فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ.

আমি একজন মানুষ। আর তোমরা আমার নিকট বিভিন্ন বিবাদের ফায়সালার জন্য আস। হতে পারে, তোমাদের কেউ অপর থেকে অধিক বাকপটু ও প্রমাণ উপস্থাপনে বেশি পারঙ্গম। তাই হতে পারে, আমি তার কথা শুনে সে অনুযায়ী ফয়সালা করে দিলাম। অতএব, এভাবে যদি আমি কারো জন্য তার ভাইয়ের কোনো হক দিয়ে দেই, সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ আমি (তার অন্যায্য দাবি ও বাকপটুতার ভিত্তিতে) তাকে যা দেই, সেটা (পরিণতির বিচারে) আগুনের একটি টুকরো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭১৩

হাদীসের প্রেক্ষাপট ছিল

একবার দুই আনসারী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর খেদমতে এলেন এবং একটি বেওয়ারিশ ও পরিত্যক্ত জমি প্রত্যেকে নিজের বলে দাবি করলেন। নিছক দাবি ছাড়া কারো কাছেই কোনো দলীল নেই। তখন নবুওতী যবান থেকে উৎসারিত হল উপরোক্ত হাদীসখানা। (দ্র. মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৩৪২৮; শরহু সুনানি আবী দাউদ, ইবনে রাসলান ১৪/৬৩২)

আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. আয়াতের তাফসীরে উপরোক্ত হাদীস উপস্থাপন করার পর বললেন

فَدَلَّتْ هَذِهِ الْآيَةُ الْكَرِيمَةُ، وَهَذَا الْحَدِيثُ عَلَى أَنَّ حُكْمَ الْحَاكِمِ لَا يُغَيِّرُ الشَّيْءَ فِي نَفْسِ الْأَمْرِ، فَلَا يُحلّ فِي نَفْسِ الْأَمْرِ حَرَامًا هُوَ حَرَامٌ، وَلَا يُحَرِّمُ حَلَالًا هُوَ حَلَالٌ، وَإِنَّمَا هُوَ يَلْزَمُ فِي الظَّاهِرِ، فَإِنْ طَابَقَ فِي نَفْسِ الْأَمْرِ فَذَاكَ، وَإِلَّا فَلِلْحَاكِمِ أجرُه وَعَلَى الْمُحْتَالِ وزْره؛ وَلِهَذَا قَالَ تَعَالَى: وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَ تُدْلُوْا بِهَاۤ اِلَي الْحُكَّامِ لِتَاْكُلُوْا فَرِيْقًا [أَيْ: طَائِفَةً] مِّنْ اَمْوَالِ النَّاسِ بِالْاِثْمِ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ أَيْ: تَعْلَمُونَ بُطْلَانَ مَا تَدَّعُونَهُ وَتُرَوِّجُونَ فِي كَلَامِكُمْ.

এই আয়াত ও হাদীস নির্দেশ করে, বিচারকের বিচার কোনো বিষয়কে মূল থেকে পরিবর্তন করতে পারে না। কাজেই (বিচারকের বিচার) আদতে কোনো হারামকে প্রকৃতভাবে হালাল করতে পারে না এবং কোনো হালালকেও হারাম করতে পারে না। বরং সেটি কার্যকর হয় কেবল বাহ্যিকভাবে। এই বাহ্যিকতা যদি বাস্তবতার সাথে মিলে যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা। অন্যথায় বিচারক (তার সাধ্যমাফিক ন্যায় বিচারের কারণে) পুরস্কার পাবে, কিন্তু নিজের পক্ষে কৌশলে রায় আদায়কারীর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন তোমরা পরস্পরে সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ পাপের পথে গ্রাস করবে জেনে-শুনে। অর্থাৎ, তোমার জানা আছে যে, তুমি, যা দাবি করছ তা অন্যায়; কিন্তু বাকপটুতার মাধ্যমে অন্যায়কেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছ। তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫২১

ইমাম খাত্তাবী রাহ. হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মাআলিমুস সুনানে লেখেন

وفيه أنه لا يجوز للمقضي له بالشيء أخذه، إذا علم أنه لا يحل له فيما بينه وبين الله، ألا تراه يقول: فلا يأخذ منه شيئاً فإنما أقطع له قطعة من النار.

এ থেকে উদ্ভাবিত হয়, কারো জন্য অন্যায়ভাবে কোনো কিছু ফয়সালা হয়ে গেলেই কেবল সেটি তার জন্য গ্রহণ করা বৈধ হয়ে যায় না। যতক্ষণ না সে নিশ্চিত হবে যে, এটি আল্লাহর বিচারে তার জন্য হালাল ও বৈধ। এই যে নবীজী বলেছেন সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ (তার এই মিথ্যা দাবি বা মিথ্যা শপথের ফলশ্রুতিতে) যা আমি তাকে দেই, সেটি (পরিণতির বিচারে) তার জন্য আগুনের একটি টুকরো! মাআলিমুস সুনান ৪/১৬৩

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. লেখেন বাহ্যিক কোনো নির্দেশ প্রকৃত কোনো হককে বাতিলে পরিণত করে না এবং বাতিলকেও হকে পরিণত করে না। ফাতহুল বারী ৫/২৮৮

ইরাকের সমকালীন আরব দাঈ ড. আবদুল কারীম যাইদান রাহ. উপরোক্ত হাদীস সংশ্লিষ্ট আলোচনায় বলেন

وفي هذا كله أعظم ضمان لحسن تنظيم علاقات الأفراد فيما بينهم وعدم ضياع الحقوق على أصحابها. وهذا مما لا يوجد في القوانين الوضعية، فإن المسألة عندها تنتهي بانتهاء صدور القرار من المحكمة، ولا شيء بعد هذا، إذ لا سلطان للقوانين الوضعية على أمور الآخرة.

এই পুরো হাদীসে ইসলামী সমাজব্যবস্থায় নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্কের চমৎকার ব্যবস্থাপনা এবং হকদারের হকের সুরক্ষার নিশ্চয়তার বিষয়টি বিদ্যমান। পক্ষান্তরে মানবরচিত ব্যবস্থায় এটি পাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে ব্যাপারটি কেবল আদালত-কতৃর্ক রায় প্রদানের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপরে তার আর কিছু করার নেই। কারণ মানবরচিত আইনের আখেরাত ও পরকালীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের সক্ষমতাই নেই। উসূলুদ দাওয়াহ, পৃ. ৫৩

আজ সততা শব্দটি যখন বেমালুম ভুলে যাওয়া হচ্ছে, ন্যায় শব্দটিও যখন বিলুপ্ত হতে চলেছে, ইনসাফ শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে অপাত্রে, কেমন যেন সততা এখন বোকাদের গুণ, চালাক মানুষ সৎ হয় কী করে! আইনের হাত যখন শক্তিমানদের ছঁুতে অসহায়, ন্যায় বিচার যখন সোনার হরিণের মতো, যার শক্তি আছে তাকে ফলটি পেড়ে দেয়াই যেন বিচার! ক্ষমতা যার, তাকে সুরক্ষা দেয়াই যেন বিচারের কাজ, হতাশার এই ক্ষণেও কুরআন কারীম আমাদের হাতছানি দিয়ে যায়! আমরা কুরআন কারীমের যত কাছাকাছি যাব, ততই আলো পেতে থাকব।

আসুন, আলো নিই কুরআন থেকে! আশ্রয় গ্রহণ করি ইসলামের ছায়াতলে! অন্ধকার ঘুঁচে ন্যায় ও ইনসাফের পতাকা উড়বে আমাদের সমাজে, ইনশাআল্লাহ। 

 

 

advertisement