১৩ যিলহজ্ব আইয়ামে বীযের বা অন্য কোনো রোযা রাখা কি জায়েয?
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন : আমরা জানি, প্রতি মাসে আইয়ামে বীযের রোযা রাখা অনেক ফযীলতপূর্ণ আমল। আর এর তারিখ হচ্ছে, প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। যা হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, যিলহজ্ব মাসে তা আদায়ের পদ্ধতি কী হবে? কারণ, হাদীস শরীফে তো আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। আর যিলহজ্বের ১৩ তারিখ যদি আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত হয় তাহলে অন্যান্য মাসের ন্যায় এই মাসের ১৩ তারিখ আইয়ামে বীযের রোযা রাখবে কীভাবে?
এক্ষেত্রে কেউ কেউ দাবি করেছেন, যিলহজ্বের ১৩ তারিখ আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত নয়। হাদীসের কোথাও নাকি সুস্পষ্টভাব যিলহজ্বের ১৩ তারিখ আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত হওয়া এবং এই দিন রোযা রাখা নিষেধ হওয়ার কথা আসেনি। ১৩ যিলহজ্ব রোযা রাখা নাজায়েয হওয়ার সপক্ষে যেসব হাদীস উল্লেখ করা হয়, সেগুলোর কোথাও নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১৩ তারিখের কথা উল্লেখ নেই। তাই তাদের দাবি হল, আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা নাজায়েয হলেও যিলহজ্বের ১৩ তারিখ এই নিষেধাজ্ঞার অন্তভুর্ক্ত নয়; বরং ১২ তারিখেই আইয়ামে তাশরীক শেষ। তাই তার মতে যিলহজ্বের ১৩ তারিখ আইয়ামে বীযের রোযা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই।
মোটকথা, এক্ষেত্রে তাদের দাবি হল, যিলহজ্বের ১৩ তারিখ আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত হওয়ার সুস্পষ্ট কোনো দলীল নেই। তাই এই দিন রোযা রাখা নিষেধ নয়। এখন আমাদের জানার বিষয় হল, এই কথা কি ঠিক? যিলহজ্বের ১৩ তারিখ আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত হওয়া এবং এইদিন রোযা রাখা নাজায়েয হওয়ার বিষয়ে কি বাস্তাবেই কোনো দলীল নেই? যদি এইদিন রোযা রাখা নাজায়েযই হয়, তাহলে যিলহজ্ব মাসে আইয়ামে বীযের রোযা রাখার পদ্ধতি কী হবে? অনুগ্রহপূর্বক প্রশ্নগুলোর সমাধান কুরআন-সুন্নাহর দলীলসহ জানিয়ে বাধিত করবেন।
নিবেদক
আরিফ আহমাদ, ঢাকা
উত্তর :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد :
‘আইয়ামে তাশরীক’ একটি পরিভাষা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য, ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্ব। এই তিন দিন রোযা রাখা নাজায়েয- এই উভয় বিষয়ই সুস্পষ্ট হাদীস এবং সকল মাযহাবের মুজতাহিদ ইমাম, ফকীহ ও উলামায়ে উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। কোনো যুগের কোনো মুজতাহিদ ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস কারো থেকেই ভিন্ন কথা নেই। তাদের কারো থেকেই ১৩ যিলহজ্ব আইয়ামে বীযের বা অন্য কোনো রোযা রাখা জায়েয হওয়ার কথা নেই। সাহাবা-তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন থেকে নিয়ে বর্তমান যুগ পর্যন্ত উলামায়ে উম্মতের কারো থেকেই একথা নেই যে, যিলহজ্বের ১১, ১২ তারিখ রোযা রাখা নাজায়েয, আর ১৩ তারিখ রাখা জায়েয। এর পক্ষে শরীয়তের কোনো দলীলও নেই। তাই এটি শরীয়তের দলীল বিরোধী নিতান্তই ভুল কথা।
১৩ যিলহজ্ব আইয়ামে তাশরীকের অন্তভুর্ক্ত হওয়ার দলীল
আইয়ামে তাশরীকের অপর নাম ‘আইয়ামে মিনা’। এই মাসআলাতেও হাদীস শরীফের কোনো কোনো বর্ণনায় ‘আইয়ামে তাশরীক’-এর পরিবর্তে ‘আইয়ামে মিনা’ শব্দ এসেছে। ‘আইয়ামে মিনা’-এর শেষ দিন হচ্ছে ১৩ যিলহজ্ব। এটি কুরআন-হাদীস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَاذْكُرُوا اللهَ فِیْۤ اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِیْ یَوْمَیْنِ فَلَاۤ اِثْمَ عَلَیْهِ وَ مَنْ تَاَخَّرَ فَلَاۤ اِثْمَ عَلَیْهِ لِمَنِ اتَّقٰی.
তোমরা (মিনায়) নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আল্লাহকে স্মরণ কর। অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি চলে যাবে- দুই দিনের মধ্যেই, তার কোনো গুনাহ নেই; এবং যে (এক দিন) দেরিতে যাবে তারও কোনো গুনাহ নেই। (এ বিধান) তার জন্য, যে আল্লাহকে ভয় করে। -সূরা বাক্বারা (০২) : ২০৩
এই আয়াতে হজ্বের সময় মিনায় ‘রমি’ (কঙ্কর নিক্ষেপ) করার বিধান দেওয়া হয়েছে এবং এর শেষের দিন মিনায় রমি করাকে ঐচ্ছিক করা হয়েছে। আর মিনায় রমির শেষের সেই ঐচ্ছিক দিনটি হচ্ছে যিলহজ্বের ১৩ তারিখ। ১২ যিলহজ্ব রমির শেষ দিনও নয় এবং সেই দিন রমি করা ঐচ্ছিকও নয়। এটি প্রসিদ্ধ ও মুজমা আলাইহি মাসআলা।
এই আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন-
ولا خلاف بين العلماء أن الأيام المعدودات في هذه الآية هي أيام منى، وهي أيام التشريق، وأن هذه الثلاثة الأسماء واقعة عليها، وهي أيام رمي الجمار، وهي واقعة على الثلاثة الأيام التي يتعجل الحاج منها في يومين بعد يوم النحر، فقف على ذلك.
উলামায়ে উম্মতের এ ব্যাপারে কোনো ইখতিলাফ নেই যে, এই আয়াতে বর্ণিত ‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ হচ্ছে ‘আইয়ামে মিনা’, আর তা-ই ‘আইয়ামে তাশরীক। এই তিনটি নাম দ্বারা এই দিনগুলোই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এই দিনগুলো কঙ্কর নিক্ষেপের দিন। আর তা হচ্ছে ‘ইয়াউমুন নাহর’ (১০ যিলহজ্ব)-এর পরের তিন দিন, যার তৃতীয় দিন থাকা ঐচ্ছিক হওয়ার কারণে হাজ্বীগণ তাড়াতাড়ি করতে চাইলে এর দ্বিতীয় দিনই চলে যান। (তাফসীরে কুরতুবী; আলজামে লিআহকামিল কুরআন ৩/১)
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. এই আয়াতের তাফসীরে আইয়ামে মা‘দূদাত ও আইয়ামে তাশরীক নিয়ে আলোচনার শেষে বলেছেন-
وعليه دل ظاهر الآية الكريمة حيث قال فمن تعجل في يومين فلا إثم عليه ومن تأخر فلا إثم عليه فدل على ثلاثة بعد النحر.
এখানে তিনি বলেছেন, আইয়ামে মা‘দূদাত ও আইয়ামে তাশরীক যে ইয়াউমুন নাহরের পরের তিন দিন এই আয়াত এর পরিষ্কার দলীল। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪১৮
আরও দেখুন : আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ৭/৪৯০
‘আইয়ামে মিনা’ যে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিনেরই অপর নাম এবং এর তৃতীয় দিন হচ্ছে ১৩ যিলহজ্ব- এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَيَّامُ مِنًى ثَلَاثَةُ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ،فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إثْمَ عَلَيْهِ، وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إثْمَ عَلَيْهِ.
অর্থাৎ ‘আইয়ামে মিনা’ হচ্ছে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। কেউ দুই দিন (মিনায়) অবস্থান করে চলে যেতে চাইলে তাতে কোনো দোষ নেই, আর তৃতীয় দিন পর্যন্ত বিলম্ব করতে চাইলেও কোনো দোষ নেই। -শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস ৩৩৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৮৮৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯৪৯
এই হাদীসেও এসেছে, আইয়ামে মিনা হচ্ছে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। যার তৃতীয় দিন মিনায় থেকে রমি করা ঐচ্ছিক, আর সেই দিনটি যিলহজ্বের ১৩ তারিখ, ১২ তারিখ কিছুতেই নয়। কারণ, যিলহজ্বের ১২ তারিখ রমির শেষ দিনও নয় এবং সেই দিন রমি করা ঐচ্ছিকও নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন-
الأيام المعدودات أيام التشريق، وهي ثلاثة أيام بعد النحر.
(কুরআনুল কারীমে বর্ণিত) ‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ হচ্ছে আইয়ামে তাশরীক, আর তা ‘ইয়াউমুন নাহর’ (১০ যিলহজ্ব)-এর পরের তিন দিন। -তাফসীরে তাবারী ৪/২০৮
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-
والمعدودات أيام منى، ثلاثة أيام بعد النحر.
‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ হচ্ছে ‘আইয়ামে মিনা’। আর তা ‘ইয়াউমুন নাহর’ (১০ যিলহজ্ব)-এর পরের তিন দিন। -আহকামুল কুরআন, তহাবী ২/২০২
চার মাযহাবের ইমাম ও ফকীহগণের নিকটও এটি স্বীকৃত বিষয়। এতে তাদের কারো মতানৈক্য নেই।
ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন-
الأيام المعدودات أيام التشريق، وهى ثلاثة أيام بعد يوم النحر.
অর্থাৎ ‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ হচ্ছে আইয়ামে তাশরীক, আর তা ‘ইয়াউমুন নাহর’ (১০ যিলহজ্ব)-এর পরের তিন দিন। -আননাওয়াদির ওয়ায যিয়াদাত ৪/৩১৩
ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন-
الأيام المعدودات أيام منى، ثلاثة بعد يوم النحر، وهي أيام التشريق.
‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ হচ্ছে আইয়ামে মিনা-‘ইয়াউমুন নাহর’ (১০ যিলহজ্ব)-এর পরের তিন দিন। আর তা-ই আইয়ামে তাশরীক। -মা‘রিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার ৭/৫১০
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেন-
وأيام التشريق ثلاثة أيام بعد يوم النحر.
আইয়ামে তাশরীক ‘ইয়াউমুন নাহর’-এর পরের তিন দিন। -মাসাইলুল ইমাম আহমাদ, রেওয়ায়েত : আবদুল্লাহ, পৃ. ১৩০
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহ. বলেন-
ولم يختلف أهل العلم أن أيام منى ثلاثة بعد يوم النحر.
আহলে ইলমগণের এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই যে, আইয়ামে মিনা ইয়াউমুন নাহরের পরের তিন দিন। -আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ১/৩৮৩
আরো দেখুন : মুআত্তা ইমাম মুহাম্মাদ, বর্ণনা ৪৯৮; আলমাবসূত, সারাখসী ৪/২৪, ১২/৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৫৯; আলহিদায়াহ, মারগিনানী ৪/৩৫৭
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন-
ولا خلاف بين العلماء أن أيام التشريق هي الأيام المعدودات، وهي أيام منى، وهي ثلاثة أيام بعد يوم النحر، كل هذه الأسماء واقعة على هذه الأيام، ولم يختلفوا في ذلك.
অর্থাৎ আইয়ামে তাশরীকই ‘আইয়ামে মা‘দূদাত’ এবং এরই নাম ‘আইয়ামে মিনা’, আর তা ‘ইয়াউমুন নাহর’-এর পর তিন দিন। এই প্রত্যেকটিই এই দিনগুলোর নাম। এ ব্যাপারে উলামায়ে উম্মতের কারো ইখতিলাফ নেই। -আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার, ১২/১২৯
এই ইজমা-এর উদ্ধৃতির জন্য আরও দেখুন : বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২/২০০; ইখতিলাফুল আইম্মাতিল উলামা ১/৫২১; তাফসীরে ইবনে রজব ১/১৫৮; আলইকনা ‘ফী মাসাইলিল ইজমা’ ১/২৭৫; নুখাবুল আফকার ৯/৫১৫
মোটকথা, ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’-এর শেষ দিন হচ্ছে ১৩ যিলহজ্ব। এটি সবার নিকট স্বীকৃত ও ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলা; কারো এতে ইখতিলাফ নেই। সর্বত্র ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’ বলে যিলহজ্বের ১৩ পর্যন্ত উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। ১৩ তারিখ এর অন্তভুর্ক্ত না হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’ বলা মানেই হচ্ছে যিলহজ্বের ১১ থেকে ১৩ তারিখ।
আর হাদীস শরীফের ইরশাদ অনুযায়ী ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’-এর তিন দিন রোযা রাখা নিষেধ। এ ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কা‘ব ইবনে মালিক রা. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে-
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَهُ وَأَوْسَ بْنَ الْحَدَثَانِ أَيَّامَ التَّشْرِيقِ، فَنَادَى : أَنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا مُؤْمِنٌ، وَأَيَّامُ مِنًى أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘ব ইবনে মালিক ও আউস ইবনে হাদাসান রা.-কে আইয়ামে তাশরীকের সময় পাঠালেন এবং বলে দিলেন তোমরা ঘোষণা করে দাও যে, মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং আইয়ামে মিনা পানাহারের দিন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৪২
আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَيَّامُ التَّشْرِيقِ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ.
আইয়ামে তাশরীক পানাহারের দিন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৪১
এই দুই বর্ণনা থেকে পরিষ্কার, যে দিনগুলোর নাম আইয়ামে মিনা সে দিনগুলোরই অপর নাম আইয়ামে তাশরীক এবং সেই দিনগুলো পানাহার করার দিন; রোযা রাখার দিন নয়।
আরেক বর্ণনায় আরও পরিষ্কারভাবে এসেছে, মুত্তালিব ইবনে আবদুল্লাহ রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন-
سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْهَى عَنْ صِيَامِ هَذِهِ الْأَيَّامِ الثَّلَاثَةِ يَعْنِي أَيَّامَ التَّشْرِيقِ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই তিন দিন অর্থাৎ আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখতে নিষেধ করতে শুনেছি। -আলমুনতাখাব মিন মুসনাদি আবদ ইবনি হুমাইদ, হাদীস ৮৩০
এমন আরও বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, যাতে আইয়ামে তাশরীক, আইয়ামে মিনা-এর তিন দিন রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। এর বিপরীত এমন একটি হাদীসও নেই, যাতে ১৩ যিলহজ্ব রোযা রাখা জায়েয বলা হয়েছে।
১৩ যিলহজ্ব রোযা রাখা নাজায়েয হওয়া বিষয়ে সব যুগরে উলামায়ে উম্মতের ইজমার প্রমাণ
এসব বর্ণনার ভিত্তিতে সব মাযহাবের মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখখিরীন সকল মুজতাহিদ ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস বলেছেন, কুরবানী ঈদের দিন যেমন নফল রোযা রাখা নাজায়েয, এর পরের তিন দিনও নফল রোযা রাখা নিষেধ। এক্ষেত্রে ১৩ যিলহজ্বের হুকুম আগের দুই দিন থেকে ভিন্ন নয়। এব্যাপারে তাদের কারো দ্বিমত নেই। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন-
لا أعلم أحدا من أهل العلم فرق بين اليومين الأولين من أيام التشريق في الصيام خاصة وفي اليوم الثالث منها. وجمهور العلماء من أهل الرأي والأثر لا يجيزون صوم اليوم الثالث من أيام التشريق، في قضاء رمضان، ولا في نذر، ولا في غير ذلك من وجوه الصيام، إلا المتمتع وحده، فإنهم اختلفوا في ذلك على ما نذكره عنهم في بابه في آخر هذا الكتاب إن شاء الله.
আহলে ইলমের কারো থেকে আমার জানা নেই যে, তাদের কেউ রোযার মাসআলার ক্ষেত্রে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিনের মাঝে প্রথম দুই দিন থেকে তৃতীয় দিনের হুকুম ভিন্ন বলেছেন। ফকীহ ও মুহাদ্দিস সকল শ্রেণীর উলামায়ে উম্মতের মতে আইয়ামে তাশরীকের তৃতীয় দিন রোযা রাখা নাজায়েয। চাই তা রমযানের কাযা রোযা হোক, কিংবা মান্নতের রোযা হোক, অথবা অন্য কোনো প্রকারের রোযা হোক। হাঁ, এক্ষেত্রে শুধু তামাত্তু হজ্বকারীর রোযার (যদি দমে শোকর আদায়ের সামর্থ্য না থাকে তাহলে এর পরিবর্তে যে রোযা রাখবে এর) ক্ষেত্রে একটি ইখতিলাফ আছে। -আলইসতিযকার ৪/২৩৮
তিনি আরও বলেছেন-
ولم يختلفوا فيما ذكرت لك، لنهي رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صيام أيام منى، وعن صيام أيام التشريق، وهي أيام منى، وأقل ما يقع عليه أيام ثلاثة، وليس في حديث ذكر صيام أيام الذبح، إنما ذلك النهي عن صيام أيام التشريق.
অর্থাৎ এই বিষয়ে উলামায়ে উম্মতের ইখতিলাফ না থাকার কারণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়ামে মিনা ও আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কোনো হাদীসে ‘আইয়ামে যাবহ’ (কুরবানীর দিনগুলো)-এর রোযার কথা আসেনি; বরং হাদীসে এসেছে, আইয়ামে তাশরীকে রোযা না রাখার কথা। -আততামহীদ ৭/৪৯৭
এখানে ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ.-এর এই বক্তব্যটির শেষের কথাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, ঈদুল আযহার সময় রোযা রাখতে নিষেধ করার ক্ষেত্রে কোনো হাদীসে ‘আইয়ামে যাবহ’ (কুরবানীর দিনগুলো)-এর কথা আসেনি। যদি ‘আইয়ামে যাবহ’ (কুরবানীর দিনগুলো)-এর শিরোনামে নিষেধাজ্ঞাটা আসত তাহলে এর দ্বারা উদ্দেশ্য ১০, ১১ ও ১২ যিলহজ্ব হত। কিন্তু এক্ষেত্রে হাদীস শরীফে এসেছে, আইয়ামে তাশরীকের কথা; আইয়ামে মিনার কথা। সুতরাং রোযা না রাখার এই বিধানকে কুরবানীর দিনগুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ করলে তা হবে মনগড়া কথা।
এখানে উল্লেখ্য, তামাত্তু হজ্বকারী দমে শোকরের পরিবর্তে যে রোযা রাখে তা আইয়ামে তাশরীকে রাখা জায়েয হওয়ার মতটি শুধু ইমাম মালেক রাহ.-এর। কিন্তু আইয়ামে তাশরীকের এই তিন দিনে অন্য কোনো রোযা রাখা ইমাম মালেক রাহ.-এর মতেও নাজায়েয। তামাত্তু হজ্বকারীর ক্ষেত্রে ইমাম মালেকের উক্ত মতটি ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. খণ্ডন করে বলেছেন-
وقال أهل المدينة أعجب من هذا، زعموا أنه يقضي ذلك في أيام التشريق، وهذه أيام نهى رسول الله‘صلى الله عليه وسلم عن صومها، بحديث معروف، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم بعث غير واحد، فيهم عبد الله بن حذافة السهمي رضي الله عنه، ينادي في الناس أيام منى أنها أيام أكل وشرب وذكر الله، يعني أيام منى، أخبرنا الربيع بن صبيح، عن يزيد الرقاشي، عن أنس بن مالك رضي الله عنه، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى عن صوم خمسة أيام : يوم الفطر ويوم النحر وأيام التشريق، فكيف يصام ما نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صومه؟
এখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, রোযার ঈদের দিন ও ইয়াউমুন নাহর তথা কুরবানী ঈদের দিন এবং ইয়াউমুন নাহরের পরবতীর্ আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন, মোট এই পাঁচ দিন কোনো ধরনের রোযা রাখাই জায়েয নয়। এর সপক্ষে তিনি প্রথমতঃ আইয়ামে মিনার হাদীস উল্লেখ করেছেন। তারপর উল্লেখ করেছেন আনাস রা. থেকে বর্ণিত এই হাদীস-
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صوم خمسة أيام : يوم الفطر، ويوم النحر، وأيام التشريق.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। রোযার ঈদের দিন ও ‘ইয়াউমুন নাহর’ তথা কুরবানী ঈদের দিন এবং (ইয়াউমুন নাহরের পরবতীর্) আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন। -কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/৩৮৭
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবু বকর জাস্সার রাহ. বলেছেন-
ولم يختلفوا أنه لا يصوم يوم النحر، فكذلك أيام التشريق؛ لأن النهي قد ورد في الجميع.
ইয়াউমুন নাহর ও আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা যাবে না- এ ব্যাপারে কারো ইখতিলাফ নেই। কেননা, নিষেধাজ্ঞা এই সব দিনগুলোর ব্যাপারেই এসেছে। -শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৫৪৬
এই বিষয়ে চার মাযহাবেরই বক্তব্য জানার জন্য আরও দেখুন-
হানাফী মাযহাব : মুআত্তা ইমাম মুহাম্মাদ, বর্ণনা ৩৭১; কিতাবুল আছল ২/২৯৪; মিনহাতুস সুলূক, পৃ. ২৭৭; জামেউর রুমূয ১/৩৭২
মালেকী মাযহাব : আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/২৮৪; আররিসালাহ, কায়রাওয়ানী, পৃ. ৬০; মাওয়াহিবুল জালীল ২/৪৫৩; আলমুনতাকা ২/৫৯
শাফেয়ী মাযহাব : আলউম্ম ২/২০৭; আলমাজমূ ৬/৪৪২; কিফায়াতুন নাবীহ, ইবনুর রিফআ ৬/৪১৫
হাম্বলী মাযহাব : আলমুগনী ৩/১৬৯; আলইনসাফ, মারদাবী ৩/২৭৯; কাশশাফুল কিনা‘ ২/৩৪২
আর এটি কেবল চার মাযহাবের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণেরই বক্তব্য নয়; যাহেরী, গাইরে মুকাল্লিদ ও সালাফী, সব মাসলাকের উলামায়ে কেরামেরই মত এটি। সবার মতেই ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’ ইয়াউমুন নাহরের পরের তিন দিন, অর্থাৎ ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্ব এবং এই তিন দিন রোযা রাখা নাজায়েয।
ইবনে হাযম রাহ. বলেছেন-
ولا يجوز صيام أيام التشريق، وهي ثلاثة أيام بعد يوم الأضحى.
আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা জায়েয নয়, আর সেই দিনগুলো হচ্ছে কুরবানী ঈদের পরের তিন দিন। -আলমুহাল্লা ৪/৪৫১
ইবনে হাযম রাহ. অন্যত্র আরও বলেছেন-
وأجمعوا أن من تطوع بصيام يوم واحد، ولم يكن يوم الشك، ولا اليوم الذي بعد النصف من شعبان، ولا يوم جمعة ولا أيام التشريق، الثلاثة بعد يوم النحر، فإنه مأجور.
এখানে তিনি ইয়াউমুন নাহরের পরবতীর্ আইয়ামে তাশরীকের তিন দিনই রোযা রাখা যায় না- এ ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন। -মারাতিবুল ইজমা, পৃ. ৪০
শাওকানী রাহ. বলেছেন-
قوله: (أيام منى ثلاثة أيام) وهي الأيام المعدودات، وأيام التشريق، وأيام رمي الجمار، وهي الثلاثة التي بعد يوم النحر، وليس يوم النحر منها.
অর্থাৎ হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আইয়ামে মিনা’ তিন দিন। শাওকানী রাহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, এই তিন দিনই হচ্ছে ‘আইয়ামে মা‘দূদাত’, ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপের দিন। আর এই তিন দিন হচ্ছে ইয়াউমুন নাহরের পরের তিন দিন। ‘ইয়াউমুন নাহর’ এই তিন দিনের অন্তভুর্ক্ত নয়। -নাইলুল আওতার ৫/৭২
একই কথা বলেছেন : মুহাম্মাদ আবদুর রাহমান মুবারকপুরী রাহ. তুহফাতুল আহওয়াযীতে ৩/৫৪০, ৮/২৫৩; উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী রাহ. মিরআতুল মাফাতীহে ৯/৪৫৩; আযীম আবাদী রাহ. আওনুল মা‘বূদে ৫/২৯৭
আরবের প্রসিদ্ধ সালাফী আলেম সায়্যিদ সাবেক রাহ. বলেন-
النهي عن صوم أيام التشريق: لا يجوز صيام الأيام الثلاثة، التي تلي عيد النحر. لما رواه أبو هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم بعث عبد الله بن حذافة يطوف في منى: أن لا تصوموا هذه الأيام، فإنها أيام أكل وشرب وذكر الله عزوجل. رواه أحمد بإسناد جيد.
وروى الطبراني في الأوسط، عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم أرسل صائحا يصيح: أن لا تصوموا هذه الأيام فإنها أيام أكل، وشرب، وبعال.
এখানে তিনি আইয়ামে তাশরীকের রোযা নিষেধের হাদীসগুলো উল্লেখ করে এর ভিত্তিতে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, কুরবানী ঈদের পরের তিন দিন রোযা রাখা নাজায়েয। -ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪৪৫
শায়েখ বিন বায রাহ. বলেন-
س: إذا وافق صيام أيام البيض أيام التشريق، فهل يجوز الصيام أم لا؟
ج: لا يجوز صيام اليوم الثالث عشر من ذي الحجة لا تطوعا ولا فرضا؛ لأنها أيام أكل وشرب وذكر الله عز وجل، وقد نهى النبي صلى الله عليه وسلم عن صيامها.
এখানেও তাঁকে আইয়ামে তাশরীকে আইয়ামে বীযের রোযা রাখার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে। উত্তরে তিনি বলেছেন, যিলহজ্বের ১৩ তারিখ নফল-ফরয কোনো প্রকারের রোযা রাখা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। -মাজমূউ ফাতাওয়া বিন বায ১৫/৩৮১
আরবের আরেক প্রসিদ্ধ সালাফী আলেম শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আলউসাইমীন রাহ.। তিনিও স্পষ্ট ভাষায় কুরবানী ঈদের পরের তিন দিন রোযা রাখা নিষেধ হওয়ার কথা বলেছেন এবং দলীল হিসেবে আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা নিষেধ হওয়ার হাদীসগুলোই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন-
أيام التشريق هي الأيام الثلاثة التي بعد عيد الأضحى، وسميت بأيام التشريق، لأن الناس يشرقون فيها اللحم أي ينشرونه في الشمس، لييبس حتى لا يتعفن إذا ادخروه، وهذه الأيام الثلاثة قال فيها رسول الله صلى الله عليه وسلم: أيام التشريق أيام أكل وشرب وذكر اللهِ عز وجل.
দেখুন : মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিল উসাইমীন ২০/৬০
এই হচ্ছে এই মাসআলায় সব যুগের উলামায়ে উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
আইয়ামে বীযের রোযা প্রসঙ্গ
এখন বাকি থাকল আইয়ামে বীযের রোযার প্রসঙ্গ। হাদীস শরীফে প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার কথা এসেছে। কিন্তু যিলহজ্বের ১৩ তারিখ রোযা রাখা নিষেধ হলে সেই মাসে উক্ত হাদীস অনুযায়ী পুরোপুরি আমল হচ্ছে না- এর কী সমাধান? এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল, এ বিষয়ে হাদীসের বর্ণনাও বিভিন্ন রকম এবং উলামায়ে উম্মতের মাঝেও অনেক মতানৈক্য রয়েছে যে, সেই তিন দিন কোন্ কোন্ দিন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণিত হাদীসে প্রতি মাসের যে কোনো তিন রোযা রাখার কথা এসেছে। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরাইরা রা. বলেন-
أَوْصَانِي خَلِيلِي بِثَلاَثٍ: صِيَامِ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيِ الضُّحَى، وَأَنْ أُوتِرَ قَبْلَ أَنْ أَنَامَ.
আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি আমলের ওসিয়ত করেছেন। প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতে, দুই রাকাত সালাতুদ দুহা আদায় করতে এবং বিতিরের নামায আদায় করে ঘুমাতে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৭১
এই হাদীসে দিন-তারিখ নির্ধারণ করা ছাড়া শুধু প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতে বলা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে আরও পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে, মুআযাহ আলআদাবিয়্যাহ রাহ. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞেস করেন-
أَكَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَصُومُ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ؟ قَالَتْ: نَعَمْ، فَقُلْتُ لَهَا: مِنْ أَيِّ أَيَّامِ الشَّهْرِ كَانَ يَصُومُ؟ قَالَتْ: لَمْ يَكُنْ يُبَالِي مِنْ أَيِّ أَيَّامِ الشَّهْرِ يَصُومُ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন?
উত্তরে আয়েশা রা. বলেন, হাঁ।
তিনি আবার প্রশ্ন করেন, মাসের কোন্ কোন্ দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখতেন?
উত্তরে আয়েশা রা. বলেন, তিনি মাসের যে কোনো তিন দিন রোযা রাখতেন (অর্থাৎ তারিখ নির্ধারিত ছিল না)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬০
অবশ্য এ সংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসে নিধার্রিত দিন-তারিখের কথাও এসেছে। তবে সেক্ষেত্রেও হাদীসের বর্ণনায় বিভিন্নতা রয়েছে। জামে তিরমিযীসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের বর্ণনা থাকলেও এক্ষেত্রে শুধু এটিই একমাত্র বর্ণনা নয়। এক্ষেত্রে হাদীস শরীফে অন্যান্য দিনের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন, এক বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ مِنْ غُرَّةِ كُلِّ شَهْرٍ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসের শুরুতে তিন দিন রোযা রাখতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪২
হাদীসের বর্ণনার এই ভিন্নতাগুলোর কারণে এই তিন দিন নির্ধারণে উলামায়ে উম্মতের মাঝেও ইখতিলাফ হয়েছে। ইমাম ইবনু দাকীকিল ঈদ রাহ. বলেন-
واختلف الناس في تعيينها من الشهر اختلافا في تعيين الأحب والأفضل لا غير.
অর্থাৎ এই তিন দিন মাসের কোন্ কোন্ দিন এ ব্যাপারে উলামায়ে উম্মতের মাঝে ইখতিলাফ আছে, এই ইখতিলাফ উত্তম-অনুত্তমের; এর বেশি কিছু নয়। -ইহকামুল আহকাম ২/৩০
ইমাম নববী রাহ. বলেছেন-
ফকীহগণ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় প্রতি মাসে দিন-তারিখ ঠিক করে রোযা রাখতেন- এমন নয়। যেন উক্ত তিন দিনকে এক্ষেত্রে নির্ধারণ করে না নেওয়া হয়। আর سُرَّةُ الشهر -এর হাদীস এবং জামে তিরমিযীর হাদীস দ্বারা আইয়ামে বীয (১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে)-এর রোযা রাখার ফযীলতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। -আলমিনহাজ, শরহে মুসলিম ৮/৪৯
মোটকথা, প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের যদিও বিশেষ ফযীলত রয়েছে, তবে এক্ষেত্রে যেহেতু হাদীসে মাসের অন্য তিন দিনের কথাও রয়েছে, এমনকি কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ করা ছাড়া মাসের যে কোনো তিন দিন রোযা রাখার কথাও বর্ণিত হয়েছে, তাই কোনো মাসে কেউ যদি ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের পরিবর্তে অন্য কোনো তিন দিন রোযা রাখে তবেও উক্ত হাদীসের উপর আমল হয়ে যাবে।
সর্বোপরি কথা হল, আইয়ামে বীযে রোযা রাখা উত্তম; না রাখলে গোনাহ নেই। আর আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা নাজায়েয; রাখলে গোনাহ হবে। অতএব এই দুইটির মাঝে আইয়ামে তাশরীকে রোযা না রাখার বিধানটিই বেশি কঠোর। সুতরাং শরীয়তের উসূল অনুযায়ী আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোতে রোযা না রাখার বিধানেরই প্রাধান্য হবে। তাই ফুকাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসগণ আইয়ামে বীযের রোযার ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলেছেন যে, সব মাসে ১৩, ১৪ ১৫ তারিখ রোযা রাখলেও যিলহজ্বের ক্ষেত্রে হুকুম ভিন্ন। যিলহজ্বের ১৩ তারিখ রোযা রাখা যাবে না; বরং সেই মাসে ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখ, এই তিন দিন রোযা রাখবে।
ইমাম ওলিউদ্দীন ইরাকী রাহ. বলেন-
واعلم: أن قولهم أن أيام البيض هي: الثالث عشر، والرابع عشر، والخامس عشر، يستثنى من إطلاقه: ذو الحجة؛ فإن صوم ثالث عشر حرام.
অর্থাৎ আইয়ামে বীয প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। তবে যিলহজ্বের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কারণ, এর ১৩ তারিখ রোযা রাখা হারাম। -তাহরীরুল ফাতাওয়া ১/৫৫৪
আল্লামা ইবনে হাজার হাইতামী রাহ.-কে ঠিক এই প্রশ্নটিই করা হয় যে, এক ব্যক্তির আইয়ামে বীযের রোযা রাখার অভ্যাস। সে যিলহজ্বের ১৩ তারিখ কী করবে? সে কি উক্ত মাসে এই এক দিনের রোযা ছেড়ে দেবে, নাকি এর পরিবর্তে ১৬ তারিখ রোযা রাখবে? সামনে এই প্রশ্ন ও জবাব তুলে ধরা হল।
(وسئل) نفع الله بعلومه عن صوم ثالث عشر الحجة لمن يعتاد صوم أيام البيض، هل يسقط بفقد يومه أو يصوم السادس عشر عنه كما قاله بعض المتأخرين؟ فهل هو احتياط أو قضاء أو نيابة؟ وكيف يقوم عنه إذا فات محله؟
(فأجاب) بقوله ممن صرح بأنه يصوم السادس عشر عوضا عن الثالث عشر في شهر الحجة العز بن عبد السلام وتبعوه، قالوا : لأن صوم ثالث عشر حرام، فكان السادس عشر عوضا عنه، ووجه ذلك أن بعض البيض فات بعذر، فشرع تداركه توسعة في حصول ثوابه، لتأكد صومها، بل قيل إنها كانت واجبة أول الإسلام، ثم نسخ وجوبها بصوم رمضان، وبقي ندبها متأكدا، وهذا باعتبار الكمال، وإلا فقد صرحوا بأنه يحصل أصل السنة بصوم ثلاثة من الشهر غيرها، والحديث الصحيح عن عائشة رضي الله عنها ্রما كان رسول الله يبالي من أي أيام الشهر يصومهاগ্ধ صريح فيما قلناه، فحينئذ اندفع استبعاد السائل لذلك بقوله وكيف إلخ.
এখানে উক্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ইমাম ইয্ ইবনে আবদুস সালাম রাহ. যিলহজ্ব মাসে ১৩ তারিখের পরিবর্তে ১৬ তারিখ রোযা রাখার কথা বলেছেন এবং এক্ষেত্রে অন্যরাও তাঁর অনুসরণ করেছেন। তারা বলেন, যিলহজ্বের ১৩ তারিখ রোযা রাখা নাজায়েয। অতএব ১৬ তারিখের রোযা এর পরিবর্তে বলে গণ্য হবে। আর তা বলা হচ্ছে কেউ যদি আইয়ামে বীযের রোযা মাসের মাঝামাঝি সেই তারিখগুলোতেই রাখতে চায়- সেক্ষেত্রে। নতুবা মাসের যে কোনো তিন দিন রোযা রাখলেই এর মূল সুন্নত আদায় হয়ে যায়। আমাদের এই কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর এই হাদীস-
ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يبالي من أي أيام الشهر يصومها.
-আলফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাহ আলকুবরা ২/৮৮
আল্লামা মুনাবী রাহ. আইয়ামে বীযের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-
(فصم ثلاث عشرة وأربع عشرة وخمس عشرة) أي صم الثالث عشر من الشهر وتالييه إلا الحجة، فصم منها الرابع عشر وتالييه.
অর্থাৎ হাদীস শরীফে এসেছে, তোমরা মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোযা রাখ। তিনি বলেন, কিন্তু যিলহজ্ব মাসে এই রোযা রাখবে ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখ। -ফয়যুল কাদীর ১/৩৯৫
আরও দেখুন : বিদায়াতুল মুহতাজ ১/৫৯২; তুহফাতুল মুহতাজ ৩/৪৫৬; দালীলুল ফালিহীন ৭/৬৩; মাজমূউ ফাতাওয়া বিন বায ১৫/৩৭৯
খোলাসা কথা হল, কুরআনুল কারীমে উল্লেখিত ‘আলআইয়ামুল মা‘দূদাত’ এবং হাদীস শরীফে বর্ণিত ‘আইয়ামে তাশরীক’ ও ‘আইয়ামে মিনা’- এই তিনটি দ্বারা উদ্দেশ্য একই। যার শেষ দিন হচ্ছে, যিলহজ্বের ১৩ তারিখ। এটি কুরআনুল কারীম, হাদীস শরীফ, উলামায়ে উম্মতের মুজমাআলাইহি ও ঐকমত্যপূর্ণ বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে আইয়ামে তাশরীকে রোযা রাখা না জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে যিলহজ্বের ১৩ তারিখও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তভুর্ক্ত হওয়ার কথা হাদীসের সুস্পষ্ট দলীল এবং উলামায়ে উম্মতের পরিষ্কার ও ঐকমত্যপূর্ণ বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং ১৩ যিলহজ্ব আইয়ামে বীযের রোযা রাখা জায়েয হওয়ার দাবি সুস্পষ্ট হাদীস-সুন্নাহ ও ইজমা বিরোধী কথা।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে হেফাযত করুন এবং সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন।
هذا، وصلى الله تعالى وسلم وبارك على سيدنا ومولانا محمد، خاتم النبيين، وعلى آله وأصحابه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.