ওরাই আল্লাহর দলভুক্ত ওরাই সফল
সূরা মুজাদালার শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
اُولٰٓىِٕكَ حِزْبُ اللهِ ، اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.
এরা আল্লাহর দল। আর শোনো, নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই সফলকাম।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলার দলের সদস্য যারা, তারা সফল হবেই। আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট জগৎ, যা একমাত্র তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন, তাঁর বান্দারা সেখানে সফল হতে চাইলে তাঁর দলভুক্ত হতেই হবে। উপরোক্ত আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দলের সদস্যদের কিছু পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়-
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُّؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ الْيَوْمِ الْاٰخِرِ يُوَآدُّوْنَ مَنْ حَآدَّ اللٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَوْ كَانُوْۤا اٰبَآءَهُمْ اَوْ اَبْنَآءَهُمْ اَوْ اِخْوَانَهُمْ اَوْ عَشِيْرَتَهُمْ، اُولٰٓىِٕكَ كَتَبَ فِيْ قُلُوْبِهِمُ الْاِيْمَانَ وَ اَيَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ، وَ يُدْخِلُهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَا، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ اُولٰٓىِٕكَ حِزْبُ اللهِ، اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.
আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোনো জাতি তুমি পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি শত্রুতাপোষণকারীদের ভালবাসে, যদিও তারা তাদের বাবা, সন্তান, ভাই কিংবা আত্মীয়স্বজন হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে রূহ দিয়ে তাদের সাহায্য করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমনসব জান্নাতে, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে, তারা তাতে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। শুনে রেখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। -সূরা মুজাদালা (৫৮) : ২২
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলার দলের সদস্যদের মোটা দাগে যে পরিচয় আমরা পাই-
১. তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী
ঈমান হচ্ছে একজন মুমিনের প্রাণ। আল্লাহ তাআলার দলের সদস্যদের জন্য এ ঈমান প্রথম পরিচয়। যে কোনো নেক আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এবং পরকালে এর অফুরন্ত পুরস্কার লাভ করার জন্য ঈমানের বিকল্প নেই। ঈমান ছাড়া কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হয় না। ঈমান আনতে হয় আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতা, নবী-রাসূল, আসমানী কিতাব ও তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি। তবে বিশেষ গুরুত্বের বিবেচনায় বিভিন্ন জায়গায় ঈমান প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কেবল পরকালের কথা বলা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতটিও এমনই, এখানে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ মোটেও এমন নয়- অন্য বিষয়গুলোর প্রতি যদি কারও ঈমান না থাকে, শুধু আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস থাকে, তবেই সে মুক্তি পেয়ে যাতে পারে, সফল মানুষদের দলে সেও অন্তভুর্ক্ত হতে পারে। এমন বিশ্বাস খণ্ডিত বিশ্বাস, আংশিক ঈমান। মুক্তি পেতে হলে, সফল হতে হলে, ঈমানকে পূর্ণ করতে হবে। সবগুলো বিষয়ের প্রতিই পরিপূর্ণ ঈমান রাখতে হবে।
কোনো একটি বিষয়ের কোনো একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রসঙ্গ অস্বীকার করলেও ঈমান হয়ে পড়বে অর্থহীন।
পবিত্র কুরআনের আরেক আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের অভিভাবক-
اَللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا، يُخْرِجُهُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَي النُّوْرِ، وَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْۤا اَوْلِيٰٓـُٔهُمُ الطَّاغُوْتُ، يُخْرِجُوْنَهُمْ مِّنَ النُّوْرِ اِلَي الظُّلُمٰتِ .
আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কাফের, তাদের অভিভাবক তাগুত। এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে বের করে নিয়ে যায়। -সূরা বাকারা (২) : ২৫৭
এ আয়াতে স্পষ্টতই মানুষদের দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে :
এক. মুমিন, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী।
দুই. কাফের।
মুমিনদের অভিভাবক আল্লাহ, তিনি তাদেরকে আলোর পথে, কল্যাণের পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেন। কুফরের অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু গলিপথ থেকে তাদের তিনি বের করে নিয়ে আসেন ঈমানের আলোকোজ্জ্বল রাজপথে। আর নিজেদের অভিভাবক হিসেবে যারা শয়তানকে বেছে নিয়েছে, অর্থাৎ যারা কাফের, তাদেরকে শয়তান অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বিপরীতমুখী এ দুই শিবিরে মানবজাতির এ বিভক্তির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে পবিত্র কুরআনের আরও অনেক আয়াতে। আরেকটি আয়াত লক্ষ করুন-
اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ، وَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ الطَّاغُوْتِ.
যারা মুমিন, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, আর যারা কাফের, তারা শয়তানের পথে লড়াই করে। -সূরা নিসা (৪) : ৭৬
কথা তো দ্ব্যর্থহীন, যারা মুমিন তারা আল্লাহ তাআলার সৈনিক, তারা আল্লাহর দলভুক্ত। তারা তাই আল্লাহর পথে লড়াই করে। আল্লাহ তাআলার মনোনীত দ্বীন সমুন্নত রাখার জন্য তারা লড়াই করে। নিজেদের জান-মাল দিয়ে, নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে লড়াই করে। অস্ত্রের শক্তিতে লড়াই করে, কলমের শক্তিতে লড়াই করে, ভাষার শক্তিতে লড়াই করে, লড়াই করে নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি দিয়েও। এ লড়াই শয়তানের বিরুদ্ধে, শয়তানের দোসর কাফেরদের বিরুদ্ধে। একইভাবে লড়াইয়ের যত মাধ্যম, সবকিছু দিয়ে কাফেররাও লড়াই করে যায়, মুমিনদের বিরুদ্ধে, ঈমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে।
সঙ্গত কারণেই যে মুমিন, যে আল্লাহ তাআলার দলভুক্ত, তাকে লড়াই করতেই হবে। শয়তান তো লড়াই করেই যাচ্ছে। তাই এ লড়াই থেকে পিছু হটার কিংবা নিজে কেবলই দর্শক হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ লড়াই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এ লড়াই নিজেকে আল্লাহ তাআলার দলে টিকিয়ে রাখারও লড়াই।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা নিজেকে কেবল মুমিনদের অভিভাবক হিসেবেই ঘোষণা করেছেন- এমন নয়; বরং মুমিনদেরকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ তাআলার বন্ধু হিসেবে। তিনি ইরশাদ করেছেন-
اَلَاۤ اِنَّ اَوْلِيَآءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَ لَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ، الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَ كَانُوْا يَتَّقُوْنَ.
শুনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, তারা দুঃখিতও হবে না- যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। -সূরা ইউনুস (১০) : ৬২-৬৩
আর কী চাই! আল্লাহ তাআলা মুমিনদের অভিভাবক, সাহায্যকারী, তারা তাঁর পথে লড়াইকারী এবং তাঁর বন্ধুও। আল্লাহ তাআলার দলভুক্তদের এটাই প্রথম পরিচয়- তারা মুমিন, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী।
২. আল্লাহ ও রাসূলের শত্রুদের তারা ভালবাসে না
সূরা মুজাদালার যে আয়াত নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, এখানে আল্লাহ তাআলার দলভুক্তদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে- তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রুদের প্রতি কোনোরূপ ভালবাসা পোষণ করে না। আগুন আর পানি যেমন একত্রিত হতে পারে না, শত্রুতা আর ভালবাসাও তেমনি একসঙ্গে চলতে পারে না। শত্রু তো শত্রুই, তাকে ভালবাসতে হবে কেন? শত্রু যদি এমন হয়, যাকে ভালবাসতে হয়, তবে তার সঙ্গে আবার শত্রুতা কেন? অবশ্য শত্রুতা পোষণ করা মানেই অকল্যাণকামিতা নয়, এমনকি স্বাভাবিক ভদ্রতা-সৌজন্য থেকে তাকে বঞ্চিত করাও নয়।
মুমিন ব্যক্তি কাকে ভালবাসবে, কার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে- এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মুমিন আল্লাহকে ভালবাসবে, আল্লাহ তাআলার প্রিয় রাসূলকে ভালবাসবে, ভালবাসবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বন্ধুদের। বন্ধুর বন্ধু তো নিজেরও বন্ধু। এ মূলনীতি অনুসারে, আল্লাহ তাআলার বন্ধু যারা, তারা প্রতিটি মুমিনেরই বন্ধু। অর্থাৎ মুমিন মুমিনের বন্ধু। মুমিনের বন্ধুত্ব ভালবাসা হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠতা সবই মুমিনদের সঙ্গে। এখানেও দুটি বিষয়-
এক. একজন মুমিন নিজের ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে একজন মুমিনকেই বেছে নেবে, কোনো কাফেরকে নয়। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়টি নির্দেশিত হয়েছে এভাবে-
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لَا يَاْلُوْنَكُمْ خَبَالًا وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْ.
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে (অর্থাৎ কোনো কাফেরকে) অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ো না। ওরা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনোরূপ ত্রুটি করে না। ওরা মনেপ্রাণে কামনা করে- তোমরা কষ্ট ভোগ কর। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১৮
দুই. মুমিন মাত্রই আরেকজন মুমিনের প্রতি ভালবাসা পোষণ করবে। পূর্ব কোনো পরিচয় না থাকলেও একে অন্যের প্রতি আন্তরিকতা লালন করবে। মুমিন মুমিনকে ভালবাসবে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়-
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ.
মুমিনেরা পরস্পর ভাইভাই। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০
মুমিনের প্রতি মুমিনের এ ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের পুরস্কারও অনেক ঈর্ষণীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস-
এক ব্যক্তি যাচ্ছিল এক গ্রামে। সেখানে সে তার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। আল্লাহ তাআলা তার পথে এক ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেশতার কাছ দিয়ে যখন সে যাচ্ছিল তখন ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন :
তুমি কোথায় যাচ্ছ?
সে বলল : আমি এ গ্রামে আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি।
ফেরেশতা জানতে চাইলেন : এ ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজন কি তোমার আছে তার কাছে?
সে উত্তর দিল : না, নেই, তবে আমি তাকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে ভালবাসি।
ফেরেশতা তখন তাকে জানালেন : আমি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তোমার কাছে এসেছি। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এ বার্তাটি পেঁৗছে দেয়ার জন্যে এসেছি- তুমি যেমন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাস, আল্লাহ তাআলাও তোমাকে ভালবাসেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৭
আমরা উপরে বলে এসেছি, সকল মানুষই দুটি ভাগে বিভক্ত- এক. আল্লাহর দল, দুই. শয়তানের দল। যারা শয়তানের দলের অন্তভুর্ক্ত, যারা ওর অনুসারী, তারা কাফের। তাদের সঙ্গে মুমিনদের, তথা আল্লাহর দলের লোকদের শত্রুতা ও বিরোধ পুরোটাই আদর্শকেন্দ্রিক, দ্বীনকেন্দ্রিক। যারা মুমিন, তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তারা আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সকল নবীকেই নবী হিসেবে বিশ্বাস করে, তারা একমাত্র নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তই অনুসরণ করে। আর যারা কাফের, তারা কেউ আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করে, কেউ স্বীকার করলেও তাঁর সঙ্গে আরও শত সহস্র মিথ্যা মাবুদের উপাসনা করে, কেউ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করে। এরা সকলেই আল্লাহ তাআলার শত্রু, তাঁর নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রু। এ শত্রুতা কেবলই দ্বীন নিয়ে। এরা শুরুতেই চেয়েছিল- এ দ্বীনের কণ্ঠ চেপে ধরে এর যাত্রা থামিয়ে দিতে। মনেপ্রাণে চেয়েছিল, দ্বীন ইসলাম যেন কিছুতেই বিজয়ী দ্বীন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তারা চেয়েছিল আল্লাহর নূর তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে। তাদের শত্রুতার এ ধারা বন্ধ হয়নি কখনো। বরং নানা রকমের কুফুরি শক্তি একত্রিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামের সঙ্গে শত্রুতায় তারা যে এক ও অভিন্ন- এটা এখনকার আধুনিক পৃথিবীরও এক বাস্তবতা। তাই যারা আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করে, তারা তেত্রিশ কোটি দেবতাকে যেমন ভালবাসতে পারে না, ভালবাসতে পারে না এসব দেবতার পূজারীদেরকেও। একত্ববাদের আলোয় যারা আলোকিত, তারা যেমন মেনে নিতে পারে না ত্রিত্ববাদের অন্ধকার, তেমনি ভালবাসতে পারে না ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসীদেরও। মুমিনের ভালবাসা পাবে মুমিনই। পূর্ব পরিচয় কিংবা দুনিয়ার কোনো স্বার্থ এখানে মুখ্য নয়। ঈমানই এ ভালবাসার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ঈমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয় মুমিনের ভালবাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ أَحَبَّ لِلهِ وَأَبْغَضَ لِلهِ وَأَعْطَى لِلهِ وَمَنَعَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ.
যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করে, আল্লাহর জন্য দান করে, আল্লাহর জন্য দান থেকে বিরত থাকে, তার ঈমান পরিপূর্ণ হয়েছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৮৩
আমাদের আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধাচরণকারী কেউ বাবা-ছেলে-ভাই কিংবা আত্মীয় যে-ই হোক না কেন, তাদেরকে মুমিনেরা ভালবাসতে পারে না। কুরআন নাযিলের সময়গুলোতেই এ শিক্ষা বাস্তবায়িত হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের জীবনাচারে। আবু বকর রা. বদরের যুদ্ধের দিন নিজ ছেলে আবদুর রহমানকে তার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আবদুর রহমান তখনো কাফের ছিলেন, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এ বদরের যুদ্ধেই মুসআব ইবনে উমায়ের রা. হত্যা করেছিলেন স্বীয় ভাই উবায়েদ ইবনে উমায়েরকে।
উমর ইবনে খাত্তাব রা. হত্যা করেছিলেন নিজের মামা আস ইবনে হিশামকে।
আলী রা. ও হামযা রা. হত্যা করেছিলেন স্বীয় গোত্রীয় উতবা শায়বা ও ওলীদকে।
মুমিনকে এমনই হতে হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে যারা ভালবাসে না, সেও তাদের ভালবাসতে পারে না। তাদের সঙ্গে বন্ধন যত ঘনিষ্ঠই হোক না কেন, দ্বীনকেন্দ্রিক এ শত্রুতা তাদের সঙ্গে পোষণ করতেই হবে। এ শত্রুতা যদি যুদ্ধে পর্যবসিত হয়, তবে সেখানেও তাদেরকে ছেড়ে কথা বলার সুযোগ মুমিনের সামনে নেই। এটাই আল্লাহর দলভুক্তদের দ্বিতীয় পরিচয়।
৩. ঈমান তাদের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে আছে
আল্লাহর দলভুক্তদের তৃতীয় পরিচয় বলা হয়েছে- তিনি তাদের অন্তরে ঈমানকে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। পাথরে খোদাই করে কিছু লেখা হলে তা যেমন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায় না, চাইলেই কেউ মুছে দিতে পারে না সে লেখা, তাদের অন্তরের ঈমানের অবস্থাও অনুরূপ। ঈমান তাদের অন্তরে এতটাই সুদৃঢ় হয়ে আছে, যত ঝড়ঝাপটাই আসুক, এ ঈমানে কোনো চিড় ধরবে না। তাদের অন্তর থেকে মুছে যাবে না খোদাই করা এ ঈমান। এ ঈমানের বলে বলীয়ান হয়েই তারা যুদ্ধের মাঠে বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতেও পিছপা হয় না, প্রাণপ্রিয় সন্তানকেও তারা যুদ্ধের মাঠে ছেড়ে কথা বলে না। এ ঈমানের শক্তিতেই তারা পেরিয়ে যায় নেক আমলের একেকটি ধাপ। এ ঈমান তাদের জন্য সহজ করে দেয় ইবাদতের সকল পথ।
আমরা যারা নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পরিচয় দিই, এ পরিচয়ের ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদেরকে আল্লাহ তাআলার দলভুক্ত দাবি করে থাকি। মুমিন যে, সে তো আল্লাহর দলভুক্ত হবেই। কিন্তু এ দলের সদস্যদের যে বৈশিষ্ট্য তা কি আমরা পুরোপুরি ধারণ করতে পেরেছি? এর উত্তর শুনতে হবে নিজের কাছ থেকেই। উত্তর যদি ইতিবাচক না হয়, তবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এসব বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করার সংগ্রামে। এ সংগ্রাম শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আল্লাহ তাআলার প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, তাঁর দ্বীনের প্রতি এবং দ্বীনদারদের প্রতি লালন করতে হবে অকৃত্রিম ভালবাসা। আল্লাহ তাআলার দলভুক্ত নিজেকে করতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।