রাব্বুল আলামীনের গুণ-পরিচয়
তাঁর হামদের পাশাপাশি তাসবীহও জরুরি
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেমন সকল উৎকৃষ্ট গুণে গুণান্বিত, তেমনি সকল দোষ-ত্রুটি এবং মাখলূকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা হতে চিরপবিত্র। তাই কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলার যেমন হাম্দ ও প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে, তেমনি তাসবীহ ও পবিত্রতাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন সকল কামাল ও পূর্ণতা গুণের এছবাত রয়েছে, তেমনি সকল অপূর্ণতা ও দোষত্রুটির নফীও রয়েছে। সিফাতে কামালের এছবাত যেমন রয়েছে, তেমনি সিফাতে কামালের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের নফীও রয়েছে। এভাবে সিফাতে কামালের এছবাত এবং বিপরীত সবকিছুর নফীর সমন্বয়েই মহামহিম আল্লাহর মাহাত্ম্য ও একত্বের ভাবকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁর অলআসমাউল হুসনা তথা গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে রয়েছে- সুব্বুহুন, কুদ্দুসুন, সালামুন। এসব নাম তাঁর পবিত্রতা ও অনন্যতাকেই প্রকটিত করে। এ ধরনের আরও অনেক গুণবাচক নাম তাঁর রয়েছে।
আমরা তাঁর প্রশংসায় সংক্ষেপে বলি- ‘আলহামদু লিল্লাহ’ এবং তাঁর পবিত্রতা, অতুলনীয়তা ও অনন্যতাকে ব্যক্ত করার জন্য সংক্ষেপে বলি- সুবহানাল্লাহ। এই ‘সুবহানাল্লাহ’ মানেই হল- আল্লাহ তাআলার সত্তা সব ধরনের ত্রুটি, মুখাপেক্ষিতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে চিরপবিত্র, তিনি পূর্ণতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিপন্থী সব বিষয় থেকে পবিত্র, তিনি সকল মহৎ গুণের অধিকারী এবং মহৎগুণের পরিপন্থী সকল বিষয় থেকে চিরপবিত্র। মোটকথা রুবুবিয়্যাত ও ইলাহিয়্যাতের শান ও মানের পরিপন্থী সবকিছু থেকে তাঁর মহান সত্তা এবং তাঁর গুণ ও কর্ম চিরপবিত্র। তাই ‘সুবহানাল্লাহ’- এই শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও অনন্যতাই বিশেষভাবে প্রকটিত হয়। এবিষয়ে কুরআন কারীমের কিছু আয়াত পাঠ করুন-
وَ جَعَلُوْا لِلهِ شُرَكَآءَ الْجِنَّ وَ خَلَقَهُمْ وَ خَرَقُوْا لَهٗ بَنِيْنَ وَ بَنٰتٍۭ بِغَيْرِ عِلْمٍ سُبْحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰي عَمَّا يَصِفُوْنَ،بَدِيْعُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ اَنّٰي يَكُوْنُ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَمْ تَكُنْ لَّهٗ صَاحِبَةٌ وَ خَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَ هُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ،ذٰلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوْهُ وَ هُوَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ وَّكِيْلٌ، لَا تُدْرِكُهُ الْاَبْصَارُ وَ هُوَ يُدْرِكُ الْاَبْصَارَ وَ هُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُ.
তারা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করেছে, অথচ আল্লাহ্ই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা অজ্ঞতাবশত তাঁর জন্য পুত্র-কন্যা গড়ে নিয়েছে, অথচ তারা (আল্লাহ সম্পর্কে) যা-কিছু বলে, তিনি তা থেকে পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে। (তিনি) আসমান ও যমীনের স্রষ্টা। তাঁর কোনো সন্তান হবে কী করে, যখন তার কোনো স্ত্রী নেই? তিনিই সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সকল বস্তু সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের প্রতিপালক। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি যাবতীয় বস্তুর স্রষ্টা। সুতরাং তাঁরই ইবাদত কর। তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। দৃষ্টিসমূহ তাঁকে ধরতে পারে না, কিন্তু দৃষ্টিসমূহ তাঁর আয়ত্তাধীন। তাঁর সত্তা অতি সূক্ষ্ম এবং তিনি সর্ববিষয়ে অবগত। -সূরা আনআম (৬) : ১০০-১০৩
দেখুন, উপরোক্ত আয়াতগুলোতে প্রথমে আল্লাহ সম্পর্কে মুশরিকদের শিরকী বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর তা থেকে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ঘোষণা করা হয়েছে একথা বলে-
سُبْحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰي عَمَّا يَصِفُوْنَ.
অর্থাৎ ‘তারা (আল্লাহ সম্পর্কে) যা-কিছু বলে, তিনি তা থেকে পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে।’
এর পরের দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও অনন্যতার কথা যুক্তিপূর্ণ ভাষায় সুবিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। যার সারমর্ম হল, মহামহিম আল্লাহই যেহেতু সমগ্র আসমান-যমীনকে নাস্তি থেকে অস্তিত্বে আনয়নকারী একমাত্র স্রষ্টা, জগতের সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত এবং সবকিছুকে তিনি এককভাবে পরিচালনা করেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তান থাকা কিংবা অন্য কোনো শরীক ও সমকক্ষ থাকা কিংবা কোনো সহযোগী থাকা অবান্তর ও অসম্ভব বিষয়। শরীক ও সহযোগী থাকা তো কার্যক্ষমতার, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার এবং জ্ঞান ও অবগতির ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা থেকে প্রকৃত ইলাহ মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ পবিত্র। তাঁর পবিত্র সত্তা এতই সূক্ষ্ম এবং অসীম ও অনন্য যে, কোনো দৃষ্টি তাঁকে ধরতে পারে না এবং তিনি এত বেশি ওয়াকিফহাল যে, সকল দৃষ্টিই তাঁর আয়ত্তাধীন এবং সকলের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত। এই সত্তাগত ও গুণগত সূক্ষ্মতা ও অসীমতায় কেউ কি তাঁর সমকক্ষ আছে? থাকতে পারে?
না, কখনোই নয়। বস্তুত মহান আল্লাহ তাআলার অসীম সত্তাকে কখনোই কোনো মাখলূকের সসীম দৃষ্টি বেষ্টন করতে পারে না; তাই এই দুনিয়ায় চর্মচোখ দিয়ে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়, আর মৃত্যুর পর আখেরাতে যদিও মুমিন বান্দাগণ তাঁকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করবে, কিন্তু সে দেখা ভিন্ন এক দেখা, দুনিয়ায় দেখার মতো নয় এবং সেই দেখা দ্বারাও আল্লাহর অসীম সত্তাকে বেষ্টন করা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদেরকে মানুষ ইলাহ ও ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করে তারা সকলেই সসীম, তাদের জ্ঞান ও শক্তি সীমিত এবং তাদেরকে এই জগতে চর্মচোখ দিয়ে দেখা সম্ভব এবং দেখা যায়। তাই তো শেষ যামানায় কিয়ামতের আগে যে দাজ্জালের প্রকাশ ঘটবে এবং নিজেকে খোদা হিসেবে দাবি করবে তার মিথ্যাবাদী হওয়ার প্রমাণ হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তার অন্যতম হল-
تعلَّمُوا أنه لن يَرى أحدٌ منكم ربَّه عز وجل حتى يموتَ.
জেনে রাখো, মৃত্যুর পূর্বে তোমাদের কেউ কখনোই তার রবকে দেখতে পাবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৩১
যাইহোক, ‘সুবহান’ শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতার ঘোষণা কুরআন মাজীদের আরও বহু আয়াতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে। যেমন, সূরা মুমিনের ৯১ নং আয়াতে এবং সূরা সাফফাতের ১৫৯ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَ اللهِ عَمَّا يَصِفُوْنَ.
সূরা সাফফাতের ১৮০ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ.
সূরা বনী ইসরাঈলের ৪৩ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰي عَمَّا يَقُوْلُوْنَ عُلُوًّا كَبِيْرًا.
সূরা যুখরুফের ৮২ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَ رَبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُوْنَ.
সূরা তূরের ৪৩ নং আয়াতে এবং সূরা হাশরের ২৩ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَ اللهِ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ.
সূরা কাসাসের ৬৮ নং আয়াতে আছে-
سُبْحٰنَ اللهِ وَ تَعٰلٰي عَمَّا يُشْرِكُوْنَ.
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ‘সুবহান’ শব্দের মাধ্যমে সর্বোতভাবে মহান আল্লাহ পাকের পবিত্রতা ও অনন্যতার কথা ঘোষিত হয়েছে। কাফির-মুশরিকরা আল্লাহর ব্যাপারে যত ধরনের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে আল্লাহ তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র; তাদের ধারণা থেকে আল্লাহ পাক অনেক অনেক ঊর্ধ্বে- একথাই বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ পাকের ফিরিশতাগণ, তাঁর নবী ও রাসূলগণ এবং তাঁর অন্যান্য মুমিন ও নেক বান্দারা এই ‘সুবহান’ শব্দের মাধ্যমে তাদের মহান রবের পবিত্রতা ও অনন্যতা ঘোষণা করে, যার বহু বিবরণ কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ফিরিশতাগণ নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং আল্লাহ তাআলার জ্ঞানের অসীমতা স্বীকার করে বলেছিল-
سُبْحٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا اِنَّكَ اَنْتَ الْعَلِيْمُ الْحَكِيْمُ.
আপনার সত্তাই পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন, তার বাইরে আমরা কিছুই জানি না। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মালিক তো কেবল আপনিই। -সূরা বাকারা (২) : ৩২
এ দুনিয়ায় আল্লাহ তাআলাকে দেখা সম্ভব নয়। মানুষ তো দূরের কথা পাহাড়-পর্বতেরও এ ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ তাআলার তাজাল্লী বরদাশত করবে অর্থাৎ তিনি নিজ জ্যোতি প্রকাশ করলে তা সহ্য করবে। এ বিষয়টা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে চোখে দেখানোর জন্যই আল্লাহ তাআলা তূর পাহাড়ে তাজাল্লী ফেলেছিলেন, যা সে পাহাড়ের পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব হয়নি। পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তখন সেই দৃশ্য দেখে হযরত মূসা অলাইহিস সালাম বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে যখন তাঁর হুঁশ ফিরে এল, তখন তিনি অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করলেন-
سُبْحٰنَكَ تُبْتُ اِلَيْكَ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُؤْمِنِيْنَ.
আপনার সত্তা পবিত্র। আমি আপনার দরবারে তাওবা করছি এবং (দুনিয়ায় কেউ আপনাকে দেখতে সক্ষম নয়- এ বিষয়ের প্রতি) আমি সবার আগে ঈমান আনছি। -সূরা আরাফ (৭) : ১৪৩
আহলে কিতাবের মধ্যে যারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান এনেছিল, তারা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির সত্যতা স্বীকার করে এবং অসত্য ও অবাস্তব হওয়ার ভ্রান্ত ধারণাকে খণ্ডন করে বলেছিল-
سُبْحٰنَ رَبِّنَاۤ اِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُوْلًا.
আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়েই থাকে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১০৮
হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম এক মহা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি যে নৌকায় চড়ে যাচ্ছিলেন, তা থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। সেই মাছের পেটের অন্ধকার থেকে তিনি মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলাকে এই বলে ডাকতে থাকেন-
لَۤا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحٰنَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ.
আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আপনি পবিত্র, নিশ্চয়ই আমি একজন অপরাধী। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭
এখানে হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম সবধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে এবং জুলুম ও অন্যায় থেকে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন।
এভাবে আল্লাহ পাকের মুমিন বান্দাগণ সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে ওঠে-
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًا سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি (এমন ফজুল কাজ থেকে) পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯১
জান্নাতে প্রবেশের পরেও মুমিন বান্দারা আল্লাহ পাকের প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করবে। এ ব্যাপারে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
دَعْوٰىهُمْ فِيْهَا سُبْحٰنَكَ اللّٰهُمَّ وَ تَحِيَّتُهُمْ فِيْهَا سَلٰمٌ وَ اٰخِرُ دَعْوٰىهُمْ اَنِ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ.
জান্নাতে (প্রবেশকালে) তাদের ধ্বনি হবে- হে আল্লাহ! সকল দোষ-ত্রুটি থেকে আপনি পবিত্র এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে- সালাম। আর তাদের শেষ ধ্বনি হবে এই যে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। -সূরা ইউনুস (১০) : ১০
শুধু মানুষ ও ফিরিশতাই নয়, বরং আসমান-যমীনের সকল সৃষ্টিই তাঁর প্রশংসার সাথে সাথে পবিত্রতাও ঘোষণা করে। ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَ الْاَرْضُ وَ مَنْ فِيْهِنَّ وَ اِنْ مِّنْ شَيْءٍ اِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهٖ وَ لٰكِنْ لَّا تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ اِنَّهٗ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا.
সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তভুর্ক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনো জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না। বস্তুত তিনি পরম সহিষ্ণু, অতি ক্ষমাশীল। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৪৪
বস্তুত স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে হাম্দ ও প্রশংসার পাশাপাশি তাসবীহ ও পবিত্রতা বর্ণনারও আদেশ করেছেন। কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত পাঠ করুন-
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ .
وَ سَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ .
وَ تَوَكَّلْ عَلَي الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَمُوْتُ وَ سَبِّحْ بِحَمْدِهٖ وَ كَفٰي بِهٖ بِذُنُوْبِ عِبَادِهٖ خَبِيْرَا .
উপরের প্রতিটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর হাম্দ ও প্রশংসার পাশাপাশি তাসবীহ ও পবিত্রতা বর্ণনার আদেশ করেছেন।
তাই আমরা তাঁর হুকুম পালনার্থে নামাযের মাধ্যমে তাঁর হাম্দ ও তাসবীহ করি। নামাযের বাইরেও আমরা তাঁর হাম্দ ও তাসবীহ করি। নামাযে রুকু অবস্থায় আমরা পড়ি-
سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ.
এবং সিজদা অবস্থায় আমরা পড়ি-
سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى.
সূরা নাস্র-এ যখন আল্লাহ পাক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করলেন-
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ ؔ.
তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। -সূরা নাসর (১১০) : ৩
তখন আদেশ পালনার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই তাসবীহ বেশি বেশি পাঠ করতেন-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه، وِأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ.
মোটকথা, এতক্ষণের এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, শুধু হাম্দ ও প্রশংসা যথেষ্ট নয়; বরং এর পাশাপশি তাসবীহ ও পবিত্রতা বর্ণনা করাও জরুরি। তাই আল্লাহ তাআলার প্রশংসনীয় ‘মুছবাত’ গুণাবলি সম্পর্কে জানা যেমন জরুরি, তেমনি পবিত্রতাসূচক ‘সালবী’ গুণাবলি সম্পর্কে জানাও জরুরি। উভয় প্রকার গুণাবলি সম্পর্কে আমরা গত সংখ্যায় সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এসংখ্যায় আমরা পবিত্রতাসূচক গুণাবলি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।
মহিমা ও পবিত্রতার প্রধান দুটি দিক
আমাদের জানা উচিত, মহামহিম আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও মহিমার প্রধান দুটি দিক রয়েছে :
এক. তিনি সকল উত্তম গুণে গুণান্বিত এবং গুণ ও বৈশিষ্ট্যে পূর্ণতা পরিপন্থী যা কিছু আছে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র। যেমন :
তিনি পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। অজ্ঞতা, অনবগতি, বিস্মৃতি ইত্যাদি থেকে তিনি পবিত্র।
তিনি পূর্ণ ক্ষমতা ও সক্ষমতার অধিকারী। অক্ষমতা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি থেকে তিনি পবিত্র।
তিনি চিরজীবী, সৃষ্টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে। লয়, ক্ষয়, জরা; নিদ্রা, তন্দ্রা, মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছু থেকে তিনি চিরপবিত্র।
তিনি ন্যয়বিচারক, অমুখাপেক্ষী। জুলুম, অবিচার, পক্ষপাত থেকে এবং সর্ব প্রকারের মুখাপেক্ষিতা থেকে তিনি পবিত্র।
তিনি দয়াময়, প্রজ্ঞাময়, তাঁর কোনো কর্ম, কোনো বিধান দয়া ও প্রজ্ঞাশূন্য নয়। অর্থহীন, তাৎপর্যহীন কাজ থেকে তিনি চিরপবিত্র।
মোটকথা, তাঁর সিফাত ও গুণাবলির পরিপন্থী সবকিছু থেকে তিনি পবিত্র। তাঁর পবিত্রতার দিকগুলো বিশদভাবে তখনই উপলব্ধি করা যাবে, যখন তার সিফাত ও গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জিত হবে।
দুই. তিনি মাখলূকের সাদৃশ্য ও সমশ্রেণিতা থেকে পবিত্র। তিনি সব দিক থেকে বেমিছাল। তিনি নিজ সত্তার দিক থেকেও বেমিছাল, গুণাবলির দিক থেকেও বেমিছাল। তাঁর নজীর ও উদাহরণ নেই কিছুই। তাঁর কোনো শরীক নেই, সহযোগী নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর স্ত্রী নেই, সন্তান নেই। তিনিও কারও সন্তান নন। তাঁর মতো কেউ নেই। তাঁর সমকক্ষ নেই, প্রতিপক্ষ নেই, তাঁর মুকাবেলা করার, তাঁর ফয়সালা রদ করার কেউ নেই।
তাঁর গুণাবলি মাখলূকের গুণাবলি থেকে আলাদা। তাঁর গুণ পূর্ণ, নিজস্ব, শ্বাশ্বত ও সবধরনের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। পক্ষান্তরে মাখলূকের গুণ ক্ষীণ, ক্ষণস্থায়ী, সীমাবদ্ধতাযুক্ত ও আল্লাহপ্রদত্ত।
সিফাতের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যমুক্ত হওয়া তাওহীদ ও তাসবীহের অপরিহার্য দাবি
আল্লাহু আহাদ-আল্লাহ তাআলা এক-অদ্বিতীয়। এক হওয়ার অর্থ কেবল সংখ্যাগত বিবেচনায় এক হওয়া নয়। কারণ যা কেবল সংখ্যায় এক, তার অংশ থাকা সম্ভব এবং তার বিরোধী সত্তা থাকাও সম্ভব। বরং আল্লাহ তাআলা এক-অদ্বিতীয় হওয়ার অর্থ হল, কোনো বিষয়ে তাঁর সদৃশ ও সমতুল্য কেউ বা কোনো কিছু নেই এবং তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। তার মানে তিনি সত্তাগত বিবেচনায় অনন্য; তাঁর অনুরূপ সত্তা আর কারও নেই, তিনি ক্ষমতায় অনন্য, তাঁর অনুরূপ ক্ষমতা আর কারও নেই, তিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অনন্য; তাঁর অনুরূপ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আর কারও নেই, তিনি মর্যাদা ও মহিমায় অনন্য; তাঁর অনুরূপ মর্যাদা ও মহিমা আর কারও নেই। মোটকথা, তিনি সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যে অনন্য; গুণ ও বৈশিষ্ট্যে তাঁর শরীক ও সদৃশ বলতে কেউ নেই। কারণ বলার অপেক্ষা রাখে না, যার সদৃশ ও সমতুল্য আছে, সে এক-অদ্বিতীয় নয়; বরং তার তো জোড়া ও সমরূপ রয়েছে।
সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা এক-অদ্বিতীয় হওয়ার অনিবার্য দাবি হল, আল্লাহ তাআলার মতো বলতে কেউ বা কোনো কিছু নেই এবং তিনিও অন্য কারও মতো নন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মাখলূকের সমশ্রেণিতা ও সাদৃশ্য থেকে মুক্ত ও পবিত্র- একথা তাওহীদের আকীদারই রোকন ও অংশ। আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে মাখলূককে শরীক করা যেমন শিরক ও তাওহীদ পরিপন্থী, তেমনি মাখলূকের বৈশিষ্ট্যে আল্লাহকে শরীক মনে করাও শিরক ও তাওহীদ পরিপন্থী।
এমনিভাবে ‘তাসবীহ’ তথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্রতা ঘোষণার অপরিহার্য রোকন হল, তিনি মাখলূকের সমশ্রেণিতা ও সাদৃশ্য থেকে চিরপবিত্র। তাঁর পবিত্রতার এই অপরিহার্য দিকটি সম্পর্কে মহিমা ও পবিত্রতাসূচক আম ও সাধারণ নুসুসের পাশাপাশি এ বিষয়ে কুরআনে কারীমে ও হাদীস শরীফে বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছ।
আমরা দেখি, কুরআন কারীমে আল্লাহ পাক বিশেষভবে তাঁর নামের পবিত্রতা বর্ণনার আদেশ করেছেন। সূরা ওয়াকিয়ায় একই শব্দে দুইবার আদেশ করা হয়েছে-
فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيْمِ.
সুতরাং তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর। -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৭৪, ৯৬
একইভাবে এবং একই শব্দে সূরা হাক্কার ৫২ নং আয়াতেও নামের পবিত্রতা বর্ণনার ও রক্ষার আদেশ করা হয়েছে।
সূরা আ‘লা-এ আদেশ করা হয়েছে-
سَبِّـحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَي.
তোমার সমুচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর। -সূরা আ‘লা (৮৭) : ১
লক্ষণীয়, উপরের আয়াতগুলোতে বিশেষভাবে নামের ‘তাসবীহ’ করার আদেশ করা হয়েছে। তাসবীহ মানে দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্রকরণ। তো নামের তাসবীহ ও পবিত্রায়নের নানা দিক রয়েছে। যবানে তাঁর পবিত্রতা আলোচনা করা, পবিত্রতাসূচক নামের মাধ্যমে তাঁর যিকির করা, তাসবীহ পড়া, তাঁর নামসমূহকে সম্মান করা, সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাঁর নাম উচ্চারণ করা। আল্লাহর পবিত্র নামগুলো কোনো মিথ্যা মাবূদের জন্য ব্যবহার না করা। তাঁর জন্য তাঁর শান ও মানের অনুপযোগী কোনো নাম ও শব্দ ব্যবহার না করা।
সর্বোপরি আল্লাহর নামের তাসবীহ ও পবিত্রায়নের বড় একটি দিক হল, তাঁর যত নাম বর্ণিত হয়েছে, তাঁর শানে যত শব্দ ও অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে, তা এমন অর্থে গ্রহণ করা, যা তাঁর শান ও মানের উপযোগী, যা সবধরনের দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এবং মাখলূকের সাদৃশ্য থেকে পবিত্র।
কেননা আমরা তো দুনিয়ায় আল্লাহর যাত ও সত্তাকে এবং তাঁর সিফাত ও গুণাবলিকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করি না। বস্তুত তাঁর সত্তার স্বরূপ এবং তাঁর গুণের স্বরূপ আমাদের পক্ষে জানা কখনোই সম্ভব নয়। আমরা তাঁকে চিনি ও জানি কেবল তাঁর আসমা ও সিফাত তথা গুণাবাচক নাম ও শব্দের মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই আমরা তাঁকে ডাকি ও স্মরণ করি এবং শব্দ ও অভিধা ব্যবহার করেই তো আমরা তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি। তাই অনিবার্য কারণেই এসব নাম ও অভিধাকে নাকিস ও অপূর্ণ অর্থ থেকে, মাহদূদ ও সীমাবদ্ধ অর্থ থেকে এবং লৌকিক ও পার্থিব অর্থ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখা জরুরি। আর তাই আল্লাহর পবিত্র নামের এবং তাঁর শানে ব্যবহৃত শব্দ ও অভিধার ভুল অর্থ বা লৌকিক অর্থ বোঝা ও গ্রহণ করা সব যুগে গোমরাহীর এক বড় কারণ।
প্রসিদ্ধ মুফাসসির নিযামুদ্দীন হাসান নীশাপুরী (ওফাত : ৮৫০ হি.) তাঁর ‘গারায়িবুল কুরআন’ নামক তাফসীর গ্রন্থে আল্লাহর নামের তাসবীহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সুন্দর কথা বলেছেন-
تسبيح اسمه تنزيهه عما لا يليق معناه بذاته تعالى أو صفاته أو بأفعاله أو بأحكامه، فإن العقائد الباطلة والمذاهب الفاسدة لم تنشأ إلا من هذه، ومن جملة ذلك أن يصان اسمه عن الابتذال والذكر لا على وجه الخشوع والتعظيم، وأن لا يسمى غيره بأسمائه الحسنى، وأن لا يطلق عليه من الأسامي إلا ما ورد به الإذن الشرعي.
আল্লাহ নামের তাসবীহ বা পবিত্রতা ঘোষণা হল, তাঁর নামকে এমন অর্থ ও মর্ম থেকে মুক্ত রাখা, যা তাঁর সত্তার উপযুক্ত নয়, কিংবা তাঁর সিফাতের উপযুক্ত নয়, কিংবা তাঁর কার্যাবলির উপযুক্ত নয়, কিংবা তাঁর বিধানাবলির উপযুক্ত নয়। কেননা এটা না করার কারণেই মূলত বিভিন্ন বাতিল আকীদা এবং ভ্রান্ত মতবাদের সূচনা হয়েছে। এমনিভাবে আল্লাহর নামের তাসবীহের আরও বিভিন্ন দিক রয়েছে। যেমন, তাঁর নামকে অসম্মান ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা, তাযীম ও বিনয়মুক্ত যিকির থেকে তাঁর নামকে রক্ষা করা। এমনিভাবে তাঁর গুণবাচক সুন্দরতম নামসমূহ অন্যের উপর আরোপ না করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য যেসব নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো নাম তাঁর জন্য ব্যবহার না করা। -গারায়িবুল ফুরকান ৬/৪৮৩
সুতরাং গুণবাচক নাম ও অভিধাকে ত্রুটিপূর্ণ অর্থ থেকে এবং পার্থিব ও মানবীয় অর্থ থেকে পবিত্র রাখা একান্ত জরুরি। এর কারণ খুবই স্পষ্ট ও যৌক্তিক। কেননা কুরআন কারীম ও হাদীসে আল্লাহ পাকের শান ও গুণ বর্ণনায় যেসব শব্দ ও অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে, তা মূলত মানবীয় ভাষারই শব্দ, যে ভাষার সাথে মানুষ পরিচিত, যে ভাষায় মানুষ কথা বলে। তো গুণ বর্ণনায় পার্থিব জগতের ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে মানুষের প্রয়োজনে, তা না হলে মানুষ সিফাতের অর্থ ও মর্ম কিছুই বুঝত না। কিন্তু পার্থিব জগতের ভাষা যেহেতু পার্থিব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, তাই মানুষের ভুল বোঝারও আশঙ্কা থাকে। তাই মানবীয় ভাষায় গুণ বর্ণনার পাশাপাশি সেই গুণের ক্ষেত্রে মাখলূকের সঙ্গে সাদৃশ্যকে নফী করা জরুরি। আর তাই কুরআন কারীমে যেমন ‘মুসবাত’ ও সদার্থক গুণ বর্ণিত হয়েছে তেমনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ও ব্যাপক অর্থবোধক শব্দে মাখলূকের সাথে তাঁর সাদৃশ্যকে সম্পূর্ণ নফী করা হয়েছে। কোথাও কোথাও একই আয়াতে বা একই সূরায় গুণের এছবাতের পাশাপাশি সাদৃশ্যকে জোরালোভাবে নফী করা হয়েছে। আমরা এখানে এধরনের কয়েকটি আয়াত এবং একটি সূরা সম্পর্কে আলোচনা করব।
সূরাতুশ শূরা-এর ১১ নং অয়াত পাঠ করুন-
فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا وَّ مِنَ الْاَنْعَامِ اَزْوَاجًا يَذْرَؤُكُمْ فِيْهِ لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ.
তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া। এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। তাঁর অনুরূপ বলতে কিছু নেই। তিনিই সব কথা শোনেন, সবকিছু দেখেন।
লক্ষ্য করুন আয়াতের শেষাংশ-
لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ.
‘তাঁর সদৃশ বলতে কিছু নেই।’ দ্ব্যর্থহীন ও ব্যাপক অর্থবোধক উক্তি। ভাষাগত বিচারে এতে কোনো দ্ব্যর্থতা ও অস্পষ্টতা নেই। আরবী ভাষার উসলূব ও বাকরীতি সম্পর্কে সচেতন যে কেউ বুঝবেন, এই আয়াতের নফী সর্বব্যাপী। অর্থাৎ কেউই বা কোনো কিছুই কোনো দিক থেকেই তাঁর সদৃশ নয়, তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই, থাকতে পারে না। তাই এর দ্ব্যর্থহীনতা ও ব্যাপকতার বিষয়ে সালাফের যামানা থেকে অজ পর্যন্ত আহলুস সুন্ন্াহ ওয়াল জামাআর সকল ইমামের ইজমা ও ঐক্যমত রয়েছে। কেউই এর ব্যাপকতাকে অস্বীকার করেননি। সিফাতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে এই আয়াতটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি মূলনীতি। মাখলূকের সঙ্গে আল্লাহ পাকের সব ধরনের সাদৃশ্যকে নফীর জন্য সাহাবীদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সকলেই এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
এবিষয়ে কুরআন কারীমের আরও কিছু আয়াত লক্ষ্য করুন :
اَفَمَنْ يَّخْلُقُ كَمَنْ لَّا يَخْلُقُ اَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ .
যেই সত্তা (এতসব বস্তু) সৃষ্টি করেন, তিনি কি তার মতো হতে পারেন, যে কিছুই সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? -সূরা নাহল (১৬) : ১৭
رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ مَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَ اصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهٖ هَلْ تَعْلَمُ لَهٗ سَمِيًّا.
তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিক এবং এ দুয়ের মাঝখানে যা আছে তারও। সুতরাং তুমি তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর ইবাদতে অবিচলিত থাক। তোমার জানামতে তাঁর সমগুণসম্পন্ন কেউ আছে কি? -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৬৫
অর্থাৎ তাঁর সমগুণসম্পন্ন যেহেতু কেউ নেই, তাই ইবাদতের যোগ্যও আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়।
মুশরিকগণ তাদের শিরকী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য আল্লাহ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টান্ত পেশ করত। যেমন, তারা অনেক সময় এই দৃষ্টান্ত পেশ করত যে, দুনিয়ার কোনো বাদশাহ নিজে একা রাজত্ব চালায় না; বরং রাজত্বের বহু কাজই সহযোগীদের হাতে ছাড়তে হয়। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলাও তাঁর প্রভুত্বের বহু কাজ দেব-দেবীদের হাতে ন্যস্ত করে দিয়েছেন। তারা সেসব কাজ স্বাধীনভাবে আঞ্জাম দেয় (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহ তাআলা তাঁদের এই দৃষ্টান্ত ও উপমা বাতিল আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন-
فَلَا تَضْرِبُوْا لِلهِ الْاَمْثَالَ اِنَّ اللهَ يَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.
ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا عَبْدًا مَّمْلُوْكًا لَّا يَقْدِرُ عَلٰي شَيْءٍ وَّ مَنْ رَّزَقْنٰهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ سِرًّا وَّ جَهْرًا هَلْ يَسْتَوٗنَ اَلْحَمْدُ لِلهِ بَلْ اَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ.وَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا رَّجُلَيْنِ اَحَدُهُمَاۤ اَبْكَمُ لَا يَقْدِرُ عَلٰي شَيْءٍ وَّ هُوَ كَلٌّ عَلٰي مَوْلٰىهُ اَيْنَمَايُوَجِّهْهُّ لَا يَاْتِ بِخَيْرٍ هَلْ يَسْتَوِيْ هُوَ وَ مَنْ يَّاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَ هُوَ عَلٰي صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ .
তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে দৃষ্টান্ত তৈরি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।
আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন, একদিকে এক গোলাম, যে কারও মালিকানাধীন আছে। কোনো বস্তুর মধ্যে তার কিছুমাত্র ক্ষমতা নেই। আর অন্যদিকে এমন এক ব্যক্তি, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে উৎকৃষ্ট রিযিক দিয়েছি এবং সে তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে। এই দুইজন কি সমান হতে পারে? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই (এমন পরিষ্কার কথাও) জানে না।
আল্লাহ আরেকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন, দুজন লোক, তাদের একজন বোবা। সে কোনো কাজ করতে পারে না; বরং সে তার মনিবের জন্য একটা বোঝা। মনিব তাকে যেখানেই পাঠায়, সে ভালো কিছু করে আনে না। এরূপ ব্যক্তি কি ওই ব্যক্তির সমান হতে পারে, যে অন্যদেরকেও ন্যায়ের আদেশ দেয় এবং নিজেও সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে? -সূরা নাহল (১৬) : ৭৪-৭৬
উপরোক্ত ৭৪ নং আয়াতে মুশরিকদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার জন্য দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের কিংবা যে কোনো মাখলূকের দৃষ্টান্ত পেশ করা চরম পর্যায়ের মূর্খতা। অতঃপর ৭৫ থেকে ৭৬ পর্যন্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা তাওহীদের অপরিহার্যতা এবং শিরকের ভ্রান্তি সম্পর্কে দুটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য, যদি সৃষ্টির দৃষ্টান্তই দেখতে হয়, তবে এ দৃষ্টান্ত দুটো লক্ষ্য কর। এর দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সৃষ্টিতে-সৃষ্টিতেও প্রভেদ আছে। কোনো সৃষ্টি উচ্চ স্তরের হয়, কোনো সৃষ্টি নিম্নস্তরের। যখন দুই সৃষ্টির মধ্যে এমন প্রভেদ, তখন স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কেমন প্রভেদ থাকতে পারে? তা সত্ত্বেও ইবাদত-বন্দেগীতে কোনো সৃষ্টিকে স্রষ্টার অংশীদার কীভাবে বানানো যেতে পারে?
লক্ষ্য করুন, উপরোক্ত তিনটি আয়াত থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এমন কোনো উপমা পেশ করা যাবে না, যা তাঁর শান ও মানের অর্থাৎ তাঁর তাওহীদের পরিপন্থী। তবে বোঝানোর জন্য কেবল এমন সুউচ্চ পর্যায়ের উপমা পেশ করা যেতে পারে, যা তাঁর শান ও মানের পরিপন্থী নয়; বরং সেই উপমা থেকে বোঝা যাবে যে, খালিক ও মাখলূকের মধ্যে কোনো ধরনের শরীকানা ও সাদৃশ্য সম্ভব নয়। এধরনের সুউচ্চ পর্যায়ের উপমা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ هُوَ الَّذِيْ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهٗ وَ هُوَ اَهْوَنُ عَلَيْهِ وَ لَهُ الْمَثَلُ الْاَعْلٰى فِي السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ.
ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلًا مِّنْ اَنْفُسِكُمْ هَلْ لَّكُمْ مِّنْ مَّا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ مِّنْ شُرَكَآءَ فِيْ مَا رَزَقْنٰكُمْ فَاَنْتُمْ فِيْهِ سَوَآءٌ تَخَافُوْنَهُمْ كَخِيْفَتِكُمْ اَنْفُسَكُمْ كَذٰلِكَ نُفَصِّلُ الْاٰيٰتِ لِقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ.
তিনিই সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টির সূচনা করেন। তারপর তিনিই তাকে পুনর্জীবিত করবেন আর এটা তার জন্য সহজতর। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে তাঁরই জন্য অবধারিত সর্বোচ্চ উপমা। তিনিই ক্ষমতার মালিক, প্রজ্ঞাময়।
তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তোমাদের দাস- দাসীদের মধ্যে কেউ কি তাতে তোমাদের এমন অংশীদার আছে যে, তোমরা ও তারা তাতে সম-মর্যাদার এবং তোমরা তাদেরকে ঠিক সে রকমই ভয় কর, যেমন ভয় করে থাক তোমরা পরস্পরে একে-অন্যকে? যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায়, তাদের জন্য আমি এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বিবৃত করি। -সূরা রূম (৩০) : ২৭-২৮
সুবহানাল্লাহ! উপরোক্ত আয়াতে খালিকের সঙ্গে মাখলূকের এবং প্রকৃত মালিকের সঙ্গে তাঁর বান্দাদের যে কোনো শরীকানা ও সাদৃশ্য নেই- তা বোঝানোর জন্য কত সুন্দর ও সহজ উদাহরণ পেশ করা হয়েছে!
তো আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে কেবল এধরনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উদাহরণ ও উপমা পেশ করা যেতে পারে, যার দ্বারা তাঁর সর্বোচ্চ মহিমা প্রকাশিত হবে এবং মাখলূকের সঙ্গে তাঁর শরীকানা ও সাদৃশ্য সর্বোতভাবে নাকচ হবে। তাই তো المثل الأعلى শব্দের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বলেন- ‘সর্বোচ্চ মাছাল বা উপমা মানে হল-
لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ.
অর্থাৎ তাঁর অনুরূপ বলতে কিছু নেই।
আর বিখ্যাত তাবিয়ী কাতাদাহ রাহ. এই শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন-
مثله أنه لا إله إلا هو، ولا رب غيره.
এখানে তাঁর সর্বোচ্চ মাছাল বা উপমা মানে হল, লা-ইলাহা ইল্লা হু-তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি ছাড়া কোনো রব নেই। -তাফসীরে তবারী ২০/ ৯৪
সাদৃশ্য নফীর বিষয়ে একটি পূর্ণ সূরা
কুরআন কারীমের ছোট্ট সূরা তথা সূরা ইখলাস, যাকে সূরাতুত-তাওহীদও বলা হয়, তাতে মহান আল্লাহর অস্তিত্বের অনন্যতা ও এককত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এবং ব্যাপক অর্থবোধক শব্দে বর্ণিত হয়েছে। এই সূরার শানে নুযুল সম্পর্কে রেওয়ায়েতে যা এসেছে, তার সারকথা হল, কাফির-মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর যাত ও সত্তা সম্পর্কে কিছু কূট প্রশ্ন করেছিল। তারা আল্লাহর পবিত্র সত্তার বর্ণনা জানতে চেয়েছিল, তাঁর বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছিল, নাউযুবিল্লাহ। সেই প্রেক্ষিতে সূরাটি নাযিল হয়। সূরাটি পড়ুন এবং এর প্রতিটি শব্দ সম্পর্কে একটু তাদাব্বুর ও চিন্তাভাবনা করুন।
‘আল্লাহু আহাদ’
‘আল্লাহু আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ এক-অদ্বিতীয় বা পরম একক। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই একত্বের অর্থ কখনোই এটা নয় যে, তিনি নিছক গণনায় ও সংখ্যায় এক, যার আগে শূন্য এবং পরে দুই হতে পারে; বরং উদ্দেশ্য হল, তাঁর কোনো শরীক ও সদৃশ নেই, থাকতে পারে না; না সত্তাগত বিচারে আর না গুণগত বিচারে। তিনি সত্তাগত বিচারে কোনো যৌগ নন; না সমসত্তা বিশিষ্ট যৌগ আর না অসম সত্তাবিশিষ্ট যৌগ। তাঁকে খণ্ডিতরূপে বা যৌগরূপে ধারণা করা কাফির-মুশরিকদের আকীদা। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ هُوَ الْمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ وَ قَالَ الْمَسِيْحُ يٰبَنِيْۤ اِسْرَآءِيْلَ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّيْ وَ رَبَّكُمْ اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَ مَاْوٰىهُ النَّارُ وَ مَا لِلظّٰلِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ .
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ ثَالِثُ ثَلٰثَةٍ ۘ وَ مَا مِنْ اِلٰهٍ اِلَّاۤ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ وَ اِنْ لَّمْ يَنْتَهُوْا عَمَّا يَقُوْلُوْنَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ.
যারা বলে, মারইয়ামের পুত্র মাসীহ্ই আল্লাহ; নিশ্চয়ই তারা কাফির হয়ে গিয়েছে। অথচ মাসীহ বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।
এবং তারাও নিশ্চয় কাফির হয়ে গিয়েছে, যারা বলে, ‘আল্লাহ তিনজনের মধ্যে তৃতীয় জন।’ অথচ এক ইলাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তারা যদি তাদের এ কথা থেকে বিরত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৭২-৭৩
উপরোক্ত দুটি আয়াতে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের প্রতি ইশারা করা হয়েছে। ‘ত্রিত্ববাদ’-এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তিন সত্তা (Persons) অর্থাৎ পিতা, পুত্র (মাসীহ) ও পবিত্র আত্মা (রূহুল কুদস)-এর সমষ্টির নাম। তাদের এক দলের মতে তৃতীয়জন হলেন মারইয়াম আলাইহাস সালাম। তাদের বক্তব্য হল, এই তিনজন মিলে একজন।
তিনের সমষ্টি ‘এক’ কীভাবে? এই হেঁয়ালির কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর কারও কাছে নেই। তাদের ধর্মতত্ত্ববিদগণ বিষয়টাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কেউ বলেছেন, হযরত মাসীহ আলাইহিস সালাম কেবল ঈশ্বর ছিলেন, মানুষ ছিলেন না। ৭২ নং আয়াতে তাদের এ বিশ্বাসকে কুফর সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, ঈশ্বর যেই তিন সত্তার সমষ্টি, তার একজন হলেন পিতা অর্থাৎ আল্লাহ, আর দ্বিতীয়জন পুত্র, যিনি মূলত আল্লাহ তাআলারই একটি গুণ, যা মানব অস্তিত্বে মিশে গিয়ে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। সুতরাং তিনি যেমন মানুষ ছিলেন, তেমনি মৌলিকত্বের দিক থেকে ঈশ্বরও ছিলেন। ৭৩ নং আয়াতে এ বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে।
‘আল্লাহুস-সমাদ’
‘আল্লাহুস-সমাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সর্বোতভাবে পরিপূর্ণ, যার ফলে সকলে তাঁর মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। এই ‘আসসমাদ’ গুণের মধ্যে যেমন সিফাতে কামাল-এর এছবাত রয়েছে, তেমনি মুখাপেক্ষীতার নফী রয়েছে। এই গুণবাচক শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থসমৃদ্ধ এবং গভীর ব্যঞ্জণাময়। সাহাবা, তাবিয়ীন এবং তাবে-তাবিয়ীন থেকে এই গুণের উভয় দিকের ব্যাখ্যা তাফসীর গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যখ্যায় বলেন-
هو السيد الذي قد كمل في سؤدده، والشريف الذي قد كمل في شرفه، والعظيم الذي قد كمل في عظمته، والحليم الذي قد كمل في حلمه، والعليم الذي قد كمل في علمه، والحكيم الذي قد كمل في حكمته. وهو الذي قد كمل في أنواع الشرف والسؤدد، وهو الله سبحانه هذه صفته لا تنبغي إلا له، ليس له كفء وليس كمثله شيء، سبحان الله الواحد القهار.
‘সমাদ’ হলেন এমন সত্তা, যিনি প্রভু ও কর্তা, প্রভুত্বে ও কতৃর্ত্বে যিনি পরিপূর্ণ। এমন মর্যাদাবান, যিনি মর্যাদায় পরিপূর্ণ। এমন মহান, যিনি মহত্বে পরিপূর্ণ। এমন সহনশীল যিনি সহনশীলতায় পরিপূর্ণ। এমন সর্বজ্ঞানী, যিনি সর্বজ্ঞানে পরিপূর্ণ। এমন হিকমতওয়ালা যিনি হিকমতে পরিপূর্ণ। মোটকথা তিনি সবধরনের মহিমা ও মর্যাদায় এবং কতৃর্ত্বে পরিপূর্ণ। তিনিই হলেন আল্লাহ, এসব পূর্ণ গুণাবলি কেবল তাঁরই উপযুক্ত। তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই এবং নেই কোনো সদৃশ। তিনি পবিত্র, এক-অদ্বিতীয় এবং সকলের উপর বিজয়ী ও পরাক্রমশালী। -তাফসীরে ইবনে কাছীর ৮/৪৯৭
এমনিভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-সহ আর অনেক সালাফ থেকে ‘সমাদ’ শব্দের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে- الذي يصمد إليه অর্থাৎ সব প্রয়োজনে এবং সব বিপদে ও সমস্যায় যার শরণাপন্ন হতে হয়।
لَمْ يَلِدوَ لَمْ يُوْلَدْ وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি এবং তাঁর কোনো অনুরূপ নেই।’
লক্ষ করুন, উপরোক্ত দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলার সত্তার তাওহীদ ও একত্ব স্পষ্ট করার জন্য কত ব্যাপক ও বলিষ্ঠ ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।
আয়াতদুটির সারকথা হল, আল্লাহ তাআলার সমতুল্য বা সদৃশ বলতে কিছু নেই এবং তা থাকা কখনো সম্ভবও নয়। আয়াতদুটিতে সবধরনের সাদৃশ্য নফী করা হয়েছ। প্রথমে সমশ্রেণিতা নফী করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
لَمْ يَلِدوَ لَمْ يُوْلَدْ.
‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি।’
এর মাধ্যমে তাঁর সমশ্রেণিতা নফী করা হয়েছে। কারণ আমরা জানি সমশ্রেণিতা রক্ষার উপায় হল প্রজনন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কারও জনক নন এবং তিনিও কারও থেকে জনিত নন। এই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা এমনিতেই সুস্পষ্ট। তবে এর মর্ম বোঝানোর জন্য কোনো কোনো সালাফ আরও ব্যাপক শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন-
(لَمْ يَلِدْ) فيخرجُ منه الولدُ، (وَلَمْ يُولَدْ) فيخرجُ مِنْ شيء.
‘তিনি জন্ম দেননি’ মানে তাঁর থেকে কোনো সন্তান নির্গত হয়নি। তাকে কেউ জন্ম দেয়নি’ মানে তিনি অন্যকিছু থেকে নির্গত হননি।
এভাবে সমশ্রেণিতা নফীর পর অত্যন্ত ব্যাপক শব্দে-
وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
-বলে সব ধরনের সাদৃশ্যকেও নফী করা হয়েছে।
রঈসুল মুফাসসিরীন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-
ليس كمثله شيء، فسبحان الله الواحد القهار.
‘তাঁর অনুরূপ কোনো বস্তু নেই, আল্লাহ পূত-পবিত্র, এক-অদ্বিতীয় এবং পরাক্রমশালী।’
তাবিয়ী আবুল আলিয়া রাহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন-
لم يكن له شبيه، ولا عدل، وليس كمثله شيء.
‘তাঁর কোনো সদৃশ নেই, নেই কোনো সমকক্ষ এবং নেই তাঁর অনুরূপ কোনো বস্তু।’
ইমাম ইবনু জুরাইজ রাহ.-ও এমন ব্যাখ্যাই করেছেন। আর কা‘ব ইবনু মালিক রা. এর ব্যাখ্যায় বলেন-
وإن الله لم يكافئه أحد من خلقه.
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে না তাঁর কোনো সৃষ্টি।’
(পূবোর্ক্ত সবগুলো ব্যাখ্যার জন্য দ্রষ্টব্য : তাফসীরুত তবারী ২৪/৭৩৮, প্রকাশনা : দারু হিজর।)
এখন একটু চিন্তা করে দেখুন-
وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.
অর্থাৎ ‘কেউই তাঁর সদৃশ নয়’- এই ব্যাপক অর্থবোধক নফীর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তাআলার যেমন কোনো সমকক্ষ ও সমশ্রেণী নেই, তেমনি ভিন্ন শ্রেণী থেকেও তাঁর কোনো সদৃশ ও অনুরূপ নেই। এভাবে উপরোক্ত দুই আয়াতে মাখলূকের সঙ্গে আল্লাহ পাকের সবধরনের সাদৃশ্যকে সম্পূর্ণ নফী করা হয়েছে।
এভাবে সূরা ইখলাসে সুসংক্ষিপ্ত ভাষায় আল্লাহ পাকের হাম্দ ও তাসবীহের সুসমন্বয় ঘটেছে। বস্তুত এ দুটি বিষয় একটি আরেকটির সম্পূরক। এ দুটি বিষয়ের তাৎপর্য এবং পারস্পরিক সম্পর্ক খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত আলেম রঈসুল মুহাদ্দিসীন ওয়াল মুতাকাল্লিমীন আল্লামা হুসাইন হালীমী রাহ. (ওফাত : ৪০৩ হি.)। তিনি قُدُّوْسٌ سُبُّوحٌ এ দুটি গুণবাচক নামের ব্যাখ্যায় বলেন-
والتقديس مضمن في صريح التسبيح، والتسبيح مضمن في صريح التقديس، لأن نفي المذام إثبات للمدائح، كقولنا: لا شريك له ولا شبيه له إثبات أنه واحد أحد. وكقولنالا يعجزه شيء إثبات أنه قادر قوي. وكقولنا: إنه لا يظلم أحدا إثبات أنه عدل في حكمه.
وإثبات المدائح له نفي للمذام عنه، كقولنا: إنه عالم نفي للجهل عنه، وقولنا: أنه قادر نفي للعجز عنه ،إلا أن قولنا: هو كذا ظاهره التقديس، وقولنا: ليس بكذا ظاهره التسبيح، لأن التسبيح موجود في ضمن التقديس، والتقديس موجود في ضمن التسبيح، وقد جمع الله تبارك وتعالى بينهما في سورة الإخلاص. فقال عز اسمه: قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ،اَللهُ الصَّمَدُ. فهذا تقديس، ثم قال: لَمْ يَلِدْ وَ لَمْ يُوْلَدْ،وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ. فهذا تسبيح.
والأمران معا راجعان إلى إفراده وتوحيده ونفي الشريك والتشبيه عنه.
অর্থাৎ ‘তাসবীহের মাঝে ‘তাকদীস’ নিহিত থাকে আর ‘তাকদীসে’র মাঝে তাসবীহ। কারণ দোষত্রুটি থেকে পবিত্রতার ঘোষণা (যা ‘তাসবীহ’) পরোক্ষভাবে প্রশংসনীয় গুণে গুণান্বিত হওয়ারই ঘোষণা (যা ‘তাকদীস’)। যেমন আমরা যখন বলি, তাঁর কোনো শরীক ও সমকক্ষ নেই, তখন পরোক্ষভাবে একথাও বলা হয় যে, তিনি এক, একক। যখন আমরা বলি, তাঁকে কোনো কিছু অক্ষম করতে পারে না, তখন পরোক্ষভাবে একথাও সাব্যস্ত করা হয় যে, তিনি সর্বশক্তিমান। যখন বলা হয়, তিনি কারো প্রতি জুলুম করেন না, তখন পরোক্ষভাবে একথাও সাব্যস্ত করা হয় যে, তিনি আদিল ও ইনসাফকারী।
তদ্রূপ প্রশংসনীয় গুণ বর্ণনা পরোক্ষভাবে দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্রতারই ঘোষণা। যেমন আমরা যখন বলি, তিনি জ্ঞানী, তিনি শক্তিমান তখন একথাও বলা হয় যে, তিনি অজ্ঞ নন, অক্ষম নন। তবে সদার্থক বা হাঁ-বাচক বাক্যে বললে বাহ্যত তা হয় ‘তাকদীস’ আর নঞর্থক বা না-বাচক বাক্যে বললে বাহ্যত ‘তাসবীহ’। সূরাতুল ইখলাসে আল্লাহ তাআলা এ দুটো বিষয় একত্র করেছেন :
قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ،اَللهُ الصَّمَدُ
-হচ্ছে তাকদীস। আর-
لَمْ يَلِدْ وَ لَمْ يُوْلَدْ،وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ
-হচ্ছে তাসবীহ। আর দুটো বিষয়ই আল্লাহ তাআলার একত্ব ও এককত্ব এবং শরীক ও সদৃশ হতে পবিত্রতা নির্দেশ করে। -আলমিনহাজ ফী শুয়াবিল ঈমান, হালীমী ১/১৯৭; আলআসমা ওয়াস সিফাত, বায়হাকী, পৃ. ৪৫
(চলবে ইনশাআল্লাহ)